নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

লৌকিক লোকলীলা (উপন্যাস: পর্ব-এগারো)

০২ রা মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:১৮

সাত

রাস্তার ধারে মাত্র কয়েকটা বাড়ি, বাড়িগুলো পিছনে ফেলে রাস্তা থেকে নেমে ওরা মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে শ্মশানের দিকে এগোতে থাকে, এখান থেকে ওরা জ্বলন্ত চিতা স্পষ্ট দেখতে পায়, দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতা। চিতার আগুনের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে, শ্মশানের পাশের সুবজ ধানক্ষেতে নাচচে আগুলের লাল আভা। ওরা কলাবাগানের ভেতর দিয়ে কিছুটা এগোনোর পর সোজা শ্মশানের দিকে না গিয়ে একটু বাম দিকে সরে গিয়ে একটা মেহগনি বাগানে প্রবেশ করে, বাগানের গাছগুলো খুব বেশি মোটা নয়। ওরা বাগানের মাঝখানে এসে হাতের রামদা, ছড়ি আর কোদাল মাটিতে রেখে বসে পড়ে গোল হয়ে। খোল-করতাল সহযোগে শ্মশানযাত্রীদের গানের সুর এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যায়, একজন গাইছে আর অন্যরা দোহারকি করছে-
‘নিতাই আমার হাত ধরিয়ে লয়ে চলরে
কত দিনে ব্রজে যাব,
আমি বহুদিন হই ব্রজ ছাড়ারে
নিতাই আমার হাত ধরিয়ে লয়ে চলরে...।’

অমল কোমরের গামছা খুলে মুখের এবং শরীরের ঘাম মোছে, ওর গলার রুদ্রাক্ষের মালার দানায়-দানায় ঘর্ষণের মৃদু শব্দ হয়। বিলাস নিজের কোমরের ধুতির ভাঁজে কায়দা করে রাখা ছোট মদের বোতলটি বের করে মুখ খুলে চুমুক দিয়ে বোতলটি বাড়িয়ে দেয় অমলের দিকে। পরিমল আবার একটা গাঁজার স্টিক ঠোঁটে পুরে প্যাকেটটা তিনজনের মাঝখানে রাখে, দিয়াশলাই জ্বেলে গাঁজার স্টিকে আগুন ধরায়, ক্ষণিকের জন্য ওর মুখ আলোকিত হয়ে ওঠে, গাঁজায় টান দেবার সময় চোখ বোজে, দিয়াশলাইয়ের প্যাকেটটাও রেখে দেয় মাটিতে। গাঁজার মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে ওর মস্তিষ্কে, আরেকটি টান দিয়ে গাঁজার স্টিকটা দেয় বিলাসকে আর অমলের হাত থেকে মদের বোতলটি নিয়ে দুই ঢোক মদ গলাধঃকরণ করে। পরিমল আর বিলাস যেমনি প্রায়ই মদ আর গাঁজা খায়, অমল তা নয়। অমলের মদ কিংবা গাঁজা খাওয়া অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক, কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে খায়। মদের বোতল আর গাঁজার স্টিক ওদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে, শ্মশানযাত্রীরা আবার ধ্বনি দেয়, একই সঙ্গে চলতে থাকে খোল-করতাল সহযোগে গান।

