নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

লৌকিক লোকলীলা (উপন্যাস: পর্ব-তিন)

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৫৪

দুই

মাঠের শেষ প্রান্তের আলপথ ছেড়ে ওরা একটা পুকুরের পাড়ে উঠে পূর্বদিকে এগোয়, পরিমল অতিক্রম করে গেলেও কড়ইগাছের তলায় বাঁশের চটার বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে অমল। অমলের পিছনে বিলাসও দাঁড়ায়, বলে, ‘এইডে মহি মৌয়ালের কবর।’

অমল লেখাপড়ার জন্য যখন ঢাকায় ছিল, তখন মহি মৌয়াল মারা যান, বিলাসের ধারণা অমল হয়ত জ্ঞাত নয় যে এটা কার কবর, কিন্তু বিলাসের ধারণা ভুল প্রমাণ করে অমল বলে, ‘জানি।’

অন্ধকারাচ্ছন্ন কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে অমল। পরিমল কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল, কয়েক পা পিছিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘দাঁড়ালি ক্যা?’

তারপর দুষ্টুমি করে আবার বলে, ‘নাকি এইডেই….!’

‘ধুরো!’ বলেই বিলাস অমলকে অতিক্রম করতে করতে সতর্ক করে বলে, ‘মোছলমানের কবর, ছুঁসনে কিন্তু!’

অমল মুখে কিছু না বললেও ওর ভাবনার সরোবরে বুদ্বুদ ওঠে- কঙ্কালের আবার জাত কী! যদি পৃথিবীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে, অতীতের মতো আবার ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় পৃথিবী, হাজার কী লক্ষ বছর পরে আজকের মানুষের উত্তর প্রজন্মের কাছে যদি মহি মৌয়ালের এই কবরটি আবিষ্কৃত হয়; তখন কি তারা জানবে যে- এটা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নাকি মুসলমানের কবর? তখন কি থাকবে আজকের দিনের এতসব ধর্ম, লোকাচার, লোকসংস্কৃতি?

‘চল চল।’

ফিসফিসিয়ে অমলের উদ্দেশে শব্দ দুটো নিক্ষেপ করেই পা চালায় বিলাস, পরিমলও। ওদের দুজনকে অনুসরণ করে আবার হাঁটতে শুরু করে অমল। বেশ বড় আকারের একটা মাছ ঘাই মারে পুকুরের জলে, হয়ত রুই কিংবা কাতলা। দশ বছর আগে মারা যাওয়া মহি মৌয়াল ওদের তিনজনের স্মৃতির জনপদে হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে- দাড়ি-গোঁফ কামানো ছিপছিপে গড়নের শ্যামবর্ণ প্রৌঢ়, গায়ে কালি-ঝুলি মাখা ফুলহাতা জামা, পরনে মলিন লুঙ্গি, পায়ে প্লাস্টিকের কালো জুতো, কাঁধের বাঁকের একদিকে মধু রাখার সিলভারের ডেকচি আর আরেকদিকে খর ও আশশেওড়া কিংবা ভাঁটগাছ-পাতা দিয়ে বানানো কারু, কোমরে সুতলি দিয়ে বাঁধা একটি ছোট্ট কাঁচের বোতল এবং হাতে চকচকে ধারালো দা!

