নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

লৌকিক লোকলীলা (উপন্যাস: পর্ব-তেরো)

০৪ ঠা মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৪০

দশ

মেহগনি বাগান থেকে বেরিয়ে রুক্ষ মাটির ডেলার জমিটুকু পেরিয়ে নিচু ভূমির ধানক্ষেতের ভেতরের আলপথ ধরে ওরা তিনজন যখন শ্মশানের সীমানায় পা রাখে তখন চন্দনা নদীর ওপাড়ের গাছপালার মাথার দিকে ঝুঁকে পড়েছে চাঁদ, শ্মশানযাত্রীরা জল ঢেলে চিতা নিভিয়ে চলে যাবার পরও কাঠ পোড়া ছাইয়ের গাদার ভেতর থেকে মৃদু ধোঁয়া উঠছে, পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে আছে বাতাসে। ওরা তিনজন থমকে দাঁড়ায়, বামদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে শ্মশানের উত্তর-পশ্চিমদিকের চিতার খুঁটির দিকে তাকায়। অমলের মনে প্রশ্ন জাগে, কার চিতা জ্বললো আজ? কোন গ্রামের মানুষ ছিল সে? বৃদ্ধ নাকি মধ্য বয়সী? নারী না পুরুষ? একজন মানুষ, হয়ত গতকাল সকালেও স্ত্রী অথবা স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে হোক-দুঃখে হোক এই পৃথিবীতে ছিল। আর এখন? মানুষটি নেই, এই পৃথিবীর কোথাও নেই, আর কোনোদিন তার পদচি‎হ্ন পড়বে না ধুলো কিংবা কাদামাখা পথের বুকে। অবশ্য প্রিয়জন কিংবা পরিচিতজনদের স্মৃতিতে আছে মানুষটি, কিন্তু ক্রমশ মানুষটির স্মৃতি ধূসর হতে থাকবে, তারপর প্রিয়জন বা পরিচিতজনরাও এই পৃথিবী থেকে একদিন বিদায় নেবে, তখন আর মানুষটির স্মৃতি রোমন্থন করারও কেউ থাকবে না, এই মানুষটি যে কোনোদিন পৃথিবীতে এসেছিল তার চিহ্নমাত্র থাকবে না! নাকি সদ্যমৃত মানুষটি এমন কোনো কীর্তি রেখে গেছে যার জন্য অনন্তকাল মানুষ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে? অমল আশপাশের কয়েক গ্রামের অজস্র মানুষের মধ্যে এমন কীর্তিমান মানুষের মুখ খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, ওর মনে হয় -এই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই কোনো সৃষ্টি বা মহৎ কীর্তি রেখে যেতে পারে না, কালের স্রোতে ভেসে যায়, কালের ধুলোয় মিশে যায়। আজকের এই মানুষটিও হয়ত তেমনি মিশে যাবে কালের স্রোতে। অসংখ্য মানুষের মধ্যে অল্প কিছু মানুষ-ই কেবল পারে কালকে অতিক্রম করতে।

বিলাস তাড়া দেয়, ‘হাঁট হাঁট, এমনিতেই মেলা দেরি অয়ে গেছে।’

ওরা তিনজন হেঁটে শ্মশানের দক্ষিণদিকে এগোয়; এদিকটায় দুটো সমাধি মঠ, একটা অনেক পুরোনো আর আরেকটা অপেক্ষাকৃত নতুন, কে জানে কবে কার সমাধি দিয়ে মঠ নির্মাণ করা হয়েছিল। ওরা ছোট মঠটির পাশ দিয়ে আরো দক্ষিণে আসে, বিলাস ঘাড়ের কোদাল মাটিতে রেখে কোমর থেকে বৈদ্যুতিক চার্জের টর্চলাইট বের করে কুঁজো হয়ে মাটির কাছাকাছি হাত নিয়ে টর্চ জ্বালে যাতে আলো বেশি না ছড়ায় আর দূর থেকে কেউ দেখতে না পায়, সংকুচিত আলোয় ওরা তিনজনই নিচু হয়ে কিছু খুঁজতে থাকে, প্রথমে অমলের নজরে পড়ে মাটিতে পুঁতে রাখা পাঁচ-ছয় ইঞ্চি দৈর্ঘের এক টুকরো পাটকাঠি, পরিমল আর বিলাসকে পাটকাঠি দেখিয়ে বলে, ‘এই যে।’