শ্মশানযাত্রার ধ্বনি শুনলে সেই ছেলেবেলা থেকেই অমলের বুকের ভেতর মোচড়ায়, বুকের তেপান্তরে হু হু করে হাওয়া বয়, মনটা উদাস হয়ে যায়। মৃত্যুকে ভয় পায় না অমল, কিন্তু মৃত্যু ওকে ভাবায়, মৃত্যু-ভাবনা ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। দাদুর কথা মনে পড়ে, জ্যাঠার কথা মনে পড়ে, বাবার কথা মনে পড়ে, পরিচিত আরো অনেকের কখাই মনে পড়ে; যারা একদিন এই পৃথিবীতে ছিলেন, কিন্তু আজ নেই। তারা এখন কোথায়, স্বর্গে নাকি নরকে? বাবা তো সারাজীবন ভালো কাজ করেছেন, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন, মানুষের সেবা করেছেন, কোনোদিন কারো অন্বিষ্ট করেননি। বাবার তো স্বর্গেই যাবার কথা! আর পাশের বাড়ির রিনা কাকিমা, তার স্থান হয়েছে কোথায়? রিনা কাকিমার অনেক দূর্নাম ছিল, মানুষের টুকিটাকি জিনিসপত্র চুরি করার স্বভাব ছিল। রিনা কাকিমার আরও একটা ব্যাপার ও জানে, সেটা ওর বড়দির বিয়ের সময়ের ঘটনা। তখন রাত, বড়দির বিয়ে হচ্ছে, বাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজন আর বরযাত্রী। শোবার জায়গার অভাবের কথা উঠতেই রিনা কাকিমা আগ বাড়িয়ে ওকে বলেন, ‘অমল, শুয়ার জায়গা না থাকলি আমাগের বাড়ি দুই-তিনজন নিয়ে যাস।’

রাতে বিয়ের পাঠ চুকে গেলে দেখা যায় শোবার জায়গা অবশিষ্ট নেই, সব বিছানায় গাদাগাদি করে শুয়েছে আত্মীয়-স্বজনরা, তারপরও অনেকের শোবার জায়গা হয় নি দেখে প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে। অমল ওর নিকটাত্মীয় দুই দাদাকে নিয়ে শোবার উদ্দেশ্যে যায় রিনা কাকিমাদের বাড়িতে। উঠোনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ডাকার পরও রিনা কাকিমা কোনো সাড়া দেন না, তবু অমল ডাকতেই থাকে, এক সময় রিনা কাকিমা সাড়া দেন, ‘অমল নাকি রে?’
অমল বলে, ‘হ কাকিমা, শুবার আসলাম।’
‘দাঁড়া, খুলতেছি।’

রিনা কাকিমার কণ্ঠস্বর শুনে অমলের মনে হয় না যে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, ঘুম ভাঙা মানুষের কণ্ঠস্বর ভারী আর কিছুটা জড়ানো হয়, তবে তিনি সাড়া দিতে এতটা দেরি করলেন কেন? এই প্রশ্ন অমলের মনে জাগলেও বিশেষ পাত্তা দেয় না ও। রিনা কাকিমা ঘরে বাতি জ্বেলে দরজা খুলে দিলে ওরা তিন ভাই ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে পাশাপাশি দুটো চকি জোড়া লাগিয়ে বিছানা পাতা, বিছানার দক্ষিণদিকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শায়িত একজন, অমল বুঝতে পারে যে তিনি সুভাষ কাকা অর্থাৎ রিনা কাকিমার স্বামী, এজন্যই বোধ হয় স্বামী-স্ত্রীর একান্ত কোনো বিশেষ কারণে কাকিমা সাড়া দিতে দেরি করেছেন। সুভাষ কাকা ফরিদপুরের একটা পেট্রোল পাম্পের ম্যানেজার, সেখানেই থাকেন, কখনো সপ্তাহে কখনো পনের দিনে একবার বাড়িতে আসেন। রিনা কাকিমা ওদের তিনজনকে রেখে অন্য ঘরে শুতে চলে যান। অমল দরজা লাগিয়ে দেয়, তারপর ওরা তিন ভাই বিছানার অবশিষ্ট জায়গায় শুয়ে পড়ে।

অনেক রাতে শুলেও খুব সকালেই ঘুম ভেঙে যায় অমলের, মাথার কাছের ছোট্ট খোলা জানালা দিয়ে তখন মৃদু আলো প্রবেশ করেছে ঘরে, আবছায়ার আবরণ খুলে একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ঘরের জিনিসপত্র, বামদিকে পাশ ফিরে শোবার সময় পাশের ঘুমন্ত মানুষটির মুখে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ায় ও যেন চমকে যায়! ঠিক দেখছে তো? ডানহাতের চেটো দিয়ে দু-চোখ ভালোভাবে রগড়ে আবার তাকায় ঘুমন্ত মানুষটির মুখের দিকে, ওই নিমীলিত চোখের মুখমণ্ডল যেন সূর্যের আলোর মতো ওর মস্তিষ্কের পাতলা কুয়াশা সদৃশ ঘুম মুছে দেয়, বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত ওর চোখের পলক পড়ে না! রাতে শোবার সময় ও যাকে সুভাষ কাকা ভেবেছিল, তিনি তো সুভাষ কাকা নন, সুভাষ কাকার বড় ভগ্নীপতি দীপেন, রিনা কাকিমার বড় ননদের বর!

