নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
তিন
রাজ্যে অনাবৃষ্টি, অনাবাদ আর দুর্ভিক্ষের এই কালবেলায় আজকাল রাজা লোমপাদের দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত অতিবাহিত হচ্ছে। তিনি স্নানাহার করছেন, স্ত্রী-সঙ্গম করছেন, রাজসভায় যাচ্ছেন; কিন্তু কিছুতেই সুখ খুঁজে পাচ্ছেন না! রাজ্যের দরিদ্র মানুষের দিকে তাকানো যায় না, তাদের পেটে ক্ষুধার যন্ত্রণা, অনাহারে বুকের পাঁজর বেরিয়ে গেছে। যে চম্পানগরী আগে পাখির কলতানে মুখর থাকতো, সে নগরী এখন ক্ষুধার্ত-রোগাক্রান্ত শিশুর কান্নায় ভারী হয়ে থাকে; রাজার শিবিকা কিংবা রথ দেখলে নগরীর আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই কোটরাগত নয়নে চেয়ে থাকে, রাজা তাদের চোখে দেখতে পান তাঁর প্রতি বিজবিজে ঘৃণা; কোনো কোনো পাগল কঙ্কালসার নগ্ন শরীরে রাজার রথ কিংবা শিবিকা দেখলে ছুটে এসে নীরবে হাত একবার মুখের কাছে নেয়, আরেকবার পেটের কাছে; এইসব দৃশ্য রাজার হৃদয়ে ভীষণ পীড়া দেয়, ফলে আজকাল আর রাজপ্রসাদের বাইরে কোথাও বিহারে বের হন না তিনি। কিন্তু গুপ্তচরদের কাছে ঠিকই শুনতে পান সারা রাজ্যের প্রজারা তাঁকে ঘৃণা করে, অভিসম্পাত করে, এমনকি তারা তাঁর মৃত্যু কামনা করে উপহাসও করে! রাজকবিগণ মুখ বন্ধ রাখলেও রাজ্যের লোককবিগণ রাজার বিরুদ্ধে কবিতা ও গীত লিখে মুখে মুখে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দিকে দিকে।
এইসব দুঃসংবাদ যতো শোনেন ভেতরে ভেতরে ততো মুষড়ে পড়েন লোমপাদ, মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয় যে সবকিছু ছেড়ে অরণ্যে গিয়ে কোনো ঋষির আশ্রমে আশ্রয় নিয়ে চীর-বল্কল পরিধান করে বাকি জীবন তপশ্চর্যায় কাটিয়ে দেবেন কি না। কিন্তু তিনি অনুভব করেন যে সংসারের প্রতি এখনো তাঁর অনেক মায়া বিদ্যমান- স্ত্রীর প্রতি মায়া, পালিত কন্যা হলেও যাকে তিনি নিজের কন্যাসম স্নেহে লালন-পালন করেছেন সেই শান্তার প্রতি মায়া, রাজ্য এবং রাজ্যের মানুষের প্রতি মায়া। তাছাড়া রাজ্যের এই দুঃসময়ে তিনি অরণ্যে চলে গেলে রাজ্য আরো বেশি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে আর তাঁকে কাপুরুষ ভেবে অঙ্গরাজ্যের মানুষ চিরকাল ঘৃণাভরে তাঁর নাম উচ্চারণ করবে।
প্রজাদের মতো রাজা লোমপাদের নিজেরও এখন একই ধারণা যে তাঁর কোনো পাপের ফলেই রাজ্যে এই অনাবৃষ্টি, তীব্র খরা, দূর্ভিক্ষ, হাহাকার, প্রাণক্ষয়! কিন্তু তাঁর কোন পাপের ফলে রাজ্যের এই বেহাল দশা তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি স্মরণ করতে পারছেন না কোনো পাপের কথা, আবার রাজজ্যোতিষীও তাঁর হাত দেখে ভাগ্য গণনা করে কিছু নির্ণয় করতে পারছেন না। নির্ণয় করতে পারলে না হয় তিনি মহা আয়োজনে প্রায়শ্চিত্ত করে সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করতেন। তবে কি তাঁর পূর্বজন্মের কোনো পাপের ফলে এই অনাবৃষ্টি? আজকাল এই প্রশ্নও জাগতে শুরু করেছে তাঁর মনে।
রাজা লোমপাদের অমাত্যগণের মনেও শান্তি নেই, রাজ্যের এহেন দুর্দশায় হন্যে হয়ে মুক্তির উপায় খুঁজছেন তারাও। রাজ্যের এই বিপর্যয় কিভাবে সামলানো যায় তার জন্য লোমপাদ দফায় দফায় বৈঠক করেন অমাত্যদের সঙ্গে। তিনি এবং তাঁর অমাত্যগণ সকলেই অসহায়ভাবে রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষীর মুখের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকেন যদি তারা কোনো সমাধান বের করতে পারেন! তাদের দুজনের পরামর্শ এবং বিধান অনুযায়ী ঘটা করে নানা রকম যজ্ঞানুষ্ঠান করা হয়েছে। একের পর এক যজ্ঞ করে পশু বলি দেওয়া হয়েছে বরুণদেবের উদ্দেশে, যাতে বরুণদেব সন্তুষ্ট হয়ে অঙ্গরাজ্যে বারি বর্ষণ করেন। কতো কতো যজ্ঞের মণ মণ ঘি পুড়লো, রাশি রাশি ধোঁয়া মিলিয়ে গেল অঙ্গরাজ্যের আকাশে-বাতাসে; কতো কতো পশুর লোহিত ধারায় ভেসে গেল মন্দিরের চত্ত্বর; তবু বরুণদেব বৃষ্টি দিলেন না।
এতো যে জলের সংকট তবু প্রতিদিন গঙ্গা-চম্পানদী থেকে ভৃত্যদের বয়ে আনা শত শত কলসি জল ঢালা হচ্ছে দেবতাদের বিগ্রহের মাথায়; কেবল জল নয়, দুধও ঢালা হচ্ছে মণ মণ; তবু দেবতারা তুষ্ট হচ্ছেন না, কিছুতেই অঙ্গরাজ্যের আকাশে মেঘের দেখা মিলছে না। রাজপুরোহিত রাত জেগে শাস্ত্র ঘেঁটে বের করছেন নতুন নতুন যজ্ঞ আর তার নিয়ম-কানুন। ঘটা করে করা হচ্ছে যজ্ঞানুষ্ঠান, দেওয়া হচ্ছে পশুবলি; কিন্তু পূর্বের ন্যায় নতুন যজ্ঞ আর বলিও বিফলে যাচ্ছে!
