নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
নয়
আধো ঘুমের মধ্যে গুনগুন সুরের গান কানে ভেসে এলে মনে হয় আমি কোথায়? রাতে কি কম্পিউটার কিংবা মোবাইলে গান চালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি? আর তারপরই ঘুমের কুয়াশা কাটে যখন পিঠের নিচের অনভ্যস্ত বিছানা আর মাথার নিচের বালিশটাকে অনুভব করি। চোখ বুজে থাকলেও অধোচেতন থেকে পুরোপুরি চেতনে ফিরি আমি। গানের সুর ছাড়াও কানে ভেসে আসে পাখপাখালির কিচির-মিচির, মোরগের বাগ, ক্ষণে ক্ষণে হাতি আর সিংহের ডাক! এখান থেকে চিড়িয়াখানা খুব কাছেই, তাই চোখ বুজে কান পাতলে অরণ্যে উপস্থিতির অনুভূতি হয়। ভাল ঘুম হয়নি আমার, আসলে নতুন জায়গায় আমি ভাল ঘুমাতে পারি না, ঘুম গভীর হয় না, আর মাঝে মাঝেই ভেঙে যায় ঘুম। চোখ খুলে মাথার কাছের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, এখন প্রায় সকাল, এখানে-ওখানে ঘাপটি মেরে থাকা অন্ধকার উবে যাচ্ছে ক্রমশ। দৃষ্টি গুটিয়ে আনি বিছানায়, আবির ঘুমোচ্ছে। বাইরে থেকে ভেসে আসছে গুনগুন সুরে গাওয়া আরশাদ ফকিরের গান। আমরা ঘুমিয়েছি মাঝরাতের পর, অথচ এতো সকালে উঠে পড়েছেন তিনি! গভীর রাতে ঘুমোলেও বাউল-ফকিরদের দেহঘড়ি কী ভোরবেলায় জাগিয়ে দেয়? কী জানি!
সেদিন আফজাল ভাই আমাকে যে ভাল খবরটি শোনাতে চেয়েছিলেন তা হলো তার গুরু আরশাদ ফকিরের আসার খবর। আরশাদ ফকির কিশোরগঞ্জ গিয়েছিলেন, শিষ্যের পীড়াপীড়িতে ফেরার সময় তার বাড়িতে চরণধুলি দিতে রাজি হন। খবরটি শোনার পর থেকেই আমি মুখিয়ে ছিলাম তার আসার অপেক্ষায়। সরাসরি বাউল-ফকিরদের গান অনেকবার শুনেছি, কিন্তু কখনোই সংসারত্যাগী কোনো বাউল-ফকিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপ করার সুযোগ হয়নি আমার; সে কারণেই আমার আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। শাশ্বতীদি, পরাগদা আর আবিরকেও বলেছিল আফজাল ভাই। কিন্তু শাশ্বতীদি অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে আর সকালে পরাগদার কলেজে পরীক্ষা থাকায় আসতে পারেননি। এসেছি আমি আর আবির। পরশু সন্ধ্যায় হলি আর্টিজানে জিম্মি ঘটনার পর থেকেই মনটা বেশ বিচলিত ছিল, জঙ্গিদের হাতে জিম্মিদের নৃশংস হত্যার খবর জানার পর থেকে কাল সারাটা দিন মন খারাপের মেঘের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। এমনিতেই আজকাল রাস্তায়-চলতে ফিরতে আতঙ্কে থাকি যে কখন পিছন থেকে চাপাতি নেমে আসে ঘাড়ে! আর এই ধরনের ঘটনা আশঙ্কা আরো বাড়িয়ে দেয়। নিজের কথা ভেবে যেমনি বিচলিত বোধ করি, তেমনি খারাপ লাগে খুন হওয়া মানুষের কথা ভেবে, তাদের পরিবারের কথা ভেবে। সেই মন খারাপ নিয়েই কাল সন্ধেয় এসেছি আফজাল ভাইয়ের বাড়িতে। আফজাল ভাইয়ের গুরু আরশাদ ফকিরের সান্নিধ্য পেয়ে মন খারাপের মেঘ কখন যে ভেসে গেছে তা নিজেও টের পাইনি, যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছিলাম কাল! সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অব্দি দুই ভাগে গান আর তত্ত্ব আলোচনা শুনে দারুণ কেটেছে! প্রথম ভাগ সন্ধ্যা থেকে তারাবি নামাজের আগ পর্যন্ত আফজাল ভাইয়ের বাড়িতে; তখন আফজাল ভাইয়ের গুরু আরশাদ ফকির আর তার সাধনসঙ্গিনীকে কেন্দ্র করে আমি, আবির আর আফজাল ভাইয়ের পরিবার ছাড়াও ছিল আশপাশের কয়েকজন সঙ্গীত পিপাসু মানুষ। আর দ্বিতীয় ভাগ খাওয়া-দাওয়ার পর তুরাগের বুকে নৌকায় ভাসতে ভাসতে; আরশাদ ফকিরকে কেন্দ্র করে আফজাল ভাই, আমি আর আবির।
