নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- চার)

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:০২

চার

পুরোনো কালের ত্রিমুখী একতলা প্রাসাদ, প্রাসাদের সামনের তিনদিকেই অলিন্দসদৃশ বাঁধানো বেদি, উপরে কোনো ছাউনি নেই, বেদিতে উঠার জন্য বেদির দু-পাশে দুটো সিঁড়ি। যে-কোনো কক্ষ থেকে বেরিয়ে বেদি পেরিয়ে আঙিনায় নামতে হয়। বেদির ওপর সারাক্ষণই দু-খানা জলচৌকি পাতা থাকে বসবার জন্য। প্রাসাদের যে-কোনো এক কক্ষে প্রবেশ করে সব কক্ষে যাওয়া যায়, কক্ষগুলোর মাঝখানে সরু গলিপথ রয়েছে, গলিপথের সঙ্গেও কক্ষের দরজা, গলিপথ দিয়ে পিছনের অলিন্দে যেমনি যাওয়া যায়, তেমনি যাওয়া যায় সামনের বেদিতে। প্রসাদের বাইরের দেয়ালে স্যাঁতা পড়েছে, স্থানে স্থানে চুন-সুরকি খসে গেছে। কোনের দিকের দেয়াল বেয়ে উঠেছে কয়েকটি লতা, গজিয়েছে ছোট্ট একটি অশ্বত্থের চারা। ছাদের দড়িতে দোল খাচ্ছে পরিধেয় বস্ত্র-উত্তরীয়। ছাদের কাঠগড়ায় নেতিয়ে পড়ে আছে ছোট ছোট কয়েক খণ্ড ন্যাতা। ত্রিমুখী প্রাসাদের সামনের ছোট্ট আঙিনার পাশে রয়েছে একটি বকুলবৃক্ষ, একটি চন্দনবৃক্ষ, একটি বিল্ববৃক্ষসহ আরো কয়েকটি বৃক্ষ। সে-সব বৃক্ষেরই ছায়া পড়েছে বেদির ওপর। বেদির পূর্বদিকের জলচৌকিতে বসে আছে উমা আর মেঝেতে বাসন্তী। সদ্যস্নান করায় উমার কেশের ডগা দিয়ে জল ঝরছে, জলে ভিজে যাচ্ছে কাঁচুলির পিঠের অংশ এবং অনাবৃত পিঠ, এখনো কাঁকুই পড়ে নি কেশে; আর বাসন্তীর মুখে সাজিমাটির প্রলেপ, কেশে সুগন্ধি তেল মেখে বিন্যাস করছে, এখনো স্নান হয় নি তার।
স্নান সেরে এসে বেদির ওপর পাতা মাদুরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সুলোচনা, তার পরনে বাস, ঊর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত, পাশে বসে তার বক্ষ এবং স্তনে কালাগুরু দিয়ে পত্ররেখা অঙ্কন করছে সরমা। কোনো কোনো বিশেষ নাগর আছে, যারা তার প্রিয় গণিকার শরীরের নানা স্থানে পত্ররেখা অঙ্কন পছন্দ করে। তেমনই একজন নাগর আজ আসবে সুলোচনার কাছে, আগে থেকেই খবর পাঠিয়েছেন তিনি। সুলোচনাও খবর পাঠিয়ে সরমাকে ডেকে এনেছে শরীরে পত্ররেখা অঙ্কন করানোর জন্য। সরমা একজন বৃহন্নলা এবং বহুমাত্রিক পেশাদার শিল্পী, বয়স কুড়ি-একুশ। সে গীত-বাদ্য-নৃত্যে যেমনি পারদর্শী; তেমনি পত্ররেখা অঙ্কন, কেশসজ্জা এবং পুষ্পাস্তরণেও নিপুণ। সে কালাগুরু কিংবা কুঙ্কুম-চন্দন-অগুরুর মিশ্রণ দিয়ে সুনিপুণ পত্ররেখা বা পত্রভঙ্গ অংকন করতে পারে মানুষের শরীরে। সাধারণত বিভিন্ন গণিকালয়ের গণিকা আর সম্ভান্ত পরিবারের নারীগণকেই সে কড়ির বিনিময়ে এই ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। গণিকা এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা একটু বেশি সৌখিন হয়, তাই তারা তাদের নাগর এবং পতিকে তুষ্ট রাখতে শরীরে নানারকম পত্ররেখা অঙ্কন করায়। অবশ্য সম্ভান্ত গৃহের অবিবাহিত কন্যারাও শরীরে পত্ররেখা অঙ্কন করায়। পুরুষেরাও যে শরীরে পত্ররেখা অঙ্কন করায় না তা নয়, তবে নারীদের তুলনায় সংখ্যায় তারা অনেক কম। সেবাগ্রহীতাদের পছন্দ অনুযায়ী নানা রকম প্রাণি, পুষ্প, লতাপাতা ইত্যাদি চিত্রের পত্ররেখা তাদের শরীরে অঙ্কন করে সরমা। এছাড়া পুষ্পাস্তরণ কলাতেও সরমার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে, কারো বিবাহে উপলক্ষে পুষ্প দিয়ে গৃহসজ্জা, ফুলশয্যা সজ্জা করার জন্য কিংবা পূজার সময় মন্দির সজ্জা করার জন্য তাকে ডাকা হয়। এসব করে তার ভালই রোজগার হয়। তবে দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষের সৌখিনতায় কিছুটা ভাটা পড়েছে, ফলে তার রোজগারেও কোপ পড়েছে, তা বলে তার একেবারে চলছে না তা নয়, আগে হয়তো দশটা কাজ পেতো, এখন পায় পাঁচটা।

