নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জন্মান্তর (উপন্যাস: পর্ব-আট)

২৪ শে জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১১

চার


মিরপুর-১০ থেকে বাসে উঠে টেকনিক্যালে নেমে তারপর ভার্সিটির বাসে উঠে বসি একদম পিছনের সিটে। বেশিরভাগ দিনই বসার সিট পাই না, যেদিন পাই সেদিন একটু সুবিধে হয়, ঘুম না হলেও চোখ বুজে থাকি, একধরনের আরামদায়ক তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আসে, চোখে এবং মস্তিষ্কে একটু আরাম পাওয়া যায়; কিন্তু দাঁড়িয়ে গেলে আর তা হয় না, দাঁড়নো অবস্থায় চোখ বুজে থাকলে অন্যরা মজা করে আর হাসে।

বাস গাবতলী ব্রিজের ওপর। তুরাগের বুকের আয়নায় নিস্তেজ লালচে সূর্যের মুখ। এই জায়গায় তুরাগকে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত রাখে মানুষ আর যন্ত্র। দিবারাত্রি বালি-পাথর বোঝাই ছোট জাহাজ বা কার্গো লঞ্চ এখানে নোঙর করা হয়, বালি-পাথর এখান থেকে ট্রাকে এবং ট্রলারে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার ভেতরে আর আশপাশে। মানুষের লোভ সম্প্রসারিত হচ্ছে, লোভের চাপে ব্রিজের দু-পাশ থেকে ক্রমশ ছোট হচ্ছে তুরাগ, বালি ভরাট করে গড়ে উঠেছে ট্রাকস্ট্যান্ড। কে জানে আমাদের উত্তরপুরুষ তুরাগকে দেখতে পাবে কিনা, তারা হয়তো তুরাগের কথা পড়বে বইয়ের পাতায়!

ব্রিজ পার হয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে বাস, এতোক্ষণ ভ্যাপসা গরম লাগলেও ব্রিজ পার হবার পর বাসের গতি বাড়লে বেশ স্বস্তি লাগে জানালা দিয়ে ঢোকা ডানপিটে বাতাসে। আমি চোখ বন্ধ করি। রাতে শুতে দেরি হওয়ায় ঘুম কম হয়েছে। চোখের পাতায় এবং মগজে দারুণ আরাম অনুভব করি! আর এই আরামদায়ক অনুভূতির ভেতরেই হঠাৎ ফিরে আসে দাদার স্মৃতি। দাদা মারা গেছেন চৌদ্দ বছর হলো, আমার বয়স তখন দশ। আজকে দাদার মৃত্যুবার্ষিকী, বাসার সবাই মিরপুর কবরস্থানে গেছে দাদার কবর জিয়ারত করতে; আমি যাইনি। গত চার বছর যাবৎ আমি পরিবারের সঙ্গে দাদার কবর জিয়ারত করতে যাই না। মুসলমানদের কবর জিয়ারত করার ব্যাপারটা স্ববিরোধী মনে হয় আমার কাছে। মুহাম্মদ যখন মৃত্যু শয্যায় তখন তার দুই স্ত্রী উম্মে হাবীবা এবং উম্মে সালামা তার কাছে মারিয়া নামক গীর্জার বর্ণনা করেছিলেন যে গীর্জার ভেতরে মৃত মানুষের মূর্তি এবং ছবি ছিল; যা তারা দেখেছিলেন হাবশায় প্রবাসী থাকাকালীন। দুই স্ত্রীর মুখে গীর্জার বর্ণনা শুনে মুহাম্মদ যা বলেছিলেন হাদিস অনুযায়ী তা এরকম, ‘আল্লাহ ইহুদী এবং খ্রিষ্টানদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করুন, কারণ তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ এবং সিজদার স্থান করে নিয়েছে। কিয়ামতের দিন এরা হবে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র কাছে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট সৃষ্টি।’

হাদিস ঘাটলে জানা যায় যে মৃতের কফিনে বা কবরে সিজদা করা, পূজা করা, ফুল দেওয়া, মোমবাতি বা ধুপকাঠি জ্বালানো, লোবান দেওয়া বা অন্য কোনো প্রকারে মর্যাদা বা সম্মান দেওয়া শিরক-বেদাত। তবে শুধুমাত্র জিয়ারত করা বা দোয়া-খায়েরের জন্য কবরে যাওয়া জায়েজ। স্ববিরোধীতার ব্যাপারটা এখানেই, যখন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মৃত ব্যক্তির সমাধিতে গিয়ে ফুল দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে সম্মান জানায় তখন মুসলমানরা সেটাকে পূজা করা বলে। মুহাম্মদ তাদের ধ্বংস কামনা করে তাদেরকে আল্লাহ’র নিকৃষ্ট সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়েছেন। অথচ মুসলমানরা কবরের সামনে দাঁড়িয়ে জিয়ারত করলে কিংবা দোয়া পড়লে সেটা পূজা নয়, কেন? অন্যান্য ধর্মাবললম্বীদের কবরে সম্মান জানানোটা যদি পূজা হয়, তবে মুসলমানদের কবর জিয়ারত করাও নিশ্চয় এক ধরনের পূজা, রীতিটা কেবল আলাদা। তাছাড়া মাজারের কথা না হয় বাদই দিলাম, এখন কবরও খ্রিষ্টানদের সমাধির মতো পাকা করে বাঁধানো নয়। কবরেও ধুপকাঠি জ্বালানো হয়, ফুল দেওয়া হয়।

স্বয়ং মুহাম্মদের কবরও জিয়ারত করে তার কোটি কোটি অন্ধ ভক্ত, এসবই মুসলিমদের স্ববিরোধীতা। অন্যরা যা করছে সেটা ভাল নয়, খুব খারাপ; আমি যেটা করছি সেটাই সর্বোৎকৃষ্ট ভেবে অন্যদের ধ্বংস কামনা করার প্রবল মানসিকতা থেকেই জন্ম হয় সহিংসতা-সংঘর্ষের। এই মানসিকতা থেকেই মুসলমান মানসে সৃষ্টি হয় বিদ্বেষের সাইমুম, আর সময়ে-অসময়ে তা আছড়ে পড়ে ভিন্নমতাদর্শীদের ওপর।

গত চার বছর যাবৎ আমি দাদার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি আমার মতো করে, সেখানে কোনো ধর্মীয় রীতি-নীতি বা অনুশাসন থাকে না, থাকে ভালবাসা-শ্রদ্ধা। মৃত্যুবার্ষিকীর দিন বিকেলে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আমি একা যাই কবরস্থানে; দাদার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই, দাদার সঙ্গে একান্তে কথা বলি, তার গন্ধ-স্পর্শ অনুভব করি। আত্মা-পরকাল এসবে আমি বিশ্বাসী নই; কিন্তু তারপরও আমি যাই এজন্য যে, আমি মনে করি মৃতের কবরে শ্রদ্ধা জানানো যেতেই পারে। দাদা ছিলেন বলেই আমি আছি, তাই দাদার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত আমার এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।

বিকেলে ক্লাস শেষে ফেরার পথে ভার্সিটির বাস থেকে নেমে পড়ি মাজাররোডের মাথায়, তারপর রিক্সাযোগে এসে নামি কবরস্থানের গেটে। পিঠে বইয়ের ব্যাগ আর হাতে একগুচ্ছ সাদা এবং হলুদ গোলাপ নিয়ে আমি হেঁটে এগিয়ে যাই কবরস্থানের রাস্তা ধরে। লোকজন খুব একটা নেই, গেটের কাছে কয়েকজন ফকির, ভেতরে আলাদা দুটো কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তিনজন মানুষ জিয়ারত করছেন। তাদের থেকে সামান্য তফাতেই একটি বাঁধানো কবরের ওপর গোলাপ এবং রজনীগন্ধার ম্রিয়মাণ পাপড়ি ছড়ানো রয়েছে। অন্য একটি কবরের পাশে শুকিয়ে যাওয়া একটি ফুলের তোড়া। কোরান-হাদিস অনুযায়ী এই পুষ্পাঞ্জলি নিঃসন্দেহে শরীয়ত বিরোধী কাজ। হয়তোবা না জেনেই কবরস্থ লোকটির স্বজন-প্রিয়জনেরা শ্রদ্ধাভরে তার কবরের ওপর পুষ্পাঞ্জলি করেছে। এই যে প্রিয়জনেরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছে তাদের এক সময়ের খুব কাছের একজন মানুষের কবরে; জীবদ্দশায় এই মানুষটি প্রিয়জনদেরকে ভালবেসেছে, স্নেহের পরশ বুলিয়েছে সন্তানের গায়ে, আদর বুলিয়েছে প্রেয়সীর গালে; তো সেই প্রিয় মানুষটির কবরে ফুলের মতো সুন্দর বস্তু দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো কী কখনো খারাপ কাজ হতে পারে! যে বলে এটা খারাপ কাজ, শরিয়ত বিরোধী কাজ; সে এক হৃদয়হীন পাষণ্ড, যেমন- মুহাম্মদ! যে পুস্তকে লেখা এই বিধান, নিকুচি করি আমি সেই পুস্তক!

