নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
দশ
ভোরবেলায় স্বপ্ন দেখে যখন শবরীর ঘুম ভাঙলো তখন কৌশিকীর বক্ষ থেকে অন্ধকার মুছে গেছে, অরণ্যে পাখিরা কিচির-মিচির করছে, পাশে উমা তখনো ঘুমোচ্ছে। শবরী শয্যায় উঠে বসে বাতায়নের বাইরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো স্বপ্নের কথা। স্বপ্ন দেখেছে- সে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে কন্দুক নিয়ে খেলছে! মুনিকুমারের মস্তকে জটা আর মৃগের ন্যায় বৃহৎ একটি শৃঙ্গ, মুখে দাড়ি-গোঁফ। একবার সে কন্দুক ছুড়ে দিচ্ছে মুনিকুমারের দিকে, আবার মুনিকুমার তার দিকে ছুড়ে দিচ্ছে! এমনিভাবে খেলতে খেলতে কন্দুকটা হঠাৎ গড়িয়ে কৌশিকী নদীর জলে পড়ে যায়, তারা দুজন দৌড়ে আসে কন্দুকটি জল থেকে তোলার জন্য, কিন্তু ততোক্ষণে কন্দুকটি স্রোতে ভেসে চলে গেছে অনেক দূরে, দুজনেই মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকে ভাসমান কন্দুকের দিকে। আর তখনই শবরীর স্বপ্ন ভেঙে গেল গিরিকার ডাকে।
প্রাতঃকৃত্য শেষে গিরিকা আর সুলোচনা মিলে শবরীকে স্নানঘরে নিয়ে গিয়ে তার সর্বাঙ্গে পেষণ করা কাঁচা হলুদের প্রলেপ লাগালো, কিছুক্ষণ পর সাজিমাটি দিয়ে শরীর মার্জন করে এবং রিঠার রসে কেশ ধুয়ে স্নান করিয়ে গিরিকার কক্ষে নিয়ে এলো। গিরিকা আর সুলোচনা মাখন রঙের বহুমূল্য এবং এতোটাই সুক্ষ্ম অধিবাস ও বাস শবরীকে পরিয়ে দিলো যাতে স্তনবৃন্ত স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয় আর তা দেখে মুনিকুমারের চিত্তবিভ্রম ঘটে, এবং শবরীর ঊরুযুগল নয়নে কামাঞ্জন বুলিয়ে মুনিকুমারের সুপ্ত কামবাসনা ত্বরিত করে।
সুলোচনা অনেক যত্ন করে শবরীকে সাজাতে লাগলো; মুখে কুঙ্কুম-চন্দনের প্রসাধন লাগিয়ে দিলো, চোখে কাজল পরিয়ে দিলো, লাক্ষারসে রাঙিয়ে দিলো ঠোঁট।
গিরিকা কেশ বন্ধন করে খোঁপা বেঁধে দিতে চাইলেও শবরী কেশ উন্মুক্ত রাখতে চাইলো। এরপর গিরিকা তোরঙ্গ থেকে বহুমূল্য ভারী ভারী সুবর্ণ অলংকার বের করলো শবরীকে পরানোর জন্য। অলংকার দেখে শবরী বললো, ‘মা, তুমি এতো ভারী ভারী সুবর্ণ অলংকার বের করছো কেন? আমি একজন তপোধনকে প্রলোভিত করতে যাচ্ছি, রাজপুত্রকে নয়। তপোধনের কাছে সুবর্ণ অলংকারের চেয়ে পুষ্পালংকার অনেক মূল্যবান।’
‘তা বললে কী হয় মাতা! সুবর্ণ’র মূল্য সকলেই বোঝে তা হোক সে রাজকুমার কিংবা মুনিকুমার। পুষ্পের জৌলুস কী সুবর্ণ’র চেয়ে অধিক হয় কখনো!’
শবরী শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো, ‘কারো কারো কাছে হয়, যেমন আমার কাছে। আমি সুবর্ণালংকারের চেয়ে পুষ্পালংকারে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। তুমি কেবল ছোট্ট দানার একটিমাত্র সুবর্ণ মাল্য, কয়েকটি অঙ্গুরীয়, নাকপুষ্প আর রৌপ্য নুপূরজোড়া আমাকে দিয়ে বাকি সব অলংকার তোরঙ্গে রেখে দাও। এই স্বল্প সুবর্ণালংকার ধারণ করে আমি যদি তপোধনকে প্রলোভিত করতে ব্যর্থ হই তবে তুমি সুলোচনা কিংবা উমাকে প্রচুর সুবর্ণালংকারে সাজিয়ে পাঠিও।’
মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে গিরিকা ভাবলেন সব ব্যাপারেই হতচ্ছাড়ীর ভিক্ষুকের স্বভাব প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, তার নিজের স্বভাবের ছিটে-ফোঁটাও পায় নি। ক্ষত্রিয়টারও তো বীরের স্বভাব ছিল, বিলাস-ব্যসনে মন ছিল; কন্যা এমন ভিক্ষুকের স্বভাব পেলো কেন কে জানে, নাকি ক্ষত্রিয়টার রক্তে শূদ্রদোষ ছিল! অপ্রসন্নতা গোপন করে গিরিকা বললেন, ‘সুবর্ণালংকার পরবি না তা আগে বললেই পারতি, এখন পুষ্পালংকার কোথায় পাই?’
‘আমি ভোরবেলায় রাঁধুনীদের পাঠিয়ে অরণ্য থেকে পুষ্প আনিয়েছি। উমা আর উলুপী পুষ্পালংকার তৈরি করছে।’
তারপর সুলোচনার উদ্দেশে বললো, ‘সখি, দেখে আয় তো উমার পুষ্পালংকার তৈরি শেষ হলো কি-না।’
সুলোচনা চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পর উমার সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করলো। উমার হাতের ডালায় হরেক রকম পুষ্পালংকার-পুষ্পহার, পুষ্পমাল্য, পুষ্পবালা, পুষ্পমেখলা প্রভৃতি। উমা এবং সুলোচনা একে একে পুষ্পালংকার এবং স্বল্প সুবর্ণালংকারে সাজাতে লাগলো তাদের প্রিয় সখিকে। সবশেষে সুলোচনা ভিন্ন ভিন্ন সুগন্ধি নির্যাস মাখিয়ে দিলো শবরীর পরিচ্ছদ, উন্মুক্ত কেশ এবং শরীরের অনাবৃত অংশে।
গিরিকা মেঝেতে বসে সঙ্গে নিয়ে আসা এবং রাঁধুনীদের বানানো নানা রকম মিষ্ট, মণ্ডা, পিষ্টক, পায়েস, নবনী, ক্ষীর, সর প্রভৃতি সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য রৌপ্যথালায় সাজাতে লাগলেন। থালার একপাশে রাখলেন একটি সু-স্বাদু মদ্যপাত্র।
ওদিকে রঘু গিয়েছিল মহর্ষি বিভাণ্ডককে পর্যবেক্ষণ করতে, ফিরে এসে কপাটের বাইরে দাঁড়িয়ে জানালো, ‘ভগিনী, মহর্ষি ফল সংগ্রহ করতে গেছেন, মাতাকে এখনই আশ্রমের পথে নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে।’
গিরিকা বললেন, ‘বেশ, যাত্রা শুরু করো।’
রঘু গিয়ে হাল ধরলো, দাঁড়িরাও সময়ক্ষেপণ করলো না। নদীর বাঁকটা পেরিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই আশ্রমের পথের মুখে তরণী নোঙর করলো। অতুলনীয় সাজে সজ্জিত শবরী রতিদেবীকে স্মরণ পূর্বক তাঁর উদ্দেশে ঊর্ধ্বমুখে প্রণাম করে খাদ্যদ্রব্য আর পানীয় দিয়ে সাজানো রৌপ্যথালা হাতে তুলে নিয়ে কপাটের বাইরে পা রাখলো, তরণী থেকে নামার সময় স্মিতহাস্যে গিরিকা এবং সখিদের দিকে একবার মাত্র তাকালো।
শবরী যেমনি জানে এই যাত্রা তার শেষযাত্রা হতে পারে, তার পদক্ষেপে একটু ভুল হলে কিংবা কোনো প্রকার ভুল না হলেও মহর্ষি বিভাণ্ডকের রোষে তার প্রাণসংশয় হতে পারে, তেমনি তার দিকে চেয়ে তরণীতে দাঁড়িয়ে থাকা গিরিকা এবং সখিরাও তা জানে। তাই উভয়েরই চিত্ত দূর্বল হতে পারে ভেবে ভূমিতে পদার্পণ করার পর আর একবারও পিছনে তাকালো না সে, ভূমিতে অপেক্ষমাণ শ্যামের দিকে নির্ভরতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘চলো দাঁড়ি।’
তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল আশ্রমের পথ ধরে।
শবরী আর শ্যামকে নামিয়ে দিয়ে রঘু এবং অন্য দাঁড়িরা তরণী ঘুরিয়ে পুনরায় পূর্বের স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। আশ্রমের পথ ধরে শবরীর পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো শ্যাম। শবরীর পরিধেয় অধিবাস এবং বাস এতোটাই সুক্ষ্ম যে শ্যাম পিছন থেকেও তাকাতে সংকোচবোধ করছে, সে ভূমির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। তার মনে শঙ্কা জাগছে, এমন সুন্দর কন্যাটি জীবন নিয়ে ফিরতে পারবে তো আশ্রম থেকে? এমন সুন্দর শরীর ভস্ম হয়ে যাবে না তো মহর্ষির অভিশাপে? আর তার নিজেরই বা কি হবে? শবরী মহর্ষির রোষানলে পড়লে সে কি রক্ষা পাবে? তারপর নিজেই এক ফুৎকারে নিজের জীবনের ভয় উড়িয়ে দিয়ে ভাবে- আমার আবার জীবন, অভিশপ্ত নিষাদ জীবন, থাকলেই কী আর না থাকলেই বা কী!
