নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জল মেঘ পাহাড়ের নৈসর্গিক মিলনমেলা

২৩ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৮:০৯

প্রবল ঝাঁকুনি আর সহযাত্রীদের চিৎকারে ঘুম ভাঙতেই জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি ভোরের নীল আকাশ, রাশি রাশি ধূসর-কালো মেঘের অন্তরালে ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি নিচে নামাতেই দেখি জল থৈ থৈ করছে অনেক দূূরের সবুজরেখার গ্রাম পর্যন্ত, জলের আয়নায় আকাশ-মেঘচ্ছবি, মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো সবুজ অরণ্যের স্থলভাগ, দিগন্তে তাকালে মনে হয় যেন ঐ রাশি রাশি চঞ্চল ধূসর-কালো মেঘ ভেঙে পরবে সবুজরেখার গ্রামগুলোর ওপর! জানালা দিয়ে আসা শীতল বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে আর দৃষ্টি এবং চিত্ত জুড়িয়ে দিচ্ছে জানালার বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্ধর্য। তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে বাস, জায়গাটা কোথায় বুঝতে পারছিলাম না, তবে অনুমান করতে পারছিলাম সুনামগঞ্জের কাছেই কোথাও হবে। রাস্তার খানা-খন্দেও বাসের গতি না কমানোয় আমরা যারা পিছনদিকের যাত্রী, তারা একটু পর পরই ছিট থেকে শূন্যে ভেসে উঠছিলাম। ড্রাইভারকে ধমকাতে ধমকাতে পিছনের কয়েকজন সহযাত্রী তেড়েফুঁড়ে সামনের দিকে গেল, তাতে কাজ হলো, বাসের গতি কিছুটা কমলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস লোকালয়ে ঢুকে পড়লো, দোকানের সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারলাম জায়গাটা সিলেটের বিশ্বনাথ। বাজারের মতো জায়গাটা পার হতেই আবার থৈ থৈ জল, মাঝে মাঝে ঘর-বাড়ি আর দৃষ্টি জুড়োনো সবুজ প্রকৃতি। রাস্তার ধারে, দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন স্থলভাগে, মানুষের পুকুর-ডোবার ধারের বিপুল কচুবন যেন আমার চোখে মায়াঞ্জন বুলিয়ে দিচ্ছে! কচুশাক আমার প্রিয়খাদ্য। আমার দৃষ্টি বারবার পতিত হতে লাগলো সবুজ কচুপাতায়। আহা, ঢাকায় আমরা এমন সতেজ-সুন্দর কচুপাতা পাই না। আমার দৃষ্টি বারবার কচুবনে যাচ্ছে দেখে নিশ্চয় অনেকের মনে পড়ে গেছে একটি চিরায়ত বাংলা প্রবাদ-রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু! কে জানে, কোন কালে কোন হতভাগা এই প্রবাদ রচনা করেছিল কচুগাছের মাহাত্ম্য না জেনেই! কচুশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম ও লৌহ। ভিটামিন এ জাতীয় খাদ্য রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে, ভিটামিন সি শরীরের ক্ষত সারাতে সাহায্য করে, কচু রক্তের কোলেস্টরল কমায়, এরকম আরো কতো গুণ কচুর। তাছাড়া ঐতিহাসিকভাবেও এই বাঙালি জাতি কি কচুগাছের কাছে কম ঋণী! ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে (১১৭৬ বঙ্গাব্দ, ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ), ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে, দেশভাগের পর শরণার্থী হয়ে, ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী থাকার সময় এবং দেশে ফিরে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে এই কচু আর কচুর শাক খেয়ে কী কম মানুষ প্রাণ রক্ষা করেছে! কচু মাহাত্ম্য এটুকুই থাক, দেখি সামনে আরো কী বিস্ময় আছে।

এ বছর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি, অনেকদিন এমন ঘন সবুজও দেখিনি, ফলে যা দেখছি তাই ভাল লাগছে; শহরের কংক্রিট দেখতে দেখতে প্রাণ হাঁফিয়ে উঠাতেই পর্যটন এজেন্সি গ্রীন বেল্টের সঙ্গে বের হয়েছি হাওর দেখার উদ্দেশে।
ছাতক পেরিয়ে সবুজ দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম সুনামগঞ্জ শহরের শ্যামলী বাস কাউন্টারের সামনে। বাস থেকে নামতেই গ্রীনবেল্টের প্রতিষ্ঠাতা এবং গাইড তরুণ শাহেদ বাস কাউন্টারের উপরে দোতলায় উঠার সরু একটা সিঁড়ি দেখিয়ে আমাদেরকে জানালেন, ‘আপনারা কেউ বাথরুমে যেতে চাইলে যেতে পারেন, ওপরে বাথরুম আছে।’

কাউন্টারের সোফায় ব্যাগ রেখে ওপরে উঠে দেখি সরু গলিতে লম্বা লাইন, লাইনের মাথা দেখা যাচ্ছে না, কেননা লাইনটা সোজা এগিয়ে বামদিকে বেঁকে গেছে। অর্থাৎ এল আকৃতির লাইন, আমি অবস্থান করছি এল-এর মাথায়, গন্তব্য শেষে। অনেকক্ষণ পর পর একজন করে মানুষ বেরিয়ে আসছে, জানতে পারলাম লাইনের সামনে একটা মাত্র টয়লেট, এই সকালবেলায় ওটাই তখন সকলের কাক্সিক্ষত জায়গা!

কী আশ্চর্য, সুনামগঞ্জ একটি পর্যটন শহর, শ্যামলী পরিবহন দেশের সবচেয়ে বড় এবং প্রতিষ্ঠিত পরিবহন কোম্পানীর একটি, আমাদের সামনেই তিন-চারটি বাস এসে থামলো কাউন্টারের সামনে, হয়তো পরে আরো এসেছে; শত শত যাত্রী, অথচ টয়লেট মাত্র একটি! এই কী কোনো সভ্য জাতির নমুনা! টয়লেটে না ঢুকেই আমি টয়লেটের ভেতরের পরিবেশ সম্পর্কে আঁচ করতে পারছিলাম, ধীরগতিতে লাইন এগোচ্ছে দেখেও মরিয়া হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে রইলাম, কেননা একে তো সকালবেলা, তার ওপর এরপরে লেগুনায় চড়ে দেড় ঘণ্টার অধিক সময় ধরে যেতে হবে তাহিরপুর উপজেলায়।

সকলের প্রাতঃকৃত্য শেষ হলে তিনজন গাইডসহ আমরা প্রায় পঁয়ত্রিশজন পর্যটক তিনটে লেগুনায় চড়ে বসলাম। আমার ডান পাশে বসেছে একটি ছেলে, তার পাশে একটি মেয়ে। দু’জনে উচ্চস্বরে গল্পজুড়ে দিলো, গল্পের বিষয়-বিসিএস পরীক্ষা, আইএলটিএস, স্কলারশীপ। আমার উল্টোদিকে বসেছে এক দম্পতি, তারাও নিজেদের মতো কথা বলছে নিচু স্বরে। আমার বামদিকে দুটো ছেলে তাদের উল্টোদিকে বসা দুটো ছেলের সঙ্গে ব্যাংক সংক্রান্ত বিষয়ে গল্প করছে। আমি সামনে বসা সহযাত্রীদের ফাঁকফোঁকর দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছি, ফোঁট ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। একটা নদীর ওপরের ব্রিজ পার হবার সময় লেগুনার পিছনের দাঁড়িয়ে থাকা হেলপারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা, এই নদীর নাম কী?’
লেগুনার গর্জন আর ঝাঁকিতে হেলপার হয়তো আমার কথা শোনেনি, পাশে বসা ছেলেটি বললো, ‘রূপসা নদী।’

আমার কান ধাক্কা খেল, রূপসা তো খুলনা অঞ্চলের নদী; এটা সুরমা হতে পারে, কালনী হতে পারে, রূপসা কোনোভাবেই নয়। যুবকের ভূগোলজ্ঞানে যুবতী মুগ্ধ, ‘তুমি কি নদী নিয়েও গবেষণা করো?’
‘নদী বিষয়ে পড়তে হয়, বিসিএস এ প্রশ্ন আসে তো।’
আমি গুগোল ম্যাপে দেখলাম, ‘এটা সুরমা নদী।’

মনে পড়লো কালরাতে যুবকটির হাতে একটা বই দেখেছিলাম, একবারও পড়তে দেখিনি। বুঝলাম, এ মেঘ যতো গজরাবে ততো বর্ষাবে না। মনে মনে সুন্দরী যুবতীকে বললাম, ‘সুরঞ্জনা, যুবকের সাথে তুমি যেও নাকো আর!’

