নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- আট)

০২ রা অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:৫৩

আট

শ্যাম নিষাদপুত্র, চম্পানগরী থেকে দুই ক্রোশ পূর্বে গঙ্গাপারের এক নিষাদ জন্মনে তার নিবাস, অন্য দাঁড়িদেরও তাই। এখানে আসবার পথে তারা দূর থেকে নিজেদের জন্মন্ দেখে চোখের শান্তি পেলেও ক্ষণকালের জন্য মনোপীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। চাইলেই তারা ইচ্ছে মতো নিজগৃহে যেতে পারে না, অনেক দিন পর পর গৃহে যাবার ছুটি পায়। অনেককাল আগে লোকমুখে গঙ্গায় মৎসের প্রাচুর্যের কথা শুনে বিন্ধ্য-পর্বতের পাদদেশের নিষাদ অধ্যুসিত অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছোট্ট একটি নিষাদ দলের সঙ্গে তার কোনো এক পূর্বপুরুষ ভাগ্যান্বেষণে এই গঙ্গাপারের অরণ্য কেটে বসতি স্থাপন করেছিল। জন্মগতভাবে নিষাদরা শংকরজন্মা; চতুর্বর্ণের পরের বর্ণ, অর্থাৎ পঞ্চম বর্ণ।

শ্যাম প্রবীণদের মুখে শুনেছে যে তাদের শরীরেও বইছে ব্রাহ্মণ রক্ত; ব্রাহ্মণরা সামাজিকতা রক্ষার্থে ব্রাহ্মণ কন্যা বিবাহ করলেও এখনো যেমন তাদের লাম্পট্য-লালসার শিকার হয় তাদেরই শ্রেণি বিভাজন করা নিন্মবর্ণের বৈশ্য কিংবা শূদ্র নারীরা, তেমনি পূর্বেও হতো। আর্যসভ্যতার বিকাশকালে ব্রাহ্মণরা তাদের জৈবিক কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে কৌশলে কিংবা জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে সম্ভোগ করতো নিন্মবর্ণের নারীদের। স্বভাবতই সেই নারীদের অনেকে গর্ভধারণ করতো, শূদ্র মাতার গর্ভে যে সন্তানের জন্ম হতো ব্রাহ্মণরা তাদেরকে নিষাদ-পারশব বলে আখ্যা দিতো। আর নিষাদপুত্র এবং নিষাদকন্যার মিলনের ফলে যে সন্তানদের জন্ম হতো, স্বভাবতই তারা ছিল নিষাদ। এভাবে ক্রমাগত ব্রা‏‏‏‏হ্মণদের অবাধ যৌন লালসার শিকার হয়ে এবং বংশানুক্রমিক নিষাদ নারী-পুরুষের স্বাভাবিক মিলনের ফলে নিষাদদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই ব্রাহ্মণরা শূদ্র কিংবা নিষাদ নারীদের সম্ভোগ করতো আবার এদেরকে ঘৃণাও করতো। ব্রাহ্মণদের দ্বারা নানারকম অত্যাচার এবং নিপীড়নের শিকার হতো নিষাদরা। ব্রাহ্মণরা যতোই তাদের ঘৃণা করুক, পতিত বলে এড়িয়ে চলুক শ্যামের পিতামহ গর্বভরে বলতেন নিষাদ জাতির বীরত্বের পুরোনো ইতিহাস, ‘পুরাকালে ভূ-লোকে কোনো রাজা ছিল না, রাজ্য ছিল না। মানুষ গোত্রবদ্ধ হয়ে পরস্পর মিলেমিশে থাকতো, কোনো দ্বন্দ্ব হলে নিজেরাই বসে মিটমাট করে ফেলতো। কোনো বিপদ এলে নিজেরাই সম্মিলিতভাবে নিজেদেরকে রক্ষা করতো। ভূ-লোকে প্রথম রাজা হয়েছিলেন মহারাজ বেণ। ব্রাহ্মণরা তাঁকে অত্যাচারী-মন্দ বুদ্ধির রাজা বললেও প্রকৃতপক্ষে তিনি অত্যাচারী বা মন্দবুদ্ধির রাজা ছিলেন না। সে-কালে ব্রাহ্মণরা রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি, অর্থনীতি, দণ্ডনীতিসহ সমাজের সকলপ্রকার নীতি নির্ধারণ করতো আর এই আধিপত্য বিস্তারকারী ব্রাহ্মণদের অনুমতিক্রমেই বেণ রাজা হয়েছিলেন। কিন্তু রাজা হওয়ার পর উঠতে-বসতে ব্রাহ্মণরা তাঁকে আদেশ-উপদেশ দিতো; লোভী-লম্পট-ব্রাহ্মণরা রাজা বেণকে তাদের হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে চাইতো। অন্যায়-অন্বিষ্ট করেও পার পেয়ে যাওয়ার জন্য ব্রাহ্মণরা দণ্ডনীতিতে তাদের জন্য গুরুপাপে লঘুদণ্ডের বিধানও রাখে নি, অথচ সমাজের অন্যদের জন্য লঘুপাপে গুরুদণ্ড নীতি নির্ধারণ করেছিল। স্বার্থবুদ্ধি সম্পন্ন ব্রাহ্মণরা সকল নীতিতেই বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল, সমাজের অন্যদের বঞ্চিত করে নিজেরা নানান রকম সুবিধা ভোগ করতে চাইতো। কিন্তু দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী ন্যায়-নীতিপরায়ণ মহারাজ বেণ ব্রাহ্মণদের ওইসব বৈষম্যমুলক নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তিনি ব্রাহ্মণদের নিয়ম-নীতি বাতিল করে সকলের জন্য মঙ্গলজনক এক নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। ব্রাহ্মণদের অন্যায় আবদার এবং আধিপত্য তো মেনে নেন-ই নি, বরং তিনি বেদ-বিরোধী ছিলেন; এমনকি দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের কর্তৃত্ব এবং অধিকারও অস্বীকার করেছিলেন। ফলে শক্তিশালী ব্রাহ্মণ পুরোহিত আর ঋষিরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল তাঁকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করার জন্য। দেবকুল, পুরোহিত এবং ঋষিরা তাঁর বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। মহারাজ বেণও তাদের হুঙ্কারে মাথা নত করেন নি, যুদ্ধের জন্য তিনিও প্রস্তুত ছিলেন আর তাঁর এই ন্যায়যুদ্ধে আমাদের পূর্বপুরুষরা বীরত্বের সঙ্গে তাঁর পক্ষে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু মন্দ কপাল মহারাজ বেণ আর আমাদের পূর্বপুরুষদের, এজন্য যে স্বয়ং মহারাজের অন্দরেই ছিল তার শত্রু; তাঁরই দক্ষিণহস্ত বলে খ্যাত নিজপুত্র পৃথু রাজা হবার লোভে দেবকুল, পুরোহিতকুল এবং ঋষিকুলের প্রলোভনে পা দিয়ে আপন পিতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার পরাজয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। পৃথুর এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই মহারাজ বেণ পুরোহিত এবং ঋষিদের হাতে নিহত হয়েছিলেন, আর তাদের হাতের পুতুল রাজা হয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতক পৃথু। রাজা হবার পরই ব্রাহ্মণদের কাছে পৃথু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, “ব্রাহ্মণরা আমার প্রথম মান্য পুরুষ, আমি কখনোই তাদের বিরুদ্ধে যাব না। আমি ভূ-লোকবাসী ব্রাহ্মণদের সযত্নে লালন করবো। আমি কোনোদিন তাদের দণ্ড দেব না।”

