নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

লৌকিক লোকলীলা (উপন্যাস: পর্ব-ছয়)

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:২২

চার

অতুলদের বাড়ি অতিক্রম করে কিছুদূর এগিয়ে ওরা তিনজন ডানদিকের একটা সরু পথ ধরে, পথের ডান দিকে একটা পুরোনো পোড়ো বাড়ি, লোকে বলে জর্জবাড়ি, বাড়িটার দেয়ালের নানা জায়গা থেকে ইট খসে পড়েছে, দেয়াল ফুঁড়ে বট-অশ্বত্থ গাছ বেড়িয়েছে আর বেয়ে উঠেছে লতা-পাতা, কক্ষগুলোর ভেতরে ময়লা-আবর্জনা। জর্জ পরিবার তাদের এই বাড়ি এবং অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতে চলে গেছে, যারা কিনেছে তারা এই বাড়িটি ভাঙেনি, বাড়িটার দক্ষিণে যে বিস্তৃত খালি জায়গা ছিল, সেখানে নতুন ঘর তুলে থাকে তারা।
সরু পথটা খেলার মাঠের দক্ষিণ পাশ দিয়ে চলে গেছে চন্দনা নদীর দিকে, চন্দনা নদীর ওপর সাঁকো আছে, সাঁকো পেরোলেই পাকা রাস্তা-বাসস্ট্যান্ড, ওরা সাধারণত এই পথেই চলাচল করে; কিন্তু এখন ওদের উদ্দেশ্য ভিন্ন, তাই জর্জবাড়ির সামনে থেকেই উত্তরদিকে অপেক্ষাকৃত যে বড় কাঁচা রাস্তাটি চলে গেছে ওরা সে-পথেই পা বাড়ায়।

কিছুদূর যাবার পর রাস্তার ডানদিকে অনেকটা নিচু ভূমিতে অশ্বত্থ গাছের তলায় অবস্থিত মন্দিরের কাছে এসে ক্ষণিকের জন্য ওরা থেমে ডানহাত কপালে ছুঁইয়ে প্রণাম করে। মন্দিরে কালী এবং বিপত্তারিনী দেবীর পূজা হয়, চৈত্রমাসে রক্ষাকালী পূজা আর আষাঢ় মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বিপত্তারিণী পূজা হয়। চৈত্র থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত কালী মূর্তি মন্দিরে থাকে, আষাঢ় মাসে বিপত্তারিণীর মূর্তি গড়ার সময় কালী মূর্তি মন্দির থেকে বের করে মন্দিরের পূর্বপাশের খোলা জায়গায় রাখা হয়, আবার চৈত্রমাসে মন্দিরে কালী মূর্তি গড়ার সময় খোলা জায়গায় রাখা আগের বছরের পুরোনো কালীমূর্তি চন্দনা নদীতে বিসর্জন দিয়ে একই জায়গায় রাখা হয় বিপত্তারিণী মূর্তি; এমনিভাবে পালাবদল করে চলে দুই দেবীর পূজা। এলাকার প্রায় সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ বিশ্বাস করে যে, এই মন্দিরের বিপত্তারিণী দেবী বড় জাগ্রত! এই অঞ্চলে বিপত্তারিণী দেবীর পূজার চল খুব বেশিদিনের নয়, অথবা অতীতে পূজা হলেও মাঝে দীর্ঘ ছেদ পড়ায় অনেকেই জানত না বিপত্তারিণী পূজার কথা। বিশ-বাইশ বছর আগের কথা, অমলরা যখন বালক তখন এই মন্দিরে বিপত্তারিণী দেবীর পূজা শুরু হয়, তারপর অমলদের গ্রামে এবং আশপাশের আরো অনেক গ্রামে বিপত্তারিণী পূজার ধুম লেগে যায়! এই গ্রামের বিনোদ চক্রবর্তী, মূলত যজমানি অর্থাৎ গৃহস্থবাড়িতে পূজা করাই ছিল তার পেশা, আর কিছু জমিজমা ছিল মাঠে, সে-সব তার বাপ-ঠাকুরদার আমলে যজমানদের দান করা জমি। আগে মানুষ মারা গেলে শ্রাদ্ধ-শান্তিতে ষোল দানের মধ্যে ভূমি দানেরও প্রচলন ছিল, সেই সূত্রেই ওইসব জমি দান হিসেবে পেয়েছিলেন বিনোদ চক্রবর্তীর ঠাকুরদা এবং বাবা। আগে এই অঞ্চলে এখনকার মতো এত মানুষ ছিল না, গৃহস্থের অনেক জমি ছিল, অনেক জমি পতিত পড়েও থাকত। সেইসব জমি থেকেই অবস্থাপন্ন গৃহস্থরা পিতা-মাতার শ্রাদ্ধকার্য উপলক্ষে সামান্য হলেও ভূমি দান করত পারিবারিক পুরোহিতকে। বিনোদ চক্রবর্তীর বাবার জীবদ্দশাতেই শ্রাদ্ধ-শান্তিতে পুরোহিতকে ভূমি দানের প্রচলন কমতে শুরু করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এইসব এলাকায় জমির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায়, পরিবারের লোকসংখ্যা বেড়ে এবং পরিবার ভেঙে গিয়ে নতুন নতুন বাড়ি গড়ে ওঠে, জঙ্গল পরিষ্কার করে মানুষ ফসল উৎপাদন কিংবা গাছের বাগান করতে শুরু করে, পতিত জমি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে গৃহস্থরা একটা সময় থেকে ভূমি দানের পরিবর্তে ভূমির দাম বাবদ সামান্য কিছু টাকা দান করতে শুরু করে পুরোহিতদের।

পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ওই জমি কামলা খাটিয়ে চাষ আর যজমানি করে বেশ সংসার চলে যেত বিনোদ চক্রবর্তীর, স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে ছিল তার সংসার, স্ত্রী ললিতা চক্রবর্তীকে নিয়ে প্রায়শই তীর্থে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তো যেতেনই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও গয়া, কাশী, বৃন্দাবন, অযোধ্যা, পুরী প্রভৃতি স্থানে তীর্থ করতে যেতেন। ফলে তার প্রতি মানুষের একটা শ্রদ্ধাভাব ছিল।

বিনোদ চক্রবর্তী একবার তীর্থ করে মাসখানেক পর গ্রামে এসে শোনেন যে তাদের পাড়ার রবি রায়ের যুবক ছেলেটি মোটর সাইকেল অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে, বছর চল্লিশের মৃগীরোগী গোবিন্দ’র মৃত্যু হয়েছে চন্দনা নদীর জলে ডুবে আর তার লাশ পাওয়া যায় কয়েক কিলোমিটার দূরে ভাটির দিকে, অশোক নন্দীর জামালপুর বাজারে যে পাটের গুদাম ছিল তা আগুনে পুড়ে গেছে। এই তিনটি পরিবারই বিনোদ চক্রবর্তীর যজমান, তিনি এদের বাড়িতে গিয়ে প্রথমে সমবেদনা জানান, তারপর এই তিনটি পরিবারসহ পাড়ার অন্যান্যদের পরামর্শ দেন বিপত্তারিণী দেবীর পূজা করার। বিপত্তারিণী দেবীর নাম শুনে কারো কারো চোখ কপালে ওঠে, তারা কেউ এই দেবীর নামই শোনেনি! বিপত্তারিণী মূলত অখণ্ড বঙ্গ, ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডের কিছু অঞ্চলের পূজিত দেবী; বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিপত্তারিণী পূজা বেশি হয়, বাংলাদেশে বিপত্তারিণী পূজার প্রচলন কম হওয়ায় অনেকেই বিপত্তারিণী দেবীর নাম জানে না। নানা জায়গায় তীর্থ করে বেড়াতেন বলেই বিনোদ চক্রবর্তী বিপত্তারিণী দেবীর সম্পর্কে জানতে পারেন আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূজা পদ্ধতিও শিখে আসেন। সে-বার পাড়ায় এসে অকালমৃত্যু এবং গুদাম পুড়ে যাওয়া জনিত কারণে বিপত্তারিণী পূজার প্রচলনের মোক্ষম সুযোগটিও পেয়ে যান বিনোদ, তিনি সকলকে বোঝান যে গ্রামে বিপদের আঁচ লেগেছে, এ থেকে রক্ষার উপায় মা বিপত্তারিণীর পূজা করা। কিন্তু কে এই বিপত্তারিণী? আর কী তার মাহাত্ম্য? বিনোদ বিপত্তারিণীর মাহাত্ম্য শোনান সকলকে-‘বহুকাল আগের কথা, মল্লরাজ্যে, মানে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে এক রাজা ছিলেন। সেই রাজার রানি ছিলেন খুব উদার, নিন্মবর্ণের মহিলাদের সাথেও তার ভাব ছিল, নিন্মবর্ণের মহিলারা যে-কোনো ব্যাপারে যখন-তখন রানির কাছে আসত। রানির এক সখী ছিল একজন মুচিনী, তাদের গরুর মাংস খাবার অভ্যাস ছিল, রানি কোনোদিন রান্না করা গরুর মাংস দ্যাখেননি, তাই একদিন মুচিনীর কাছে রান্না করা গরুর মাংস দেখার আবদার করেন। রানির কথা শুনে ভয়ে মুচিনীর আত্মারাম খাঁচাছাড়া! উচ্চবর্ণের অভক্ষ-অচ্ছুত গরুর মাংস রানিকে দেখাবেন? স্বর্গ তো দূরের কথা, তার তো নরকেও ঠাঁই হবে না! তাছাড়া এই কথা যদি কোনোভাবে পাঁচ কান হয়ে রাজার কানে যায় তবে তো আর তার রক্ষা নেই! মুচিনী রানিকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তার গরুর মাংস দেখার দরকার নেই, কিন্তু রানি নাছোড়বান্দা, রান্না করা গরুর মাংস তিনি দেখবেনই। রানির এই নাছোরবান্দা মনোভাবের কাছে শেষ পর্যন্ত মুচিনী হার মানে, একদিন সে গুরুর মাংস রান্না করে পাত্রে ঢেকে আঁচলের নিচে নিয়ে রাজবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অন্যদিন দ্বাররক্ষী মুচিনীকে আটকায় না, কিন্তু সেদিন মুচিনীর চোখ-মুখের হাবভাবে দ্বাররক্ষী কিছু একটা সন্দেহ করে, আঁচলের নিচে কী আছে তা দেখতে চায়। মুচিনী জানায় যে এটা রানির জিনিস, দেখানো যাবে না; দ্বাররক্ষী বারবার দেখতে চাইলেও মুচিনী তাকে না দেখিয়ে সোজা রানির কাছে চলে যায় এবং রানিকে রান্না করা গরুর মাংস দেখায়। দ্বাররক্ষী তখনই মুচিনীর নামে নালিশ করে রাজার কাছে। মুচিনীর অবাধ্যতার কথা শুনে রাজা রেগে যান আর তখনই তিনি রানির ঘরে যান দেখতে যে মুচিনী কী এমন বস্তু নিয়ে রাজবাড়ীতে প্রবেশ করেছে যা রানি ব্যতিত অন্য কাউকে দেখানো যাবে না? রাজার পায়ের শব্দ শুনেই রানি ভয়ে গোরুর মাংস আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেলেন, অদূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকে মুচিনী। রাজা রানির ঘরে প্রবেশ করে রানির কাছে জানতে চান যে দ্বাররক্ষীকে না দেখিয়ে মুচিনী কী জিনিস নিয়ে এসেছে। রানি ভয়ে কাঠ হয়ে প্রাণপণে মনে মনে বিপত্তারিণী মাকে ডাকতে থাকেন, ক্ষুব্ধ রাজা রানিকে নিরুত্তর দেখে রানির আঁচল ধরে টান দেন আর সঙ্গে সঙ্গে গোমাংসের বদলে রানির হাতে দেখা যায় এক থালা রক্তজবা ফুল! বিপত্তারিণীর দয়ায় রানি এবং মুচিনী উভয়েরই প্রাণ রক্ষা হয়, সেই থেকেই রানি বিপত্তারিণী দেবীর পূজা আরম্ভ করেন।’