যজ্ঞের পর যজ্ঞ করেও যখন ফল মেলেনি তখন রাজজ্যোতিষীও জানিয়েছেন, ‘মহারাজ, নিশ্চয় আপনি এমন কোনো পাপ করেছেন যার শাস্তি আপনাকে ইহ জনমে কিছুকাল ভোগ করতেই হবে, তাই আপনি শাস্তি ভোগ করছেন। তবে আমি গণনা করে দেখেছি আপনার শনির দশা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। শীঘ্রই হয়তো আপনার শনির দশা কেটে যাবে।’
রাজজ্যোতিষীর কথায় লোমপাদ আশান্বিত হয়ে অপেক্ষায় আছেন শনির দশা কেটে যাবার, কিন্তু অপেক্ষার প্রহর বড়ো দীর্ঘ, বড়ো যন্ত্রণাদায়ক।
নিত্যদিনের মতোই রাজা লোমপাদ, অমাত্যগণ, রাজপুরোহিত, রাজজ্যোতিষী, রাজকর্মকর্তা এবং কর্মচারীগণ রাজসভায় উপস্থিত হয়েছেন। রাজা লোমপাদ নিত্যদিনের মতোই চিন্তিত, বিষন্ন এবং গম্ভীরভাবে রাজকার্য শুরু করলেন। রাজকার্য শুরু হবার বেশ কিছুক্ষণ পর একজন দ্বাররক্ষী এসে অবনত মস্তকে জানালো, ‘মহারাজ, রাজদ্বারে একজন ঋষি এসেছেন, তিনি নাকি খুব জরুরি এক বার্তা নিয়ে এসেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’
এই দুর্দিনে রাজা লোমপাদকে অনেকেই অনেক রকম কথা বলেন, বিধান দেন, তিনি সে-সব পালনও করেন, কিন্তু ফল হয় শূন্য। কে জানে ঋষিও তেমনই নিষ্ফল বাক্য শোনাবে কি না! তবু তিনি বললেন, ‘যাও, নিয়ে এসো।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বাররক্ষী একজন ঋষিকে নিয়ে উপস্থিত হলে রাজসভার সকলেই দৃষ্টি রাখলেন তাঁর দিকে- মাথায় লম্বা জটা, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ, নগ্ন গাত্র, পরনে কৌপীন, গলায় এবং বাহুতে রুদ্রাক্ষের মাল্য, কপালে-বুকে-বাহুতে চন্দন লেপন করা, ধুলোমলিন নগ্ন পা। ঋষি রাজা লোমপাদকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, ‘মহারাজ, আমার নাম বলদেব, তীর্থ ভ্রমণ আর তপশ্চর্যা করাই আমার ধর্ম, আমি এই ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত অঙ্গরাজ্যের জন্য ঊষাকালের সূর্যদেবের ন্যায় একটি সুসংবাদ নিয়ে এসেছি।’
সুসংবাদের কথা শুনে লোমপাদ নড়েচড়ে বসলেন, রাজসভার সকলেই দারুণ কৌতুহলে তাকিয়ে রইলেন আগন্তুক ঋষির দিকে। লোমপাদ উঠে দাঁড়িয়ে করজোরে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘মুনিবর, আপনি দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে অপরাধী করবেন না, আসনে উপবেশন করুন। আমি আপনার সকল কথা শ্রবণ করবো।’
একজন রাজকর্মকর্তা উঠে গিয়ে ঋষি বলদেবকে অতিথির আসন দেখিয়ে দিলে তিনি সেখানে উপবেশন করলেন, তারপর লোমপাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মহারাজ, আমি অঙ্গরাজ্যের যে দুর্দশার কথা শুনেছিলাম, এখানে আসবার পথে দেখলাম অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ এবং হৃদয় বিদারক। অঙ্গরাজ্যের মানুষের এই দুর্দশা দেখে আমার হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। আমি ব্যথিত, মর্মাহত।’
লোমপাদ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন বলদেবের দিকে, তারপর বললেন, ‘মুনিবর, অঙ্গরাজ্য আজ বিপন্ন, আমরা সকলেই অসহায় এবং ব্যথিত। আপনি কী সুসংবাদ বয়ে এনেছেন, দয়া করে যদি প্রকাশ করেন।’
‘মহারাজ, এখানে আসবার পূর্বে আমি নয়নাভিরাম দরদ দেশে ছিলাম। সৌভাগ্যবশত সেখানে কয়েকজন দেবতার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ এবং আলাপ হয়, তাঁরা অপ্সরাদের সঙ্গে নিয়ে দরদ দেশের আরামদায়ক আবহাওয়ায় বিহার করতে এসেছিলেন। স্বর্গ-মর্ত্য বিষয়ে যখন তাঁদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল, তখন একজন দেবতার কাছ থেকে আমি জানতে পারি যে দেবরাজ ইন্দ্র আপনার প্রতি ভীষণ অপ্রসন্ন, তাই তিনি অঙ্গরাজ্যে বারিবর্ষণ করছেন না!’
