নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- সাত)

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:১২

সাত

বাতায়নের ধারে বসে গঙ্গার বুকে জেগে ওঠা ধূসর বালুচরের ওপর দিয়ে দূরের জন্মনের দিকে তাকিয়ে আছে শবরী। ঐসব জন্মনে কারা থাকে? তারা দেখতে কেমন? কেমন তাদের জীবনযাপন? নানান রকম কৌতুহলী প্রশ্নজাগ্রত ভাবনায় ডুবে আছে সে। বুদ্ধি হবার পর সে মাত্র দু-তিনবার চম্পানগরীর বাইরে পা দিয়েছে। ছোট তরণীতে আরোহণ করে সেই যাত্রা ছিল নগরীর অদূরের আত্মীয়বাড়ি। এই প্রথম সে এতো বড়ো তরণীতে আরোহণ করে নগরী ছেড়ে বহুদূরে যাচ্ছে। সে আসতে চায় নি, মাতার জোরাজুরিতেই তাকে আসতে হয়েছে। কাল থেকে মাতার সঙ্গে তার মান-অভিমান পর্ব চললেও ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই নিজেকে প্রবোধ দিয়ে এই যাত্রার জন্য মনকে প্রস্তুত করেছে। ছক বাঁধা জীবনের বাইরে এসে এখন গঙ্গাবক্ষে ভাসতে ভাসতে সবকিছু অবলোকন করতে ভালই লাগছে তার। বিস্ময়ও জাগছে মনে। আবার বুকের ভেতরটায় কাঁটার মতো বিঁধছে এক অজানা ভয়ও। এই ভয়কে জয় করার জন্য এখন সে নিজের সাথে নিজেই লড়াই করছে। ভয়ের কারণ এই যে মাতা বলেছে মুনিকুমারের কাছে প্রথমে তাকেই যেতে হবে, একা।

তার রমনীয় শরীরের গন্ধ-স্পর্শের মাধ্যমে জাগ্রত করতে হবে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গের সমগ্র ঘুমন্ত ইন্দ্রিয়দেশ! যুবক ঋষ্যশৃঙ্গের কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং অন্তর্রিন্দ্রিয়ে ঝড় তুলে লণ্ডভণ্ড করে দিতে হবে তার সংযম! তারপর কামোপহত করে তাকে নিয়ে আসতে হবে তরণীতে, অতঃপর চম্পানগরীতে। যদিও ভীতু স্বভাবের সে কখনোই নয়, আবার একেবারে যে ডাকাবুকো তাও নয়। সে যদি তার সৌন্ধর্য, শারীরক স্পর্শ আর বাকচাতুর্য দিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলোভনের জালে জড়াতে ব্যর্থ হয়, তবে তার পরে দায়িত্ব পাবে উমা অথবা সুলোচনা। কিন্তু মায়ের লোভের জালে আটকে এসেই যখন পড়েছে তখন আর ব্যর্থ হতে চায় না সে। যে করেই হোক ঋষ্যশৃঙ্গকে তার প্রতি আকৃষ্ট করিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে চায়। সে যদি ব্যর্থ হয় তবে তা হবে তার রূপ-যৌবনের জন্য কলঙ্ক!

তাছাড়া ভয়টুকু সরিয়ে রাখলে কাজটি ব্যতিক্রম এবং আত্মশক্তি যাচাই করার একটা সুযোগও বটে। দিনের পর দিন চেনা গণ্ডির মধ্যে থাকতে থাকতে ভীষণ একঘেয়ে আর দম বন্ধ লাগে তার, রাতের পর রাত একইরকম কামুক স্বভাবের পুরুষকে প্রেমহীন কামসেবা দিতে দিতে অরুচি ধরে যায়। শরীর-মন উভয়ই ক্লান্ত হয়, হারিয়ে যায় কামকেলির অপার সৌন্ধর্য এবং আনন্দ। তখন মনে হয়, একরাতের জন্য এমন একজন প্রেমিক পুরুষ যদি পাওয়া যেতো, যে কেবল শরীরের লোভে আসবে না, বুক ভরে প্রেম নিয়ে আসবে, কুন্দপুষ্পের মতো প্রেমের সুবাস ছড়াবে, যার বুকে মাথা রেখে সে সারারাত গল্প করবে, শেষ রাতে দুজনের মিলনের মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হবে গল্প, তারপর প্রেমিক পুরুষের বুকে মাথা রেখে সে সুখনিদ্রা যাবে! আসে না, তেমন প্রেমিক আসে না। আসে কেবল মাতাল, অর্ধমাতাল আর শরীর খাদক একেকটা হৃদয়হীন পুরুষ। শরীর দলাই-মলাই করে, চেটে, কামড়ে, লালায় ভিজিয়ে ঘেন্না ধরিয়ে দেয়।

যদিও মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে সে কেবল স্পর্শ করে প্রলোভিত করতে পারবে, সঙ্গমে লিপ্ত হবার অধিকার তার নেই। সে ছলনার জাল মাত্র, জালে বন্দী করে এনে মুনিকুমারকে ছেড়ে দিতে হবে রাজকুমারীর খাঁচায়। তারপরই তার দায়িত্ব শেষ, আবার ফিরে যেতে হবে আগের জীবনে। মাতাকে সন্তুষ্ট করতে দেহমন্দিরে প্রবেশাধিকার দিতে হবে কামতীর্থযাত্রীবৃন্দের, তাদেরকে অবগাহন করাতে হবে কামসরোবরে!
স্নানের পর শরীরে গঙ্গাবক্ষের অকৃপণ উন্মুক্ত আদুরে বাতাসের স্পর্শ পেয়ে দারুণ অনুভূতি হচ্ছে শবরীর। শরীরের সমস্ত অলংকার স্নানে যাওয়ার আগে খুলে রেখেছে। অনেকদিন পর অলংকারবিহীন কণ্ঠ আর নুপূরবিহীন পা দুটো হালকা লাগছে, সর্বক্ষণ দুল পরিহিত দুর্গম কানদুটো এখন প্রজাপতির পাখার মতো ঠেকছে, স্বস্তিবোধ করছে সে। স্নান সেরে এসে আজ আর মুখে কোনো প্রসাধন ব্যবহার করে নি, এমনকি কেশও আঁচড়ায় নি। ওসব সে রোজই করে, স্নান সেরে এসে কুঙ্কুম-চন্দনের প্রসাধনে সাজে, লাক্ষারসে ঠোঁট রঞ্জন করে, একেকদিন একেক রকম কেশবিন্যাস করে স্নিগ্ধ পুষ্পমাল্য গুঁজে সুগন্ধি লাগায়, শরীর সাজিয়ে কামমন্দির বানিয়ে অপেক্ষা করে মধুপায়ী কামতীর্থযাত্রীর জন্য। কিন্তু আজ সে-সবের বালাই নেই, তাই প্রসাধন মেখে পুতুল সেজে বসে থাকারও কোনো প্রয়োজন নেই। মুনিকুমারের আশ্রমের কাছে তরণী নোঙর না করা পর্যন্ত সে এমনি প্রসাধনবিহীন-নিরলংকার থাকতে চায়। নিজের মতো থেকে খুঁজে পেতে চায় নিজেকে। স্বস্তি হচ্ছে এই ভেবে যে কয়েকটা দিন অন্তত মদ্য আর ঘামের গন্ধযুক্ত পুঙ্গব স্বভাবের পুরুষকে তো বুকে টেনে নিতে হবে না, তাদের দন্তদংশন, নখক্ষত আর মর্দন-পেষণ তো সহ্য করতে হবে না! মুক্তির আনন্দে হঠাৎ যেন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে তার দেহ-মন, মনে হচ্ছে সারাটা জীবন যদি এমনিভাবে জলবিহার করে পার করা যেতো!