হাঁটতে হাঁটতে দাদার কবরের কাছে পৌঁছে যাই, দাদার কবরটা রাস্তা থেকে খানিকটা ভেতরের দিকে, বেশ সুনসান জায়গায়, সামান্য তফাতেই একটা নিমগাছ। সাদা টাইলস-এ বাঁধানো দাদার কবরটি চকচক করছে। কবরের ওপর কোনো ফুলের পাপড়ি বা ফুল নেই; আছে কয়েকটি ঝরে পড়া নিমপাতা। ইসলাম ধর্মমতে কবরে ফুল দেওয়া যে বেদাত, তা আমার পরিবার জানে, এজন্যই তারা কবরে এসে শুধুই জিয়ারত করে চলে যায়। কিন্তু গত চার বছর ধরে আমি কবরস্থানে আসার সময় একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আসি দাদার কবরে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। ফুল আমার খুবই প্রিয়, ফুলের ব্যবহার আমি পছন্দ করি; হোক তা জীবিত মানুষের হাতে কিংবা খোঁপায়, মৃত মানুষের শয্যায়-কফিনে কিংবা কবরে-সমাধিতে।

নিস্তেজ সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। এদিকের কবরগুলোর ওপর মাতৃস্নেহের মতো গাছের নিবিড় ছায়া পড়েছে। আমি কাঁধের ব্যাগ বাঁধানো সরু পথের ওপর নামিয়ে রেখে হাঁটু মুড়ে বসে দাদার কবরের ওপর ফুলের গুচ্ছ রেখে কবর স্পর্শ করি, হাত বুলাতে থাকি কবরে। দাদার কবরে হাতের পরশ বুলাতে বুলাতে আমি আমার সারা গায়ে দাদার হাতের স্পর্শ অনুভব করি যেন! দাদা প্রায়ই আমার সারা গায়ে গ্রাম থেকে আনা ঘানি সরিষার তেল মালিশ করে দিতেন স্নানের আগে। সেই স্পর্শের অনুভূতি, সেই ঘানি সরিষার তেল আর দাদার গায়ের গন্ধ, সেই ছবি এখনো আমার স্মৃতিতে সজীব। আসলে আমি তার ছেলের ঘরের প্রথম নাতি বলে তিনি আমাকে সবার চেয়ে বেশি ভালবাসতেন। এটা নিয়ে আমার চাচী বেশ মনঃক্ষুন্নও ছিলেন।

ব্যাগে কিছু গোলাপের পাপড়ি এনেছি, সেখান থেকে দু-মুঠো পাপড়ি নিয়ে ছড়িয়ে দিই দাদার কবরের ওপর আর অবশিষ্ট পাপড়িপুলো রেখে দিই ব্যাগে। আমি দাদার কবর স্পর্শ করে বসে থাকি। মনে মনে কথাও বলি দাদার সঙ্গে, অনেক কথা! কেবল দাদার মৃত্যুবার্ষিকীতেই নয়, প্রায়ই আমি কবরে আসি, ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন শ্মশানেও যাই। কবর কিংবা শ্মশানে মানুষের প্রায়ই আসা উচিত, একা। তাহলে জীবনটা একটু অন্যভাবে উপলব্দি করা যায়, এই উপলব্ধিটা আসলে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ব্যাপারটা বিমূর্ত শিল্পের মতো, কেবল অনুভব করাই ভাল, ব্যাখ্যা করতে যাওয়াও বোকামি। শ্মশান কিংবা কবরে এলেই আমার মনে হয় যে একদিন আমি এই পৃথিবীতে থাকবো না, আমি এই পৃথিবীর ক্ষণকালের অতিথি; পৃথিবীর বায়ু-পানি আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে, পৃথিবীর শস্যদানা খেয়েই আমার শরীরের বৃদ্ধি ঘটছে আর আমি বেঁচে থাকছি; অতএব পারতপক্ষে আমার দ্বারা যেন এই পৃথিবীর কোনো ক্ষতি না হয়।

আশপাশের গাছগুলোয় বসা পাখিরা থেকে থেকে ডেকে ওঠে, দু-একটা চড়ুইপাখি গাছের ডালে নাচতে নাচতে হঠাৎ-ই নিচে নেমে বসে কোনো বাঁধানো কবর কিংবা বাঁশের বেড়ার ওপর, আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। নিমগাছের একটা হেলে পড়া ডালে বসে ঈষৎ ঘাড় বাঁকিয়ে যেন-বা দার্শনিক ভাবনায় মগ্ন একটা হলদে পাখি! পাখিটার মাথা, গলা, ঊর্ধ্ব বক্ষ, পুচ্ছ এবং ডানার আগার দিকের কিছু অংশ কালো; দেহের বাকি অংশ উজ্জ্বল সোনালি হলুদ রঙের, গোলাপি ঠোঁট আর গাঢ় লাল চোখ। ডানে-বাঁয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে ‘কোয়াক’ বোল তুলে ডেকে ওঠে দু-বার। তারপর হঠাৎ একপশলা বাতাস ছুঁয়ে যায় নিমগাছ, হলদে পাখি, কবর আর আমাকে; হলদে পাখিটা উড়ে যায়। আচমকা আমি নিজেই যেন হলদে পাখি হয়ে যাই! কালের গায়ে ঠেস দিয়ে হলদে পাখি হয়ে আমি উড়ে যাই মহাকালের শরীর বেয়ে অতীতের দিকে! আমি উড়তে থাকি, ক্রমাগত উড়তেই থাকি-গ্রাম, উপশহর, শহরের ওপর দিয়ে; কতো জনপদ, কতো খালবিল, নদী-নালা পেরিয়ে, মেঘ ফুঁড়ে আমি উড়ে চলি; কতো জনপদের ওপর আমার ছায়া পড়ে, কতো নদী বা বিলের ওপর পড়ে চঞ্চল প্রতিবিম্ব! উড়তে উড়তে আমি পৌঁছে যাই চতুর্দশ শতকের প্রাচীন নগর শ্রীহট্টে, শ্রীহট্টের আকাশে চক্কর মারতে মারতে নদীতে দৃষ্টি পড়তেই ভীষণ তৃষ্ণা অনুভব করি। তৃষ্ণা মিটাতে অবতরণ করি নদীটির পারে, সুরমা নদী; সুরমার জলে গোলাপি ঠোঁট ডুবিয়ে জলপান করতেই আবার আমি মানুষ হয়ে যাই! জলের ওপর ঝুঁকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখি নিজের প্রতিবিম্ব! সুরমার শীতল জল আঁজলায় তুলে পুনরায় পান করি আর মুখমণ্ডলে জল ছিটিয়ে জলের কাছে সঁপে দিই ক্লান্তি। তারপর নদীর ঢাল বেয়ে উঠে হাঁটতে শুরু করি সুরমা পারের রাস্তা ধরে। হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াই একটা নৌ-ঘাটের কাছে এসে। ঘাটে অনেকগুলো নৌকা নোঙর করা; ছোট, মাঝারি এবং বৃহৎ বাণিজ্য নৌকা। মানুষেরা নৌকায় মালামাল তুলছে-নামাচ্ছে; কিছু নৌকা ঘাটে নোঙর করছে, আবার কিছু ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে। আমি আবার হাঁটতে শুরু করি নৌ-ঘাট পিছনে ফেলে। প্রশস্ত রাস্তার একদিকে বসতি, কোথাও ছোট-বড় ইমারত কোথাওবা মাটির ঘর; অন্যদিকে স্রোতস্বিনী সুরমা। অনেকটা পথ হেঁটে সুরমা পারের একটা প্রাচীন বটগাছের নিচে এসে দাঁড়াই, পাশেই একটা ভাঙা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, ধ্বসে পড়া ছাদ আর দেয়ালের ইটে স্যাঁতার বসতি। মন্দিরটার সামান্যই অবশিষ্ট আছে তবু তারই ভেতর থেকে ডানপিটে বালক-বালিকার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে একটি অশ্বত্থ আর দুটি বটের চারা। কেউ বা কারা ভাঙা দেয়ালের স্যাঁতাপড়া ইটে সিঁদূরের ফোঁটা দিয়ে রেখেছে, যা দেখে আরো নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটা একটা মন্দির ছিল। হঠাৎ আমার দৃষ্টি পড়ে নদীর ঢাল বেয়ে উঠে আসা মাঝারি গড়নের কৃষ্ণবর্ণ একজন মানুষের দিকে; শ্মশ্রুমুণ্ডিত মুখ, খালি গা, মাথায় সাদা নামাজি টুপি, পরনে লুঙ্গির মতো করে পরা মলিন ধুতি। চোখে বিষাদমাখা উদাসীনতা। কাছে এসে অপলক দৃষ্টি রাখেন আমার দিকে, আমিও তার চোখে চোখ রাখি। তাকে চিনতে পেরে আমি হতবাক, আবেগাপ্লুত! কী করে কথা শুরু করবো, কোথা থেকে শুরু করবো তা বুঝে উঠতে পারি না! তিনি আমার পূর্বপুরুষ, দু-চোখ মেলে আমি কেবল তাকিয়ে থাকি তার দিকে, যার শরীরের জিন-সেল মাঝখানের আরো অনেক পুরুষের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বইছে আমার শরীরে। তিনি হঠাৎ মাথার টুপিটা খুলে ফেলেন। আমি তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি মাথার কাঁচা-পাকা চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত। তার নাকটা অবিকল আমারই মতো বড়ো, ভ্রু আর চোখেরও দারুণ মিল, চিবুকের টোল একই রকম! তার ঠোঁট দুটো যেন আমার বাবার ঠোঁট, চুলগুলোও বাবার মতো; মেদহীন শরীর, চিকন হাত বেশ লম্বা, হাত-পায়ের আঙুলগুলো সরু; ঠিক আমার বাবা-চাচা আর আমার মতো! বাম বাহুতে বেশ বড়ো একটি কাটা দাগ। তিনিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন আমাকে, হয়তো আমারই মতো সাদৃশ্য খোঁজেন। তার কণ্ঠস্বর শোনার ব্যাকুলতায় নীরবতার অদৃশ্য আব্রু সরিয়ে বলি, ‘কেমন আছেন?’