সরমা এক মনে কালাগুরু দিয়ে সুলোচনার বক্ষে একটি প্রজাপতি অঙ্কন করছে আর সুলোচনা চোখ ‍বুজে আছে। সদ্য স্নান সেরে হলুদ আর খয়েরি রঙের শুষ্কবস্ত্র পরে ছাদের দড়িতে ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে নিচে নেমে এসে বেদির আরেকটি জলচৌকিতে বসে কাঁকুই হাতে কেশবিন্যাস করতে করতে সকলের সঙ্গে গালগল্প করছে শবরী। সরমার উদ্দেশে শবরী বললো, ‘অমন মন দিয়ে কী অঙ্কন করছিস সরমা?’

শবরী-উমাদের বয়স ঊনিশ-কুড়ি বছর, সরমা বয়সে ওদের চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড় হলেও ওরা তাকে তুই সম্বোধন করে, উমা বললো, ‘কী আর অঙ্কন করবে, নিশ্চয় দুটো সারমেয়’র মৈথুনচিত্র!’

উমার কথা বলার ধরন দেখে হেসে উঠলো সকলেই, হাসতে গিয়ে বাসন্তীর গালে ভাঁজ পড়লো আর শুকনো সাজিমাটির গোটা কয়েক চলটা খুলে পড়লো তার গাল থেকে। হাসতে গিয়ে ‍সুলোচনার বুকও কেঁপে উঠলো, আর তাতে সরমার অঙ্কন কিছুটা লেপটে গেল, সরমা উমার উদ্দেশে বললো, ‘ওকে হাসিয়ে অঙ্কনটা দিলি তো নষ্ট করে, পরেরবার তোর আর তোর নাগরের মৈথুনের চিত্র অঙ্কন করবো সুলোচনার পিঠে, তখন বুঝবি মজা!’

শবরী কপট ধমক দিলো, ‘যাঃ লক্ষ্মীছাড়ী, মুখে কিচ্ছু আটকায় না!’

গরমের দ্বিপ্রহরে গণিকালয়ে নাগরের আনাগোনা থাকে না বললেই চলে, কদাচিৎ এক-দুজন হয়তো আগের রাত থেকেই থাকে। কিন্তু আজকাল সন্ধ্যার পরও নাগর আসা কমে গেছে। বছরের পর বছর অনাবৃষ্টি আর অনাবাদের ফলে এখন চলছে দুর্ভিক্ষ। এ বছর দুর্ভিক্ষ আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে, মহামারী রোগে মানুষ মরছে আর প্রহরে প্রহরে শবযাত্রার শ্মশানযাত্রীদের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। এই আকালের প্রভাব পড়েছে গণিকালয়েও। পরিচিত অনেক নাগরের মুখ-ই এখন আর তেমন দেখা যায় না। কেবল চাল চুলোহীন ভবঘুরে, অতি সৌখিন আর ধনী নাগররাই এখন আসে, কিন্তু তারাও আর আগের মতো উদার হস্ত নয়। আগে কোনো কোনো নাগর নাবীবন্ধের গিঁট খোলার আগে নাভীর ওপর ট্যাঁক খুলে রাখতো, পুরো ট্যাঁক লোপাট করে দিলেও তারা গায়ে মাখতো না; বিদায়কালে রসিকতা করে বড়োজোর আরেকটু জড়িয়ে ধরতো, ঠোঁটে কী স্তনে সোহাগের চুম্বন করতো। আর এখন নাগরেরা ট্যাঁক সাবধানে রাখে। কামলীলা সাঙ্গ হলে ট্যাঁকের মুখ খুলে গুনে গুনে কড়ি দেয় হাতে। তাদের আয় কমে গেছে, কিন্তু মোট আয়ের এক ষষ্ঠমাংশ কর ঠিকই দিতে হচ্ছে রাজাকে। কে জানে এই দুর্যোগকালে কর আরো বাড়িয়ে দেবে কি না! মানুষের মধ্যে রোগ-ব্যাধির প্রকোপ বেড়েছে। নাগররা কে কোন রোগ নিয়ে আসে তার ঠিক কী! সঙ্গমের সময় ভয়ে গণিকাদের প্রাণ যেন প্রকোষ্ঠে হাঁসফাঁস করে!

দ্বিপ্রহরের এই সময়টুকু গণিকাদের একান্ত নিজস্ব সময়। বেশিরভাগ গণিকাই ঘুম থেকে ওঠে বেশ বেলা করে। তাই দ্বিপ্রহরে তারা রূপচর্চা-কেশচর্চা করে, স্নান সেরে কয়েকজন একত্র হয়ে গল্প কিংবা রঙ্গ-রসিকতা করে, একসঙ্গে বসে মধ্যা‎হ্নভোজ সারে, কেউবা পুনরায় আরেকটু গড়িয়ে নেয় শয্যায়। এরপর অপরা‎হ্ণে তারা মুখে চন্দন-কুঙ্কুমের প্রসাধন করে, মাথার কেশ থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত সাজিয়ে দেহকে করে তোলে কামমন্দির, অতঃপর সদরদ্বারে এসে অপেক্ষা করে কামতীর্থযাত্রীর জন্য। তবে কোনো কোনো দ্বিপ্রহরে এক-দুজন কামবাই নাগর কারো কারো কক্ষে থাকে। এখন যেমন বিদুলার ঘরে একজন নাগর আছে; কাল সন্ধেয় এসেছে, এখন অব্দি যাবার নাম নেই। হয়তো দুপুরে স্নানাহারও এখানেই করবে। বিদুলা আর ওর নাগরকে নিয়েও রসিকতা করছে শবরীরা।