গঙ্গাবক্ষ থেকে কোথাও লোকালয় খুব কাছে, আবার কোথাও ধূসর চরের পরে বেশ দূরে। ধু ধু বালিয়াড়ি রোদে জ্বলছে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। রোদে বালিও নিশ্চয় এখন তেতে উঠেছে। তবু ওই তপ্ত বালির ওপর দিয়ে হেঁটেই মানুষ গঙ্গার জলের কাছে আসছে, স্নান করছে, জল সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে। লোকালয়ের পাশ দিয়ে যাবার সময়ও মুগ্ধ হয়ে মানুষের জীবনযাপন অবলোকন করছে শবরী। গঙ্গাপারে কোথাও কোথাও পতিত ভূমিতে কিংবা রাস্তার পাশে ভিন জন্মনের আগন্তুক মানুষেরা শিবির ফেলে তাদের পরিবার-পরিজন এবং গৃহপালিত পশু নিয়ে অস্থায়ী নিবাস গড়েছে; তীব্র খরায় যাদের জন্মনের পাতকুয়ো শুকিয়ে গেছে, পুকুর এবং নদীর তলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও এইসব আগন্তুকদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের গোলমাল হয়। স্থানীয় মানুষ অনেক কারণে এইসব আগন্তুকদের অপছন্দ করে। আগন্তুকদের কেউ কেউ জন্মনে ঢুকে মানুষের বৃক্ষের ফল-মূল চুরি থেকে শুরু করে গৃহে সিঁদ কেটে যা পায় তাই নিয়েই সটকে পড়ে। এমনিতেই বছরের পর বছর অনাবৃষ্টির কারণে বেশিরভাগ ভূমিতে ফসল হয় না, গঙ্গার তীরবর্তী অল্প কিছু ভূমিতে যৎসামান্য যে ফসল ফলে তা দিয়ে গৃহস্থের ছয় মাসের উদর পূর্তিও হয় না। তার ওপর চোরে সেই ফসলে হাত দিলে গৃহস্থের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। এদিকে আগন্তুকরাও নিরুপায়; নিজেদের বাসগৃহ-ভূমি ফেলে তারা এখানে আশ্রয় নিয়েছে। জলের তৃষ্ণা মিটলেও তাদের পেটের ক্ষুধা মিটছে না। চোখের সামনে বাবা-মা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ক্ষুধায় কাতরাতে কাতরাতে মারা যাচ্ছে; রোগাক্রান্ত হয়েও মরছে কেউ কেউ। তীব্র খাবারের সংকট, জঠর জ্বালা তাদেরকে প্রলুব্ধ করছে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়তে। কেউ বেছে নিচ্ছে চৌর্যবৃত্তির পথ, আবার কেউ কেউ দলবদ্ধ হয়ে নানা জায়গায় গিয়ে দস্যুবৃত্তি করছে। পথিকের পথের সম্বল কেড়ে নিচ্ছে, এমনকি পথিককে হত্যাও করছে।

কোথাও কোথাও স্থানীয় মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে তারা একত্র হয়ে আগন্তুকদের ওপর চড়াও হয়, তাড়িয়ে দিতে চায় আগন্তুকদের। আগন্তুকেরাও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া, তারাও ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মতো হামলে পড়ে স্থানীয়দের ওপর। ধুন্ধমার যুদ্ধ লেগে যায় দু-পক্ষে। তখন রাজার সৈন্য এসে লাঠিপেটা করে শান্ত করে উভয় পক্ষকে। কিন্তু তাতে সংকটের সমাধান হয় না। গরিবের সংকট সবসময়ই থাকে, রাজার শাসন-শোষণে জেরবার হয় তাদের জীবন, কিন্তু এখনকার এই মহা সংকটের মূলে অনাবৃষ্টি। এক ভয়ানক নৈরাজ্য চলছে সমগ্র অঙ্গরাজ্যে।

সেই সংকটের সমাধানেই চলেছে শবরী। যদিও এখনো পর্যন্ত সে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে ভুগছে। অন্য সকলের মতো সে প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাস করতে পারছে না যে মহর্ষি বিভাণ্ডকের পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে রাজকুমারীর বিবাহ দিলেই রাজ্যে বৃষ্টি হবে। কিন্তু সে মনে-প্রাণে চায় রাজ্যে বৃষ্টি হোক; শুকনো খটখটে ঊষর ভূমি আবার উর্বর হোক, আবার কৃষকের লাঙল কর্ষণ করুক ঋতুবতী ভূমির জরায়ু, আবার ফসলে ভরে উঠুক মাঠ, সোনালি ফসল বাতাসে দোলাক মাথা সুখের মতো; নদী-নালা আবার জীবন ফিরে পাক আর মৎসে ভরে থাকুক জঠর, নদীর জঠর ছেকে জুড়োক কৈবর্তদের জঠর জ্বালা, ফুটুক হাসি তাদের মুখে; দূর হোক রাজ্যের দুর্ভিক্ষ।

