নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জন্মান্তর (উপন্যাস: পর্ব-পনেরো)

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৯

আট


চাঁনরাতের আগের রাতে আমরা বান্দরবান যাব, সন্ধ্যায় কল্যাণপুর থেকে বাসের টিকিট কিনে আবির আর আমি রিক্সায় উঠি মিরপুর ২ নম্বরের উদ্দেশ্যে। আবির বাড়িতে গিয়েছিল, আজ-ই এসেছে; কচুক্ষেতে নিত্রাদির বাসায় যাবে। কেবল আমরা দু-জনই নয়; পরাগদা, শাশ্বতীদি আর আফজাল ভাইও বান্দরবান যাবেন। আবিরের গার্লফ্রেন্ড প্রিয়তিও যেতে চেয়েছিল, কিন্তু পারিবারিক প্রয়োজনে ও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। কয়েক বছর যাবৎ আমি ঈদের সময় ঢাকায় থাকি না; বান্দরবান, সিলেট, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাই। ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার পর দুটো ঈদ আমি বাড়িতে ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা সুখের নয়। প্রথমবার ঈদের নামাজ পড়ার জন্য জোরাজুরি করেছিল বাসার সবাই, কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। আমার পাঁচ-ছয় বছর বয়সের পর সেই প্রথম বাবা আমাকে ছাড়া ঈদের নামাজ পড়তে যান গম্ভীরমুখে। দাদী একবার আমাকে শুনিয়ে মাকে বলেন, ‘হের লাইগাই পোলাপান বেশি নিতে অয়, পাঁচ-ছয়ডা থাকলে একটা-দুইডা গোল্লায় গেলেও তার কপাল নিয়া যাইবো! পোলা বেশি থাকলে কী আর একটার দিকে চাইয়া থাহন লাগে!’

সেই দুই ঈদে আমি পাঞ্জাবি-পাজামা পরিনি, নামাজও না। খাবার সময় হলে আমাকে খেতে ডেকেছিলেন মা, বাড়িতে কোনো নতুন অতিথি এলে যেমন গুটিয়ে থাকে, তেমনি সবার সাথে বসে খেয়েছিলাম। দুপুরের পর থেকেই বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসতে শুরু করেছিল, তাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম কিন্তু ইতিমধ্যে তারা আমার নাস্তিকতা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ায় তাদের কথায়-আচরণে আগের আন্তরিকতার ঘাটতি লক্ষ্য করেছিলাম, আবার এমনও হতে পারে বাসার পরিস্থিতি আমার প্রতিকূলে থাকায় আমার অমন মনে হয়েছিল; তবে কেউ কেউ আমাকে জ্ঞানদান পূর্বক আল্লাহ’র পথে ফেরার পরামর্শ দিতে ভুল করেনি। আমার মনে হয়েছিল আমি যেন মলিন পোশাক পরিহিত এক ভিখারি, অযাচিতভাবে ঢুকে পড়েছি সকলের অভিজাত আনন্দযজ্ঞে! মনে হয়েছিল এ বাড়ির মানুষ আর আত্মীয়-স্বজনদেরকে আমি চিনি না, দেখিনি কোনোদিন। সেই প্রথম আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করি যে আমি ভুল বাড়িতে জন্মেছি, আমার তো এ বাড়িতে জন্মানোর কথা নয়! আর তার পর থেকে যখনই বাড়ির সবাই আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তখনই এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় আমার। ঘরের ভেতর একা বসে থাকলে গা ছমছমে ভাব হয়। চারপাশে বিদ্যমান সবকিছুর অস্তিত্ব ভুলে আমি যেন এক নতুন জনপদে পৌঁছে যাই আর খুঁজতে থাকি আমার মা-বাবা, স্বজনদের। মনে হয় সেই নতুন জনপদেই আছেন আমার মা-বাবা আর স্বজনরা, যারা আমারই মতো ধর্ম আর সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী, যারা শান্ত-সৌম্য; কখনো মতের অমিল হলে বা তুচ্ছ কারণে রেগে যান না, চিৎকার করে কথা বলেন না। আমি খুঁজতে থাকি, খুঁজতেই থাকি তাদেরকে।