মহিউদ্দিন হোসেন, তিনি মুলত বর্গাচাষী, চাষাবাদের পাশাপাশি মৌয়ালের কাজও করতেন, ফলে এই অঞ্চলের বহু গ্রামের মানুষ তাকে চিনত মহি মৌয়াল নামে। শরৎ-হেমন্তকালে দক্ষিণের সুন্দরবন থেকে ঝাঁক ঝাঁক মৌমাছি এসে এইসব অঞ্চলের মানুষের বসতবাড়ি কিংবা রাস্তা-ঘাটের গাছে, এমনকি কোথাও কোথাও দালানের কার্নিশে আর টিনের ঘরের বারান্দার বাঁশ অথবা কাঠের আড়েও চাক বানায়। শরৎ-হেমন্তের ফুল, শীতকালের মাঠভরা নানা জাতের রবিশস্যের ফুল আর আমের মুকুল এবং বসন্ত-গ্রীষ্মের বিভিন্ন প্রকার ফুলের মধুর লোভেই মৌমাছিরা এই অঞ্চলে এসে অস্থায়ী বসতি গড়ে, আবার চলে যায় বর্ষার আগে। তবে বর্ষায়ও কিছু কিছু মৌচাকে মৌমাছি থেকে যায়, পুরনো চাক ছেড়ে আবার নতুন করে চাক বানায়, তারা আর সুন্দরবনে ফেরে না, কোন অভিমানে কে জানে!
মহি মৌয়াল এই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামের মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করতেন; গৃহস্থবাড়ির মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে সংগৃহীত মধু দুই ভাগ করে অর্ধেক গৃহস্থকে দিতেন আর বাকি অর্ধেক তিনি নিতেন, তবে সরকারী রাস্তা কিংবা রেললাইনের ধারের গাছের মধু সংগ্রহ করলে কাউকে ভাগ দিতে হতো না। মৌচাক ভাঙার আগে তিনি পরনের লুঙ্গি কাছা মেরে মুখে-মাথায় গামছা জড়িয়ে নিতেন, কোমর থেকে কাঁচের বোতলটা হাতে নিয়ে জল ভরে কপালে-বুকে ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পাঠ করতেন-
‘মাছি বন্ধম মাইছানী বন্ধম
বন্ধম দেবীর পাও,
রামের হুংকারে মাছি
চাক ছাড়িয়া যাও।
চাক ছাড়িয়া মাছি
রইয়া কর খাও,
দোহাই আল্লাহ’র
ত্রিশ কোটি দেবতার মাথা খাও।’

মন্ত্র শেষ হলে বোতলের পড়া-পানি একটুখানি ডানহাতে ঢেলে কারু, দা, ডেকচি এবং গাছের গুঁড়িতে ছিটিয়ে বোতলটি পুনরায় কোমরে বেঁধে রাখতেন। তারপর গাছের কাছে গিয়ে পুনরায় মন্ত্র পড়তেন-
‘ওরানী ঘুরানী কামাক্ষ্যা
কামরূপীর মাথা খা,
আমার বন্ধুর বাড়িতে
চাকের মাছি সমস্ত
উইড়া চইলা যা।’

পর পর তিনবার এই মন্ত্র পাঠ করে নিজের শরীরে তিনটি ফুঁ দিয়ে শরীর বন্ধ করতেন মহি মৌয়াল, যাতে তাকে মৌমাছি না কামড়ায়। আরো একবার মন্ত্র পাঠ করে গাছের গায়ে তিনটি ফুঁ এবং তিনটি চাপড় মারতেন। তারপর গাছে উঠে কারুতে আগুন ধরাতেন, মৌচাকের কাছে গিয়ে বোতলের জল হাতে নিয়ে মৌচাকে ছিটিয়ে মাছি বন্ধ করতেন। এরপর কারু দিয়ে মৌচাকে ধোঁয়া দিতেন, ধোঁয়া পেলেই মৌমাছিরা মৌচাক ছেড়ে উদভ্রান্তের মতো উড়াউড়ি করত কিংবা কিছুটা দূরে গিয়ে একই গাছ অথবা অন্য গাছের শাখায়-পাতায় বসত, আগুনের উত্তাপে কিছু মৌমাছি আহত হতো এবং কিছু আধপোড়া হয়ে মারাও যেত। মৌচাকের যে অংশে মধু থাকত কারু দিয়ে সেই অংশ থেকে মৌমাছি তাড়িয়ে দা দিয়ে মধু কেটে নিয়ে নিচে নামতেন মহি মৌয়াল। তার এই কর্মযজ্ঞের সময় একটা মৌমাছিও কোনো মানুষ কিংবা গৃহপালিত পশুকে কামড়াত না, তাই মানুষ ভাবত এটা মহি মৌয়ালের মন্ত্রের গুণ, আর মহি মৌয়ালও তেমনটাই বিশ্বাস এবং প্রচার করতেন! মানুষের এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছিল এই জন্য যে যখন কোনো মৌচাকে বাঁজপাখি ছোঁ মারত মধুর লোভে কিংবা কোনো দুষ্টু ছেলে খেয়ালের বশে ঢিল ছুড়ত, তখন মৌমাছির ঝাঁক ক্ষিপ্ত হয়ে মানুষ-গরু-ছাগল যাকেই নাগালের মধ্যে পেত তাকেই কামড়াত। মৌমাছির কামড়ে অনেকেরই চোখ-মুখ কিংবা শরীরের নানা স্থান ফুলে যেত, কারো কারো জ্বর আসত। তাছাড়া এই অঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতায় বাঁজপাখি ছোঁ মারার কারণে মৌমাছির কামড়ে ছাগল কিংবা ছোট বাছুর মারা যাবার মতো দৃষ্টান্ত কম হলেও একেবারে বিরল ছিল না। এসব কারণেই মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মৌচাক কাটার সময় মহি মৌয়ালের মন্ত্রের গুণেই মৌমাছিরা কাউকে কামড় দেয় না। ফলে মৌমাছিরা মানুষের বাড়িতে মৌচাক বানালে এবং মৌচাকে মধু হলে তারা মহি মৌয়ালকে খবর দিত, খবর না দিলেও মহি মৌয়াল নিজেই বাঁক কাঁধে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন মৌচাকের সন্ধানে।