সদরদ্বার দিয়ে দুর্যোগ বিষয়ক অমাত্য অন্নদামঙ্গল প্রবেশ করলেন, তাকে দেখে শবরী-উমারা বেশ বিস্মিত হলো। অন্নদামঙ্গল কখনোই এমন অসময়ে আসেন না, আসেন সন্ধ্যার পর অথবা অনেক রাত্রে। আর এমন রাজসভার পোশাক পরেও তিনি কখনো আসেন না, তিনি আসেন একেবারে নাগর বেশে, গায়ে সুগন্ধি মেখে! শবরী নিচুস্বরে অন্নদামঙ্গলের আসার কথা বলতেই সুলোচনার বক্ষে পত্ররেখা অঙ্কনরত হাত গুটিয়ে নিলো সরমা, শায়িত সুলোচনা দ্রুত উঠে প্রায় দৌড়ে কক্ষে প্রবেশ করলো, বাসন্তীও তেলের বাটি রেখেই উধাও হলো, শবরীও চলে গেল। উমা উঠে বেদি থেকে নেমে অন্নদামঙ্গলের দিকে এগিয়ে গিয়ে নমস্কার করে ঠোঁটে হাস্যপুষ্প ফুটিয়ে রসিকতা করে গেয়ে উঠলো-‘কী দেখিয়া চিত্ত হইলো উতলা, ছুটিয়া আসিলো নাগর এই অবেলা!’
তারপর গান থামিয়ে বললো, ‘বাবু, আজ যে একেবারে অসময়ে, তাও এই ভরদুপুরে!’

অন্নদামঙ্গল ডানহাতের পঞ্চ আঙুলের ডগার মাধ্যমে উমার চিবুকে মৃদু দোলা দিয়ে বললেন, ‘কেনরে, ভরদুপুরে মদনদেব ভাতনিদ্রা দেয়, না কি তার শর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়!’
‘তা হলে তো মদনদেবের প্রাণসংশয় হবে বাবু, তাবৎ পুরুষেরা শর-ধনু নিয়ে মদনদেবকে বধ করতে ছুটবে!’
অন্নদামঙ্গল হাসতে হাসতে উমার কাঁধে হাত রেখে সিঁড়ি দিয়ে বেদিতে উঠে বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘গিরিকাদেবী কোথায় রে?’
‘মাসিমা তো গৃহে নেই। তার বোনপুতের খুব অসুখ, তাই দেখতে গিয়েছেন।’
‘সবাইকে বৈঠকখানায় আসতে বল।’ বলেই উমার কাঁধ থেকে হাত নামালেন অন্নদামঙ্গল।
‘সবাইকে! বাব্বা! বাবু কি মদনদেবের অক্ষয়রেতঃ বর পেয়েছেন!’
‘এখন রসিকতার সময় নয় উমা! জরুরি কাজে এসেছি, সবাইকে বৈঠকখানায় ডাক।’
উমা উচ্চস্বরে কাজের ভৃত্য মেয়েটিকে ডাকলো, ‘যোগী….।’
যোগী আশপাশেই কোথাও ছিল, সামনে এসে বললো, ‘আজ্ঞে দিদি।’

উমা যোগীকে নির্দেশ দিলো, ‘সবাইকে একবার বৈঠকখানার ঘরে আসতে বল তো, বলবি জরুরি কাজে অমাত্য মশাই ডাকছেন। আর শোন, ওই বিদুলা মাগিটাকে এবার ঘর থেকে বেরোতে বল, স্নানাহার ভুলে কাল সন্ধে থেকে যে একেবারে সর্পের ন্যায় শঙ্খ লেগে আছে!’
উমা অন্নদামঙ্গলের হাত ধরে এনে তাকে বৈঠকখানার কেদারায় বসিয়ে দিলো। অন্নদামঙ্গলের আসার খবর শুনে গণিকারা দ্রুত মুখে প্রসাধন মেখে, সুবর্ণতনুতে অলংকার শোভিত করে সুগন্ধ ছড়াতে ছড়াতে এসে দাঁড়ালো চঞ্চুতে হাস্যপুষ্প ফুটিয়ে; অন্নদামঙ্গলকে ঘিরে কেউ জলচৌকিতে বসলো, কেউ বসলো মেঝেতে, আবার কেউবা দাঁড়িয়ে রইলো। সকলেই যেন তাকে কামসেবা করতে তুমুল আগ্রহী! সকলেই চোখের তারায়, চঞ্চুতে, কেউ পীনোন্নত ঘনস্তনে, কেউবা স্থুল পয়োধরে যৌন আবেদন ফুটিয়ে বাক্যরসে মুগ্ধ করতে চাইলো অন্নদামঙ্গলকে। শবরী এলো সকলের শেষে, মুখে কোনো প্রসাধনের প্রলেপ ছাড়াই। শবরী কেবল এই গণিকালয়েরই নয়, সমগ্র চম্পানগরীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী গণিকাদের একজন, একই সঙ্গে সে বুদ্ধিমতী, বাকপটু, সংগীতে-নৃত্যে সুনিপুণ। গেল সমন উৎসবের নৃত্য প্রতিযোগিতায় সারা অঙ্গরাজ্যের সকল দক্ষ নৃত্যশিল্পীকে পিছনে ফেলে সে শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী নির্বাচিত হয়েছে। ওই যে পুরাকালে দেবতা মিত্রের অভিশাপে স্বর্গের অপ্সরা উর্বশী মর্তে পতিত হয়ে কাশীরাজ পুরূরবার স্ত্রীরূপে চার বছর কাটিয়ে স্বর্গে ফিরে গিয়েছিলেন, উর্বশী আর পুরুরবার প্রেমের আখ্যান অবলম্বনেই সমন উৎসবে নৃত্য পরিবেশন করেছিল শবরী। সুনিপুণ নৃত্যে সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল।