পরিমল আর অমল দিনের বেলায় একবার শ্মশানে এসেছিল, জায়গাটা চি‎হ্নিত করে ছুরি দিয়ে কয়েকটি দাগ কেটে ছোট্ট এক টুকরো পাটকাঠি পুঁতে রেখে গিয়েছে, যাতে রাতেরবেলা এসে জায়গাটা সহজেই খুঁজে পায়। অমল পাটকাঠির কাছের ছুরির দাগগুলো পরীক্ষা করে চুড়ান্তভাবে নিশ্চিত হয় যে এটাই দিনের বেলায় ওদের চিহ্নিত করা জায়গা, বিলাস কোদালখানা সরিয়ে চিহ্নিত জায়গায় রেখে লাইট বন্ধ করে পরিমলের উদ্দেশে বলে, ‘আরেট্টা ধরা, দুই টান দিয়ে শুরু করি।’

অমল আর পরিমল দূর্বা ঘাসের ওপর বসে পড়ে, পরিমল গাঁজা ধরায়, নিজে দুই টান দিয়ে সেটা বাড়িয়ে দেয় বিলাসের দিকে, বিলাস কয়েক পা এগিয়ে এসে পরিমলের হাত থেকে গাঁজার স্টিকটা নিয়ে প্রথমে ছোট্ট একটা টান দেয়, ক্ষণিকের বিরতি দিয়ে এবার কিছুটা দীর্ঘ টান মেরে স্টিকটা অমলের হাতে দিয়ে মুখ ওপর দিকে তুলে চোখ বুজে ধোঁয়া ছাড়ে সময় নিয়ে আস্তে আস্তে, তারপর কোমরের গামছাখানা খুলে দাঁতে চেপে ধরে ধুতির ঢিলে কাছাটা শক্ত করে বাঁধে, এরপর গামছাখানা কোমরে কষে বেঁধে কোদাল হাতে নিয়ে কুপিয়ে চি‎হ্নিত জায়গার মাটি খুঁড়তে শুরু করে।

বিলাসের শ্বাস-প্রশ্বাস আর গলার রুদ্রাক্ষের মালার শব্দ, শক্ত মাটিতে কোদালের আঘাতের শব্দ আর ঝিঁঝিপোকার ডাক; এছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। অন্ধকারে আলো জ্বেলে বেশকিছু জোনাকি উড়তে থাকে শ্মশানের নানা দিকে, গাঁজায় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নেশাতুর চোখে অমল জোনাকির আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, একটা জোনাকি উড়তে উড়তে ওর খুব কাছে চলে এলে সে বামহাত বাড়ায় আলোর দিকে, কিন্তু মুহূর্তেই জোনাকি দূরে সরে যায়। জোনাকির দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয়, জোনাকির অমন সুন্দর আলো আছে, সেই সঙ্গে যদি মুখ দিয়ে বাঁশির মতো চিকন সুর তুলতে পারত, কী আশ্চর্য সুন্দরই না হতো! বাঁশির মতো না হলেও নিদেন পক্ষে মৌমাছির মতো গুঞ্জন তুলতে পারলেও মন্দ হতো না। অথচ জোনাকির স্বর শোনাই যায় না!