রিনা কাকিমার সম্বন্ধে অনেক বাজে কথা শুনেছে অন্য প্রতিবেশী, গ্রামবাসীর মুখে কিংবা বন্ধু-মহলে, কিন্ত সে-সব কথা বিশ্বাস করতে চায় নি অমল, কোনো রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও প্রতিবেশী কাকিমা সম্বন্ধে ওই সব কথা শুনে ওর অস্বস্তি হতো। কিন্তু আধো আলো-আধো ছায়া ঘরের বিছানায় ঘুমন্ত মধ্যবয়সী দীপেনের মুখের দিকে তাকিয়ে রিনা কাকিমা সম্বন্ধে মানুষের বলা বাজে কথাগুলোই ওর কানে বাজতে থাকে। একদিন যে রিনা কাকিমা সম্বন্ধে মানুষের বলা কথা বিশ্বাস করতে চায় নি, দীপেনকে দেখার পর সে-ই রিনা কাকিমা সম্বন্ধেই ওর মাথায় প্রশ্নের জন্ম হয়, আর নিজেই আত্ম-প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে বিব্রতবোধ করে- দীপেন এসেছেন জেনেও রিনা কাকিমা কেন তাকে শুতে আসতে বললেন? নাকি দীপেন তখনও আসেন নি আর আসবেন কি না তা তিনি জানতেন না? তিনি বাড়ি ফেরার পর দীপেন এসেছেন? রিনা কাকিমাদের তো আরো ঘর আছে, যে ঘরে তার মেয়ে শোয়, মেয়ের কাছে না শুয়ে তিনি কেন রাতেরবেলা ননদের বরের সঙ্গে একই বিছানায় শুয়েছিলেন? নাকি দীপেন অনেক রাতে এসেছেন বলে মেয়ের ঘুম ভাঙিয়ে রিনা কাকিমা তার কাছে শুতে যান নি কিংবা মেয়েকে নিজের কাছে এনে ওই ঘরে দীপেনকে শুতে না দিয়ে এখানেই শুতে দিয়েছেন সরল মনে, আদতে তাদের মধ্যে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই বা হয় নি? কিন্তু তার ডাকে সাড়া দেওয়া রিনা কাকিমার ওই কণ্ঠস্বর? অমলের ভেতরে শুরু হয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিপরীতমুখী দড়ি টানাটানি।

সেদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে জেগে বিছানায় দীপেনকে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখার পর বিস্মিত অমল যখন চুপ করে শুয়ে ছিল, রাত্রি জাগরণের কারণে চোখ জ্বালা করলেও ঘুম আর আসছিল না, তখন ঘরের বেড়ায় টাঙানো সুভাষ কাকার যৌবনকালের সাদাকালো একটি বাঁধানো ছবির দিকে চোখ পড়ে আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর কল্পনায় ভেসে ওঠে একটি দৃশ্য। দৃশ্যটি ঠিক এই রকম- গুমোট গন্ধময় দরজা-বন্ধ ঘরের পাতলা অন্ধকারে বিছানায় নগ্ন শরীরের রিনা কাকিমা আর দীপেন জাপটাজাপটি করছেন, দীপেন রিনা কাকিমার ঠোঁট কামড়াচ্ছেন, গাল-গলা-স্তন চাটছেন, ঊরুতে মুখ গুঁজছেন; তারপর নানান কৌশলে দুজনে সঙ্গম করছেন, প্রবল সঙ্গমসুখে অস্থির স্বাস্থ্যবতী রিনা কাকিমা দুই হাতে জাপটে ধরে ছিপছিপে গড়নের দীপেনকে নিজের শরীরের সঙ্গে পিষে ফেলতে চাইছেন যেন! অল্প দূরেই বেড়ায় ঝোলানো কাঠের ফ্রেমের মাঝখানে স্থির সুভাষ কাকার দুটি চোখ।