লোমপাদ অত্যন্ত বিস্মিত এবং বিচলিত হয়ে বললেন, ‘মুনিবর, আমি তো কখনো দেবরাজ ইন্দ্রকে অমান্য করি নি, মন্দ বাক্য বলি নি, তাঁর প্রতি কোনো অসদাচরণ করি নি, তাঁকে অস্বীকারও করি নি। অন্য কোনো দেবতাকেও আমি কদাচিৎ অস্বীকার করি নি। তাহলে কোন অপরাধে তিনি আমার প্রতি অপ্রসন্ন? আমি কি নিজের অজ্ঞাতে কোনো অন্যায় করেছি? নাকি আমার পূর্বজন্মের কোনো পাপের ফলে তিনি আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন? বলুন মুনিবর, আমার যে আর তর সইছে না!’
‘মহারাজ, পূর্বজন্মের নয়, তিনি আপনার ইহজন্মের পাপের শাস্তিই আপনাকে দিচ্ছেন। স্মরণ করে দেখুন তো অতীতে আপনি কখনো ব্রাহ্মণদের সঙ্গে অসদাচরণ করেছিলেন কি না?’
বিচলিত লোমপাদ ভাবতে লাগলেন, তাঁর বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল, শরীর মৃদু কাঁপতে লাগলো, তিনি ঘর্মাক্ত হতে থাকলেন।
বলদেব বললেন, ‘মহারাজ, দেবতা আমায় জানিয়েছেন যে একদা আপনি নাকি চম্পানগরীর ঋষি, পুরোহিত এবং সকল ব্রাহ্মণগণকে অপমান করেছিলেন, তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করেছিলেন, যে করেই হোক সে-কথা দেবরাজ ইন্দ্রের কানে পৌঁছয়, এ কারণেই দেবরাজ ইন্দ্র আপনার প্রতি ভীষণ অপ্রসন্ন হয়ে আছেন এবং শাস্তিস্বরূপ অঙ্গরাজ্যে বারিবর্ষণ বন্ধ রেখেছেন।’
লোমপাদ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন সে কথা যে অনেক বছর আগে এক যজ্ঞের সময় অসহিষ্ণু হয়ে তিনি ব্রাহ্মণদেরকে লোভী, উচ্ছিষ্টভোজী ইত্যাদি বলেছিলেন; তাতে ব্রাহ্মণগণ ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। বলদেবের কথায় তাঁর সে-কথা স্মরণ হলো, সিংহাসনের হাতলে কনুই রেখে তিনি কপালে হাত দিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘হে ভগবান, আমারই পাপে আজ ডুবতে বসেছে অঙ্গরাজ্য, আমারই জন্য আজ অঙ্গরাজ্যের প্রজারা জলকষ্টে ভুগছেন, রাজ্যের পশুপাখি আর বৃক্ষলতা ক্লেশ পাচ্ছে; প্রাণিকুল জলবিনা অনাহারে রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে, আমারই পাপে, আমি এক মহাপাপী, অযোগ্য রাজা!’