সেদিন বাড়ির অস্বস্তিকর দমবন্ধ পরিবেশ থেকে রেহাই পেতে বিকেলে বাসা থেকে বেরোই একটা শার্ট গায়ে চড়িয়ে, কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই। যাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যায় তারা সবাই ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে। আমি রাস্তায় রাস্তায় একাই ঘুরি আর ঈদ উদযাপনকারীদের দেখতে থাকি। অধিকাংশ মানুষের কাছে ঈদের আনন্দ মানে বাসা থেকে ভরপেট খেয়ে পার্কে আর রাস্তার ফুটপাতে বসে আড্ডা দেওয়া। যদিও মুহাম্মদ রাস্তায় বসতে নিষেধ করেছেন, আর রাস্তায় বসলেও রাস্তার হক আদায় করতে বলেছেন। হক আদায় মানে- দৃষ্টি সংযত রাখা, উৎপীড়ন করা থেকে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎ কাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকা। অথচ অধিকাংশ তরুণেরা ঈদের দিন রাস্তায় বসে আড্ডা দেয়, হারাম হলেও অনেকে গীটার বাজিয়ে দলবদ্ধভাবে গান গায়, কেউ মেয়ে দেখলে শিস বাজায় বা ইভটিজিং করে। আমার কিছু সহপাঠী ঈদের কয়েকদিন আগেই চাঁদা তুলে মদ আর বিয়ারের কার্টুন কিনে স্টক করে রাখে ঈদ উদযাপন করার জন্য! আর আমাদেরই মহল্লার আমার স্কুল-কলেজের কিছু সহপাঠী আরো অভিজাতভাবে ঈদ উদযাপন করে। ওরা আমাকেও একবার প্রস্তাব করেছিল ওদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে, উদযাপনের ধরন শুনে আমি হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম! সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলাম। ওদের মদের স্টক তো থাকেই, সেই সঙ্গে থাকে কলগার্ল! ঈদের সময় পরিবারের সবাই গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়ায় ওদের কারো না কারো বাসা ফাঁকা থাকেই। সেই ফাঁকা বাসায় ওদের সাত-আটজনের জন্য দু-তিনজন কলগার্ল ভাড়া করে নিয়ে আসে। তারপর সারারাত চলে ঈদ উদযাপন, ওদের ভাষায় সেক্সপার্টি! অভিনব ঈদ উদযাপন বটে!

সেদিন বাসায় ফিরি অনেক রাতে, আত্মীয়-স্বজন চলে যাওয়ার পর। পরপর অস্বস্তিকর দুটো ঈদ বাড়িতে কাটানোর পরই আমি সিদ্ধান্ত নিই ঈদের সময় আর বাড়িতে থাকবো না, কোথাও ঘুরতে যাব। এরপর থেকেই আমি ঘুরতে যাই, নিজেও বিব্রত হই না, অন্যদেরকেও বিব্রত করি না।

আবির আর আমি মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পিছনদিকের গেটের বিপরীতে এসে রিক্সা থেকে নামি, তারপর হেঁটে পাশের সরু গলি দিয়ে ঢুকে বাঁ-দিকের একটা বটগাছের গোড়ার বাঁধানো বেদিতে বসি। জায়গাটা নিরিবিলি; মাঝে মাঝে দু-চারজন মানুষ থাকে, এখন নেই; হঠাৎ হঠাৎ গাছের পাখিরা পায়খানা করে, কখনো কখনো তা গায়েও পড়ে, আমরা বিরক্ত হই না! একদিন পড়েছিল আমার কপালের ডানদিকে; তবু এখানে আসি কারণ জায়গাটা নিরিবিলি, আর গাছ থাকলে পাখি থাকবেই, পাখি থাকলে পায়খানাও করবে, প্রাকৃতিক ব্যাপার।

ভীষণ গরম, জলতৃষ্ণা পেয়েছে। আবিরকে বলি, ‘তোর ব্যাগে জল আছে?’

‘আছে, তবে এ জল আমাদের পেটে সহ্য হবে না।’

‘কেন?’

ও শব্দগুলো টেনে প্রলম্বিত করে বলে, ‘মহাপবিত্র গঙ্গা-পদ্মাজল!’

‘মানে?’

গলায় কপট গাম্ভীর্য এনে বলে, ‘সে এক বিরাট রগড় রে বাপু, তোর মতো নরাধম নাস্তিক তা বুঝবে না!’