এই দৃশ্যটি কল্পনায় ভেসে উঠলে অমল এতটাই বিব্রতবোধ করে যে সকালের আলোয় দীপেন কিংবা রিনা কাকিমার মুখোমুখি হতে চায় না, অন্য কেউ উঠার আগেই সে বিছানা ছেড়ে আলগোছে দরজা খুলে চুপি চুপি বাড়ি চলে যায়।

এই ঘটনার পর থেকেই অমল রিনা কাকিমাদের বাড়িতে যাওয়া ছেড়ে দেয়, কোথাও রিনা কাকিমাকে দেখলে সে দূর থেকেই সরে পড়ত, পারতপক্ষে রিনা কাকিমার সামনে পড়তে চাইত না। রিনা কাকিমার দিকে তাকাতে লজ্জা লাগত, তাকালে মনে হতো সে যেন রিনা কাকিমার পরনের কাপড় ভেদ করে শরীরটা দেখতে পাচ্ছে আর রিনা কাকিমার সঙ্গে দীপেনের সঙ্গমের ওই কল্পিত দৃশ্যটা মনশ্চক্ষে ভেসে উঠত! এই কল্পিত দৃশ্যটাকে সে মনে করতে চাইত না, কিন্তু রিনা কাকিমাকে দেখলে কিংবা তার সামনে কেউ রিনা কাকিমার প্রসঙ্গ তুললে দৃশ্যটা আপনা-আপনিই মনশ্চক্ষে ভেসে উঠত! রিনা কাকিমা আর দীপেন তো বটেই, এমনকি সুভাষ কাকাকে দেখলেও দৃশ্যটা তার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠত! এছাড়াও সিনেমায় নারী-পুরুষের মিলনের দৃশ্য দেখলে কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে যৌনতা বিষয়ক আলোচনার সময়েও ওই দৃশ্যটা তাকে তাড়া করত। কখনো কখনো একান্তে বসে কিংবা শুয়ে থাকলেও ওই দৃশ্যটার কথা মনে পড়ত, বহুদিন ওই দৃশ্যটার কথা মনে পড়ায় তার শরীরে কাম জেগে উঠেছে, নিরলে বন্ধ ঘরে কিংবা অতীশদের বাগানে গিয়ে হস্তমৈথুন করেছে!
অমলের বন্ধুরা মানুষের সম্পর্ক নিয়ে কিংবা কার সঙ্গে কে শোয় এই ধরনের সত্য অথবা বানোয়াট বিষয় নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত এবং এখনো করে, কিন্তু রিনা কাকিমা আর তার ননদের বর দীপেনের রাতে এক বিছানায় শোবার কথা সে কোনোদিন কাউকে বলে নি, তার মনে হয়েছিল এমনিতেই তো মানুষ রিনা কাকিমাকে কত কলঙ্ক দেয়, সেই কলঙ্কের ডালা আর নাইবা ভারি করল সে! তাছাড়া সে তো কেবল এই বিষয়টাতেই নিশ্চিত যে রিনা কাকিমা আর দীপেন একই ঘরে একই বিছানায় শুয়ে ছিলেন; সে তো এই বিষয়ে নিশ্চিত নয় যে রিনা কাকিমা আর দীপেন শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন কি না। অন্য একটি বিষয়ও ভেবেছে অমল, এমনও তো হতে পারে যে সুভাষ কাকা শারীরিকভাবে ততটা সক্ষম নন, তিনি হয়ত রিনা কাকিমাকে পরিপূর্ণভাবে যৌন মিলনের তৃপ্তি দিতে পারেন না। তাই হয়ত রিনা কাকিমা অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌন মিলনে লিপ্ত হন কেবল শারীরিক সুখের জন্য, কিন্তু তিনি ভালোবাসেন সুভাষ কাকাকেই! এমনও তো হতে পারে যে এই ব্যাপারে সুভাষ কাকার সম্মতি আছে! স্বামীর সঙ্গে সঙ্গমে অতৃপ্ত একজন নারী যদি কেবল শারীরিক সুখের জন্য অন্য একজন পুরুষের সম্মতিতে তার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয় তাতে দোষের কী? রিনা কাকিমার শরীর আছে, শরীরে যৌন ক্ষুধা আছে, তার ক্ষুধা সে কিভাবে এবং কার সঙ্গে সঙ্গম করে মিটাবে সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার! পাড়া-পড়শীর তাতে কী আসে যায়? রিনা কাকিমা সম্পর্কে এই ভাবনাটা ভাবতে পেরে অমল বেশ স্বস্তি বোধ করত।

