নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- এগারো)

০৯ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:৫৬

এগারো

মহর্ষি বিভাণ্ডক একা একা দিকভ্রান্তের ন্যায় অরণ্যে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, গত দু-দিনও তিনি এমনিভাবে হেঁটে অরণ্য চষে বেড়িয়েছেন সেই নারীর খোঁজে যে তাঁর একমাত্র পুত্রকে পথভ্রষ্ট করতে আশ্রমে এসেছিল। সেই প্রভাতে আশ্রম থেকে বেরিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন অরণ্য, আর একবারে ফলমূল সংগ্রহ করে আশ্রমে ফিরেছেন মধ্যা‎হ্ন গড়িয়ে গেলে। কিন্তু কোথাও তিনি কোনো নারী তো দূরের কথা কোনো মানুষের দর্শনও পান নি। তাহলে কে তাঁর পুত্রের দেহ অপবিত্র এবং চিত্ত বিভ্রান্ত করে দিয়ে গেল? এই প্রশ্ন তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে, দুশ্চিন্তায় তিনি রাতে ঘুমাতে পারছেন না। কেবলই মনে হচ্ছে তিনি পুত্রকে হারিয়ে ফেলবেন না তো? এতোদিন তিনি পুত্রের সামনে নারী শব্দটি উচ্চারণমাত্র করেন নি, উদরের ক্ষুধা ব্যতিত পুত্র দেহের ক্ষুধা সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু হঠাৎ-ই সে কোনো এক পাতকিনীর গন্ধ-স্পর্শ পেয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, বিরহে কাতর হয়ে আছে। তিনি তাকে অনেক বুঝিয়েছেন যে কোনো রাক্ষস মানুষের বেশে এসে তাকে বিভ্রান্ত করে গেছে, পুত্র তাঁর কথা বিশ্বাস করেছে কিন্তু তারপরও সে বিমনা হয়ে থাকে, ভুলতে পারে না নারীদেহ স্পর্শের সুখানুভূতি। সেই পাতকিনীর কথা স্মরণ হলেই তার কামবাসনা জাগ্রত হয়, তখন সে অপ্রকৃতস্থের ন্যায় আচরণ করে। শাস্ত্রে অমনোযোগী হয়ে পড়েছে, তপশ্চর্যায় ভুল করছে, আহারে তার মন নেই; মনে হয় যেন তার দেহটাই কেবল আশ্রমে আছে কিন্তু মনটা হারিয়ে গেছে সেই পাতকিনীর মাঝে! তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে পুত্রকে পর্যবেক্ষণ করেন আর তাঁর হৃদয় ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে যায় পুত্রের ভবিষ্যৎ চিন্তায়। পুত্র কোনোদিন তপশ্চর্যার পথ ছেড়ে, তাঁকে ছেড়ে সেই নারীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে না তো? কিংবা সেই নারী যদি পুনরায় আশ্রমে আসে? ভাবতেই ক্ষোভে তাঁর গাত্র দগ্ধ হয়, চক্ষু ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় অনল। সেই পাতকিনীকে পেলে মহাশাস্তি দেবেন তিনি যাতে আর কোনোদিন আশ্রমমুখী না হয়। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ অভিযান চালিয়েও যখন তিনি কোথাও খুঁজে পেলেন না কোনো নারীকে, তখন তাঁর অন্তরে প্রশ্ন জাগলো, এই নারী আসলেই কি মানবী, না কি অন্য কিছু?

অরণ্য চষে ব্যর্থ এবং পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরে ঝিরির শীতল জলে হাত-মুখ ধুয়ে আঁজলায় জল তুলে তৃষ্ণা মিটালেন বিভাণ্ডক, তারপর ঝিরি আর কৌশিকীর মিলনস্থলের পাশে একটা শিলাখণ্ডের ওপর উপবেশন করে দৃষ্টি ছুড়ে দিলেন কৌশিকীর অপর পারে অথবা শূন্যে। জল পানের পর তাঁর শ্রান্তি কিছুটা দূর হলেও প্রশ্নটি বারবার তাঁকে বিদ্ধ করছে, কে এই নারী? তিনি কোনো দেবী নয় তো, কিংবা স্বর্গের অপ্সরী! দেবতারা অনেক সময়ই ঋষিদের ঈর্ষা করেন। ঋষিরা তপশ্চর্যায় সিদ্ধিলাভ করলে স্বর্গে গিয়ে যদি ইন্দ্র কিংবা অন্য কোনো দেবতার পদ দাবী করেন, তাই প্রায়শই কূট-বুদ্ধির দেবতারা ঋষিদের কাছে সুন্দরী অপ্সরীদের পাঠিয়ে তাদেরকে কামোত্তেজিত করে তপশ্চর্যা ভণ্ডুল করার চেষ্টা করেন আর কখনো কখনো সফলও হন। এ-ও দেবতাদের তেমন কোনো অভিসন্ধি নয় তো যে তার পুত্রের তপশ্চর্যায় ভীত হয়ে তারা তাকে বিপথগামী করতে অপ্সরী পাঠিয়েছিলেন? শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বাসেই স্থির হলেন তিনি যে এ নিশ্চয় কোনো মন্দবুদ্ধির দেবতার কার্য, আর সিদ্ধান্ত নিলেন এখন থেকে পুত্রকে তিনি চোখে চোখে রাখবেন। ফলসংগ্রহ করতে গিয়ে অধিক সময়ক্ষেপণ করবেন না। যতোটা সময় পারেন, পুত্রকে সঙ্গ দেবেন। পুত্রকে আরো অধিক সময় তপশ্চর্যায় ব্যস্ত রাখবেন। নইলে নারীর সংস্পর্শে তার প্রিয় পুত্র বিনষ্ট হবে। অতীতে নারীর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে অনেক তপস্বীর জীবন উচ্ছন্নে গেছে, এখনো যাচ্ছে। নারীর প্রলোভন সামলাতে না পেরে কেউ কেউ এখন বিবাহ করে সংসার যাপন করছেন, কেউ-বা তপস্যা ছেড়ে সংসারে ফিরে গিয়েও প্রশান্তি লাভ করতে পারেন নি, শেষে আত্মদহনের জ্বালায় পাগল হয়ে গেছেন কিংবা আত্মহত্যা করেছেন। তার প্রিয় পুত্রেরও তেমন গতি হোক তা তিনি চান না। তার নিজের তপশ্চর্যাও অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে, নয়তো তিনিও আজ সংসারী হয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে জনপদে বাস করতেন কিংবা পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াতেন। নারীর প্রতি আকর্ষণ যে কী দুর্নিবার তা তিনি নিজে জানেন। কঠোর তপশ্চর্যা এবং নিয়মানুবর্তিতায় আবদ্ধ থেকেও তিনি একবার ভুল করেছিলেন, জীবনে একবারই মোহগ্রস্ত হয়ে নারীসঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিলেন, যার ফসল পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ। বহু কষ্ট আর সাধনার চেষ্টায় নারীর প্রতি তাঁর লালসা আর মোহাচ্ছন্নতা দূর করেছিলেন। তখন তিনি বুঝেছিলেন যে পুরুষের পেশি শক্তির জোর থাকতে পারে কিন্তু আদতে নারীর কাছে পুরুষ স্রোতের মুখের পিপীলিকার ন্যায়! অনেক শক্তিমান যোদ্ধাও নারীর কাছে শিশুর ন্যায় সরল ও দুর্বল হয়ে যেতে পারে! তাই তিনি নিজেকে ওই স্রোত থেকে দূরে রেখে নির্বিঘ্নে তপশ্চর্যা করতেই লোকালয় থেকে অনেক দূরের এই বিজন অরণ্যে আশ্রম গড়েছেন। তবু বহু বৎসর আগের সেই স্মৃতি আজও তাঁকে তাড়া করে। উর্বশীর শারীরিক সৌন্ধর্য আর তার কামকলার নিপুণ পারদর্শিতার কথা স্মরণ হলে এখনো শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করেন।