‘আরে ব্যাটা রহস্য না করে খুলে বল।’

‘আমার জেঠিমা, কিছুদিন আগে তীর্থে গিয়েছিলেন গয়া, কাশী, বৃন্দাবন; ওখান থেকে আর কিছু আনুন বা না আনুন বড়ো দুই বোতল গঙ্গাজল নিয়ে এসেছেন। পাড়ার লোকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল একটুখানি গঙ্গাজল নেবার জন্য। তীর্থ থেকে আনা গঙ্গাজল, কাউকে না দিলে যদি পাপ হয়! তাই আমার জেঠিমা সকলকেই একটু একটু করে গঙ্গাজল বিতরণ করেছেন। আর তীর্থ থেকেই ফিরেই তিনি পাড়ার সবাইকে, মানে প্রায় দুশো-আড়াইশো মানুষকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন। বৃন্দাবনে তীর্থ করতে গেলে ফিরে এসে নাকি মানুষকে অন্নভোজন করাতে হয়, নইলে পূণ্য হয় না! আমি জেঠিমাকে বললাম, “জেঠিমা, তোমার এই অন্নভোজনের টাকাগুলো আমাকে দাও, আমি লোকজনের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে আরো কিছু টাকা এর সঙ্গে যোগ করে পাড়ায় একটা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করি। তোমার পূণ্য হোক বা না হোক, তুমি যেদিন লোকজনকে খাওয়াবে তার পরদিন সকালেই মানুষ টয়লেট নিশ্চয় পূর্ণ করবে! এতে কারো কোনো উপকার হবে না, কিন্তু একটা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করলে মানুষের উপকার হবে।” জেঠিমা আমাকে কী বললো জানিস?’

‘কী?’

‘বললো, দূর হ লক্ষ্মীছাড়া মুখপোড়া!’

পুরো ঘটনা আর আবিরের বলার ধরনে আমি এমনিতেই মিটিমিটি হাসছিলাম, এবার বেশ জোরেই হেসে উঠি।

আবির আবার শুরু করে, ‘এদিকে আমার দিদির শ্বশুরবাড়ির গোত্রের দূর-সম্পর্কের একজন লোক মারা গেছে, তার সঙ্গে দিদিদের সম্পর্কের ব্যাপারটা মনে কর এইরকম হবে আর কী- জামাইবাবুর দাদুর বাবার কাকাতো ভাইয়ের বংশধর। তাও যে লোকটা মারা গেছে সে থাকতো পশ্চিবঙ্গের হাওড়ায়। দিদি-জামাইবাবু তাকে কোনোদিন দেখা তো দূরের কথা মনে হয় নামও শোনেনি। অথচ দিদিরা এখন অশৌচ পালন করছে, ওদের নিজেদের গা-গতর থেকে শুরু করে ঘর-দোর সবই নাকি অশৌচ! দু-একদিনের মধ্যেই সেই লোকের শ্রাদ্ধ, তাই ওদের ঘরে গঙ্গাজল ছিটিয়ে অশৌচ দূর করতেই আমাকে গঙ্গাজল নিয়ে আসতে বলেছিল। জেঠিমা দিদির জন্য একটা ছোট বোতলে গঙ্গাজল দিলো, আমিও ব্যাগের বাইরের এই পকেটে রাখলাম। লঞ্চ থেকে নামার আগে দেখি জলের বোতল হাওয়া, তলায় খুঁজলাম নেই! নদীর ওপারে বাসের ঝাঁকিতে ব্যাগের পকেট থেকে পড়ে গেছে নাকি লঞ্চ থেকে কেউ নিয়ে খাবার জল মনে করে খেয়ে ফেলেছে তা জানি না। জল না পেলে তো দিদি আমাকে আচ্ছা ঝাড় দেবে। হঠাৎ মাথাটা খুলে গেল, একটা ছোট বোতল কিনে সেই বোতলের জল খেয়ে খালি বোতলে পদ্মার ভরে নিয়ে এসেছি!’

‘তাদের বিশ্বাস তাদের কাছে, তাই বলে তুই মিথ্যা বলবি?’

‘এই তোর ভূগোলের জ্ঞান কি আমার জেঠিমার মতো? তুই জানিস না যে গঙ্গা-ই বাংলাদেশে ঢুকে পদ্মা হয়ে গেছে! ঐ গঙ্গাদ্বারেও যে জল, আমাদের পদ্মায়ও সেই একই জল।’

‘তা তো জানি!’