অমলের হাত ঘুরে গাঁজা এখন আবার পরিমলের হাতে, অমল কোমরের গামছা খুলে ঘাসের ওপর পেতে মাথার নিচে দু-হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকায়, আকাশের বুকে ফুলের মতো ফুটে থাকা একটার পর একটা নক্ষত্রে দৃষ্টি বুলায়। ছেলেবেলায় গরমের সন্ধ্যায় উঠোনে পাটি পেতে কখনো জেঠিমার কোলে মাথা রেখে, কখনো জেঠিমার পাশে শুয়ে তার হাতের তালপাখার বাতাস খেতে খেতে আকাশ-চাঁদ-তারা ইত্যাদি সম্পর্কে কৌতুহলী প্রশ্ন করত অমল- ‘জেঠিমা, আকাশটা কোন গ্রামের পরে শ্যাষ অইচে?’ ‘মাটির সাথে মিশিচে?’ ‘সেই গ্রামের মানুষ আকাশ ছুঁবার পারে?’ ‘চাঁদ মামা দিনের বেলা কনে যায়?’ ‘তারারাও দিনের বেলা ঘুমায়?’।

জেঠিমা আকাশ-চাঁদ-নক্ষত্র সম্পর্কে তার ছেলেবেলায় শোনা লোকগাঁথাগুলোই অমলকে বলতেন, নক্ষত্র সম্পর্কে বলতেন যে মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়। অমল সে-সব বিশ্বাস করত, বহুদিন যাবৎ সেই ভ্রান্ত বিশ্বাস ওর মধ্যে প্রোথিত ছিল। তারপর আরো বড় হয়ে যখন জানতে পারে যে অসীম আকাশ কোনো গ্রামের পরে কোথাও মাটিতে মিশে যায় নি; চাঁদ তার মায়ের অতি দূর সম্পর্কেরও কোনো ভাই নয়, পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ কখনো ঘুমায় না, সারাক্ষণ কক্ষপথে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে; মানুষ মরে গেলে তারা হয় না, ওই তারাগুলো আসলে বিশাল বিশাল নক্ষত্র, যার কোনো কোনোটার আয়তন আমাদের এই পৃথিবীর চেয়েও অনেক বড়; তখন নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পায় সে! মনে হয়- না জানার কারণে যুগযুগ ধরে মানুষ এরকম কত মনগড়া গল্পগাঁথা বিশ্বাস করত, মিথ্যে বিশ্বাস নিয়ে বাঁচত, এখনো বহু মানুষ মহাবিশ্ব সম্পর্কে প্রাথমিক বিষয়গুলো না জেনে বা অনেকে জানার পরও মিথ্যে গল্পগাঁথায় বিশ্বাস রেখে বাঁচে! ওরা নিজেরাও ধর্ম-কর্ম করে স্বর্গ প্রাপ্তির লোভে, স্বর্গ-নরক আছে কী নাই তার কিছুই জানে না, কে জানে ওরাও হয়ত মিথ্যে বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছে!

স্বর্গ নরক থাকুক বা না থাকুক, মৃত্যু আছে, মৃত্যু সত্য; মৃত্যু অমলের কাছে এক আশ্চর্য বিস্ময়ের, বেদনারও। বাল্যকালে তাদের পাশের বাড়ির সবুজের ঠাকুমা মারা গেলে প্রথম শ্মশানযাত্রী হয়েছিল সে, তারপর বহুবার শ্মশানযাত্রী হয়েছে, তার মনে পড়ে সেইসব মৃত মানুষের মুখ।