অন্নদামঙ্গল শবরীর প্রতীক্ষাতেই যেন অন্য গণিকাদের কথা বলার সুযোগ দিচ্ছিলেন। শবরী প্রবেশ করামাত্র তিনি তার কুশল জিজ্ঞাসা শেষে সকলের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি এখানে আমোদ করতে আসি নি আজ, এসেছি মহারাজের প্রয়োজনে, আমার প্রয়োজনে, তোমাদের প্রয়োজনে; অঙ্গরাজ্যের সকল মানুষ, পশুপাখি এবং বৃক্ষরাজির প্রয়োজনে।’

গণিকাগণ ভীষণ কৌতুহলী আর আগ্রহী দৃষ্টিতে এমনভাবে অন্নদামঙ্গলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো যেন তারা সকলেই সেই বিশেষ প্রয়োজন মিটাতে দারুণ আগ্রহী। তারা কেউ কেউ ধারণা করলো যে হয়তোবা রাজবাড়ীর বিশেষ কোনো অতিথি অথবা অতিথিবৃন্দের সামনে নৃত্য-গীত পরিবেশন কিংবা অতিথিবৃন্দকে কামসেবা করতে হবে। অতঃপর অন্নদামঙ্গলের মুখে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণের বিষয়ে সকল বৃত্তান্ত শোনার পর গণিকাদের সর্বাঙ্গে যে কামনার আনন্দপুষ্প প্রস্ফুটিত হয়েছিল মুহূর্তেই যেন তা শুকিয়ে ঝরে পড়লো অথবা লজ্জাবতী লতার মতো সংকুচিত হয়ে গেল! কেউ কেউ মনে মনে সংকল্প করে বসলো, মরে গেলেও তারা এই কর্ম করতে রাজি হবে না। অপারগতা প্রকাশের অপরাধে মহারাজ যদি তাদেরকে শূলেও চড়ান তবু তারা মুনিকুমারকে আনতে যাবার সাহস করবে না, কেননা মহর্ষি বিভাণ্ডকের অভিশাপে সহস্র কিংবা অযুত বৎসর তারা পাথর কিংবা বৃক্ষ হয়ে থাকতে চায় না! তার চেয়ে যা শাস্তি হয় এই জনমেই হোক! কিন্তু অন্নদামঙ্গল যদি সৈন্য নিয়ে এসে জোর করে তাদের তুলে নিয়ে পাঠিয়ে দেয় বিভাণ্ডকের আশ্রমে, এই ভয়ে শৃঙ্গারসে পূর্ণ তাদের সুবর্ণ মুখশ্রী অকস্মাৎ পাংশুবর্ণ ধারণ করলো। অন্নদামঙ্গল তাদের পাংশুবর্ণ মুখাবয়বের ভাষা পড়তে পেরে সবাইকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘ভয় নেই তোমাদের, তোমরা স্বেচ্ছায় না গেলে কাউকেই জোর করে সেখানে পাঠানো হবে না। যাওয়া বা না যাওয়া তোমাদের স্বেচ্ছাধীন। তবে রাজ্যের মঙ্গলের জন্য তোমাদের এই মহৎ কার্যে এগিয়ে আসা উচিত।’

অন্নদামঙ্গলের আশ্বাসে গণিকাদের রাজভয় কিছুটা দূর হলেও মহর্ষি বিভাণ্ডকের ভয়ে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণের ব্যাপারে কেউ-ই কোনো কথা বললো না, কেবল একে অপরের মুখ চাওয়া-চায়ি করতে লাগলো।

অন্নদামঙ্গল বললন, ‘এই কার্য সম্পাদনে যারা আগ্রহী হবে তাদেরকে প্রচুর কড়ি, সুবর্ণ অলংকার, গঙ্গাতীরে সুরম্য প্রাসাদ প্রদান করা হবে। তাদেরকে রাজনটীর সম্মান দেওয়া হবে, কর দিতে হবে না, রাজকোষ থেকে আজীবন তারা মাইনে পাবে। কারো যদি আরো কিছু প্রার্থনা থাকে সে-সবও পূরণ করা হবে।’