নদীপারের মানুষের জীবনযাত্রা তরণী থেকে আর কতোটুকুই-বা অবলোকন করা যায়, তবু যে-টুকু অবলোকন করেছে তাতেই নিজের জীবনকে এখন তুচ্ছ মনে হচ্ছে শবরীর। মনে হচ্ছে মুনিকুমারকে নিয়ে এলে সত্যিই যদি রাজ্যে বৃষ্টি নামে, তবে মহর্ষি বিভাণ্ডকের শাপে যদি তার প্রাণও যায়, তবু তার কোনো দুঃখ থাকবে না। মনের ভেতরে দ্বিধা থাকলেও তার বিশ্বাসের বুনট বুননে বেড়ে ওঠা মন এখন সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করতে চাইছে মুনিকুমারকে রাজ্যে আনতে পারলে বৃষ্টি নামবে! এইসব ক্ষুধার্ত মানুষ, হাড় জিরজিরে শিশুদের দেখে তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল, মনোবল চাঙ্গা হলো, উবে গেল হৃদয়ের কোনে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকা ভয়। মহর্ষি বিভাণ্ডক তাকে শাপ দিলে দিক, দৈব আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করুক, বৃক্ষ কিংবা প্রস্তরখণ্ডে রূপান্তরিত করে রাখুক সহস্র-অযুত বৎসর! তবু সে ছলনা করে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে রাজ্যে নিয়ে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করবে এইসব ক্ষুধাতুর মানুষদের জন্য। সে মায়ের মুখে শুনেছে, পুরাকালে দধীচি নামে এক মুনি দেবতাদের সুখের জন্য বৃত্রাসুর বধের নিমিত্তে আত্মত্যাগ করেছিলেন। দেবতাদের অনুরোধে তিনি প্রাণ ত্যাগ করার পর বিশ্বকর্মা তার অস্থি দ্বারা ভীমরূপ বজ্র নির্মাণ করেছিলেন, দেবরাজ ইন্দ্র সেই বজ্র নিক্ষেপ করেই মহাসুর বৃত্রকে নিহত করেছিলেন। দধীচি মাহাত্ম্য স্মরণ হওয়ায় আরো উজ্জ্বীবিত হলো সে, রাজ্যের মানুষের সুখের জন্য প্রয়োজনে সে-ও আত্মোৎসর্গ করবে। পাতকিনীর জীবন তার কামুক পুরুষকে কামসেবা করতে করতেই একদিন শেষ হবে, তার চেয়ে যদি রাজ্যের সকল মানুষ, পশুপাখি আর বৃক্ষ-লতার মঙ্গলের জন্য শেষ হয়, সেটাই তো উত্তম।

শবরী এখন ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীপারের দিকে, কিন্তু তার অন্তর্দৃষ্টি ঋষ্যশৃঙ্গের ওপর। ঋষ্যশৃঙ্গকে দেখা তো দূরের কথা দু-দিন আগে সে এই মুনিকুমারের নামও জানতো না। কিন্তু এখন সে তার কল্পনায় ঋষ্যশৃঙ্গকে দেখতে পাচ্ছে, আর তাকে কেন্দ্র করেই তার কল্পনার ডানা আরো বিস্তৃত হচ্ছে। সে ভাবতে লাগলো কিভাবে ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে যাবে, কী বলে তাকে বশীভূত করবে। ঋষ্যশৃঙ্গের জন্ম কথা শুনে ভারী আশ্চর্য হয়েছে সে, হ্রদের জলে ভাসতে থাকা মহর্ষি বিভাণ্ডকের লিঙ্গচ্যূত শুক্র পান করে এক কৃষ্ণসার মৃগ গর্ভধারণ করে, তারপর জন্ম দেয় এক মানবশিশু, যার মাথায় আবার একটা শৃঙ্গ! এই কখনো হয় না কি! গণিকালয়ের স্নানঘরে তারা যখন পরিচ্ছন্ন হয় কিংবা স্নান করে, তখন তাদের যৌনাঙ্গে লেগে থাকা পুরুষের শুক্র জলে ধুয়ে যায়, নিশ্চয় জলের সঙ্গে পশু-পাখিরা তা পান করে, কিন্তু কখনো তো শোনে নি যে কোনো পশু বা পাখি মানবশিশুর জন্ম দিয়েছে! নাকি মুনি-ঋষিরা সিদ্ধপুরুষ বলেই অমন হয়, মুনি ঋষিদের সম্পর্কে কতো অলৌকিক কথাই তো শোনা যায়, হলেও হতে পারে। এই ভাবনায় স্থিত হয় শবরী আর তার হৃদয়াকাশে আরো পরিচ্ছন্ন হয় ঋষ্যশৃঙ্গের মুখশ্রী। আচ্ছা, ঋষ্যশৃঙ্গ যদি কামতাড়িত হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হতে চায় তখন সে তাকে নিবৃত্ত করবে কী উপায়ে? নিবৃত্ত করতে গেলে মদনাবিষ্ট মুনিকুমার ক্ষুব্ধ হয়ে যদি তার শিঙ্গ দিয়ে তাকে ঢুঁস দেয়? যেহেতু সে মৃগযোনিজ, তাই মৃগের কিছু স্বভাব তার আচরণে থাকাটাই স্বাভাবিক! মানুষের মাথায় শৃঙ্গ! দেখতে কী অদ্ভত-ই না লাগে তাকে! মদনাবিষ্ট মুনিকুমার ক্ষুব্ধ হয়ে শৃঙ্গ দ্বারা তাকে ঢুঁস মারতে উদ্যত, এই দৃশ্য কল্পনা করে সে আপন মনেই হেসে উঠলো!

দ্বিপ্রহরের আহারের জন্য তরণী নোঙর করা হয়েছে গঙ্গাপারে, দাঁড়িরা এখন নিচতলায় নিজেদের কক্ষে অবস্থান করছে, আহার শেষে তারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে, তারপর আবার শুরু হবে যাত্রা।

রাঁধুনীরা দ্বিপ্রহরের আহার গিরিকার কক্ষে দিয়ে গেছে, আহার করতে বসে গিরিকা লক্ষ্য করলেন শবরীর শরীরে কোনো অলংকার নেই, মুখে কুঙ্কুম-চন্দনের প্রলেপ নেই, মাথার কেশে কাঁকুই পড়ে নি, স্নান করে এসে একটা ভাল পোশাকও পরে নি; আর কেমন যেন বিমনা ভাব। বিমনা ভাব নিয়ে তিনি চিন্তিত নন, কেননা কন্যা তার প্রায়ই এমন বিমনা থাকে। কিন্তু সাজসজ্জা নেই কেন? নাকি তার ওপর রাগ করে তাকে কষ্ট দিতেই অমন যোগিনী বেশ নিয়েছে! ব্যাপারটা তাকে ভাবালো। কন্যাদের কখনো এমন আটপৌরে বেশে থাকতে দেখলে তিনি বিরক্ত হন, চিৎকার করে বকাঝকা করেন। কতোবার বলেছেন, নাগর না থাকলেও গণিকাদের সবসময় সেজেগুজে থাকতে হয়, নইলে আলস্য ভর করতে পারে শরীরে, অন্তরে বৈরাগ্যভাব জন্ম নিতে পারে। তিনি নিজে এই ষাট বছর বয়সেও সেজেগুঁজে থাকেন, যাতে কন্যারা তাকে দেখে শেখে। তার মাথার কেশ শুভ্র হতে পারে কিন্তু অগোছালো থাকে না কখনো, শরীরের চর্ম কিছুটা কুঞ্চিত হতে পারে কিন্তু বসন কুঞ্চিত হয় না! অথচ তার নিজের কন্যা সাজগোজের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন, কন্যার সাজগোজের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয় তাকেই।