তখন তিনি তারুণ্যের প্রান্ত অতিক্রম করে সবে মাঝবয়সের অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ আঙিনায় পা রেখেছেন। এরই মধ্যে তার তপস্যার খ্যাতি ঋষিদের মুখ থেকে জনপদেও ছড়িয়েছে। দীর্ঘদিন নিবিড় তপশ্চর্যার পর শ্রান্ত হয়ে তিনি এক বসন্তের অপরা‎হ্ণে এক মহাহ্রদে স্নান করছিলেন, হ্রদের অনতি দূরেই ছিল তাঁর আশ্রম। তার গৌড়বর্ণ শরীর এবং বক্ষ চওড়া হলেও দীর্ঘদিন স্বল্পাহার এবং স্নানবিহীন কঠোর তপশ্চর্যার ফলে শরীর তখন ধুলো মলিন এবং বক্ষ শীর্ণ হয়েছে। মুখভর্তি লম্বা দাড়ি-গোঁফ থাকা সত্ত্বেও তপশ্চর্যাজনিত কারণে চোয়ালের হাড়ের বৈসাদৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়, চোখ কোটরাগত হলেও দৃষ্টিতে বুদ্ধিদৃপ্তির ছাপ। হ্রদের কোমর জলে দাঁড়িয়ে মাথার মলিন জটার বন্ধন খুলে দিতেই দড়ির মতো লম্বা লম্বা জটাগুলো ছড়িয়ে পড়লো পিঠের ওপর। আচমন করে অঘমর্ষণ মন্ত্রপাঠের পর ডুব দিতেই শীতল জলের স্পর্শে যেন তাঁর সকল শ্রান্তি দূর হয়ে যায়। কাঁধের উত্তরীয়ের প্রান্ত দিয়ে কচলে ধুয়ে ফেলেন শরীরের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ময়লা। পুনরায় ডুব দিয়ে ওঠার পর আঁজলা ভরে আয়নার মতো স্বচ্ছ জল নিয়ে জপ করেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর পান করেন পর পর কয়েক আঁজলা স্বাদু জল। জল এতোই স্বচ্ছ যে হ্রদের তলদেশও পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হয়! তিনি হ্রদের তলদেশে দেখতে পান সবুজ জলজ উদ্ভিদ, রঙ-বেরঙের ছোট ছোট মৎস্য, একটি কাঁকড়া এবং একটি ছোট কচ্ছপ। ওদের নির্ভীক প্রাণবন্ত চলন ভীষণ ভাল লাগে তাঁর, দু-নয়ন ভরে তিনি উপভোগ করেন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণির অকৃত্রিম সৌন্ধর্য। ওপর থেকে তাকিয়ে দেখেন, এমনকি জলে ডুব দিয়েও দেখেন। কয়েকটি ছোট মৎস্য কৌতুহলবশত তার পায়ে ঠোকরাতে থাকে, হয়তো ওরা কোনোদিনও এতোবড় গৌড়বর্ণ প্রাণি দেখে নি! অনেকদিন পর তিনি জীবনের স্পন্দন টের পান, অনেকদিন পর তিনি অন্য জীবনের সান্নিধ্য পান। এতোদিন যেন ভূ-মণ্ডলে তিনি একাই ছিলেন!

নিপুণ নৈঃশব্দে হ্রদের ছোট ছোট ঢেউ ভাঙতে থাকে তাঁর শরীরে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে, আর তিনি হ্রদের চৌদিকের অপার সৌন্ধর্য অবলোকন করতে থাকেন। চতুর্দিকে সবুজ বৃক্ষরাজি, বৃক্ষরাজির ছায়া পড়েছে হ্রদের বুকে। মাঝে মাঝে কিছু পুষ্পবতী পলাশ আর শাল্মলী বৃক্ষ যেন শরীর থেকে সবুজ বস্ত্র খুলে অনাবৃত লাস্যময়ী নারীর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে আপন সৌন্ধর্য প্রস্ফুটিত করে! অপরা‎হ্ণের বাতাসে বাঁশবনের ঝর্ঝর সুরের ভেতর ক্ষণে ক্ষণে সোমের ঠেকার মতো ধ্বনিত হচ্ছে বাঁশের সঙ্গে বাঁশের সংঘর্ষ, খুনসুটি অথবা চুম্বনের শব্দ! পাখির ঝাঁক ডানার আড় ভাঙছে অথবা করছে আকাশ বিহার মেঘমুক্ত পরিচ্ছন্ন আকাশে, হ্রদের নীলাভ জলে পড়ছে তাদের চঞ্চল প্রতিবিম্ব। আবার কোনো কোনো নিঃসঙ্গ পাখি উড়ে যাচ্ছে হ্রদের এপাড় থেকে ওপাড়ে, হয়তো সঙ্গীনির খোঁজে অথবা বাচ্চার আহার মুখে নিয়ে ফিরছে নীড়ে! অরণ্য থেকে ভেসে আসছে চেনা-অচেনা অসংখ্য পাখির কণ্ঠস্বর আর একটি কাঠঠোকরার নিরন্তর চর্চার ধ্বনি। তিনি কোকিলের সুরে কান পাতেন; হ্রদ, হ্রদের পাড়ের বৃক্ষরাজি এবং পক্ষীকূলের সৌন্ধর্যে মোহিত হয়ে যেন আত্মভোলা হয়ে যান তিনি! হ্রদের শীতল জলে সাঁতার কাটেন কিছুক্ষণ। তারপর যখন তিনি শেষবারের মতো পান করার জন্য এক আঁজলা জল তুলে নেন মুখের কাছে তখন তাঁর কানে ভেসে আসে সুমধুর গীতের সুর। ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন হ্রদের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক অপূর্ব সুন্দরী!