তিনি আমার কথার উত্তর দেন না, ছলছল চোখে এমনভাবে তাকিয়ে থাকেন যেন ত্বক ভেদ করে তিনি আমার শরীরের অভ্যন্তর দেখছেন! আমি পুনরায় প্রশ্ন করি, ‘আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

এবার তিনি মৃদুভাবে হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়েন, কিন্তু মুখে কিছু বলেন না। কথা না বলায় আমি বোঝার চেষ্টা করি যে আমার এই পূর্বপুরুষ বোবা কি না। তার চোখে জোয়ারের পূর্বাভাস, নিমীলিত ঠোঁটে প্রভূত আনন্দের হাসি। হাতের টুপিটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে তিনি নীরবে দু-হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে টেনে নেন। আমি মাথা পেতে তার বুকের স্পন্দন শুনি, তার শরীরের ঘ্রাণে নাক গুঁজে রাখি। আরে! এ যে চেনা স্পর্শের অনুভূতি, চেনা ঘ্রাণ; আমার বাবা আর দাদার স্পর্শের মতো একই অনুভূতি আর তাদের গায়ের মতোই ঘ্রাণ! আমি ইন্দ্রিয় দ্বারা মগজের কোষে কোষে সঞ্চয় করি আমার পূর্বপুরুষের শরীরের গন্ধ-স্পর্শ। তার চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে আমার ঘাড়ে। বেশ কিছুক্ষণ তার বুকে মুখ গুঁজে থাকার পর আমি মুখ তুলে তাকাই তার দিকে, এরই মধ্যে আমার দু-চোখ থেকে জল গড়িয়ে নেমেছে গাল বেয়ে, তিনি ডান হাতের আঙুলের পরশে আমার চোখের জল মুছে দেন, আমার মাথায়-মুখে-বুকে-কাঁধে হাতের স্নেহস্পর্শ বুলিয়ে বলেন, ‘কেঁদো না।’

আমি এতোক্ষণে নিশ্চিত হই যে তিনি বোবা নন, কথা বলতে পারেন। কিছুটা অভিমানের সুরে বলেন, ‘এতোকাল পর এই প্রথম আমার কোনো উত্তরপুরুষ তার পূর্বপুরুষের কথা ভাবলো!’

‘এর আগে আর কেউই ভাবেননি?’

‘না, ভাবেনি। আমার উত্তরপুরুষেরা তাদের পূর্বপুরুষের কথা কখনো ভাবেনি, ভাবার চেষ্টাও করেনি। ওরা কেবল ওদের সৃষ্টিকর্তা, ইহকাল-পরকাল, নিজের আর পরিবারের জীবন্ত মানুষগুলোকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। কিন্তু যাদের ত্যাগ আর লড়াই-সংগ্রামের ফসল ওরা, সেই পূর্বপুরুষদের কথা কখনোই ওদের মনে স্থান পায়নি। যেন ওদের কোনো পূর্বপুরুষ ছিল না, ওরাই ওদের বংশের গোরাপত্তন করেছে! অনেক বেশরিয়তী কর্ম করেও প্রতিনিয়ত সহি মুসলমান হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে! তুমি কেন পূর্বপুরুষদের কথা ভাবছো?’

‘আমি ইতিহাস বিস্মৃত হতে পারিনি, নিজের শিকড় অনুসন্ধান করবার অদম্য কৌতুহল আমার মধ্যে বিদ্যমান। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি আমার সেইসব পূর্বপুরুষদের, যারা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে, অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে জীবনটাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যু অবধি।’

তিনি বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘ইতিহাস, শিকড়, ইতিহাস! বড়ো নির্মম, বড়ো নিষ্ঠুর!’

তারপর স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমারই উত্তরপুরুষেরা বারবার আঘাত করছে আমার সেইসব স্বজনের উত্তরপুরুষকে, যারা শ্রীহট্ট থেকে পালাতে পেরেছিল, যাদেরকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হতে হয়নি। কিন্তু কী নির্মম পরিহাস, দীর্ঘকালব্যাপী একই রক্তের একটি ধারা আরেকটি ধারাকে হত্যা-নিপীড়ন করছে! হায়, আমার উত্তরপুরুষেরা আজ ইতিহাস বিস্মৃত, শিকড়চ্যূত!’

‘আপনার স্বজনেরা পালিয়েছিল কেন?’

‘না পালালে যে আমার আরো অনেক স্বজনের মতো হয় ওদেরকে তরবারির আঘাতে মরতে হতো, নয়তো আমার মতো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হতো।’

‘তরবারি! আমি তো শুনেছি ভারতবর্ষে, বিশেষত বঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের প্রসার ঘটেছে; সুফিদের অলৌকিক ক্রিয়া, তাদের মুখে ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কথা, শান্তির বার্তা শুনে মানুষ মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে!’

আমার এই কথায় নিমেষেই তার চোখ-মুখের ভাষা বদলে যায়, উত্তেজনায়-আক্রোশে দু-হাতে নিজের মাথার চুল টানতে থাকেন, তারপর ভগ্ন মন্দিরের দেয়ালে পরপর সজোরে কয়েকটি ঘুষি মেরে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলেন, ‘মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা, ডাঁহা মিথ্যে কথা!’

আমি দ্রুত তাকে জাপটে ধরি, তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন আর কান্না জড়ানো গলায় বারবার বলতে থাকেন, ‘মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা, ডাঁহা মিথ্যে কথা!’

বেশ কিছুক্ষণ আমি তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখি। তারপর তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ-মুখের জল মোছেন। কিছুটা শান্ত হলে বলি, ‘আমি সত্যটা আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।’

তিনি তার বাম বাহুর দাগটি দেখিয়ে বলেন, ‘দেখ, এটা তরবারির কোপের দাগ।’

আমি দাগের ওপর আলতোভাবে হাত বুলাই, ‘কে কোপ মেরেছিল?’

‘ভারবর্ষের শ্রেষ্ঠ সুফিসাধক নিজামুদ্দিন আউলিয়ার যোগ্য শিষ্য, বঙ্গের শ্রেষ্ঠ সুফিসাধক, তোমাদের শান্তিকামী মহান সুফিসাধক হযরত শাহ্ জালাল!’