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই লেগুনা ছুটতে লাগলো সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর রোডে। আমার ডানে চলছে বিসিএস পরীক্ষা, আইএলটিএস, স্কলারশীপ আর পুঁথিগত বিদ্যার জাহির। বামদিকে ব্যাংক বিষয়ক আলাপ। আমি ঢাকা থেকে এসেছি মুক্তির নেশায়, তাই ঢাকা ছেড়েই ভুলে গেছি ঢাকা আর ঢাকার দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞের কথা। দুটোদিন সব ভুলে সুনামগঞ্জের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে যেতে চাই। দু-পাশের আলোচনায় আমি কিছুটা বিরক্ত, শুনতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে শুনতে হচ্ছে, লেগুনা থেকে না নামা পর্যন্ত এ থেকে মুক্তি নেই। তবে একটা অভিজ্ঞতা এই হলো যে কিছু মানুষ নগরজীবনের ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনে গেলেও তাদের মন নগর জীবনের একঘেয়েমিতেই ঘরপাক খায়, নগরের বন্ধন থেকে তাদের মন মুক্তি পায় না, নগর আর নগরের কোলাহল তাদের সাথে সাথে ঘুরে ফেরে। ফলে পর্যটনে এসেও তারা প্রকৃতির পূর্ণ সৌন্ধর্য অবলোকন করতে পারে না, মুক্তির স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। সিদ্ধান্ত নিলাম যে যাই করুক, বিরক্ত হবো না। বরং প্রাণ-প্রকৃতি দেখার পাশাপাশি এইসব নাগরিক মানুষগুলোর আচরণের ওপর গভীর দৃষ্টি রাখবো, তাতে মানুষ হিসেবে নিজেকে যেমনি শোধরাতে পারবো, তেমনি লেখক হিসেবে সমৃদ্ধ হবো।

দেড় ঘণ্টার লেগুনাযাত্রা একটু কষ্টকর হলেও রাস্তার একদিকে জল আর আরেকদিকে সবুজ মাঠ-লোকালয় দেখতে দেখতে আর আমার দু-পাশের সহযাত্রীদের নাগরিক আলাপ শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম তাহিরপুরে। তাহিরপুর বাজারে নেমে দেখি আমাদেরই মতো আরো অনেক পর্যটক নামছে লেগুনা থেকে, অর্থাৎ এখানে পর্যটক ভালই আসে। কিন্তু বাজারের ভেতরের রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় জল-কাদা জমে আছে। বর্ষায় আমাদের দেশের পথ-ঘাটের অবস্থা খারাপ থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক পর্যটক পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হয় না। তবু আমার মতো কিছু মরিয়া ভ্রমণপিপাসুর প্রাণ যখন শহরে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে ওঠে, তখন পথ-ঘাটের কষ্টের কথা চিন্তা না করে বেরিয়ে পড়ি। বাংলাদেশ সরকার কখনোই পর্যটনশিল্প-বান্ধব ছিল না, এখনো নেই, জানি না ভবিষ্যতে হতে পারবে কি না।

গাইডরা আমাদেরকে একটা বিল্ডিং এর নিচতলায় খাবার হোটেলে নিয়ে গেল, সেখানে পর্যটকদের ভিড়, দাঁড়ানোর জায়গারও অভাব। তবু আমাদের দলের কেউ কেউ হোটেলে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলো যাতে কেউ উঠে পড়লেই খালি সিটে বসা যায়। এখন সকাল, দলে দলে পর্যটক আসছে, সকালবেলায়ই হয়তো হোটেলে ভিড় বেশি থাকে। নিচতলার আলোছায়াময় গলিতে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আমিও ঢুকে পড়লাম হোটেলে। দেখি একটা চেয়ার ফাঁকা, টেবিলের দু-দিকের চারটে চেয়ারের পাশাপশি দুটোয় বসেছে দুই তরুণী আর তাদের সামনের একটিতে বসেছে এক যুবক। এরা তিনজন আমাদেরই দলের। আর কোথাও সিট খালি নেই দেখে তরুণের উদ্দেশে বললাম, ‘এখানে কি কেউ বসবে?’
যুবকটি বললো, ‘না, আপনি বসতে পারেন।’
‘ধন্যবাদ।’

এই ভবনের ওপরতলাগুলোয় আবাসিক হোটেল-হোটেল টাঙ্গুয়া ইন। হোটেল টাঙ্গুয়া ইন-এ মেয়েদের পোশাক পরিবর্তনের জন্য দুটো ঘর বুকিং দিয়েছে গ্রীন বেল্ট। ছেলেদের জন্য কোনো ঘর বরাদ্দ নেই, তবে কমন বাথরুম ব্যবহারের সুযোগ আছে। চেয়ারে ব্যাগটা রেখে আমি ফ্রেস হতে গেলাম।

ফিরে এসে দেখি হোটেলের ভিড় কিছুটা কমেছে, আমাদের অনেকেই খেতে বসে গেছে। আমারও ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে। গাইডরা জানালো, ‘ভাত আর পরোটা আছে, যে যা খেতে চান, খেতে পারেন।’ ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম পরোটার সাথে শুধু ডিম আছে, কোনো সবজি নেই। ভাতের সাথে আছে তিন পদের ভর্তা-শুটকি, বেগুন আর মাছ ভর্তা। সকালবেলা আমি কোনোদিনও ভাত খাই না। কিন্তু শুধু ডিম দিয়ে পরোটা খেতে ইচ্ছে করলো না। আবার তিন পদের ভর্তা কিছুটা লোভও জাগালো। তাছাড়া এখন খাবার পর হাওরে গিয়ে আবার কখন খাই তার ঠিক কী! ওয়েটারকে বললাম, ‘ভাত দাও।’

কিছুক্ষণ পর সামনে এলো গরম ভাত আর তিন পদের ভর্তা। তিনপদের ভর্তাই বেশ সুস্বাদু, কিন্তু সাংঘাতিক ঝাল। ঝাল মনে করিয়ে দিলো দু-বার ভারতের ত্রিপুরা ভ্রমণের কথা। ২০১০ সালের এপ্রিলে আগরতলায় ‘এবং বিদ্যাসাগর’ আর ডিসেম্বরে মেলাঘরে ‘সংক্রান্তি’ নাটকের শো করতে গিয়ে এমন ঝাল খেয়েছিলাম। পাঁঠার মাংস আর ত্রিপুরার ঐতিহ্যবাহী খাবার সিঁধল খেয়েছিলাম, সুস্বাদু খাবার, কিন্তু ভয়ংকর ঝাল ছিল। ত্রিপুরার মানুুষ ঝাল খুব বেশি খায়।

খেতে খেতে দুই তরুণী আর যুবকটির সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা হলো। খাওয়া শেষ হলে দুই তরুণী গেল তাদের জন্য বারান্দ রুমে পোশাক পরিবর্তন করতে। আমি এবং তরুণটি বসে বসে আলাপ করতে লাগলাম। পরিচয় বিনিময় হলো। তরুণটির নাম তাজবিদ, কলসেন্টারে চাকরি করে, বাসা উত্তরায়। আমরা বসেই আছি, কিন্তু দুই তরুণীর আর কোনো খবর নেই। তাজবিদকে বললাম, ‘সবাই নৌকায় চলে যাচ্ছে, ওনাদেরকে ফোন দিন।’

তাজবিদ ফোন করে জানতে পারলো তারা এরই মধ্যে নৌকায় চলে গেছে, তারা ভেবেছে যে আমরাও নৌকায় চলে গেছি। আমরাও পা বাড়ালাম নৌকার ঘাটের দিকে, লোকের কাছে শুনে শুনে পৌঁছে গেলাম ঘাটে। আমাদের জন্য ভাড়া করা হয়েছে ইঞ্জিন চালিত দুটো বড় নৌকা। তারই একটার ছাদ থেকে দুই তরুণী হাত ইশারা দিলো আমাদের উদ্দেশে। মাথা নিচু করে নৌকার ভেতরে ঢুকে ব্যাগ রাখলাম আর দেখে নিলাম ভেতরের পরিবেশ। নৌকার ভেতরে দাঁড়ানো যায় না, কোমর বাঁকা করে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকতে হয় মাথা নিচু করে। পাটাতনের ওপরে লম্বা টানা বিছানা পাতা, রাতে এখানেই আমাদেরকে ঘুমাতে হবে। মাঝখানে পালকি আকৃতির ছোট্ট একটা টয়লেট। টয়লেটের সামনে দিয়ে নৌকার এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়া যায়, ওপাশে রান্না করার এবং মাঝিদের ঘুমানোর জায়গা। নৌকার দু-পাশে অনেকগুলো জানালা। জানালায় বসে দিব্যি বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়।

গ্রীণ বেল্টের দুটো প্যাকেজ-যারা রাতে নৌকায় থাকবে তাদের জন্য চার হাজার আর যারা হোটেলে থাকবে তাদের জন্য পাঁচ হাজার টাকার প্যাকেজ। কয়েক জোড়া দম্পতি বাদে আমরা অধিকাংশ পর্যটকই নৌকায় ঘুমানোর প্যাকেজে গিয়েছিলাম। রাতে ছেলেদের একটি নৌকায় ঘুমানোর ব্যবস্থা, আরেকটিতে মেয়েদের। নৌকায় ঘুমানো, টয়লেটের পরিবেশ এবং রাতে ঘুমানোর আগে স্নানের কথা ভেবে আমি হোটেলের ফোন নম্বর নিয়ে নিয়েছিলাম। মনে হলো ফোন নম্বর নিয়ে ভালই করেছি, অবস্থা বুঝে হোটেল বুকিং দেওয়া যাবে। সিঙ্গেল রুম আড়াইশো টাকা। গ্রীন বেল্টের হোটেল প্যাকেজ না নিয়ে ভালই হয়েছে, হোটেল নিলেও বেঁচে যাবে সাড়ে সাতশো টাকা।
ব্যাগ রেখে তাজবিদ আর আমি নৌকার ছাদে গেলাম। আকাশ মেঘলা, হাওরের বাতাস এসে আড়মোড়া ভাঙছে গায়ে, শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। নৌকা ঘাট ছাড়লো গভীর হাওরের উদ্দেশে; আমাদের নৌকায় মাত্র বারো-তেরোজন, বাকিরা অন্য বড় নৌকাটিতে। এখন বর্ষাকাল হওয়ায় ফসলি জমি, হাওর আর নদী সব জলে ভেসে একাকার। যতোদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। জলের ভেতর থেকে বীরের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে হিজল আর করচগাছ। করচগাছই বেশি, অসংখ্য। করচগাছ শক্ত প্রাণের গাছ, বছরের চার-পাঁচ মাস জলের মধ্যে কেবল মাথা জাগিয়ে বেঁচে থাকে। এখন বর্ষাকাল হওয়ায় গাছে কেবল গাঢ় সবুজ পাতা, ফুল নেই। গ্রীষ্মকালে ছোট ছোট থোকায় লালচে এবং বেগুনি ফুল ফোটে।