আহারের সময় সাজসজ্জার উদাসীনতার ব্যাপারে শবরীকে কিছুই বললেন না গিরিকা। আহারের পর একটা তাম্বূল মুখে পুড়ে শয্যায় বেশ কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিলেন, কন্যাদেরও বিশ্রামের সুযোগ দিলেন। ঘুমিয়েই পড়েছিলেন গিরিকা, ঘুম ভাঙলো উমার হাসির শব্দে। বাতায়ন দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন সূর্যদেবের তেজ কিছুটা কমলেও বেলা এখনো অনেক বাকি। সুলোচনা তার পাশে এখনো ঘুমোচ্ছে, তিনি উঠে কক্ষ থেকে বেরিয়ে শবরী আর উমার কক্ষে প্রবেশ করে ওদেরকে দেখতে পেলেন না। কক্ষ থেকে বেরিয়ে ডাকলেন, ‘শবরী….উমা….।’
উমা সাড়া দিলো তরণীর ছাদ থেকে, ‘আমরা এখানে মাসিমা।’

গিরিকা তরণীর পিছন দিকে গিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওরা দুজন ছাদের কেদারায় বসে আছে, দাঁড়িরা দাঁড় বাইতে বাইতে দেখছে ওদেরকে, কিন্তু সে-দিকে ওদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। উমা রোজকার মতোই সেজেছে কিন্তু শবরীর দিকে তাকিয়ে রাগ হলো গিরিকার। সেই একই বেশ! এমন ভিক্ষুকের বেশে কোনো গণিকা পুরুষের সামনে বের হয়? হলোই বা ওরা দাঁড়ি, পুরুষ তো!
তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘নিচে নেমে আয়, দরকারী কথা আছে।’

তারপর গিরিকা স্নানাগারে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিজের কক্ষে এসে হাত-মুখের জল মুছলেন। ঘুমন্ত সুলোচনাকে ডাকলেন, ‘এখন ওঠ লো। কর্মহীন হয়ে এমন করে ঘুমোলে হাতে-পায়ে জল জমে যাবে।’
কপাটের বাইরে থেকে রঘুর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘ভগিনী,….।’
কপাটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন গিরিকা, ‘কিছু বলবে রঘু?’

আগে থেকেই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা রঘু বললো, ‘সামনে গঙ্গার পারে একটা হাট আছে। যদিও বেলা এখনো অনেক বাকি, তবু হাটের ঘাটেই তরণী নোঙর করা অধিক নিরাপদ হবে। রাতটুকু এখানে বিশ্রাম করে আবার কাল সকালে যাত্রা করা যাবে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী যদি কিছু ক্রয় করার থাকে, এখান থেকেই ক্রয় করতে হবে, এর পরে আর এতো বড়ো কোনো হাট নেই। কৌশিকী নদীর পারে একটা হাট আছে বটে, তবে তা বসবে পরশু মধ্যা‎হ্নে। আপনি অনুমতি দিলে তরণী সামনের হাটের ঘাটেই নোঙর করতে চাই।’

‘বেশ তো, হাটের ঘাটেই নোঙর করো। আর কিছু দ্রব্যসামগ্রীও ক্রয় করতে হবে বৈকি। আমায় একবার হাটে নিয়ে যেও।’
‘আজ্ঞে ভগিনী, আপনি হাটে যাবেন!’
‘কেন, কোনো অসুবিধে হবে?’
‘না, না, কোনো অসুবিধে হবে না। আমরা থাকতে আপনি আবার কষ্ট করে যাবেন…।’
‘আমার কোনো কষ্ট হবে না ভ্রাতা রঘু। বালিকা বয়সে কতো হাটে গিয়েছি পিতার সঙ্গে! আজও চম্পানগরীতে আমি নিজেই হাটে যাই দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে। ‍তুমি তরণী নোঙর করে আমায় ব’লো, দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করাও হবে, আবার হাট ঘুরে দেখাও হবে।’
‘আজ্ঞে ভগিনী, আমি তাহলে যাই।’
‘বেশ যাও।’

সুলোচনা উঠে স্নানাগারের উদ্দেশ্যে গিয়েছে। শবরী আর উমা ছাদ থেকে নেমে গিরিকাকে রঘুর সঙ্গে কথা বলতে দেখে নিজেদের কক্ষে ঢুকেছে। রঘু চলে যাবার পর গিরিকা বেশ যত্ন করে নিজের মাথার দীর্ঘ শুভ্র কেশ আঁচড়ে খোঁপা বাঁধলেন। মুখমণ্ডলে চন্দনের প্রলেপ দিলেন। তারপর একটা তাম্বূল মুখে পুরে কাঁকুই হাতে নিয়ে শবরী আর উমার কক্ষের সামনে গিয়ে শবরীকে ডাকলেন, ‘শবরী, একটু আমার কক্ষে আয়।’

উমা বাতায়ন দিয়ে শবরীকে গঙ্গার বুকে কিছু দেখাচ্ছিল, দুজনই তাকালো গিরিকার দিকে। গিরিকা নিজের কক্ষে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরই শবরী মৃদু পায়ে প্রবেশ করলো। গিরিকা স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘চুলগুলো কেমন সন্ন্যাসীনির মতো হয়ে আছে, আয় আঁচড়ে দিই।’