আমি আঁৎকে উঠি, ‘হযরত শাহ্ জালাল!’

‘হ্যাঁ, হযরত শাহ্ জালাল।’

আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি তার মুখের দিকে, তিনি আমার পূর্বপুরুষ, আমি তাকে অবিশ্বাস করতে পারি না। আবার হযরত শাহ্ জালাল যে তাকে তরবারির আঘাত করেছে, একথা বিশ্বাস করতে আমার খারাপ লাগে। যে শাহ্ জালালের নামে বিশাল মাজার হয়েছে, কোটি কোটি ভক্ত যাকে অহিংস সুফিসাধক জেনে তার মাজারে আসে শ্রদ্ধা জানাতে-মানত করতে, যার সম্পর্কে কেবলই ভাল ভাল কথা শুনেছি এতোদিন, সেই সুফিসাধক হযরত শাহ্ জালাল হাতে তরবারি তুলে নিয়েছিলেন! আঘাত করেছিলেন আমারই পূর্বপুরুষকে!

‘তবে যে হযরত শাহ্ জালাল সম্পর্কে শুনতে পাই-তিনি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষ ছিলেন, হরিণের চামড়ার জায়নামাজে নদী পার হয়েছিলেন, পরম দয়ালু ছিলেন!

‘গুজব, সব গুজব, তিনি কোনোদিন তার অলৌকিক ক্ষমতা কাউকে দেখাতে পারেননি। তার হরিণের চামড়ায় নদী পার হওয়া এবং আরো অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে গুজব রটিয়েছিল সেনাপতি নাসিরুদ্দিনের বাঙালী সৈন্যরা, যাতে রাজা গৌরগোবিন্দ’র সৈন্যরা ভয় পায়! মুসলমান বাহিনী জেতার পর কোনো কোনো সহজ-সরল মানুষ এইসব গুজব বিশ্বাস করেছিল।’

‘শোনা যায় শাহ্ জালালের মুখে ইসলামের সাম্যবাদের কথা শুনে সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।’

‘সব মিথ্যে কথা, বানানো কথা। শাহ্ জালাল তো প্রথমদিকে বাংলা ভাষা বুঝতেনই না, তাহলে তিনি কী করে ইসলামের সাম্যবাদের কথা বলে মানুষকে প্রভাবিত করবেন? পারস্য এবং আরব ভূমি থেকে আসা সুফিরা আরবি আর ফারসি ভাষা ব্যতিত কোনো ভারতীয় ভাষায় কথা বলতেন না। ভারতীয় ভাষাকে তারা ঘৃণা করতেন, ভারতীয় ভাষাকে “জাহিলিয়া ভাষা” বলতেন। অন্যদিকে শ্রীহট্টের সাধারণ মানুষও প্রথমদিকে আরবি-ফারসি ভাষা বুঝতো না। তাহলে তারা কি ক’রে শাহ্ জালালের কথায় মুগ্ধ হবে? মানুষকে জোর করে মুসলমান বানানোর পর নাসিরুদ্দিনের কোনো কোনো সেনা দো-ভাষীর কাজ করতো। তখন থেকেই বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি-ফারসি ভাষা ঢুকতে শুরু করে।’

রাস্তার পাশের সবুজ ঘাস দেখিয়ে আমি তাকে বলি, ‘চলুন, ওখানে গিয়ে বসি। আমি শুনতে চাই সে-সব কথা।’

দু-জনে পাশাপাশি হেঁটে গিয়ে ঘাসের ওপর বসি। তিনি সুরমার বুকে দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলতে শুরু করেন, ‘তখন আমাদের শ্রীহট্টের রাজা ছিলেন গৌরগোবিন্দ। গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ’র নির্দেশে তার ভাতিজা সিকান্দার খান গাজী দু-বার আমাদের রাজ্যে হামলা চালায়, রাজ্যের কিছু ধন-প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি হলেও হামলাকারীরা দু-বারই পরাজিত হয় আমাদের রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর কাছে। সুলতানের প্রধান সেনাপতি নাসিরুদ্দিন তৃতীয়বার যখন আমাদের রাজ্যে হামলা চালায়, তখন আমার বয়স তেরো। দিল্লীর সুফি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার আদেশে তিনশো ষাট জন অনুসারী নিয়ে নাসিরুদ্দিনের পক্ষে জিহাদ করতে শ্রীহট্টে আসে শেখ শাহ্ জালাল। দু-পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। চারিদিকে খবর রটে যায় যে সুলতানের পক্ষে যুদ্ধ করতে দিল্লী থেকে শেখ শাহ্ জালাল নামে অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন একজন যোদ্ধার নেতৃত্বে একদল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা এসেছে, যাদের পরাজিত করা অসম্ভব; রাজা গৌরগোবিন্দের সৈন্যদেরকে তারা কচুকাটা করছে! রাজ্যের পরাজয় আসন্ন ভেবে অনেকেই তখন পরিবার-পরিজন নিয়ে ধর্ম এবং জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যেতে শুরু করে আসাম আর কামরূপের জঙ্গলের দিকে, অনেকে শ্রীহট্ট ছেড়ে অন্য কোথাও। আবার অনেকেই রয়ে যায় এই আশায় যে আগের দু-বার সুলতানের বাহিনী পরাজিত হয়েছে, নিশ্চয় এবারো হবে।

এই আশায় বুক বেঁধে আমাদের পরিবারও শ্রীহট্টে থেকে যায়, আমি তখন তেরো বছরের কিশোর। এক সন্ধেয় বাবার সাথে হাট থেকে ফিরছি, আমাদের পল্লীর কাছাকাছি চলে এসেছি। বাবার মাথায় দ্রব্যসামগ্রীর ধামা, আমার হাতে এক ঠোঙা মিঠাই, আমি মনের আনন্দে মিঠাই খেতে খেতে বাবার পাশে পাশে হাঁটছি। হঠাৎ ধুলো উড়িয়ে পিছন থেকে ধেয়ে আসে একদল অশ্বারোহী সৈন্য! ভয়ে আমার হাত থেকে পড়ে যায় মিঠাই, বাবার মাথা থেকে দ্রব্যসামগ্রীর ধামা! দৌড়ে পালাবার আগেই তারা আমাদের ধরে ফেলে। সর্দার গোছের একজন বাবাকে কোপ দিতে গেলে আমি ভয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরি, বাবা আর আমি দু-জনেই হুড়মুড়িয়ে মাটিতে পড়ে যাই। পড়ে যাবার সময় তরবারি’র ডগা আমার বাম বাহুর মাংস কেটে বেরিয়ে যায়। গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে আমার কাটা বাহু থেকে। একজন সৈন্য আমার চুলের মুঠি ধরে বাবার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে নেয়, বাবা আমাকে আঁকড়ে ধরতে গেলে সে বাবার বুকে লাথি মেরে পুনরায় বাবাকে ধুলোর মধ্যে ফেলে দেয়। তারপর সর্দার গোছের লোকটির নির্দেশে একজন সৈন্য তার হাতের তরবারি দিয়ে এক কোপে বাবার ধড় থেকে মস্তক আলাদা করে ফেলে, ছিন্ন মস্তক ধুলোর মধ্যে লুটিয়ে পড়ে আর ধড়টা আছাড়ি-পিছাড়ি করতে থাকে! আমি আর্তচিৎকার করে উঠায় একজন সৈন্য আমার উদ্দেশে তরবারি তুলতেই সর্দার লোকটি হাতের ইশারায় থামার ইঙ্গিত করে দুর্বোধ্য ভাষায় তাকে কিছু বলায় আমার মস্তকটি আর ধুলোয় লুটায় না।

এরপর তারা আমাদের পল্লীতে আক্রমণ করে, কিছু কিছু বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ত্রাস সৃষ্টির জন্য, দাউ দাউ করে জ্বলে সারা পল্লী; মানুষের চিৎকার, কান্নাকাটি, আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে বাতাস। পুরুষদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে ওরা; আর নারী-শিশু-বালকদের করে বন্দী, আমাকেও।

শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজা গৌরগোবিন্দ পরাজিত হন, অনেক সৈন্য পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করে। আর যারা পালাতে পারে না, তারা মুসলিম বাহিনীর হাতে কচুকাটা হয়!