বলদেব শান্তস্বরে বললেন, ‘মহারাজ, আমি জেনেছি যে ব্রাহ্মণদের প্রতি আপনি সঠিক দায়িত্ব পালন করছেন না, আসবার পথে আমি নিজেও স্বচক্ষে দেখেছি যে আপনার রাজ্যে অনেক ব্রাহ্মণ তিনবেলা পেট পুরে আহার করতে পারছেন না।’
লোমপাদ কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি লজ্জিত, দুঃখিত মুনিবর।’
‘মহারাজ, ব্রাহ্মণদের প্রতি রাজার কী কর্তব্য সে বিষয়ে দেবতাগণ আমাকে জ্ঞান দান করেছেন, শাস্ত্রেও আছে।’
‘মুনিবর, আমি অজ্ঞান-মূঢ়, আমি দেবতা প্রদত্ত সেই জ্ঞান শ্রবণ করতে চাই। আমি আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতে চাই।’
‘মহারাজ, ব্রাহ্মণের ধর্ম ইন্দ্রিয় দমন, বেদাভ্যাস, অধ্যাপন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ। ব্রাহ্মণ সেবাই রাজার শ্রেষ্ঠ ধর্ম। রাজা প্রচুর দক্ষিণাযুক্ত যজ্ঞ সম্পাদন করবেন এবং ধর্মের জন্য ব্রাহ্মণদের ভোগ্যবস্তু ও ধন দান করবেন। অব্রাহ্মণকে দান করলে সমফল (শাস্ত্রবিহিত ফলের সমান), ব্রাহ্মণব্রুবকে দানে দ্বিগুণ ফল হয়, যে বেদাধ্যয়ন শুরু করেছে তাকে দানের ফল লক্ষগুণ, বেদে পারদর্শী ব্রাহ্মণকে দানের ফল অনন্ত। ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত ধন অবিনশ্বর বলে উক্ত হয়। যে রাজ্যের ব্রাহ্মণগণ অভাবগ্রস্ত এবং অভুক্ত থেকে রাত্রে শয্যায় যান, সেই রাজ্য এবং রাজার প্রতি দেবতাগণ প্রসন্ন হন, অভিসম্পাত করেন। সেই রাজ্যে অনাবৃষ্টিতে আবাদ হয় না, অতিবৃষ্টিতে ফসল নিমজ্জিত হয়, দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মতিভ্রষ্ট হয়ে যদি কদাচিৎ কোনো ব্রাহ্মণ অন্যায় বা অনাচার করেও থাকেন, তবু ক্ষত্রিয় রাজার পক্ষে তাকে দণ্ড দেওয়া অনুচিত। ব্রাহ্মণকে রক্ষা এবং সেবা করাই রাজার শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এরপর একজন দেবতা আমাকে পুরাকালের এক আখ্যান শুনিয়েছেন।’
লোমপাদ বললেন, ‘আপনি বলুন মুনিবর, আমি সেই আখ্যান শুনে পূণ্য অর্জন করতে চাই, ধন্য হতে চাই।’
‘বহু বৎসর আগের কথা, তখন কৃষিকর্মের প্রসার খুব বেশি ঘটে নি, ব্যবসা-বাণিজ্য তো নয়ই। নানা গোত্রের মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতো, ধর্মানুসারে পরস্পরকে রক্ষা করতো। কোনো রাজ্য ছিল না, রাজা ছিল না, রাজদণ্ডও ছিল না। কিন্তু ক্রমশ মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেতে থাকলো, মোহের বশে ধর্মজ্ঞান লুপ্ত হতে থাকলো, বেদ অমান্য করতে শুরু করলো। পুরোহিত এবং ঋষিগণ জ্ঞান দিতেন বটে, কিন্তু মানুষ তা অগ্রাহ্য করতে শুরু করলো। অরণ্য পরিষ্কার করে যে স্বল্প আবাদী জমি তৈরি করা হয়েছিল কখনো তা নিয়ে এবং কখনো নারীর অধিকার নিয়ে লড়াই শুরু হলো। কেবল অনার্য রাক্ষস, পনি, অজ, যক্ষদের সঙ্গেই নয়; আর্যদের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যেও জমি, জন্মন্ এবং নারীর অধিকার নিয়ে যুদ্ধ শুরু হলো। কিন্তু আর্যদের এক গোত্রের সঙ্গে আরেক গোত্রের কিংবা অনার্যদের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধলেও মানুষকে একতাবদ্ধ করা, নেতৃত্ব দেওয়া এবং আইনের দ্বারা সমাজ পরিচালিত করার মতো কোনো মানুষ ছিল না। তখন সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে প্রয়োজন পড়লো একজন রাজার, যিনি তার গোত্রের মানুষকে অন্য গোত্র কিংবা অনার্যদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবেন, নিজ গোত্রের মানুষকে নেতৃত্ব দিবেন, নিজ গোত্রের অন্যায়কারীকে সাজা দিবেন, ধর্ম এবং গোত্র রক্ষার্থে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে দ্বিধা করবেন না। তখন পুরোহিত, ঋষি এবং গোত্রের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ মিলে বেণ নামক একজনকে রাজা নির্বাচন করলেন। কিন্তু রাজা হবার পর বেণ স্বেচ্ছাচার এবং দুর্বিনীত হয়ে উঠলেন, ভগবান বিষ্ণু এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে অস্বীকার করলেন, বেদকে অগ্রাহ্য করলেন, যজ্ঞকে অপ্রয়োজনীয় মনে করলেন। পুরোহিত এবং ঋষিদের অমান্য এবং অপমান করলেন। তখন সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য দেবতাদের পরামর্শে পুরোহিত এবং ঋষিগণ বেণকে বধ করে তারই জ্যেষ্ঠ্যপুত্র পৃথুকে রাজা নির্বাচিত করলেন। দেবতা, পুরোহিত এবং ঋষিগণ রাজা পৃথুকে বললেন, “তুমি তোমার নিজের প্রিয় এবং অপ্রিয়ের বিচার না করে সমস্ত মানুষের প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হবে, কাম-ক্রোধ-লোভের বশীভূত হবে না, ধর্মভ্রষ্ট মানুষকে বাহুবলে দমন করবে, তুমি প্রতিজ্ঞা করো- যে কায়মনোবাক্যে বেদনির্দিষ্ট ও দণ্ডনীতিসম্মত ধর্ম পালন করবে, পৃথিবীর সমস্ত ব্রাহ্মণকে রক্ষা করবে, কখনো ব্রাহ্মণগণকে দণ্ড দেবে না এবং বর্ণসংকরদোষ নিবারণ করবে।”
পৃথু প্রতিজ্ঞা করলে শুক্রাচার্য তার পুরোহিত হলেন। পৃথু ধর্মানুসারে প্রজাপালন করতে লাগলেন। জগতে আবার শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এলো। পৃথুর রাজ্য পরিচালনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবতা, পুরোহিত এবং ঋষিগণ বেণকে বাতিল করে তাঁকে ভূ-মণ্ডলের প্রথম রাজার স্বীকৃতি দান করলেন।’
বলদেব রাজা পৃথুর আখ্যান শেষ করলে রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষী ‘সাধু সাধু’ বলে উঠলেন। লোমপাদের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কাতরস্বরে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি অজ্ঞান, আমি মূঢ়, আমি অযোগ্য!’