আরো নিকটস্থ হতেই বৃক্ষরাজির মর্মর শব্দ, পক্ষীকূলের সুমধুর স্বর, হ্রদের তীরে ঢেউ ভাঙার মৃদু শব্দ, সব ছাপিয়ে গীতের সুরের সঙ্গে নিপুণ ছন্দে ঝমর ঝমর শব্দে যেন ঝঙ্কার তুলছে পদ্মিনীর চরণের নূপুর আর কটিদেশের মেখলা! মৃদু দোলাতেও নিনাদ তুলছে তার কানের দুল এবং হাতের কঙ্কণ।

অনেকদিন তিনি কোনো নারী দর্শন করেন নি, আর এমন অপূর্ব সুন্দরী হয়তো-বা কোনোকালেও দর্শন করেন নি! সুসজ্জিত কমনীয় সরু তনু, দ্বীপশিখার ন্যায় গাত্রবর্ণ, চন্দন-কুঙ্কুম চর্চিত চন্দ্রিমার ন্যায় মুখশ্রী, চিত্রল হরিণীর ন্যায় টানা টানা চঞ্চল চোখে লালাভ ভাব, সুতীক্ষ্ণ নাক, রক্তকরবীর ন্যায় লাক্ষারসে রাঙা চঞ্চু, পীনোন্নত পয়োধর, পারিজাত পুষ্পের ন্যায় উজ্জ্বল লোহিতবর্ণ বসন পরিধান করে রাজহংসীর ন্যায় ধীর লয়ে হেঁটে চলেছে! কে এই পদ্মিনী?

বসন্ত বাতাস আপনমনে খেলছে তার বন্ধনহীন দীর্ঘ কৃষ্ণ কুন্তল নিয়ে। মাথার পিছন থেকে ডান কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুলে পড়েছে কুন্তললগ্ন শুভ্র সতেজ পুষ্পমাল্য, কণ্ঠের মাল্যটি তার সুডৌল স্তনযুগলের ওপর দিয়ে ঝুলে আছে অনাবৃত নাভিমূলের কাছে, যেন মনে হচ্ছে এই যুগলমাল্য’র শুভ্র পুষ্পরাশি কস্মিনকালেও কোনো গাছে ছিল না, জন্মলগ্ন থেকে অনন্তকাল যাবৎ এমনি ভাবেই আছে এই পদ্মিনীকে জড়িয়ে! দেহকুঞ্জে অপার সৌন্ধর্য প্রস্ফুটিত করে পৌরুষে কামনার টঙ্কার বাজানো এই অপূর্ব পদ্মিনী সুন্দরী কোথা থেকে এলো, আর কোথায়-ই বা চলেছে? এর স্থান তো মনুষ্যলোক নয়, এর তো দেবলোকে থাকবার কথা!

মোহাবিষ্ট-কামাবিষ্ট হয়ে পড়েন তিনি, হ্রদের জলের মৃদুমন্দ ঢেউ শরীরে আড় ভেঙে আর হালকা বাতাস বুকের সিক্ত রোমগুলোয় সুড়সুড়ি দিয়ে তাঁর কামনা যেন আরো উস্কে দেয়! অদ্ভুত শিহরণ জাগে শরীরে! তিনি জল পান করতে ভুলে যান, আঁজলার জল আঙুলের ফাঁক গলে মিশে যায় হ্রদের জলরাশিতে। জটা থেকে নেমে আসা মুখমণ্ডলের জল উত্তরীয় দিয়ে মুছতে মুছতে তিনি হ্রদের পাড়ে ওঠেন, কয়েক কদম এগিয়ে একটি পলাশবৃক্ষের নিচে তিনি সেই নারীর মুখোমুখি দাঁড়ালে সে-ও দাঁড়িয়ে করজোড়ে প্রণাম করে বলে, ‘প্রণাম মুনিবর।’

‘আয়ুষ্মান হও, এই বনপথে আপন সৌন্ধর্যের প্রভা ছড়িয়ে একা একা চলেছ, কে তুমি মনোহারিনী পদ্মিনী, দেবী না মানবী?’

‘পাতকিনীর নাম উর্বশী, মুনিবর।’
‘উর্বশী….উর্বশী! তুমি নিশ্চয় স্বর্গের অপ্সরী উর্বশী?’
‘আজ্ঞে না মুনিবর।’
তারপর স্বর্গের অপ্সরী উর্বশীর উদ্দেশে করজোড় কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম জানিয়ে মর্তের উর্বশী পুনরায় বলে, ‘তিনি তো নমস্য, স্বর্গের জ্যোতির্ময়ী; তাঁর মতো সৌভাগ্য ক’জনের হয়! মুনিবর, আমি মিথিলা দেশের বারাঙ্গনা।’
‘অপূর্ব!’

অস্ফুটে বিভাণ্ডকের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে শব্দটি। বুঝতে না পেরে উর্বশী বলে, ‘কিছু আদেশ করলেন মুনিবর?’

তিনি অপলক চোখে তাকিয়ে থাকেন উর্বশীর চন্দন-কুঙ্কুম চর্চিত সুন্দর মুখশ্রীর দিকে। উর্বশীর প্রশ্ন শুনে এবার তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘অপূর্ব! অপূর্ব তোমার সৌন্ধর্য! তুমি কেবল বারাঙ্গনা নাও, রূপাঙ্গনাও বটে! মর্তলোক নয়, দেবলোক-ই তোমার প্রকৃত স্থান হওয়া উচিত!’

উর্বশী লজ্জা পায়, তাঁর চোখ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নতমুখে ছুড়ে দেয় হ্রদের জলে, ঠোঁটে ফুটে থাকে লাজুক হাসি। এই অবসরে তিনি উর্বশীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিখুঁত ভাবে অবলোকন করেন। উর্বশীর পরনে লোহিতবর্ণ সুক্ষ্মবস্ত্র, এতোটাই সুক্ষ্ম যে বুকের কাঁচুলি ভেদ করে স্তনবৃন্ত চোখে মায়াঞ্জন বুলায়, চিত্তে বুলায় কামাঞ্জন!

কয়েক মুহূর্ত পর তিনি বলেন, ‘তোমার ব্রীড়ানত মুখশ্রী আরো বেশি মায়াময়, আঁখি তোলো স্বৈরিণী!’
উর্বশী মাথা তুলে তাঁর রক্তাভ চোখের দিকে তাকালে তিনি বলেন, ‘তুমি এখানে কী করে এলে?’
উর্বশী বলে, ‘আমি সঙ্গীদের সঙ্গে অরণ্য বিহারে এসেছি মুনিবর, দলছুট হয়ে পথ হারিয়ে এই ভুলপথে চলে এসেছি।’

তিনি মৃদু হাসেন, ‘তুমি পথ ভুল করো নি উর্বশী, পথই তোমাকে ছলনা করে নিয়ে এসেছে এখানে, আমার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ করাবে বলে!’