অন্নদামঙ্গল প্রলোভনের টোপ ফেলে শবরীর দিকে তাকালেন এই আশায় যে শবরী নিশ্চয় টোপ গিলবে, কিন্তু টোপ ফেলার জলকাটা ঢেউ শবরীর মনে লাগলেও সে কৌতুহলী হয়ে মনোযোগ দিলো না টোপের দিকে! তার মনে পড়লো অনেকদিন আগে দিদিমার মুখে শোনা গৌতম মুনির অভিশাপে অহল্যার প্রস্তরখণ্ডে রূপান্তরিত হবার কথা। অনেককাল আগে গৌতম মুনি তখন পত্নী অহল্যাকে নিয়ে মিথিলার এক উপবনে আশ্রমে বাস করছিলেন। একদিন গৌতম মুনি কোনো কাজে আশ্রমের বাইরে গেলে গৌতমের রূপ ধারণ করে দুষ্টু ইন্দ্র অহল্যার কাছে এসে সঙ্গম প্রার্থনা করেন। অহল্যা গৌতমের ছদ্মবেশী ইন্দ্রকে চিনতে পারলেও দুর্মতিবশে স্বর্গের রাজার সঙ্গে মিলনের লালসায় সম্মতি দিলেন এবং গৌতমরূপী ইন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলেন। সঙ্গম শেষে অহল্যা তার পরিতৃপ্তির কথা জানালেন ইন্দ্রকে, ইন্দ্রও তার পরিতুষ্টির কথা জানালেন। তারপর অহল্যা গৌতম মুনির ফিরে আসার সম্ভাবনার কথা ভেবে ইন্দ্রকে দ্রুত আশ্রম ত্যাগ করতে বললেন। কিন্তু ইন্দ্র কুটীরের বাইরে আসতেই গৌতম মুনির মুখোমুখি হলেন। গৌতম মুনি সব বুঝতে পেরে ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন নপুংশক হবার, তখনই ইন্দ্রের অণ্ডকোষ খসে পড়লো ভূমিতে। আর অহল্যাকে অভিশাপ দিলেন সহস্র বছর প্রস্তর খণ্ড হয়ে থাকার। আজও নাকি মিথিলার উপবনে প্রস্তরখণ্ড হয়ে পড়ে আছেন অহল্যা, তার মুক্তি মেলেনি। অহল্যার কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো শবরীর। সে শুনেছে বিভাণ্ডকও তপঃসিদ্ধ মহর্ষি, তার পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করতে গেলে তিনি যদি অভিশাপ দিয়ে তাদেরকে প্রস্তরখণ্ড করে রাখেন! না, এ কার্য তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শবরী সাবধানী উত্তর দিলো যাতে অন্যরাও কেউ আগ্রহী না হয়, ‘যদি বেঁচেই না থাকি, তাহলে আর প্রচুর কড়ি দিয়ে কী করবো বাবু? কে পরবে সুবর্ণ অলংকার, আর গঙ্গাতীরের সুরম্য প্রাসাদেই বা কে বাস করবে? মাসে মাসে রাজকোষ থেকে প্রাপ্ত মাসোহারা কে ভোগ করবে? তাছাড়া মুনিকুমারকে হরণ করে এনে রাজকুমারীর সঙ্গে বিবাহ দিলেই যে বৃষ্টি হবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?’

‘আছে, একজন মুনিবর স্বর্গের দেবতাদের কাছ থেকে অঙ্গরাজ্যে অনাবৃষ্টির কারণ এবং এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় জেনে এসেছেন। তার কথামতো কার্য করতে পারলেই দেবরাজ ইন্দ্র সন্তুষ্ট হয়ে অঙ্গরাজ্যে বারিবর্ষণ করবেন।’

‘এর আগেও তো রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষীর কথায় অনেকবার যজ্ঞ করা হয়েছে। কই, বৃষ্টি তো হলো না?’

‘মূর্খ বারাঙ্গনা! নাস্তিকের ন্যায় কথা বোলো না, দেবতাগণ এবং ঋষির কথায় বিশ্বাস রাখো। তোমাদের যা কার্য সেই চর্চাতেই তোমরা মনোযোগ দাও, কামক্ষুধা জাগিয়ে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে এসো।’

শবরী দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘আমায় ক্ষমা করবেন বাবু, সম্পদের প্রতি আমার কোনো লালসা নেই, আমি যেতে পারবো না; অন্যরা যায় তো যাক।’

শবরীর মতো সকলেই ক্ষমা চেয়ে অপারগতা প্রকাশ করলো। তারা যেন এখন অন্নদামঙ্গলের সামনে থেকে সরে পড়তে পারলেই বাঁচে!
গণিকাদের ওপর অন্নদামঙ্গলের রাগ হলেও ঋষি বলদেবের আদেশ মেনে তিনি তা প্রকাশ করলেন না, গম্ভীরমুখে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

গণিকালয়ের বাইরে এসে তার জন্য অপেক্ষারত শিবিকার দিকে এগোতেই ধুলি-মলিন শরীরে জটাধারী এক পাগল এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। পাগলের পরনে নেংটি, উদোম ময়লা শীর্ণ কালো শরীর; বাঁ-দিকের পাঁজরে দগদগে ঘা, কপালে একটা কাটা দাগ। দাড়ি-গোঁফ সত্ত্বেও শুষ্ক ঠোঁটের কোনার ঘা দৃষ্টিগোচর হয়। চিকন বাঁশের মতো তার পা দুটোর ওপর শরীরটাও যেন ফালি ফালি বাঁশের কাঠামোয় গড়া! ময়লার প্রলেপ পড়া হলদে দাঁত বের করে একগাল হেসে পাগল অন্নদামঙ্গলের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে সুরে সুরে বললো, ‘অন্নদা…অন্ন দে, অন্নদা…অন্ন দে, অন্নদা…অন্ন দে!’

