নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
সোনার বালাজোড়া খুঁজে না পেয়ে একসময় রণে ভঙ্গ দেন যতীন ডুবুরি, আর তার অভিজ্ঞতা থেকে এই সিদ্ধান্ত দেন যে বালাজোড়া নদীতে পড়েনি, নদীতে পড়লে তিনি পেতেনই।
অভিজ্ঞ যতীন ডুবুরির এই সিদ্ধান্তের পর পার্বতীর আগে কে কে এই ঘাটে স্নান করে গেছে চলে সেই খোঁজ, একজন জানায় যে সে পাড়ার অকাল বিধবা তাপসীকে স্নান করে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছে, আরেকজন জানায় সুরেনের বাড়ির কামলা ফরিদকে স্নান করতে দেখেছে, অন্য একজন জানায় সে বিনোদ চক্রবর্তীকে স্নান করে বাড়িতে যেতে দেখেছে। এই তিনজনের বাইরে অন্য কেউ স্নান করে থাকলেও কেউ তাদের দ্যাখেনি, সঙ্গত কারণেই সন্দেহের প্রাথমিক তালিকায় ওঠে এই তিনজনের নাম। কিন্তু বিনোদ একে তো ব্রাহ্মণ, তার ওপর সৎ মানুষ হিসেবে তার সুনাম থাকার কারণে এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারে না যে বিনোদ বালাজোড়া পেয়েছেন, পেয়ে থাকলে নিশ্চয় তিনি বাড়িতে না নিয়ে পথেই মানুষকে জানাতেন। ফলে অধিকাংশ লোকের চূড়ান্ত সন্দেহের তীর ধাবিত হয় তাপসী এবং ফরিদের দিকে। কেউ কেউ ভাবে, বিধবা তাপসী ভাশুরের সংসারে থাকে, তার নিজের রোজগার নেই, হাত খরচের দুটো টাকার জন্যও তাকে তাকিয়ে থাকতে হয় ভাশুরের দিকে, সোনার বালাজোড়া পেয়ে সে গোপন করতেই পারে! কেউ কেউ বলাবলি করে যে নিশ্চয় ফরিদই পেয়েছে সোনার বালাজোড়া, হাড়হাভাতে গরিব কামলা সে, অমন সুন্দর আর দামী সোনার বালাজোড়ার লোভ কিভাবে সামলাবে! ননী, পার্বতী এবং পাড়ার আরও কিছু মানুষ প্রথমে ফরিদকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন যে সে সোনার বালা পেয়েছে কি না? ফরিদ অস্বীকার করে, জানায় যে সে স্নান করার সময় নদীর ঘাটে বালাজোড়া দ্যাখেই নি। আল্লাহ’র কসম কাটে, প্রয়োজনে সে কোরান শরীফ ছুঁয়ে বলতেও রাজী আছে, ফরিদ কিছুতেই স্বীকার না করায় সকলে যায় তাপসীর কাছে। তাপসী শোনা মাত্র কেঁদে-কেটে ঈশ্বরের নামে শপথ করে, তার মৃত বাবা এবং স্বামীর নামে কিরে কেটে, একমাত্র পুত্রের মাথায় হাত রেখে ফরিদের মতোই জানায় যে সে বালাজোড়া দ্যাখেই নি! তিন বছরের একমাত্র ছেলেকে স্নান করিয়ে, তারপর সে নিজে স্নান করে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চলে এসেছে। তারপরও তাপসীকে অবিশ্বাস করে তার ঘরে তল্লাশী চালানো হয়, কিন্তু বালাজোড়া পাওয়া যায় না। এরপর বাকি থাকে বিনোদ, কিন্তু বিনোদকে কথাটা কিভাবে বলা যায়? কানাকানি হতে হতে এরই মধ্যে কথাটা বিনোদের কানে পৌঁছায় এবং বিনোদ নিজেই এসে জানান যে নদীর ঘাটে তিনি কোনো সোনার বালা দ্যাখেন নি, দেখলে নিশ্চয় তিনি কাউকে না জানিয়ে চুপি চুপি বাড়িতে চলে যেতেন না।