ঠিক তখনই ওপর থেকে বৃন্তচ্যুত একটি পলাশপুষ্প প্রথমে পড়ে তাঁর জটায়, অতঃপর মাটিতে। তিনি ভূ-পতিত পলাশপুষ্পের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ভূমি থেকে পলাশপুষ্প হাতে তুলে নিয়ে বলেন, ‘এই দেখ স্বৈরিণী, মদনদেব আমায় বাণ মারলেন! আমি মহর্ষি বিভাণ্ডক, এতোদিন ঊর্ধ্বরেতা ছিলাম কিন্তু আজ তোমার অনিন্দ্য সৌন্ধর্য আমার চিত্ত চঞ্চল করেছে, তুমি আমার চিত্ত হরণ করেছ; আমি তোমার প্রতি মোহাবিষ্ট-কামাবিষ্ট হয়েছি, তুমি এই কামপোহতকে কামসেবা করো, আমার রতি ধারণ করো। তাছাড়া এখন অপরাহ্ণ, কিছুক্ষণ বাদেই অরণ্যে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে। হিংস্র জন্তুর আহার হওয়াটাও তোমার জন্য মঙ্গলজনক হবে না। কাল প্রত্যুষে তোমাকে আমি সঠিক পথে এগিয়ে দিয়ে আসবো।’

উর্বশী তাঁর রক্তনেত্রের দিকে তাকায়। দড়ির মতো লম্বা সিক্ত জটা, ঠোঁট আবৃত করা গোঁফ এবং প্রায় নাভি স্পর্শ করা দাড়িতেও দৃষ্টি বুলায়। তাঁর সঙ্গে শারীরিক মিলনের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কোনোটাই প্রকাশ পায় না উর্বশীর মুখের অভিব্যক্তিতে। যদি অনিচ্ছাও থেকে থাকে তবু তাঁর মতো খ্যাতিমান তপস্বীর শাপের ভয়ে অথবা তাঁর হাত থেকে বিজন অরণ্যে রেহাই পাবার আর কোনো সম্ভবনা নেই বলেই হয়তো ইচ্ছাটাই প্রকাশ করে সে, ‘আপনি সুবিখ্যাত তপস্বী, আপনার কঠোর তপশ্চর্যার কথা দিকে দিকে সুবিদিত। আপনাকে অগ্রাহ্য করার ধৃষ্টতা আমার মতো সামান্য বারাঙ্গনার নেই মুনিবর। আমি সৌভাগ্যবতী যে না চাইতেই আপনাকে কামসেবা করে আপনার রতিপ্রসাদে তুষ্ট হবার সুযোগ আমার সম্মুখে এসেছে।’

তখন তাঁর জটা এবং উত্তরীয়ের জল শরীর, ভেজা চীর এবং চরণ বেয়ে নিচের দিকে নেমে ভূমি কর্দমাক্ত হচ্ছে। মৃদু হেসে তিনি কয়েক কদম এগিয়ে হাতের পলাশপুষ্প উর্বশীর কেশে গুঁজে দেন। উর্বশীর শরীর থেকে ভেসে আসা আশ্চর্য সুগন্ধ মাতোয়ারা করে তাঁর ঘ্রানেন্দ্রিয়; উর্বশীকে ললাটিকা আলিঙ্গন করার পর দু-হাতের আঁজলায় উর্বশীর মুখ ধরে তার কপালে উষ্ণ চুম্বন করেন, তারপর দুজন দুজনকে করেন তীর্যক চুম্বন। তাঁর মুখের দাড়ি-গোঁফ আর শরীরের জলে সিক্ত হয় উর্বশীর সুক্ষ্ম বসন এবং শরীরের কোমল অঞ্চল। চুম্বন শেষে উর্বশীর চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কুটীরে চলো স্বৈরিণী।’

তিনি উর্বশীর কোমল শরীর বাহু বেষ্টনে আবদ্ধ করে পাশাপাশি হাঁটতে থাকেন কুটীরের দিকে। নির্জন অরণ্যপথে হাঁটতে হাঁটতে নানারকম পুষ্প দেখতে পায় উর্বশী আর তাঁর বাহুমুক্ত হয়ে নিজের কোঁচরে তুলে নেয় কিছু সুগন্ধি পুষ্প। কয়েকটি তাম্বূলপাতা আর তলায় পড়ে থাকা সুপারিও নেয় কুড়িয়ে। তারপর পুনরায় তাঁর বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ হয়ে কুটীরের আঙিনায় এসে যুগল কৃষ্ণসার মৃগ দেখে উর্বশী বলে, ‘বাহ্, কী সুন্দর মায়ামৃগ! মুনিবর, ওরা কি আপনার পোষ্য?’

‘পোষ্য-ই বলতে পারো। ওরা আপনা থেকেই এসেছে, আশপাশে ঘুরে ফিরে আহার করে, আঙিনাতে খেলা করে, আর দেহলীতে উঠে ঘুমায়।’
‘আপনাকে ভয় পায় না?’
‘ভয় পাবে কেন? ওরা বুঝতে পেরেছে আমি কখনোই ওদেরকে বধ করবো না।’
‘আমি ওদের ছুঁয়ে দেখবো।’
‘বেশ, দেখ।’

বাহুমুক্ত হয়ে উর্বশী কোঁচরের পুষ্পসহ উত্তরীয় তাঁর হাতে দিয়ে বালিকার চপলতায় মৃগ দুটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ওরা একটুও ভীত না হয়ে মায়া মায়া চোখে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। উর্বশী আঙিনার পাশ থেকে কয়েকটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে এনে ওদের মুখের সামনে ধরতেই ওরা মুখে পুরে নেয়। সে ওদের মাথায়-শৃঙ্গে পরম মমতায় হাত বুলালে ওরাও তার হাত শুকতে থাকে। উর্বশী একটা মৃগ’র গালের সাথে নিজের গাল ছোঁয়ায়, তিনি পিছনে দাঁড়িয়ে তার বালিকাসুলভ আচরণ দেখে মৃদু হেসে বলেন, ‘ওরা তোমাকে পছন্দ করেছে, বোধহয় তোমার সঙ্গে সই পাতাতে চায়।’

উর্বশীও তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, ‘তাই তো মনে হচ্ছে।’

তারপর যুগল মৃগ ছেড়ে তাঁর হাত ধরে কুটীরে প্রবেশ করে উর্বশী।

চাঁচের বেড়া আর ছনে ছাওয়া কুটীরখানা খুব বেশি বড়ো নয়, মাত্র দুটি কক্ষ; উত্তরেরটিতে তিনি তপশ্চর্যা করেন আর দক্ষিণেরটি তাঁর শয্যাকক্ষ। উর্বশীকে শয্যাকক্ষে রেখে তিনি তপশ্চর্যার কক্ষে প্রবেশ করেন। কণ্ঠ এবং বাহুর রুদ্রাক্ষমাল্য খুলে রাখেন একটি মৃৎপাত্রে। তারপর দেবতার উদ্দেশে প্রণাম করেন।