নৌকা কিছুদূর এগোতেই নয়ন জুড়োনো দৃশ্য, একটু একটু করে দৃশ্যমান হচ্ছে মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়! হাওরের জল গিয়ে মিশেছে পাহাড়ের কোলে। সবাই সাগ্রহে তাকিয়ে আছি দূরের পাহাড়ের দিকে। হঠাৎ মেঘ চিড়ে সূর্য দৃশ্যমান হতেই যেন মুখে-হাতে, অর্থাৎ শরীরের খোলা অংশে চিড়িক করে লাগলো রোদের আঘাত। ভীষণ গরম লাগতে শুরু করলো। যারা ছাতা নিয়েছিল, ছাতা ফুটালো মাথার ওপর। আমি ছাতা নিইনি, হ্যাট নিয়েছি দুটো। তাজবিদ কিছুই নেয়নি দেখে নৌকার ভেতর থেকে একটা হ্যাট এনে ওকে দিলাম।

পিছনে তাকিয়ে দেখি আমাদের অন্য নৌকাটির ছাদে ছায়নামা টাঙিয়ে দিয়েছে মাঝিরা। বুঝলাম যে আগে থেকেই ওই নৌকায় বাঁশ বাঁধা ছিল বলে আমাদের দলের বেশিরভাগ মানুষ ওই নৌকাতেই উঠেছে। কতো ব্যাপারেই যে আমি অনভিজ্ঞ!

তিনজন গাইডের একজন শাকিল উঠেছে আমাদের নৌকায়। শাহেদের মতো শাকিলও গ্রীন বেল্টের একজন প্রতিষ্ঠাতা। কয়েকজন তরুণ মিলে গড়ে তুলেছে গ্রীন বেল্ট। ওদের আন্তরিকতা বেশ ভাল লেগেছে আমার। শাকিলের উদ্যোগে আমাদের মধ্যে শুরু হলো পরিচয় পর্ব। ছাদের দুই পাশের লোহার বেঞ্চে বসেই আমরা সবাই যার যার পরিচয় দিলাম। এরই মধ্যে তাজবিদ এবং ওর কাজিন দুই তরুণী সুমাইয়া এবং ফারহানার সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে আমার। আমি আর তাজবিদ বসেছি পাশপাশি, আমাদের উল্টোদিকে বসেছে সুমাইয়া আর ফারহানা। আমরা প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্ধর্য অবলোকন করছি আর বিশ্লেষণ করছি হাওরের রূপের।

ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে দু-চারটি জেলে নৌকা। আমাদের পাশ ঘেঁষে বা কিছুটা দূূর দিয়ে ভটভট শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে যাত্রী এবং মালামাল বোঝাই ইঞ্জিনচালিত নৌকা। হয়তো ফসল বিক্রি এবং প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য কিনতে যাচ্ছে কোনো বাজারে। বিশাল জলরাশির মধ্যে দ্বীপের মতো কিছু জনপদ, কোথাও ক্ষুদ্র একটি পাড়া, কোথাওবা দু-তিনটি বাড়ি। সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে কোনো কোনো বাড়ির রুপালি টিনের চালা, সবুজ গাছপালার ভেতর টিয়া রঙের টিনের বাড়িও চোখে পড়লো দু-তিনটি। আমাদের নৌকা এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জনপদের পাশ দিয়ে যাবার সময় আমি এখানকার মানুষ আর ঘর-বাড়ি ভাল মতো লক্ষ্য করলাম। অধিকাংশই বাড়িরই টিনের চালা, বেড়াও টিনের। দু-একটি বাড়ির দেয়াল পাকা। কোনো বাড়ির স্থলভাগের প্রান্তসীমায় বালির বস্তা রাখা একটার পর একটা, আবার কোনো বাড়ির স্থলভাগের প্রান্তসীমায় সাজানো পাথর; হাওরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালির বস্তা কিংবা পাথরের গায়ে। এই বালির বস্তা কিংবা পাথর রাখার উদ্দেশ্য হলো মাটির ভাঙন রোধ করা। আমার ইচ্ছে হলো এখানে নেমে এদের সাথে কথা বলি, এদের জীবন সম্পর্কে গভীরভাবে জানি। কিন্তু এসেছি একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে, সুতরাং আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছে পূরণের কোনো সুযোগ নেই। এই যে দূর থেকে মানুষ দেখছি, তাদের ঘর-বাড়ি দেখছি, এই দেখা ভাসা ভাসা। সাধারণ ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এই দেখা যথেষ্ট হলেও আমার মতো লেখকের জন্য তা যথেষ্ট নয়। আমাকে জানতে হবে এদের জীবনের গভীরে ঢুকে। এ যাত্রায় তা খুব একটা সম্ভব হবে না। তারপরও সুযোগ পেলেই যতোটা সম্ভব জানতে হবে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে, করতে হবে মানুষসঙ্গ। হাওর আর হাওরের জনপদের মানুষ নিয়ে লিখতে গেলে আমাকে এখানে আবারও আসতে হবে, তলিয়ে দেখতে হবে জীবন ও জনপদ। এ যাত্রায় বর্ষার হাওরের রূপ, জীবন ও জনপদ সম্পর্কে যতোটা দেখা যায় দেখে যাই, যতোটা জানা যায় জেনে যাই; এরপর আমি হাওরে আসবো শীতের সময়, একা অথবা দু-একজন সঙ্গীসহ। তখন দেখতে পাবো শীতের কুয়াশামাখা হাওরের রূপ, দেখতে পাব হাজার হাজার অতিথি পাখির কলকাকলি। বর্ষায় হাওরের মানুষের কর্মচাঞ্চল্য কম, ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় চাষবাস একদমই নেই। শীতের সময় দেখতে পাব হাওরের কর্মমুখর জীবন। কোনো অঞ্চল নিয়ে লিখতে গেলে সে অঞ্চলের ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানা উচিত। তাতে লেখায় জীবন ও জনপদের গভীর ছাপ পড়ে। অন্যথায় সে লেখায় ফাঁকি থেকে যায়, গভীর মনোযোগী পাঠ সে ফাঁকি ধরতে পারে।

বাউলাই নামক একটা নদীর ওপর দিয়ে আমাদের নৌকা ছুটে চলেছে টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশে। কি ফসলি জমি, কি বাউলাই নদী, কি টাঙ্গুয়ার হাওর, কিছুই আলাদা করে চিনবার উপায় নেই; না দেখা যায় জমির আল, না চোখে পড়ে বাউলাই নদীর তট আর না বোঝা যায় হাওরের পাড়; অথৈই জলে ডুবে সবই একাকার, জলময়।

এরই মধ্যে জলের রং বদলে গেছে, এতোক্ষণ ছিল ঘোলা জল, এখন ক্রমশ সবুজ। গোলাবাড়ি নামক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জনপদের পাশ ঘেঁষে আমাদের নৌকা এগিয়ে চলেছে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। এখনও ওয়াচ টাওয়ার আমাদের নজরে পড়ছে না। প্রচুর করচগাছ এখানে জলের ওপর মাথা তুলে আছে, একেবারে কচরগাছের অরণ্য বলা চলে। আরো কিছুদূর এগোনোর পর ওয়াচ টাওয়ার দেখতে পেলাম। ওয়াচ টাওয়ারের পিলারে বেশ কয়েকটি নৌকা বাঁধা। নৌকায়, জলে এবং ওয়াচ টাওয়ারে পর্যটকেরা হইহুল্লোর করছে। করচগাছের জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে আমাদের নৌকা পৌঁছে গেল ওয়াচ টাওয়ারের কাছে। কয়েকটি পর্যটক নৌকা ওয়াচ টাওয়ার ছেড়ে চলে যাওয়ায় হইহুল্লোর কিছুটা কমলো। নৌকা থেকে আমরা ওয়াচ টাওয়ারের সিঁড়িতে নেমে ওপরে উঠে গেলাম। করচগাছের কারণে ওয়াচ টাওয়ারের আশপাশের জল গাঢ় সবুজ, করচ গাছের ওপারে তাহিরপুরের দিকে ঘোলাজল, আবার মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের দিকের জল নীলাভ! এখান থেকে পাহাড় বেশ কাছেই, পাহাড়ের মাথায় যেন মণিপুরি নৃত্যরত রাশিরাশি সাদা-কালো মেঘ, পাহাড়ের খাজে খাজে জমে আছে মেঘ। কী আশ্চর্য সুন্দর, মন কেমন করা নৈসর্গিক দৃশ্য! জীবনে এমন দৃশ্য অবলোকন না করে মরে যাওয়া মানে জীবনকে ঠকানো, যা একেবারেই অনুচিত। দিদির মুখে শুনেছি, আমার বাবা নাকি আফসোস করে বলে, ‘ও একটা সরকারি চাকরি পেলো না, অন্তত প্রাইমারিতে চাকরি করলেও তো পারতো। সেই চেষ্টাও কোনোদিন করলো না। টেলিভিশনে কী চাকরি করে!’