শেষ পর্যন্ত পাড়ার আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করেও সোনার বালাজোড়ার সন্ধান না পাওয়ায় ননী তার যজমান সুফলকে দিয়ে গ্রামে এই কথা চাউর করেন যে বালাজোড়া ফেরত না পেলে তিনি চটা চালানের ব্যবস্থা করবেন! কিন্তু চটা চালানের ভয়ে ভীত হয়েও বিনোদ, তাপসী, ফরিদ কিংবা অন্য কেউ বালাজোড়া ফেরত না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত এক মঙ্গলবার সকালে চটা চালানের ব্যবস্থা করেন ননী। মধুখালির কাছের এক গ্রাম থেকে তুলারাশির দুজন চটা চালানকারীকে নিয়ে আসে সুফল; একজনের নাম পবন, আরেকজনের নাম রতন। পবনের বয়স পঞ্চাশের ওপরে, ফর্সা গায়ের রঙ, মাথার সামনে-মাঝখানে টাক, মাথার দুইপাশে এবং পিছনে কাঁচা-পাকা কোঁকড়া চুল; আর রতনের বয়স চল্লিশের নিচে, মাথা ভর্তি কালো বাবড়ি চুল। দুজনেরই উচ্চতা মাঝারি, পবন একটু রোগা আর রতন কিছুটা মোটা। দুজনেরই পরনে সাদা ধুতি, গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, কোমরে বাঁধা গামছা, দুজনেরই নগ্ন পা। বাঁশঝাড় থেকে নতুন বাঁশ কেটে রাখা ছিল আগেই, পবন আর রতন দুজনে মিলে সেই বাঁশ কেটে সাত হাত লম্বা দুটো মসৃণ চটা বানায়। চটা দুটো রাখা হয় নদীর ঘাটে, ননীর স্ত্রী পার্বতীর কথা অনুযায়ী তিনি যেখানে বালাজোড়া রেখেছিলেন সেখানে। পবন চটায় তেল-সিঁদূরের ফোঁটা দেয়, ধান-দূর্বা ইত্যাদি দেয়। তারপর দুজনেই তাদের ডানহাতের মধ্যমা আর অনামিকায় কোনো এক গাছের শিকড় এবং লম্বা দূর্বা প্যাঁচায় আংটির মতো করে, এরপর তারা দুজন চটার দু-পাশে গিয়ে চটা এবং ইষ্ট দেবতার উদ্দেশে মাটিতে প্রণাম করে চটা দুটো হাতে নেয়। চটার দুই মাথায় দুজন, চটার আগা থাকে দুজনের কনুইয়ের ভাঁজের কাছে আর দুজনে চার হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে চটা। কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর দুজনের হাত আস্তে আস্তে নড়তে শুরু করে, ক্রমশ এমন জোরে নড়তে থাকে যে তাদের শরীর কাঁপে আর চটা দুটোর মাঝখানে সংঘর্ষ হয়ে একই ছন্দে চটাৎ চটাৎ শব্দ হয়। নদীর ঘাটে কৌতুহলী লোকের ভিড়, সারা গ্রামের শিশু-কিশোর এবং নারী-পুরুষ তো বটেই এমনকি আশপাশের গ্রাম থেকেও কেউ কেউ চটা চালান দেখতে হাজির হয়। সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে চটা চালানকারী পবন, রতন আর তাদের হাতের চঞ্চল দুটো চটার দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর পবন আর রতন ঘাট থেকে নদীর ঢালের দিকে চলতে শুরু করতেই কৌতুহলী জনতা উল্লাস করে ওঠে, কেউ কেউ হাত তালি দেয়। ভিড়ের ভেতর থেকে গুঞ্জন ওঠে, ‘এহন আর লোক দুজনের হাতে কোনো ক্ষমতা নাই, সব ক্ষমতা চটার, চটা তাগের যে-দিক নিয়ে যাবি, তারাও সে-দিক যাবি!’