বছর খানেক আগে রিনা কাকিমা সেই একই বিছানায় রাত্রিবেলা মরে পড়ে ছিলেন, পাশে কেউ ছিল না, না দীপেন, না সুভাষ কাকা কিংবা অন্য কেউ। মৃত্যুর পর রিনা কাকিমা কোথায় গেছেন, স্বর্গে না কী নরকে? ভাগবত পুরাণ, দেবী-ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ এবং গড়ুর পুরানে যে আটাশ প্রকার নরকের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে এক প্রকার নরকের নাম-তপ্তসুর্মি বা তপ্তমূর্তি। তাদের গ্রামের ভাগবত পাঠক দেবু বিশ্বাসের মুখে সে অনেকবার শুনেছে- যে পুরুষ বা নারী নিজ স্ত্রী বা স্বামী ব্যতিত লালসার বশবর্তী হয়ে অন্য নারী বা পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়, মৃত্যুর পর তার ঠাঁই হয় নরকে, আর শাস্তিস্বরূপ তাকে কষাঘাত করা হয় এবং বিপরীত লিঙ্গের তপ্ত লালাভ একটি লৌহমূর্তি আলিঙ্গন করতে বাধ্য করা হয়। রিনা কাকিমাও কি এখন সেই শাস্তি ভোগ করছেন?

আর ভাগবত পাঠক দেবু বিশ্বাস অর্থাৎ গ্রামবাসী সম্পর্কে অমলের দেবু জ্যাঠা আর মানসী বোদি? তারা কোথায় যাবেন, স্বর্গে না কী নরকে? দেবু জ্যাঠা আর মানসী বৌদির সম্পর্ক অমলের কাছে বিস্ময়ের এবং আনন্দের, কিন্তু পাড়া-পড়শী কিংবা গ্রামবাসীর কাছে তা উপহাসের-লজ্জার-কলঙ্কের!

দেবু জ্যাঠা ভাগবত, গীতা, রামায়ণ প্রভৃতি পাঠ করতেন। এলাকার কোনো বাড়িতে মানুষ মারা গেলে শ্রাদ্ধ-শান্তি বেরিয়ে যাবার পর সেই বাড়ির লোকেরা মৃতের আত্মার শান্তি কামনায় বাড়িতে ভাগবত পাঠের আসর বসাতেন আর অবধারিতভাবেই ভাগবত পাঠের আমন্ত্রণ পেতেন দেবু জ্যাঠা। এছাড়াও বছরের নানা সময়ে গৃহস্থবাড়ি থেকে ভাগবত-গীতা-রামায়ণ পাঠের আমন্ত্রণ পেতেন তিনি, শীতের সময় বেশি আমন্ত্রণ পেতেন, প্রণামীও পেতেন বেশ। দেবু জ্যাঠা বিবাহিত ছিলেন, চার সন্তান তার। বিবাহিত হলেও শারীরিক সম্পর্ক ব্যতিত স্ত্রীর অর্থাৎ সুষমা জেঠিমার সান্নিধ্য তিনি উপভোগ করতেন না, বিশেষত মধ্য বয়সে পা দেবার পর থেকে সুষমা জেঠিমার সঙ্গে তার চিন্তা-ভাবনার দূরত্ব অনেক বেড়ে যায়, সুষমা জেঠিমাও তাকে বুঝতে পারতেন না, এমনকি বোঝার চেষ্টাও কোনোদিন করতেন না।
মাঠে জমি-জমা ছিল দেবু জ্যাঠার, সংসারের ভার অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন ছেলেদের ওপর, তিনি ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং আলোচনায় সময় অতিবাহিত করতেন। এই যে তার ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং আলোচনা, এতে তিনি কখনোই সুষমা জেঠিমাকে সঙ্গী হিসেবে পেতেন না, তার ধর্মীয় আলোচনায় সুষমা জেঠিমা কখনোই আগ্রহ দেখাতেন না। অথচ তার চাওয়া ছিল যে তার সুষমা জেঠিমা তার এই ধর্মীয় জীবন-যাপনের সঙ্গী হোক। একটা সময়ে তিনি যেখানেই ভাগবত কিংবা গীতা-রামায়ণ পাঠ করতে যেতেন, সুষমা জেঠিমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং আলোচনার মাঝেই তিনি দেখতে পেতেন যে সুষমা জেঠিমা বেড়ায় কিংবা খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছেন! পরে তিনি সুষমা জেঠিমাকে নিয়ে যাওয়া বাদ দিয়েছিলেন, তাতে সুষমা জেঠিমাও যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন! সারারাত ধর্মকথা শুনে বেলা করে ঘুম থেকে উঠার চেয়ে, সারারাত ঘুমিয়ে ভোরবেলা উঠে ধান সিদ্ধ করাই উত্তম মনে করতেন সুষমা জেঠিমা! ফলে সুষমা জেঠিমার সঙ্গে দেবু জ্যাঠার মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, স্ত্রীকে মনের মতো করে না পাবার কারণে দেবু জ্যাঠার মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, এই যে শূন্যতা দেবু জ্যাঠার ভেতরে, তা তিনি পূরণ করেছিলেন মানসী বৌদিকে দিয়ে।