শবরী শান্ত স্বরে বললো, ‘আমি পরে আঁচড়ে নেব।’
‘আয় একটু তেল দিয়ে আঁচড়ে দিই।’
‘বললাম তো আমি পরে আঁচড়ে নেব।’
‘পরে আঁচড়ে নেব বললে কী হয়! চুল আঁচড়াস নি, মুখে প্রসাধন মাখিস নি, সব অলংকার খুলে রেখে ছাদে গিয়ে বসে আছিস দাঁড়িদের সামনে।’
‘আমরা দাঁড়িদের প্রলোভিত করতে আসি নি মাতা।’
‘তা বলে দাঁড়িদের সামনে এমন হতশ্রী হয়ে থাকবি? হাজার হোক ওরা পুরুষ তো, পুরুষের সামনে গণিকাদের একটু সাজসজ্জা করে থাকতে হয়।’
‘সব সময় তো তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী চলি, দয়া করে এই যাত্রাপথটুকু আমাকে নিজের মতো করে থাকতে দাও। সব সময় তোমার ইচ্ছের দাসী হয়ে থাকতে ভাল লাগে না।’
‘আমার ওপর রাগ করিসনে মাগো। আমি যা করি তা তোর মঙ্গলের জন্যই।’
‘আমার মঙ্গলের জন্য তোমার এতো উদগ্র লালসা আর বন্ধন আমার সহ্য হয় না মাতা!’
চলে গেল শবরী। বিমর্ষ গিরিকা কাঁকুই হাতে নিয়ে শয্যায় বসে রইলেন।

বেলা অনেকটা থাকতেই হাটের ঘাটের এক কোনার দিকে তরণী নোঙর করলো রঘু। কাছে-দূরের বিভিন্ন জন্মন্ থেকে হাট করতে আসা হাটুরেদের ছোট-মাঝারি তরণী সারি করে ঘাটে বাঁধা। হাট শেষে কিছু তরণী ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে, আবার কিছু নোঙর করছে ঘাটে। অনেকে দল বেঁধে তরণী নিয়ে এসেছে হাট করতে। কোনো কোনো দলের প্রায় সবাই হাট করে তরণীতে ফিরে এসে অপেক্ষা করছে কোনো একজন মন্থর স্বভাবের হাটুরের জন্য। মন্থর স্বভাবের হাটুরের প্রতি কেউ বিরক্ত, আবার কেউবা তাকে নিয়ে করছে রসিকতা।

শবরী, উমা আর সুলোচনা; তিনজনই শবরীদের কক্ষের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাটের দিকে তাকিয়ে আছে। শবরী আটপৌরে বেশে থাকলেও উমা আর সুলোচনা দারুণ সেজেছে; রাজবাড়ি থেকে দেওয়া কারাকার্যময় নতুন বাস-অধিবাস আর সুবর্ণ অলংকার পরিধান করেছে! ওরা যেমনি বিস্ময়ে দেখছে হাট, গঙ্গার পারের দিকের ছোট ছোট খুপড়ি বিপণী, হাটের মানুষ; তেমনি হাট করতে আসা তরণীর মানুষও বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে ওদেরকে।

রঘু স্নান সেরে হাতের আঙুলের সাহায্যে মাথার কেশ পরিপাটী করে একটা কাপড়ের ঝোলা নিয়ে এসে গিরিকার কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ভগিনী, হাটে যাবেন বলেছিলেন, আমি প্রস্তুত।’

গিরিকা রঘুর আহ্বানের অপেক্ষায়ই ছিলেন। তার মুখে তাম্বূল, তাম্বূলপাত্রের মুখে ঢাকনা দিয়ে হাঁ করে চুনমাখা বোটার ডগাটা দাঁতে কেটে জিভ দিয়ে তাম্বূলের সাথে টেনে নিয়ে রঘুর উদ্দেশে মুখ খুললেন, ‘আসছি ভ্রাতা।’

কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে কন্যাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি হাটে যাচ্ছি, অজানা-অচেনা জায়গা, কক্ষের ভেতরে যা তোরা, বাইরে থাকিসনে।’

সুলোচনা গিরিকার হাটে যাবার কথা শুনে ধেই করে নেচে উঠলো, ‘আমি তোমার সঙ্গে যাব মাসি।’
গিরিকা রঘুর মুখে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বললেন, ‘কোনো অসুবিধে হবে না তো ভ্রাতা?’
রঘু ঘাড় নেড়ে জানালো, ‘কোনো অসুবিধে নেই ভগিনী, মাতা যখন যেতে চাইছেন নিয়ে চলুন।’

রঘু দুজন দাঁড়িকে তরণীতে রেখে অন্য দুজনকে তাদের সঙ্গে নিলো, তরণী থেকে নেমে অল্প একটু চর আর গঙ্গাপারের ঢাল বেয়ে উপরে উঠে একসময় চোখের আড়ালে চলে গেল তারা। শবরী আর উমা নিজেদের কক্ষে প্রবেশ করে শয্যায় গা এলিয়ে গল্প করতে লাগলো।
বেলা যতো পড়ে আসছে, ঘাট ততো ফাঁকা হতে শুরু করেছে, দিনের আলো থাকতেই গৃহে ফেরার আশায় হাটুরেদের তরণী ঘাট ত্যাগ করছে। শবরী আর উমার কাছে এই জলযাত্রা বিস্ময়কর লাগছে। ওরা দুজন বাতায়নে চোখ রেখে ঘাট ছেড়ে যাওয়া হাটুরেদের দেখছে, তাদের কথা শুনছে, আর এই জলযাত্রা নিয়ে নিজেরাও গল্প করছে। ঘাট ছেড়ে যেতে যেতে হাটুরেরাও বারবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে ওদেরকে, কী ভাবছে তারা কে জানে!

উমা হঠাৎ বললো, ‘সখি, আমি এতোদিন আফসোস করতাম রাজকুমারী হয়ে না জন্মানোর জন্য। আমাদের রাজকুমারী শান্তাকে আমি দেখি নি কখনো, কিন্তু মনে মনে আমি তাকে ঈর্ষা করতাম। ভাবতাম তার কী সৌভাগ্য, সর্বদা বহুমূল্য পরিচ্ছদ আর অলংকারে ভূষিত থাকে, তার সেবা করার জন্য সদা প্রস্তত থাকে ভৃত্যরা, কী আরাম-আয়েসের জীবন তার, একদিন কতো কতো দেশের রাজা এবং রাজপুত্ররা তার স্বয়ম্বর সভায় আসবে, রাজকুমারী নিজের পতি নিজে পছন্দ করে নেবে, তার গর্ভের পুত্রও একদিন রাজা হবে! আহা, কী জীবন! এমন জীবন আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো! কিন্তু আজ আর রাজকুমারী শান্তার প্রতি আমার ঈর্ষা হচ্ছে না, বরং দুঃখ হচ্ছে রাজকুমারীর জন্য। রাজকুমারী হয়ে সুখভোগের পর তার কপালে লেখা আছে এমন দুর্ভোগ!’