‘তাহলে আমি তো মিথ্যা বলছি না, এটাও তো গঙ্গারই জল! এটাই দিদিকে দেব।’

আমি হেসে বলি, ‘তুই পারিসও!’

‘শোন, বহু বছর আগে গঙ্গার মূল প্রবাহ বর্তমানের ভাগীরথী-হুগলি নদীর খাত দিয়ে বইতো, কিন্তু কালের আবর্তে ভূমিরূপের পরিবর্তনের ফলে গঙ্গার মূল প্রবাহ গড়ায় পদ্মা দিয়ে। আগের দিনের মানুষের ভূগোলের জ্ঞান ছিল না, তাই দেশভাগের আগে পদ্মাপারের মানুষ গঙ্গা হয়ে আসা পদ্মার জলে রোজ স্নান করার পরও পূণ্যের লোভে দল বেঁধে ঘটা করে নদীয়া-কলকাতার হুগলি নদীতে গঙ্গাস্নান করতে যেতো গরুর গাড়ি-ঘোড়ার গাড়িতে বা পালকিতে চেপে, পায়ে হেঁটেও যেতো অনেকে; পথে অনেকে মরেও যেতো। কিন্তু এখন তো সেই দিন নেই, সব গ্রামেই শিক্ষিত মানুষ আছে, ইন্টারনেট আছে, গুগোল ম্যাপে চোখ বুলালেই জানা যায় যে গঙ্গার আর পদ্মার জল একই। অনেকে জানেও, তবু মানষের অন্ধ বিশ্বাস, গঙ্গার জলের প্রতি অন্ধ ভক্তি। ফলে ঘরের কাছে পদ্মায় গঙ্গাজল রেখে টাকা খরচ করে গঙ্গাস্নান করতে যায় দূরে। অতীতে কতো মানুষ এই গঙ্গাজল খেয়ে ডায়রিয়া-কলেরায় মরেছে তা কে জানে!’

গঙ্গা-পদ্মার জলে আমাদের অরুচি, তাই আপাতত জল কিনে এনে তৃষ্ণা মিটাই আমরা। এরই মধ্যে শাশ্বতীদির ফোন।

‘হ্যালো দিদি…’

‘টিকিট পেয়েছিস?’

‘হ্যাঁ, পেয়েছি।’

‘আবির কোথায়?’

‘আমরা একসাথেই আছি।’

‘তোরা কি এখনো কল্যাণপুরে?’

‘না, ২ নম্বরে।’

‘শোন, বাইরে থাকিস না, বাসায় চলে যা। গুলশানে জঙ্গি হামলা হয়েছে।’

‘বলো কী! কখন?’

‘এই তো টিভিতে লাইভ দেখাচ্ছে। গুলশানের হলি আর্টিজান নামের একটা রেস্টুরেন্টে জঙ্গিরা ঢুকে মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে।’

‘মানুষ মারা গেছে?’

‘ভেতরে কী হচ্ছে কেউ বলতে পারছে না। র‌্যাব-পুলিশ ঘিরে রেখেছে রেস্টুরেন্ট। বাইরে থেকে পুলিশ ঢুকতে গিয়েছিল, জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেড আর গুলির আঘাতে দু-জন পুলিশ মারা গেছে, আহত হয়েছে আরো কয়েকজন। শুনছি এধরনের জিম্মি কিংবা হামলার ঘটনা আরো হতে পারে, তোরা বাসায় চলে যা।’

‘ঠিক আছে দিদি, আমরা একটু পরই চলে যাচ্ছি, তুমি চিন্তা কোরো না।’

‘আর পরশুদিন তোরা দু-জনই বাসায় আসছিস তো?’

হ্যাঁ, আসবো।’

‘আচ্ছা, রাখছি।’

‘আচ্ছা।’

আমি আবিরকে ঘটনাটা বলি। এরই মধ্যে আমার বাসা থেকে মা ফোন করে, আবিরকে ফোন করে নিত্রাদি। আরো জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় দু-জনকেই তাড়াতারি বাসায় ফেরার আদেশ জারি হয়। আমরা আসছি বলে ইসলামী জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে আলাপ চালিয়ে যেতে থাকি। কিছুক্ষণ পর বাসা থেকে আবারো মায়ের ফোন, ‘২ নম্বর থেকে আসতে তোর এতোক্ষণ লাগে?’