এসব কথা শুনলে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, প্রাইমারিতে চাকরিরত আমার বন্ধুদের মুখ। ওরা সকালে এক ব্যাচ প্রাইভেট পড়িয়ে স্কুলে যায়, স্কুল শেষে বাড়িতে ফিরে আবার আরেক ব্যাচ প্রাইভেট পড়ায়। ওদের কাছে বেড়ানো মানে কোনো আত্মীয় বাড়িতে যাওয়া, কারো বিয়েতে বরযাত্রী কিংবা কারো শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ রক্ষা করা। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ওদের জীবন এভাবেই চলছে। ওদের সারাটা জীবন হয়তো এভাবেই কাটবে। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ওরা কোথাও ঘুরতে যায় না; ওরা জানে না কেওক্রাডাং পাহাড় চূড়ায় বসে রাতে মেঘ আর বিদ্যুৎ চমকের কী দূর্লভ দৃশ্য দেখা যায়, ওরা জানে না বম কিংবা চাকমাদের জীবন কেমন, ওরা দেখতে চায় না পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহারের গায়ের হাজার বছরের বেশি সময় আগের কোনো মৃৎশিল্পীর হাতের টেরাকোটা। ওরা কেবল একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অর্থ রোজগার কারে, কে কতো সুন্দর বাড়ি করতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় নামে। ভ্রমণ মানে ওদের কাছে অর্থের অপচয়! ওদের কাছে যা অপচয়, আমার কাছে তাই-ই সমৃদ্ধি! ওদের ওখানে থাকলে, ওদের মতো জীবন-জীবিকা নির্বাহ করলে লেখক হওয়া তো দূরের কথা আমি তো নিজের কাছে কখনো মানুষই হতাম না!

ওয়াচ টাওয়ার থেকে নৌকায় নেমে পোশাক বদলে, লাইফ জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ছোট ছেলেদের একটা অপ্রশস্ত নৌকায় উঠলাম। আমাদের দলের আরো দুটি মেয়ে এবং দুটি ছেলেও উঠলো। করচগাছের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে এসে জলে ঝাঁপ দিলাম। সাঁতার জানি তবু লাইফ জ্যাকেট গায়ে দিয়েছি এজন্য যে দীর্ঘক্ষণ জলে ভেসে থাকা যাবে। আমাদের দলের আরো অনেকেই নেমেছে, হাওরের অথৈ-শীতল জল পেয়ে হুটোপুটি করছে। বিপত্তি ঘটলো এক তরুণীকে নিয়ে। সাঁতার জানে না, তবু বরের উৎসাহে নেমেছে কিন্তু নেমেই ভয়ে বরের গলা জড়িয়ে ধরে আছে, বরের কোল থেকে আর নামতে চাইছে না। বেচারা বরেরও সাধ্য নেই, একা তার স্ত্রীকে পুনরায় নৌকায় তুলে দেয়, কেননা জল থেকে নৌকা বেশ উঁচুতে। শেষে কয়েকজন মিলে ধরে, কেউ করচগাছে উঠে, কোনোরকেমে বেচারিকে নৌকায় তুলে দেওয়া দিলো। সাঁতার না জানা মানুষের পক্ষে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক, কেননা হাওরের অবাধ ঢেউয়ের চাপ এসে লাগছে বুকে। আমরা যারা সাঁতার জানি, তারাও টলছি অনবরত। বেশ কিছুক্ষণ পর লাইফ জ্যাকেটটা খুলে অনেক্ষণ সাঁতার কাটলাম। হাঁফিয়ে উঠলে একটা করচগাছ ধরে জিরিয়ে নিলাম, তারপর আরো কিছুক্ষণ সাঁতরে উঠে এলাম নৌকায়।

এবার সবাই ছায়নামা টাঙানো বড় নৌকাটিতে উঠলাম। খাবারের ব্যবস্থা বড় নৌকাটিতে। ভাত, শবজী, সালাদ, হাঁসের মাংস আর ডাল। নৌকার মাঝিদের রান্না বেশ ভালই। পেট পুড়ে খেলাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে।

খেয়ে বোটের ভেতরে গিয়ে উত্তরদিকের জানালার কাছে বসলাম। ছায়নামা থাকলেও দুপুরের রোদের তাপ খুব। সকাল থেকে রোদে পুড়ে হাত-মুখ লাল হয়ে গেছে। হাওরে রোদ-ছায়ার খেলা চলে সারাক্ষণ, সূর্য এই মেঘের আড়ালে চলে যায় তো পরক্ষণেই আবির্ভূত হয় স্বমহিমায়। উত্তরদিকের জানালায় বসলাম কারণ এদিকটাতেই মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়, ওই পাহাড় গড়িয়ে আসা রাশি রাশি বৃষ্টির জলেই বছরের চার-পাঁচটা মাস এই ভাটি অঞ্চল ডুবে থাকে। পাহাড়ের মাথায় মেঘ, খাঁজে খাঁজে মেঘ; যেনবা পাহাড় সেজেছে মেঘের অলংকারে! পাহাড়ের ঢাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমানা, পাহাড়ের প্রায় পাদদেশ পর্যন্ত জল। জলে পড়েছে পাহাড়ের ঘন সবুজ ছায়া, মেঘ আর নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি। এখানে বসেছে জল-মেঘ-পাহাড়ের নৈসর্গিক মিলনমেলা! ওই পহাড়ের পাদদেশে যারা বাস করে কিংবা জলের মধ্যে দ্বীপের মতো যাদের বাড়ি, তাদের অর্থ-বিত্ত কম থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃতি তাদেরকে দিয়েছে এমন নৈসর্গিক সৌন্ধর্য যে তারা বুক ফুলিয়ে গর্ব করতেই পারে।

কিছুক্ষণ পর সুমাইয়া, ফারহানা আর তাজবিদও নৌকার ভিতরে এসে বসলো। আমরা বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে লাগলাম। সুমাইয়া স্কুল শিক্ষক। ফারহানা এবং তাজবিদের বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানাশোনা থাকলেও সুমাইয়া একেবারেই অনভিজ্ঞ। এটা ওর প্রথম ভ্রমণ, মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে চলে এসেছে। ফারহানার কারণেই ওর মা ওকে ছেড়েছে। ফারহানা দেশে এবং দেশের বাইরে অনেক জায়গায় ঘুরেছে। ফারহানার বর ওকে আসতে বাঁধা দেয়নি। ওর বরটাকে বেশ উদারই বলতে হবে, নইলে এতোগুলো ছেলের সঙ্গে নিজের বউকে কেউ আসতে দেয়!

আমরা যখন খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত টেকেরঘাটে পৌঁছলাম তখন বিকেল হলেও রোদে প্রচণ্ড তাপ। নৌকা থেকে মাটিতে নামার পর মনে হলো গরম কড়াইতে নেমেছি। বাতাসবিহীন ভ্যাবসা গরমে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগলো শরীর থেকে। ছোট্ট মাঠটা পেরিয়ে আমরা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম যেখানে অনেকগুলো মোটর সাইকেল রয়েছে যাত্রীর অপেক্ষায়। পাহাড়ের ঢালে কাঁটাতারের সীমান্তরেখা চোখে পড়লো। পাহাড়ের ঢাল ভর্তি আঁচিলের মতো ছোট-বড় পাথর। এখানকার যাতায়াতের প্রধান বাহন মোটর সাইকেল, কিছু ইজিবাইকও আছে। আমাদের গন্তব্য এখন লাকমা ছড়া, হেঁটে গেলে নাকি পনের-বিশ মিনিটের পথ। রোদের তাপ আর গরম না থাকলে হেঁটেই যেতাম, নতুন জায়গায় হেঁটে গেলে যতো গভীরভাবে মানুষ-প্রকৃতি দেখা যায়, কোনো দ্রুতগামী বাহনে গেলে তা দেখা যায় না। আমাদের দলের অনেকেই আগে আগে এসে বাইকে রওনা দিয়ে দিয়েছে। গাইডরা হাঁটতে শুরু করেছে। অনেকগুলো মোটর সাইকেল, আমাদেরকে কারা বহন করবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। শেষে আমাদের নৌকার মাঝি দুটো মোটর সাইকেল ঠিক করে দিলো, নিয়ে যাবে এবং নিয়ে আসবে, দুটোর ভাড়া দুইশো টাকা। সুমায়ইয়া এবং ফারহানা দুজনেই স্থলকায়, এক মোটরবাইকে দুজনের বসা সম্ভব নয় বলে সুমাইয়া বললো, ‘ভাইয়া আসেন আমি আর আপনি একটায় উঠি, ফারহানা আপু আর তাজবিদ আরেকটায় উঠুক।’

তাই উঠলাম। রাস্তা ভাল নয়। মাঝে মাঝে খাদ। প্রবল ঝাঁকুনি লাগছিল। সুমাইয়া বললো, ‘ভাইয়া আমি আপনাকে ধরে বসবো? আপনার অসুবিধা হবে না তো?’