পৃথু ব্রাহ্মণদেরকে দেওয়া তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন, ব্রাহ্মণদের অঙ্গুলি হেলনেই তিনি রাজ্য চালাতেন। শত অন্যায় করলেও ব্রাহ্মণদের কোনো দণ্ড হতো না। পৃথুর প্রতি সন্তুষ্ট ব্রাহ্মণরা বেণকে রাজা হিসেবে অস্বীকার করে পৃথুকে ভূ-লোকের প্রথম রাজার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, আর পৃথুর নামানুসারেই ভূ-লোকের নাম হয় পৃথ্বী অর্থাৎ পৃথিবী। অন্যায়ের কাছে ন্যায়ের করুণ পরাজয় ঘটে রাজপদ সৃষ্টির সূচনালগ্নেই! পৃথু রাজা হবার পর থেকে মহারাজ বেণের পক্ষালম্বন করার অপরাধে ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে আমাদের পূর্বপুরুষদের ওপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পৃথুর রাজ্য থেকে উৎখাত করা হয়। বাস্তুস্তুত হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিন্মভূমির দিকে নেমে এসে বিন্ধ্যপর্বত সংলগ্ন অঞ্চলের অরণ্যভূমিতে আশ্রয় নিয়ে হিংস্র পশুদের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ছিলেন আর অরণ্যের ফলমূল-পশুপাখি এবং নদীর মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

মহারাজ বেণ যে সততা, দৃঢ়তা, আদর্শ এবং ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে রাজ্য শাসন শুরু করেছিলেন, পৃথুর রাজত্ব থেকেই তা বদলে যায়। রাজচরিত্রে ঢুকে পড়ে ব্রাহ্মণতোষণ আর রাজ্যশাসনে ধর্মীয় অনুশাসন। প্রজাপালনে শুরু হয় বৈষম্য আর প্রজাদের ওপর নেমে আসে ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রীয় নিপীড়ন; যা আজও পর্যন্ত বিদ্যমান।’

নিষাদদের পূর্বপুরুষরা যে ন্যায়ের পক্ষে থেকে বীরত্ব দেখিয়ে লড়াই করেছিল তাই নিয়ে গর্বের শেষ ছিল না শ্যামের পিতামহের। সাপ আর ব্রাহ্মণদেরকে শত্রু মনে করতেন তিনি। কেননা জলে মৎস্য শিকার করতে গেলে প্রায়-ই নিষাদ পুরুষদের সাপে কাঁটতো আর ডাঙায় শাস্ত্রে মারতো ব্রাহ্মণরা। তিনি সাহসীও ছিলেন খুব; একবার ভিন জন্মন্ থেকে আসবার পথে রাতের অন্ধকারে বস্ত্রের আবরণে মুখ ঢেকে এক ব্রাহ্মণকে পিটিয়ে আধমরা করেছিলেন। অথচ শ্যাম হয়েছে ওর পিতামহের উল্টো, সাহসের বড্ড অভাব।

আগে স্বাধীন পেশা ছিল শ্যামের, পিতা এবং বড়ো দাদাদের সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে মৎস্য শিকার করতো। শরীর ও মন ভাল থাকলে মৎস্য শিকার করতে যেতো, ভাল না থাকলে যেতো না; গঙ্গার পারে সখাদের সঙ্গে কন্দুক আর গুলি-ডাণ্ডা খেলে সময় অতিবাহিত করতো। কন্দুক আর গুলি-ডাণ্ডা খেলায় নিষাদ জন্মনে তার তুল্য কেউ ছিল না। বাবা-মা তার বিবাহ দিয়েছিলেন তাদেরই গাঁয়ের কন্যা অম্বার সঙ্গে। বিবাহের আগে মৎস্য শিকার করতে করতে একসময় তার মন আনচান করতো কন্দুক আর গুলি-ডাণ্ডা খেলার জন্য, গৃহে ফিরেই ছুটতো সখাদের সঙ্গে খেলতে; আর বিবাহের পর মৎস্য শিকার করতে করতে কন্দুক কিংবা গুলি-ডাণ্ডা নয়, মন আনচান করতো অম্বার জন্য। তার মনে হতো অম্বার ভেতরেই রয়েছে অসংখ্য কন্দুক আর গুলি-ডাণ্ডার হর্ষ; আর রয়েছে এক দৈব মদ্য সরোবর, যার মদ্যপানে যেন এক মায়াবী নেশা আচ্ছন্ন করে রাখে, দূরে গেলে হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে!

জাল টানতে টানতে হঠাৎ সে অনুভব করতো অম্বার শরীর যেন তার দেহ-মন দুই-ই টানছে; জাল যেমনি জলের কোল ছেঁকে মৎস তুলে আনে, তেমনি অম্বাও যেন এক অদৃশ্য জালে আবদ্ধ করে তাকে ভীষণভাবে টানছে! অম্বার গন্ধ-স্পর্শ অনুভব করে সে বিমনা হয়ে জাল টানতে ভুলে গিয়ে পিতার ধমক খেতো প্রায়ই। তারপর ফিরে এসে অম্বার গন্ধ-স্পর্শ-আলিঙ্গন পেয়ে তার মনে হতো অমরাবতী দূরে নয়, গৃহ-ই তার অমরাবতী আর অম্বা মন্দাকিনী! অম্বায় অবগাহন করে মিটাতো তার জীবনতৃষ্ণা।

কিন্তু শ্যামের এই বিপুল সুখে কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো দুর্ভিক্ষ আর মৎস্য-করকর্তা। দুর্ভিক্ষের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কর বকেয়া পড়েছিল নিষাদ জন্মনের অনেকেরই, তা শোধ করতে এবং পরিবারকে বাঁচাতে নিজের সাধ-আহাদ বিসর্জন দিয়েছে সে! একদিন করকর্তা রাজসৈন্য নিয়ে নিষাদ জন্মনে গিয়ে তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা এবং বেছে বেছে সুঠাম দেহের আরো কয়েকজন নিষাদকে রাজতরণীতে দাঁড়ির কাজ করে কর শোধ করার আদেশ দেয়। জ্যেষ্ঠভ্রাতার পত্নী তখন পোয়াতি, তার তখন গৃহে থাকা প্রয়োজন। শেষে করকর্তাকে বলে জ্যেষ্ঠভ্রাতার পরিবর্তে সে নিজে রাজতরণীতে কাজ করতে আসে। বকেয়া কর শোধ করার পর রাজ আজ্ঞা আসে যে তাদেরকেই নিয়মিত দাঁড়ির কাজ করতে হবে, বিনিময়ে পারিশ্রমিক তারা পাবে। রাজ আজ্ঞা অমান্য করার সাধ্য কারো নেই, করলে দণ্ড অবধারিত। তাই শরীর-মন না চাইলেও তাদেরকে দাঁড়ির জীবিকা মেনে নিতে হয়েছে। তিন-চার মাস পর পর একবার গৃহে ফেরার সুযোগ পায় তারা। আগে অম্বার বিরহে কাতর হয়ে থাকতো শ্যাম, বিরহের জ্বালা রূপান্তরিত হতো ক্ষোভের আগুনে, কিন্তু সে আগুন কোথাও জ্বালবার উপায় নেই। জ্বাললে তার শিখায় নিজেকেই পুড়ে মরতে হবে। তাই মনের আগুন নিজেকেই প্রশমিত করতে হতো। অমাত্য এবং রাজকর্মচারীদেরকে তরণীতে বয়ে নিয়ে দূর-দূরান্তে যেতো, কখনো কখনো ভিন রাজ্যেও যেতো। যাবার সময় গঙ্গার পারে অম্বার বয়সী কোনো বধূকে দেখলে ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠতো তার। তখন ইচ্ছে করতো দাঁড় দিয়ে মেরে অমাত্য এবং রাজকর্মচারীদের ফালা ফালা করে দিতে! শুয়োরের বাচ্চাগুলো গণিকা নিয়ে আমোদ করে নৌকার কক্ষে, মদ্যপান করতে করতে চতুরঙ্গ খেলে; আর তাদেরকে দাঁড় বেয়ে যৌবন ক্ষয় করতে হয়!

