নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

অন্নদাতা

০৩ রা জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:২৫

গ্রীষ্মের তীব্র রোদ আর হাঁস-ফাঁস করা গরমে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনির পর হাজরা দাসের মতো দরিদ্র কৃষকরা রাতে বৈদ্যুতিক ফ্যানের বাতাসে একটু আরামে ঘুমাবে সে উপায় নেই, রাতে ওদের রঘুপুর গ্রামে বলতে গেলে বিদ্যুৎ থাকেই না, আধা কি এক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ কখন এসে আবার কখন চলে যায় তা গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ঘুমের ঘোরে টেরও পায় না, হাজরার টিনের ঘর, মাথার কাছের জানালা সারারাত খোলাই থাকে, কিন্তু প্রকৃতি মোটেও সদয় হয় না, গাছের পাতাটিও নড়ে না, সে শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে, সারাদিনের কর্মক্লান্ত শরীর ঘুমিয়ে পড়তেও বেশি সময় নেয় না, রাতের শেষ প্রহরে ঘুম ভেঙে যায় হাজরার, ঘামে ভেজা জবজবে বালিশটা উল্টে আবার মাথা রাখে, সংসার চালানোর দুশ্চিন্তা ভর করে মাথায়; হাজরা রঘুপুর গ্রামের হিন্দু মাহিষ্য সম্প্রদায়ের একজন হতদরিদ্র কৃষক, পঞ্চাশ বছর আগেও হালচাষ করাই ছিল গ্রামের প্রায় সকল মাহিষ্যদের একমাত্র পেশা, দু-একজন শিক্ষিত মানুষ ছোট-খাটো চাকরি বা ব্যবসা করত, স্বাধীনতার পর থেকে অবস্থা বদলাতে শুরু করে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নব্য-শিক্ষিত যুবকেরা শিক্ষকতা কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরিতে ঢুকতে শুরু করে, সেটাও খুব বেশি সংখ্যক নয়, কিন্তু পরের দশকগুলোতে গ্রামে শিক্ষিত ছেলে-মেয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে, অনেকেই চাকরি পেয়ে চলে যায় বিভিন্ন শহরে, আর গত দুই দশকে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কেউ-ই গ্রামে থেকে কৃষিকাজ করতে চায় না, শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত সকলেই শহরমুখী হয়, কেবল স্কুলের শিক্ষকগণ বাধ্য হয়ে গ্রামে থাকে, শহরে গিয়ে সবাই যে খুব বড় চাকরি পায় তাও নয়, শিক্ষিতরা বড় কি মাঝারি মানের সরকারি-বেসরকারি চাকরি পেলেও স্বল্পশিক্ষিতরা নানা ধরনের পণ্যের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে, তবু তারা গ্রামে থেকে কৃষিকাজ করতে চায় না; এখন গ্রামে শুধুমাত্র কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে হাজরার মতো মধ্যবয়সী মানুষেরা, চল্লিশ বছরের নিচে কৃষক আছে মাত্র তিনজন, ত্রিশের নিচে একজনও নেই, অল্প শিক্ষিত তরুণদের এই কৃষি বিমুখতার কারণ-কৃষিকাজে অত্যাধিক পরিশ্রম, উৎপাদন খরচের চেয়ে পণ্যমূল্য কম, বছরের পর কাজ করেও কৃষকদের জীবনযাত্রার মানের ক্রমাগত অবনতি এবং শহরে কম পরিশ্রমে অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনের উচ্চাভিলাস, তরুণদের শহরে গিয়ে কাজ করার এই উচ্চাভিলাসের যৌক্তিক এবং দৃশ্যমান কারণও আছে, কেননা স্বল্পশিক্ষিত যারা শহরে গিয়ে নানা ধরনের পণ্যের দোকানে কাজ করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও কৃষকদের চেয়ে অনেক ভাল, জীবনের দীর্ঘকাল কৃষিকাজ করে মাটির প্রতি টান থাকলেও জীবনযাত্রার মানের ক্রমশ অবনতি হওয়ায় কোনো