‘এই তো আসছি মা।’

‘জলদি বাসায় আয়, তোর বাবা রাগারাগি করছে।’

‘আচ্ছা, দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।’

ফোন রেখে আবিরকে বলি, ‘চল আজ উঠি, নইলে আবার ফোন করে রাগারাগি করবে।’

আবিরকে ২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আমি হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরি, সবাই ড্রয়িংরুমে বসে টেলিভিশন দেখছে, আমি ফেরায় বাসার সবাই যেন স্বস্তি পায়। গুলশানের ঘটনাটি সরাসরি দেখাচ্ছে চ্যানেলে, জঙ্গিরা হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের ভেতরে দেশি-বিদেশি মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। জিম্মিকারীদের হাতে বন্দী মানুষের কথা ভেবে র‌্যাব-পুলিশ বাহিনী কোনো অ্যাকশনে যাচ্ছে না, তারা ভবনটি ঘিরে রেখেছে আর জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।

আমি গোসল করে সবার সঙ্গে ভাত খেয়ে আবার ড্রয়িংরুমে বসি টিভি চালিয়ে। নিরাপত্তাজনিত কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশে এখন আর সরাসরি দেখাচ্ছে না কোনো চ্যানেল। কয়েকজন ইতালিয়ান, জাপানী, একজন ভারতীয় নাগরিকসহ বাংলাদেশি নাগরিকও ভেতরে জিম্মি রয়েছে; কিন্তু ঠিক কতোজন ভেতরে জিম্মি রয়েছে সে ব্যাপারে কোনো ধারণা দিতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ দেখি সিএনএন সরাসরি দেখাচ্ছে। বাবা আর ছোট আপুও এসে বসেন টিভির সামনে, রান্নাঘরের কাজ সামলে একটু পর মাও আসেন। তাদের সবার মুখে ওই একই কথা, কোরানের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এদেরকে বিপথগামী করা হয়েছে। আমি তাদের কথা শুধু শুনি, কিছুই বলি না। কী বলবো? এক কথা আর কতোবার বলা যায়! আমি টিভির পর্দায় তাকিয়ে ভাবতে থাকি ভেতরে জিম্মি থাকা মানুষগুলো আর তাদের পরিবারের মানসিক অবস্থার কথা। ভেতরের মানুষগুলো জীবিত আছে নাকি জঙ্গিরা তাদেরকে মেরে ফেলেছে তা অজানা, কী ভীষণ যন্ত্রণায়-উৎকণ্ঠায় পার করছেন জিম্মিদের পরিবারের মানুষেরা। সবাই নিশ্চয় আশায় বুক বেঁধে আছেন যে মানুষগুলো জীবিত-ই ফিরবে।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বলি, ‘বাবা, অনার্স শেষ হলে আমি আমেরিকা বা ইয়োরোপিয়ান কোনো কান্ট্রিতে চলে যাব। এই দেশে আর থাকবো না।’

মা, বাবা, ছোট আপু, তিনজনই অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকান।

বাবা বলেন, ‘অনার্স আগে শেষ হোক তারপর দেখা যাবে।’

মা বলেন, ‘তুই বিদেশ গেলে আমাগো কী অইবো?’

‘পরে তোমাদেরও নিয়ে যাব। নাকি কাফেরদের দেশে থাকতে তোমাদের অসুবিধা হবে? এই দেশ ক্রমশ আফগানিস্তান হবে এ ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নাই। কোনোভাবেই ওদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে না। আর তালেবান-আইএস মার্কা দেশে আমি থাকতে পারবো না, আগে থেকেই তোমাদের জানিয়ে রাখলাম। অনেক রক্ত ঝরানোর পর হয়তো এই দেশ সভ্য হবে, কিন্তু তা আরো এক-দুই শতাব্দী পর।’