এরকম নানাজনের নানা কথার গুঞ্জন চলতে থাকে, পবন এবং রতন ক্রমশ নদীর ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী কৌতুহলী জনতাকে হঠিয়ে তাদের পথ করে দেয়, অতি কৌতুহলী শিশু-কিশোররা ছুটোছুটি করে আর বড়দের ধমক খায়! নদীর ঢাল থেকে উঠে তেঁতুল গাছের নিচে এসে অল্প সময়ের জন্য দাঁড়ায় দুজন, চারিদিকে গুঞ্জন ওঠে যে চোর নিশ্চয় এখানে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল! পবন এবং রতনের হাত থামে না, অনবরত তাদের হাত একবার সম্প্রসারিত আরেকবার প্রসারিত হয় আর চটায়-চটায় সংঘর্ষ হয়ে একই ছন্দে চটাৎ চটাৎ শব্দ হয়। ফরিদ এখানেই উপস্থিত, কিন্তু চটা তার দিকে যায় না, কেউ কেউ ভাবে ফরিদ তো আর বালাজোড়া সঙ্গে রাখেনি যে চটা তার কাছে যাবে, যেখানে বালাজোড়া রাখা আছে সেখানেই যাবে চটা! পবন এবং রতন রাস্তায় উঠে উত্তর দিকে চলতে শুরু করলে কেউ কেউ হইহই করে ওঠে এই ভেবে যে ফরিদ ব্যাটাই বালাজোড়া নিয়েছে, সুরেনের বাড়ি সেদিকেই, আর ফরিদ যেহেতু সুরেনের বাড়িতে কাজ করে, তাই সুরেনের বাড়ির কোথাও সে বালাজোড়া লুকিয়ে রেখেছে! কিন্তু উল্লসিত জনতাকে অবাক করে পবন এবং রতন হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়, তারপর দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করতেই কৌতুহলী লোকজন তাদের পিছু নেয় চটার অলৌকিক কেরামতি দেখতে। বিনোদ এবং তাপসী দুজনের বাড়িই ওই দক্ষিণদিকে, পবন এবং রতনও সেদিকেই চলেছে অথবা উপস্থিত লোকের মতে চটাই তাদেরকে সেদিকে নিয়ে চলেছে। একটা বাড়ি পার হবার পর পবন এবং রতন পুনরায় কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়, তারপর আবার চলতে শুরু করে। সামনেই তাপসীর বাড়ি, তারপর আরো দুটি বাড়ি পরে বিনোদের বাড়ি। পবন এবং রতন তাপসীদের বাড়িতে ঢোকার পথের মুখে দাঁড়ায়, পিছন পিছন ছুটে চলা জনতা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় যে তাপসী-ই বালাজোড়া নিয়েছে, এবার নিশ্চয় চটা বালাজোড়া খুঁজে বের করবে, তাদের চোখে-মুখে বিপুল কৌতুহল আর উচ্ছ্বাস! যেহেতু জনতা অনেকটাই নিশ্চিত যে তাপসী-ই বালাজোড়া নিয়েছে, সেহেতু তাদের চোখ খোঁজে তাপসীকে, কিন্তু রাস্তা থেকে উঠোন বা বারান্দার কোথাও তাপসীকে দেখা যায় না। সে কি আগে থেকেই ভয়ে কোথাও পালিয়েছে? কিন্তু অবাক কাণ্ড, চটার প্রভাবে পবন আর রতন তাপসীদের বাড়ির পথে যায় না, রাস্তা ধরে চটা যায় আরও দক্ষিণে! ফরিদ বালাজোড়া পায়নি বা নেয়নি, তাপসীও না, তবে কে? রইলো বাকি বিনোদ! অনেকেরই বিশ্বাস হয় না যে বিনোদ বালাজোড়া পেয়েও গোপন করেছে। তবে কি অন্য কেউ? পবন আর রতন ছোটে আগে আগে, উত্তেজিত জনতা ছোটে পিছে পিছে। অনেকে যা বিশ্বাস করতে চায়নি, অনেকে যা বিশ্বাস করলেও মুখে প্রকাশ করেনি, সেই বিনোদের বাড়িতেই গিয়ে ওঠে পবন আর রতন। বিনোদ, তার স্ত্রী ও দুই ছেলে তখন ঘরের বারান্দায় বসা, আষাঢ়ের মেঘ তাদের মুখে। পবন আর রতন প্রথমে যায় বিনোদের কলতলায়, সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। কৌতুহলী কেউ কেউ ভাবে নিশ্চয় বিনোদ নদী থেকে স্নান করে কলে পা ধুতে এসেছিল, তাই