আমি আর আবির যে আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী তা নয়, আমরা দু-জনই ভিন্ন চিন্তার জগতের বাসিন্দা হলেও এসেছি গান আর কিছু তত্ত্বকথা শুনতে, একজন বাউলকে কাছ থেকে দেখতে, বাউল দর্শন সম্পর্কে কিছু জানতে। আমরা বাউল-ফকির দর্শনের খুব যে ভক্ত তাও নয়, বরং অন্যান্য ধর্মের মতোই বাউল-ফকিরদের কিছু কু-সংস্কার আমরা অপছন্দ করি। বাউল-ফকির দর্শন সম্পর্কে আমি কিছু কিছু পড়াশোনা করেছি, যদিও পুঁথিগত বিদ্যার মাধ্যমে বাউল-ফকির দর্শনের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে জানা একেবারেই অসম্ভব। এটা কেবল দিনের পর দিন বাউল-ফকিরদের সঙ্গলাভ আর প্রত্যক্ষভাবে তাদের জীবনাচার অবলোকন করার মাধ্যমেই সম্ভব। তা বলে ইদানিং কালের অধিকাংশ যুবকদের মতো শুধুমাত্র হুজুগে গা ভাসিয়ে গানের তালে উদ্দাম নাচতে বা দেহ দোলাতেও আসিনি। বই পড়ে আর আফজাল ভাইয়ের মাধ্যমে সমুদ্রের বারিবিন্দুর মতো হলেও বাউল-ফকিরি ভাষা কিছু রপ্ত করেছি। আগে তো গানের কথার মধ্যে ‘অমাবস্যা’ শব্দটি শুনলে চোখের সামনে ভাসতো আমাদের গ্রামের বাড়ির ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রি, বাঁকা নদী বলতে বুঝতাম গড়ান চটবাড়ির কাছে বাঁক নেওয়া তুরাগ। কিন্তু এখন অমাবস্যা মনে বিস্ময় জাগায়, বাঁকা নদী শরীরে জাগায় শিহরণ!
অনেক বাউল গানের অন্তর্গত দর্শন বা চিন্তার সঙ্গে আমি একমত না হলেও কিছু গান ভাল লাগে, হৃদয় স্পর্শ করে। আবার অনেক গান আমি বুঝিও না। কেননা বাউল গানের শরীর দেখে অন্তর বোঝা যায় না। শব্দের আস্তিনে লুকোনো থাকে গুপ্ত অর্থ। আজকাল শহরের তথাকথিত আধুনিক যুবকদের মধ্যে বাউল গানের প্রতি এক কৃত্রিম উন্মাদনা দেখতে পাই; অনেকে যে আগ্রহ নিয়ে ডিজে পার্টিতে যায় সেই একই আগ্রহ নিয়ে যায় বাউল গানের আসরে, অর্থ না বুঝেই বাউল গানের বহিরঙ্গের সঙ্গে অঙ্গ নাচায় দুদ্দাড়। আমার ধারণা এদের বেশিরভাগই কিছু কিছু বাউলগানের গূঢ় অর্থ যদি জানতে পারে তাহলে হয়তো নাক সিঁটকাবে, মাওলানাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গালমন্দও করবে বাউলদের! আজকাল শহরে বাউল গানের কৃত্রিম শ্রোতা যেমনি তৈরি হয়েছে, তেমনি তৈরি হয়েছে কৃত্রিম বাউলও। কৃত্রিম শ্রোতা তৈরিতে কৃত্রিম বাউলরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
পুঁথিগত বিদ্যা আর আফজাল ভাইয়ের মাধ্যমে বাউল দর্শন সম্পর্কে যতোটুকু জেনেছি, তাতে অপছন্দের অনেক কিছুই আছে, আবার পছন্দের বিষয়ও আছে, আছে বিস্ময়েরও।
আবির পাশ ফিরে শোয়। ওকে আমার ঈর্ষা হয়, ওর মতো যদি ঘুমাতে পারতাম! আরশাদ ফকির গান থামিয়ে কথা বলছেন। আফজাল ভাইও এতো সকালে উঠে পড়েছে? নাকি আরশাদ ফকির একা একাই কথা বলছেন! সম্ভবত তিনি ফোনে কথা বলছেন, আর একটু পরই তিনি আফজাল ভাইয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকেন। কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর আবার আরশাদ ফকিরের কণ্ঠ, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবা। তোমার মারে ডাকো। আমাদের এক্ষুনি রওনা হতি হবি।’
তার কথা আমি স্পষ্ট শুনতে পাই, কণ্ঠে অকৃত্রিম বেদনা প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। আফজাল ভাই বলেন, ‘কী অয়ছে বাবা?’