বাবা-মা চুপ করে তাকিয়ে থাকেন আমার মুখের দিকে।

আমি টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টি ফেরাই। সারাবিশ্বের মানুষ দেখছে এই ঘটনা, জানছে যে বাংলাদেশ একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র, সেখানে বিদেশীরা নিরাপদ নয়! ছিঃ, বাংলাদেশের জন্য এটা কী ভীষণ লজ্জার! সব সরকার ধর্মান্ধদের তোষণ করতে করতেই আজ দেশটাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। সরকার জঙ্গিদের অর্থের উৎস বন্ধ করছে না, জঙ্গিদের ব্যবসা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেয়ে গেছে দেশ। জঙ্গিবাদী কার্যক্রম এবং ইসলামের প্রসারে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে ওরা। অর্থনীতি এবং লোকবল, দুটোতেই ওরা ভীষণ শক্তিশালী। আছে শক্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। আর ওদের বড়ো শক্তি ওরা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এবং লক্ষ্যে অবিচল। সেই একাত্তরের পরাজয়ের পর থেকে পুনরায় বিজয়ের লক্ষ্যে খুব সন্তর্পণে এক পা এক পা করে এগিয়েছে ওরা, সামরিক শাসনের সময় থেকে নির্ভয়ে হাঁটতে শুরু করেছে, আর এখন হিংস্র থাবা উঁচিয়ে দাপটের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে। কে বাঁচাবে এই দুর্ভাগা দেশটাকে?

রাত বাড়ে, কিন্তু আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী কোনো আশার কথা শুনাতে পারে না; তারা কেবল চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট। বাবা-মা আর ছোট আপু, একে একে সবাই ঘুমাতে চলে গেছেন। দাদী অনেক আগেই ঘুমিয়েছেন। ড্রয়িংরুমে আমি একা, একসময় টিভি বন্ধ করে আমিও উঠে পড়ি, মশারি টাঙিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ি; কিন্তু ঘুম আর আসে না। শুয়ে শুয়েও মাথার ভেতরে একই চিন্তা, মানুষগুলো জীবিত ফিরবে তো? কী দ্রুত দেশটা আফগানিস্থান, ইরাক, সিরিয়ার পথে হাঁটছে। আগে যখন ওইসব দেশে এই ধরনের ঘটনার খবর দেখতাম টিভিতে, তখন ভাবতাম যে ওইসব দেশে মানুষ থাকে কীভাবে? আর থাকেই বা কেন, অন্য দেশে চলে যেতে পারে না? এখন বুঝি যে তারা কীভাবে থাকে, আর কোথাও যাবার জায়গা নেই তাই থাকতে বাধ্য হয়। একান্ত নিরুপায় হয়ে কেউ কেউ নিজের এবং পরিবারের জীবন বিপন্ন করে ঝুঁকি নিয়ে জলপথে ইয়োরোপে যাবার চেষ্টা করে; কেউ সফল হয়, কেউবা হয় না। ইয়োরোপিয়ানরা মুসলমানদেরকে তাদের দেশে ঢুকতে দিতে চায় না। ইসলামী সন্ত্রাসের বীজ কে-ই বা পুঁততে চায় নিজের শান্তিপূর্ণ দেশে? ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি, প্রসাবের চাপে পৌনে ছয়টার দিকে ঘুম ভাঙে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি বাবা নিউজ চ্যানেল চালিয়ে বসে আছেন। টিভি স্ক্রলে কোনো সুসংবাদ নেই; র‌্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী এখনো চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে রেস্টুরেন্ট, কোনো অপারেশান চালায়নি। আমি নিজের ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়ি।

ঘুম ভাঙে বেশ বেলায়; উঠে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি বাবা, মা আর ছোট আপু টিভি দেখছে। সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা সকাল সাতটা চল্লিশ মিনিটে ‘অপারেশান থান্ডারবোল্ট’ নামের অভিযান চালিয়ে ছয় জঙ্গিকে হত্যা করে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। উদ্ধার করেছে বিশটি লাশ; যাদের নয়জন ইতালিয়ান, সাতজন জাপানী, তিনজন বাংলাদেশী ও একজন ভারতীয়। তাদেরকে কুপিয়ে-জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। তেরোজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, যাদেরকে জঙ্গিরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে, এদের বেশিরভাগই হলি আর্টিজানের কর্মী, আর কয়েকজন নাকি হলি আর্টিজানের কাস্টমার। সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে ডিবি কার্যালয়ে।