বিনোদ চক্রবর্তীর মুখে বিপত্তারিণী দেবীর অজানা মাহাত্ম্য শুনে অনেকের চোখে জল আসে, সদ্য স্বজন হারানো পরিবার দুটির মানুষ ভাবে- আহা, আরো আগে যদি বিপত্তারিণী দেবীর মাহাত্ম্য তাদের জানা থাকত আর পূজা দিত, তাহলে হয়ত তাদের স্বজনদেরকে হারাতে হতো না; অশোক নন্দী আর তার স্ত্রী ভাবেন, বিপত্তারিণী মায়ের পূজা দিলে হয়ত তাদের পাটের গুদাম রক্ষা পেত! আর অন্যরা ভাবে তাদের পরিবারকে যাতে কোনো বিপদ স্পর্শ করতে না পারে সেজন্য শীঘ্রই বিপত্তারিণী মায়ের পূজা দেওয়া দরকার। কিন্তু কিভাবে পূজা করা যায়? বিনোদ চক্রবর্তী সবাইকে জানান, ‘মহিলাদের তিন গ্রাম ঘুরে মাঙন মাঙতে হবে। মাঙন মেঙে যে টাকা-পয়সা আর চাল-ডাল পাওয়া যাবে, তার সঙ্গে নিজেদেরকে যার যার সাধ্য মতো কিছু দান করতে হবে; এই দিয়েই করতে হবে বিপত্তারিণী মায়ের পূজা।’
অনাগত বিপদের আশঙ্কায় সবাই বিপত্তারিণী দেবীর পূজা করতে আগ্রহী হয়, এমনকি গ্রামের যারা বিনোদ চক্রবর্তীর যজমান নয় তারাও। কিন্তু গোল বাধান ননী চক্রবর্তী, ননী এবং বিনোদ দুজনই পৌরহিত্য করেন, গ্রামে মোটে দুই ঘর ব্রা‏‏‏হ্মণ, কিন্তু তাদের মধ্যে রেষারেষি অনেক পুরোনো। ফলে যেহেতু বিনোদ চক্রবর্তী বিপত্তারিণী পূজার কথা আগে তুলেছেন ননী বিরোধিতা করে বলেন, ‘গ্রামে তো রক্ষাকালী পূজা হয়ই, বিপত্তারিণী পূজার আবার কী দরকার! মা রক্ষাকালীই সকল বিপদের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেন। মা রক্ষাকালীর পূজা করলে আলাদা করে আর বিপত্তারিণী পূজার প্রয়োজন নেই।’

কিন্তু ঈশ্বর, অজস্র দেব-দেবী এবং তাদের সম্পর্কে কথিত অলৌকিক আখ্যানে বিশ্বাসী গ্রামের এইসব মানুষের মন বড় দূর্বল, এমনিতেই ছোটো-খাটো বিপদে তারা বারো মাস এ দেবতা- ও দেবতার চরণে আশ্রয় খোঁজে, তার ওপর চোখের সামনে যখন কারো জোয়ান ছেলে মরে যায় আর তখন যদি কোনো ব্রা‏হ্মণ এমন কোনো দেবতার পূজার কথা বলেন যে দেবতার পূজা করলে আসন্ন বিপদ কেটে যাবে, তাহলে গ্রামের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ তা উড়িয়ে দিতে তো পারেই না, বরং তারা উক্ত দেবতার মূর্তির চরণ আঁকড়ে ধরতে চায়। ফলে বিনোদের যজমানরা বিপত্তারিণী পূজার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে, এমনকি ননীর কোনো কোনো যজমানের মধ্যেও আগ্রহ দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত গ্রামের মানুষের মনোভাব বুঝে ননী নিজেও বিপত্তারিণী পূজার ব্যাপারে সম্মতি জানান এবং তার অত্যন্ত প্রিয় যজমান সুকুমার মাস্টারকে দিয়ে সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষের কানে এই কথাটা পৌঁছে দেন যে বিপত্তারিণী পূজার পৌরহিত্য তিনিই করবেন। গ্রামের বারোয়ারি রক্ষাকালী এবং হাজরা পূজার পৌরহিত্য ননী করেন, আবার বিপত্তারিণী পূজার পৌরহিত্য করার দাবিও তিনিই করে বসায় বিনোদের যজমানরা আপত্তি তোলে। বিনোদের যজমানদের জোর দাবি যে তাদের পুরোহিত আগে বিপত্তারিণী পূজার কথা তুলেছেন, সুতরাং তিনিই পৌরহিত্য করার দাবীদার; অন্যদিকে ননীর বেশিরভাগ যজমান পুরোহিত হিসেবে ননীকে চাইলেও, তার কয়েকজন বিচক্ষণ যজমান বিনোদের যজমানদের যুক্তি উড়িয়ে দিতে পারে না। এই নিয়ে দুই পুরোহিতসহ দুই পক্ষ একদিন মিটিংও করে। ননী তার দাবীর পক্ষে এই যুক্তি দেখান যে- এই এলাকায় যখন চন্দনা নদী সংকুচিত হতে শুরু করেছিল, চন্দনার চরে গজিয়ে ওঠা বন-জঙ্গল সাফ করে নতুন বসতি গড়ে উঠেছিল, তখন প্রথম ব্রাহ্মণ হিসেবে তার পূর্বপুরুষ দশরথ চক্রবর্তীর পবিত্র চরণ এই গ্রামের মাটিতে পড়ে এবং গ্রামের মানুষের অনুরোধে সেই মহাত্মা এখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। তখন এই গ্রামের মানুষ ছিল অনেকটা আদিম মানুষের মতো বর্বর! কোনো ভদ্রস্থ পূজা-পার্বণ তারা জানত না, নিজেরা নিজেরাই ইতুপূজা ব্রত বা সুবোচনী ব্রত’র মতো কিছু অনার্য ব্রত পালন করত, গাছপূজা করত, যা গ্রামের মানুষের কোনো মঙ্গল বয়ে আনত না! তাছাড়া গ্রামের মানুষ তখন বুঝে বা না বুঝে অনেক পাপ করত, ভূত-প্রেতের মতো অশুভ শক্তি দাপিয়ে বেড়াত গ্রামে! তখন গ্রামে নানা রকম রোগ-বালাই লেগেই থাকত; ডায়রিয়া, কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগে ভুগে মানুষ মরত। বংশ বৃদ্ধি হতো কম, কোনো কোনো বংশ নির্বংশ হতো। তার পূর্ব-পুরুষ দশরথ চক্রবর্তী ছিলেন এই গ্রামের ত্রাতা, শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ দশরথ চক্রবর্তীর পদস্পর্শেই গ্রামের মানুষের অর্ধেক পাপ নাশ হয়ে যায়, তিনি এই গ্রামে নানা রকম সভ্য পূজার প্রচলন করেন, পূজা এবং মন্ত্রের প্রভাবে অশুভ শক্তিরা সব ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়, আর তখন থেকেই দেবতাদের দয়ায় গ্রামে রোগের পাদুর্ভাব কমে যায়!