একবার অমলদের গ্রামের সুধীর মাস্টারের বাড়ির আমগাছের মৌচাক কাটার সময় মহি মৌয়াল জলের বোতলটি হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পাঠ করছিলেন; এলাকায় নতুন আগত জয়ন্ত নামের সাতাশ-আটাশ বছরের এক তরুণ ফেরিওয়ালা তখন এসেছিল সিলভারের ডেকচি, গামলা, জগ ইত্যাদি বেচতে আর পুরোনো সিলভারের ভাঙারি কিনতে। মহি মৌয়ালের মন্ত্র পাঠের ধরণ দেখে কৌতুহলী হয়ে সিলভারের ডেকচি-গামলার বাঁক কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে এগিয়ে গিয়ে জয়ন্ত যখন অন্য লোকের মুখ থেকে জানতে পারে যে মৌচাক থেকে মধু কেটে আনার জন্য মহি মৌয়াল মন্ত্র পাঠ করছে মৌমাছির হুল বন্ধ করার জন্য যাতে মৌমাছি মানুষকে কামড়াতে না পারে; তখন সে আচমকা হো হো শব্দ করে হেসে ওঠে আর তখনই তার দৃষ্টিতে পড়ে একটু দূরে মাটিতে পড়ে থাকা বাঁক, ডেকচি, দা, কারু। জয়ন্ত’র হাসি দেখে কেউ অবাক হয়ে, কেউবা বিরক্ত হয়ে তাকায় তার দিকে। মন্ত্র পড়া জল কারু, দা, ডেকচিতে ছিটানো শেষ হলে মহি মৌয়াল বিরক্ত হয়ে চোখ কটমট করে জয়ন্ত’র দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘হাসির কী অলো? বেয়াক্কেলের মতোন হাসতেছ ক্যা?’

হাসির দমক কমিয়ে জয়ন্ত বলে, ‘চাক থেকে মধু ভাঙতি বুঝি মন্তর-তন্তর লাগে কাকা?’
‘মন্তর-তন্তর ছাড়া চাক ভাঙা যায়? ওস্তাদের দয়া আর দুয়ায় করে খাতেছি, এসব গুরুবিদ্যা, তুমি বুঝবা না।’
জয়ন্ত আবার হেসে বলে, ‘ক্যান মানুষরে মিথ্যে ভুংভাং বোঝাও কাকা? চাক ভাঙতি মন্তর-তন্তর লাগে না।’

আঁতে ঘা লাগে গুরুবিদ্যা জানা মহি মৌয়ালের, ওস্তাদ নিজাম শেখের নামে সালাম দিয়ে রেগে গিয়ে বলেন, ‘বাপের জন্মে কোনোদিন চাক ভাঙিচ! এ কী তুমার ডেকচি-পাতিল বেচা পাইচ!’

‘আমি যদি মন্তর-তন্তর ছাড়া চাক থেকে মধু ভাঙতি পারি তাহলি কী হবি বল দিকি কাকা?’
‘কী অবি তা পরের কতা, জীবন নিয়ে ফিরে যাবার পারবা না। নিজে মরবা আবার মানুষ-গরু-ছাগলও মারবা।’
‘যদি পারি তাহলি কী হবি তাই বল দিকি আগে?’