কিন্তু কোনো ক্ষোভের আগুনই বাইরে বিকশিত হতো না, মনের ভেতরেই জন্ম নিতো আবার মনের ভেতরেই হতো নিঃশেষ।
একবার দীর্ঘদিনের জলযাত্রায় গিয়েছিল অবন্তী রাজ্যে, ফিরে এসে ছুটি নিয়ে গিয়েছিল গৃহে, অম্বা তখন গর্ভবতী। গৃহে ফিরে অম্বাকে সে আর পায় নি, অম্বা মরে গেছে সাপের কামড়ে। তারপর কিছুদিন শোকাচ্ছন্ন হয়ে থাকার পর রাজসৈন্য গৃহ থেকে তাকে পুনরায় ধরে নিয়ে এসেছে। পিতামাতা-তাকে পুনরায় বিবাহ দিতে চাইলেও সে আর রাজি হয় নি। বিবাহ করলে অম্বার মতোই নতুন বধূকে ফেলে তাকে দূরে থাকতে হবে, তিন-চার মাস পর একবার ছুটি পাবে; দুজনকেই ভোগ করতে হবে অসহনীয় বিরহ। আর ফিরে এসে অম্বার মতো তাকেও যদি না পায়! তাছাড়া অম্বাকে সে এখনো ভুলতে পারে নি। চোখ বুজলে এখনো অম্বাকে দেখতে পায়, অম্বার গন্ধ পায়, স্পর্শ অনুভব করে।

দাঁড় বাওয়া ভীষণ একঘেয়ে, বিরক্তিকর আর শারীরিক পরিশ্রমের কাজ। কোনো বৈচিত্র্য নেই, আমোদপূর্ণ সংগ্রাম নেই; যা মৎস্য শিকারে ছিল। মৎস্য শিকার, কন্দুক কিংবা গুলি-ডাণ্ডা খেলায় একটা আমোদপূর্ণ লড়াই ছিল। মৎস্য শিকারের সময় লড়াই করতে হতো জলের সঙ্গে। পরিশ্রম হতো, কিন্তু যখন জাল ভরে মৎস্য উঠতো, তখন খুশিতে মনও আনন্দে নেচে উঠতো। কখনো জালে মৎস্য কম উঠলে বিপুল উদ্যমে পরেরবার জাল ফেলতো জলে। এভাবে কখনো মৎস্য বেশি উঠতো আবার কখনো কম। মা গঙ্গা যেন তাদের সাথে লুকোচুরি খেলতো, এই খেলার সাথে জড়িয়ে ছিল তাদের জীবন-জীবিকা; তাই পরিশ্রম যেমনি হতো, তেমনি প্রচুর মৎস্য ধরতে পারলে বিপুল আমোদিতও হতো তারা। গৃহে ফিরে উৎসবে মেতে উঠতো পরিবার-পরিজনের সঙ্গে।

তেমনি কন্দুক কিংবা গুলি-ডাণ্ডা খেলাতেও আমোদপূর্ণ লড়াই আছে। লড়াইটা সহ খেলোয়াড়দের সঙ্গে আবার নিজের সঙ্গেও। গুলি-ডাণ্ডা খেলার সময় দৃষ্টি ঠিক রেখে গুলিতে সঠিকভাবে ডাণ্ডার আঘাত করতে পারলেই জয়ের সম্ভাবনা, আর না পারলে পরাজয়; পরের বার আবার বিপুল উদ্যমে চিত্ত এবং দৃষ্টির সংযোগে খেলতে হয়। উভয় পক্ষ-ই নিপুণ খেলোয়াড় হলে খেলাটা আরো বেশি জমে।

গুলি-ডাণ্ডা খেলতে খেলতে শ্যামের নেশা লেগে যেতো, স্নানাহার ভুলে যেতো। এজন্য পিতার হাতে প্রহারও জুটেছে অনেকবার। আর এখন? শরীরের জল নিংড়ে একনাগাড়ে দাঁড় বাইতে বাইতে এই যৌবনেও মনটা যেন বৃদ্ধ হয়ে গেছে। অম্বার মৃত্যুর পর তার জীবনের আমোদবৃক্ষটি যেন সমূলে উৎপাচিত হয়ে শুকিয়ে মরে গেছে। আমোদ আর লড়াইহীন যৌবন যেন সময়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে নদীর কূলের অসহায় ভূমির মতো।

যদিও জীবনের পরিধি পূর্বের চেয়ে বিস্তৃত হয়েছে, অঙ্গরাজ্যের ভেতরেই গঙ্গাবক্ষের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় তারা মৎস্য শিকার করতো। আর অঙ্গরাজ্যের বাইরে অন্য রাজ্য ভ্রমণের কোনো অভিজ্ঞতাই তার ছিল না। এখন সে অঙ্গরাজ্যের বাইরেও কলিঙ্গ, মগধ, কোশল, চেদি, মধুপুরী, লিচ্ছবি, অযোধ্যা, বিদেহ প্রভৃতি রাজ্য এবং সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা দেখার সুযোগ পায়। কিন্তু অমাত্য কিংবা রাজকর্মচারীদের মতো বিনাশ্রমে প্রমোদভ্রমণ করতে করতে বিচিত্র মানুষ এবং তাদের জীবনযাত্রা দেখা আর শরীর নিংড়ে একনাগাড়ে দাঁড় বাইতে বাইতে দেখা এক নয়। কোনো ভিন রাজ্যের ঘাটে নোঙর করলে তখন নদীর পারে তাকিয়ে মানুষ দেখার চেয়ে অবসন্ন শরীর আর অবশ হাত দুটোকে বিশ্রাম দিতে পালাক্রমে একটু বিছানায় গড়িয়ে নেওয়ার বাসনাই প্রকট হয়ে ওঠে। মন যদি বাহিরপানে টানে তো শরীর টানে শয্যা!

দাঁড়ির কাজ মোটেও উপভোগ করে না সে। কেবল সে একা নয়, এই তরণীর কেউ-ই উপভোগ করে না। সে এবং সুকেতু ব্যতিত অন্য সকলেরই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আছে। সবচেয়ে বয়সী দাঁড়ি রঘু, তার বয়স আড়াই কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে; সে-ই হালে বসে এবং সবাইকে নেতৃত্ব দেয়। রঘু ব্যতিত অন্য সকলেরই বয়স দু-কুড়ির নিচে। শ্যামের বয়স এক কুড়ি পাঁচ, আর সুকেতুর এক কুড়ি দুই। রঘু ব্যতিত সবাই তাগড়া জোয়ান, ফলে একনাগাড়ে নদীতে থাকতে থাকতে কখনো কেউ হাঁফিয়ে উঠলে, কারো চিত্ত চঞ্চল হলে কিংবা কেউ বিদ্রোহী হয়ে উঠলে রঘু সান্ত্বনার জল ঢেলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বাইশ বছরের ফুটন্ত জেদি যুবক সুকেতু মাঝে মাঝেই ফুঁসে ওঠে, রাজার লোকজন তরণীতে না থাকলে দ্রুম দ্রুম করে লাথি মারে তরণীর পাটাতন কিংবা কক্ষের দেয়ালে। গত মাসে মগধ থেকে ফেরার পথে রাতেরবেলা শুয়ে সুকেতু সকলকে বলেছিল, ‘ইচ্ছে করে সবগুলোকে মেরে মা গঙ্গার ভোগে দিয়ে দিই, তারপর পরিবারের সকলকে তরণীতে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাই কোনো দূর রাজ্যে।’

শুনেই যেন আঁৎকে উঠেছিল রঘু। বলেছিল, ‘অমন কথা মুখেও আনিসনে সুকেতু, পাপে ডুবে মরবি!’
‘এখন বেঁচে থেকে কী সুখেই বা আছি!’