ছয়জন তরুণ জঙ্গির লাশ বারবার দেখাচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায়। অপরের তো বটেই নিজের জীবনও এদের কাছে কী তুচ্ছ! কী অবলীলায় ধর্মের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দেয় এরা! এতো সুন্দর পৃথিবীতে দীর্ঘদিন বাঁচার সাধ জাগেনি; সাধ জেগেছে যে জগত সে দ্যাখেনি, আজ অব্দি কেউ দ্যাখেনি, যে জগতের কোনো অস্বিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেই জগতে বাঁচার! চৌদ্দশো বছর আগে একজন মানসিক রোগী-প্রতারক এক মিথ্যে অলৌকিক জগতের স্বপ্ন দেখিয়ে গেছে, আর সেই জগতে যাবার জন্য একবিংশ শতাব্দীর এই বিজ্ঞানের যুগে মানুষ অন্যের জীবন কেড়ে এভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারে, চোখ বুজে ভাবলে কেমন অবিশ্বাস্য লাগে, মনে হয় এসব রূপকথার গল্প! কিন্তু চোখ খুললেই চোখের সামনে উপস্থিত নিষ্ঠুর বাস্তবতা; সমগ্র বিশ্বে অসংখ্য মুসলিম যুবক বেহেশেতের মাদকে মত্ত হয়ে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও প্রতঙ্গের আগুনে ঝাঁপ দেবার মতো ঝাঁপ দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে! ধর্ম মাত্রই এক ধরনের মাদক, আর নিঃসন্দেহে সবচেয়ে তীব্র বিষাক্ত এবং ভয়ংকর মাদক ইসলাম; যা দিনকে দিন অন্যদের জীবনও বিষময় করে তুলছে।

আর কী দেখবো! নিজের রুমে গিয়ে বিছানা গুছিয়ে বাথরুমে যাই। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে চা বানিয়ে নিয়ে এসে কম্পিউটারের সামনে বসি। ফেসবুক খুলে দেখি নিন্দার ঝড় বইছে। অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়েছে জঙ্গিদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতি তীব্র ঘৃণা জানিয়ে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মানুষের স্ট্যাটাসে চোখ বুলাই। মহা ধার্মিক মুসলমানও নিন্দা জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছে। এইসব গোবেচারাদের জন্য আমার করুণা হয়, এরা না জানে ইসলামের ইতিহাস না পড়ে কোরান-হাদিস। নিজের অজান্তেই এরা ইসলাম বিরোধী স্ট্যাটাস দেয়, এই বিপুল সংখ্যক তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষদের প্রতি করুণা ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারি! কী স্ট্যাটাস দেব আমি? যদি সত্য কথাটা লিখি যে মুহাম্মদের আদর্শ ধারণ করে ছয়জন প্রকৃত মুসলমান ইসলামের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে; ব্যাস, তাহলেই আমার মুণ্ডুপাত শুরু হবে। আমার গায়ে ইসলাম বিদ্বেষী তকমা লাগিয়ে দেবে তথাকথিত মডারেট মুসলমানরা, পূর্বেও লাগিয়েছে। এরা বুঝতে চায় না যে ইসলাম আর পাঁচটা ধর্মের মতো নয়, ইসলামের এই রক্ত পিপাসা জন্মলগ্ন থেকে। অন্যান্য ধর্মে এখন রক্তপাত নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ধর্ম প্রবর্তকদের মনে মুহাম্মদের মতো সম্পদ ও নারী লুণ্ঠন, জবরদস্তিমুলক ধর্মান্তর এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের লালসা ছিল না, তাঁরা মুহাম্মদের মতো হত্যার উস্কানি দিয়ে কোনো গ্রন্থ নাজিল করেননি; প্রচলিত ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনাচারের প্রতি বিরক্ত-বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাঁরা প্রচার করেছেন তাদের নতুন দর্শন ও চিন্তা, এক্ষেত্রে তারা যে সনাতন সংস্কৃতি থেকে পুরোপুরি প্রভাবমুক্ত ছিলেন তা নয়। তবে নিজের দর্শন ও চিন্তার প্রসারে তারা মুহাম্মদের মতো সন্ত্রাসের পথ বেছে নেননি। যদিও পরবর্তীকালে কোনো কোনো ধর্ম প্রবর্তকের উত্তরসুরী অবিশ্বাসী বা ভিন্ন মতাদর্শীদের ওপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে; তবে বর্তমানে সেটাও কমে গেছে। কিন্তু ইসলামের অনুসারীরা জন্মলগ্ন থেকে আজ অব্দি একইভাবে বিশ্বব্যাপী রক্তের হোলি খেলছে কোরান-হাদিস আর মুহাম্মদের জীবন অনুসরণ করে।



(চলবে….)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:৪৪

রাজীব নুর বলেছেন: পুরো লেখায় বাস্তব সব ঘটনা।

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:২৯

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.