রাগে হুঙ্কার ছেড়ে মহি মৌয়াল বলেন, ‘আমার ওস্তাদের কসম যদি চাক কাটপার পারো আর মৌমাছি যদি এট্টা কামড়ও কাউরে না দেয়, তালি জীবনে আর মৌচাকে হাত দেব না।’

দুজনের কথা কাটাকাটিতে উপস্থিত মানুষ মজা পেয়ে যায়, কেউ কেউ মজা দেখতে জয়ন্তকে উসকে দেয়, কিন্তু সুধীর মাস্টার তখন গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘যম নিয়ে বাজাবাজি কোরো না তোমরা। যে যা পারো না তা করবার যাইয়ো না।’

বাঁকা চোখে তাকিয়ে মহি মৌয়াল বলেন, ‘বাপের নাম ভুলো দিবেনে, এর নাম মৌমাছি!’
জয়ন্ত লুঙ্গি কাছা মারে, কোমরের গামছা খুলে হিজাবের মতো করে বেঁধে নেয় মুখে-মাথায়।
সুধীর মাস্টার ধমকান, ‘এই ছ্যামড়া এক পা আগাবা না, যা পারো না তা নিয়ে বাজাবাজি করবা না।’

জয়ন্ত সুধীর মাস্টারকে আশ্বস্ত করতে বলে, ‘আপনি চিন্তা করবেন না কাকা। আপনারা ওই বারান্দায় যায়ে বসেন, কেউ হাঁটাচলা করবেন না, দৌড় দেবেন না। আমার ওপর ভরসা রাখেন।’

কাউকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা কারু, ডেকচি আর দা নিয়ে যে আমগাছে মৌচাক পড়েছে সেদিকে এগিয়ে যায় জয়ন্ত; মুহূর্তের মধ্যে আমগাছে উঠে পকেট থেকে ম্যাচলাইট বের করে কারুর মাথায় আগুন ধরিয়ে মৌচাকের দিকে এগিয়ে যায়, বিস্মিত-উদ্বিগ্ন চোখে উঠোনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকেন মহি মৌয়াল। উপস্থিত জনতার কেউ কেউ ভয়ে সুধীর মাস্টারের শোবার ঘর আর কাছাড়ি ঘরে গিয়ে ঢোকে, কেউবা বারান্দায় উঠে দুরু দুরু বুকে অথচ কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে থাকে জয়ন্ত’র দিকে। জয়ন্ত কারুর আগুন নিভিয়ে কেবল ধোঁয়া সৃষ্টি করে যাতে মৌমাছি আগুনে পুড়ে মরে না যায়, ধোঁয়া দিয়ে মৌচাক থেকে মৌমাছি তাড়ায়, গুঞ্জন তুলে কিছু মৌমাছি উড়তে থাকে আর কিছু গাছের পাতায় গিয়ে বসে। জয়ন্ত মধু কেটে ডেকচিতে ভরে নিরাপদে নিচে নেমে আসে, একটা মৌমাছিও না তাকে, না অন্য কোনো মানুষ কিংবা গরু-ছাগলকে কামড়ায়। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে এলোমেলো উড়তে থাকা কিংবা গাছের শাখায়-পাতায় বসে থাকা মৌমাছিরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মৌচাকে ফিরতে শুরু করে। মহি মৌয়াল নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে পারেন না, অথচ তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়, অর্ধেকেরও কম বয়সী এক যুবকের কাছে বাজিতে পরাজিত হয়ে অপমানে-লজ্জায় চোখে জল চলে আসে তার। এ কী করে সম্ভব! কোনো মন্ত্র ছাড়া মৌচাক থেকে মধু ভাঙা যায়? অথচ এতকাল তিনি মন্ত্রপড়া জল ছিটিয়ে মৌমাছির হুল বন্ধ দিয়ে মৌচাক থেকে মধু ভেঙেছেন! কখনও কখনও দু-একটা কামড় নিজে খেয়েছেন, কিন্তু অন্য মানুষ কিংবা গরু-ছাগলকে কামড়ায়নি মৌমাছি। সে তো মন্ত্রের গুণেই, মন্ত্রই তো বশে রাখত হাজার হাজার মৌমাছিকে! এতদিন তাই জেনেছেন তিনি, তার ওস্তাদ নিজাম শেখও এমনিভাবেই মন্ত্র পড়ে জল ছিটিয়ে মৌমাছির হুল বন্ধ দিয়ে মৌচাক থেকে মধু ভাঙতেন। অনেকদিন পিছন পিছন ঘুরঘুর করে, অনেক হাতে-পায়ে ধরে তবে তিনি নিজাম শেখের কাছ থেকে মৌচাক থেকে মধু ভাঙার মন্ত্র শিখেছেন; সেই গুরুবিদ্যার ওপর বিশ্বাস রেখেই এতদিন তিনি মৌচাক থেকে মধু ভেঙেছেন। অথচ জয়ন্ত কোনো মন্ত্র ছাড়াই মৌচাক থেকে মধু ভেঙে আনলো! তবে কি তার শেখা মন্ত্র মিথ্যা? কিন্তু গুরুবিদ্যা মিথ্যা হয় কী করে!