এরপর আমাদেরকে বন্দী করে যেখানে নিয়ে যায় সেখানে আগে থেকেই আমার মতো অনেক কিশোর, শিশু, নারী আর কিছু পুরুষ ছিল। আমার মতো যারা আহত ছিল, তাদের ক্ষতস্থানে লতাপাতার ওষুধ লাগিয়ে কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। আমাদেরকে জানানো হয় ইসলাম গ্রহণ করলে আমরা প্রাণে বাঁচতে পারবো, অন্যথায় আমাদেরকে হত্যা করা হবে। পরদিনই আমাদের মুসলমান হিসেবে দীক্ষিত করা হয়। ইসলামে ধর্মান্তরিত বহু মহিলাকে যোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়, তাদের সর্বনাশ করে, গর্ভে বাচ্চা উৎপাদন করে। আরো অনেকের মতোই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে প্রাণে বেঁচে যাই আমি; কানাই মণ্ডল থেকে হই মোহাম্মদ কলিমুদ্দি।

যার তরবারির আঘাতে আমার বাহুতে ক্ষত হয়েছিল, যার নির্দেশে আমার বাবার মস্তক ধড় থেকে ছিন্ন করেছিল একজন সৈন্য, তার কাছেই আমরা কলেমা পড়ে ইসলামে দীক্ষিত হই; তখনই জানতে পারি যে তিনিই শাহ্ শাহজালাল। সেদিন একসঙ্গে বহু মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করা হয়, তবে কাউকেই খৎনা করা হয়নি; শুধুমাত্র শেখানো কলেমা মুখে মুখে বলেই আমরা মুসলমান হই; আমরা কেউই শুদ্ধভাবে কলেমা উচ্চারণ করতে পারিনি!’

এ পর্যন্ত বলে তিনি ছলছল চোখে উদাসীন দৃষ্টি আকাশে ভাসিয়ে কিছুক্ষণ মৌন থাকেন, তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা, তারপর বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষেরা সনাতন ধর্মাবলম্বী, আমার উত্তরপুরুষেরা খৎনা করা মুসলমান, মাঝখানে আমি এক হতভাগ্য পুরুষ-খৎনাবিহীন মুসলমান; আমিও সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলাম জীবনের প্রথম তেরো বছর। আমি এক অভিশপ্ত মানুষ, আমি আমার পূর্বপুরুষ এবং উত্তরপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন; মুসলমান হওয়ার পর থেকে আমি পূজাপার্বণ করতে পারিনি, আবার ঠিকমতো নামাজপড়া-কলেমা পড়াও শিখতে পারিনি! আমি নিঃসঙ্গ। সারাজীবন আমি কেবলই এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেরিয়েছি যে আমার জীবনেই কেন এমন দূর্ঘটনা ঘটলো, কেন আমাকেই এতো রক্তপাত-স্বজনের মৃত্যু দেখতে হলো, আমার আগের কিংবা পরের কোনো পুরুষের ক্ষেত্রে কেন এমন দূর্ঘটনা ঘটলো না?’

তিনি উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন শূন্যে, আমি ঝাপসা চোখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। আমার কানে বাজতে থাকে তার বলা শেষ কথাগুলো আর চোখের সামনে ভাসতে থাকে হযরত শাহ্ জালালের মাজার, যেখানে অসংখ্য ভক্তের ভিড়, ভক্তদের মানত করা, মোমবাতি-আগরবাতি প্রজ্জ্বলন, ভক্তি-শ্রদ্ধার কতোরকম দৃশ্য; অথচ তারা জানেও না যে যাকে তারা এতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করছে, তারই হাতে নির্যাতিত, খুন এবং ধর্মান্তরিত হয়েছে তাদেরই পূর্বপুরুষেরা; সম্ভ্রম হারিয়েছে কুলনারীরা। আমার চোখের সামনে ভাসে সিলেট শাহ্ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। যে সুফি একজন গোঁড়া-ধর্মান্ধ-হিংস্র মুসলমান ছিলেন, যে সুফি ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তারে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, যে সুফি কোরান-হাদিস শিক্ষা ব্যতিত অন্য কোনো শিক্ষার কথা ভাবতেও পারেননি; তার নামেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শাহ্ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়! দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নামকরণও হয়েছে তারই নামে! হায়রে ইতিহাসের গায়ে পরিহাসের কী নিষ্ঠুর আলখাল্লা!

বুকে ব্যথার ভারে দু-জনেই মৌন, অনেকক্ষণ পর আমার পূর্বপুরুষ কানাই মণ্ডল অথবা কলিমুদ্দি বলেন, ‘শাহ্ জালাল সাতশো জিহাদি সঙ্গে নিয়ে ভারতে এসেছিল ইসলামী জিহাদে অংশ নেবার জন্য। কোনো সাধু উদ্দেশ্য তার ছিল না। তারও অনেক বছর আগে সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর বাহিনীর সাথে ভারতে এসেছিল সুফিসাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী। উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নেওয়া। দিল্লী এবং আজমীরের শাসক তখন পৃথ্বীরাজ চৌহান। ঘোরী দিল্লী আক্রমণ করলে পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজপুত বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয় তরাইন নামক স্থানে। তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পৃথ্বীরাজের হাতে বন্দী হয় ঘোরী। কিন্তু ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি এবং প্রাণহানি সত্ত্বেও দয়ালু রাজা পৃথ্বীরাজ ঘোরীকে সসম্মানে মুক্তি দেন। বিশ্বাসঘাতক ঘোরী সংগঠিত হয়ে পরের বছর পুনরায় দিল্লী এবং আজমীর আক্রমণ করে। তরাইনের এই দ্বিতীয় যুদ্ধে ঘোরীর কাছে পরাজিত হয়ে বন্দী হন পৃথ্বীরাজ। বেঈমান ঘোরী পৃথ্বীরাজের চোখ উপড়ে ফেলে তাকে হত্যা করে।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী অস্ত্রহাতে ঘোরীর পক্ষে জিহাদে অংশগ্রহণ করে। এরপর সে আজমীরের আনাসাগর সরোবরের কাছে আস্তানা গড়ে তোলে এবং আশপাশের প্রচুর হিন্দুকে জোরপূর্বক ইসলামে দীক্ষিত করে, আর মন্দির ধ্বংস করতে যোদ্ধাদের প্ররোচিত করে। সে যখন জানতে পারে যে গরু খেলে হিন্দুদের জাত যায়, তখন থেকেই সে এক হিন্দু মন্দিরের সামনে প্রতিদিন একটি করে গরু জবাই করা শুরু করে হিন্দুদেরকে অপমান এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য।

বখতিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয়ের পর এসেছিল আরেক সুফি শেখ জালালুদ্দিন তাবরিজী, পান্দুয়ার (মালদাহ) দেবতলায় একটি মন্দির ধ্বংসের পর সেখানে খানকাহ্ নির্মাণ করে প্রচুর হিন্দু এবং বৌদ্ধকে জোরপূর্বক ইসলামে দীক্ষিত করে সে।

সুফিরা কোথাও অস্ত্র হাতে সরাসরি জিহাদে অংশ নিতো আবার কোথাও পিছনে থেকে মুসলিম শাসকদের ইন্দন জোগাতো বিধর্মীদের মন্দির-উপসনালয় ধ্বংস করে তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত অথবা হত্যা করার জন্য। কোথাও ইসলামের বিজয়ের খবর পেলে তারা উল্লাসিত হয়ে মুসলিম শাসকদের প্রশংসা করতো আর বিধর্মীদের ওপর আরো জোরালো হামলা চালানোর জন্য উৎসাহিত করতো। বিধর্মীদের রাজ্য থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ আল্লাহ’র উপহার হিসেবে তারা গ্রহণ করতো। দিল্লী, কাশ্মীর, গুজরাট, বঙ্গসহ ভারতবর্ষের সকল অঞ্চলে ইসলাম প্রসারের চিত্র একই রকম নির্মম ও নিষ্ঠুর।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘অথচ সকলে বলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে নিন্মবর্ণের হিন্দুরা ইসলামের সাম্যবাদে মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্চায় ইসলাম গ্রহণ করেছে।’

‘হুম, সাম্যবাদ! কীসের সাম্যবাদ? জাতপাতহীন ইসলামের সাম্যবাদ এক বাতাসের ঘর, তা আর চোখে দেখিনি কোনোদিন। ইসলাম যদি সাম্যবাদের ধর্মই হবে, তাহলে আশরাফ আর আতরাফ শব্দদুটোর প্রচলন হলো কী করে? তুর্কি, আফগান আর পারসিকরা নিজেদেরকে উঁচুজাত মনে করে, ওরা নিজেদেরকে বলে আশরাফ; আশরাফরা আমাদেরকে মানে ধর্মান্তরিত ভারতীয় মুসলমানদেরকে বলে আতরাফ অর্থাৎ নিচুজাত, নিচুজাত হিসেবেই ওরা আমাদেরকে অবহেলা, অপমান আর তুচ্ছবাচ্ছল্য করে। হিন্দু তাঁতী ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে তন্তুবায় জোলা, জেলে হয় নিকিরি; নাম পরিবর্তন হলেও সামাজিক অবস্থানের কোনো-ই পরিবর্তন হয় না। তবে হ্যাঁ, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে; কিছু দাগী চোর-ডাকাত আর উচ্ছৃঙ্খল-মাতাল-লম্পট প্রলোভিত হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে। শাহ্ জালালের মুরিদদের মুখে ওরা যখন শোনে যে ইসলাম গ্রহণ করলে ব্রা‏হ্মণসহ সকল বর্ণের হিন্দুদের সম্পদ লুণ্ঠন করে ভোগ করা যাবে, তাদের অন্তঃপুরের নারীদের গনিমতের মাল হিসেবে সম্ভোগ করা যাবে, সেবার জন্য তাদের বালক এবং কিশোর পুত্রদেরকে দাস হিসেবে রাখা যাবে; আর এসবে কোনো পাপ হবে না, হবে পূণ্য। আবার ইহজগতে এতোসব ভোগ-বিলাসিতার পরেও পরজগতে বেহেশতে যাওয়া যাবে, সেখানেও মিলবে ভোগ-বিলাসের অঢেল উপকরণ-ফলের বাগান, ঝর্ণা, দুধ আর মদের নহর, পদ্মরাগের মতো বাহাত্তরটা ষোড়শী হুরি, মুক্তার মতো আশি হাজার সুদর্শন বালক গেলমান ইত্যাদি; তখন ওদের রক্তে যেন আগুন জ্বলে উঠে, জিভ লকলক করতে শুরু করে! একদিকে এতো সব ভোগ-বিলাসিতা আবার অন্যদিকে মুসলমানদের হাত থেকে নিজের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করাও যাবে; তখন ওরা ছুটে যায় সুফির কাছে, ইসলাম গ্রহণের পর ওরা আরো উশৃঙ্খল হয়ে উঠে; যারা কোনোদিন ব্রা‏হ্মণ কিংবা উচ্চবর্ণের মানুষের অন্তঃপুরে যাবার সাহস পায়নি, তারাই বিছানায় নিয়ে সম্ভোগ করে ব্রা‏হ্মণ আর উচ্চবর্ণের নারীদের; বাদ যায় না হিন্দু নিন্মবর্ণের নারীরাও।

পরে কিছু ভাল মানুষও ইসলাম গ্রহণ করেছে একান্ত বাধ্য হয়ে; জিজিয়া, খারাজ আর অন্যসব করের বোঝা টানতে আর নিত্যদিন অপমান-অবহেলা সহ্য করতে না পেরে। একদা যে-সব হিন্দু আর বৌদ্ধরা ছিল সম্ভ্রান্ত ধনী, একসময় তাদেরকেই দেখেছি অতীতের চোর-ডাকাত নব্য মুসলমানের দ্বারে দ্বারে করুণা ভিক্ষে করতে; তবু তারা নিজধর্ম ত্যাগ করেনি। কিন্তু সবাই নিজধর্ম ধরে রাখতে পারেনি, অভাব আর অত্যাচারের কাছে হার মেনেছে। হিন্দু আর বৌদ্ধদের কাছ থেকে খারাজ এবং জিজিয়া কর বাবদ ফসলের চার ভাগের তিন ভাগই নিয়ে নিলে কখনো আধপেটা খেয়ে কখনোবা না খেয়ে দিন কেটেছে তাদের। মন্দিরের সাথে সাথে হিন্দুদের পাঠশালা এবং বৌদ্ধদের বিহার ধ্বংস করে তার জায়গায় গড়ে তুলেছে মক্তব আর মাদ্রাসা, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ছেলে-মেয়েরা বিদ্যা-শিক্ষা লাভ করবে কোথায়? দরিদ্র হিন্দু আর বৌদ্ধরা তো বটেই, অপেক্ষাকৃত ধনীরাও খারাজ আর জিজিয়া কর দিতে গিয়ে নানা রকম অপমানের শিকার হয়। সামর্থ্য থাকলেও কোনো হিন্দু বা বৌদ্ধ মূল্যবান পোশাক পরে বা ঘোড়ায় চড়ে কর দিতে আসতে পারতো না, অতি সাধারণ পোশাক পরিধান করে তাদেরকে পায়ে হেঁটে আসতে হতো। কর আদায়কারী বসে থাকতো আর কর প্রদানকারী থাকে দাঁড়িয়ে। এরপর কর আদায়কারী তার ঘাড় ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলতো, “জিজিয়া পরিশোধ কর।”

জিজিয়া পরিশোধ করার পর তার মাথার পিছনে চড় মেরে তাকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিতো। অন্য নব্য মুসলমানরা তখন উল্লাস করতো, হাসতো। খারাজ প্রদানের সময় যদি কোনো আদায়কারীর মনে হয় যে খারাজ দাতার মুখে সে থুথু দেবে, তখন খারাজ দাতাকে মুখ হাঁ করতে হতো আর আদায়কারী তার মুখে থুথু দিতো। অনেক সময়ই দেখা যেতো যে কর আদায়কারী অতীতে চোর-ডাকাত ছিল, নয়তো নিচুজাতের কোনো দরিদ্র কারিগর ছিল, যে হয়তো একদা কর প্রদানকারীর বাড়িতে কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো; কিন্তু পরে তারাই নিপীড়ন করতে আরম্ভ করে পূর্বের মালিককের ওপর। কারো সাথে কোনো বিষয়ে পূর্ব শত্রুতা থাকলে তার ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যেতো। অমুসলমানদের ওপর এইসব অত্যাচার করা নাকি সুন্নত, এইসব অবমাননা এবং অপমানজনক কাজ ওরা করতো অন্য ধর্মকে হেয় আর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য।

অনেক জায়গায় হিন্দু আর বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলে মুসলমানরা। হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পর এই ঋণ যাতে শোধ না করতে হয় সে-জন্য তারা কাজীর কাছে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করতো যে মহাজন নবী এবং ইসলাম ধর্মকে গালিগালাজ করেছে। এই ধর্মীয় অবমাননার কথা শুনে ক্ষিপ্ত মুসলমানরা মহাজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-ঘরবাড়িতে লুঠপাট চালাতো, মারধর করতো, তারপর খৎনা করে কলেমা পড়িয়ে তাকে মুসলমান বানাতো। এইরকম নানাবিধ ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিপীড়ন-নির্যাতনের ফলে অনেকে বাধ্য হয় ইসলাম গ্রহণ করতে।’

শুনতে শুনতে আমার অতীত-বর্তমান একাকার হয়ে যায়, আমি হতবাক হয়ে যাই এই ভেবে যে মধ্যযুগের মুসলমানদের এই সব কৌশল একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশী মুসলমানরা এখনো কী অবলীলায় প্রয়োগ করছে! ২০১২ সালে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার সাজানো অভিযোগ তুলে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া; চট্টগ্রামের পটিয়াসহ আরো কিছু জায়গায় অসংখ্য বৌদ্ধমন্দির এবং বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালায় মৌলবাদী মুসলমানরা; মন্দির আর ঘর-বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছারখার করে দেয়! পাবনা এবং আরো কয়েকটি জেলাতেও হিন্দু কোনো যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ইসলামবিরোধী ছবি এবং লেখা পোস্ট দেয় মুসলমান মৌলবাদীরা, তারপর নিজেরাই হিন্দুদের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুঠপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এ যেন মহাকালের মঞ্চে ইতিহাসের পুনর্মঞ্চায়ন! পার্থক্য কেবল এটুকুই হিন্দু এবং বৌদ্ধরা এখন ইসলাম গ্রহণ না করে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ভারতে কিংবা অন্য কোনো দেশে।