‘দুর্ভোগ কেন বলছিস সখি?’ উমার কথা শুনতে শুনতে গঙ্গার বুকে তাকিয়েছিল শবরী, প্রশ্ন ছুড়ে এবার ওর মুখের দিকে তাকালো।
‘দুর্ভোগ ছাড়া একে আর কী বলবো! কোথায় বীরপুরুষ রাজকুমার আর কোথায় বনমানুষ! কে জানে ভবিষ্যতে রাজকুমারীকে চীর-বল্কল ধারণ করে পতির সঙ্গে বনে যেতে হয় কি-না! আমি রাজকুমারী হলে বিষফল খেয়ে প্রাণ ত্যাগ করতাম তবু একটা বনমানুষকে বিবাহ করতাম না।’

উমার কথা বলার ধরনে শবরীর হাসি পেলেও সামলে নিয়ে বললো, ‘এভাবে বলছিস কেন তুই? রাজপুত্রের হয়তো বিত্তের গরিমা আছে কিন্তু মুনিকুমারের আছে জ্ঞান আর বিদ্যার গরিমা। রাজপুত্র হয় রাজ্যলোলুপ, ভোগী, কখনো কখনো নির্দয়। আর মুনিকুমার লোভী হয় না; হয় ত্যাগী, বিনয়ী, জীবের প্রতি তাদের দয়া থাকে, কখনো প্রাণ হরণ করে না।’

‘কিন্তু রাজকুমারী তো আর বনে বড়ো হয় নি, সে রাজপুরীতে বিত্ত-বৈভবের মধ্যেই বড়ো হয়েছে; একজন বনবাসী মুনিকুমারের সঙ্গে সে সহজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না।’

‘এটা তুই ঠিক বলেছিস, রাজকুমারীর পক্ষে মুনিকুমারকে মেনে নেওয়া কঠিন হবে অথবা বাধ্য হয়ে মুনিকুমারের গলায় পুষ্পমাল্য পরালেও মন থেকে সে কখনোই মুনিকুমারকে মেনে নেবে না। কিন্তু তাই বলে মুনিকুমারকে তুই ক্ষুদ্র ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারিস না, বরং সৎ গুণের বিচারে রাজপুত্রের চেয়ে মুনিকুমারই শ্রেষ্ঠ।’

‘সে তো আমি কথার কথা বলেছি। তবে যতো ভাল-ই হোক আমি কখনোই একজন মুনিকুমারকে বিবাহ করতে পারবো না। ময়লা উঁকুন ভর্তি বড়ো বড়ো জটা, দাড়ি-গোঁফ; ঠিক মতোন স্নান করে কি-না কে জানে; এমন মানুষের সঙ্গে রতিক্রীড়া করতেও তো গা ঘিন ঘিন করে! যদি চুম্বন সুধার সঙ্গে উঁকুন খেয়ে ফেলি! আর এক-দুদিন হলে এক কথা, দিনের পর দিন এমন মানুষের সঙ্গে থাকা যায়! তার ওপর এই মুনিকুমারের মাথায় নাকি আবার একটা শৃঙ্গ আছে! একটা শৃঙ্গধারী পুরুষের সাথে রতিক্রীড়া করতে কেমন লাগে না বল? দেখা গেল কামোত্তেজিত হয়ে শৃঙ্গের গুঁতোয় দুটো দাঁতই ভেঙে দিলো কিংবা নাকটা থেঁতলে দিলো!’

উমার কথা শুনে সশব্দে হাসতে হাসতে শয্যায় শুয়ে পড়লো শবরী। উমাও হাসতে হাসতে আবার বললো, ‘আরো কথা আছে শোন, আমাদের রাজকুমারীর সঙ্গে বিবাহের পর দেখা গেল তার একটা পুত্র হলো আর তার মাথায়ও মস্ত একটা শৃঙ্গ, তখন কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হবে বলতো! বুকের দুগ্ধ পান করতে করতে ফুরিয়ে গেলে শৃঙ্গ দিয়ে গুঁতো মারবে! দুগ্ধপানের সময় পুত্র গুঁতোবে আর রতিক্রীড়ার সময় পুত্রের পিতা গুঁতোবে! মাতা গো রক্ষা করো, এমন রাজকুমারীও হতে চাই না, স্বামী-পুত্রের গুঁতো খেয়ে মরতেও চাই না!’

শবরী এবার উপুড় হয়ে উপাধানে মুখ গুঁজে হাসছে, হাসির দমকে কাঁপছে তার শরীর। কোনোক্রমে সে উমাকে বললো, ‘মাতা গো, আর পারি না! তুই থামবি সখি।’

হাসির রেশ কাটলে শবরী উঠে বসতে বসতে বললো, ‘দাঁড়া, আমি যদি মুনিকুমারকে আনতে পারি, তবে তোর দিকে লেলিয়ে দেব; যাতে তোর গর্ভে এমন একটা পুত্র দিতে পারে যার দেহটা মানুষের মতো আর মাথাটা মৃগ’র মতো!’

‘মরণ! আমি ওসবের মধ্যে নেই বাপু। শেষে প্রসবব্যথা ওঠার পর ধাইয়ের আসতে দেরি হলে যদি রেগে গিয়ে শৃঙ্গের গুঁতোয় আমার পেট চিড়ে বেরিয়ে আসে!’

এবার দুজনই হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে শবরীর দৃষ্টি বাতায়নের বাইরে যেতেই দেখলো তাদের তরণীর একজন যুবক দাঁড়ি স্নান করতে নেমে প্রায় কোমর জলে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এখনো ডুব দেয় নি। কৃষ্ণবর্ণ মসৃণ লম্বাটে মুখ যেন ছেনি দিয়ে খোদাই করা! মুখের দাড়ি-গোঁফ কামানো। মাথায় উষ্ণীবের মতো করে বাঁধা একখণ্ড বস্ত্র। কৃষ্ণবর্ণ সুঠাম শরীর, বেশিবহুল বাহু, বুকভরা কালো কুচকুচে লোম। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ বছর হবে। শবরীর সাথে চোখাচোখি হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রায় বুক জলে নামলো সে। শবরী আঙুলের ইশারায় দাঁড়িকে দেখিয়ে উমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘তাকিয়ে আমাদের দেখছিল, সব কথা শুনে ফেলেছে কিনা কে জানে!’

উমাও তাকালো দাঁড়ির দিকে। দাঁড়ি মাথার বস্ত্রখণ্ড খুলে জলে ভিজিয়ে শরীর মার্জন করছে। শেষ বিকেলের সূর্যের সোনালি প্রভা ছড়িয়ে থাকা তার কৃষ্ণবর্ণ সুঠাম পিঠের মাংসপেশিতে ঢেউ উঠেছে। আর গঙ্গার ঢেউ ভাঙছে তার শরীরে।

শবরী পুনরায় নিচুস্বরে বললো, ‘মাতা গো একেবারে খোদাই করা কালো পাথরের শিব মূর্তি!’
‘দাঁড়া একটু মজা করি।’ শবরী কিছু বলার আগেই ডানহাতে বাতায়নের কাঠের ছড় ধরে উমা বললো, ‘ও দাঁড়ি, জল কী শীতল না উষ্ণ?’

ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছুটা বিব্রত কিছুটা ভীত চোখে-মুখে তাকালো দাঁড়ি, কথা বললো না। উমা আবার বললো, ‘শুনতে পাও নি? বলছি জল কী শীতল না উষ্ণ?’
‘শীতল।’ বলেই চোখ নামিয়ে নিলো দাঁড়ি।
‘দেখো, আবার ঠাণ্ডা যেন না লাগে! তা… কড়ি আছে কাছে? কড়ি পাওনা হয়ে গেল যে!’
আবারো বিব্রত চোখে তাকালো দাঁড়ি, সারামুখে ভয়ের ছায়া।
‘কানে কালা না কি? বলছি কড়ি আছে?’
দাঁড়ি হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়লো।

‘এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখছিলে, কথা শুনছিলে, তাতে অপরাধ হয়েছে তোমার, এই অপরাধের শাস্তিস্বরূপ কড়ি চাই!’
দাঁড়ির কালো মুখও যেন লজ্জায় সাময়িক বিভ্রান্ত হয়ে অন্য রঙ ধারণ করতে চাইলো! চুরি করে ধরা পড়া অপরাধীর মতো তাকিয়ে রইলো ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে আসা হলুদ রঙের একটা ম্লান গাঁদা পুষ্পের দিকে, যেনবা পুষ্পের পাপড়ির ভাঁজে সে লুকিয়ে পড়তে চায়!

উমা দাঁড়িকে আরো নাকাল করে ছাড়তো। উমার মুখের লাগামহীন কথায় আরো নাকাল হওয়ার আগেই শবরী যেন তাকে রক্ষা করতে বললো, ‘দাঁড়ির নাম কি?’
‘আজ্ঞে, শ্যাম।’
‘তুমি অমন ভয়ে সিঁটিয়ে আছো কেন? আমরা তো পাথুরে মুখের রাজার সৈন্য নই, পুষ্পের মতোন কোমল নারী!’

শ্যাম তবু নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে রইলো। উমা আবার চুকো স্বাদ ছড়ালো, ‘পত্নী-পুত্র আছে, নাকি নানা দেশে ঘুরে ফুলে ফুলে মধু খাওয়া স্বভাব?’

এবার শ্যামের চোখ দুটিতে যেন ফুটে উঠলো বিষাদপুষ্প। যদিও সেই বিষাদপুষ্প দেখতে এবং তার গন্ধ অনুভব করতে পারলো না শবরী এবং উমা। শবরী বললো, ‘আমরা দেখতে কি তোমার পত্নীর চেয়েও খুব বেশি কুতসিৎ? একটু তাকাও আমাদের দিকে।’

‘আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে ক্ষমা করে দিন, আর কখনো এমন ভুল হবে না।’ আস্তে আস্তে বললো শ্যাম।
উমা বললো, ‘আমার সখি বড়ো উদার, সে তোমায় ক্ষমা করলেও আমি করছিনে; কড়ি তোমায় দিতেই হবে।’
‘আজ্ঞে কতো কড়ি দিতে হবে?’
‘এক শত কড়ি তো তোমাকে দিতেই হবে।’
‘অতো কড়ি তো আমি জীবনে চোখেই দেখি নি!’
‘তাহলে কড়ির বদলে একশো ডুব দিতে হবে।’
‘একশো!’
‘হুম একশো, নইলে রাজবাড়ীতে ফিরে গিয়ে তোমার নামে অভিযোগ করবো!’

অসহায় শ্যাম বাধ্য হয়ে একের পর এক ডুব দিতে শুরু করলো। দশ-বারোটা ডুব দেবার পর ঘাটের দিকের গলুই থেকে আরেক দাঁড়ি সুকেতু চিৎকার করে উঠলো, ‘ও শ্যামদা, তোমার হলোটা কী, ওভাবে ডুব দিচ্ছো কেন?’

সুকেতুর ডাক কানে যেতেই থামলো শ্যাম। জোরে নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে একবার শবরীদের দিকে আরেকবার সুকেতুর দিকে তাকাতে লাগলো। সুকেতু আবার বললো, ‘কী হলো তোমার? অমন পাগলের মতো ডুব দিচ্ছো!’

‘কে কথা বলে?’ শবরী জানতে চাইলো।
শ্যাম এবার সুকেতুর দিক থেকে ফেরানো দৃষ্টি রাখলো শবরীর মুখে, ‘ওর নাম সুকেতু, আমাদের সঙ্গে কাজ করে।’
লজ্জায় যেন জলে মিশে যেতে চাইছে শ্যাম! তাকে রেহাই দিতে শবরী বললো, ‘আচ্ছা, তোমাকে আর ডুব দিতে হবে না, এখন স্নান করে যাও, নইলে লজ্জায় একেবারে গঙ্গাজলে বিলীন হয়ে যাবে দেখছি!’

এই রায়ে আপত্তি জানালো উমা, ‘না না না, এতো অল্প ডুবে হবে না; কিছু কড়ি তোমাকে দিতেই হবে।’
‘কীসের কড়ি গো শ্যামদা?’ দেখতে না পেলেও শবরীদের কথা শুনতে পাচ্ছে সুকেতু।
শ্যাম চুপ করে রইলো।

উমা সুকেতুকে দেখতে না পেলেও তাকে শোনাতে বেশ জোরে বললো, ‘তোমার দাদা লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখছিলো যে!’
ওদিক থেকে উত্তর এলো, ‘আপনাদের দেখলে বুঝি কড়ি দিতে হয়?’
‘দিতে হয় বৈকি।’
‘তবে তো আমার কাছেও আপনাদের ঢের কড়ি পাওনা হয়েছে, আমিও যে দাঁড় টানতে টানতে আপনাদের দেখেছি!’
‘সখি, এ যে দেখছি খুব সেয়ানা, আবার কথাও জানে।’ শবরী মৃদু হেসে বললো।
উমা বললো, ‘হুম, সাহসও আছে!’
‘আপনারা আমার দাদাকে ভালো মানুষ পেয়ে নাকাল করবেন, আর আমি চুপ করে বসে থাকবো!’
শবরী বললো, ‘তোমার দাদা খুব ভালো মানুষ বুঝি!’
সুকেতু বললো, ‘হ্যাঁ, শ্যামদার তুল্য মানুষ হয় না।’

শবরী হেসে বললো, ‘বেশ তাহলে তোমার দাদার শাস্তি লঘু করে দিচ্ছি।’ তারপর শ্যামের উদ্দেশে বললো, ‘শোনো দাঁড়ি, তোমাকে কড়ি দিতে হবে না, হাটে মণ্ডা পাওয়া যায় নিশ্চয়, আমাদের মণ্ডা খাওয়ালে তোমাকে ক্ষমা করে দেব।’

শ্যামের শুরুর বিব্রতভাব এবং ভয় এখন কেটে গেছে, সে শবরীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে আবার ডুব দিলো গঙ্গাবক্ষে।


(চলবে......)