দেবু জ্যাঠা গ্রামের যে বাড়িতেই ভাগবত-গীতা পাঠ করতে যেতেন, সেখানেই শ্রোতা হিসেবে দেখতে পেতেন মানসী বৌদিকে। মানসী বৌদি বিধবা, দেবু জ্যাঠার চেয়ে বছর পনের ছোট ছিলেন। ধর্মশাস্ত্র আলোচনায় মানসী বৌদির এই আগ্রহ হয়ত দেবু জ্যাঠার চোখে পড়েছিল, আর এই ব্যাপারটিই দুজনকে কাছাকাছি এনেছিল। দেবু জ্যাঠা প্রায় রোজই দুপুরে মানসী বৌদির বাড়িতে যেতেন, বারান্দায় বসে দুজনে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। মানসী বৌদি দুপুরে ভাত খাবার পর বারান্দায় বসে কখনো কাঁথা, কখনো আসন সেলাই করতেন, এই সময়টাতেই আসতেন দেবু জ্যাঠা, দুজনের ধর্মালাপ জমে যেত। মানসী বৌদি কাঁথা কিংবা আসন সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে নানা প্রশ্ন করে অনেক কিছু জেনে নিতেন দেবু জ্যাঠার কাছ থেকে। আলাপ করতে করতে দুজনের বেলা গড়িয়ে যেত, মানসী বৌদি কোনো কোনো দিন উঠে গিয়ে একবাটি মুড়ি এনে রাখতেন দেবু জ্যাঠার সামনে, সঙ্গে চারটে নাড়ু কিংবা বাতাসা, একটু পর আবার উঠে গিয়ে চা করে আনতেন। দুজনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তখন হয়ত পৌঁছে গেছেন বৃন্দাবনে কিংবা কুরুক্ষেত্রের ময়দানে! মানসী বৌদি ছিলেন দেবু জ্যাঠার ধর্মীয় আলোচনার মুগ্ধ শ্রোতা এবং ভক্ত।