আশ্রমের পথটি ছায়াময়, দু-পাশে অরণ্যের উঁচু বৃক্ষরাজি। কিছুদূর এগোনোর পরই দৃষ্টিগোচর হলো আশ্রমের পথের দু-পাশে ছোট-বড়ো নানা জাতের পুষ্পের গাছ- কুন্দ, করবী, কদম, কৃষ্ণচূড়া, নীল ও শ্বেত অপরাজিতা, বেলি, বকুল, দোলনচাঁপা, শিউলি, মালতী, নাগেশ্বর, গুঞ্জা ইত্যাদি। দেখেই অনুমিত হয় যে এই পুষ্পগাছগুলি প্রাকৃতিকভাবে জন্মে নি, নিশ্চয় মহর্ষি বিভাণ্ডক আশপাশের অরণ্য এবং অন্যত্র থেকে চারা সংগ্রহ করে এনে পথের দু-ধারে রোপণ করেছেন। কুন্দ, রক্তকরবী, শ্বেতকরবী, কৃষ্ণচূড়া, বেলি, দোলনচাঁপা পুষ্পগাছে শোভা পাচ্ছে নয়ন জুড়োনো-চিত্ত আমোদিত করা পুষ্প।
শ্যাম শবরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাম দিকের অরণ্যে প্রবেশ করলো, অরণ্যের ভেতর দিয়ে হেঁটে আশ্রমের পথ থেকে অন্তত দেড়শো কদম দূরে একটা বড়ো চন্দন বৃক্ষের আড়ালে লতা-গুল্মের ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতর ছায়াচ্ছন্ন এমন এক জায়গায় লুকিয়ে বসলো যাতে আশ্রমের পথে প্রবেশ করলে সে মহর্ষি বিভাণ্ডককে দেখতে পেলেও তিনি যেন কোনোভাবেই তাকে দেখতে না পান। ভাল মতো দৃষ্টি রাখার জন্য মুখের সামনের লতা-গুল্মের পুরু দেয়াল টেনে ছিঁড়ে সামান্য ফাঁকা করলো সে। তারপর মৃদু শব্দে কয়েকবার কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে গুপ্তচরের ন্যায় অপেক্ষা করতে লাগলো।
রৌপ্যথালা হাতে শবরী কণ্ঠে সামগীতের সুর আর শরীরে কল্লোল তুলে ক্রমশ এগিয়ে চললো আশ্রমের পরিপাটী পথ ধরে, কমনীয় শরীর থেকে বাতাসে ছড়াতে লাগলো সুগন্ধি আর পুষ্পের সৌরভ! কিছুদূর এগোনোর পর তার চোখে পড়লো গৌড়বর্ণের এক সুদর্শন যুবক মুনিকুমার আশ্রমের পথের একপাশে রক্ষিত একটা মাঝারি আকৃতির শিলাখণ্ডের ওপর বসে কিছু একটা মুখে পুরে চিবোচ্ছে আর তার পায়ের কাছে বসে কদলী কামড়াচ্ছে এক বানর শাবক। কদলী আহার শেষ হলে বানর শাবকটি এক লাফে মুনিকুমারের ঊরুর ওপর উঠে বসলো, আর ডান হাত দিয়ে মুনিকুমারের ছোট ছোট অপুষ্ট দাড়ি খুঁটতে লাগলো। অচেনা কণ্ঠস্বরে গীত আর নুপূরের ঝমর ঝমর শব্দ শুনে মুনিকুমার এবং বানর শাবক উভয়েই তাকালো শবরীর দিকে, উভয়ের চোখেই বিপুল বিস্ময়! বানর শাবকটি দাড়ি খোঁটা বাদ দিয়ে একবার মুনিকুমারের দিকে আরেকবার শবরীর দিকে তাকাতে লাগলো।
ক্রমশ মুনিকুমারের সঙ্গে শবরীর দূরত্ব কমছে, গীতের শেষোক্ত পংক্তির সুর মিলিয়ে গেছে বাতাসে। মুখে বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর নৈঃশ্বদ হাসি ছড়িয়ে রাখলেও শবরী দ্বিধান্বিত। কে এই সুদর্শন যুবক মুনিকুমার, যার কৈশোর উত্তীর্ণ গৌড়বর্ণ মুখমণ্ডলে অপুষ্ট ছোট দাড়ি-গোঁফ থাকা সত্ত্বেও মুখশ্রীতে এখনো লুকিয়ে আছে নিষ্পাপ কিশোরসুলভ সৌন্ধর্য? হালকা বাদামী চোখ দুটো যেন মায়া সরোবর! তীক্ষ্ণ নাক, রক্তাভ চঞ্চু, কপাল এবং বাহুতে নিখুঁত হাতের শুষ্ক চন্দন আর মাথার ঈষৎ জটালো কেশ নিপুণ হাতে চূড়ো করে বাঁধা। লম্বা বাহুযুগল আর আশ্চর্য সুন্দর পরিমিত তার দেহসৌষ্ঠব। উল্লোল বুক এখনো ততোটা রোমশ নয়, যেন মনে হচ্ছে বানর শাবক নিয়ে খেলা করারই বয়স তার। পরনে সুতিবস্ত্রের চীর, বাহু এবং গলায় বীজমাল্য। পা দুটি নগ্ন। ইনিই কি ঋষ্যশৃঙ্গ? কিন্তু তা কী করে হয়? এই মুনিকুমারের মাথায় তো শৃঙ্গ নেই! সে তো শুনেছে ঋষ্যশৃঙ্গ’র মাথায় শৃঙ্গ বিদ্যমান। তবে কি ইনি ঋষ্যশৃঙ্গ’র কোনো সহোদর কিংবা সহচর? কিন্তু সে তো শুনেছে মহর্ষি বিভাণ্ডক আর তার পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ ব্যতিত আশ্রমে অন্য কেউ থাকেন না। তাহলে ইনি কে, আর ঋষ্যশৃঙ্গ-ই বা কোথায়? শবরীর ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে সে কী করে ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলোভিত করবে!