সেই ছেলেবেলা থেকে এখন পর্যন্ত ওদের গ্রাম এবং আশপাশের কয়েক গ্রামের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে অমল চিনত; তাদের কেউ ছিলেন বিত্তবান এবং প্রবল প্রতাপশালী গ্রামের মাতব্বর গোছের মানুষ, আবার কেউ ছিলেন দরিদ্র নিরীহ গোবেচারা ধরনের। কেউ উত্তম হৃদয়ের পরপোকারী, কেউ দাম্ভিক-আত্মকেন্দ্রিক, কেউ কলহপ্রিয়, কেউ আত্মমগ্ন, কেউ দাঙ্গাবাজ বা মামলাবাজ, কেউ ভীতু, কেউ সৎ, কেউ অসৎ, কেউ মিথ্যাবাদী, কেউ সত্যবাদী, কেউ চোর, কেউ দানশীল; নানান শ্রেণির, নানান পেশার, নানান চারিত্রিক বৈশিষ্টের মানুষের শবদেহ পুড়ে নিঃশ্বেষ হয়েছে এই শ্মশানের চিতায় আর যাদেরকে সমাধি দেওয়া হয়েছে তাদের রূপ-যৌবন সব মিশে গেছে মাটিতে। একে একে সেইসব মানুষের মুখ মনে পড়ে নেশায় চুর অমলের, এমনকি শত শত বছর আগের মৃত মানুষেরাও ভিড় করে ওর কল্পনার তেপান্তরে, যখন এই চন্দনা নদী ছিল যুবতী, খরস্রোত বইত বুকে, সেই খরস্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হয়ত ভেসে যেত বড় বড় বাণিজ্য নৌকা কিংবা ছোট্ট ডিঙ্গি, সেইসব অতীতকালের হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষদের একটা শারীরিক অবয়ব তৈরি হয় ওর মনে, যদিও মুখগুলো অস্পষ্ট। তবু অমলের অন্তর্জগতে ভিড় করে কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া জগতের সেইসব মানুষেরা; এই চন্দনার বুকের ওপর দিয়েই হয়ত ভেসে যেত নব-বিবাহিত দম্পতি আর বরযাত্রী বোঝাই অসংখ্য বিবাহের নৌকা, আবার এই চন্দনার বুকের ওপর দিয়েই হয়ত একদিন তাদের মৃতদেহ নিয়ে ভেসে আসত শ্মশানযাত্রী বোঝাই নৌকা। কাল, কাল, কাল গিলে খেয়েছে কতকিছু; কত মানুষ আর প্রাণিকে খেয়েছে, চন্দনা নদীকেও খেয়ে প্রায় শেষ করে ফেলেছে! মহাকাল ওর পূর্ব-পুরুষদের খেয়েছে, একদিন ওকেও খাবে, ওর ছেলেমেয়েকেও খাবে, নাতি-পুতিকেও খাবে, বংশ পরম্পরায় যারাই জন্মাবে তাদেরকেই খাবে! অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শরীরে বইবে ওর রক্ত প্রবাহ। কেমন হবে তারা দেখতে? কেমন হবে তাদের গায়ের রঙ কিংবা উচ্চতা? কেমন হবে তাদের আচরণ? সবাই কি ওর বাবার মতো লম্বা আর কালো দেখতে হবে, নাকি ওর মতো মাঝারি উচ্চতার হবে? সবাই কি ওর আর ওর বাবার মতো সৎ মানুষ হবে নাকি কেউ কেউ ওর বাবার সৎভাই, অর্থাৎ ছোট কাকার মতো ধুরন্ধর আর কলহপ্রিয়ও হবে? নাকি কেউ ওর জ্যাঠার মতো সৌখিন এবং অদ্ভুত স্বভাবের হবে? নিশ্চয় সৎ-অসৎ উভয়ই হবে। তারা কি জানবে ওর কথা, কেউ কি জানবে যে অমল নামে একজনের জিন-সেল বহন করছে তারা? কেউ কি স্মরণ করবে ওর কথা?

ভবিষ্যৎ থেকে আবার অতীতে ফেরে অমল, ওর স্মৃতির গলিপথ ধরে হেঁটে আসে অসংখ্য মৃত মানুষের মিছিল, তাদের অনেকেই ওর চেনা, আবার অনেকে অচেনা। দাদু প্রবোধ চন্দ্র দাসের মুখ চিনতে পারে সে, দাদুর মাথায় সাদা চুল, গাল বসা; গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পরনে সাদা ধুতি। দাদুকে জীবিত দ্যাখে নি অমল, দাদুর বৃদ্ধ বয়সের একটা বাঁধানো সাদাকালো ছবি আছে ওর ঘরের দেয়ালে, ছবিটার জায়গায় জায়গায় লালচে হয়ে গেছে, তবু মুখের গড়ন স্পষ্ট বোঝা যায়। সেই ছবি থেকেই দাদুর জীবন্ত অবয়ব কল্পনা করে নিয়েছে অমল। দাদু ছিলেন দরিদ্র কৃষক, হয়ত দাদু তেমন সৌখিন মানুষ ছিলেন না, কিংবা হয়ত দাদুর তারুণ্যে বা প্রৌঢ় বয়সেও তাদের জামালপুর বাজারে কোনো স্টুডিও ছিল না, ফলে দাদুর তরুণ বয়সের কোনো ছবি নেই। আর ঠাকুরমার কোনো ছবি-ই নেই।