‘আপনি যেভাবে কমফোর্ট ফিল করেন, ধরে বসেন; আমার কোনো অসুবিধা নেই।’

সুমাইয়া আমার কাঁধ ধরে রইলো আষ্ঠেপৃষ্ঠে। আঁকা-বাঁকা উঁচু-নিচু রাস্তায় ঝাঁকি খেতে খেতে আমরা পৌঁছে গেলাম লকমা ছড়ায়।
লাকমা ছড়া একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা। মেঘালয়ের দুই পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এসে পড়েছে বাংলাদেশের মুখে, নিচু সমতল ভূমিতে। ছড়াটি খুব বেশি বড় নয়, স্রোতও এখন খুব বেশি নেই। বৃষ্টির সময় নিশ্চয় স্রোত বেড়ে যায়। বাংলাদেশের যে নালা দিয়ে ছড়ার জল বয়ে যাচ্ছে আরো নিচের দিকে, সে জলে দর্শনার্থীরা পা ভেজাচ্ছে, স্থানীয় বাচ্চারা হুটোপুটি করছে, কোথাও কোমর কোথাও হাঁটু জলে স্থানীয় কয়েকজন নারী-পুরুষ ঠেলা জাল দিয়ে মাছ ধরছে। আমার কৌতুহল হলো, পাহাড়ী ছাড়ার মুখের এইটুকু জলে মাছ পাওয়া যায়? কাছে গিয়ে দেখলাম কুচো মাছ ধরছে ওরা। নিশ্চয় ছড়াটির উৎসমুখ মেঘালয়ের কোনো লেক, নইলে মাছ আসবে কোথা থেকে! বালক-বালিকার চপলতায় আমরা নেমে পড়লাম নালার জলে। বেশ শীতল জল। ভ্যাবসা গরমে শীতল জলে হাত-মুখ ধুয়ে বেশ স্বস্তি পেলাম।

নালার পাশেই বেলে মাটিতে ভ্যান আকৃতির একটা ঠেলাগাড়ি, ঠেলাগাড়ির মধ্যে দুটি বস্তা, পাশে দাঁড়িয়ে এক মধ্যবয়সী লোক আরেকটি বস্তার মুখ বাঁধছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা, এই বস্তার মধ্যে কী?’
‘কয়লা।’
‘কয়লা কোথায় পেলেন?’
তিনি সিলেটী ভাষায় যা জানালেন তার অর্থ এই, ‘সীমান্তের ওপার থেকে বৃষ্টিতে ভেসে আসে কয়লা।’
‘সীমান্তের ওপারে কয়লা খনি আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই কয়লা বিক্রি করেন কোথায়?’
‘লাকমা বাজারে। ঢাকার পার্টি আসে কয়লা কিনতে।’

বর্ষা মৌসুমে এখানকার দরিদ্র লোকজনের একটা বাড়তি রোজগারের উপায়। বেশ ভালই। বেশি বেশি করে বৃষ্টি নামুক আর ওপার থেকে আরো বেশি কয়লা ভেসে আসুক। পাহাড়ে গিয়ে যে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে এরা জীবিকা নির্বাহ করবে কাঁটাতারের বেড়ার জন্য সে উপায় নেই। অথচ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের আগ পর্যন্ত এদের বাবা-চাচারা হয়তো তাই করতো। দেশভাগ এবং কাঁটাতারের বেড়া পরবর্তী প্রজন্মের কপাল পুড়িয়েছে।

বিকেলের আলোয় আমরা পাহাড়ী সৌন্ধর্য উপভোগ করছি আর স্মৃতি ধরে রাখছি ক্যামেরায়। আমাদের মোটর সাইকেলের একজন ড্রাইভার বললো, ‘আপনার রাজাই ছড়ায় যাবেন?’
জানতে চাইলাম, ‘কতো দূর?’
‘টেকেরঘাট থেকে এখানটা যতোদূর, রাজাই ছড়া এর চেয়ে আরেকটু বেশি দূর।’
‘টেকের ঘাট হয়েই যেতে হবে?’
‘হ্যাঁ’।

আমি আমার তিন সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপ করে নিলাম। ওরাও যেতে রাজি। বেলা পড়ে আসছে। ফলে আর দেরি না করে আমরা আবার বাইকে উঠে পড়লাম। আবার সেই টেকেরঘাট হয়ে পূর্বদিকে চলতে লাগলো বাইক। বামপাশে পাহাড়ের পাদদেশে শহীদ সিরাজউদ্দিন লেক আর ডানপাশে ছোট্ট কিন্তু চমৎকার নীলাদ্রী টিলা, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। কয়েকটি ছোট গ্রাম আর একটি বাজার পড়লো আমাদের যাত্রা পথে। আসলে এসব জায়গা সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে, তাদের জীবনযাপন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে এই বাইকে চলে পোষায় না। যেতে হয় হেঁটে, ঘর-বাড়ি আর হাট-বাজারের চিত্র দেখতে হয়, মানুষের কথা বলতে হয়। এতো অল্প সময়েও তা হয় না, কয়েকদিন সময় নিয়ে এসে থাকতে হয়। আমার ইচ্ছে শীতকালে আমি এখানে আবার আসবো। বাইকওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এখানে গেস্ট হাউজ আছে। ভালই হলো, এখানে এসে থাকা যাবে কয়েকদিন।

রাস্তার পাশে কয়েকটি বাঙালি এবং আদবাসী পাড়া, সেসব পেরিয়ে রাজাই ছড়ার পাশের একটি পাড়ায় এসে আমাদের বাইক থামলো। ছড়ার জল পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। ছড়া বেশি দূরে নয়, কিন্তু উঁচু পথে সুমাইয়ার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। জানালো কিছুদিন আগেই নাকি ওর জ¦র হয়েছিল, হাতে-পায়ের যে ব্যথা হয়েছিল তা এখনো যায়নি। ডাক্তার জানিয়েছে কয়েকমাস সময় লাগবে। অগত্যা ওর হাত ধরে টেনে পাথুরে পিচ্ছিল পথ অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম রাজাই ছড়ায়। ছড়াটি ছোট। ছয়-সাত ফুট ওপর থেকে জল পড়ছে। অনেকগুলো বড় বড় পাথর আছে এখানে। শীতল জলে হাত-পা ভিজালাম, তৃষ্ণা মিটালাম। একটা পাথরে বসলাম কিছুক্ষণের জন্য। সুমাইয়া ছড়া দেখে আপ্লুত, আনন্দের বাহিঃপ্রকাশ বাঁধ ভাঙা। ও এর আগে কোনোদিন ছড়া দ্যাখেনি। আমি ভাবলাম ও যদি বান্দরবানের ঝাদিপাই ঝর্ণা দ্যাখে, তাহলে তো ঝাদিপাইয়ের সৌন্ধর্য আর বিশালতা দেখে আনন্দে মূর্ছা যাবে! ফারহানা বা তাজবিদের উচ্ছ্বাস ততোটা নয়, কেননা ওরা এর আগে অনেক জায়গায় ঘুরেছে।

বাইরে আলো থাকলেও জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। আমরা আবার ফিরে এসে বাইকে চড়ে বসলাম। বাইক চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা ভারতে যান না?’
‘হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই যাই।’

ওরা যায় বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় চোরাই পথে। বাইক থেকে নেমে পড়লাম নীলাদ্রি টিলা আর শহীদ সিরাজউদ্দিন লেকের মাঝখানের রাস্তায়। উদ্দেশ্য নীলাদ্রী টিলায় উঠবো। পায়ের জন্য সুমাইয়া উঠতে পারলো না। আমি, ফারহানা, আর তাজবীদ উঠলাম ঘন সবুজ ঘাসে ছাওয়া দৃষ্টিনন্দন টিলার চূড়ায়। শেষ বিকেলের মোলায়েম আলোয় চারপাশটা অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল। উত্তরে সু-উচ্চ সবুজ পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে সবুজ গাছপালার ফাঁকে নানা আকৃতির পাথর ছড়িয়ে আছে একেবারে পাদদেশের লেকের জল পর্যন্ত। কাঁটাতারের ওপারের পাহাড়ে মাঝে মাঝে লোকের ঘর-বাড়ি। সবুজের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি বিল্ডিং, সম্ভবত ওগুলো বিএসএফ এর কোয়ার্টার। ইচ্ছে হলো ওপারে যাই, ওপারের মানুষের ঘর-বাড়ি, জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখি; কিন্তু সে উপায় নেই।

টিলার চূড়া থেকে হাওরের জল দেখা যায়। টিলা থেকে কিছুটা দূরে বেড়া দেওয়া একটা জায়গায় কয়েকটা কয়লার ঢিবি আর কয়েকখানা টিনের ঘর। ভারত থেকে কয়লা এনে মজুদ করে রেখেছে কয়লা ব্যবসায়ীরা। এখান থেকে কয়লা চালান হবে আমাদের দেশের ভেতরে। টিলার সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে-শুয়ে-বসে আমাদের ছবি তোলা পর্ব শেষ হলো। আমার ইচ্ছে হলো কিছুক্ষণ মৌন হয়ে বসে থাকি টিলার ওপর, বিকেলের শেষ আলোটুকু শুষে নেবার দৃশ্য দেখি এখানে বসে। কিন্তু সে উপায় নেই। আমাদেরকে না পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাকতে এসেছে আমাদের গাইড শাহেদ। অগত্যা টিলা থেকে নেমে এলাম ঘাটের উদ্দেশে। ঘাটে যাবার পথেই একাত্তরের শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভে দাঁড়িয়ে কয়েকখানা ছবি তুলে নিলাম।

সন্ধ্যার আগের আদুরে আলোয় নৌকার ছাদে বসে চারপাশের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতেই হঠাৎ অন্ধকার নেমে এলো। পাহাড়ের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে চললো। জ্বলে উঠলো পাহাড়ের ঢালের সীমান্তের কাঁটাতারের লাইটপোস্টের সারিবদ্ধ আলো। যতো অন্ধকার হয় আলো ততো উজ্জ্বল হয়। এই আলো বুকে আনন্দ জাগায় না, হাহাকার জাগায়, দেশভাগের হাহাকার!