‘কোনজন্মে পাপের ফলে আমরা নিষাদকুলে জন্মেছি, এসব বলে আর পাপের ভাগ ভারী করিসনে। শাস্ত্রে আছে আমাদের জন্ম হয়েছে উচ্চ বর্ণকে সেবা করার জন্যে, মন দিয়ে তাই কর; শাস্ত্র অমান্য করিসনে। ভগবানকে শতকোটি প্রণাম কর যে তবু তোকে নিষাদকুলে পাঠিয়েছেন, কুকুর-বিড়াল করে তো আর পাঠান নি!’

‘এই জীবনের চেয়ে কুকুর-বিড়ালের জীবনও ঢের ভাল তাত, কুকুর-বিড়ালও পিতা-মাতা, পত্নী-পুত্র-কন্যার সঙ্গে স্বাধীনভাবে বাস করতে পারে; আমাদের মতো পরাধীন নয়।’
‘হায় ভগবান! তোর মতিভ্রম হয়েছে সুকেতু!’
‘মতিভ্রম আমার হয় নি তাত, মতিভ্রম হয়েছে নিষাদ জন্মনের তোমার মতো বুড়োদের, যারা ব্রাহ্মণদের ওইসব শাস্ত্রের কথা শুনে নিজেদেরকে মেরে রেখেছ, আবার আমাদেরও মারছো।’
‘তো কী করবি শুনি? লড়াই করতে যাবি ব্রা‏হ্মণ-ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে?’
‘আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা একদিন ওদের সঙ্গে লড়াই করেছিল, দরকার হলে আমরাও যাব।’
‘ঝাড়ে-বংশে বিনাশ হবি তবে। কথা বাড়াসনে, ঘুমো এখন।’
‘বিনাশ যদি হতেই হয় তো একদিন দু-গণ্ডা ব্রা‏হ্মণ মেরেই হবো তাত!’

সুকেতুর ভেতরের এই আগুন বড়ো ভাল লাগে শ্যামের। সত্যি সত্যিই ওর কোনো ভয়ডর নেই। ভগবান থেকে শুরু করে রাজার মৎস-করকর্তা ভগদত্ত, সকলের নামেই গালাগাল করে ও। ব্রা‏‏‏হ্মণের টিঁকি আর তাদের শাস্ত্রে সে দিনে তিনবার আগুন দেয় কী হিসি করে! সবই মুখে মুখে, তবে সত্যি সত্যিই ও যদি এগুলো করে, তাতে অবিশ্বাসের কিছু নেই। এজন্য শ্যাম ওকে খুব স্নেহ করে, সে চায় ওর এই আগুন জ্বলতে থাকুক, নিষাদ জন্মনের আরো আরো যুবক-কিশোর এবং শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক। আগামী দিনের প্রজন্মই হয়তো একদিন নিষাদদের জন্য মুক্তিবার্তা নিয়ে আসবে।

রঘু ব্যতিত আর কেউ-ই গিরিকা এবং তার কন্যাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানে না। তারা কারা এবং কী উদ্দেশ্যে বিজন অরণ্যের পথে তাদের এই জলযাত্রা তাও জানে না। রঘুকে প্রশ্ন করে শ্যাম শুধু জানতে পেরেছে যে এরা রাজবাড়ীর অতিথি; এদের আপ্যায়নে বিন্দুমাত্র ত্রুটি যেন না হয়, হলে মহারাজ তাদের মৃত্যুদণ্ড দেবেন। তবে রঘু না বললেও এদের বহুমূল্য স্বল্পাভরণ, নিঃশঙ্কোচ চাল-চলনে শ্যাম এবং অন্যরা শুরুতেই বুঝতে পেরেছে যে এরা কোনো পুরনারী নয়, নিশ্চয় গণিকা। কেননা রাজবাড়ীর পুরনারীদের সাথে পুরুষ অবিভাবক থাকে, বাইরের মানুষ তাদের মুখ দর্শন করতে পারে না, একবার কক্ষে প্রবেশ করলে তারা সহজে আর বাইরে বের হয় না, আর দাঁড়ি কিংবা অন্য পুরুষের সাথে কথা বলা তো দূরের ব্যাপার তাদের কণ্ঠস্বর কক্ষের বাইরে থেকেও শোনা যায় না। আর গণিকাদের এসবের বালাই নেই, তারা রাজবাড়ীর বনেদী নাগরের সঙ্গে আসে, স্বল্পাভরণ হয়ে স্বচ্ছন্দে তরণীতে চলাফেরা করে, গঙ্গার ঢেউয়ের মতো কলকল করে হাসে, নাগরের মনোরঞ্জনে পায়ে ঘুংগুর বেঁধে নৃত্য-গীত করে। বেশিরভাগ গণিকা দাঁড়িদের প্রতি খেয়ালই করে না, তবে দাঁড়িরা দাঁড় টানতে টানতে অযাচিত শ্রোতা হয়ে সেই নৃত্য-গীতে কান পাতে। নৃত্য-গীত শুনতে শুনতে হয়তো কারো করো বুকে চোরা স্রোত বয়ে যায়, কেউ হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে; রাজনর্তকী কিংবা গণিকার শরীর দেখে পত্নী বিহনে কেউবা নিরলে করে আত্মরতি।
তাই পুরনারীরা যেমনি তাদের কাছে দূরের মানুষ, তেমনি রাজনর্তকী কিংবা গণিকারাও তাদের কাছে দূরের অপ্সরা হয়েই থাকে। তারা ছাদের কেদারায় নাগরের বাহুলগ্ন হয়ে বসে থাকে, রঙ্গ-রসিকতা করতে করতে কখনো কখনো নাগরকে আলিঙ্গন করে, নাগরের কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে ওষ্ঠ চুম্বন করতেও দ্বিধা করে না। দাঁড়িরা আড়চোখে সবই অবলোকন করে, কিন্তু যুগল প্রমোদপিপাসু তাদেরকে গ্রাহ্য করে না, হয়তো তাদেরকে অবলা বন্য জীব সদৃশ মনে করে!

কিন্তু এই গণিকারা ব্যতিক্রম, জীবনে এমন অভিজ্ঞতা হয় নি শ্যামের। এদের সঙ্গে কোনো নাগর নেই; এরা পায়ে ঘুংগুর বেঁধে নৃত্য-গীত করছে না, তবে কখনো কখনো আপন খেয়ালে কেউ গেয়ে উঠছে দু-এক কলি গীত। এরা যা খাচ্ছে তাদেরকেও তাই খেতে দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করছে। তাদের রঙ্গ-রসিকতার সুযোগ নিয়ে অদম্য সাহসী সুকেতুও পাল্টা রসিকতা করেছে তবু এরা বিরক্ত হয় নি বা রেগে যায় নি। অথচ এদের সৌন্ধর্যও অপ্সরীতুল্য, এদের সুবর্ণগাত্রেও বহুমূল্য পরিচ্ছদ এবং রত্নখচিত অলংকার। যদিও একজনের শরীরে সাধারণ পরিচ্ছদ এবং রত্নখচিত অলংকারও পরে নি, তবু তার সৌন্ধর্য এতোটুকুও ম্লান হয় নি।

হাট থেকে নানারকম দ্রব্যসামগ্রী, ফল এবং বেশ বড়ো দুটি হংস ক্রয় করে সন্ধ্যার মুখে তরণীতে ফিরেছেন গিরিকা এবং অন্যান্যরা। গিরিকা অনেকদিন হংসের মাংস আহার করেন না, তাই হাটে হংস দেখে লোভ সামলাতে না পেরে ক্রয় করেছেন। যদিও হংসের মাংস আহার করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ, কিন্তু অনার্যদের মতো অনেক আর্যও আজকাল শাস্ত্র লঙ্ঘন করে গোপনে হংস মাংস আহার করে থাকে।