বলদেব বললেন, ‘মহারাজ, আপনি ভেঙে পড়বেন না। আমি পূজনীয় দেবতাগণের কাছ থেকে অঙ্গরাজ্যের এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায়ও জেনে এসেছি।’
মাথা তুলে আশান্বিত হয়ে করজোরে বলদেবের দিকে তাকিয়ে লোমপাদ বললেন, ‘মুনিবর, আমার পাপের জন্য আজ আমি ভীষণ অনুতপ্ত; আমি এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই, দয়া করে বলুন, পূজনীয় দেবতাগণের কাছ থেকে এই সংকট থেকে উত্তরণের কী উপায় আপনি জেনে এসেছেন। কীভাবে আমি দেবরাজ ইন্দ্রকে তুষ্ট করতে পারবো, যাতে তিনি আমার প্রতি ক্ষমাশীল হয়ে অঙ্গরাজ্যে পূর্বের ন্যায় রাশি রাশি বারিবর্ষণ করেন। আপনি নিঃশঙ্কোচে বলুন, প্রায়শ্চিত্তের জন্য আমি যে-কোনো কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছি।’
বলদেব গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘মহারাজ….এ কিছুটা ত্যাগ-ই বটে।’
লোমপাদ গম্ভীর মুখে এবং হয়তোবা কিছুটা ভীতচিত্তে তাকিয়ে রইলেন বলদেবের দিকে। অমাত্যবর্গ উশখুস করতে লাগলেন প্রকৃত কথাটা শোনার জন্য। বলদেব বললেন, ‘মহারাজ, দুটি কর্ম আপনাকে সম্পাদন করতে হবে। প্রথমত আপনাকে দেবরাজ ইন্দ্রের উদ্দেশে যজ্ঞানুষ্ঠান করে প্রায়শ্চিত্য করতে হবে, রাজ্যের সকল ব্রাহ্মণকে যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করতে হবে। তাদেরকে উত্তম অন্নভোজন করাতে হবে; উত্তম বস্ত্র, প্রচুর কড়ি এবং সুবর্ণ দান করতে হবে। সর্বদাই খেয়াল রাখতে হবে যেন আপনার রাজ্যে কখনো কোনো ব্রাহ্মণ ক্ষুধায় কষ্ট না পান। ব্রাহ্মণদের সন্তুষ্ট করতে হবে, তারা সন্তুষ্ট হলেই দেবরাজ ইন্দ্র আপনার প্রতি প্রসন্ন হবেন। দ্বিতীয়ত, এমন একজন মুনিকুমার প্রয়োজন যিনি একনিষ্ঠভাবে তপশ্চর্যা করছেন, যিনি কখনো নারীর সংস্পর্শ পান নি, কখনো নারী সম্ভোগ করেন নি। এইরূপ একজন মুনিকুমারের পদস্পর্শে রাজ্যের ভূমি পবিত্র করতে পারলে এবং তার সহিত আপনার কন্যা শান্তার শুভবিবাহ সম্পন্ন করতে পারলেই কেবল আপনার পাপের প্রায়শ্চিত্য হবে, ইন্দ্রদেব প্রসন্ন হয়ে অঙ্গরাজ্যে বিপুল বারিবর্ষণ করবেন।’
ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু রাজভাণ্ডারের আরো কিছু ধন ব্যয় হলেও প্রথম বিধানটি রাজা লোমপাদের জন্য কিছু স্বস্তিদায়ক; কিন্তু দ্বিতীয় বিধানটি তাঁর জন্য যেমনি অস্বস্তিদায়ক, তেমনি পীড়াদায়কও বটে। প্রিয় কন্যার কথা চিন্তা করে তাঁর মুখে এবং চিত্তে কিছুটা দ্বিধার মেঘের আবির্ভাব হলেও রাজ্যের সংকটের কথা স্মরণ করে অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি তা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘মুনিবর, আমার কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমি এখন যে-কোনো কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত, আমি অবশ্যই রাজ্যের ব্রাহ্মণদের সন্তুষ্টির জন্য প্রায়শ্চিত্য করবো। কিন্তু কখনো নারী সংস্পর্শ পান নি, নারী সম্ভোগ করেন নি এমন একজন নিষ্কলুষ মুনিকুমার কোথায় পাওয়া যাবে তা ভেবেই আমি চিন্তিত।’
রাজপুরোহিত এতোক্ষণে কথা বললেন, ‘মহারাজ, আমি এমন একজন মুনিকুমারের সন্ধান জানি বটে, কিন্তু বলতে ভীষণ বিব্রত বোধ করছি। কেননা একদা তার পিতা আমার বাল্যসখা ছিলেন।’
রাজজ্যোতিষী বললেন, ‘রাজপুরোহিত মহাশয়, রাজ্যের এই মহাদুর্যোগকালে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা ভুলে বোধকরি রাজ্যের কল্যাণের জন্য বৃহত্তর চিন্তা করাই উত্তম।’
রাজপুরোহিত রাজজ্যোতিষীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আমিও সে কথাই ভাবছি। কিন্তু…’