তাহিরপুরে ফেরার পথে দেখলাম কয়েক বছরের পুরোনো ঘরের রোদে পোড়া-বৃষ্টিতে ভেজা শনের চালার মতো কালো মেঘ আকাশে। চাঁদ দূরে থাক একটা তারারও দেখা নেই। অথচ আজ পূর্ণিমা। কতো আশা করে এসেছি পূর্ণিমা রাতে হাওরের জলে ভেসে ভেসে আকাশ দেখবো, জল দেখবো, গাছপালা দেখবো। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হবার সম্ভাবনা খুবই কম। পূর্ণিমার আলো যেহেতু দেখতে পাব না, হোটেলে রুম বুক করাই উত্তম। রাতে ভাল ঘুম হলে কালকের দিনটা অধিক আনন্দে উদযাপন করতে পারবো। তাছাড়া অধিকাংশ পর্যটকই নৌকায় থাকবে। সবাই গাদাগাদি করে এক জায়গায় থাকলে ভাল ঘুম হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তার ওপর নৌকায় পালকির মতো একটা টয়লেট! সাত-পাঁচ ভেবে হোটেলে একটা সিঙ্গেল রুম নিয়ে নিলাম।

প্রায় সারাদিনই তো রোদে পুড়েছি, সারাদিন জলের ওপর ভেসে থাকার পরও মনে হলো রোদের তাপে জলবিনা টবের গাছের মতো কুকড়ে গেছি। চেহারা লাল হয়ে গেছে, ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে। আসলে আমরা যারা ঢাকার মতো একটি বসবাসের অযোগ্য শহরে থাকি, যেখানে পর্যাপ্ত হাঁটাচলার জায়গা নেই, পার্ক নেই, খেলার মাঠ নেই; তারা টবের গাছের মতোই কম প্রাণশক্তি নিয়ে বাঁচি, অল্প শ্রমেই নুয়ে পড়ি। ভরপুর প্রাণশক্তিতে বাঁচে ঢাকার বাইরের মানুষ। এই যে আমাদের নৌকার মাঝিদের দেখলাম কী প্রাণশক্তি আর কী পরিশ্রমী! রোদ-বৃষ্টি কিছুই এদের কাবু করতে পারে না। আল-আমিন নামের একটা ছেলে, হ্যাংলা শরীর, তারের মতো শক্ত হাত-পা, নৌকা চালানো, রান্নার কাজে সাহায্য করা, খাবার পরিবেশন করা, সব কাজে পটু। ওকে কখনো ক্লান্ত হতে দেখলাম না। অন্য মাঝিদেরও তাই। আসলে আমরা টবের ছোট গাছ আর এরা বনভূমির বৃক্ষরাজি!

হোটেলে ফিরে স্নান করে বেশ আরামবোধ করলাম। শরীরে জল পড়তেই চনমনে ভাবটা ফিরে এলো। স্নান শেষে হোটেলের বিছানায় কিছুটা সময় গড়িয়ে নিলাম। তারপর নিচে নেমে বাজারের মধ্যে খানিকটা হাঁটাহাঁটি করলাম, দোকানের ক্রেতা-বিক্রেতাদের কথপোকথনে কান পাতলাম, কিছু শব্দের অর্থ না বুঝলেও এদের পুরো বাক্যের অর্থ বুঝতে অসুবিধা হলো না। আমি তো এর আগেও দু-বার সিলেটে গেছি, দু-বার শ্রীমঙ্গল গেছি। সেখানকার মানুষের কথপোকথনে কান পেতেছি। ভাষা বুঝতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয়নি। চট্টগ্রামের ভাষার চেয়ে সিলেটের ভাষা অনেক সহজবোধ্য মনে হয়েছে আমার কাছে। চট্টগ্রামের মানুষ যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে, তখন সে ভাষার সঙ্গে তাল মিলাতে পারে না আমার কান। চট্টগ্রামের ভাষা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভাষার চেয়ে একটু বেশি গতিময় এবং দুর্বোধ্য। চট্টগ্রামের মানুষ আমার ওপর রেগে যাবে কিনা জানি না, তবে সত্যি আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে বাংলা ভাষা থেকে উড়িয়া বা অহমিয়া ভাষার যে দূরত্ব, চট্টগ্রামের ভাষার দূরত্বও অনেকটা সেরকমই।

কিছুক্ষণ দোকানে দোকানে উঁকি-ঝুঁকি মেরে গেলাম নৌকায়। বড় নৌকাটিতে চড়ে হাওরের জলে ভেসে ভেসে হবে আমাদের নৈশ আহার। অন্য যারা হোটেলে রুম নিয়েছে, তারা সকলেই ফ্রেশ হয়ে নৌকায় ফিরে এলে নৌকা ঘাট ছাড়লো। কিছুটা ভেতরের দিকে গিয়ে মাঝিরা নৌকার গতি থামিয়ে দিলো, আমরা কেবল স্রোতে ভাসতে লাগলাম। শুরু হলো আড্ডা, গান-বাজনা। ভাল গান জানে এমন লোক পাওয়া গেল না। অগত্যা বেসুরো গলাতেই কেউ কেউ গাইলো গান।

হঠাৎ দেখি মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু জ্যোৎস্নার ঔজ্জ্বল্য নেই, খেটে খাওয়া গ্রাম্য বৃদ্ধার পরনের ময়লা থানের মতো জ্যোৎস্না! মেঘের যা দাপট, তাতের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধিরও কোনো সম্ভবনা নেই।

হাওরের উন্মুক্ত বাতাস এসে আদর বুলিয়ে দিচ্ছে শরীরে। আমি আকাশ দেখছি, জ্যোৎস্নার মলিন আলোয় জলের ওপর মাথা তুলে থাকা কচরগাছ দেখছি আর দেখছি অনেক দূরের সীমান্তের কাঁটাতারের সারি সারি আলো। চারপাশে সকলের হইহুল্লোর চলছে, তারই মাঝে আমি কেমন একা হয়ে গেলাম। আমার এমন হয়, সকলের মাঝে থেকেও আমি অনেক সময়ই একা হয়ে যাই, অন্তর্জগতে ডুব দিয়ে কী যেন হাতরে খুঁজি! কী খুঁজি?

পরদিন সকাল আটটায় নৌকায় যাবার কথা। কিন্তু আমি সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে স্নান করে বিছানায় বসে রইলাম। রাতে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। গরম আর ছারপোকার কামড়ে ভাল ঘুম হয়নি। রাতে উঠে দেখি বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ বৃষ্টি দেখেছি। যে ঘুমের জন্য হোটেলে রুম নিলাম, সেই ঘুমই হলো না। কী করে ঘুমাবো? বিছানা তো নয় যেন চিতা! শুলেই ছাড়পোকার আগুন কামড়!

কতোক্ষণ আর বিছানায় বসে থাকা যায়। স্নান করা ফ্রেশ শরীরে ছারপোকাময় বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেও ইচ্ছে হলো না। ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নামলাম। ঘাটে গিয়ে দেখি আমাদের নৌকা নেই। রাতে ওদের হাওরের ভেতরের দিকে ঘুমানোর কথা, তাই এখনো ফেরেনি। আমি আবার ফিরলাম বাজারের দিকে। দোকানপাট কিছু খুলেছে, কিছু খুলছে। এক দোকাদারের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম অনেক কিছু। আমরা আজ যে জায়গায় যাব-শিমুল বন, জাদুকাটা নদী এবং বারিক্কা টিলায়; শীত মৌসুমে সেখানে নাকি মোটর সাইকেলে যাওয়া যায়। মোটর সাইকেলসহ জাদুকাটা নদী পেরোতে হয় নৌকায়। বারিক্কা টিলা থেকে আবার টেকেরঘাট যাওয়া যায়, যেখানে আমরা গতকাল গিয়েছিলাম। জানতে পারলাম এখনকার জলমগ্ন অধিকাংশ জমিতে একবারই ধান চাষ হয়; আর ওপর দিকের কিছু কিছু জমি, যেখান থেকে জল একটু আগে সরে যায়, শীত মৌসুমে সেসব জমিতে শীতের শাক-সবজি উৎপাদিত হয়। গত বছর পাহাড়ী ঢলে আগাম বন্যা হয়েছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দুর্নীতি এবং গাফিলতির ফলে হাওরের বাঁধ ভেঙে যায়। এতে হাওরাঞ্চলের ছয় জেলায় মোট ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৮ লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার এই ক্ষতির শিকার হয়। এছাড়া প্রচুর মাছ নষ্ট হয়, গবাদি পশু এবং হাঁস মারা যায়। মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। শুধুমাত্র পাউবো কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফলেই কৃষকের এই বিপুল ক্ষতি হয়।

বাজার থেকে বেরিয়ে হোটেলের সামনের রাস্তা ধরে একটু এগোতেই দেখি রাস্তাটি মিশেছে বেড়িবাঁধে গিয়ে। সরু পাকা রাস্তার একদিকে তাহিরপুরের জনপদ আরেকদিকে অথৈ জল। বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বাঁধের দেয়ালে। লোকের কাজের সুবিধার্থে বাঁধের ওপর থেকে একটা চওড়া সিঁড়ি নেমে গেছে জলের মধ্যে। দুটো বালক বাঁধের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ছে জলে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে আবার ঝাঁপ দিচ্ছে জলে। আমি ওদের জলে লাফিয়ে পড়ার বেশ কিছু ছুবি তুল তুললাম।

ওদের ছবি তুলতে দেখে ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি বালক এসে বললো, ‘আমার ছবি তোলো।’
তুললাম তার ছবি। মুখে কী খুশির ঝিলিক!