দশরথ চক্রবর্তী এই গ্রামে আসেন দেড়শো বছর আগে, ননী দশরথের পঞ্চম প্রজন্ম। আর বিনোদের ঠাকুরদা এখানে আসেন ষাট-সত্তর বছর আগে, তাদের মাত্র তিন পুরুষের বাস এখানে, তাহলে বিনোদ কী করে এই গ্রামের বারোয়ারি কোনো পূজার পৌরহিত্য করার দাবীদার হতে পারেন! গ্রামের মানুষের কি কৃতজ্ঞতাবোধ বলে কিছু নেই?

একথা সত্য যে ননী চক্রবর্তীর পূর্বপুরুষ দশরথ চক্রবর্তী-ই প্রথম ব্রা‏হ্মণ হিসেবে এই গ্রামে বসতি স্থাপন করেন, গ্রামের মানুষও বংশ পরম্পরায় এসব কথা জানে। তবে তারা এটা জানে না বা ভাবতে পারে না যে দশরথ চক্রবর্তী এই গ্রামে আসেন অভাবের তাড়নায়, নানা জায়গায় ঘরতে ঘুরতে এখানে এসে নতুন বসতি পেয়ে এবং কোনো ব্রা‏হ্মণ নেই দেখে শাস্ত্রের কথায় অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থদের পটিয়ে আর অশুভ শক্তির ভয় মনে ঢুকিয়ে তাদের কাছ থেকে থাকার জন্য জমি নেন, ক্রমান্বয়ে নানা পূজা-পার্বণের প্রচলন করেন এবং বেশ জাঁকিয়ে বসেন। কালক্রমে শ্রাদ্ধকার্যে গৃহস্থদের কাছ থেকে দান হিসেবে জমি পেতে পেতে চক্রবর্তী পরিবার অনেক জমির মালিক হয়। এর বহু বছর পরে এই গ্রামে বসতি স্থাপন করে ননীর পূর্বপুরুষদের একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাগ বসান বিনোদের ঠাকুরদা। এই ভাগ বসানোটা ননীর পূর্ব-পুরুষরা পছন্দ করেননি, তখন থেকেই দুই পরিবারের শত্রুতা।

অনেক যুক্তি-তর্কের পরে শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিপত্তারিণী পূজার পৌরহিত্যের দায়িত্ব পান বিনোদ চক্রবর্তী, যেহেতু তিনিই প্রথম পূজার কথাটা তোলেন।