এখন অন্ধকার নেমেছে। ঘাটে হাটুরেদের কলরব নেই বললেই চলে, মাত্র কয়েকটি তরণী বাঁধা। গিরিকা এবং সুলোচনা তরণীর হালের দিকে দাঁড়িয়ে সুকেতুর হংস প্রক্রিয়াজাত করা দেখছে। গঙ্গার তীরে বসে সুকেতু হংস বধ করে পালক ছাড়িয়ে এখন কাঠের আগুন জ্বালিয়ে মাংস আগুনে ঝলসাচ্ছে, রন্ধনের আগে আগুনে কিছুক্ষণ ঝলসে নিলে লোম যেমনি পুড়ে যায়, তেমনি মাংসও বেশি সু-স্বাদু হয়। জলন্ত মশাল হাতে ধরে সুকেতুর বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছে আরেক দাঁড়ি বলাই, দুজনের মাঝখানে জ্বালানো কাঠের আগুন, বাতাসে মশালের আলো আছাড়ি-পিছাড়ি করছে আর আগুনের লালচে আভা খেলা করছে সুকেতু এবং বলাইয়ের মুখে। গঙ্গার বক্ষেও কাঁপছে সুকেতু, বলাই আর আগুনের প্রতিবিম্ব।

হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো এক নারী, তার কোলে একটি ছোট্ট শিশু। নারী তরণীতে দাঁড়ানো গিরিকা এবং সুলোচনার দিকে তাকিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, ‘মাতা, আপনাদের হৃদয়ে যদি কিছুমাত্র দয়া থাকে তো আমার এই শিশুপুত্রটি আপনারা ক্রয় করুন। পুত্রটিকে নিয়ে আমাকে কিছু কড়ি দিন।’

সুকেতু আর বলাই অবাক হয়ে তাকালো নারীর দিকে। গিরিকার চোখও কপালে ওঠার অবস্থা! এই ষাট বছরের জীবনে তিনি কোনোদিন আপন পুত্র বিক্রয়ের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন নি। বললেন, ‘কেমন নিষ্ঠুর মাতা তুমি, যে আপন পুত্রকে বিক্রয় করতে চাইছো!’

‘মরণ আকাল লেগেছে মাতা, খেতে পাই না বলে বক্ষে দুগ্ধ নেই, পুত্রের মুখে কিছু দিতে পারছি নে। গৃহে আমার আরো দুটি সন্তান ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে, কোলের পুত্রটিকে বিক্রয় করে কিছু কড়ি পেলে তা দিয়ে গৃহের দুটিকে কিছুদিনের জন্য অন্তত বাঁচাতে পারবো। মাতা, দয়া করুন, আমার পুত্রটিকে আপনারা ক্রয় করুন। বড়ো শান্ত পুত্র আমার, পেট পুরে দুধ খেতে পেলে একটুও কাঁদে না।’

‘এমন পাপকর্ম ক’রো না বাছা, কষ্ট হলেও পুত্রকে নিজের কাছে রাখো। তোমার অন্তরে কী দয়ামায়া নেই!’

‘যদি মাতা-পুত্র কেউই বেঁচে না থাকি তবে দয়ামায়া দিয়ে কী হবে মাতা! আমার কাছে রাখলে পুত্রকে আমি বাঁচাতে পারবো না। বিক্রয় করলে আমি হয়তো পুত্রকে হারাবো, কিন্তু পুত্র আমার বেঁচে তো থাকবে কোথাও না কোথাও। দয়া করুণ মাতা, বিশ্বাস করুণ, আমি শূদ্র হলেও আমার পুত্রের শরীরে ব্রা‏‏হ্মণের রক্ত। এই দেখুন, ওর গায়ের রঙ আমার মতো কৃষ্ণবর্ণ নয়, গৌর বর্ণ।’

সন্তানকে মশালের আলোর দিকে এগিয়ে ধরলো নারী, মশালের আগুনের লালচে আভা ছড়িয়ে পড়লো ছয়-সাত মাসের পুত্রটির গায়ে-মুখে। নারীর কান্না এবং কথা শুনে শবরী আর উমাও এসে দাঁড়িয়েছে গিরিকার পিছনে। গিরিকা বললেন, ‘আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, তুমি কোনো মায়ের কোল খালি করে শিশুটিকে চুরি করে আনো নি তো?’

‘ভগবান শিবের দিব্যি দিয়ে বলছি মাতা, এই পুত্র আমার, আমি-ই একে গর্ভে ধারণ করেছি।’
‘তা বেশ, তোমার পুত্র হয় তো ভালো কথা। কিন্তু আমি এই বয়সে পুত্র ক্রয় করে কী করবো বাপু, আমার বয়স আরো কম হলে না হয় কথা ছিল! এই বয়সে পুত্র লালন-পালনের ঝক্কি আমার সইবে না। তুমি অন্য কোথাও চেষ্টা করো।’
‘মাতা দোহাই আপনার, আমাকে যৎসামান্য কড়ি দিন, তবু পুত্রটিকে আপনারা নিন। পুত্রটিকে আপনারা বাঁচান।’
শবরী পিছন থেকে বললো, ‘মা, ওকে কিছু কড়ি দাও।’

গিরিকা শবরীর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর হাট করার পর আঁচলের খোঁটে যে কয়েকটি কড়ি বেঁধে রেখেছিলেন, তার থেকে দুটি কড়ি নিয়ে বলাইকে বললেন, ‘কড়ি দুটো ওকে দাও তো বাছা।’

নারীর কোলের পুত্র এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল, হঠাৎ জেগে উঠে কেঁদে উঠলো; হয়তো ক্ষুধার জ্বালায়। বলাই এগিয়ে এসে নিচে দাঁড়িয়েই কড়ি দুটো গিরিকার হাত থেকে নিয়ে নারীর হাতে দিলো। কড়ি দুটো হাতে নিয়ে নারী পুনরায় অনুনয় করে বললো, ‘মাতা, আর কিছু কড়ি দিয়ে আমার পুত্রটিকে নিন। দেখুন ক্ষুধার জ্বালায় কেমন কাঁদছে।’

গিরিকা বললেন, ‘তুমি অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখ বাছা, এখন যাও।’

মশালের আলোয় সকলেই ক্রন্দনরত শিশুটির মুখের দিকে তাকালো, সত্যিই সুন্দর দেখতে শিশুটি। ওর চোখ আর কান্নার কর্কশ স্বরে কেবলই ক্ষুধা নিবারণের অকৃত্রিম আকুতি।

অসফল হয়ে নারী চলে গেল। সুকেতু হংস দুটি প্রক্রিয়াজাত করলে উলুপী এসে মাংস নিয়ে গেল রন্ধনশালায়। সুকেতু দু-হাতে মৃত্তিকা ঘষে গঙ্গার জলে রক্ত ধুয়ে হাটের দিকে পা বাড়ালো শ্যামকে খুঁজতে। সেই কখন শ্যাম হাটের দিকে গেছে অথচ ফেরে নি এখনো।

সুকেতু অন্ধকারে গঙ্গার চরটুকু পেরিয়ে ঢাল বেয়ে উঠে হাটের ভেতরে প্রবেশ করলো। হাট ভেঙেছে গোধূলিবেলায়। ক্রেতারা আর বিশেষ নেই হাটে। বিক্রেতারা কেউ বিপণী বন্ধ করছে, কেউবা প্রদীপের আলোয় শেষবারের মতো গণনা করছে কড়ি। শ্যামকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে হাটের পূর্ব দিকে গঙ্গাপার ঘেঁষা এক শুঁড়িখানায় তাকে পেলো সুকেতু। শুঁড়িখানার চারদিকে চারটে লম্বা দীপাধারের ওপর জ্বলছে তৈল-প্রদীপ। ভেতরে সাত-আটজন পানশৌণ্ড; এদের বেশিরভাগই পল্লী গায়ক, নট, ছিঁচকে চোর অথবা ভূ-স্বামী। মাঝে মাঝে দস্যুরাও আসে; দস্যুরা এলে অন্যরা ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে, দ্রুত পানপাত্র শূন্য করে নীরবে কেটে পড়ে। তারা মাঙনা মদ্যপান করে না, কিন্তু পাঁঠা কিংবা গো-মাংস না পেলে শুঁড়িখানার পরিবেশনকারী আর শৌণ্ডিককে খিস্তিখেউর করে। কখনো কখনো লুণ্ঠন করা সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি-রক্তারক্তি করে। তবে আজ তারা নেই, হঠাৎ হঠাৎ তাদের আগমন ঘটে, বিশেষত যখন তারা বড়ো কোনো লুণ্ঠনকার্য সম্পাদন করে ফেরে।