চটাও কলতলায় এসেছে! তারপর পবন আর রতন কিছুক্ষণ উঠোনের এদিকে-ওদিকে যায়, এরপর যায় তুলসীতলায়। জনতা সমীকরণ মেলায়-কলতলায় পা ধুয়ে এসে বিনোদ নিশ্চয় তুলসীতলায় প্রণাম করেছে, তাই চটা তুলসীতলায় এসেছে! তুলসীতলা থেকে পবন আর রতন যায় বিনোদের শোবার ঘরে, উত্তেজিত জনতা তখন ঘরের জানালায় উঁকি দিতে থাকে, কেউবা দরজা দিয়ে পারলে ঘরে ঢুকে যায়, স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের তাড়ায়। পবন আর রতন ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ আগুপিছু করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জনতাকে হতাশ করে। আবার কিছুক্ষণ উঠোনে আগুপিছু করে দুজন, তারপর যায় বিনোদের রান্নাঘরে, রান্নাঘরেও দুজন কিছুক্ষণ আগুপিছু করে। জনতা ভাবে নিশ্চয় বিনোদ বালাজোড়া নিয়ে রান্নাঘরেও এসেছিলেন, হয়ত স্ত্রীর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতে, শেষ পর্যন্ত বালাজোড়া কোথায় রেখেছেন সেটাই এখন দেখার পালা, নিশ্চয় চটা এখন বালাজোড়া খুঁজে বের করবে! রান্নাঘরের পশ্চিম দিকের বেড়ার সাথে মই বাঁধা, মইয়ের ওপর ফাঁকে ফাঁকে রাখা মুড়ি ভাজার পাত্র- একটা বালেনের ওপর রাখা একটা খোলা, পাশেই একটা ঝাঁজর। এছাড়াও মইয়ের ওপর রাখা একটা সিলভারের মাঝারি ডেকচির ওপর আরেকটা ছোট ডেকচি, তার পাশে একটা লোহার কড়াই। উত্তরদিকের বেড়ার সঙ্গে বাঁধা আরেকটা ছোট মইয়ের ওপর রাখা ভাত রান্না করার মাটির হাঁড়ি, দুটো কড়াই আর একটা বড় গামলা। পবন আর রতন এবার পশ্চিমদিকের মইয়ের কাছে গিয়ে উত্তর-দক্ষিণ হয়ে দাঁড়ায় যেখানে মুড়ি ভাজার পাত্রগুলো রাখা আর পাত্রগুলোর প্রায় গা ঘেঁষে আরো কিছুক্ষণ নড়াচড়া করার পর ক্রমশ স্থির হয় তাদের হাত, বন্ধ হয় চটায়-চটায় সংঘর্ষের শব্দ। এখনো কিছুই পাওয়া যায়নি, তবু রান্নাঘরের দরজার বাইরে দাঁড়ানো ননীর কয়েকজন যজমান উল্লাস করে ওঠে। যারা আরো পিছনে উঠোনে দাঁড়ানো এবং ঘরের ভেতর কী হচ্ছে তার কিছুই দেখতে পায় না, তারা অতি উৎসাহে জিজ্ঞাসা করে, ‘পাইছে রে, পাইছে?’
দরজার সামনে থাকা লোকগুলো বলে, ‘না, এহনো পাওয়া যায় নাই, তয় পাওয়া যাবেনে মনে অতেচে!’
পবন চটা দুটো রতনের হাতে দিয়ে মইয়ের ওপর থাকা লোহার কড়াই আর ডেকচি দুটো আগে নামান মাটিতে, কড়াইয়ের ভেতর কিছু নেই; ডেকচি দুটো আলাদা করে দ্যাখেন পবন, একটা ডেকচি একবারে শূন্য, আরেকটায় রাখা কিছু কাঁচা ছোলা, সেই ছোলা মাটিতে ঢেলে হাত দিয়ে ছড়িয়ে ভালো করে দ্যাখেন পবন, কিন্তু ছোলার ভেতর কিছু কাঁকর ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ে না। এবার ঝাঁজরটা নামিয়ে দ্যাখেন পবন, শূন্য ঝাঁজর। তারপর বালেনের ওপর রাখা চাল ভাজার খোলা নামান, খোলার মধ্যে একজোড়া লুচনি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। এরপর নামান বালেন, দরজায় দাঁড়ানো সকলের চোখ বালেনের দিকে, তারা উত্তেজিত, বালেনের ভেতর সত্যি কি কিছু আছে নাকি এই চটা চালান কেবলই ভড়ং, বিনোদ চক্রবর্তীকে হেনস্থা করার মাধ্যম? পিছন থেকে কেউ কেউ আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘পাইছে রে?’
সামনে থাকা একজন বিরক্ত প্রকাশ করে, ‘আলো না বুদাই, এত অধৈর্য্য হোসনে!’
পবন বালেন নামিয়ে দ্যাখে তার মধ্যে মুড়ি ভাজা পোড়া বালি, বালির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নড়াচড়া দিতেই তার হাত কিছু একটা আবিষ্কার করে বলে মনে হয়, পরক্ষণেই বালির ভেতর থেকে তার পাঁচ আঙুল তুলে আনে একজোড়া সোনার বালা, বালাজোড়ার খাঁজ থেকে পোড়া বালি ঝরে পড়ে মাটিতে। জনতা উল্লাস করে ওঠে, ‘পাইচে রে...পাইচে!’
পিছন দিক থেকেও অনেকে উল্লাস করে ওঠে, কেউ কেউ ধুয়ো তোলে- ‘চোর, চোর, শালার বাওন চোর!’
বিনোদ চক্রবর্তী নিজের উদ্যোগে সকলের সহায়তায় মন্দিরে বিপত্তারিণী দেবীর পূজা প্রতিষ্ঠা করার বছর তিনেকের মধ্যেই যে তার জীবনে এমন বিপদ নেমে আসবে তা কে জানত! পরদিন সকালে মন্দিরের মাথায় ছায়া দিয়ে রাখা অশ্বত্থগাছের ডালে গলায় দড়িসহ বিনোদ চক্রবর্তীর মৃতদেহ ঝুলতে দেখা যায়! আর মন্দিরে অধিষ্টিত বিপত্তারিণী দেবীর সামনে পোড়া মাটির প্রদীপ চাপা দেওয়া একটা কাগজ পাওয়া যায়, তাতে লেখা- ‘মা, এই মন্দিরে আমি তোকে প্রতিষ্ঠা করলাম, আর তুই আমায় মিথ্যে চোরের অপবাদ দিয়ে তার প্রতিদান দিলি! তোর মাহাত্ম্য যদি সত্যি হয়, তুই যদি সত্য হোস, তবে আমার প্রাণ রক্ষা কর দেখি, নইলে তোর সামনেই আমি আত্মঘাতী হলাম!’
বিপত্তারিণী দেবী বিনোদ চক্রবর্তীকে রক্ষা করেন নি, গলায় দড়ি দিয়ে অশ্বত্থ গাছের ডালে ঝুলে পড়ায় শ্বাসরোধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। পরদিন সকালে শতশত মানুষ অশ্বত্থ গাছের নিচে ভিড় করে, আগের দিন যারা বিনোদকে ‘চোর’ ‘চোর’ বলে উল্লাস করেছিল, পরের দিন সকালেই তাদের অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘মানুষটা বড় ভালো ছিল। নিশ্চয় বিনোদ ঠাহুর বালা চুরি করে নাই, এর মদ্যি কোনো কিন্তুক আছে!’
মানুষের মুখ থেকে যখন আহা, উহু, ইস ইত্যাদি ধরনের হাহাকার-আফসোস আর আবেগী কথা ঝরে পড়ে বিনোদের জন্য; বিনোদ তখন চিতার আগুনে পুড়ে ছাই হবার অপেক্ষায় নিথর-নিস্তব্ধ প্রাণহীন একটি মৃতদেহ মাত্র!
পরিমল আর অমল স্কুলে যাবার পথে বিনোদের লাশ দেখেছিল, তখন ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল না লাশ, দড়ি থেকে নামিয়ে মন্দিরের সামনে শুইয়ে রাখা হয়েছিল, গলায় একটা গভীর কালচে দাগ ছিল, জিভ বেরিয়ে ছিল। বীভৎস দেখাচ্ছিল বিনোদ চক্রবর্তীকে! ওদের কৈশোরের নরম মন পীড়িত হয়েছিল ভীষণ।
পরে কেউ কেউ ধারণা করে যে বালা চুরির ব্যাপারটি ননী চক্রবর্তীর ষড়যন্ত্র, বিপত্তারিণী পূজার পুরোহিত হতেই তিনি আর তার স্ত্রী বালা চুরির ঘটনাটি সাজিয়েছিলেন বিনোদ চক্রবর্তীকে ফাঁসানোর জন্য, ননী নিজে অথবা কাউকে দিয়ে রাতের আঁধারে বিনোদের দরজাবিহীন রান্নাঘরের মুড়ি ভাজার বালেনের পোড়া বালির মধ্যে সোনার বালা দুটো রেখে চটা চালানের আয়োজন করেছিলেন, আসলে ওসব চটা চালান-টালান মিথ্যে ভড়ং! আজও নানা মুখে নানা কথা ভেসে বেড়ায় সেই চটা চালান এবং বিনোদের মৃত্যু নিয়ে। কিন্তু প্রকৃত সত্য কী তা কে জানে!