শিবিকার বেহারারা দ্রুত এসে ধমক দিলেও পাগল নড়লো না, একইভাবে বলতে লাগলো, ‘অন্নদা…অন্ন দে।’

এবার বেহারারা পাগলের দুই বাহু ধরে টানতে শুরু করলে সে ভূমিতে বসে পড়লো, বেহারারা তবু ছেঁচড়ে টানতে লাগলো পাগলকে। অন্নদামঙ্গল হাতের ইঙ্গিতে বেহারাদের থামতে বলে পকেট থেকে দুটো কড়ি বের করে পাগলের সামনে ধুলোয় ছুড়ে দিয়ে শিবিকায় গিয়ে উঠলেন। বেহারারা শিবিকা কাঁধে তুললো। পাগল কড়ি দুটো হাতে নিয়ে হাসলো, তারপর কড়ি দুটো শিবিকার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ‘অন্নদা…অন্ন দেয় না, অন্নদা…অন্ন দেয় না!’

শিবিকার কপাট খোলা, নকশা করা ছোট্ট হাতপাখার বাতাসে অন্নদামঙ্গল নিজেই নিজেকে শীতল করার চেষ্টা করছেন, তবু ঘামছেন। বাইরে দুপুরের তাতানো রোদ, বাতাসের অভাবে বৃক্ষপত্র যেন ক্রমাগত রোদের লেহনে ঝিমিয়ে পড়েছে।

চম্পানগরীর গণিকালয়গুলো নিজের হাতের তালুর মতোই চেনা অন্নদামঙ্গলের, তার গণিকাপ্রীতির কথা রাজবাড়ীর দ্বাররক্ষী থেকে রাজা লোমপাদ সকলেরই জানা, আর এ কারণেই যে গণিকা সন্ধানের দায়িত্বটা তার ওপর বর্তেছে তা তিনি জানেন। শুরুতেই ব্যর্থ হলেও দায়িত্বটা তিনি সফলভাবে পালন করতে পারবেন এই বিশ্বাসে গেলেন নগরীর অন্য গণিকালয়ে। গণিকাদেরকে বুঝিয়ে বললেন সকল বৃত্তান্ত। প্রচুর কড়ি, সুবর্ণ অলংকার, মণিরত্ন, গঙ্গাতীরে সুরম্য প্রাসাদ, রাজনটীর সম্মান প্রভৃতির প্রলোভন দেখালেন; কিন্তু কোনো গণিকাই প্রলোভনে ভুলে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করে আনতে রাজি হলো না। অন্নদামঙ্গল ভেবেছিলেন গণিকাদের রাজি করানো কী আর এমন কঠিন কার্য, শোনা মাত্রই সম্পদের লোভে রাজি হয়ে যাবে; কিন্তু দিনভর একের পর এক গণিকালয়ে ঘুরে ঘুরে গণিকাদের কাছ থেকে প্রত্যাখাত হয়ে বুঝলেন, এর চেয়ে দুরূহ কাজ আর নেই, প্রাণের মায়া সকলেরই আছে; প্রাণের মায়ার কাছে অঢেল সম্পদও তুচ্ছ!
অসফল অন্নদামঙ্গল পরদিন সকালে ভগ্ন মনোরথে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে গণিকাদের অপারগতার কথা জানালেন রাজা লোমপাদকে। চিন্তিত লোমপাদ ভীষণ আশাহত হয়ে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে গম্ভীর আর হতাশ স্বরে বললেন, ‘চম্পানগরীতে এতো এতো গণিকা অথচ একজনও রাজি হলো না!’

অন্নদামঙ্গল বললেন, ‘মহারাজ আমি সব রকম চেষ্টাই করেছি, কিন্তু সকল গণিকাই মহর্ষি বিভাণ্ডকের অভিশাপের ভয়ে সম্পদকে তুচ্ছজ্ঞান করেছে।’

লোমপাদ ভেতরে ভেতরে ভীষণ মুষড়ে পড়লেন যা রাজসভার কারো কারো দৃষ্টিগোচর হলো। তাঁর মর্মপীড়া অনুধাবন করতে পেরে খাদ্য বিষয়ক অমাত্য বললেন, ‘মহারাজ, দুশ্চিন্তা করবেন না, উপায় একটা হবেই।’

‘আর কী করে উপায় হবে অমাত্য মহাশয়! সবই তো শুনলেন।’
রাজসভায় যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হঠাৎ রাজজ্যোতিষী বলে উঠলেন, ‘মহারাজ, ভিন রাজ্যে দূত পাঠিয়ে গণিকার সন্ধান করা যেতে পারে।’
‘ভিন রাজ্যে!’
‘আজ্ঞে মহারাজ, শুনেছি সিন্ধু, শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা নদীর পার্শ্ববর্তী জনপদের গণিকারা তো বটেই অনেক পুরনারীও দারুণ লোভী, দুশ্চরিত্রা, অশ্লীলভাষিণী এবং ভীষণ সাহসী হয়।’
লোমপাদের কপালে পুনরায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো, ‘কিন্তু সে তো বহুদূরের পথ, যেতে-আসতে অনেক সময়ের প্রয়োজন।’
‘মহারাজ, এছাড়া আর তো কোনো উপায় দেখছি না! কখনোই না হওয়ার চেয়ে বিলম্বে হওয়াও শ্রেয়। কালক্ষেপণ না করে কালই তরণীযোগে চৌকস কর্মকর্তাদের যাত্রা করা উচিত কার্য মনে করি। আর এদিকে আমরা রাজ্যের ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন করে ফেলি।’
‘কোন রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা ফলপ্রসু হবে বলে মনে করেন আপনি?’