পানশৌণ্ডরা প্রত্যেকেই ভূমিতে পাতা মাদুরের আসনে উপবিষ্ট, তাদের সম্মুখের জলচৌকিতে রাখা পানপাত্র এবং শালপাতার ভোজনপাত্র। একজন পল্লী গায়ক জলচৌকিতে তাল ঠুকে নিচুস্বরে গাইছে এই অঞ্চলের লোকগীতি-
প্রিয়া তুই প্রেম না দিলে
একদিন গান্ধার দেশে যাব চলে
পাব গান্ধার কন্যার আদর
সেদিন বুঝবিরে তুই আমার কদর।

শুঁড়িখানায় প্রবেশ করে সুকেতু শ্যামের কাছে গিয়ে বললো, ‘বেশতো আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছ!’

শ্যামের কিঞ্চিৎ নেশা হয়েছে। বললো, ‘তোকে ছাড়া শুঁড়িখানায় এলে নেশা করে আমোদ পাই না, কেমন বোবা হয়ে থাকতে হয়! কিন্তু কী করবো বল, দেখলাম তোর ওপরে আবার রাজহংসের মাংস প্রস্তুতের দায়িত্ব পড়েছে; তাই একাই সটকে পড়লাম। বসে পড়।’

শ্যাম পরিবেশনকারীর উদ্দেশে বললো, ‘ভ্রাতা, আর দু-পাত্র দাও।’

একটু পরই একজন পরিবেশনকারী বাঁশের চোঙার পানপাত্রে দুজনকে মদ্য দিয়ে গেল। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে পান করতে লাগলো দুজন। ওদের জীবনে বিলাসিতা বলি আর আনন্দ বলি এটুকুই, মাঝে মাঝে কোনো নগর কিংবা গাঁয়ের সস্তা শুঁড়িখানায় বসে দু-চার পাত্র মদ্য পানের ফাঁকে নিজেদের অতীত জীবনের জাবড় কাটে, বর্তমান আর ভবিষ্যতের হতাশায় ডুব দিয়ে অন্য এক জগতে প্রবেশ করে। এ কী আনন্দ, না কি এই একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্য অন্য কোথাও হারিয়ে যাওয়া! এই হারিয়ে যাওয়াতেই বুঝি ওদের আনন্দ! নিরানন্দ জীবনের দুঃখময় গাদ ছেঁকে একটু আনন্দরস বের করার প্রচেষ্টা মাত্র!

দুজনেই চার পাত্র করে পান করার পর শ্যাম বললো, ‘চল, এখন উঠি। নইলে রঘু তাত আবার খুঁজতে বের হবে।’
‘চলো।’ উঠতে গিয়ে একটু টাল খেলো সুকেতু।
ওকে সতর্ক করলো শ্যাম, ‘দেখিস।’

শ্যামও উঠে পড়লো, উঠার সময় জলচৌকির নিচ থেকে শালপাতার পাত্রে মোড়ানো কিছু একটা হাতে নিলো সে। তারপর শৌণ্ডিককে মদ্য’র মূল্য মিটিয়ে কিঞ্চিৎ টাল খাওয়া পায়ে হাটের মাঝের বড়ো বড়ো গাছগুলির ছায়া আর জ্যোৎস্নার আলো মাড়িয়ে হাঁটতে লাগলো ঘাটের দিকে।

ঘাট এখন সুনসান; কেবল বাতাসের শব্দ, পারে ঢেউ ভাঙার মৃদু শব্দ। সারাদিন কাঠফাটা রোদে পোড়ানোর পর প্রকৃতি দারুণ সদয় হয়েছে, সন্ধের পর থেকেই বেশ জোরে বাতাস বইছে, জোলো বাতাস শরীর একেবারে জুড়িয়ে দিচ্ছে। একপাশে সামান্য ভাঙা মৃৎ-পাত্র আকৃতির চাঁদ চুইয়ে পড়া জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে ধরণী, নিখুঁত গোলাকার মৃৎ-পাত্রের রূপ নিতে চাঁদের আরো দিন কয়েক সময় লাগবে। তবু জ্যোৎস্নায় অনেকটা দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। হাটে এখন কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই, বিক্রেতারা বিপণী বন্ধ ফিরে গেছে।
গঙ্গাবক্ষে চিকচিক করছে চাঁদের আলো। বেশ দূর দিয়ে ভাটির দিকে একটা তরণী যাচ্ছে মশাল জ্বালিয়ে। জোর বাতাসে মশাল আছাড়ি-পিচাড়ি করছে। রাতের আহার শেষে তরণীর ছাদে একটা মাদুর বিছিয়ে বসেছে গিরিকা এবং তার কন্যারা। রাঁধনীরা নিচে হয়তো আহার করছে অথবা আহার শেষে ঘুমের আয়োজন করছে, রন্ধনশালা আর দাঁড়িদের কক্ষের প্রদীপের আলোর মৃদু প্রভা আবরণহীন বাতায়নের বাইরে ছড়িয়ে আছে জলের ওপর। দাঁড়িদের মধ্যে বলাই আর ললিত মাত্রই ঘুমোতে গেছে; আর রঘু, শ্যাম এবং সুকেতু ঘাটের কাছের গলুইয়ের দিকে বসে গল্প করতে করতে তামাক সেবন করছে। বেশ কিছুদিন পর তৃপ্তি করে হংসের মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছে সবাই।

সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে পেট পুরে খাওয়ার পর শরীর এখন ছেড়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর হাই তুলে রঘু বললো, ‘আমি যাই শুয়ে পড়ি গিয়ে। কাকভোরে যাত্রা করতে হবে। তোরাও শুয়ে পড়।’

সুকেতু বললো, ‘হা শুয়ে পড়বো এখনই। তুমি যাও।’

শ্যাম আর সুকেতু তরণীর গলুয়ের দিকের খোলা জায়গায়ই শয্যার আয়োজন করেছে। আয়োজন বলতে একখানা পাতলা হিমকন্থার ওপর দুজনের দুটো তেলচিটে উপাধান। শীত-বর্ষা ব্যতিত বছরের বাকি সময় ওরা এখানেই ঘুমায়। তাতে যেমনি নদীর খোলা হাওয়ায় শরীর জুড়োয়, তেমনি তরণী পাহাড়া দেওয়াও হয়। আর আজ ওদের পেটে দু-পাত্র পড়েছে, কতোক্ষণ বকবক করবে কে জানে! বকবক করতে করতে একসময় নিজেদের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়বে।

রঘু নিচ থেকেই গিরিকার উদ্দেশে বললো, ‘ভগিনী, আমি শয্যায় যাচ্ছি। আপনাদের কোনো ভয় নেই, শ্যাম আর সুকেতু বাইরে ঘুমাবে। কোনো প্রয়োজন হলে ওদের ডাকবেন।’

গিরিকা বললেন, ‘না প্রয়োজন আর কী আছে! তুমি ঘুমোও গিয়ে ভ্রাতা।’
রঘু চলে গেলে গিরিকা আবার কন্যাদের সঙ্গে গল্পে ফিরলেন, ‘কোথায় যেন ছিলাম?’