মহি মৌয়াল আর ভাবতে পারেন না, তার এতদিনের লালিত বিশ্বাসের ঘরে জয়ন্ত আজ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, সেই আগুনের আঁচে উদভ্রান্ত তিনি। এলাকায় মহি মৌয়াল এবং তার মধুর সুনাম আছে, এই এলাকায় আরো যারা মৌয়াল আছে তারা সবাই মধুতে চিনির সিরা মেশায়, কিন্তু মহি মৌয়াল এই কাজ কখনো করে না, তার মধু এক নম্বর, এজন্য তার মধুর দামও অন্যদের চেয়ে কমপক্ষে একশো টাকা বেশি। এলাকার মানুষ বিশ্বাস করে যে মহি মৌয়াল খাঁটি মানুষ, তার মধুও খাঁটি। অথচ এলাকার মানুষ আজ থেকে জানবে যে মহি মৌয়ালের চাক ভাঙার মন্ত্র মিথ্যে! তার মনে এই শঙ্কা জাগে যে যখন এলাকায় জয়ন্ত’র মন্ত্র ছাড়া মধু ভাঙার খবর চাউর হয়ে যাবে, তখন সবাই বলবে- মহি মৌয়ালের জারিজুরির গুমর ফাঁস হয়ে গেছে! সবাই হয়ত তাকে মিথ্যাবাদী ভণ্ড বলবে! তার বড় অসহায় লাগে, কান্না পায়।

জয়ন্ত মধুর ডেকচি মহি মৌয়ালের সামনে নামিয়ে রেখে বলে, ‘এই ন্যাও কাকা তোমার মধু। এবার বিশ্বাস হলো তো যে মন্তর-তন্তর ছাড়া মৌচাক ভাঙা যায়?’

এতক্ষণ যারা ভয়ে ঘরে লুকিয়ে ছিল, কোনো অঘটন ঘটেনি দেখে তারা বাইরে বেরিয়ে আসে; জয়ন্ত, মহি মৌয়াল আর মধুর ডেকচি ঘিরে দাঁড়ায়।

অসহায় আর্দ্র দুটি চোখে ডেকচির মধুর দিকে তাকান মহি মৌয়াল, তিনি দেখেই বুঝতে পারেন নিখুঁত ভাবে কাটা, কেবল মধুর অংশটুকুই কেটে এনেছে জয়ন্ত, আনাড়ির মতো মৌমাছির বাচ্চা নষ্ট করেনি। এবার জয়ন্ত’র দিকে তাকান তিনি, দু-দিকে মাথা নাড়েন, তারপর হাঁটতে শুরু করতেই জয়ন্ত দ্রুত তার কাছে গিয়ে হাত ধরে থামায়, ‘কই যাচ্ছো কাকা? দোহাই লাগে তোমার, আমার ওপর রাগ কোরো না। তোমারে আমি কষ্ট দিতি চাইনি, তুমি বাপ তুলে কথা বললে দেখে আমার জেদ চাইপে গেল।’

মহি মৌয়াল জয়ন্ত’র মুখের দিকে তাকান, শেষবারের মতো তার ভেঙে যাওয়া বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে ডানহাতে জয়ন্ত’র বামহাতের কব্জি ধরে আশান্বিত চোখে বলেন, ‘তুমার জন্মদাত্রী মায়ের কসম লাগে, সত্যি করে কও তো, তুমি কোনো মন্তর-তন্তর জানো না? মনে মনে কোনো মন্তর পড়ো নাই?’