বিপত্তারিণী পূজার সিদ্ধান্ত হওয়ামাত্র গ্রামের নারীরা আশপাশের তিন গ্রামে বেরিয়ে পড়ে মাঙন মাঙতে, তাদের মুখে মাঙন মাঙার উদ্দেশ্য এবং বিপত্তারিণী দেবীর মাহাত্ম্যের কথা শুনে ওইসব গ্রামের নারীরাও বিপত্তারিণী দেবীর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে। সে বছর বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে বিপত্তারিণী পূজা হয় এই গ্রামে। এর পরের বছর অমলদের গ্রামেও বিপত্তারিণী পূজা হয়, মাঙন মাঙতে যাওয়া নারীদের মুখে মুখে বিপত্তারিণী দেবীর মাহাত্ম্য ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে এবং এরপর বেশ কয়েক বছর আশপাশের অনেকগুলো গ্রামে বিপত্তারিণী পূজার এক মহা হুজুগ ওঠে। বিভিন্ন গ্রামের নারীরা দল বেঁধে গ্রামে গ্রামে মাঙন মেঙে পূজা শুরু করে, মাঙন মাঙার প্রচলন এতটাই বেড়ে যায় যে ধার্মিক মানুষেরাও বিরক্ত হয়ে পড়ে, কোনো কোনো ধর্ম বিশ্বাসী পুরুষের মুখেও শোনা যায় যে, ‘মাগিরা পুজোর নামে ব্যবসা ফাঁদিচে!’

বিপত্তারিণী পূজার অছিলায় কোনো কোনো দরিদ্র নারী মাঙন মেঙে কিছু রোজগার করে যে সংসারে খরচ করেনি এমনটাও নয়, অনেকেই করেছে। বিপত্তারিণী পূজার এই হুজুগটা থাকে বেশ কয়েক বছর, তারপর ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। এমনকি অমলদের গ্রামেও এখন আর বিপত্তারিনী পূজা হয় না, অনেক গ্রামেই হয় না, তবে এই গ্রামটিতে এখনো হয়। এখন অবশ্য বিনোদ চক্রবর্তী নয়, পূজা করেন বৃদ্ধ ননী চক্রবর্তী, সে আর এক কাহিনী!