লোমপাদ বললেন, ‘কোনো সংকোচ করবেন না রাজপুরোহিত মহাশয়, দয়া করে বলুন মুনিকুমার সম্পর্কে।’
‘মহারাজ, কশ্যপের পুত্র মহর্ষি বিভাণ্ডকের পুত্র যুবক তপস্বী ঋষ্যশৃঙ্গ। শুনেছি তিনি মৃগযোনিজ, একদা এক মহাহ্রদে স্নানরত অবস্থায় মহর্ষি বিভাণ্ডক অপ্সরা উর্বশীকে দেখে কামোত্তেজিত হলে হ্রদের জলে তার শুক্রপাত হয়। অরণ্যের এক মৃগী জলে ভাসমান সেই শুক্র পান করে গর্ভবতী হয় এবং একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। মহারাজ, সেই পুত্রই ঋষ্যশৃঙ্গ; মৃগযোনিজ বলে তার মস্তকে একটি শৃঙ্গ বিদ্যমান। তিনি একনিষ্ঠভাবে তপশ্চর্যায় নিমগ্ন এবং মুখ্য ও গৌণ এই দুই ধরনের ব্রহ্মচর্যা পালন করেছেন। নিভৃত অরণ্যে থাকার ফলে তিনি কখনো নারীর সংস্পর্শ পান নি, এমনকি পিতা ব্যতিত অন্য কোনো পুরুষও তিনি দেখেন নি। নারী-পুরুষের ভেদ তিনি জানেন না। তিনি এখন আশ্রমে অগ্নি পরিচর্যা এবং পিতার শুশ্রূষায় সময় অতিবাহিত করছেন। শোনা যায়, তপশ্চর্যায় তিনি নাকি তার পিতাকেও ছাড়িয়ে যাবেন।’
লোমপাদ বললেন, ‘মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রম কোথায় রাজপুরোহিত মহাশয়?’
‘আমি যাই নি কখনো, তবে ঋষিদের মুখে সে-জায়গার বর্ণনা শুনেছি। ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের উত্তর দিকে কৌশিকী নদীতীরের এক বিজন অরণ্যে মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রম, যেখানে সচরাচর মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে না।’
‘রাজপুরোহিত মহাশয়, আপনি সেখানে যান, সেখানে যেতে আপনার যা কিছু প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করা হবে; আপনি মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে আসুন।’
‘আমায় মার্জনা করবেন মহারাজ। মহর্ষি বিভাণ্ডক কোনোক্রমেই তার পুত্রকে তপশ্চর্যার পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেবেন না। মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে আনতে হলে তার পিতার অগোচরে ছলনা করে আনতে হবে; তাতে বিভাণ্ডক নিশ্চয় অভিশাপ দেবেন। তাছাড়া, একদা তিনি আমার বাল্যসখা ছিলেন, তার পুত্র আমারও পুত্রসম। ছলনার মাধ্যমে তার একমাত্র পুত্রকে হরণ করে আনা আমার পক্ষে ন্যায়সঙ্গত হবে না। বাল্যসখার সঙ্গে ছলনার মতো অপরাধ করলে আমার নরকবাস নিশ্চিত!’
লোমপাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো, মুখশ্রী আবার মেঘাচ্ছন্ন হলো। রাজপুরোহিত অযৌক্তিক কিছু বলেন নি। তিনি আশান্বিত হয়ে রাজজ্যোতিষীর মুখের দিকে তাকালেন, ‘রাজজ্যোতিষী মহাশয়, তাহলে আপনি যান, মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে আসুন, বিনিময়ে আমি আপনাকে সুরম্য প্রাসাদ, কড়ি ও সুবর্ণ, সুন্দরী নারী এবং ভৃত্য উপহার দেব। আপনি শুধু মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে এনে দিন।’
রাজজ্যোতিষী বললেন, ‘মহারাজ, সুরম্য প্রসাদ, কড়ি ও সুবর্ণে আমার অরুচি নেই, সুন্দরী নারীর মণিবন্ধে আবদ্ধ থেকে ভৃত্যের পদসেবা গ্রহণ স্বর্গীয় সুখকর; কিন্তু আপনি আমায় যা দিয়েছেন বয়সের ভারে আমি সে-সবের-ই সদ্ব্যবহার করতে পারছি না, আরও নিলে অপচয় হবে নিশ্চয়। আর মানুষের ভাগ্য গণনার বাইরে অন্য কোনো কর্মেও আমি অক্ষম এবং অপারগ। তাছাড়া, মহর্ষি বিভাণ্ডক মহা শক্তিশালী, আমি তার পুত্রকে আনতে গেলে তিনি আমার ওপর ক্ষুব্ধ হবেন এবং আমাকে ধ্বংস করবেন। আমায় ক্ষমা করুন মহারাজ।’
লোমপাদ বললেন, ‘তবে কি সৈন্য পাঠিয়ে মুনিকুমারকে জোর করে তুলে আনবো?’