‘ওই যে কলিঙ্গদেশ হয়ে সু‏‏হ্মদেশের সমুদ্দুর উপকূলে নোঙর করেছিল তোমাদের তরণী।’ স্মরণ করিয়ে দিলো উমা।

‘ও হ্যাঁ, হায়, ভগবান বিষ্ণুর যে কী লীলা! সমুদ্দুর তো নয়, যেন এক অনন্ত জলরাশি! যতোদূর চোখ যায় কেবল নীল জল আর জল! আমি আমার বাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বাবু এর শেষ কোথায়?” বাবু বললেন, “এর কোনো শেষ নেই গো, এ এক অসীম জলরাশি!” সমুদ্দুর দেখে আমার ঘোর যেন আর কাটতেই চায় না! তবে সে জল দেখতেই সুন্দর, পান করা যায় না। খুব নোনা, স্নান করা যায় কেবল। সেখানকার মানুষও ভারী আশ্চর্যের, বেশিরভাগই কালো আর ভারী আমুদে। সমুদ্দুরকে কেন্দ্র করেই তাদের কতো রকম জীবিকা। আর শুধু কি সু‏হ্মদেশের মানুষ? কতো দেশের মানুষ কতোরকম বাহারী তরণী নিয়ে সেখানে যায়! কেউ যায় বাণিজ্য করতে, কেউ যায় প্রমোদবিহারে! সেখানকার গণিকাদের তো রমরমা অবস্থা! নানান দেশের নাগরদের দেওয়া কড়ি গোনার জন্যই তাদের একজন করে ভৃত্য রাখতে হয়! আমাদের তরণী যেখানে নোঙর করেছিল সেখান থেকে আরো পূর্বদিকে গেলেই নাকি বঙ্গদেশের এক বিশাল অরণ্য, সেখানে নাকি শত শত অতিকায় হস্তী, ব্যঘ্র, কুম্ভীরের বাস। ওখানেও নাকি মানুষ বিহার করতে যায়, আমার বাবুর হাতে সময় ছিল না বলে ওদিকটায় আর যাওয়া হয় নি।’

সুলোচনা বললো, ‘তুমি কতো ভাগ্যবতী গো মাসি। কতো দেশে বিহার করেছ!’
‘ভাগ্যে থাকলে একদিন তোরাও যেতে পারবি।’

কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো। উমা আর সুলোচনা মনে মনে চলে গেল সেই আশ্চর্য সু‏হ্মদেশে। সমুদ্দুরের নীল জল আঁজলায় নিয়ে মুখশ্রী ধোয় ওরা, জিহ্বায় নোনতা স্বাদ লাগে। শবরীর কল্পনায় নীল জলরাশি ভেসে উঠলেও সে ওদের মতো নিজেকে সেখানে নিয়ে গিয়ে আঁজলায় জল তুলে মুখশ্রী ধোয়ার মতো অতোটা স্বপ্নবিলাসী নয়, সে মন বিছিয়ে রাখে গঙ্গার বুকে। কারণ সে জানে, তার মাতা মুখে যতো মন ভোলানো কথাই বলুক না কেন, তাদেরকে কোনোদিনই কোনো বেনে বাবুর সঙ্গে অতোদূরে বিহার করতে যেতে দেবেন না। মাতা সবাইকে মুঠোয় চেপে কড়ি রোজগার করবে, বিহারে যেতে দিলে হাত ফসকে পড়া কড়ির মতো তারাও যদি ফসকে যায়!
অনেকদিন পর জলবিহারে এসে গিরিকার সেইসব সোনালি যৌবনের অজস্র স্মৃতি চাগাড় দিয়ে উঠছে। মনে পড়ছে সেইসব নাগরদের কথা যারা তার যৌবনের অমৃতসুধা পান করার বিনিময়ে বিত্ত-বৈভব, সুখ-স্বাচ্ছন্দে ভরিয়ে রেখেছিলেন তার জীবন। আজ তারা কোথায় কেমন আছেন তা জানেন না তিনি। অনেকেই আর বেঁচে নেই নিশ্চিত, আবার কেউ কেউ হয়তো বার্ধক্যে পৌঁছে তারই মতো যৌবনের স্মৃতি রোমন্থন করছেন একলা নিরালায়। তাদের কারো কারো হৃদয়পট্টে আজও হয়তো কামনার মতো সজীব এককালের সুনিপূণ কামশিল্পী রূপবতী যুবতী গিরিকার আলেখ্য।

কাকভোরে গঙ্গাপারের গাছগাছালিতে নানান রকম পাখির কিচির-মিচির শুনে ঘুম ভাঙতেই শবরী অনুভব করলো তার নাকটা বোজা বোজা লাগছে আর বাতায়ন দিয়ে প্রবেশ করা মিষ্ট বাতাস বিলি কাটছে শরীরে। অনভ্যস্ত পরিবেশে শরীরে সারারাত ধরে জোলো বাতাস লাগার কারণেই মাথাটা ভার ভার লাগছে আর একটু ঠাণ্ডা মতো লেগেছে। শয্যায় উঠে বসে বাতায়নে চোখ রাখলো সে, গঙ্গাবক্ষ থেকে একটু একটু করে অন্ধকার উবে যাচ্ছে। কপাট খুলে বাইরে বেরিয়ে একটুক্ষণ এদিক-ওদিক চাইলো, তারপর নিচের শৌচাগারে গিয়ে প্রাতঃকার্য সেরে, দন্ত মার্জন করে স্নানাগারে গিয়ে জলের পাত্র থেকে জল নিয়ে মুখ-মুখমণ্ডল-ঘাড়-গলা ধৌত করলো। তারপর সোজা উঠে এলো ছাদে, উড়নীর প্রান্ত দিয়ে ঘাড়-মুখের জল মুছলো। প্রভাতের গঙ্গাবক্ষের মিষ্টি বাতাস দারুণ উপভোগ্য মনে হলো তার কাছে। ছাদের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হাঁটতে লাগলো। দেখলো শ্যাম আর সুকেতু এখনো ঘুমোচ্ছে।

ভোরবেলার গঙ্গাবক্ষের এমন অপার সৌন্ধর্য শবরী আগে কখনোই এতো কাছ থেকে অবলোকন করে নি। শিশুর মতো আপ্লুত হয়ে চতুর্দিক অবলোকন করার পর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গভীর গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে অনুভব করলো তার সামনে যেন অসীম গঙ্গা আর ধরণীতে সে এখন একলা। মনে হলো এই মুহূর্তটি যদি জীবনে অনন্তকাল ধরে রাখা যেতো! যদি বার্ধক্য না থাকতো, জরা-ব্যাধি না থাকতো, দুঃখ-ক্লেশ না থাকতো; থাকতো কেবল এই যৌবন আর অপার সৌন্ধর্যময় এই মুহূর্ত, তাহলে কী ভাল-ই না হতো!

কাল রাতে মাতার মুখে শোনা মাতার যৌবনের কথা মনে পড়লো। একদিন মাতারও তার মতোই যৌবন ছিল, কালের ঘূর্ণাবর্তে আজ তা অতীতের স্মৃতিমাত্র। একদিন সেও মাতার মতো বৃদ্ধ হবে, কেশ শুভ্র হবে, চর্ম কুঞ্চিত হবে, সেও হয়তো তার কন্যাদের কাছে আজকের এই জলযাত্রার স্মৃতি রোমন্থন করবে। মাতার সেই সু‏হ্মদেশের সমুদ্দুর উপকূল আজও আছে, এই গঙ্গাও হয়তো অনন্তকাল প্রবহমান থাকবে; থাকবে গঙ্গার ভোর, মধ্যা‎হ্ন, অপরা‎‎‎হ্ণ, গোধূলি, অন্ধকার-জ্যোৎস্না রাত্রির ভিন্ন ভিন্ন সৌন্ধর্য। কেবল সে-ই থাকবে না। তার স্থলে থাকবে তার কন্যা, তারপর কন্যার কন্যা, এমনিভাবে অনাগতকালের কতো-শত কন্যা।