বিপত্তারিণী দেবী বিনোদ চক্রবর্তীকে রক্ষা করতে পারেননি, এমনকি নিজেকেও রক্ষা করতে পারেন না; বছর পাঁচেক আগে পূজার দু-দিন আগে কারা যেন বিপত্তারিণীর দেহটা দুমড়ে-মুচড়ে রেখেছিল আর মাথাটা ভেঙে ফেলে রেখেছিল রাস্তায়, সে বছর পূজা হয় নি। সে-বছর রক্ষাকালীরও রক্ষা হয়নি, হাতগুলো মুচড়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল আর ভেঙে খান খান করা মাথাটা পাওয়া গিয়েছিল খেলার মাঠের মধ্যে!
তারপর বছর দুয়েক আগের ঘটনা, কোরবানি ঈদের পরদিন সকালে বিপত্তারিণী দেবীর গলায় মালার মতো করে গরুর নাড়ি প্যাঁচানো দেখতে পাওয়া যায়, আর সামনে ঘটের কাছে দেখা যায় মলসহ গরুর ভুঁড়ি!
যে বিপত্তারিণী দেবী একদিন মল্লরাজ্যের রানির আঁচলের নিচের থালার গরুর মাংস মুহূর্তের মধ্যে রক্তজবায় পরিণত করেছিলেন বলে আখ্যান প্রচলিত আছে, রাতের আঁধারে কোনো অমানুষ সেই বিপত্তারিণী দেবীর মূর্তির গলায় গুরুর নাড়ি পেঁচিয়ে আর ভুঁড়ি সামনে রেখে যায়, তবু সকালের আলো ফোটার আগে দেবী সেই গরুর নাড়িকে রক্তজবার মালা আর ভুঁড়িকে গাঁদাফুলে পরিণত করতে পারেননি, সকালে তার ভক্তদেরকে ফুল-মালার পরিবর্তে নাড়ি-ভুঁড়িই দেখতে হয়!
তবু মানুষ এখনো বিপত্তারিণীর পূজা করে, ভাবে যে বিপত্তারিণী বড় জাগ্রত দেবী, বিপদের রক্ষাকত্রী! পরিমল, অমল আর বিলাসও তাই-ই ভাবে; যদিও অমল আজকাল পূজা-পার্বণের বিষয়ে সংশয়ে ভোগে, তার নিজের ভেতরে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়, কিন্তু সে কারো সাথে এসব আলাপ করে না। নিজের ভেতরের সংশয় সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না বলেই সেই কলেজ জীবনে শিবপূজার যে ব্রত নিয়েছিল তা এখনো পালন করে, অন্যান্য পূজাও করে আরো অনেকের মতো।
(চলবে.....)
২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:২৩
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
২| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:১৯
রাজীব নুর বলেছেন: লম্বা ধারাবাহিক এইভাবে পড়ে আরাম পাচ্ছি না।
কি করি বলেন তো?
২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:২৬
মিশু মিলন বলেছেন: সম্পূর্ণ উপন্যাস চূড়ান্ত সম্পাদনা করা শেষ। প্রতিদিন এক পর্ব করে প্রকাশ করলে কেমন হয়?
৩| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:৩২
রোকনুজ্জামান খান বলেছেন: বাস্তবমূখী ও শিক্ষনীয় একটি লেখা । হাত চালান লাঠি চালান এগুলো বলতে কিছু নেই। আমি নিজেই একজন তুলা রাশি। কৌতোহল বশত একাবার হাতে সিবা নিয়ে কাশার প্লেটে হাত রেখেছিলাম, হাত আর চলেনি।
২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:২৭
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
৪| ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:১৬
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: গভীর থেকে গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গল্প . . . .
++++
০১ লা মার্চ, ২০২০ রাত ১২:২৮
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:০৫
নেওয়াজ আলি বলেছেন: অতুলণীয়