‘রাততিরি কারা যেন আখড়ায় আগুন দিয়েছে, ছেলেপেলেগুলোকে মেরেছে!’
‘হায় কপাল!’ বলেই আফজাল ভাই নীরব, নীরব আরশাদ ফকিরও।
‘তোমার মা’রে ডাকো বাবা, এক্ষুনি রওনা হই।’
আফজাল ভাই ভাবীকে ডাকেন। আমি চিৎ হয়ে শুয়ে থম মেরে তাকিয়ে থাকি টিনের চালের দিকে, কিন্তু অন্তরচক্ষুতে দেখতে পাই দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আখড়া, আরশাদ ফকিরের শিষ্যদের মার খাওয়া, তাদের আহাজারি-আর্তনাদ। অদ্ভুত সুন্দর একটি রাত পার করার পরই যে সকালটা এমন বিষন্নতায় ভরে উঠবে তা কে ভেবেছিল! সুস্বাদু মিষ্টি খাবার পরই মুখে ভীষণ তেতো স্বাদ পেলে যে অনুভূতি হয়, হৃদয় আপ্লুত করা রাতের পর আমার হৃদয়েও তেমনি বিপরীত অনুভূতি হচ্ছে এখন।
আর শুয়ে থাকা চলে না। আমি উঠে পড়ি, একবার ভাবি আবিরকে ডাকবো কিনা, তারপর মনে হয় থাক বেচারা আরেকটু ঘুমাক, উঠলেই তো খবরটা শুনে মনের শান্তি নষ্ট হবে। আমি দরজা খুলে বারান্দায় যাই, আরশাদ ফকির বসে আছেন খুঁটিতে হেলান দিয়ে, তার পাশেই আফজাল ভাই বসে। ঘুম থেকে উঠেই দুঃসংবাদ শুনে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আরশাদ ফকিরের সাধনসঙ্গিনী আর ভাবী।
আফজাল ভাই ভাবীকে তাড়া দেন, ‘জলদি দুডে ফ্যানাভাত চড়ায় দাও।’
আরশাদ ফকির বলেন, ‘এখন আর মুখে কিছু যাবিনানে বাবা, খাতি গিলি দেরি হয়ে যাবিনি।’
‘হাত মুখ ধুতি ধুতি হয়ে যাবিনি বাবা। তুমি যাও।’ ভাবীকে আবার তাড়া দেয় আফজাল ভাই। ভাবী রান্নাঘরের দিকে ছোটে।
আফজাল ভাই আমার উদ্দেশে বলে, ‘সর্বনাশ অয়ে গেছে ভাইডি। বাবার আখড়া আগুন দিয়ে পুড়ায়ে দিছে। গুরু ভাইদের মারধর করিছে।’
আমি আরশাদ ফকিরের কাছে গিয়ে বসি। তিনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকান, দু-চোখ তার সংযত জলের কুয়ো!