‘আমি তোমারে ক্যান মিথ্যে কতা কবো কাকা! মা’র কিরে করে কচ্চি, আমি কোনো মন্তর-তন্তর জানিনে। তুমি তো জানো না কাকা, মৌয়ালের রক্ত আমার গায়ে। আমার পূর্বপুরুষেরা সুন্দরবন থেকে মধু ভাঙে সংসার চালাত। আমিও অনেকদিন মৌয়ালের কাম করছি। শোনো কাকা, সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসতেছি সুন্দরবনের যারা মৌয়াল-বাওয়ালি-জেলে, তারা হিন্দু-মুসলমান সকলেই বনবিবির পুজো করে। কেন? যাতে বনবিবির আশির্বাদে মানুষ বিপদ থেকে রক্ষা পায়, বাঘ-কুমিরের প্যাটে না যায়। আমাদের বাড়িতেও বনবিবির পুজো হতো, কিন্তু তাতেও কী শেষ রক্ষা হইছে? আমার ঠাকুরদা বাঘের প্যাটে গেছে মৌচাক ভাংতি গিয়ে। তবু বাড়িতে বনবিবির পুজো হতো। বাবাও দু-বার বাঘের মুখ থেকে বাঁচে ফিরিছে। সকলে কইতো বনবিবিই তারে বাঘের মুখ থেকে ফিরায়ে আনিছে। আমিও তাই বিশ্বাস করতাম। বনবিবিরে খুশি করতি বাড়িতে পুজো হতো, পাঁচালী পড়া হতো, আমরা গান গাইতাম-
কাঙালেরও মাতা তুমি বিপদনাশিনী
আমার দুঃখেরও মাঝে তরাবে আপনি
বনবিবি গো
ও বনবিবি গো।।
বনবিবি মাগো তোমার ভরসাতে এলাম
দুধে-ভাতে থাকব সুখে সেলাম দিলাম
যেন বাঘে ছুঁয়ে না
যেন বাঘে ছুঁয়ে না।।

কিন্তু বনবিবি কী আমাগের বিপদ নাশ করিছে? আমি আর আমার ছোট ভাই জঙ্গলে মধু ভাঙতি যাতাম। দু-বছর আগে আমার চোখের সামনে থেকে ভাইটারে বাঘে নিল, না বনবিবির ভাই শাহজাঙ্গলি তারে বাঁচাতি পারল, না বনবিবি। সেই থেকে কিরে কাটিছি আর মধু ভাঙতি যাব না। তা কিছু একটা করে তো খাতি অবি, তাই তুমাগের এলাকায় আসে এই সিলভারের ডেকচি-পাতিল ফেরি করে খাচ্ছি। আমাগের এলাকাতেও অনেক মন্ত্রর-তন্তর চালু আছে, মধু ভাঙা মন্তর, যাতে বাঘের প্যাটে না যায় সেই মন্তর; অনেকেই তা বিশ্বাস করে, কিন্তু ওতে কিছু অয় না কাকা। ধোঁয়া কম দিলে সুযোগ পেলে মৌমাছিতেও কামড়ায়, আবার বাগে পালি বাঘেও ধরে নিয়ে যায়। তবু মানুষ পুরনোকালের উপকথা বিশ্বাস করে, রীতি-সংস্কৃতি পালন করে। তুমি রাগ কোরো না কাকা, তোমার কিরে আমি তুলে নিলাম।’
‘তুমার উপর আমার কোনো রাগ নাই ভাস্তে, রাগ আমার নিজের উপর, এতকালের মিথ্যে বিশ্বেসের ওপর, আমি এক বাপের জন্ম, কসম যা কাটিচি তা কাটিচি-ই, আমি আর কোনোদিন চাক ভাঙবো না!’

আর দাঁড়ান না মহি মৌয়াল; মধুর ডেকচি, কারু আর দা ফেলেই চলে যান।

পরিমল, অমল আর বিলাস তখন কিশোর; স্কুল থেকে ফেরার পথে তারাও কৌতুহলী হয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল এই ঘটনা, আজ এতদিন পর সেই ঘটনা যেন পুনরায় জীবন্ত হয়ে ওঠে ওদের স্মৃতিতে। সেই ঘটনার পর মহি মৌয়াল যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কখনোই মৌচাক থেকে মধু ভাঙেন নি।


(চলবে......)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:১০

রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম।

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:২৭

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:১২

নেওয়াজ আলি বলেছেন: ভালো লাগলো।

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:২৮

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:৫৬

মনিরা সুলতানা বলেছেন: এইটাই কি শুরু ?

২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:৪৬

মিশু মিলন বলেছেন: না, এটা তৃতীয় পর্ব। এর আগে আরো দুই পর্ব আছে দেখুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.