তখন অপরাহ্ণ অন্তিমে, শয্যাকক্ষের দক্ষিণের খোলা বাতায়ন দিয়ে মৃদু আলো প্রবেশ করায় ভেতরের আবহ আলো-ছায়াময়; কিন্তু এই আলোও বেশিক্ষণ থাকবে না। বাতায়ন বরাবর উত্তর-দক্ষিণে কুশশয্যা পাতা। কক্ষের পশ্চিমকোনে ভূমিতে রাখা জলের কুঁজো, তার পাশে একটি বড়ো এবং দুটি ছোট মৃৎপাত্র, একটি জলপান করার পাত্র। সামান্য দূরত্বে একটি ঝুড়িতে রাখা ফলমূল এবং একটি ছুরি। খুঁটিতে ঝুলছে অরণি-মন্থ, খুঁটির গোড়ায় কাঠের দ্বীপাধার। একটা বাঁশের সঙ্গে ঝোলানো বিভাণ্ডকের পরিহিত পরিচ্ছদ। উর্বশী বড়ো মৃৎপাত্রটি নিয়ে তার ওপর সাজিয়ে রাখে কোঁচরের ফুল, আর ছোটটিতে রাখে তাম্বূল ও সুপারি। তারপর ফল কাটা ছুরি নিয়ে সুপারির আঁশ ছড়িয়ে কুচি কুচি করে কেটে গুছিয়ে রাখে তাম্বূলের ওপর।

তিনি জ্বলন্ত মৃৎ-প্রদীপ হাতে শয্যাকক্ষে প্রবেশ করে দ্বীপাধারটি বেড়ার কাছ থেকে সরিয়ে এনে তার ওপর রাখেন প্রদীপ, প্রদীপের উন্নত শিখার লালচে আভা খেলা করে দুজনের মুখে, গাত্রে, সমগ্র কক্ষে; বাতায়নের বাইরে নীরবে নেমে আসে অন্ধকার। উর্বশী নিজহাতে তাঁর পরনের সিক্ত চীর খুলে বাঁশে রাখে, তারপর একখণ্ড শুষ্ক বস্ত্র নিয়ে সিক্ত জটা এবং অনাবৃত শরীরের জল মুছে দিতে থাকে। নারীর কোমল হাতের নিবিড় স্পর্শ পেয়ে তাঁর নারীসঙ্গহীন দেহাভ্যন্তরে যেন দীর্ঘক্ষণ নিভু নিভু হয়ে জ্বলার পর হঠাৎ তেলপ্রাপ্ত প্রদীপের শিখার ন্যায় কামনার শিখা লকলকিয়ে উঠে! তিনি উর্বশীর বাঁ হাতটি ধরে হাতের পাতায় চুম্বন করার পর নিজের মুখমণ্ডলে ঘষতে থাকেন। পরমুহূর্তেই দুজন আবিষ্ট হন নিমিত্তক চুম্বনে।

তারপর উর্বশী নিজেই নিজের বুকের কাঁচুলি এবং পরিধেয় বস্ত্র খুলে ফেললে তিনি বিস্ময়ে অপলক চোখে অবলোকন করতে থাকেন উর্বশীর অনাবৃত কায়ামাধুর্য। উর্বশীর কপালের মাঝ বরাবর তর্জনী ছোঁয়ান; তারপর ক্রমশ নিচের দিকে নামিয়ে নাক, ঠোঁট, চিবুক, কণ্ঠদেশ স্পর্শ এবং বক্ষসরোবর অতিক্রম করে তর্জনী নাভীমূলে স্থির করে প্রথমে অস্ফুট তারপর স্ফুটস্বরে উচ্চারণ করেন, ‘অপূর্ব, অপূর্ব তোমার অঙ্গশ্রী স্বৈরিণী; দাবাগ্নির ন্যায় দগ্ধ হচ্ছে আমার গাত্র!’

উর্বশী তাঁর হাতখানা নিজের মুখের কাছে তুলে তর্জনীর ডগায় চুম্বন করার পর হাত ধরে তাঁকে শয্যায় নিয়ে আসে। তিনি শয্যায় উপবেশন করলে তাঁর বাম ঊরুতে বীণার ন্যায় উপবেশন করে উর্বশী, আর তিনি বাঁ-হাতে উর্বশীর কোমর বন্ধন করে ডান হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলির মাধ্যমে তার স্তনবৃন্তে মৃদু চাপ দিতেই বীণার ন্যায় অস্ফুটে নিনাদ তোলে সে। উর্বশী হাত বাড়িয়ে মৃৎপাত্র থেকে একমুঠো সুগন্ধি পুষ্প নিয়ে তাঁর মুখে-সর্বাঙ্গে পেষণ করে। তিনিও কামোন্মত্ত হয়ে উর্বশীর স্তন লেহন ও দন্তদংশন করতে থাকেন, গলার পুষ্পমাল্য ছিঁড়ে নখক্ষত সহযোগে পাপড়ি পিষে দিতে থাকেন তার মুখশ্রী, স্তনযুগল, নাভিমূলসহ সমস্ত শরীরে। উর্বশী শীৎকার-ফুৎকারে প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো সৌন্ধর্যের পাপড়ি মেলে নিজের সাধ্যমতো সহজাত কামকলার নিপূণ নৈপূণ্য প্রকাশ করতে শুরু তাঁর দেহসুখের জন্য।
তিনি কামকলায় দক্ষ নন, অন্যদিকে কামশাস্ত্র উর্বশীর আত্মস্থ, কামকলার নিপূণ শিল্পী সে-কামশিল্পী। সে নিজের নিতম্বের নিচে উপাধান দিয়ে জঙ্ঘাদ্বয় উঁচু করে তাঁকে আহ্বান জানিয়ে উৎফুল্লক আসন রচনা করে। তারপর উপাধান সরিয়ে উভয় জঙ্ঘা ওপরে উঠিয়ে ভুগ্নক আসন এবং দুই জঙ্ঘা তাঁর দুই কাঁধে স্থাপন জুম্ভিতক আসন রচনা করে। তাঁর তখন মনে হয় যে জগতের সকল সুখ নারী ভিন্ন অন্য কিছুতে নয়! এরপর উর্বশী চতুর্পদী পশুর মতো দুই হাঁটু এবং দুই হাত ভূমিতে রেখে অধোমুখী হয়ে ধেনুক আসন রচনা করে আর সুখের আতিশয্যে কণ্ঠে তোতাপাখির মধূর কূজনের ন্যায় শব্দ করতে থাকে।