‘সিন্ধু আর গান্ধারদেশের স্ত্রীদের বদনাম সর্বাপেক্ষা বেশি। প্রথমে সিন্ধুদেশেই সন্ধান করা উচিত, সেখানে ব্যর্থ হলে গান্ধার।’
সেনানী হঠাৎ ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, ‘নেহাত মুনিবর জোর করতে নিষেধ করেছেন তাই, নইলে এই রাজ্যের সকল গণিকাকে আমি…।’
রাজজ্যোতিষী মুখে বিদ্রুপাত্মক হাসি ছড়িয়ে বললেন, ‘মহাবীর্যশালী সেনানী মহাবাহু, আপনি আপনার শৌর্য ধরে রাখুন, প্রয়োজনে যুদ্ধের ময়দানে দেখাবেন, লোধ্রপুষ্পের পাপড়ির ন্যায় গণিকাদের কোমল গাত্রে নয়!’

সেনানী বিরক্ত হয়ে রাজজ্যোতিষীর দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন, অসমতল ভূমির ন্যায় তার কাঁধ এবং বাহুর পেশি হঠাৎ রুক্ষ পার্বত্যভূমির ন্যায় একটু বেশি ফুলে উঠে পুনরায় পূর্বের রূপ ধারণ করলো। এই রাজজ্যোতিষীর জন্য তিনি কখনোই আত্মপ্রশংসা করে নিজেকে প্রকটভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না রাজা লোমপাদের সামনে, কৌতুকের ছলে রাজজ্যোতিষী যেন ভল্ল নিক্ষেপ করেন! এজন্য সেনাপতি ভেতরে ভেতরে ভীষণ ক্ষুব্ধ রাজজ্যোতিষীর ওপর।

এমন সময় একজন দ্বাররক্ষী রাজসভায় প্রবেশ করে নত মস্তকে জানালো, ‘মহারাজ, একজন বৃদ্ধা রাজসভায় প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করছেন; তিনি মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণের ব্যাপারে কিছু বলতে চান।’

মহারাজ লোমপাদ অমাত্যগণের মুখের দিকে তাকালেন, তারপর রক্ষীকে ইঙ্গিত করলেন বৃদ্ধাকে নিয়ে আসবার জন্য। কিছুক্ষণ পর নিন্মাঙ্গে সুতির শুভ্র বাস এবং ঊর্ধ্বাঙ্গে কারুকার্যময় শুভ্র অধিবাস পরিহিত একজন শুভ্রকেশী বৃদ্ধা রাজসভায় প্রবেশ করলেন, মাথায় ঘুঙটের আবরণ নেই, গলায় সুবর্ণ মাল্য। বকের পালকের ন্যায় তার উজ্জ্বল মুখমণ্ডল এবং অনাবৃত হাতের চামড়া ইষৎ কুঞ্চিত হলেও, দেখে বোধ হয় কোনোকালে ইনি পরমা সুন্দরী ছিলেন। যেন রূপপতত্রি উড়ে গেছে কিন্তু ফেলে গেছে তার সুন্দর সুবর্ণ পালক। তাম্বূলরসে রাঙা ঠোঁট; চোখে-মুখে ব্যক্তিত্বের সুস্পষ্ট ছাপ, তবে কুলনারীর মতো আড়ষ্টভাব কিংবা লাজুকতা নেই। ভয় তো নেই-ই। সরাসরি মহারাজ লোমপাদ এবং অমাত্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নমস্কার মহারাজ, নমস্কার অমাত্যগণ।’

তারপর রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নমস্কার বিপ্রগণ।’
পুনর্বার রাজা লোমপাদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনি বললেন, ‘মহারাজ, পাতকীর নাম গিরিকা। অনুমতি দিলে রাজ্যের মঙ্গলহেতু আমি কিছু বলতে চাই।’

লোমপাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গিরিকাকে অবলোকন করছিলেন, বললেন, ‘কী বলতে চান, বলুন ভদ্রা।’
‘মহারাজ, চম্পানগরীর উত্তরদিকের একটি গণিকালয় এই পাতকীর নিবাস। রাজাধিরাজ, আপনার অনুমতি পেলে অঙ্গরাজ্যের মঙ্গলের জন্য আমি মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে আনবার উদ্যোগ করতে পারি।’

গিরিকার বাক্য শেষ হওয়ামাত্র রাজজ্যোতিষী শব্দ করে হেসে উঠে পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘মহারাজ, আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন। কৌতুকবোধ করে আমি হাস্য চেপে রাখতে পারি নি। মহারাজ, সুদূর অতীতে যৌবন খুইয়ে আসা পক্ককেশী, কুঞ্চিত গাত্রচর্মের এবং শুষ্ক ফুলের ন্যায় কালের খরায়…..যাইহোক, এক বিগত যৌবনা গণিকা তেজস্বী যুবক মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে ইন্দ্রিয়াকর্ষণে প্রলোভিত এবং মদনাবিষ্ট করে নিয়ে আসতে চাইছেন অঙ্গরাজ্যের মঙ্গলের জন্য, এর চেয়ে হাস্যাস্পদ এবং কৌতুকের বিষয় ভূ-মণ্ডলে আর কিছু আছে কি-না আমার জানা নেই!’