মুনিকুমার তার ঊরুর ওপর উপবেশন করা বানর শাবকটিকে ভূমিতে নামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শবরীর প্রতি করজোরে প্রণাম জানালো। শবরীর হাতে থালা থাকায় সে করজোর করে প্রতি প্রণাম জানাতে পারলো না বটে কিন্তু মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে বললো, ‘তপোধন, আপনি আমাকে অভিবাদন করবেন না, আপনিই আমার অভিবাদনের যোগ্য। আমি এসেছি মহর্ষি বিভাণ্ডক এবং তার পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ’র মঙ্গল সমাচার জানতে।’
‘আমি মহর্ষি বিভাণ্ডকের পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ, পিতাশ্রী এখন আশ্রমে নেই। তিনি অরণ্যে ফল সংগ্রহ করতে গেছেন।’
শবরীর চোখে-মুখে বিস্ময়, ইনিই তবে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ! কিন্তু তার মাথার শৃঙ্গ কোথায়? তাকে তো বলা হয়েছে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গের মাথায় শৃঙ্গ আছে। অথচ এই মুনিকুমারের মাথায় তো কেবল চূড়ো করে বাঁধা সুন্দর ঈষৎ জটালো কেশ! মুনিকুমার নিশ্চয় নিজের পরিচয় গোপন করে তাকে মিথ্যে বলছে না। তবে কি শৃঙ্গের কথাটা নিছকই জনশ্রুতি! ঋষিদের সম্পর্কে যতো সব অদ্ভুত-অতিমানবীয় কথা লোকের মুখে মুখে লোকালয়ে ছড়ায়, তার সবই কি তবে মানুষের অলীক কল্পনা? ঋষিরা কারো প্রতি ক্ষুব্ধ হলে তাকে অযুত বৎসর বৃক্ষ কিংবা শিলাখণ্ডে রূপান্তরিত করার কথাও কি তবে অতিরঞ্জন? নিশ্চয় মৃগযোনিতে মুনিকুমাররের জন্মকথাও মিথ্যে, মৃগযোনিতে আবার মানব শিশু প্রসব করে নাকি! নিশ্চয় এসবই মানুষের তিলকে তাল, তালকে ভূমণ্ডল ভাবার নির্বোধ প্রবণতা! অথচ নির্বোধের মতো সেও মানুষের কথা বিশ্বাস করেছে। মানুষের এবং নিজের বির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে তার হাসি পেলো কিন্তু হাসির বহিঃপ্রকাশ তীব্র হলো না। মৃদু হেসে বললো, ‘তপোধন, আপনারা মঙ্গলময় আছেন তো?’
ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘নিশ্চয়।’
‘এই অরণ্যের পশুপখি, বৃক্ষলতা, সকলেই সুখে আছে নিশ্চয়?’
‘ঈশ্বরের কৃপায় সকলেই মঙ্গলময় আছে।’
‘অরণ্যে থাকতে আপনাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? যথেষ্ট পারিমাণে ফলমূল, স্বাদু জল আছে কি?’
‘আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না মহামান্য। এই অরণ্য সারা বৎসর অকৃপণভাবে বিপুল পরিমাণ ফল উৎপাদন করে আমাদেরকে লালন করছে। স্বাদু জলেরও কোনো অভাব নেই, অদূরে ঝিরিতে পাহাড়ী ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জল আছে, প্রবল গ্রীষ্মেও যার জলধারা অব্যাহত থাকে। মহামান্য, আপনি জ্যোতিঃপুঞ্জের ন্যায় দীপ্তিমান, জ্যোৎস্নার ন্যায় স্নিগ্ধ আপনার হাসি, অন্ধকারের ন্যায় আপনার দীঘল কেশরাশি, পক্ষীর ন্যায় সুমিষ্ট আপনার কণ্ঠস্বর, স্বর্গীয় উদ্যান নন্দনকাননের ন্যায় আপনার গাত্র থেকে সুগন্ধ বিকশিত হচ্ছে! আপনি কি কোনো দেবতা? নিশ্চয় স্বর্গ থেকে এসেছেন?’
চঞ্চুতে আরেক প্রস্থ নীরব জ্যোৎস্না ছড়িয়ে শবরী বললো, ‘আমি কোনো দেবতা নই তপোধন, আমি আপনারই মতো একজন তপস্বী।’
‘আপনার কল্যাণ হোক তাপস। অনুগ্রহ করে আপনি আমাদের আশ্রমে পদধুলি দিন।’
‘চলুন তপোধন।’
ঋষ্যশৃঙ্গ আগে আগে, তার পিছনে বানর শাবক, আর সবশেষে হাঁটতে লাগলো শবরী। কিছুদূর যাবার পর বানর শাবকটি পথের অনতিদূরে অরণ্যের ভেতর ছুটে গেল তার মাতার কাছে। শবরী হাঁটতে হাঁটতে পিছন থেকে দেখতে লাগলো ঋষ্যশৃঙ্গকে। উমা তার কাছে সংশয় প্রকাশ করেছিল, ‘ঋষিরা সাধনায় মগ্ন থাকার কারণে দিনের পর দিন স্নান করে না, ঋষিদের গাত্র-পরিচ্ছদ নিশ্চয় মলিন থাকে, ধূলিধূসরিত জটায় নাকি উঁকুন থাকে আর গাত্রে দূর্গন্ধ হয়; মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গও নিশ্চয় তেমনই হবেন!’
অথচ ঋষ্যশৃঙ্গ ঠিক যেন উল্টো! যেমনি আশ্চর্য সুন্দর তার দৈহিক সৌন্ধর্য, তেমনি পরিচ্ছন্ন তার গাত্র! পরিধেয় সুতির গৈরিক চীরের কোথাও নেই একচিলতে ময়লা। মাথার ঈষৎ জটালো সুন্দর কেশে ধূলির লেশমাত্র নেই। স্নানের পরের স্নিগ্ধতা বিদ্যমান তার সর্বাঙ্গে। শবরীর মুগ্ধ দৃষ্টি ঘুরছে ঋষ্যশৃঙ্গ’র জটালো কেশের চূড়ো, অনাবৃত পৃষ্ঠদেশ হয়ে নগ্ন পায়ে, এমনকি ঋষ্যশৃঙ্গ’র পৃষ্ঠদেশের ডানপাশের নিচের দিকের ক্ষুদ্র একটি তিলও তার দৃষ্টির উপেক্ষা পায় নি!