সবশেষে উর্বশী শয্যায় শুয়ে হিমকন্থার ন্যায় তাঁকে নিজের শরীরের ওপর টেনে নেয় কূর্মাসন করার জন্য; তিনি উর্বশীর ঠোঁটে ঠোঁট, বাহুতে বাহু, জঙ্ঘায় জঙ্ঘা, বক্ষে বক্ষ সেঁটে রতিরঙ্গের অমৃত সুধা পান করতে থাকেন। তিনি যেন উর্বশীর শরীরে লীন হয়ে যেতে চান আর উর্বশীও তাঁর রুদ্রমন্থন-বাহুবন্ধনে খুঁজে নিতে চায় অপরিমেয় দেহসুখ। দুজন দুজনার শরীরের সবটুকু উষ্ণতা শুষে নিয়ে যেন শীতল হতে চান। রতির অন্তিমকালে বিপুল কামোত্তেজনা আর দেহসুখের আতিশয্যে কম্পমান হাতে উর্বশী প্রবলভাবে তাঁর পিঠ নিষ্পেষণ করে নখক্ষত করতে থাকে, জটা ধরে টানে; অসহ্য সুখের বানে ভেসে তাঁর কাঁধে দন্তদংশন করে! তিনিও উর্বশীকে পুষ্পের ন্যায় নিষ্পেষিত করে তার কণ্ঠে-গ্রীবায় তীব্র দন্তদংশন এবং কাঁধে-বক্ষে নখক্ষত পূর্বক রতিরঙ্গ সাঙ্গের পর অবসন্ন দেহে মূর্তির ন্যায় স্থির হয়ে পড়ে থাকেন উর্বশীর দেহের ওপর। বাউরি বাতাসের ন্যায় দুজনের উন্মত্ত শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে উর্বশী ডান হাত বাড়িয়ে মৃৎপাত্র থেকে এক মুঠো পুষ্প নিয়ে ছড়িয়ে দেয় নিজের এবং তাঁর মুখশ্রী ও শরীরে। কামের গন্ধ ছাপিয়ে ফুলের সুভাস ছড়ায় কক্ষময়। তিনি উর্বশীর দেহ থেকে শয্যায় অবতরণ করে চিৎ হয়ে শয়ন করেন উপাধানে মাথা রেখে। তখন উর্বশী শুষ্ক বস্ত্র খণ্ড দিয়ে তাঁর এবং নিজের কপাল, কণ্ঠ ও বক্ষের ঘাম মুছে ফেলে, তারপর তাম্বূলপাত্র থেকে দুটো তাম্বূল নিয়ে একটা নিজের মুখে আর আরেকটা তাঁর মুখে পুরে দেয়। তিনি তাম্বূল চিবোতে চিবোতে উর্বশীকে নিজের বক্ষের সঙ্গে চেপে ধরে কপালে চুম্বন করেন এবং কেশে ও মুখে আঙুলের মৃদু আদুরে পরশ বুলান।

নিদ্রা ভুলে সেই রাত তাঁর কাটে এক অদ্ভুত উন্মাদনায়, আবেগে-আবেশে, প্রেমে-কামে, শ্রান্তিতে-প্রশান্তিতে! উর্বশীর নিবিড় সাহচার্য আর সুমিষ্ট কণ্ঠের গীতে রাতটি হয়ে ওঠে মধুর। উর্বশীকে নিয়ে সংসার করার ক্ষণিক মোহও চাগাড় দিয়ে ওঠে তাঁর অন্তরে। কিন্তু প্রতুষের আলো ফুটতেই তাঁর তপস্বী চিত্ত সচেতন হয়ে ওঠে, তপস্বীর কঠোর-একাগ্র চিত্তের রৌদ্রদাহে দূর হয় প্রেমিক চিত্তের মোহাচ্ছন্নতার কুয়াশা। পরদিন প্রত্যুষে তিনি উর্বশীকে ফেরার পথ চিনিয়ে দেন।

তারপরই তিনি অনুধাবণ করেন যে ক্ষণিক কামনার বশে ভুল করেছেন নারীসঙ্গে জড়িয়ে, এখানে থাকলে মোহের বশে একই ভুল বারবার হতে পারে, অল্প কিছুদিন বাদেই তিনি নারীসঙ্গ এবং নারীদর্শন থেকে দূরে থেকে আরো নির্বিঘ্নে একান্তে তপশ্চর্যা করার জন্য সেই মহাহ্রদের কাছের আশ্রম পরিত্যাগ করে চলে এসেছেন নন্দা-অপরনন্দা নদী পেরিয়ে, ঋষভকূট পর্বত ছাড়িয়ে কৌশিকী নদীর পারে বিজন অরণ্যে। আশপাশে কয়েক ক্রোশের মধ্যে কোনো লোকালয় নেই, নেই কোনো মন্দির। এমনকি একক্রোশের মধ্যে কোনো ঋষির আশ্রমও নেই। নির্বিঘ্নে তপশ্চর্যা করার জন্য তিনি এই গহীন স্থানে আশ্রম নির্মাণ করেছেন। এখানে আসার কিছুদিন পর একবার কয়েকজন ঋষি ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল এপথেই, কৌশিকী নদীর পারে তার সঙ্গে দেখা হওয়ায় এখানে তিনরাত্রি বিশ্রাম করেছিলেন তারা। এছাড়া আর কোনো অতিথি তাঁর আশ্রমে আসে নি। কোনো নিষাদ কিংবা কিরাত জাতির শিকারি দলও এতো দূর্গম স্থানে শিকার করতে আসে না। আশ্রম থেকে কৌশিকী নদী হাজার কি বারো’শ কদম দূরে হওয়ায় নদী পথে কোনো বাণিজ্য তরণী কিংবা পর্যটকবাহী তরণী গেলেও তা তাঁর চোখে পড়ে না, যদি না তিনি নদীর পারে আসেন। এ অঞ্চল বন্য প্রাণিদের অভয়ারণ্য, বন্য প্রাণিরাও তাঁকে দেখে হয়তো তাদের মতো অরণ্যচারী কোনো প্রাণি ভাবে হয়তো! তাই তারাও তাঁকে ভয় পায় না। নির্ভয়ে তাঁর পাশ দিয়ে চরে বেড়ায়।

পূর্বের আশ্রমের ন্যায় এক কৃষ্ণসার মৃগ দম্পতি কৌশিকী পারের এই আশ্রমেও আশ্রয় নিয়েছিল, ওরা আশ্রমের আশপাশে চরে বেড়াতো আর আঙিনায় এসে বিশ্রাম নিতো, সারারাত এখানেই থাকতো। ওরা দুটো সুন্দর মায়াবী বাচ্চা প্রসব করেছিল। তিনি দেহলীতে বসে থাকলে বাচ্চা দুটো কাছে এসে তাঁর শরীর শুকতো-চাটতো; তারপর শরীর ঘেঁষে বসে থাকতো। তিনিও স্ব-স্নেহে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। ওদের সঙ্গে দিব্যি সময় কাটাতো তাঁর। ধ্যান করার সময় তিনি কুটীরের দরজা বন্ধ করে নিতেন, নইলে ওরা তাঁকে না দেখে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে ধ্যানরত অবস্থায়তেই তাঁর শরীর শুকে চাটতে শুরু করতো।