কানাই মণ্ডল অথবা কলিমুদ্দি আবার বলতে শুরু করেন, ‘ইসলামের কী দেখে মুগ্ধ হবে মানুষ? ইসলাম আমাদের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম, ঘৃণার নাম ছিল। মুসলমানদের আক্রমণের আগে থেকেই তাদের ভয়ে রাজ্যের মানুষ তটস্থ হয়ে থাকতো, ঘুমোতে পারতো না রাতে, ঘুমের মধ্যেও দুশ্চিন্তা এই বুঝি মুসলমানরা আক্রমণ করে। কতো গুজব ছড়াতো বাতাসে যে মুসলমানরা আক্রমণ শুরু করেছে, এদিকেই ধেয়ে আসছে। শুনলেই আমরা বনে-জঙ্গলে গিয়ে লুকোতাম, বহুবার এমন হয়েছে। তবে আসল খবরটি পেতাম বাণিজ্য থেকে ফেরা মানুষের কাছে। চেনা-জানা অনেকেই বড় বড় বণিকদের বাণিজ্য নৌকায় দাঁড়বাহক অথবা ভৃত্যের কাজ করতো, তারা ফিরে এলে মানুষ তাদের ছেকে ধরতো সংবাদ শোনার জন্য। তাদের মুখে কেবলই দুঃসংবাদ শুনতাম- অমুক রাজ্যের রাজাকে হত্যা করে মুসলমানরা রাজ্য দখল করে নিয়েছে, তমুক রাজ্য মুসলমানরা দখল করে মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে; এই ধরনের বুক হিম করা সব দুঃসংবাদ। মুসলমানদের এইসব অপকর্মের বৃত্তান্ত শোনার পর একসময় নিজেদের রাজ্যই যখন আক্রমণের শিকার হয় তখন মানুষ কোন বুদ্ধিতে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হবে আর কেনইবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে?’

কথা শুনতে শুনতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়, শুনতে হবে আরো অনেক কথা। কিন্তু আমার ভেতরটা আকুলি-বিকুলি করতে থাকে পূর্বপুরুষের আদি ভিটেটা দেখার জন্য। বলি, ‘যেখানে আমার শিকড়, যেখানে আপনার জন্ম, যেখানে আমাদের আরো অনেক পূর্বপুরুষের নাড়িপোঁতা; আমি সেই বাড়িটি দেখতে চাই।’

‘দেখবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘দেখো না, দেখে সহ্য করতে পারবে না।’

‘তবু আমি দেখবো।’

‘বেশ, চলো।’

আমরা উঠে পড়ি। সুরমার পার ধরে হাঁটতে থাকি আমি আমার পূর্বপুরুষের কাঁধে হাত রেখে। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশের একটা মসজিদ চোখে পড়ে, মসজিদের আঙিনায় একজন শীর্ণকায় বৃদ্ধ পাগল বিড়বিড় করছিল, আমাদেরকে দেখে সে ছুটে আসে। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে আমার পূর্বপুরুষের দিকে তাকাই, তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেন, ‘ভয় পেয়ো না, ওর নাম রইচউদ্দিন, ও কাউকে আঘাত করে না, শুধু প্রশ্ন করে।’

‘লা ইল্লাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, লা ইল্লাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। হয় নাই?’

রইচউদ্দিন আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলে আমার পূর্বপুরুষ ইশারা করেন হ্যাঁ বলার জন্য। রইচউদ্দিনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলি, ‘হ্যাঁ, হয়েছে।’

রইচউদ্দিন শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে হাততালি দিতে দিতে নাচতে থাকে, ‘আমি নাকি পারি না, পারছি, পারছি!’

তার মাথায় জটা পাকানো ধুলো মলিন চুল, মুখে সাদা দাড়ি-গোঁফ; গায়ে কালি-ঝুলি মাখা ময়লা চাদর, পরনেও লুঙ্গির মতো করে পরা ময়লা ধুতি। দাঁতগুলো কালচে, হাত-মুখের ত্বক রুক্ষ, নাকটা ডানদিকে কিছুটা বাঁকানো।

অল্পক্ষণ পরই নাচ থামিয়ে হাসি বন্ধ করে খুব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করে, ‘আল্লাহরে দেখিছো, আল্লাহ?’

দু-দিকে মাথা নাড়ি, ‘না, দেখি নাই।’

‘আল্লাহ’র কাছে বিচার দেব, বিচার।’ আকাশের দিকে আঙুল তোলে, ‘ওই সাত আসমানের ওপর থেকে যেদিন আল্লাহ নেমে আসবে এই ঘরে, সেদিন তার কাছে বিচার দেব।’

‘কীসের বিচার দেবেন আপনি?’

‘কেন জানো না? আল্লাহ’র লোকজন এসে আমার বাবাকে বলি দিলো, তারপর মূর্তি ভাঙতে ভাঙতে বললো যে এই মাটির মূর্তিতে আল্লাহ থাকে না, আল্লাহ থাকে সাত আসমানের ওপরে। তারপর তারা মন্দির ভেঙে এখানে আল্লাহ’র ঘর মসজিদ বানালো। সেই থেকে বসে আছি আল্লাহ’র অপেক্ষায়, কিন্তু আল্লাহ’র ঘরে আল্লাহ আর এলো না। বৃষ্টির সময় আমি আল্লাহ’র ঘরে ঢুকলেই আমাকে মেরে বের করে দেয়। আমি ওদের কতো বলি যে আমাকে থাকতে দাও, আল্লাহ এলেই আমি বাইরে গিয়ে শোব, ওরা শোনে না, আমাকে মেরে বের করে দেয়। এই ঘরে কতো মানুষ আসে নামাজ পড়তে, কিন্তু আল্লাহ’র ঘরে আল্লাহ কেন আসে না, কেন আসে না? আল্লাহ’র কাছে বিচার দেব, বিচার…!’

বলতে বলতে চলে যায় রইচউদ্দিন, আমরাও সামনের দিকে পা বাড়াই। আমার পূর্বপুরুষ বলেন, ‘ওর বাবা এখানকার মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন। ওর সামনেই তাকে জবাই করেছিল শাহ্ জালালের মুরিদরা। এরপর ওর পরিবারের অন্যদেরকেও হত্যা করেছিল। আমার সাথেই ওকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দিয়েছিল শাহ্ জালাল। কিন্তু তারপর থেকেই ও পাগল হয়ে গেল। ওর পরিবারের কেউ বেঁচে ছিল না তখন, কোনো আত্মীয়-স্বজনেরও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই থেকে ও এখানেই আছে, ক্ষুধা পেলে হাটে-ঘাটে কিংবা মানুষের বাড়িতে গিয়ে চেয়ে খায়।’

শুনতে শুনতে বুকটা ভার হয়ে যায়, না জানি কতো মানুষের জীবন এমন বিপন্ন হয়েছে নির্মম ইসলামী আগ্রাসনে। কতো জীবন, কতো সম্পর্ক, কতো সংসার, কতো জনপদ ধুলোয় মিশেছে!

আমার পূর্বপুরুষদের নাড়িপোঁতা ভিটেয় এসে দাঁড়াই আমরা দু-জন। ঘাস, লতা-পাতায় জঙ্গলাকীর্ণ একটি মাটির বাড়ি। আমার পূর্বপুরুষকে পিছনে ফেলে আঙিনার ঘাস, লতা-পাতার ভেতর দিয়ে আমি এগোই; আঙিনার একপাশে গরুর গাড়ির একটি পুরনো পচন ধরা চাকা, তার ওপরে পিঁপড়ের সারি। পাশেই জবা গাছে ফুটে রয়েছে দুটো রক্তজবা। কাছেই প্রায় বসে যাওয়া তুলসি ভিটে, গাছ নেই, তুলসি ভিটের ওপর স্যাঁতাপড়া দুটো কড়ি আর একটা তামার পয়সা, নিচে এক টুকরো ভাঙা শাখা। ঘরের সামনে একটা পোড়ামাটির পুতুল। ঘরের দেয়ালের মাটি জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে, দেয়াল বেয়ে লতা উঠেছে টালির চালে; চালার ওপর রাশি রাশি শুকনো ঝরা পাতা-পচা পাতা, গাছের দু-চারখানা মরা ডাল, একটা শুকনো নারকেল; কয়েক জায়গা থেকে টালি খসে পড়েছে। হঠাৎ ঘরের পাশের পুঁইপাচার কাছে গিয়ে চমকে থমকে দাঁড়াই বেশ লম্বা একটা কঙ্কাল দেখে, কঙ্কালটির মাথার খুলি ভাঙা!

আমার পূর্বপুরুষকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এটা কার কঙ্কাল?’

কঙ্কালে চোখ স্থির রেখে তিনি বলেন, ‘আমার কাকার।’

কয়েক পা এগোতেই বারান্দার নিচে দেখতে পাই আরেকটি কঙ্কাল, এটা আগেরটার চেয়ে কিছুটা ছোট। জিজ্ঞেস করি, ‘এটা?’