রাজজ্যোতিষীর কথা বলার ধরনে রাজসভার কেউ কেউ পুলক অনুভব করে মুখ টিপে নিঃশব্দে হাসলেন। গিরিকা রাজজ্যোতিষীর দিকে তাকিয়ে স্মিতহাস্যে বললেন, ‘বিপ্র, সত্যই আমি বিগতযৌবনা, কিন্তু বিগত মস্তিষ্কা নই! অনেক বৎসর পূর্বে বঙ্গদেশ ভ্রমণ করার সময় গঙ্গা নদীর তীরের এক মেলায় আমি ‘পুতুলনৃত্য’ বলে এক ধরনের নৃত্য দেখেছিলাম। পুতুলের হাতে-পায়ে সুতো বাঁধা থাকে, আর পিছন থেকে সেই সুতোর সাহায্যে পুতুলকে চালিত করেন একজন দক্ষ মানুষ। বড়োই মনোহর সেই পুতুলনৃত্য!’

রাজা লোমপাদ গিরিকার নিঃসঙ্কোচ বাকচাতুর্যে বেশ মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘স্বৈরিণী, আপনি বলুন, মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করার ব্যাপারে কী উদ্যোগ গ্রহণ করতে চান।’

‘মহারাজ, গতকাল আমার গৃহে অনুপস্থিতির কারণে আমার কন্যারা মান্যবর অমাত্যের নিকট অপারগতা প্রকাশ করে যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে সে-জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। রাজ্যের মঙ্গলহেতু অনেক বুঝিয়ে আমি আমার অনুপমা সুন্দরী কন্যাদেরকে রাজি করিয়েছি মুনিকুমারকে হরণ করার ব্যাপারে। আপনার অনুমতি পেলে আমি আমার কন্যাদেরকে নিয়ে কাল সূর্যোদয়ে-ই মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে চাই।’

রাজা লোমপাদ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, ‘আপনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন স্বৈরিণী। বলুন আপনার কী চাই? মণিরত্ন, সুবর্ণ অলংকার, বহুমূল্য পরিচ্ছদ, কড়ি, সুসজ্জিত বাসগৃহ; আরো কী চাই আপনার বলুন, আপনার যে কোনো প্রার্থনা পূরণ করতে আমি প্রস্তুত।’
‘মহারাজ, আপনি তো জানেন মণিরত্ন আর সুবর্ণ অলংকারে নারীর লোভ যেমনি চিরকালীন, তেমনি মানুষ মাত্রেই কড়ির প্রতি মোহও চিরন্তন। আর আমার বাসগৃহটি পুরনো এবং জীর্ণ, কন্যাদের নিয়ে থাকতে একটু অসুবিধে হয় বৈকি। গঙ্গার পাড়ে একটি সুসজ্জিত বাসগৃহ পেলে কন্যাদের রেখে নিশ্চিন্তে অন্তিম নিদ্রায় যেতে পারি!’

‘আপনাকে সবই প্রদান করা হবে স্বৈরিণী। মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রমে যেতে আপনার আর কী প্রয়োজন?’

‘মহারাজ, অমাত্য মহাশয় নাকি কন্যাদেরকে জানিয়েছেন যে মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রমে যেতে হবে তরণীযোগে। তাই দাঁড়বাহক সহ পুষ্প-লতায় সজ্জিত আশ্রমের ন্যায় একটি তরণী, পথ খরচ সহ প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য এবং দুজন রান্নার ভৃত্য প্রয়োজন; আর যাত্রার প্রাক্কালে কন্যাদের জন্য মূল্যবান পরিধেয় বস্ত্র, সুবর্ণ অলংকার, সাজ-সজ্জার সামগ্রী।’

রাজা লোমপাদ সঙ্গে সঙ্গে অর্থ বিষয়ক অমাত্যকে নির্দেশ দিলেন গিরিকার চাহিদা অনুযায়ী সকল কিছু প্রদান এবং রথারোহণে তাকে গৃহে পৌঁছে দেবার জন্য। তারপর গিরিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্বৈরিণী, অঙ্গরাজ্যের ভাগ্য এখন আপনার এবং আপনার কন্যাদের হাতে, আপনারা সফল হয়ে ফিরে আসুন। আমি আপনাদের অপেক্ষায় থাকবো, চম্পানগরী আপনাদের অপেক্ষায় থাকবে।’

গিরিকা উৎফুল্ল চিত্তে প্রচুর কড়ি, সুবর্ণ অলংকার, মণিরত্ন, নিজের এবং কন্যাদের জন্য বহু প্রস্থ মূল্যবান পরিচ্ছদ নিয়ে রথারোহণে রাজবাড়ী ত্যাগ করে বাসগৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।


(চলবে......)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:২২

রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম। নাগরীর সাথেই আছি।

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:৫০

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

২| ১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১২:০৯

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:



উপন্যাস তার সঠিক গতি পথেই চলছে ।
ভাষার কারুকার্যময়তা চিত্তাকর্ষক ।
পরের পর্ব দেখতে চললাম ।
শুভেচ্ছা রইল

১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৪৮

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.