একদিন তিনি অরণ্য থেকে ফল সংগ্রহ করে ফিরে এসে কুটীরের দেহলীতে কুশাসনের ওপর উপবেশন করে ছিলেন, মৃগ শাবক দুটো তাঁর কাছে এসে আদর গ্রহণ করছিল, ওদের পিতা-মাতা গিয়েছিল হয়তো আহার-বিহারে। তখন এক নারীকে কিছু একটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আশ্রমের পথে হেঁটে আসতে দেখেন তিনি। এখানে কোনো নারীকে দেখে তিনি যেমনি বিস্মিত হন, তেমনি বিরক্তও বোধ করেন। একবার মহাহ্রদের নিকটস্থ আশ্রমে থাকতে গণিকা উর্বশীকে দেখে তাঁর যৌনাকাঙ্ক্ষা জেগেছিল, মোহের বশে রতিক্রীড়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন। এজন্যই তিনি মহাহ্রদের পাড় থেকে এখানে চলে এসেছেন, যাতে নারীমুখ দর্শন করতে না হয়, তার তপশ্চর্যায় কোনোরূপ ব্যাঘাত না ঘটে। অথচ এখানেও আবার নারী! নিজেকে তিনি সংযত রাখার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। নারী আরেকটু কাছে আসতেই তিনি চিনতে পারেন, আরে, এতো সেই গণিকা উর্বশী! উর্বশী তার আশ্রমের খবর পেলো কী করে? আর এখানে এলোই বা কেন? উর্বশী এমন এক নারী যাকে দেখলেই মদনদেবের বাণ যেন বক্ষে এসে বিদ্ধ হয়! সে-বার উর্বশী তাঁকে ভীষণ তৃপ্ত করেছিল, তেমনি তিনিও উর্বশীকে তৃপ্ত করেছিলেন। যাবার বেলায় উবর্শী তাঁকে শেষবারের মতো আলিঙ্গন করে প্রশংসা বাক্য বলেছিল, ‘মুনিবর, আমি অনেক পুরুষের সঙ্গলাভ করেছি, কিন্তু আপনার মতো পৌরুষদীপ্ত পুরুষের সঙ্গ পাই নি কখনো। কেউ-ই আপনার মতো রতিশৌর্য দেখাতে পারেন নি!

আমি পরম তৃপ্তি লাভ করেছি। আপনি আহ্বান করলে আমি বারবার আসবো।’

তিনি বলেছিলেন, ‘তুমিও আমাকে ভীষণ তৃপ্ত করেছ স্বৈরিণী! প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে আহ্বান করবো। কিন্তু আপাতত আমি তপশ্চর্যায় মন দিতে চাই।’

লালসা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তিনি, আর আহ্বান করেন নি উর্বশীকে, উপরন্তু আগের আশ্রম পরিত্যাগ করে চলে এসেছেন। তবে কেন এসেছে উর্বশী? সেই রতিসুখের কথা স্মরণে রেখে উর্বশী কি তাঁকে কামনা করে আবার এসেছে? কিন্তু তিনি এখন কোনোভাবেই তার সঙ্গে শয্যায় যেতে পারবেন না।

উর্বশী কাছে এসে চঞ্চুতটে চিত্ত চঞ্চল করা হাসির ঢেউ ছড়িয়ে বলে, ‘কেমন আছেন মুনিবর?’
‘সদানন্দে আছি। কিন্তু তুমি আমার আশ্রমের সন্ধান পেলে কী করে, আর এলেই বা কী উপায়ে?’

কথা বলতে বলতে তিনি লক্ষ্য করেন উর্বশীর কোলে শুভ্র বস্ত্রে আবৃত ছোট্ট শিশুর ঘুমন্ত মুখ।

উর্বশী বলে, ‘আমি বলদেব নামে একজন ঋষির কাছ থেকে আপনার আশ্রমের সন্ধান পেয়েছি, তিনি একবার ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতে যাবার পথে আপনার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। আর আমি এসেছি তরণীযোগে, নদীতে দাঁড়িরা আমার ফেরার অপেক্ষায় আছে।’

তাঁর মনে পড়ে অতৃপ্ত-অস্থিরমতি-মন্দবুদ্ধির বাল্যবন্ধু বলদেবের কথা, যে গুরুগৃহে থাকার সময় তাঁকে নানাভাবে উত্যক্ত করতো। আর তারুণ্যে কোনো মতাদর্শে পরিতুষ্ট হতে না পেরে কোথাও স্থির হতে পারছিল না, অস্থিরচিত্তে কেবল পরিব্রাজন করছিল। তাঁর মহাহ্রদের আশ্রমেও বেশ কয়েকবার এসেছিল। আর ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতে যাবার পথে যে ঋষির দলটি তাঁর এই আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সেও ছিল। সেই দুষ্টুবুদ্ধির বাল্যবন্ধু বলদেবই তবে তার ঠিকানা বলেছে উর্বশীকে!

তিনি ভূমিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার কাছে কেন এসেছ স্বৈরিণী?’

‘মুনিবর, আপনার রতি ধারণ করে আমি গর্ভবতী হয়েছিলাম। তারপর আমি এই শিশুপুত্র প্রসব করেছি। এ আপনার পুত্র।’
তিনি বিস্ময়ে তাকান উর্বশীর মুখপানে, তারপর কোলের শিশুপুত্রের দিকে, বলেন ‘তুমি অসত্য বলছো স্বৈরিণী।’

উর্বশী বলে, ‘আমি অসত্য বলছি না মুনিবর। আপনার কামপ্রসাদ গ্রহণ করার পর লোকালয়ে ফিরে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলাম বেশ কিছুদিন। একজন দক্ষ বৈদ্যের সুচিকিৎসায় আমি সুস্থ হই। আর তখনই অনুভব করি আমি গর্ভবতী। মুনিবর, আমি জানি আপনার কামপ্রসাদের ফল এই পুত্র, কেননা এই সময়ে আমি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে শয্যায় যাই নি। তাই একে আমি ত্যাগ না করে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।’

তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তিনি বলেন, ‘বেশ, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করছি। কিন্তু একে আমার কাছে কেন নিয়ে এসেছ?’