দাদুর বাবা এবং দাদুর মায়েরও কোনো ছবি নেই, ফলে তাদের জীবন্ত অবয়ব অমল কল্পনা করতে পারে না, ওর কল্পনায় তাদের যে মুখাবয়ব আসে তা খুবই ঝাপসা। মৃত মানুষের মিছিলে সবার আগে বাবার মুখটি স্পষ্ট দেখতে পায়। লম্বা গড়নের মানুষ, গায়ের রঙ কালো, ব্যাকব্রাশ করা মাথার প্রায় সব চুল সাদা। গায়ে সাদা শার্ট, পরনে কালো প্যান্ট, পায়ে চামড়ার কালো স্যান্ডেল; ডানহাতের মধ্যমা, অনামিকা আর কনিষ্ঠায় অরবিন্দ জ্যোতিষীর দেওয়া পাথর বসানো একটি সোনার আর দুটি রুপার আংটি।

বাবা অবিনাশ কুমার দাস যখন মারা যান তখন অমলের বয়স পঁচিশ, বাবার উৎসাহেই অমল আজ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, কৈশোরকাল থেকেই বাবা তাকে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হবার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। বাবার চেম্বারে এবং বাড়িতে শোবার ঘরে ডাঃ ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের বেশ বড় দুটো বাঁধানো ছবি ছিল, চেম্বারের ছবিটি এখনো আছে। হ্যানিম্যান ছিলেন বাবার দ্বিতীয় ভগবান, রোজ সকালে উঠেই হ্যানিম্যানের ছবিতে প্রণাম করতেন! অমল প্রণাম না করলেও ওর শ্রদ্ধাবোধ ছিল এবং এখনো আছে মাথার মাঝখানে টাক আর দু-পাশে সাদা চুলের শেতাঙ্গ বৃদ্ধ ভদ্রলোকের প্রতি। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর বাবার পরামর্শেই ঢাকার মিরপুরের সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেয় এবং চান্সও পেয়ে যায়। কলেজ হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতো সে। ওর ইচ্ছে ছিল বি,এইচ,এম,এস (ব্যাচেলর অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারী) পাস করার পর সুযোগ পেলে জার্মানী গিয়ে এম,পি,এইচ কিংবা পি,ডি,এইচ,ই এর মতো উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার পর দেশে ফিরে কোনো হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করবে আর পাশাপাশি মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেবে। কিন্তু পাঁচ বছর একাডেমিক শিক্ষার পর যখন হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক বছরের ইন্টার্নি করছিল, তখন ওর বাবা মারা যান, তখনো ইন্টার্নি তিনমাস বাকি। বাবা মারা যাবার পর যেন অথৈ সাগরে পড়ে অমল! কেননা বাবার ডাক্তারির রোজগারেই ওদের তিন-ভাইবোনের লেখাপড়া এবং সংসার চলত। বাবা তেমন টাকা-পয়সা জমিয়েও রেখে যান নি, পরিবারের সকলের অন্নবস্ত্রের যোগান আর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচের পর একজন গ্রাম্য হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের পক্ষে সেটা সম্ভবও ছিল না। ছোট ভাই তখন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়ছে, বোন পড়ছে জামালপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট। ফলে ইন্টার্নি শেষে গ্রামে ফিরে আসে সে, বাবার চেম্বারে প্র্যাকটিস শুরু করে সংসারের হাল ধরতে আর ছোট দুই ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ চালাতে। তার আর উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানী যাওয়া হয় নি, কোনো হোমিওপ্যাথিক কলেজে শিক্ষকতাও করা হয় নি। বাবার মতোই সে-ও আজ একজন সাধারণ গ্রাম্য হোমিওপ্যাথি ডাক্তার।