সাড়ে আটটার দিকে আমাদের দুই নৌকা যাত্রা শুরু করলো শিমুল বন, জাদুকাটা নদী আর বারিক্কা টিলার উদ্দেশে। আমাদের দু-দিনের সফরের আজই শেষ দিন। আবার সেই করচগাছ, দু-চারটি হিজলগাছ, লোকের বাড়ি দেখতে দেখতে চলেছি আমরা। যেতে যেতে সকালের নাস্তাও সেরে নিলাম; রুটি, ডিম আর সবজি।

বেশকিছু দূর এগোনোর পর জলের রঙ হঠাৎ বদলে গেল; কোথাও হালকা, কোথাও গাঢ় টিয়া রঙের জল। জল দেখতে দেখতেই অনেকটা পথ অতিক্রম করলাম। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একটা বাড়ির ঘাটে দেখলাম গেট সাজানো। বাড়িতে এবং ঘাটে কর্মব্যস্ত নারী-পুরুষ। হয়তোবা বিয়ের অনুষ্ঠান।

মাঝে মাঝে বিছিন্ন দ্বীপের মতো সবুজ জমিন, সেখানে চড়ছে শত শত মুক্ত গরু। নিশ্চয় পাশের জনপদ থেকে অল্প জলের ভেতর দিয়ে গরুগুলো সেখানে নিয়ে এসেছে রাখালেরা। এবার আর বিচ্ছন্ন দ্বীপের মতো বাড়ি নয়, জনপদের ধার ঘেঁষে ছুটতে লাগলো আমাদের নৌকা। মাঝে মাঝে কিছু পাথরভাঙা কারখানা চোখে পড়লো, অনেক শ্রমিক সেখানে কাজ করছে। কোথাও চোখে পড়লো টিনের দো-চালা ঘরের নিচে নৌকা নির্মাণ কারখানা। জাদুকাটা নদীর ধারে দেখতে পেলাম চুনাপাথরের বড় বড় ঢিবি। শ্রমিকেরা মাথার ঝুড়িতে চুনাপাথর বয়ে ঢালছে কার্গো লঞ্চে। এখান থেকে এসব চুনাপাথর চালান হয় দেশের ভেতরে।

বর্ষা মৌসুমে হাওরের অধিকাংশ মানুষেরই কৃষিকাজ কাজ থাকে না। অনেকে অলস সময় কাটায়। আবার অনেকে খেয়া পারপার করে, মাছ ধরে, হাঁসের খামার দেখাশোনা করে, কেউ পাথভাঙা কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে ইত্যাদি। এসময় অনেক গানের দল গান করে বেড়ায় হাওর পাড়ের বিভিন্ন গ্রামে।

দূর থেকে পাহাড় আর পাহাড়ের মাথায় রাশি রাশি ধূসর এবং তুতে রঙের মেঘ দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। যেন পাহাড়ের মাথায়-গায়ে চঞ্চল মেঘরাশির গোল্লাছুট! নৌকা আরো কাছে যেতেই সবুজ পাহাড়ের গায়ে একটা ঝর্ণা চোখে পড়লো। জাদুকাটা নদীর ধারেই শিমুলবন। আমরা নৌকা থেকে নেমে বালুর ভেতর দিয়ে কিছুটা হেঁটে পৌঁছলাম শিমুল বনে। সারি সারি শিমুল গাছ, যেদিক দিয়ে তাকানো যায় কেবল সারিবদ্ধ গাছ চোখে পড়ে। একটা গাছও সারিচ্যূত নয়। পরিকল্পনা করে লাগানো গাছগুলো। এখন বর্ষাকাল, ফলে গাছে ফুল নেই, সবুজ পাতা। তলায় ঘন সবুজ ঘাসের গালিচা। বসন্তকালে এখানে আসবার বাসা জেগে উঠলো মনের মধ্যে। বসন্তে শিমুল ফুল ফোটে, তখন কী ভালই না লাগে দেখতে! স্থানীয় একজনের কাছ থেকে জানলাম এই বাগানটির আয়তন একশো একর। নিঃসন্দেহে বাগানের মালিক সৌখিন মানুষ।

ইচ্ছেমতো ছবি তুললাম। তারপর ফিরে এলাম নৌকায়। নৌকা আরো সামনের দিকে এগোলো। পাহাড়ের গায়ের ঝর্ণাটা আরো দৃশ্যমান হতে লাগলো। দুই পাহাড়ের কোলের ভেতর দিয়ে মেঘালয় থেকে বাংলাদেশে পড়েছে জাদুকাটা নদী। ওই যে ঝর্ণাটি আমরা দেখতে পাচ্ছি ওটা মেঘালয়ের অংশে পড়েছে। নৌকা আরো কিছুটা এগিয়ে বাম দিকের একটা পাহাড়ী টিলার কাছে গিয়ে নোঙর করলো। আমরা নদীর ঢাল বেয়ে টিলার উপরে উঠলাম। এটা টিলার উপর বাংলাদেশের শেষ সীমান্তের একটি গ্রাম। গ্রামটির নাম বড়গুপটিলা। গ্রামের ভিতর দিয়ে হেঁটে, খানিকটা খাড়া চড়াই পেরিয়ে আমরা পৌছলাম বারিক্কা টিলার উপর। যে পাহাড়ে ঝর্ণাটির অবস্থান আমরা তার বিপরীতদিকের পাহাড়ে অবস্থান করছি, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে জাদুকাটা নদী। আমরা এতোক্ষণ একটি ঝর্ণা দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু এখানে এসে উপরদিকের পাহাড়ে আরো তিনটি জর্ণ দেখতে পেলাম, অর্থাৎ মোট চারটি ঝর্ণা। নয়ন জুড়ানো অপূর্ব দৃশ্য, চারটি ঝর্ণাকে ঘিরে নৃত্য করছে রাশি রাশি বর্ণিল মেঘ! ঠাঠা রোদের মধ্যেও অনেকটা সময় এখানে অতিবাহিত করলাম।

এখানকার ঝোপে-ঝাড়ে একধরনের গাছ দেখলাম। প্রায় কোমর সমান উঁচু গাছ, বড় বড় পাতা, থোকায় চার-পাঁচটি করে সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে, আরো কিছু কুঁড়ি ফোটার অপেক্ষায়। প্রত্যেকটা ফুলের পাঁচটি করে পাপড়ি। সমতলে কখনো এই ফুল দেখিনি। ফুলটির নাম জানতে পারলাম না।

খাড়া পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে সুমাইয়া বললো, ‘সব পাহাড় আর ভালো ভালো জায়গাগুলো ভারত নিয়ে নিয়েছে, আমাদের কিছুই দেয়নি, তাই না ভাইয়া?’

আমি মৃদু হাসলাম। এধরনের কথা আমি অনেক মুসলিম ছেলেমেয়ের মুখেই শুনেছি। এদের ধারণা ভারত ষড়যন্ত্র করে সব ভাল জায়গা নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এরা কি জানে যে এদের অনেকেরই দাদা কিংবা দাদার বাবা-চাচারা দেশভাগ করে মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবীতে রাস্তায় নেমেছিল? বিপুল উচ্ছ্বাসে পাকিস্তানের চাঁদ-তারা মার্কা মারা পতাকা উড়িয়েছিল আর মিছিলে স্লোগান দিয়েছিল-‘হাত মে বিড়ি মুখ মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’!

সিলেটের কিছু অংশে গণভোট হয়েছিল। সেই গণভোটে পাকিস্তানের পক্ষে গণজোয়ার তুলেছিল এদেশের অধিকাংশ মুসলিম। সেই গণভোটের ফল অনুযায়ী সিলেটের কিছু অংশ ভারত আর কিছু অংশ পায় বাংলাদেশ। সুমাইয়া এসবের কিছুই জানে না, এমনকি জানতে পারলাম র‌্যাডক্লিফ লাইন সম্পর্কেও ওর কোনো ধারনা নেই, ও র‌্যাডক্লিফের নামই শোনেনি! অথচ ও বাচ্চাদের একটি স্কুলের শিক্ষক!
এই যে আমাদের আঁটসাঁট পাঠ্যবই, ওগুলো ভাল মতো পড়লে জীবিকার রসদ মেলে, কিন্তু উন্মুক্ত জ্ঞান মেলে না, স্কুল শিক্ষক সুমাইয়াকে দেখে আমার সেই কথাটিই আবার মনে হলো। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের মৃত্যু ঘটেছে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে। আমার মতে প্রকৃত জ্ঞান ছড়িয়ে আছে দেশে দেশে, সমুদ্রে, নদীতে, পাহাড়ে-সমতলে, গ্রামের পাড়ায় পাড়ায়, ফসলি জমিতে, উন্মুক্ত তেপান্তরে, শহরের অলি-গলিতে; আর স্কুলের পাঠ্য বইয়ের বাইরে গণিত বইয়ে।

যাইহোক, ফিরবার সময় বড়গুপটিলা গ্রামে জাদুকাটা নদীর পারের একটি চায়ের দোকানে ঢুকলাম আমি আর সুমাইয়া। বাঁশের চাঙায় বসে জল আর চা খেয়ে তৃষ্ণা মিটালাম। এখান থেকে নদী, নদীর ওপারের গ্রাম, পাহাড়, মেঘ সবকিছুর সৌন্ধর্য উপভোগ করা যায়। প্রতিদিন সকাল-বিকাল প্রকৃতির এই রূপ দেখতে দেখতে যে চা খায়, অলস সময় কাটায়, আর্থিকভাবে সে যতো দরিদ্রই হোক, আমার কাছে সে ঐশ্বর্যশালী নয়।