একটা পর্যায়ে দেবু জ্যাঠা নিজের গ্রাম তো বটেই আশপাশের কোনো গ্রামেও ভাগবত-গীতা পাঠ করতে গেলে সঙ্গে যেতেন মানসী বৌদি, পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্নায় গা ভাসিয়ে কিংবা অন্ধকার রাতে টর্চলাইট জ্বেলে মধ্যরাতে দুজনে বাড়ি ফিরতেন, দেবু জ্যাঠা মানসী বৌদিকে বাড়ি পৌছে দিয়ে নিজে বাড়িতে যেতেন। এই যে দেবু জ্যাঠার সঙ্গে মানসী বৌদির সখ্যতা, ভাগবত-গীতা পাঠের আসরে সঙ্গী হওয়া, দিনের পর দিন বসে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে করা, এটাতেই মানুষ রঙ চড়িয়ে তাদের মনের ক্যানভাসে এঁকেছিল প্রেমের-কামের ছবি! পাড়া-পড়শী কিংবা গ্রামবাসীর নানারকম রগরগে কথা শুনে অমলের মনেও অনেকবার প্রশ্ন জেগেছে- সত্যিই কি প্রেম আছে দেবু জ্যাঠা আর মানসী বৌদির মধ্যে? নিজের মন থেকেই উত্তর পেয়েছে অমল- প্রেম নিশ্চয় আছে, নইলে দুজন মানুষ দিনের পর দিন একসঙ্গে গল্প করতে পারে? প্রেম না থাকলে দেবু জ্যাঠা যেখানেই ভাগবত-গীতা পাঠ করেন, সেখানে কেন যাবেন মানসী বৌদি? কিন্তু এ প্রেম হয়ত অন্য রকম, জাগতিক কামনা-বাসনার উর্দ্ধে। এ প্রেম হয়ত একে অপরের সাহচার্য পাবার, মনের কথা ভাগ করে নেবার, শাস্ত্র আলোচনার আর কিছুটা হয়ত চোখের দেখা পাবারও প্রেম!

কিন্তু মানুষ তাদের এই প্রেমকেই দেখত কুৎসিত চোখে, অনুধাবন করত কুটিল মনে, কথাবার্তায় থাকত শারীরিক সম্পর্কের ইঙ্গিত। তাই তারা সহজেই দেবু জ্যাঠাকে বলতে পারত- ‘একদিক গীতা-ভাগবত পড়ে, আবার আরেকদিক বিধবে মাগির সাথে পিরিত করে! ভণ্ড সাধু!’

মজার ব্যাপার হলো এসব যারা বলত, তারাও তাদের বাড়িতে ভাগবত পাঠের জন্য দেবু জ্যাঠাকে আমন্ত্রণ জানাত, আর নিশ্চিতভাবেই সেখানে উপস্থিত থাকতেন মানসী বৌদি। আশ্চর্য ব্যাপার হলো- অনেকেই দেবু জ্যাঠা আর মানসী বৌদির সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে সুষমা জেঠিমার কান ভাঙানি দিত, দুজনের নামে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলত, সুষমা জেঠিমা লোকের কথা শুনতেন, কিন্তু বিস্ময়করভাবে তিনি নীরব থাকতেন এই ব্যাপারটি নিয়ে। কোনোদিন কারো কাছে তিনি এই বিষেয়ে ভালো-মন্দ কিছুই বলতেন না। তিনি কী বুঝেছিলেন যে দেবু জ্যাঠার জ্ঞান ধারণ করবার মতো যোগ্যতা তার নেই, তাই তিনি স্বামীকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন এই জন্য যে- আমি তো স্বামীকে যোগ্য সঙ্গত দিতে পারি না, স্বামী যদি অন্য কারো কাছ থেকে সঙ্গত পেয়ে তৃপ্ত থাকে, থাক না!

আর তাই হয়ত সুষমা জেঠিমা যখন মারা যান তখন মোটেও ভেঙে পড়েন নি দেবু জ্যাঠা, একেবারেই স্বাভাবিক ছিলেন তিনি, যেন দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয়-বিয়োগ হয়েছে, তাকে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে দ্যাখে নি কেউ!