আরশাদ ফকির, তার সাধনসঙ্গিনী আর আফজাল ভাইকে গাবতলী থেকে মেহেরপুরের বাসে তুলে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে আমরাও ফেরার বাসে উঠে বসি। আমার চোখে ভাসে আরশাদ ফকিরের জল ছলছল দুটি চোখ, কানে বাজে তাদেরকে সিটে বসিয়ে বাস থেকে নামার সময় আমাদের উদ্দেশে বলা আরশাদ ফকিরের কথা, ‘ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে তাতে কী হয়ছে, গাছতলা তো আছে, গাছতলা আর তিনতলা সবই আমাদের কাছে সমান, সবই আমাদের আনন্দধাম; তবে কী জানো বাবা, প্রাণে বড় আঘাত লাগে মানুষের এই সহিংসতা দেখে; একবার যেও তোমরা দু-জন, ওই গাছতলাতেই!’
বাউল-ফকিরদের ওপর এই হামলা, তাদেরকে উৎখাত করা কিংবা চুল-দাড়ি কেটে বা নিগ্রহের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু সমাজে ফিরিয়ে নেবার অপচেষ্টা নতুন নয়; বহুকাল ধরেই এই অপচেষ্টা চলছে। কেবল বাউল-ফকির নয়, ভারতবর্ষে হিন্দু এবং মুসলমান ধর্মের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যখনই যে নতুন ধর্ম বা উপধর্মের জন্ম হয়েছে কিংবা যে বা যারা ধর্মগুলির হাল ধরতে চেয়েছে তাদের সবাইকেই কম-বেশি শারীরিক কিংবা মানসিক নিপীড়ন সইতে হয়েছে। চতুর্দশ শতকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার-প্রসারকালে শ্রী চৈতন্যকে কেবল মুসলমানদেরই নয়, ব্রাহ্মণ এবং হিন্দু সমাজপতিদেরও প্রবল বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। ব্যঙ্গ করে তাকে বলেছে, ‘ন্যাকা চৈতন্য’; তার মাথার টিকির নাম দিয়েছে ‘চৈতনটিকি’; নানাভাবে উত্যক্ত এবং ঠাট্টা-মশকরা করেছে। এতেও ক্ষান্ত হয়নি বিরোধীরা, চৈতন্যের পক্ষে এমন জনজোয়ার তৈরি হয় যে নিরামিষাশী চৈতন্যের দুর্নাম রটাতে ব্যঙ্গাত্মক গান লিখেও প্রচার করেছে-
‘কেহো বোলে, “এগুলা সকল নাকি খায়।
চিনিলে পাইবে লাজ- দ্বার না ঘুচায়।”
কেহ বোলে- “সত্য সত্য এই সে উত্তর।
নহিলে কেমতে ডাকে এ অষ্টপ্রহর।”
কেহ বোলে- “আরে ভাই মদিরা আনিয়া।
সভে রাত্রি করি খায় লোক লুকাইয়া।”
বন্য প্রাণির মধ্যে শিয়াল যেমনি ধূর্ত, মানুষের মধ্যে তেমনি ব্রাহ্মণ! শত বাধা সৃষ্টি করেও যখন তারা চৈতন্যের অগ্রযাত্রা রোধ করতে ব্যর্থ হয়, যখন দ্যাখে যে বৈশ্য-শূদ্ররা মেনে নিয়েছে চৈতন্যকে; তখন তাদের একটা অংশ একটু একটু করে এগোতে থাকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের দিকে। এ বিষয়ে কোনো এক অজানা লোকগীতিকারের লেখা থেকে জানা যায়-
‘মহাপ্রভুর বিজয়ের কালে
যতো দেশের বিটলে বামুন
তারে পাগল আখ্যা দিলে।
মানুষ অবতার গোঁসাই
সাত্ত্বিক শরীরে উদয়
দেখে তাই পামর সবাই
ভির্মি রোগী বলে।
যখন দেখে মিথ্যা কিছু নয়
বৈষ্ণব এক গোত্রসৃষ্টি পায়
দেশের বামুন মিলে সবাই
শাস্তর লিখে নিলে।’
তারপরও চৈতন্যবিরোধীতা ছিলই। ফলে অভিমানে হোক, আর যে কারণেই হোক, জীবনের শেষ আঠারো বছর চৈতন্য গৌড়বঙ্গে পা রাখেননি। চৈতন্যের মৃত্যুর (ভক্তরা বলে ঈশ্বরের দেহে লীন) পরই বৈষ্ণব হওয়া ব্রাহ্মণরা ঝামেলা পাকাতে শুরু করে। নিত্যানন্দ চৈতন্যের আদর্শ অনুসারে জাতপাতহীন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের কথা বললেও এই সময় থেকেই ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবরা জোটবদ্ধ হতে থাকে ‘ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব’ নামে, আর নিত্যানন্দের মৃত্যুর পর হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ পুরোপুরি ফিরে আসে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মেও। ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবরা নতুন বিধান দেয় যে কেবলমাত্র তারাই সকল বর্ণের বৈষ্ণবদের দীক্ষা দিতে পারবে; বৈশ্য-শূদ্র বৈষ্ণবরা ব্রাহ্মণদেরকে দীক্ষা দিতে পারবে না, তারা সমবর্ণ বা নিচুবর্ণের বৈষ্ণবদের দীক্ষা দিতে পারবে। বর্ণবাদের যাঁতাকলে ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়ে নিচু বর্ণ থেকে আসা বৈষ্ণবরা, ফলে বাধ্য হয়েই তারা বেছে নেয় সহজিয়ার পথ। অর্থাৎ জাতপাতহীন একটি উদার ধর্মকে ধর্ষণ করে ব্রাহ্মণরা।
শীতকালে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলেই দেখি কোথাও না কোথাও চব্বিশ, বত্রিশ, আটচল্লিশ বা ছাপ্পান্ন প্রহরব্যাপী হরিনাম সংকীর্তন হয়, আর সেখানে ব্রাহ্মণ বা অন্য উচ্চ বর্ণের মানুষদের উপস্থিতিই শুধু থাকে না, আয়োজক কমিটির হর্তা-কর্তাও তারাই থাকে। বাওন-বাওনীরা সব ঊর্ধ্ববাহু হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে চোখের জলে কপোল ভাসায়! দেখে আমার ভীষণ হাসি পায়, একদিন এদের পূর্বপুরুষরাই ব্যঙ্গাত্মক গান লিখে সকালবেলার টহল কীর্তন ‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ’র সুর নকল করে গাইতো-
‘নবদ্বীপের বাঁধাঘাটে
নিত্যানন্দ পাঁঠা কাটে
নিমাই চাপিয়া ধরে ঠ্যাং!’
আঠারো শতকের শেষদিকে হিন্দু-মুসলমান ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ অনেক উপধর্ম জেগে ওঠে; যেমন-কর্তাভজা, দরবেশ, সাঁই, গোপ বৈষ্ণব, চামার বৈষ্ণব, টহলিয়া বৈষ্ণব, গুরুদাসী বৈষ্ণব, বৈরাগী, ফকিরদাসী, সাহেবধনী, কবীরপন্থী, কুড়াপন্থী, বলরামী, চরণদাসী প্রভৃতি; এধরনের আরো অনেক উপধর্ম। ধর্মগুলির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে হিন্দু-মুসলমানের মাথা ব্যথার কারণ। ফলে এদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন বাড়তে থাকে, এটা বহুলাংশে বেড়ে যায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। কোনো কোনো ধর্ম এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে ব্রাহ্মণ-মাওলানাদের রুটি-রুজি হুমকির মুখে পড়ে যায়। যেমন কর্তাভজা; জাতিভেদহীন সমন্বয়বাদী এই ধর্মটির প্রতি এমন জনজোয়ার সৃষ্টি হয় যে অপেক্ষাকৃত উদার ব্রাহ্মধর্মের অনুসারীরাও এই ধর্মটির বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটাতে শুরু করে। এসময়ে অন্যান্য উপধর্মের মতো বাউল-ফকির দর্শনের প্রতিও শুরু হয় জনজোয়ার। অসংখ্য নিন্মবর্ণের হিন্দু এবং মুসলমান বাউল-ফকিরদের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে। ফলে এইসব দর্শন বা উপধর্মগুলি সম্পর্কে নোংরা ভাষায় কুরুচিপূর্ণ কুৎসা রটিয়ে সাধারণ হিন্দু-মুসলমানকে তাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে ব্রাহ্মণ-মাওলানারা। শ্রী রামকৃষ্ণের মতো বদ্ধ উন্মাদ ধার্মিক ‘যতো মত ততো পথ’র মতো উদার বাণীর মাধ্যমে অনেকের সম্ভ্রম আদায় করলেও উপধর্ম সাধনাকে তিনি আখ্যা দেন বাড়িতে ঢোকার পায়খানার পথ হিসেবে।
কোনো সন্দেহ নেই যে এই উপধর্মগুলিও পুরোনো বোতলে নতুন মদ পরিবেশনেরই নামান্তর; মূল হিন্দু-ইসলাম ধর্মের মতোই অন্ধ বিশ্বাস, কু-সংস্কার আর কাল্পনিক মিথে ঠাসা! তা হলেও ধর্ম পালনের অধিকার সকলেরই আছে, কে কী ধর্ম পালন করবে না করবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার; কাউকে ধর্ম পালনে বাধা দেওয়া মানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা।