আমরা নৌকায় ফিরলাম। নৌকা নোঙর করলো নদীর অপর পারের বালুচরে। একেবারেই অল্প জল দেখে আমি আর স্নান করতে নামলাম না। সকালে স্নান করে এসেছি, আবার হোটেলে ফিরে স্নান করবো। আমাদের দলের কেউ কেউ লাইফজ্যাকেট গায়ে দিয়ে কোমর সমান জলে স্নান করতে নেমে পড়লো! আমি খালি পায়েই নৌকা থেকে নেমে পড়লাম। কিছুটা দূরে নৌকায় লোকজন, মালামাল এবং মোটর সাইকেল পারাপার করছে। সেখানেই বালির মধ্যে দুটো তাঁবু খাটানো। আমি সেদিকেই হাঁটতে শুরু করলাম।

দূরের গ্রামটি দেখে স্থানীয় একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম গ্রামটির নাম লওড়ের গড়। ওখানে নাকি পুরোনো দূর্গ আছে। একটা মন্দির আর একটা মাজার আছে, শীতকালে মন্দিরে পূজার অনুষ্ঠান আর মাজারে ওরস হয়। অনেক লোকসমাগম হয়। না, শীতকালে একবার আসতেই হবে, ওখানেই তো পড়ে আছে গল্প-উপন্যাসের রসদ। তাঁবুর কাছে গিয়ে দেখলাম বালিতে খুঁটো পুঁতে বালুময় পথের দু-দিকে দুটো তাঁবু খাটানো। তাঁবুর নিচে পলিথিনের বিছানা পেতে কলা, বিস্কুট, সিগারেট, জল ইত্যাদি সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে দু-জন দোকানদার। বালুচর হেঁটে এসে যারা নদীর ওপারে যায় বা ওপার থেকে এপারে আসে মুলত তারাই এই দুই দোকানের খরিদ্দার। একটা তাঁবুর পাশে দশ-বারোজন নারী, অবশ্য নারী শব্দটি এদের সঙ্গে যায় না, অপচয় হয়; বোরকা নামক একটা ভ্রাম্যমাণ মহলের মধ্যে ঢুকে এরা চলাফেরা করে, ফলে এদেরকে মহিলা বলাই শ্রেয়। সবাই কালো বোরকা পরিহিত, দু-তিনজন বাদে কারো মুখ বা হাত দেখারও উপায় নেই। সব ঢাকা। বুঝলাম, বৃদ্ধের মুখে লাওড়ের গড়ে যে মাজারের কথা শুনলাম, ওই মাজারের পীর আর খাদেমরাই আশপাশের জনপদে বোরকার বীজ বপন করেছে। দোকানের অন্য পাশে একজন বৃদ্ধাকে দেখলাম শুধু শাড়ি পরিহিত। এরা সবাই অপেক্ষা করছে ওপার থেকে নৌকা আসার। আমি দোকানের ছবি তুললাম। বালির ভেতর দিয়ে সারি সারি মোটর সাইকেল আসছে, অপেক্ষা করছে নৌকার জন্য। আমাকে ছুবি তুলতে দেখে বৃদ্ধা স্থানীয় ভাষায় বললো, ‘কোথা থেকে এসেছো?’
‘ঢাকা থেকে।’
‘বাব্বাহ তোমরা অতোদূর ঢাকা থেকে এসেছো? আমরা তো সুনামগঞ্জেই যেতে পারি না!’

ওপার থেকে একটা নৌকা এসে থামলো বালুচরে। লোকজন, মালামাল আর মোটর সাইকেল বোঝাই। নৌকা খালি হতেই বোরকার বহরটি গিয়ে নৌকায় উঠলো, বৃদ্ধাও গেলেন, আরো কিছু লোকজন উঠলো। সাত-আটজন মোটর সাইকেলওয়ালা মোটর সাইকেল চালিয়েই উঠলো নৌকায়। ঘাট ছেড়ে গেল নৌকাটি। আমি পা বাড়ালাম লাওড়ের গড়ের দিকে, ওদিকেই ভারতীয় অংশেই ঝর্ণাটা। লাউড়ের গড়ের মন্দির আর মাজারে তো যাবার সময় পাব না, কিছুক্ষণ পরই আমাদের ফিরতে হবে। আমি সামনে এগোতে লাগলাম ঝর্ণাটা আরো কাছ থেকে দেখার জন্য। তাছাড়া প্রচণ্ড গরমেও কেন জানি না খালি পায়ে চুনাপাথর আর বালির ভেতর দিয়ে হাঁটতে ভাল লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গেলাম। চারপাশটা অসম্ভব সুন্দর। গ্রামের সবুজ রেখা গিয়ে মিশেছে পাহাড়ে, পাহাড়ের মাথায় আর নীল আকাশে মেঘ। ওই সবুজ রেখার গ্রাম থেকে বেরিয়ে বালুচরের ঘাটের দিকে আসছে মানুষ আর মোটর সাইকেল। নদীর ওপারে বড়গুপটিলা গ্রাম, বারিক্কা টিলাও এখন থেকে চোখে পড়ে।

পিছন ফিরে দেখলাম আমাদের দলের এক দম্পতি চলে এসেছে। এরাই কাল টাঙ্গুয়ার হাওরে বিপাকে পড়েছিল। মেয়েটিকে সকলে ধরাধরি করে নৌকায় তুলতে হয়েছিল। ওদের সাথে আলাপ হয়নি।
তরুণ বললো, ‘আপনার দেখাদেখি সাহস করে চলে এলাম।’

আলাপ হলো। তরুণ রবিতে চাকরি করে। বললাম, ‘কাঁটাতারের কাছে যাবেন নাকি? ওখান থেকে ঝর্ণাটা আরো ভাল দেখা যাবে।’
ওরা রাজি হলো। কিন্তু কিছুটা এগোনোর পর দেখলাম সামনে জল গভীর, উঁচু বালুচরের কারণে আমরা দেখতে পাইনি। কাঁটাতারের দিকে যেতে হলে অনেকটা ঘুরে যেতে হবে। ওদিকে যারা স্নান করছিল তারা সব উঠে পড়েছে। সঙ্গত কারণেই আমরা ফিরলাম। ফিরবার সময় আমি একটা পরিত্যক্ত নৌকায় বসে তরুণকে দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলিয়ে নিলাম। ওরা ফিরতে শুরু করলেও আমি পরিত্যক্ত ভাঙা নৌকায় বসেই রইলাম। হোক গরম, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে এভাবে একা রোদ উপভোগ করার সুযোগ জীবনে কবার মেলে! কিছুক্ষণ বসে অন্তর্জগতে ডুব দিয়ে রইলাম। তারপর উঠে চারপাশটা ভিডিও করে ধীর পায়ে ফিরতে লাগলাম নৌকার দিকে।

ফেরার পথেই দুপুরের খাবার খেলাম। এখন বিকেল, রোদের তেজ কমেছে, আকাশে জমেছে কালো মেঘ। পিছনে ফেলে আসা পাহাড় ক্রমশ ঝাপসা হতে লাগলো। ঝাপসা হতে হতে একসময় গ্রাম-গাছপালার একেবারে আড়ালে চলে গেল। যে পথে এসেছি সে পথে না ফিরে মাঝিরা অন্য পথ ধরলো যাতে আমরা তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারি। সুনামগঞ্জ গিয়ে রাতে বিশ্বকাপের খেলা দেখবো-আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্স ম্যাচ।

হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি, নৌকার ভিতরে গিয়ে জানালার কাছে গিয়ে বসলাম যাতে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারি। প্রচণ্ড বৃষ্টি, আর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো খুব বড় বড়, ফুলের মতো ফুটছে হাওরের জলে। হাওরের জলের রঙ কোথাও ঘোলাটে, কোথাও সবুজ। যেন হলো নৌকার ইঞ্জিনের শব্দটি না থাকলে ভাল হতো, বৃষ্টি আর জলের মধুর নিনাদ শুনতে পেতাম। একেবারে যে শুনতে পাচ্ছি না তা নয়, কিন্তু ইঞ্জিনের প্রবল শব্দের ভেতর থেকে বৃষ্টির শব্দ আবিষ্কার করে নিতে হচ্ছে সচেতনভাবে। আমার পিছনে কয়েকজন মিলে লুডু খেলতে বসলো। বাইরে এমন মনোরম দৃশ্য, লুডু খেলার সময় কোথায়! ছোট ছোট দ্বীপের মতো গাছপালায় ঘেরা ঘরবাড়ি, মানুষ, জেগে থাকা সবুজ চড়ে নিরন্তর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রাখাল ছেলেদের ফুটবল খেলা, বাহারি জলের রঙ, বৃষ্টির জলের সঙ্গে হাওরের জলের মৈথুনের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি বুঁদ হয়ে রইলাম প্রকৃতির অসীম শক্তি আর সৌন্ধর্যের ভাবনায়।

ঢাকা
জুলাই, ২০১৮।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৯:০৭

রাজীব নুর বলেছেন: ছবি কই?

২৩ শে মার্চ, ২০২০ রাত ১০:০৪

মিশু মিলন বলেছেন: এটা পুরোনো লেখা। ছবি দেওয়া বেশ ঝামেলার, তাই দিইনি। দেখি পরে সময় করে দেব।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.