বাবার মধ্য এবং প্রৌঢ় বয়সের স্মৃতি অমলের কাছে খুবই জীবন্ত, তবে বাবার যৌবনের ছবিও কল্পনা করতে পারে, কেননা বাবার যুবক বয়সের বেশ কিছু ছবি তাদের পারিবারিক ফটো অ্যালবামে আছে।

দাদু প্রবোধ চন্দ্র দাস, বাবা অবিনাশ কুমার দাস, আর সে অমল কুমার দাস; এই তিন পুরুষের ছবি আছে, এর আগের লক্ষ লক্ষ প্রজন্মের কারো ছবি নেই। দাদুর এবং বাবা-মায়ের ছবি স্ক্যান করে ফেসবুকে আপলোড করে রেখেছে সে, ফলে এই তিন প্রজন্মের ছবি থেকে যাবে, অনাগত প্রজন্ম দেখতে পাবে তাদেরকে, পূর্বের লক্ষ লক্ষ প্রজন্মের মানুষদের মতো তাদের স্মৃতি এই পৃথিবী থেকে একেবারে নিশ্চি‎হ্ন হয়ে যাবে না।

অমল এমনিতেই কল্পনাপ্রবণ, তার ওপর বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কদাচিৎ যখন মদ-গাঁজা খায় তখন ওর কল্পনার দিগন্ত যেন মহাবিশ্বের মতো অসীম হয়ে যায়; বাস্তব, অবাস্তব, পরাবাস্তব সব ভর করে মাথায়!

পরিমলও কখন গামছা পেতে পাশে শুয়ে পড়েছে তা খেয়াল করে নি অমল। বিলাস একনাগাড়ে কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে, কোদালের মাটি ফেলে অল্পক্ষণের জন্য থেমে অমল আর পরিমলের সটান দুটো দেহের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নেশার ঠ্যালায় আবার ঘুমা পড়িস নে!’

বিলাসের কথায় ঘোর কাটে অমলের। পরিমল বলে, ‘আরে না ব্যাটা, আমরা কী মাতাল কানাই নাকি!’

পরিমলের বলার ধরনে হেসে ওঠে অমল আর বিলাস। মাতাল কানাই- মানে ওদের গ্রামের কানাইলাল মজুমদার। একবার গ্রামের একজনের শবদেহ দাহ করতে রাত আটটা-নয়টার দিকে শ্মাশানযাত্রীদের সঙ্গে শ্মশানে এসেছিল কানাইলাল, সে বাজার থেকে মদ পান করে এসেছিল আর নেশার ঘোরে কোনো এক সময় শ্মশানের একপাশে গিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়েছিল। গভীররাতে মৃতদেহ দাহ করা শেষ হলে অন্য শ্মশানযাত্রীরা শ্মশান ছেড়ে বাড়ির পথে ফিরলেও কানাইলাল তখন গভীর ঘুমে অচেতন, কেননা অন্ধকারে তাকে কেউ খেয়াল করে নি। কানাইলালের যখন ঘুম ভাঙে তখন শ্মশানের ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে একা, উঠেই ভয়ে দৌড়তে শুরু করেছিল বাজারের দিকে। বাজারের ভেতরে গিয়ে পাহাড়াদারদের দেখতে পেয়ে তাদের দিকে ছুটে যাবার সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে।

পাহাড়াদাররা এগিয়ে এসে তার মাথায় জল ঢেলে, জাঁতি দিয়ে দাঁতলাগা ছাড়িয়ে তাকে সুস্থ করে তুলেছিল। সুস্থ হবার পর কানাইলালের মুখ থেকেই সকল বৃত্তান্ত জানা যায়, এই ঘটনার পর লোকে কানাইলালের নাম দেয়- মাতাল কানাই!