হিন্দুরা মুখে মারলেও মুসলমানরা তাদের পরম্পরাগত-সহজাত পথেই বেছে নেয়- সহিংসতার পথ, আলেমদের নির্দেশে তারা বাউল-ফকির নিধনে নামে। আখড়া পুড়িয়ে দেওয়া, একতারা-দোতারা ভেঙে মারধর করা, দাড়ি-গোঁফ কেটে মাথা মুণ্ডন করা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রাণভয়ে অনেক বাউল-ফকির নিজে থেকেই চুল-দাড়ি কেটে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়। আগুনে ঘি ঢালেন মীর মোশাররফ হোসেন; যাকে ‘প্রথম সার্থক মুসলমান সাহিত্যিক’ বলতে বলতে এযাবৎ মুসলমানদের মুখে টনটন গ্যাঁজলা উঠেছে, লিখতে লিখতে মণ মণ কালি আর না জানি কতো সহস্র দিস্তা কাগজ ফুরিয়েছে! তিনি লেখেন-
‘ঠ্যাঁটা গুরু ঝুটা পীর
বালা হাতে নেড়ার ফকির
এরা আসল শয়তান কাফের বেঈমান।’
তিনি কতোটা সার্থক মুসলমান, কতোটা সার্থক মুসলমান সাহিত্যিক ছিলেন, সেই বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও এই লেখাটির মাধ্যমে তিনি যে অন্ধ আলেম আর তার সাহিত্যিক সত্তার ভেদ ঘুচিয়ে দিয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই! জানি না তার এই উস্কানিতে কতো বাউল-ফকিরের আখড়ায় আগুন জ্বলেছে, কতো বাউল-ফকিরের মাথায় একতারা-দোতারা আর লাঠির বারি পড়েছে, কতো বাউল-ফকিরের চুল-দাড়ি কেটে তাদের হৃদয় রক্তাক্ত করা হয়েছে!
মুসলমানদের এই বাউল-ফকির বিরোধী অভিযান চলতে চলতে ঊনবিংশ শতাব্দী অতিক্রম করে পৌঁছোয় বিশ শতাব্দীতে। বাউল-ফকির নির্মূলে রংপুরের মৌলানা রেয়াজুউদ্দিন আহমেদ লেখেন ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ নামক বই; যা কট্টরপন্থী মুসলমান সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং বাউল নিধনে মানুষকে বিপুল উৎসাহ যোগায়। পাকিস্থান আমলে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছে পূর্ব-পাকিস্থানের বাউলদের ওপর। তারপর দেশ স্বাধীন হয়, গণতন্ত্র নামক এক গালভরা অভিজাত নাম যুক্ত হয় আমাদের সংবিধানে, ওই গণতন্ত্র্রের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে বাউল নিপীড়ন এসে পৌঁছায় এই একবিংশ শতাব্দীতেও। বাংলাদেশে তো বটেই পশ্চিমবঙ্গেও অতীতের মতো ব্রাহ্মণদের এখন আর তেমন প্রভাব নেই, শাস্ত্রীয় বিধান দ্বারা তারা মানুষকে অতীতের মতো বেঁধে রাখতে পারছে না। উল্টোদিকে আলেম এবং ধর্মান্ধ মুসলমানের সংখ্যা এবং প্রভাব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে ভিন্নমতের ওপর নিরন্তর আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আজও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এবং পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদীয়ার মুসলিম অধ্যুসিত এলাকাগুলোতে মুসলমানদের হাতে প্রতিনিয়ত নিগ্রহের শিকার হচ্ছে বাউল-ফকিররা।
দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমানোর আগে আফজাল ভাইকে ফোন দিই, তারা এখনো পৌঁছায়নি আরশাদ ফকিরের গ্রামে। ফোন রেখে শুয়ে পড়ি; রাতে ভাল ঘুম হয়নি, ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে কিন্তু মাথার ভেতরে আখড়া পোড়ানোর অদেখা ছবি। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না, ঘুম ভাঙে সন্ধ্যার কিছু আগে। ঘুম ভাঙতেই আবারো মাথায় চাগাড় দিয়ে ওঠে আখড়া পোড়ানোর ছবিটাই। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আফজাল ভাই আমাকে ফোন করেছে দু-বার; সাইলেন্স থাকায় বুঝতে পারিনি। আফজাল ভাইকে ফোন করে জানতে পারি, আখড়ার একটা ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, আরেকটার অর্ধেক পুড়েছে। তিনজন বাউলকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে, একজনের অবস্থা খুব খারাপ।
বিষাদে ভরে যায় মনটা, যার অবস্থা বেশি খারাপ সে বাঁচবে তো? বাঁচলেই ভাল। এতোদিন লেখক-বাউল-সংখ্যালঘু সসম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক হামলা হলেও সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি, সরকার হেফাজতে ইসলামের মন রক্ষায় ব্যস্ত ছিল। এখন আর এটা কোনো লুকোনো ব্যাপার নয় যে হেফাজতে ইসলামের প্রধান আহমদ শফি হুজুরের কওমি মাদ্রাসা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত, বানের জলের মতো দেশের আনাচে-কানাচে বেড়েছে এই মাদ্রাসা, চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গিবাদ; আহমদ শফি হুজুর নিজেও জঙ্গিবাদী বক্তব্য দিয়েছে বহুবার, তারপরও সরকার গ্রেফতার করার পরিবর্তে তাকে তুষ্ট করতে এবং তাদের আন্দোলন দমিয়ে রাখতে দান করেছে সত্তর কোটি টাকার সরকারী জমি, দিয়েছে নানান সুযোগ-সুবিধা।
হলি আর্টিজানে জিম্মি এবং হত্যার পর সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে, আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে আর দেশি-বিদেশী সংবাদ মাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে দেখাতে জঙ্গি ধরপাকড় শুরু করেছে। এ থেকেই জঙ্গিদের ব্যাপারে সরকারের আপোষকামী মনোভাব স্পষ্ট বোঝ যায়। এসব জঙ্গিদের আগে কেন ধরেনি সরকার? এই প্রশ্ন এখন জনমনে।
ফোন করে শাশ্বতীদি আর পরাগদাকে আরশাদ ফকিরের আখড়া আক্রান্ত হওয়ার দুঃসংবাদটি জানাই। ওরাও আমারই মতো ব্যথিত। আমার ঘরের দরজায় কেউ নক করছে। উঠে দরজা খুলে দেখি মা টেবিলে ইফতার সাজাচ্ছে, আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ইফতার দেব তোরে?’
‘আমি মুখ ধুয়ে পরে খাব।’
বাবা ডাইনিং টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসার সময় একবার তাকান আমার দিকে, আমি দরজা খোলা রেখেই বিছানায় এসে বসি। একটু পরই মসজিদের মাইকে বেজে ওঠে মুয়াজ্জিনের কর্কশ স্বর, আর আমার চৈতন্যে বেজে ওঠে আফজাল ভাইয়ের কণ্ঠে শোনা একটি গানের সুর-
মনপাখি চায় মনের আকাশে উড়িতে
মৌলবী চায় তারে শরিয়তের খাঁচায় পুরিতে
শরিয়তের জটিল-কুটিল ফাঁদে
মনপাখি বিষম জ্বালায় কাঁদে
দিবানিশি মনপাখি মনের মানুষ খোঁজে
অন্ধ মাওলানা সে কথা নাহি বোঝে।
(চলবে……)
১০ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:৪৪
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
২| ১০ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:০৬
শোভন শামস বলেছেন: চলমান জীবনের কথকতা তুলে ধরছেন লেখায় , ধন্যবাদ।
১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ২:৫৯
মিশু মিলন বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ১০ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৩১
রাজীব নুর বলেছেন: অনেক ইতিহাস তুলে ধরছেন লেখায়।
ভালো লাগছে।