বাঁশ দিয়ে নির্মিত আশ্রমের প্রবেশদ্বার আচ্ছাদিত নানা প্রকার বুনো পুষ্পলতায়, থোকা থোকা পুষ্প ঝুলছে তাতে। আশ্রমে প্রবেশ করে দু-চোখ যেন জুড়িয়ে গেল শবরীর! মৃৎ-প্রাচীরের ওপর ছনে ছাওয়া পরিপাটী কুটীর, সামনে দেহলী ও প্রশস্ত বর্গাকৃতি আঙিনা। আঙিনার দক্ষিণকোনে কুটীরের দেহলী-ঘেঁষা একটি দাড়িম্বগাছে ঝুলছে ছোট ছোট দাড়িম্ব ফল, উত্তরদিকের দেহলী থেকে খানিকটা দূরত্বে একটি পুষ্পবতী নাগেশ্বর। পূর্বদিকে প্রবেশদ্বারের ডান পাশে একটি জলভরা মৃৎ-কলসি এবং ছোট্ট একটি ঘড়া। দক্ষিণ-পূর্বকোনে একটি ঝাঁকড়া তুলসীগাছ, আর পিছনে ছোট ছোট আরো কয়েকটি চারা; পাশেই একটি কুন্দগাছে ফুটে আছে অসংখ্য শুভ্র পুষ্প। এছাড়া আশ্রমের চতুর্দিকে মাথা তুলে আছে চন্দন, বকুল, রক্তন; কিছুটা দূরে শাল, তমাল, ছাতিম, হিজল প্রভৃতি বৃক্ষ ছায়াবৃত করে রেখেছে আশ্রমকে। আঙিনার দক্ষিণদিক থেকে অপর একটি পথ অরণ্যের ভেতর দিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে পাহাড়ী ঝিরির কাছে। পিতা-পুত্র এ পথেই ঝিরিতে যায় স্নান এবং পানীয় জল সংগ্রহ করার জন্য।
ঋষ্যশৃঙ্গ মাটির ঘড়ায় পা ধোয়ার জল এনে নিজ হাতে শবরীর পা ধুয়ে দিলো। শবরী মনে মনে ভাবলো- মুনিকুমার একে তো ব্রাহ্মণ, তার ওপর তপস্বী, তার মতো পাতকিনীর পায়ে হাত দেওয়ায় তার পাপ হবে না তো? আবার পরমুহূর্তেই ভাবলো যে সে নিজেও এখন তপস্বীর অভিনয় করছে, এখন পাপ-পূণ্যের কথা ভাবলে চলবে না, নিখুঁত অভিনয় করতে হবে। সে হাতের থালা দেহলীতে রাখলো। ঋষ্যশৃঙ্গ কুটীরে প্রবেশ করে কৃষ্ণাজিনাবৃত সুখাসন এনে দেহলীতে পেতে দিয়ে বললো, ‘অনুগ্রহ করে উপবেশন করুন তাপস, আপনি আমার বন্দনীয়, পাদ্য-ফলমূল দিয়ে আমি আপনার যথাবিধি সৎকার করবো।’
শবরী বাধা দিয়ে বললো, ‘আপনি ব্যস্ত হবেন না তপোধন।’
‘তাপস, আমি আপনাকে পক্ক ভল্লাতক, আম্র, আমলক, করূষক, ইঙ্গুদ, ধন্বন ও প্রিয়রক ফল দিচ্ছি; আপনি ইচ্ছে মতো আহার করুন।’
‘আমায় ক্ষমা করবেন তপোধন, আমার স্বধর্ম এই যে আমি অভিবাদন এবং পাদ্য জল গ্রহণ করতে পারি না। আমি আমার তপশ্চর্যার রীতি অনুযায়ী আপনার সঙ্গে ব্রত পালন করবো আর আপনাকে এই উত্তম খাদ্য আহার এবং পানীয় পান করাবো। আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?’
‘আপনি আমার অতিথি তাপস, আপনার তপশ্চর্যায় সহযোগিতা করাই আমার কর্তব্য।’
‘আপনার কল্যাণ হোক তপোধন।’
‘তাপস, আপনি কোন ব্রত পালন করছেন? আপনার আশ্রম কোথায়?’
‘ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের অপর দিকে আমার মনোরম আশ্রম। সেখানেই আমি তপশ্চর্যা করি। আপনার মতো তাপসগণ আমার আশ্রমে আসেন, আমি তাদেরকে অভিবাদন করি। তাদের সঙ্গে আমি রতিব্রত পালন করি।’
‘এই ব্রত’র নাম পূর্বে কখনো শুনি নি। এই ব্রত’র নিয়ম কী, কখন পালন করতে হয়?’
‘রতিব্রত’র অনেক নিয়ম বিদ্যমান, বিবিধ এর প্রয়োগরীতি। রতিব্রত’র আবার কিছু উপব্রত আছে, যেমন-আলিঙ্গনব্রত, চুম্বনব্রত, মুখমৈথুনব্রত, নখক্ষতব্রত, দন্ত-দংশনব্রত ইত্যাদি; এসকল ব্রত’র সমন্বয়েই অনুষ্ঠিত হয় রতিব্রত। দিবারাত্রির যে কোনো সময়েই রতিব্রত পালন করা যায়, তবে সূর্যাস্তের পর থেকে রাত্রি শেষ প্রহর পর্যন্ত সময়কাল রতিব্রত’র জন্য উত্তম এবং আনন্দদায়ক।’
‘রতিব্রত পালনে কী ফল হয়?’
‘রতিব্রত পালনের ফলেই ভূমণ্ডলে প্রাণিকুল টিকে থাকে। রতিব্রত পালন না করলে ভূমণ্ডলের সকল প্রাণি বিলুপ্ত হবে।’
‘অতি উত্তম এবং প্রাণিজগতের কল্যাণের জন্য আপনার এই রতিব্রত। আমি আপনার ব্রত পালন করতে চাই, জানতে চাই আপনার তপশ্চর্যার নিয়মকানুন এবং গূঢ় তত্ত্ব। অনুগ্রহ করে আপনি আমাকে রতিব্রত শিক্ষা দিন তাপস।’
শবরী মৃদু হেসে বললো, ‘নিশ্চয় তপোধন, আমি আপনাকে রতিব্রত শিক্ষা দেব। রতিব্রত’র প্রাথমিক রীতি অনুসারে এখন আমি আপনার সঙ্গে আলিঙ্গনব্রত এবং চুম্বনব্রত পালন করবো।’
শবরী ঋষ্যশৃঙ্গের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে দিয়ে পুনরায় বললো, ‘আপনি আমার আরো নিকটে আসুন তপোধন, আমি আপনার হস্ত স্পর্শ করতে চাই।’
ঋষ্যশৃঙ্গ দূরত্ব ঘুচালে শবরী তার দুই হাত ধরে ঈষৎ চাপ প্রয়োগ করে চুম্বন করলো হাতে; ঋষ্যশৃঙ্গের চোখে চোখ রেখে নিজের কণ্ঠের সুগন্ধ পুষ্পমাল্য খুলে পরিয়ে দিলো তার গলায়, তাকে আরো কাছে টেনে চোখে চোখ রেখে, ললাটে ললাট স্পর্শ করে ললাটিকা আলিঙ্গন করলো। তারপর লতার ন্যায় বাহুবন্ধনে জড়িয়ে লতা বেষ্টিতক আলিঙ্গন করার পর ঋষ্যশৃঙ্গের মুখ নিরীক্ষণ করে পরপর চলিতক এবং সভৌষ্ঠ-চুম্বন করতে লাগলো মৃদু শীৎকার সহযোগে। চুম্বনের ফাঁকে এক মুহূর্ত বিরতি পেয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘তাপস আমার দারুণ হর্ষ হচ্ছে! এটা কী ব্রত?’
‘চুম্বন ব্রত।’
এরপর শবরী ঋষ্যশৃঙ্গের কাঁধে মাথা রেখে ঘাড়ে ঠোঁট স্পর্শ করে কখনো তার পিঠে-নিতম্বে, কখনো ঘাড়ে-মাথায় শিথিল হাতের পরশ বুলাতে লাগলো। কোমল স্তনযুগলের চাপ প্রয়োগ করলো ঋষ্যশৃঙ্গের বুকে। কয়েক মুহূর্ত পর শবরী অনুভব করলো ঋষ্যশৃঙ্গের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ ছন্দ হারাচ্ছে, ত্বকের নিচের লোহিত সাগরে ঢেউ উঠছে আর তাকে অনুকরণ করে সে-ও তার ঘাড়ে ঠোঁট স্পর্শ করে পিঠে-নিতম্বে, ঘাড়ে-কেশারণ্যে হাতের পরশ বুলাচ্ছে। ঋষ্যশৃঙ্গের নিবিড় স্পর্শ তার নিজের সংযমের বাঁধেও চিড় ধরাচ্ছে বুঝতে পেরে সে ঋষ্যশৃঙ্গকে আলিঙ্গনমুক্ত করলো।
আবার ঋষ্যশৃঙ্গের প্রশ্ন, ‘এটা কী ব্রত তাপস?’