পরিমল হঠাৎ নিচুস্বরে গেয়ে ওঠে-
‘তুমি আর একবার আসিয়া
যাও মোরে কান্দাইয়া
আমি মনের সুখে একবার
কানতে চাই।’

পরিমলের গলায় তেমন সুর নেই, তবু শুনতে ভালো লাগে অমলের, সুরে কান পেতে তাকিয়ে থাকে দূর আকাশের তারার দিকে, এমনি এক তারা-ঝলমলে রাতে ওদের স্কুলের খেলার মাঠের উত্তরদিকের পুরোনো অর্ধভগ্ন নির্জন শিবমন্দিরের সামনের সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে ছিল আশালতার সঙ্গে। ওরা তখন ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে, সহপাঠী রিতার বিয়েতে গিয়েছিল দুজনই, রিতাদের বাড়ি নলিয়ায়, শ্যামামোহন ইনস্টিটিউশনের কাছেই। রাতে বিয়েবাড়ির হই-হট্টগোল থেকে বের হয়ে ওরা দুজন চলে যায় নির্জন মন্দিরের সামনে কিছুটা সময় নিরিবিলি কাটানোর জন্য। তিন বছর প্রেম করার পর সেদিনই প্রথম অমল ঘাসের ওপর শুয়ে দুরু দুরু বুকে আশালতাকে নিজের বুকের ওপর তুলে এনে জড়িয়ে ধরে, আশালতার স্তনের চাপ অমলের বুকে শিহরণ জাগায়, আশালতা কিছু না বলায় ওর সাহস আরো বেড়ে যায়, আলত চুম্বন করে আশালতার কপালে। আশালতা বলে, ‘এই কী করিস!’

‘একটু আদর করবার দে। তোর ভালো লাগতেচে না?’
‘হুম। কিন্তু এ যে পাপ, আমাগের বিয়ে অয় নাই।’
‘তুই আমারে ভালোবাসিস না?’
‘ভালো না বাসলি রাতেরবেলা তোর সাথে এই জায়গায় আসতাম!’
‘তালি আমাগের বিয়ে অয়ে গেছে।’
‘ধ্যাৎ!’

‘ধ্যাৎ না, সত্যি! হিন্দুশাস্ত্র মতে পাত্র-পাত্রী নিজেরা ভালোবেসে যদি একসাথে থাকে বা সেক্স করে, তাকে গান্ধর্ব বিবাহ বলে। মহাভারতে দুষ্মন্ত আর শকুন্তলা প্রথম দেখাতেই একে অন্যকে ভালোবাসছিল, সেক্স করছিল, শকুন্তলা সন্তানের জন্মও দিছিল।’
‘তুই মহাভারত পড়ছিস?’
‘গতমাসে শেষ করলাম। তোরে দেব, পড়ে ফেলিস। পড়লি তোরও অনেক বিষয়ে সংকীর্ণতা কাটে যাবেনে। তাইলে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার মতো আমরাও...!’
আশালতা অমলের বাহুতে চিমটি কেটে বলে, ‘এই খবরদার, তুই সেই ধান্দা করিসনে!’

‘না না, পাগল তুই! দুষ্মন্ত রাজা ছিলেন, তার ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। আর আমি এক সাধারণ হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের ছেলে, এখনো ছাত্র, বাপের টাকায় খাই-পরি, এই বয়সে বাবা হলি বাচ্চারে খাওয়াবো কী! অত ঝামেলার দরকার নাই বাপু, আপাতত এট্টু আদর করবার দে।’