হঠাৎ পিছনে কারো পায়ের শব্দে তার ভাবনার ঘোর কাটলো, চমকালোও খানিকটা, তাকিয়ে দেখলো- শ্যাম! কী দুঃসাহস দাঁড়ির, তাকে একা দেখে তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, নিশ্চয় খারাপ উদ্দেশ্যে! শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে উদোম শরীরে, পরনে হাঁটুর উপরে তোলা শুভ্রতা খোয়ানো মলিন বস্ত্র। হাতে একটা পোটলা। শবরী ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্ত কয়েক পরই তার দিকে হাতের শালপাতার পোটলাটা নিঃশব্দে এগিয়ে দিলো শ্যাম।

‘এটা কী?’ জানতে চাইলো শবরী।

‘মণ্ডা।’ ভোরের মতোই শান্ত উত্তর দিয়ে শ্যাম শবরীর চোখ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে রাখলো মণ্ডার পোটলার ওপর।

আত্মলজ্জায় লজ্জিত হলো শবরী। কয়েক মুহূর্ত আগেই সে ভেবেছিল তাকে একা পেয়ে খারাপ উদ্দেশ্যে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে শ্যাম। নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানালো তার মনের ক্ষুদ্রতায় আর বিস্ময় জড়ানো কণ্ঠে বললো, ‘আমি তো রসিকতা করেছিলাম তোমার সঙ্গে, তুমি সত্যি সত্যি মণ্ডা নিয়ে এসেছো!’

শ্যাম কোনো কথা বললো না, একইভাবে তাকিয়ে রইলো মণ্ডার দিকে। মণ্ডা গ্রহণ করা উচিত হবে কি না কিংবা গ্রহণ না করলে শ্যাম দুঃখ পাবে কি না সেই বিবেচনা করতে কিছু কালক্ষেপণ হলো শবরীর। তার খুব খারাপ লাগলো এই ভেবে যে মানুষগুলো পরিবার-পরিজন ছেড়ে কতো পরিশ্রম করে কড়ি রোজগার করে, তার সামান্য রসিকতার জন্য শ্যাম নিজের ঘাম ঝরানো কড়ি দিয়ে মণ্ডা ক্রয় করে এনেছে। আফসোস হলো তার। আবার মুগ্ধও হলো শ্যামের সরলতা দেখে, আর ভীষণ ভাল লাগলো এই ভেবে যে আজ পর্যন্ত সে কোনো পুরুষের কাছ থেকে নিঃস্বার্থভাবে বা এমনি এমনি কোনোকিছু উপহার পায় নি। মূল্যবান উপহার এবং সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য সে বহুজনের কাছ থেকে বহুবার পেয়েছে, কিন্তু তার বিনিময়ে ভোগ করতে দিতে হয়েছে নিজের শরীর। শ্যামই প্রথম পুরুষ যে কোনো স্বার্থ ছাড়াই তার জন্য মণ্ডা ক্রয় করে এনেছে।

শ্যাম একইরকম শান্ত স্বরে বললো, ‘নিন।’

বাতাসে মুখের ওপর ঝুলন খেলা কেশগুলো হাত দিয়ে পিছনে দিলো শবরী। তারপর গ্রহণ করাই উচিত মনে করে শ্যামের হাত থেকে মণ্ডার পোটলাটা নিয়ে মৃদু হেসে বললো, ‘তুমি বড্ড ছেলেমানুষ দাঁড়ি, রসিকতাও বোঝো না!’

শ্যাম চোখ তুলে তাকালো শবরীর চোখের দিকে। শবরীর চোখে একজন নিখাঁদ সরল মানুষ দেখার মুগ্ধতা, শ্যামের চোখে বিপুল আনন্দের ঢেউ।


(চলবে......।)




সহায়ক গ্রন্থ

১. বেদ -অনুবাদ: রমেশ চন্দ্র দত্ত
২. মনুসংহিতা -অনুবাদ: সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. রামায়ণ -মূল: বাল্মীকি; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৪. মহাভারত -মূল: কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাস; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৫. কামসূত্র -বাৎসায়ন
৬. কথা অমৃতসমান (দ্বিতীয় খণ্ড) -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৭. দণ্ডনীতি -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৮. জীবনীকোষ ভারতীয়-পৌরাণিক -শ্রীশশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার
৯. দেবলোকের যৌনজীবন -ডঃ অতুল সুর
১০. ভারতে বিবাহের ইতিহাস -ড: অতুল সুর
১১. প্রাচীন ভারতে শূদ্র -রামশরণ শর্মা
১২. প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস -ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ
১৩. ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য -সুকুমারী ভট্টাচার্য


মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:১৭

রাজীব নুর বলেছেন: লেখাটা পড়ে খুব ভালো লেগেছে। আনন্দ পেয়েছি।
এই ধারাবাহিক সমস্ত ব্লগাদের পড়া উচিত।

০২ রা অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:০৫

মিশু মিলন বলেছেন: আনন্দ পেয়েছেন জেনে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

২| ০৩ রা অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৮:০০

আনমোনা বলেছেন: খুব সুন্দর। বই আকারে বেরুবে?

০৩ রা অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১২:১০

মিশু মিলন বলেছেন: কোলকাতা থেকে বই আকারে বের হতে পারে, আলোচনা চলছে। ধন্যবাদ।

৩| ০৩ রা অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:৩৫

শুভ_ঢাকা বলেছেন: আমিও বলবো খুব সুন্দর।

আপনি আমার আগের এক প্রশ্নের উওরে বলেছিলেন এই আখ্যানের সময়কাল রামচন্দ্রের জন্মের কিছুকাল পূর্বের। সেই সময় বিহারের মুঙ্গের বা ভাগলপুরে নিশ্চয়ই বাংলা ভাষার ব্যবহার ছিল না। তাহলে উক্ত অঞ্চলের মানুষ কোন ভাষার কথা বলতেন তা কি আপনার জানা আছে।

০৫ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:১১

মিশু মিলন বলেছেন: নিশ্চিত করে বলা কঠিন। হতে পারে আর্যরা হয়তো সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতো, আর অন্যান্য অনার্য জাতি তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতো। ধন্যবাদ।

৪| ১৯ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১:৪৫

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:



ব্রক্ষপুরাণে বর্ণিত সৃষ্টি তথ্য হতে দেখা যায় যে অঙ্গহতে সুনীথার গর্ভে একটি মাত্র পুত্র ‌উৎপন্ন হয় ।
মহরাজ বেন অত্যাচারী হওয়ায় তার প্রতি মহর্ষিগন ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিনাস সাধন করেন ,অত:পর মৃত
বেনের ডান হাত মন্থন করে এক প্রথিত যশা নরপতিকে তারা উতপন্ন করেন। তিনিই মহারাজ পৃথ্বু ।
তাই এই পর্বে বর্ণীত মহারাজ বেন ও পৃথ্বু সম্পর্কে কথামালায় একটু কনফিউজ্ড। যাহোক, বরাবরের
মত এ পর্বটিও ভাল লেগেছে।পরের পর্ব দেখতে গেলাম।

শুভেচ্ছা রইল

২০ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:৪১

মিশু মিলন বলেছেন: আমি সকল ঘটনার ক্ষেত্রে পুরাণ অনুসরণ করিনি। পুরাণের আখ্যান খুঁড়ে ইতিহাস বের করে আনার চেষ্টা করেছি। বেণকে আমার দৃষ্টিতে অত্যাচারী মনে হয়নি, আমার মতে বেণ সেই সমাজের মানুষের থেকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক মনস্ক ছিলেন। অনেক পুরোনো প্রথাকে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। আর এ কারণেই ব্রাহ্মণ এবং ঋষিদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আর কারো ডান হাত মন্থন করে কোনো মানুষ সৃষ্টি করা যায় না। আমার মনে হয়েছে পৃথু বেণের ঔরসজাত সন্তান। এটা আমার নিজস্ব ব্যাখা, আমার নিজের অনুসন্ধান।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.