‘আলিঙ্গনব্রত।’
বলেই দু-হাতে ঋষ্যশৃঙ্গের মুখ ধরে তার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে পুনরায় সভৌষ্ঠ-চুম্বন করলো। একইভাবে অনুকরণ করে ঋষ্যশৃঙ্গও তার কপালে এবং ঠোঁটে চুম্বন করলো।
তারপর ঋষ্যশৃঙ্গকে কৃষ্ণাজিনাবৃত সুখাসনে উপবেশন করিয়ে শবরী নিজেই কুটীরের ভেতরে গিয়ে একটা জল ভরা মৃত্তিকা ঘড়া আর জল পানের পাত্র নিয়ে এলো। পাত্রে জল ঢেলে নিজে হাত ধুয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে জলপান করালো। দুজনের মাঝখানে থালা রেখে নিজ হাতে একে একে ঋষ্যশৃঙ্গ’র মুখে তুলে দিলো মিষ্ট, মণ্ডা, পিষ্টক, পায়েস, নবনী, ক্ষীর, সর প্রভৃতি সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য। শরীরের চঞ্চলতা কাটিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ পরম তৃপ্তিতে আহার করতে করতে মিষ্ট ও মণ্ডাকে ফল ভেবে বললো, ‘অতি সুস্বাদু আপনার এই ফল! আমাদের অরণ্যে এমন ত্বক আর বীজবিহীন ফল নেই।’
ঋষ্যশৃঙ্গ শিশুর মতোই সরল এবং শিশুর মতোই ভূ-মণ্ডলের অনেক বিষয় সম্পর্কেই সে অজ্ঞাত। এমন শিশুসুলভ একজন মুনিকুমারকে মিথ্যে বলতে এবং ছলনার মাধ্যমে তাকে প্রলোভিত করতে শবরীর বিবেক ভীষণ আহত হলেও তাকে মিথ্যা আর ছলনার আশ্রয়ই নিতে হচ্ছে। অকারণে জিভ দিয়ে ওপরের ঠোঁট চেটে সে বললো, ‘আমাদের আশ্রমে এরকম আরো অনেক প্রকার ত্বকবিহীন উত্তম ফল আছে। আপনি কখনো আমাদের আশ্রমে তপশ্চর্যা করতে গেলে সে-সব ফল দিয়ে আমি আপনার সৎকার করবো।’
আহার শেষ হলে ঋষ্যশৃঙ্গ তৃপ্তির ঢেকুর তুললো, শবরী পাত্রের জল ঢেলে প্রথমে নিজের হাত ধুয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ’র মুখ মুছে দিলো। এরপর পাত্রটি জলশূন্য করে তাতে মদ্য ঢেলে উঠে গিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ’র ডানপাশে তার গায়ে গা ঘেঁষে বসে মুখের কাছে মদ্যপাত্র ধরে বললো, ‘আমাদের আশ্রমের সুস্বাদু পানীয়, পান করে তৃপ্তি লাভ করুন।’
শবরী কখনো ঋষ্যশৃঙ্গ’র চিবুক ধরে, কখনো তার কাঁধে কিংবা পিঠে বাঁ হাতের মৃদু স্পর্শ বুলিয়ে মদ্যপান করাতে লাগলো। পরপর কয়েক পাত্র মদ্য পান করার পর ঋষ্যশৃঙ্গ পুলক অনুভব করে বললো, ‘এই জলের স্বাদও আমাদের ঝিরির জলের মতো নয়, একটু অন্যরকম; পানের পর দারুণ পুলক অনুভূত হচ্ছে!’
ঋষ্যশৃঙ্গকে মদ্যপান করানোর ফাঁকে ফাঁকে শবরী নিজেও কিছুটা মদ্যপান করলো। ঋষ্যশৃঙ্গ’র গালে চুম্বন করে তার কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর ঋষ্যশৃঙ্গ’র হাত ধরে টেনে তুলে দেহলী থেকে নিয়ে এলো আঙিনায়। ঋষ্যশৃঙ্গ’র পা ঈষৎ আন্দোলিত, শবরীর হাত শক্ত করে ধরে হাসতে হাসতে বললো, ‘তাপস, আমি জীবনে এমন আশ্চর্য জল পান করি নি। আমার মস্তকের অভ্যন্তরে কেমন যেন অনুভূত হচ্ছে, বোধ হচ্ছে আমি যেন হাওয়ায় ভাসছি, ভীষণ হর্ষ অনুভব করছি আমি!’
‘আমিও হর্ষ অনুভব করছি তপোধন। ইচ্ছে করছে আপনাকে নিয়ে অজানা কোনো দেশে উড়ে গিয়ে তপশ্চর্যা করি!’
‘খুব হাস্য করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার।’
‘হাসুন তপোধন, আপনার যেমন খুশি উপভোগ করুন আমার সঙ্গ।’
ঋষ্যশৃঙ্গ হাসতে হাসতে বললো, ‘তাপস, ভূ-মণ্ডল কী আবর্তিত হচ্ছে? আমি ভূমিতে লুটিয়ে পড়বো না তো?’
‘আমি আপনার হাত ধরে আছি, আপনি ভূ-পতিত হবেন না তপোধন। প্রয়োজনে আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরুন, যতো খুশি আমার সঙ্গে চুম্বন-আলিঙ্গন ব্রত পালন করুন।’
ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে ঘাড়ে চুম্বন করে বললো, ‘তাপস, আপনার কেশে আশ্চর্য সুগন্ধ!’