রাজপুরোহিত বললেন, ‘মহারাজ, স্বপ্নেও অমন কর্মের কথা ভাববেন না, তাহলে স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে। তেজস্বি মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে জোর করে আনার সাধ্য কারো হবে না। তবে তার চিত্ত বালকের ন্যায়, পিতার অগোচরে তাকে মুগ্ধ করে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনা যেতে পারে।’
বলদেব বললেন, ‘মহারাজ, এই কার্যে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে জোর করে পাঠানোও ন্যায়সঙ্গত হবে না, কেউ যদি স্বেচ্ছায় গিয়ে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে আসতে পারে তবেই কার্যসিদ্ধি হবে।’
লোমপাদ আবার গম্ভীর হয়ে গোঁফে আঙুল বুলাতে লাগলেন, যতো না গরমে তার চেয়ে অধিক দুশ্চিন্তায় তিনি ঘর্মাক্ত হচ্ছেন, যদিও তাঁর পিছনে দু-পাশে দুজন সেবক দাঁড়িয়ে অবিরাম বৃহৎ পাখার বাতাস করে তাঁর দেহ শীতল রাখার চেষ্টা করছে। তবু ঘর্মাক্ত হচ্ছেন তিনি।
রাজ্যের দূর্যোগ বিষয়ক অমাত্য অন্নদামঙ্গল বললেন, ‘মুনিবর, রাজপুরোহিত, রাজজ্যোতিষী, তাহলে আপনারা এমন একটা উপায় বলে দিন, যাতে সহজেই মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে রাজধানী চম্পানগরীতে উপস্থিত করা যায়।’
রাজসভার সকলেই অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছেন বলদেব, রাজজ্যোতিষী এবং রাজপুরোহিতের মুখের দিকে। রাজসভায় যেন শ্মশানের নীরবতা বিরাজ করছে। বলদেব কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘মহারাজ, একটা উপায় আছে…।’
সভার সকলে আশান্বিত হয়ে বলদেবের মুখের দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, ‘প্রস্তরখণ্ড যেমনি দীর্ঘকাল ভূমিতে পড়ে থাকলেও নিজে নিজে তপ্ত হয় না বা আগুন জ্বলে না যতোক্ষণ না তাতে আরেক খণ্ড প্রস্তরের ঘর্ষণ লাগে; নিশ্চয় ঋষ্যশৃঙ্গও তেমনি প্রস্তরখণ্ড, আরেকখণ্ড প্রস্তরের ঘর্ষণেই কেবল তপ্ত হতে পারে! মহারাজ, ঋষ্যশৃঙ্গ স্ত্রী-বিহার-সুখ সম্পর্কে অজ্ঞাত। তার পিতার অগোচরে পুরুষের চিরকালের চিত্তন্মাদী ইন্দ্রিয়ভোগ্য সুন্দরী নারী দ্বারা তার সুপ্ত কামভাব জাগিয়ে, শারীরিক সুখের প্রলোভনে আচ্ছন্ন করে তাকে রাজধানী চম্পানগরীতে নিয়ে আসা সম্ভব।’
লোমপাদ এবং অন্যান্য অমাত্যগণের মুখের দুশ্চিন্তার মেঘ কাটতে আরম্ভ করলো, দেখা দিলো রৌদ্রের আভাস। রাজজ্যোতিষী বলদেবের বুদ্ধির প্রশংসা করে তার কথায় সমর্থন করে বললেন, ‘অতি উত্তম প্রস্তাব।’
রাজপুরোহিত বললেন, ‘মহারাজ, রাজ্যের গণিকাদের ভেতর থেকে অতি সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতি গণিকাদেরকে বাছাই পূর্বক এই কর্মে নিযুক্ত করে শীঘ্রই তাদেরকে বিভাণ্ডকের আশ্রমে পাঠানো যেতে পারে।’
বলদেব বললেন, ‘তবে স্মরণ রাখতে হবে এই শুভকার্যে গণিকাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কাউকে যেন পাঠানো না হয়। যিনি স্বেচ্ছায় যেতে চান, তাকেই পাঠানো হোক।’
লোমপাদ বললেন, ‘রাজপুরোহিত মহাশয়, রাজজ্যোতিষ মহাশয়, আপনারা দুজনই বিজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাবান, সকলের শ্রদ্ধেয়; চম্পানগরীর সকলেই আপনাদেরকে মান্য করে। গণিকা নির্বাচনের ব্যাপারে আপনারা যদি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাহলে সেটাই মঙ্গল হয়।’
রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষী উভয়েই জিভ কেটে হাতজোড় করলেন। রাজজ্যোতিষী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার প্রারম্ভিক শব্দ ছাপিয়ে রাজপুরোহিত বলে উঠলেন, ‘ক্ষমা করবেন মহারাজ। গণিকাদ্বার আমাদের কাছে নরকদ্বারের সমতুল্য। আশাকরি এ ব্যাপারে আপনার অমাত্যগণ-ই সফল হবেন।’
এরপর রাজা লোমপাদ তার অমাত্যদের সঙ্গে আলোচনা করলেন; সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে দুর্যোগ বিষয়ক অমাত্য, সুদর্শন এবং বাক্যবাগীশ অন্নদামঙ্গলকে দায়িত্ব দিলেন শীঘ্র নগরের গণিকালয়গুলোতে গিয়ে সুন্দরী ও বাকপটু গণিকা সন্ধান করার; এবং প্রচুর কড়ি, মণিরত্ন, সুবর্ণ অলংকার, গঙ্গাতীরে সুরম্য প্রাসাদ এবং রাজনটীর সম্মান প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে তার পিতার নিকট থেকে হরণ করে আনার ব্যাপারে গণিকাদের রাজি করানোর।