‘আমার জ্যাঠার।’

আমার দৃষ্টি পইঠায় পড়ে থাকা একটি হুঁকো আঁকড়ে ধরে।

ঘরের উদ্দেশ্যে পইঠায় পা রাখি, আমার পূর্বপুরুষ আঙিনাতেই দাঁড়িয়ে থাকেন। বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢোকার মুহূর্তে কয়েকটা চড়ুই আর বুনো কৈতর উড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। মাটির ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে ঢোকা মোলায়েম আলো ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে। দক্ষিণদিকের মেঝেতে তাকাতেই আমি আঁৎকে উঠি কঙ্কালের স্তুপ দেখে! কোনটার মাথা কোনটা, কোনটার পা বা হাত কোনটা দেখে তা বোঝার উপায় নেই! একটা কঙ্কালের বুকের পাঁজ ভেদ করে রয়েছে জং ধরা তরবারি। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে নিথর চোখে তাকিয়ে থাকি কঙ্কালগুলোর দিকে। আমার হাত নাড়াতে পারি না, পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে গেছে, বুঝিবা থেমে গেছে বুকের স্পন্দন! কতোক্ষণ কেটে যায় জানি না, নৈঃশব্দ খান খান করে ডেকে ওঠা একটি কাকের কর্কশ স্বর শুনে আমি অবচেতন থেকে চেতনে ফিরি। দু-চোখ ঝাপসা, কপোল বেয়ে চিবুকে ঠেকেছে জল। আমি সারা ঘরে দৃষ্টি বুলাই-মেঝেতে ছাড়ানো ছিটানো ভাঙা কয়েকটি মাটির স্যাঁতাপড়া হাঁড়ি-পাতিল, পচন ধরা কাঠের চিরুনি, কাপড়ের ছেঁড়া টুকরো, একটা ছোট্ট শঙ্খ ইত্যাদি। নিঃশব্দে বেরিয়ে আসি ঘর থেকে। কোথায় আমার পূর্বপুরুষ, কানাই মণ্ডল অথবা কলিমুদ্দি? ডেকে সাড়া পাই না, সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার দেখা মেলে না। বুঝতে পারি তিনি আর আমার সামনে আসবেন না। আমার দৃষ্টি স্থির হয় উঠোনে পড়ে থাকা পুতুলটার ওপর, বউ পুতুল। নিশ্চয় আমার কোনো পূর্বপুরুষের ছোট্ট মেয়ে খেলা করতো পুতুলটা নিয়ে, তুলতুলে হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতো পুতুলটাকে, হয়তো মিথ্যে মিথ্যে বুকের দুধও পান করাতো। আহা, মেয়েটার সম্পর্কে কিছুই জানা হলো না। আমার পূর্বপুরুষ সম্পর্কে আরো কতো কিছু জানবার বাকি!

আমি নিচু হয়ে পুতুলটা স্পর্শ করতেই পুনরায় হলদে পাখি হয়ে যাই! আঙিনায় ঘুরে ঘুরে খুঁটে খুঁটে পূর্বপুরুষের ভিটের কিছু শস্যদানা খাই, নিমগাছের নিচে একটা ভাঙা মৃৎপাত্রে জমে থাকা জল পান করে তৃপ্ত হই। তারপর উড়ে গিয়ে বসি কদমগাছের ডালে, শেষবারের মতো পূর্বপুরুষের ভিটেয় জলভরা দু-চোখের বেদনার্ত দৃষ্টি বুলিয়ে আবার উড়াল দিই আকাশে!



(চলবে…..)

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৮:১৬

উম্মু আবদুল্লাহ বলেছেন: Click This Link

এইটাকেও আবার জোর পূর্বক ইসলাম গ্রহন বলে আবার প্রোপাগান্ডা চালিয়েন না।

২| ২৪ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৯:১১

নেওয়াজ আলি বলেছেন: ভালো হয়েছে । ধর্ম কর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার । ধর্ম নিয়ে কুট উক্তি না করলে হলো।

২৪ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১১:২৪

মিশু মিলন বলেছেন: কটুক্তি আর সত্য উন্মোচন এক নয়, আমি সত্য উন্মোচন করছি মাত্র।

৩| ২৪ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১০:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: লেখার খাতিরে ধর্মের বিষয় গুলো এসেছে না ইচ্ছা করে এনেছেন? কারন আপনাকে নিরপেক্ষ ভাবতে পারছি না।

২৪ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১১:২২

মিশু মিলন বলেছেন: লেখার খাতিরেই ধর্মের বিষয় এসেছে। আমি নিরপেক্ষ নই; সর্বদাই ধর্মের নামে হওয়া সন্ত্রাসবাদ এবং রক্তপাতের বিপক্ষে। সন্ত্রাসী মতবাদের প্রচার, ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের জায়গা-জমি দখল, ভিন্ন সংস্কৃতিকে উৎখাত, জোর-জবরদস্তিমুলক ধর্মান্তর করেও যারা মহামানবের খ্যাতি পেয়েছে আমি তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে চাই।

৪| ২৫ শে জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:১০

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: মিশু ভাই , ঘটনা কি? ঘটনা প্রবাহ কোথা থেকে কোথায় নিচছেন ???

এইসব লিখার উদ্দেশ্য কি ?

আপনি এই সব লিখার মাধ্যমে কি অর্জন করতে চাচছেন - আপনি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী না এটা প্রমান / নতুন ইতিহাসবিধ হিসাবে প্রতিষঠা / কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ায় স্থানান্তর )??

আপনি নতুন করে ইতিহাস লিখতে চলেছেন -তা ভাল । তবে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নিজস্ব ইচ্ছায় বিতর্ক তৈরী করা উচিত না ।তা সে হিন্দু, বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান,মুসলিম যেই ধর্মই হোকনা কেন।
এ দুনিয়ায় অসংখ্য মানুষ আছে যাদের সৃষ্টিকর্তায় / ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই।তাদের অবিশ্বাসের জন্য সৃষ্টিকর্তার / ঈশ্বরের কোন ক্ষতি / লাভ নেই। কারন সৃষ্টিকর্তা / ঈশ্বরও জানেন সব মানুষ তাকে মানবেনা । আর তাই ঈশ্বর স্বর্গ ও নরক সৃষ্টি করে রেখেছেন ,তাদের কাজের প্রতিদান হিসাবে দেয়ার জন্য। ঈশ্বর স্বর্গ ও নরক মানুষের দ্বারাই পরিপূর্ণ করবেন তা হিন্দু, বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান,মুসলিম সকল ধর্মমতেই এটা প্রতিষঠিত।

সৃষ্টিকর্তা / ঈশ্বর - মানা না মানা সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সৃষ্টিকর্তা / ঈশ্বর আপনাকে জ্ঞান,বিবেক দিয়েছেন ।জ্ঞান,বিবেক দিয়েছেন এই জন্য যে আমি ,আপনি সেই জ্ঞান,বিবেক ব্যবহার করে যা ভাল গ্রহন করার জন্য আর যা খারাপ তা ত্যাগ করার জন্য।শেষ বিচারের দিন আপনি,আমি আমরা সবাই আমাদের কাজের জন্য জিজ্ঞাসিত হব।ভাল বা খারাপ যাই আমরা করছি সেই অনুযায়ী ই ফল পাব।

আপনি ধর্ম মানেন না বা পালন করেন না সেটা একানত আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার তবে আপনার মতামত ইতিহাসের ঘাড়ে চাপিয়ে নতুন করে যে ইতিহাস লিখতে আপনি লিখতে চেষ্টা করছেন তা কি ঠিক করতেছেন কিনা তাই বুঝতে পারছি না ।

সৃষ্টিকর্তা / ঈশ্বর আমাকে ,আপনাকে আমাদের সকলকে সঠিক পথ অন্বেষণ করার তওফিক দিন ও হেদায়াত নসিব করুন,এই প্রার্থনা সবসময়।

২৬ শে জুলাই, ২০২০ ভোর ৪:২৭

মিশু মিলন বলেছেন: 'সৃষ্টিকর্তা / ঈশ্বর আমাকে ,আপনাকে আমাদের সকলকে সঠিক পথ অন্বেষণ করার তওফিক দিন ও হেদায়াত নসিব করুন,এই প্রার্থনা সবসময়।'

ভাই, আমি সঠিক পথেই আছি। একটু নির্মোহভাবে ইতিহাস পড়ে দেখুন, সত্যটা আপনিও উন্মোচন করতে পারবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.