বিনোদ এবং ননী কাছাকাছি বয়সের, ননী বছর দুয়েকের বড়, দুজনই তখন প্রৌঢ়। একদিন দুপুরে ননীর স্ত্রী পার্বতী চন্দনা নদীর ঘাটে স্নান করার আগে নাকি তার হাতের সোনার বালাজোড়া পরিষ্কার করে ঘাটপাড়ে রেখে তারপর স্নান করতে নামেন আর মনের ভুলে বালাজোড়া ঘাটে ফেলেই বাড়িতে চলে আসেন, অনেকক্ষণ পর যখন তার স্মরণ হয় তখন নদীর ঘাটে গিয়ে দ্যাখেন বালাজোড়া নেই! কেঁদে-কেটে এবং শাপ-শাপান্ত করে হুলস্থুল বাঁধিয়ে প্রায় সারা পাড়ার মানুষ ঘাটে জড়ো করে ফেলেন তিনি! পার্বতী ঘাটপাড়েই বালাজোড়া রেখেছিলেন সেটা বারবার নিশ্চিত করে বলার পরও যতীন ডুবুরিকে খবর দিয়ে আনা হয়। পার্বর্তী কোথায় বসে বালাজোড়া পরিষ্কার করেছিলেন, একেকটি বালার ওজন কত, কত জলে নেমে এবং ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে তিনি ডুব দিয়েছিলেন ইত্যাদি বিষয়ে খুঁটিয়ে শোনেন যতীন ডুবুরি। অঘ্রানের মৃদুমন্দ স্রোতের চন্দনায় বালাজোড়া যদি পড়েও থাকে তবু বেশি দূরে যাবার কথা নয়, মনে মনে একটা জড়িপ চালিয়ে যতীন ডুবুরি নদীতে নামেন, হুঁচা দিয়ে প্রথমে কাছের, তারপর ক্রমশ দূরের বেলেমাটি-কাদামাটি উপরে তুলে ভালো মতো খুঁজে দেখেন; কিন্ত কাঁকর, ইটের খোয়া, বাচ্চার প্যান্ট, ব্লাউজ, ছেঁড়া ত্যানা, সাইকেলের টিউবের টুকরো, পোড়ামাটির পুতুল ছাড়া কিছুই মেলে না। তবু হাল ছাড়েন না যতীন ডুবুরি, পাড়ে উঠে একটা বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে কিছুক্ষণ জিড়িয়ে নিয়ে আবার নামেন জলে, আঁকড়া দিয়ে চন্দনার তলদেশের কাদা তোলপাড় করে ফেলে একের পর এক ডুব দিয়ে হুঁচা ভরে মাটি তোলেন, তার প্রাথমিক জড়িপের চেয়েও বেশি জায়গার মাটি তুলে খোঁজেন, কিন্তু বালার দেখা মেলে না। বালার পরিবর্তে পাওয়া যায় সাড়ে তিন বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এপাড়ার কিশোরী সুলেখার একপাটি রূপার নূপুর, ততদিনে যুবতী হয়ে সুলেখার বিয়ে হয়ে গেছে, খবর পেয়ে সুলেখার মা এসে সেই নূপুর নিয়ে যায় যতীন ডুবুরিকে কিছু বকশিস দিয়ে। আর পাওয়া যায় একটি আংটি, আংটিটা দেখার পর ঘাটে আগত কয়েকজন নারী চিনতে পারে যে এটা কার আংটি, তাদের তো বটেই, আরো অনেকের মুখ থেকেই আফসোস ঝরে পড়ে, আর এপাড়ার স্বপনের বুকের ভেতরে করে হাহাকার! আংটিটা স্বপনের স্ত্রী অনিলার, তখন ওদের সবে বিয়ে হয়েছে, অষ্টমঙ্গলা থেকে ফিরে আসার তিনদিনের মাথায় অনিলা তার হাতের আংটিটা হারিয়ে ফেলে; দুপুরে নদীতে স্নান করার পর বাড়িতে ফিরে সিঁথিতে সিঁদূর দিতে গিয়ে দ্যাখে যে তার হাতের গোলাপী পাথর বসানো ছয় আনা ওজনের সোনার আংটিটা নেই। স্নান সে নদীতেই করেছিল, কিন্তু আংটি নদীতে পড়েছে, পথে পড়েছে, নাকি বাড়িতেই কোথাও পড়েছে তা খেয়াল করে নি। নতুন বউ বিয়ের ক’দিনের মাথায় আংটি হারিয়েছে, লোকে শুনলে বলবে কী! বাড়ির কাউকেও বলার সাহস করে না অনিলা। কিন্তু রাতে ভাত খেতে বসে তার শূন্য আঙুল শাশুড়ির দৃষ্টি এড়ায় না। শাশুড়ি আংটির কথা জিজ্ঞেস করায় সে থতমত খেয়ে যায়, তারপর সত্য কথাটিই বলে দেয় মিথ্যে বলার অভ্যাস না থাকায়। রাতেই শুরু হয় শাশুড়ির গরল বচন, রাতে ঘুমানোর সময়টুকু বাদ দিয়ে পরদিন সকাল থেকে আবার একইভাবে চলতে থাকে! সারা পাড়ার মানুষ জানতে পারে যে স্বপনের নতুন বউ বিয়ের আংটি হারিয়ে ফেলেছে, শুনতে পায় যে স্বপনের নতুন বউটা অলক্ষ্মী, সংসারে আসতে না আসতেই জিনিস খোয়ানো শুরু করেছে, আরও কী সর্বনাশ করবে তা কে জানে! বছর বিশেকের যুবতী বধূ অনিলা শ্বশুরবাড়িতে এসেই এত অপমান, এত গঞ্জনা মানসিকভাবে সইতে পারে নি, সন্ধ্যায় একলা ঘরে গলায় কাপড় বেঁধে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে জীবন জ্বালা জুড়ায়। কোনো বকশিস ছাড়াই আংটিটা স্বপনকে ফেরত দেন যতীন ডুবুরি।



(চলবে.....)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:০১

রাজীব নুর বলেছেন: কি সুন্দর লিখে যাচ্ছেন।
মনে হচ্ছে আমার আত্মজীবনী পড়ছি।

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:১৭

মিশু মিলন বলেছেন: অনুপ্রাণিত হচ্ছি। ধন্যবাদ।

২| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০২

নেওয়াজ আলি বলেছেন: চমৎকার সৃষ্টি, পাঠে মুগ্ধতা রেখে গেলাম।

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:২৪

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

৩| ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:০৭

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: আটপৌড়ে জীবনের গহন সাতকাহন.....

বেশ লাগছে

+++

০১ লা মার্চ, ২০২০ রাত ১২:২৪

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.