অমল আশালতাকে ঘাসের ওপর চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে ওর মুখের ওপর ঝুঁকে ঠোঁট চুম্বন করে, একে অপরের ঠোঁটের নোনা স্বাদে বুঁদ হয় জীবনে প্রথমবারের মতো, দুজনের রক্ত প্রবাহ চঞ্চল হয়, আশালতা হাতের নখগুলো দিয়ে আঁকশির মতো আঁকড়ে ধরে অমলের বাহু-কাঁধ-গলা, চিরুনির মতো আঙুল চালায় অমলের চুলে, দীর্ঘ চুম্বনের প্রভাবে দুজনই হাঁফিয়ে ওঠে। আশালতা অমলের শেভ করা মসৃণ গাল আর থুতনি কামড়ে ধরে, দুজনেরই শরীর চায় আরো নৈকট্য, আরো গভীর স্পর্শসুখের স্বাদ। কিন্তু জোয়ারের জলের মতো ধাবমান সুখের নদীতে সংযমের বাঁধ দেয় দুজনই, চুম্বন শেষে দুজনের ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হলেও আশালতা নিজের শরীরের ওপর থাকা অমলের মুখে আর গলায় অনেকগুলো নাতিদীর্ঘ চুম্বন করে, অমলও আশালতাকে। আশালতা অমলের চুলে নাক গুঁজে আদর করতে করতে বলে, ‘থাক, তুই এভাবেই থাক, আমার ভালো লাগতেচে!’

অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়, দুজনের কেউই কথা বলে না, কেবল চোখ বুজে দুজন দুজনকে স্পর্শের সুখটুকু উপভোগ করতে থাকে, শেষে অবস্থা এমন হয় যে রাত বেড়ে যাওয়ায় অমল উঠতে চাইলেও আশালতা উঠতে চায় না, অমলের মাথা বুকে চেপে রেখে বলে, ‘আরেকটু থাকি অমল, তোরে ছাড়ে যাবার ইচ্ছে করতেচে না।’

অমল আশালতার গলার কাছে মাথা রেখে ওর মুখে আদুরে হাতের পরশ বুলাতে বুলাতে বলে, ‘আমারও কী তোরে ছাড়ে যাবার ইচ্ছে করতেচে? কিন্তু রাত যে বাড়ে যাতেচে, সবাই যদি আমাগের খোঁজে!’
‘খুঁজুক!’
‘যদি জানাজানি হয়?’
‘হোক!’
‘যদি আমাগের নামে কলঙ্ক রটে?’
‘চুপ কর তো, রটে রটুক!’

পাঁচটি মাত্র শব্দ মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়, কিন্তু মিলিয়ে যাবার আগে মধুর নিনাদ তুলে যায় অমলের শ্রবণেন্দ্রিয়ে আর হৃদয়ে, যার রেশ আজ এত বছরেও ম্লান হয় নি। সেদিনের পর ওদের সম্পর্ক আরো মজবুত হয়, একে-অপরের প্রতি টান বহুগুণে বেড়ে যায়। সেই প্রথম অমল অনুভব করে শারীরিক স্পর্শ মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক অধিক দৃঢ় করে।

তারপর থেকে সুযোগ পেলেই নির্জন কোনো জায়গায় আশালতার গা ঘেঁষে বসে থাকত অমল, আশালতাও ওর হাতের মধ্যে হাত রাখত, হাত নিয়ে নিজের মুখে ছোঁয়াত। সিনেমা দেখতে গিয়ে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে একজন আরেকজনের কাঁধে মাথা রেখে সময় অতিবাহিত করত। কী যে ভালো লাগত তখন আশালতার স্পর্শ, ওর জীবনে ভালোবাসার অর্থই বদলে গিয়েছিল, যেন ওর জগতটাই পাল্টে দিয়েছিল আশালতা!

আহা, আশালতা; অমলের কাছে এক অপার বিস্ময়ের নাম, বর্ণিল দিনযাপনের নাম, অনাবিল সুখের নাম!






(চলবে.....।)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:০৪

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অনিন্দ্য সুন্দর লেখনী ।

০৪ ঠা মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৫৪

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

২| ০৪ ঠা মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৪৬

মনিরা সুলতানা বলেছেন: সব পর্বই পড়ে যাচ্ছি ! চমৎকার লেখনী ;

০৪ ঠা মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৫৪

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

৩| ০৪ ঠা মার্চ, ২০২০ বিকাল ৫:০৯

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর লিখেছেন। ভাষা সুন্দর।

০৪ ঠা মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৫৫

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.