সহায়ক গ্রন্থ

সহায়ক গ্রন্থ

১. বেদ -অনুবাদ: রমেশ চন্দ্র দত্ত
২. মনুসংহিতা -অনুবাদ: সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. রামায়ণ -মূল: বাল্মীকি; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৪. মহাভারত -মূল: কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাস; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৫. কামসূত্র -বাৎসায়ন
৬. কথা অমৃতসমান (দ্বিতীয় খণ্ড) -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৭. দণ্ডনীতি -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৮. জীবনীকোষ ভারতীয়-পৌরাণিক - শ্রীশশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার
৯. দেবলোকের যৌনজীবন -ডঃ অতুল সুর
১০. ভারতে বিবাহের ইতিহাস -ড: অতুল সুর
১১. প্রাচীন ভারতে শূদ্র -রামশরণ শর্মা
১২. প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস -ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ
১৩. ইতিহাসের আলোকে বৈদিক -সাহিত্য সুকুমারী ভট্টাচার্য





মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৪৩

রাজীব নুর বলেছেন: আমার ল্যাপটপে সমস্যা করছে। পোষ্ট পড়ে আরাম পাচ্ছি না। ফন্ট ছোট বড় দেখাচ্ছে।

সহায়ক গ্রন্থ দিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ। আন্তরিক ধন্যবাদ।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫৩

মিশু মিলন বলেছেন: সমস্যা সমাধান হবে আশা করি। ধন্যবাদ।

২| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ২:১৪

আনমোনা বলেছেন: শবরী তাহলে মনের দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে চললো মুনিপুত্রকে হরন করতে। পথের বর্ণনা আর হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়ে ওদের জীবনের সুখদুখের কথা উঠে আসছে। এর আগে রামায়নে এই গল্প পড়েছিলাম। আর কার লেখা ভুলে গেছি, একটা বই পড়েছিলাম, রাজকুমারী শান্তার মনভাব নিয়ে। আপনার লেখায় নতুন ভাবে পড়ছি একই পুরানো গল্প, নতুন আঙ্গিকে।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫৪

মিশু মিলন বলেছেন: জেনে ভাল লাগলো। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

৩| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:৪৭

শুভ_ঢাকা বলেছেন: ভাগ ভাগ করে পড়লাম। গতকাল অর্ধেকটা আর আজ বাকীটা। ভাষা, বাক্য শৈলী, বর্ণনা আর সেই সময়ের চালচিত্র সব মিলিয়ে দারুণ। এই আখ্যান কত পর্বের।

০১ লা অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:৪৮

মিশু মিলন বলেছেন: বিশ পর্বের। অনেক ধন্যবাদ।

৪| ১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১০

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:



মুগ্ধ হয়ে পাঠ করলাম ।
বাংলাদেশে মুক্তাগাছার মন্ডা খুবই বিথ্যাত ।
এই মুক্তাগাছা মন্ডা তৈরীর সাথে ঐশ্বরিক সম্পর্ক
রয়েছে বলে দাবী করা হয়ে থাকে ।

এই পর্বে এসে কিছু সহায়ক গ্রন্থের তালিকা পাওয়া গেল ।
নাগরি উপন্যাসটি কোন গ্রন্থটির সাথে বেশী জড়িত তা
জানতে পারলে ভাল হতো । তালিকায় থাকা সহায়ক
প্রন্থগুলির কয়েকটি কিছুটা পাঠ করেছি।

দেব নাগরী তথা নাগরি ভাষায় লেখা সাহিত্যের প্রতি আমার বেশ আগ্রহ আছে ।
সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রণীত ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য
পাঠে অনেক বিষয়ই জানা যায় । বৈদিক সাহিত্যের পরিধির মধ্যে প্রায় দেড়
হাজার বছরে বেদ কেন্দ্রিক যে-সাহিত্য রচিত হয়েছিল তার ইতিহাস রয়েছে ।
এ-সাহিত্যের প্রথম পর্যায়ে, বহুদেবতার উদেশে রচিত স্তব, প্রার্থনা যেমন আছে,
তেমনি আছে সমাজ জীবনের নানা গৌণ চিত্র ও কিছু অধ্যাত্মবিষয়ক রচনাও।
পরবর্তী ব্রাম্মন সাহিত্যে যজ্ঞের প্রণালী, উপযোগিতা, পুরোহিতের ভূমিকা ও
দক্ষিণা সম্বন্ধে নির্দেশ এবং তৎসংশ্লিষ্ট কিছু আখ্যায়িকাও আছে। সেখানে
রূপকায়িত আকারে দেখা দেয় আরণ্যকসাহিত্য, যার পূর্ণ পরিণতি উপনিষদে।
এই গ্রন্থে বেদকে তার আর্থসামাজিক পরিবেশের মধ্যে রেখে বিচার করার চেষ্টা রয়েছে।
বৈদিক সাহিত্য যে শুধু ধর্মগ্রন্থই নয়, সাহিত্যও বটে, এই কথাটি স্মরণে রেখে যথাসম্ভব
এর সাহিত্যিক মূল্যায়নেরও প্রয়াস নেয়া হয়েছে এ গ্রন্থে। আপনার এই নাগরি উপন্যাসে
এর সুন্দর কিছু প্রকাশ অনুভুত হয়েছে ।

যাহোক পরের পর্ব দেখতে চল্লাম ।

শুভেচ্ছা রইল

২০ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:২৬

মিশু মিলন বলেছেন: মূল আখ্যান রামায়ণ এবং মহাভারতে আছে। আর ছোট ছোট অনেক ঘটনা, তৎকালীন সমাজের রীতি-পদ্ধতি, সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি বিন্যাস করেছি অন্য বইগুলির তথ্যের সাহায্যে। ঠিকই বলেছেন বৈদিক গ্রন্থগুলি কেবল ধর্মগ্রন্থ নয়, এগুলির ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে আপনার বেশ আগ্রহ এবং পড়াশোনা আছে জেনে ভাল লাগলো। ধন্যবাদ।
আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.