শবরী ঋষ্যশৃঙ্গের বাহুবন্ধনে থেকেই নিপুণভাবে পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার গালে গাল ঘষতে লাগলো, বারবার কেশের স্পর্শ দিতে লাগলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র নাকে-মুখে; ঋষ্যশৃঙ্গ’র হাত নিয়ে নিপুণতার সঙ্গে স্পর্শ করালো নিজের অনাবৃত কোমল পেট, নাভিমূল এবং ক্ষীণ কটিতে। পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ’র দুই হাত নিজের দুই স্তনে রেখে মৃদু চাপ প্রয়োগ করলো আর লক্ষ্য করলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র গৌরবর্ণ মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে।
হঠাৎ ঋষ্যশৃঙ্গকে আবর্তিত করে নৃত্য-গীত করতে লাগলো শবরী। তার নূপুরের নিনাদ, গীতের সুর আর থেকে থেকে হাতের তালির শব্দে আশ্রমের অন্যসকল প্রাণির কণ্ঠস্বর আচমকা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল! নৃত্যের ছন্দে ছন্দে সে নিজের শরীরের পুষ্পালংকার ছিঁড়ে পাপড়ি ছুড়ে দিতে লাগলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র শরীরে। টলটলায়মান পায়ে ঋষ্যশৃঙ্গ দু-হাত বাড়িয়ে বারবার তাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। সে কখনো ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে নৃত্য করছে, কখনো ঋষ্যশৃঙ্গ’র বাহুবন্ধনে ধরা দিয়ে লতার ন্যায় তাকে জড়িয়ে ধরে হাতের মুঠোয় পুষ্প পাপড়ি নিয়ে পেষণ করছে ঋষ্যশৃঙ্গ’র মুখে-গলায়-বক্ষে, কখনো-বা নিজেই কামোত্তেজিত হয়ে উন্মাদিনীর ন্যায় ঋষ্যশৃঙ্গ’র মাথা নিজের বক্ষে চেপে ধরে যেন উপড়ে ফেলতে চাইছে তার মাথার কেশ কিংবা ক্ষতবিক্ষত করতে চাইছে তার পৃষ্ঠদেশ।
হঠাৎ টাল সামলাতে না পেরে দুজনই ভূ-পতিত হলো। বিপুল হর্ষে হাস্য করতে করতে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে গড়াতে লাগলো ভূমিতে, ধুলিধূসরিত হলো দুজনের সর্বাঙ্গ। ঋষ্যশৃঙ্গ’র কেশবন্ধন খুলে গেল। পাত্রে আবদ্ধ জল যেমনি স্বধর্ম না বুঝে স্থির থাকে, কিন্তু ভূমিতে পড়া মাত্র স্বধর্ম অনুযায়ী নিজেই নিজের গড়িয়ে যাবার পথ চিনে নেয়; তেমনি মদনদেবের পঞ্চবাণে জর্জরিত কামার্ত ঋষ্যশৃঙ্গও যৌবনের ধর্ম অনুযায়ী ক্রমশ যেন চিনতে শুরু করেছে রতিব্রত’র অজানা পথ! দুজনের হাত, মাথা, বক্ষ, কোমর, ঊরুযুগল আর পা চাল এবং তিলের ন্যায় মিলিত হয়ে রচিত হলো তিলতণ্ডুলক আলিঙ্গন।
শবরী দু-দিকে পা রেখে শায়িত ঋষ্যশৃঙ্গ’র শরীরের ওপর উপবেশন করে পিঠ সামনে বেঁকিয়ে স্তনযুগল ঋষ্যশৃঙ্গ’র বক্ষে জোরে চেপে ধরে স্তনালিঙ্গন করলো। বাঁ-হাতের মুঠোয় ঋষ্যশৃঙ্গ’র জটালো কেশ ধরে তন্ময় হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে ডান হাতের তর্জনীর অগ্রভাগ দিয়ে আলতোভাবে স্পর্শ করতে লাগলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র ঠোঁট-কপোল-চিবুক। ঋষ্যশৃঙ্গও একইভাবে বাঁ-হাতে শবরীর কেশ মুঠো করে ধরে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে শবরীর ঠোঁট-কপোল-চিবুক স্পর্শ করে বললো, ‘তাপস, অপূর্ব আপনার ব্রত। আমার গাত্র ভীষণ দগ্ধ হচ্ছে, আমার গাত্রাভ্যন্তরে বিপুল হর্ষের নিমিত্ত আমি অস্থির হয়ে আছি, আপনি আমার সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে চুম্বন এবং আলিঙ্গন ব্রত পালন করুন।’
ক্রমশ শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র শরীরের ওপর শয়ন করে পায়ে পা ঘষতে লাগলো এবং একে অন্যকে উত্তর-চুম্বন করতে থাকলো। ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘তাপস, শাল্মলী তুলার ন্যায় আপনার কোমল বক্ষ আমার বক্ষে, আপনার কটিদেশ আমার কোটিদেশে এমনিভাবে চেপে রাখুন। তাপস, ভূ-মণ্ডলের সকল ব্রতের চেয়ে আপনার ব্রতই শ্রেষ্ঠ, আপনি আমার পরম গুরু!’
তারপর শবরী ভূমিতে শয়ান হয়ে হিমকন্থার ন্যায় শরীরের ওপর টেনে নিলো ঋষ্যশৃঙ্গকে। ঋষ্যশৃঙ্গ দু-হাতে শবরীর মুখশ্রী ধরে অবিরাম সম্পুট-চুম্বন করতে করতে শবরীর ডান জঙ্ঘায় নিজের দুই জঙ্ঘা পেষণ করে ঊরুপণ্ডহন করতে লাগলো।
ঋষ্যশৃঙ্গকে আপনা-আপনিই ঊরুপণ্ডহন করতে দেখে শবরীর ইচ্ছে জাগলো তার দেহসমুদ্রের আরো গভীরে তাকে অবগাহন করাতে, মৈথুনের সুখ দিতে; কামকলার যতো প্রকার কৌশল সে জানে তার সকল প্রকার প্রয়োগ করার ব্যাকুল বাসনা উঁকি দিলো মনের মধ্যে। ইচ্ছে হলো শিশুর ন্যায় রতিবিদ্যা সম্পর্কে অজ্ঞাত ঋষ্যশৃঙ্গকে সুনিপুণভাবে রতিবিদ্যার সকল পাঠ শিখিয়ে তার পৌরুষের ঘুম ভাঙিয়ে তাকে পুরুষ বানাতে। মনে হলো অনন্তকাল যদি সে ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে এই আশ্রমে থেকে যেতে পারতো, একে অন্যকে ভালবেসে কাটিয়ে দিতে পারতো অসংখ্য দিবস-রজনী, যদি ঋষ্যশৃঙ্গ’র ঔরসে তার গর্ভে সন্তানলাভ হতো, তবে ধন্য হতো তার নারী জীবন। পুরুষসঙ্গ লাভের এমন ব্যাকুল বাসনা পূর্বে কখনোই তাকে এতোটা তাড়িত করে নি। ঋষ্যশৃঙ্গ’র মাঝে যেন এক আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তি আছে যা তার দেহ-মনকে টলিয়ে দিচ্ছে, ক্রমশ তার সংযম ভেঙে পড়ছে!
অকস্যাৎ কানে ভেসে এলো কোকিলের কুহুতান, সচকিত হলো শবরী, আশ্রমের পথের দিক থেকেই ভেসে আসছে। এ নিশ্চয় আসল কোকিলের কণ্ঠ নয়, শ্যামের অনুকরণের স্বর। হ্যাঁ, তাই তো, পরপর তিনবার কুহুতান, তেমনটাই বলেছিল শ্যাম। তারপর কয়েক মুহূর্তের বিরতি দিয়ে আবার তিনবার, এমনিভাবে বারবার কোকিলের স্বরে ডাকার কথা শ্যামের। নিশ্চয় মহর্ষি বিভাণ্ডক এসে পড়েছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঋষ্যশৃঙ্গকে ছেড়ে যেতে হবে, ঋষ্যশৃঙ্গের ঊরুপণ্ডহনের লীলা তাকেই ভঙ্গ করতে হবে। কামোপহত ঋষ্যশৃঙ্গকে রেখে তার যেতে ইচ্ছে করছে না। ঋষ্যশৃঙ্গ তাকে দুর্নিবার আকর্ষণ করছে, যেন অন্তর্জালে আবদ্ধ করে রেখেছে তাকে। কিন্তু সে নিরুপায়, তাকে দ্রুত পালাতে হবে এখন থেকে, নইলে সমূহ বিপদ হবে তার।
ঋষ্যশৃঙ্গকে ঠেলে নিজের দেহের ওপর থেকে নামিয়ে পুনরায় ভূমিতে শয়ান করিয়ে উঠে বসলো শবরী, পায়ের নূপুর জোড়া একটানে ছিঁড়ে হাতে রাখলো, যাতে তার চলার সময় নূপুরের শব্দ মহর্ষি বিভাণ্ডকের কানে না পৌঁছয়। সুখারোহণ চ্যূত ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীর হাত ধরে বললো, ‘তাপস, আমার ভীষণ হর্ষ হচ্ছিল। আপনি পুনরায় ভূমিতে শয়ান করে লতার ন্যায় আমাকে আলিঙ্গন করুন। ভূমিতে শয়ান করে আলিঙ্গনব্রত পালন ভীষণ হর্ষজনক, আমার ভীষণ উপস্থসুখ হচ্ছিল।’
শবরী ঋষ্যশৃঙ্গের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে জলভরা চোখে শেষবারের মতো তার কপালে চুম্বন করে উঠে দাঁড়ালো আর পনুরায় তাকে আবির্তিত করে নৃত্য করতে লাগলো। ঋষ্যশৃঙ্গ দৃষ্টি ঘুরিয়ে শবরীকে দেখতে দেখতে বললো, ‘অপূর্ব আপনার নৃত্য তাপস! ভীষণ সুখকর আপনার রতিব্রত! আমি আপনার কাছে আরো রতিব্রত শিখবো। ব্রত শেষে আমি আপনাকে গুরুদক্ষিণা প্রদান করবো। তাপস, আপনি আমায় স্পর্শ, আমার গাত্র দগ্ধ হচ্ছে।’
শবরী নৃত্য করতে করতে তার শরীরের অবশিষ্ট পুষ্পমাল্য ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছিন্ন পাপড়ি শায়িত ঋষ্যশৃঙ্গ’র মুখে ছুড়ে দিতেই ঋষ্যশৃঙ্গ জন্য চক্ষু নিমীলিত করলো আর এই সুযোগে সে তড়িৎ বেগে আশ্রমের দক্ষিণের ঝিরিমুখী পথের দিকে অন্তর্হিত হলো।
নিমীলিত চোখে ঋষ্যমৃঙ্গ বললো, ‘তাপস, আপনি পুনরায় ভূমিতে শয়ান করে লতার ন্যায় আমাকে হর্ষজনক আলিঙ্গন করুন। তাপস….’