অন্নদামঙ্গল তখনই বেরিয়ে পড়লেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং বাকপটু গণিকার সন্ধানে।
লোমপাদ বলদেবের উদ্দেশে বললেন, ‘মুনিবর, ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে কবে যজ্ঞ করা উচিত বলে আপনি মনে করেন।’
বলদেব বললেন, ‘সে ব্যাপারে রাজপুরোহিত মহাশয়ই ভালো বলতে পারবেন, তবে যতো শীঘ্র করা যায় ততোই মঙ্গল।’
রাজপুরোহিত কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘মহারাজ, তিনদিন পর একটি ভালো দিন আছে, সে-দিনই যজ্ঞ করা যেতে পারে।’
লোমপাদ বলেন, ‘তবে তিনদিন পরই যজ্ঞের আয়োজন করুন রাজপুরোহিত মহাশয়।’
তারপর বলদেবের উদ্দেশে লোমপাদ বললেন, ‘মুনিবর, আপনি অঙ্গরাজ্যের মানুষের জন্য সুসংবাদ বয়ে এনেছেন। স্পর্ধা নেবেন না, আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করতে চাই, আপনার যা কিছু প্রয়োজন, তার জন্য আপনি আমাকে আদেশ করুন। ইচ্ছা হলে আপনি সারাজীবন এই রাজপ্রাসাদে অতিথি হয়ে থেকে যেতে পারেন।’
বলদেব মৃদু হেসে বললেন, ‘মহারাজ, আমি একজন ঋষি, সারাজীবন তীর্থভ্রমণ আর কঠোর তপশ্চর্যা করে কাটিয়ে দিয়েছি। এখন এই বয়সে এসে রাজপ্রাসাদের সুখ আমার সইবে না। আপনি বরং…।’
‘আপনি নিঃশঙ্কোচে বলুন মুনিবর।’
‘আমি নদী তীরবর্তী কোনো অরণ্যে একটি সুরম্য আশ্রম গড়তে চাই, যেখানে বাকি জীবন তপশ্চর্যা করে কাটিয়ে দিতে পারবো। সুরম্য আশ্রম গড়ার জন্য আপনি আমাকে কিছু দক্ষিণা দিতে পারেন।’
‘নিশ্চয় মুনিবর, আপনি অঙ্গরাজ্যের জন্য যা করলেন তার তুলনায় আপনার এই চাওয়া সমুদ্রে বারি বিন্দুর ন্যায়।’
তারপর লোমপাদ অর্থ বিষয়ক অমাত্যের উদ্দেশে বললেন, ‘অমাত্য মহাশয়, সুরম্য আশ্রম নির্মাণবাবদ মুনিবরকে দুই সহস্র কড়ি উপহার দিন।’
এরপর আবার বলদেবের উদ্দেশে লোমপাদ বললেন, ‘মুনিবর, যজ্ঞকার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি আমার গৃহে অতিথি হয়ে থাকুন।’
বলদেব করজোর করলেন, ‘আমায় মার্জনা করবেন মহারাজ, আমি ব্রাহ্মণের গৃহ ব্যতিত অন্ন ভোজন করি না।’
রাজা লোমপাদ রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষীর মুখের দিকে তাকালেন, লোমপাদের মনোভাব বুঝতে পেরেই রাজপুরোহিত বললেন, ‘মুনিবর, আপনি আমার গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করলে আমি ধন্য হবো।’
ঋষি বলদেব বললেন, ‘নিশ্চয়।’
রাজসভা শেষ হলে বলদেব দুই সহস্র কড়ি নিয়ে রাজপুরোহিতের সঙ্গে সভাকক্ষ ত্যাগ করলেন।
(চলবে....।)
২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৩০
মিশু মিলন বলেছেন: লোমপাদের রাজ্যের নাম ছিল অঙ্গরাজ্য। বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের মুঙ্গের এবং ভাগলপুর অঞ্চল।
২| ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:২১
আনমোনা বলেছেন: এমন ঋষির প্রয়োজন যে নারীমুখ দর্শন করেনি। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি তেমনই একজন। তবে তাকে গনিকা দিয়ে আনালে কি সেই অবস্থা থাকে?
পড়তে ভালো লাগছে।
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:০৮
মিশু মিলন বলেছেন: এমন ঋষির প্রয়োজন যে নারীমুখ দর্শন করেনি। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি তেমনই একজন। তবে তাকে গনিকা দিয়ে আনালে কি সেই অবস্থা থাকে?[/sb
পুরাণ অনুসারে ঋষ্যশৃঙ্গ তেমন একজন ঋষি ছিলেন যে কি না কখনো নারীমুখ দর্শন করেননি। আর আমি এটাকে ঋষিদের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখিয়েছি।
অনেক ধন্যবাদ।
৩| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৫০
ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
বলদেবের প্রস্তাব বলদেবের মতই !!
পরের পর্ব দেখতে গেলাম ।
১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৪৭
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০৩
রাজীব নুর বলেছেন: লোমপাদ রাজার দেশ কোথায়?