কৃষকই এখন চায় না যে তার ছেলে কৃষক হোক, স্বল্পশিক্ষিত ছেলেকেও কৃষক বাবা শহরে গিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে, সঙ্গত কারণেই রঘুপুরের মাহিষ্য সম্প্রদায়ে এখন কৃষকের চেয়ে অন্য চাকরি করা মানুষই বেশি, এই যে গ্রামের অধিকাংশ মাহিষ্য তাদের পূর্বপুরুষের পেশা কৃষিকাজ ছেড়ে অন্যকাজ করছে, তবু গ্রামের যে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার আছে তারা অবজ্ঞা করে এখনো মাহিষ্যদের ‘হাইল্যা চাষা’ বলে, কোনো মাহিষ্য বালক বা বালিকা ব্রাহ্মণদের বাড়ির ওপর দিয়ে যাবার সময় বয়সের চপলতায় কদাচিৎ গাছের নিচু ডালের একটা আম বা পেয়ারায় হাত দিলেই ব্রাহ্মণ অথবা ব্রাহ্মণী হাতের কাছে যা পায় তাই নিয়ে তেড়ে আসে আর ‘হাইল্যা চাষার বাচ্চা’ বলে গালি দেয়, অথচ এই ব্রাহ্মণরা এখনো বারোমাস মাহিষ্যদের বাড়িতে পৌরহিত্য করেই সংসার খরচের বড় একটি অংশ সংগ্রহ করে থাকে, এছাড়া সারাবছরই যজমানের গাছের আম-কলা-নারকেল ইত্যাদি চেয়ে নেয়, পৌরহিত্য করে জীবিকা নির্বাহ করার চেয়ে কৃষিকাজ কিংবা ক্ষৌরকর্ম অথবা জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করা যে অধিক সম্মানের, এই সহজ সত্যটি এখনো সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়নি, কৃষকরা না পেয়েছে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা না পেয়েছে সামাজিক প্রতিষ্ঠা; এমনকি মাহিষ্যদের ভেতরেই যেসব শিক্ষিতরা শহরে কিংবা গ্রামে থেকেই চাকরি করে, যারা দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত, যাদের পূর্বপুরুষ হলচাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারাও উঠতে-বসতে নানা কারণে কৃষকদের অপমান-অবহেলা করে, তাদের কাছেও কৃষকরা নিন্ম শ্রেণির এবং নিন্ম বুদ্ধির মানুষ; উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও কৃষকদের পেটের খোরাক-পরার কাপড়ের নূন্যতম চাহিদা এখন মিটছে না, মিটবার কথাও নয়, ধানের মণ প্রতি উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজার মূল্য আড়াইশো-তিনশো টাকা কম, কয়েক বছর যাবৎ এমনই হচ্ছে, তবু কৃষকরা ধান চাষ করে, কিসের নেশায় চাষ করে কে জানে, মানুষ শহরমুখী হওয়ায় কৃষি শ্রমিকের দাম বেশি, ধান কেটে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে নিতে যে খরচ হবে সেই দামে বিক্রি করা যাবে না বলে কোনো কোনো গৃহস্থ এবার ধানক্ষেতে আগুন দিয়েছে, বছর বছর ধানে লোকসান হচ্ছে, পাটে লোকসান হচ্ছে, আর কৃষকরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছেন ক্ষুদ্র ঋণের জালে, এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ কৃষকরা দেখতে পাচ্ছেন না; হাজরার চোখে আর ঘুম আসে না, কেবল এপাশ-ওপাশ করে, কামভাব জাগে তার, অন্ধকারে কর্মক্লান্ত ঘুমন্ত স্ত্রীর শরীর আর মুখের দিকে তাকাতেই রতন মাস্টারের মুখটা মনে পড়ে হঠাৎ, দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে হাজরা আর পারছে না সংসারের ঘানি টানতে, বাধ্য হয়ে স্ত্রী উন্নতি ঝিয়ের কাজ নিয়েছে রতন মাস্টারের বাড়িতে, তাতেও সংসারের অভাব যায় না, দিশেহারা হাজরা, এখন আর কেউ তাকে টাকা ধার দেয় না, জানে হাজরা মানুষটা ভাল কিন্তু টাকা ধার নিলে শোধ দিতে পারবে সহজে, বাজারের দোকানদাররা কেউ তাকে বাকিতে পণ্য দেয় না, অথচ রোজ সকালে ঘুম ভাঙতেই চারটা পেটে একযোগে ক্ষুধা লাগে, তার ওপর কানাঘুষায় শুনেছে, লোকে নাকি বলাবলি করে যে উন্নতি রতন মাস্টারের সাথে শোয়, এই ব্যাপারে সে উন্নতিকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি, কিন্তু তার মনেও ঘুণ ধরেছে, এই যে রতন মাস্টারের বাড়ি থেকে উন্নতি রোজ ভাত কিংবা মাছ-মাংসের ঝোল অথবা দুটো নারকেল বা দু-কেজি পিঁয়াজ এরকম আরো কত কিছু নিয়ে আসে, বিনিময়ে হয়ত রতন মাস্টারের সঙ্গে শোয় উন্নতি, কে জানে হয়ত নগদ টাকাও দেয়, ঘরে বাজার করার টাকা না থাকলে উন্নতি টাকা বের করে দিয়ে জানায় যে তার কাছে ক্ষুদ বা ডিম বেচা কয়টা টাকা ছিল, হাজরার সন্দেহ ক্রমশ দৃঢ় হয়েছে, একে তো রক্ত জল করে ফলানো ফসলের ন্যায্য মূল্য নেই বাজারে, তার ওপর স্ত্রীর চরিত্র্র নিয়ে গ্রামে গুঞ্জন, হাজরার পাগল পাগল লাগে, রতন মাস্টারের মুখটা মনে পড়তেই বিষন্নতার বাতাসে ওর কামভাব উবে যায়, উবে যায় বাঁচার ইচ্ছাও, চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোয়ালের বেড়ায় ঝোলানো বিষের বোতলটি, উঠে ঘুমন্ত স্ত্রীর পায়ের কাছ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বাইরে যায়, ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে জামগাছের নিচে গিয়ে লুঙ্গি তুলে বসে প্রসাব করে ঘরে এসে বিড়ি আর ম্যাচটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে বিড়ি টানতে থাকে, তার মনে হয় সে সংসার চালাতে অক্ষম এক পুরুষ, তার অক্ষমতার কারণেই উন্নতি শরীরের বিনিময়ে বাড়তি রোজগার করে সংসারের অভাব দূর করার চেষ্টা করছে, ছিঃ, টিভিতে ভদ্রেলোকেরা বলে-দেশ বাঁচাতে হলে অন্নদাতা কৃষককে বাঁচাতে হবে, দেশে নাকি ঘরবাড়ি-কারখানার চাপে ফসলের জমি কমছে, হরিশের দোকানে কারখানায় তৈরি যেসব বিস্কুট-নুডুলস পাওয়া যায় তার গমটা কোথায় পাবে আর ভবিষ্যতে মানুষ কী খেয়ে বাঁচবে কে জানে, মরুকগে মানুষ, দুঃখ এই যে উন্নতি…আজ রতন মাস্টারের সঙ্গে…, কাল আরেকজন, পরশু…., আর ভাবতে পারে না হাজরা, হাতের জলন্ত বিড়িটা ঠেসে ধরে বারান্দার মেঝেতে, উঠোনে ছুড়ে ফেলে ক্রদ্ধস্বরে বলে-‘শুয়োরের বাচ্চারা দ্যাশ চালায়…, চ্যাটের অন্নদাতা, চ্যাটের জীবন’।




রচনাকাল: ২০১৯।


মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: কৃষকদের কথা কেউ ভাবে না।
শহরে বিদ্যুৎ না গেলে গ্রাম দেশে বিদ্যুৎ এর খুব করুন অবস্থা।

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:১৮

মিশু মিলন বলেছেন: একদম ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ।

২| ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:১৫

আহমেদ জী এস বলেছেন: মিশু মিলন,




গল্পের ফাঁকে বর্তমান গ্রামীন বাস্তবতা। সুন্দর লিখেছেন।
গল্পটিতে প্যারা নেই। প্যারা করে দিলে ভালো হোত।

০৭ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১:৪০

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
পরিকল্পনা মতো গল্পটিতে এক হাজার শব্দের একটি বাক্য এবং একটি সংলাপ ব্যবহার করেছি, সচেতনভাবেই করেই প্যারা রাখিনি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.