কিন্তু মানসী বৌদি মারা যাবার পর যে খুব ভেঙে পড়েছিলেন দেবু জ্যাঠা, তা তাকে দেখেই বোঝা যেত। বাইরের কান্না লুকোতে পারলেও তার অন্তরের কান্না অনাবৃত হয়ে পড়ত অনেকের কাছে, উদাসীন হয়ে বসে থাকতেন যেখানে-সেখানে। মানসী বৌদি মারা যাবার পর দেবু জ্যাঠা সত্যিকারের নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। মানসী বৌদি মারা যাবার পর তিন বছর বেঁচে ছিলেন দেবু জ্যাঠা, এই তিন বছর জীবন উপভোগ করেন নি তিনি, তার এককালের সুখের দুপুরগুলো কেটেছে বিষন্নতায় আবছায়া ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে।

মানসী বৌদির সঙ্গে দেবু জ্যাঠার সম্পর্ক যেন ছিল বিমূর্ত, ব্যাখ্যাতীত! কিন্তু এই বিমূর্ত সম্পর্কটিকেই মানুষ মূর্ত করে তুলেছিল নোংরা কথা কালিমা দিয়ে, অনেক ব্যাখা দাঁড় করিয়েছিল। অমল আজও বিশ্বাস করে মানসী বৌদির সঙ্গে দেবু জ্যাঠার সম্পর্কটি ছিল স্বামী-স্ত্রীর মতো নয়, আবার প্রথাগত প্রেমিক-প্রেমিকার মতোও নয়, হয়ত বন্ধুত্বের কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু, হয়ত এক পবিত্র নিষ্কাম প্রেমের সখা-সখির! ভগবান নিশ্চয় প্রেম পছন্দ করেন, শ্রীকৃষ্ণ তো প্রেমের রাজা। দুনিয়াতে এসে মানুষ কিছু না করলেও অন্তত প্রেম করা উচিত! অমলের মনে হয়- যদি স্বর্গ-নরক বলে কিছু থেকে থাকে, তাহলে দেবু জ্যাঠা আর মানসী বৌদির অবশ্যই স্বর্গে যাওয়া উচিত!

নাকি স্বর্গ-নরক বলে সত্যিই কিছু নেই? এই যে ওরা সারা বছর এত সব পূজা-পার্বণ করে, আচার-অনুষ্ঠান পালন করে, এতে কি সত্যিই কোনো ফল হয়? মানুষের কিংবা জগতের কোনো মঙ্গল হয়? না কী অয়নের বিশ্বাস মতো এসবই মিথ্যা, সত্য কেবল মৃত্যু, আর মৃত্যুর পর জীবের পুনর্জন্ম হয় না; কোনো স্রষ্টা জগত সৃষ্টি করেন নি, জগত তার আপন নিয়মে চলে, জরা-ব্যাধি-বার্ধক্যে জীবদেহের যেমনি মৃত্যু হয়, তেমনি এই অজস্র গ্রহ-নক্ষত্রের মহাবিশ্ব থেকে একদিন পৃথিবীও বিলুপ্ত হবে!

অয়নকে অনেকেই দেখতে পারে না, বলে যে নিজের জাত ত্যাগ করা আর গরুর মাংস খাওয়া উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে! কিন্তু অয়ন ছেলেটাকে অমলের ভালো লাগে, পরিচ্ছন্ন চিন্তার ছেলে, নিজের যা ভালো লাগে বা নিজে যা বিশ্বাস করে, তাই-ই করে; কোনোদিন কারো কোনো ক্ষতি করে নি, কারো পিছে লাগে নি। বাড়িতে এলে মাঝে মাঝে ওর চেম্বারে আসে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক কথা হয়। অমল ওর কথা শোনে, এতদিনকার লালিত বিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে না পারলেও, অয়নের কথা উড়িয়ে দিতে পারে না অন্য সবার মতো। বরং লেখাপড়া এবং সুন্দর চিন্তা-ভাবনার কারণে অয়নের প্রতি স্নেহ ছাড়াও এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আছে ওর।



(চলবে.....)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৪

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: বরাবরের মতোই ভাল লাগা রইলো!

+++

০২ রা মার্চ, ২০২০ রাত ১১:৩০

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ০২ রা মার্চ, ২০২০ রাত ১০:৩৮

রাজীব নুর বলেছেন: আমি একবার গ্রামে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছি, সেখানে রাতে আমাকে অন্য বাসায় ঘুমাতে হয়েছে।

০২ রা মার্চ, ২০২০ রাত ১১:৩৩

মিশু মিলন বলেছেন: হ্যাঁ, সব গ্রামেই সাধারণত একরম হয়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.