কামোপহত ঋষ্যশৃঙ্গ চোখ খুলে দেখলো শবরী নেই, চতুর্দিকে দৃষ্টি বুলালো কিন্তু তার দৃষ্টি শবরীকে খুঁজে পেলো না! ভূমি থেকে উঠে বসতে বসতে বললো, ‘তাপস, আপনি আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন! শৈশবে পিতাও আমার সঙ্গে এরূপ লুকোচুরি খেলতো। তারপর আমি ঠিকই গৃহকোন কিংবা বৃক্ষের আড়াল থেকে পিতাকে খুঁজে বের করতাম। আমি আপনাকেও খুঁজে বের করবো।’
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে পুনরায় বসে পড়লো ঋষ্যশৃঙ্গ, তারপর দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় উঠে দাঁড়ালো। আন্দোলিত পায়ে হাসতে হাসতে বললো, ‘তাপস, আমি আপনাকে খুঁজে বের করবোই!’
শিশুসুলভ আনন্দে আশ্রমের নানাদিকে শবরীকে খুঁজলো ঋষ্যশৃঙ্গ, কিন্তু কোথাও পেলো না। অরণ্যের সূর্যের মতোই আকস্মিক মিলিয়ে গেল তার মুখের হাসি, ডাকতে ডাকতে কোনো সাড়া না পেয়ে হতাশ এবং ব্যথিত চিত্তে ভূমিতে বসে পড়লো। শবরীর ফেলে যাওয়া এক টুকরো পুষ্পমাল্য ভূমি থেকে কুড়িয়ে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকতে শুকতে পুনরায় চিৎ হয়ে শুয়ে কেঁদে ফেললো, ‘তাপস, আপনি কোথায়? আমার গাত্র দগ্ধ হচ্ছে, আমাকে লতার ন্যায় হর্ষজনক আলিঙ্গন করুন। আপনাকে গুরুদক্ষিণাও প্রদান করা হয় নি। গুরুদক্ষিণা প্রদান না করলে আমার নরকবাস হবে। তাপস, আপনি কোথায়?’
ফল সংগ্রহ করে আশ্রমে ফিরে এসে মহর্ষি বিভাণ্ডক দেখলেন তার প্রিয় পুত্র ধূলিধূসরিত দেহে নিমীলিত চোখে ভূমিতে শয়ন করে ছিন্ন এক টুকরো মলিন পুষ্পমাল্য নিজের মুখে-কণ্ঠে-বক্ষে ঘষতে ঘষতে প্রলাপ বকছে! পুত্রের শরীর এবং মুখশ্রী রক্তিমবর্ণ এবং স্থানে স্থানে নখের আঁচড়ের লালচে দাগ, উত্থিত লিঙ্গের প্রভাবে তরণীর পালের ন্যায় স্ফীত তার পরনের চীর! আশ্রমের আঙিনা ধূলিময় আর এখানে-সেখানে ছড়ানো পুষ্পের পাপড়ি, দেহলীতে রাখা রৌপ্যথালা এবং মদ্যপাত্রও তাঁর চোখে পড়লো! এই দৃশ্য মহর্ষি বিভাণ্ডকের কাছে অকল্পনীয়, বিস্ময়কর! বিভাণ্ডক তৎক্ষণাৎ অনুধাবন করলেন, নিশ্চয় আশ্রমে কোনো নারীর আগমন ঘটেছিল, যে নারী তার পুত্রকে বিভ্রান্ত করে গেছে। তিনি ফলের ঝুড়ি নামিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ’র কাছে বসতেই ওর মুখ থেকে তাঁর নাকে ভেসে এলো মদ্যের গন্ধ। ঋষ্যশৃঙ্গ’র হাত ধরলে রক্তবর্ণ চক্ষু মেলে ধরলো সে।
তিনি বললেন, ‘তুমি ভূমিতে শয়ন করেছ কেন পুত্র? ওঠো।’
ঋষ্যশৃঙ্গ ব্যথিত দৃষ্টিতে পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিভাণ্ডক হতবিহ্বল পুত্রকে ভূমি থেকে টেনে তুলে উপবেশন করিয়ে পুনরায় বললেন, ‘পুত্র, তোমার সর্বাঙ্গ ধূলিময়, তুমি এমন বিচলিত আর কাতর হয়ে আছো কেন?’
কাতর কণ্ঠে ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘পিতাশ্রী, আমি গুরুদক্ষিণা দিতে পারি নি। আমার কী পাপ হবে?’
ঋষ্যশৃঙ্গের মুখের শব্দ কিছুটা জড়ানো। ছিন্ন পুষ্পমাল্য এখনো তার হাতে। বিভাণ্ডক তার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘কাকে গুরুদক্ষিণা দিতে পারো নি বৎস? কে এসেছিল আশ্রমে?’
‘একজন ব্রহ্মচারী এসেছিলেন পিতাশ্রী। দেবপুত্রের ন্যায় তার সৌন্ধর্য। তিনি আকারে অধিক দীর্ঘ নন আবার খর্বও নন। গোধূলিকালের পশ্চিম আকাশের ন্যায় তার গাত্রবর্ণ, রৌদ্রের ন্যায় উজ্জ্বল তার হাসি। পদ্মপলাশতুল্য আয়ত তার চক্ষু। তার মাথার জটা আমাদের জটার ন্যায় জড়ানো আর মোটা নয়; সুতোর ন্যায় চিকন এবং সুদীর্ঘ, নির্মল কৃষ্ণবর্ণ আর অতি সুগন্ধযুক্ত। তার গলার মাল্যের সঙ্গে ঝোলানো আকাশের বিদ্যুতের ন্যায় গোলাকার একখণ্ড বস্তু। আর তার বক্ষও আমাদের বক্ষের ন্যায় নয়; তার রোমহীন বক্ষে শাল্মললী তুলোর ন্যায় কোমল অতি মনোহর দুটি মাংসপিণ্ড, যার স্পর্শে বিপুল হর্ষ হয়। তার কটি পিপীলিকার মধ্যভাগের ন্যায় ক্ষীণ, পরিধেয় বস্ত্র অদ্ভুত এবং এতোই সুক্ষ্ম যে বস্ত্র ভেদ করে তার শরীরের সর্বত্র দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। আমাদের জপমাল্যের ন্যায় তার চরণের অতিসুন্দর মাল্য এক আশ্চর্য শ্রুতিমধুর শব্দ করছিল। তার কণ্ঠের গীতের সুর কোকিলের কণ্ঠের চেয়েও সুমিষ্ট, তার বাক্য ও গীত শুনলে কর্ণ এবং চিত্তে সুখানুভুতি হয়। তিনি নিজ হাতে এমন আশ্চর্য ধরনের সুমিষ্ট ফল আমাকে আহার করিয়েছেন যার ত্বক এবং বীজ নেই, আমাদের এই অরণ্যে তেমন ফল একটিও নেই। তার প্রদত্ত জল আমাদের ঝিরির জলের মতো স্বাদহীন নয়, অতি সুস্বাদু! সেই জল পান করে আমার বিপুল হর্ষ হচ্ছে এখনো, মনে হচ্ছে যেন ভূ-মণ্ডল ঘুরছে! জানেন পিতাশ্রী, তার এই ব্রতের নাম রতিব্রত, অতি আশ্চর্য আর সুখকর। আপনি আমায় যে-সব ব্রত শিক্ষা দিয়েছেন, তাতে কোনো হর্ষ নেই। কিন্তু তার ব্রত আমাকে বিপুল হর্ষ দিয়েছে। আমার গাত্র এখনো দগ্ধ হচ্ছে আর গাত্রাভ্যন্তরে কেমন যেন বোধ হচ্ছে। আমি তার সঙ্গে চুম্বনব্রত এবং আলিঙ্গনব্রত পালন করেছি, তাতে আমার বিপুল হর্ষ হয়েছে। হঠাৎ তিনি আমাকে ফেলে কোথায় যেন অন্তর্হিত হলেন, দেখুন এই সুগন্ধ মাল্য তিনি নিজ হাতে আমাকে পরিয়ে দিয়েছেন। পিতাশ্রী সেই তাপসের প্রতি আমার দারুণ অনুরাগ জন্মেছে, তার বিরহ আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। আমার গাত্রভ্যন্তরে অগ্নি জ্বলছে। পিতাশ্রী, আমি তার কাছে যাব। আমি তার সঙ্গে রতিব্রত পালন করবো।’
অদেখা নারীর প্রতি তীব্র ক্রোধ এবং ঘৃণা জন্মালেও পুত্রের সম্মুখে তা প্রকাশ না করে চিত্ত স্থির রেখে বিভাণ্ডক বললেন, ‘শান্ত হও বৎস। যে তোমার কাছে এসেছিল সে কোনো তাপস নয়, সে রাক্ষসী। এই রাক্ষসীরা মনোহর রূপ ধারণ করে এসে তপস্বীদের তপস্যায় বিঘ্ন ঘটায়। তাদের মায়াজালে পা দিলে তপস্বীরা পথভ্রষ্ট হয়, স্বর্গলাভ হয় না। তাই ওই সকল রাক্ষসীদের দিকে তপস্বীদের দৃষ্টিপাত করা অনুচিত পুত্র। এই পুষ্পমাল্য তুমি কণ্ঠ থেকে খুলে ফেলে দাও, রাক্ষসীদের উপহার আমাদের ব্যবহার করা উচিত নয়।’
বলে বিভাণ্ডক নিজেই পুত্রের কণ্ঠ থেকে পুষ্পমাল্য খুলতে গেলে বাধা দিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘পিতাশ্রী, তিনি যদি রাক্ষসী হবেন, তবে তিনি আমাকে ভক্ষণ করার বদলে কেন আমাকে সুখানুভূতি প্রদান করলেন?’
‘পুত্র তুমি এখন অপ্রকৃতস্থ। প্রকৃতস্থ হলে আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবো। ওঠো, তোমাকে স্নান করিয়ে তোমার গাত্রে গঙ্গাজল ছিটিয়ে মন্ত্রপাঠ পূর্বক তোমাকে পবিত্র করতে হবে।’
বিভাণ্ডক পুত্রকে ভূমি থেকে তুলে নিজের কাঁধে তার শরীরের অনেকটা ভর বহন করে হাঁটতে লাগলেন ঝিরির দিকে স্নানের উদ্দেশ্যে।
(চলবে......)
সহায়ক গ্রন্থ
১. বেদ -অনুবাদ: রমেশ চন্দ্র দত্ত
২. মনুসংহিতা -অনুবাদ: সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. রামায়ণ -মূল: বাল্মীকি; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৪. মহাভারত -মূল: কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাস; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৫. কামসূত্র -বাৎসায়ন
৬. কথা অমৃতসমান (দ্বিতীয় খণ্ড) -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৭. দণ্ডনীতি -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৮. জীবনীকোষ ভারতীয়-পৌরাণিক -শ্রীশশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার
৯. দেবলোকের যৌনজীবন -ডঃ অতুল সুর
১০. ভারতে বিবাহের ইতিহাস -ড: অতুল সুর
১১. প্রাচীন ভারতে শূদ্র -রামশরণ শর্মা
১২. প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস -ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ
১৩. ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য -সুকুমারী ভট্টাচার্য
০৯ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:৫১
মিশু মিলন বলেছেন: শবরী নামটা আমারও খুব পছন্দের। ধন্যবাদ।
২| ০৯ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:১৫
শুভ_ঢাকা বলেছেন: Honeytrap! আমি কয়েকটা পর্ব পড়েছি। ওয়াও! আমি সময় করে সব পর্ব পড়বো।
১০ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:৪৫
মিশু মিলন বলেছেন: হুম, আধুনিক ভাষায় তাই। ধন্যবাদ।
৩| ১৯ শে অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৭:৩৪
ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
পর্বটি বেশ সুখপাঠ্য ।
ঋষ্যশৃঙ্গকে শবরী প্রদর্শিত রতিব্রত চমৎকার ভাবে বিবৃত হয়েছে।
সঠিক রতিক্রিযা পদ্ধতি না জানার দরুণ কত কত জীবনই না ব্যর্থতার গ্লানিতে ভরে উঠতেছে!
কত অসুখী স্বামী-স্ত্রী’ই না এর জন্য চরম দুঃখময় জীবনকে বরণ করে নিচ্ছেন।
সাধারণ মানুষে মনে করে রতিব্রত চর্চা পাপ ; উহা হতে বিরত থাকাই শুদ্ধমপাপবিদ্ধং পুৰুষের লক্ষণ ।
কিন্তু প্রকৃত কথা ঠিক তার বিপরীত, বিজ্ঞান সন্মত রতিক্রিয়া না জানাই অসুস্থ-মানসিক বিকাশের লক্ষণ।
হাজার হাজার বৎসর পূর্বেও ভারতবর্ষে কামসুত্র নিয়ে আলােচনা হত ও কামবিজ্ঞান সম্বন্ধে অনেক
শাস্ত্রগ্রন্থও রচিত হইয়াছিল, তন্মধ্যে বাৎসায়নের কামসুত্র’ আজও বর্তমান আছে।
পরের পর্ব দেখার জন্য চললাম ।
২০ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:১৬
মিশু মিলন বলেছেন: হাজার হাজার বছর আগে যৌনতার বিষয়ে ভারতবর্ষের মানুষ অনেক উদার ছিল। কামসূত্র’র মতো বই তখন লেখা হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সেই পরম্পরা ধরে রাখা যায়নি। আজকের দিনে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও যৌনতার বিষয়ে অনেক ট্যাবু। চিন্তুার দিক দিয়ে আমরা যেমন এগিয়েছি, তেমনি পিছিয়েওছি।
©somewhere in net ltd.
১| ০৮ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১১:০৯
রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। শবরি নামটা সুন্দর।