‘মুনিবর, আমার জন্ম হয়েছে কামসেবা করবার জন্য। আমি কোথাও স্থির থাকতে পারি না, অবিরাম জল-স্থল বিহার করতে হয়। আমার পক্ষে পুত্র লালন করা সম্ভব নয়। আপনি একে গ্রহণ করুন মুনিবর, আপনার মতো করে গড়ে তুলুন।’

তিনি কপালে একই রকম ভাঁজ ফেলে ভাবেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর বলেন, ‘কিন্তু এই গহীন অরণ্যে আমি একে কী করে লালন-পালন করবো! আমি সারাক্ষণ তপশ্চর্যা আর ফলমূল সংগ্রহে ব্যস্ত থাকি, তাছাড়া এই অরণ্যে হিংস্র জীবজন্তু রয়েছে। আমি একে কীভাবে সারাক্ষণ আগলে রাখবো?’

‘আমি নিরুপায় হয়ে এসেছি মুনিবর, আমি চাইলে একে কলসিতে করে নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এই নিষ্পাপ শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি তা করতে পারি নি। আপনি আমায় এই সংকট থেকে উদ্ধার করুন। আপনি একে গ্রহণ করুন, আপনি নিশ্চয় লালন-পালন করে একে আপনার মতো তপস্বীরূপে গড়ে তুলতে পারবেন। দয়া করুন মুনিবর।’

তিনি মৌন হয়ে চিন্তা করতে থাকেন। মৃগশাবক দুটো মাথা দিয়ে তাঁর হাতে মৃদু ঢুঁস দিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর আদর না পেয়ে পুনরায় একইভাবে ঢুঁস দিতে থাকে।

তাঁকে মৌন থাকতে দেখে উর্বশী বলে, ‘আমি নিশ্চিত, এই মৃগ শাবকদের সঙ্গে খেলতে খেলতেই আমাদের শিশুপুত্র একদিন যৌবনলাভ করবে, আপনার মতো তপশ্চর্যা করবে। কিন্তু আমার কাছে থাকলে পুত্র সু-শিক্ষা পাবে না মুনিবর।’

শিশুপুত্রের সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর হৃদয় পুত্রস্নেহে আর্দ্র হয়ে ওঠে। তাঁরও মনে হয় যে যথার্থই বলেছে উর্বশী, এই নিষ্পাপ ফুটফুটে শিশুপুত্র ওর কাছে থাকলে সু-শিক্ষা পাবে না। ভবিষ্যতে হয়তো-বা উচ্ছন্নেও যেতে পারে পুত্রটি। তাঁর নিজের ঔরস থেকে জন্ম নেওয়া পুত্র, তাঁরই আত্মজ। তাঁর মতো স্বনামধন্য একজন ঋষির আত্মজ উচ্ছন্নে যাবে? ভবিষ্যতে পুত্রের পরিচয় কোনোভাবে জানাজানি হলে লুণ্ঠিত হবে তাঁর সম্মান, তাঁর সকল অর্জন। সুতরাং পুত্রটিকে নিজের কাছে রেখে দেওয়া উত্তম মনে করে তিনি উর্বশীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বেশ, আমি একে রেখে দিচ্ছি। তবে আমার কিছু আদেশ তোমাকে পালন করতে হবে।’

‘আপনি নিঃসঙ্কচে আদেশ করুন মুনিবর, যতো কষ্টই হোক আমি আপনার আদেশ মান্য করবো।’

‘আমি এই পুত্রকে আমার মতো করেই গড়ে তুলবো। কিন্তু তুমি ভবিষ্যতে কখনোই আমার আশ্রমে আসবে না। পুত্রের জন্য তোমার হৃদয় স্নেহার্দ্র হলেও তুমি কখনো নিজের পরিচয় উন্মোচন করে পুত্রের মুখোমুখি হবে না। এই পুত্র যে তোমার গর্ভজাত সে-কথাও কাউকে বলতে পারবে না। ’

ক্ষণকালের নীরবতা কাটিয়ে উর্বশী বলে, ‘বেশ। আমি প্রতিজ্ঞা করছি মুনিবর, আপনার এই আদেশ পালন করবো।’
‘আমার আরেকটি আদেশ তোমাকে পালন করতে হবে।’
‘বলুন।’

‘তুমি তোমার সখিদের দিয়ে এই কথা প্রচার করাবে যে, মহর্ষি বিভাণ্ডক একদা এক মহাহ্রদে স্নান করছিলেন, তখন হ্রদের পাড় দিয়ে স্বর্গের সুন্দরী অপ্সরী উর্বশীকে দেখে তিনি কাম তাড়িত হন এবং হ্রদের জলে তার রতিপাত হয়। তারপর একটি মৃগ জল পান করতে এসে হ্রদের জলে ভাসতে থাকা সেই শুক্র জলের সঙ্গে পান করে গর্ভবতী হয় এবং একটি পুত্র সন্তান প্রসব করে। মৃগযোনিজ বলে পুত্রের মস্তকে একটি শৃঙ্গ বিদ্যমান, তাই তার নাম ঋষ্যশৃঙ্গ। আশ্চর্য শক্তিসম্পন্ন সেই পুত্র তার পিতার কাছে বেদ অধ্যায়ন এবং তপশ্চর্যা শিখছে।’

‘জলে ভাসমান শুক্র পান করে কোনো মৃগ তো দূরের কথা, নারীর পক্ষেও কি গর্ভধারণ সম্ভব? একথা কি কেউ বিশ্বাস করবে মুনিবর?’

‘মানুষ ঋষিদেরকে যেমনি ভয় করে, তেমনি বিশ্বাসও করে। মানুষ বিশ্বাস করে যে, ঋষিরা মহাশক্তিশালী, তাদের পক্ষে যে-কোনো অলৌকিক কার্য ঘটানো সম্ভব। শোনো, মানুষ বড়ো বিশ্বাসী প্রাণি, তারা যদি শোনে যে মহর্ষি বিভাণ্ডকের শুক্র গঙ্গাদ্বার থেকে ভাসতে ভাসতে গঙ্গা আর সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে চলে গিয়েছিল, আর সেখানকার এক বৃহন্নলা জলের সঙ্গে সেই শুক্র পান করে গর্ভবতী হয়ে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছে, মানুষেরা সে কথাও বিশ্বাস করবে। বিশ্বাসের মায়াজালে জড়িয়ে আছে এই ভূ-মণ্ডলের মানুষ। বিশ্বাস বড়ো সংক্রামক, মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। অল্প সংখ্যক অবিশ্বাসী নাস্তিক থাকলেও লোকে তাদেরকে বিশ্বাস করে না।’

‘কিন্তু মুনিবর, একথা কেন বলবো?’

‘বলবে এজন্যই যে যাতে আমার কলঙ্ক না হয়। নইলে প্রকৃত সত্য জানলে সবাই ভাববে আমি কামুক; দেবতা, ঋষি এবং মনুষ্য সমাজে আমি পতিত হবো। তুমি কি চাও যে তোমার পুত্রের পিতা কলঙ্ক নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক?’

‘আমি তা চাই না মুনিবর, আপনি আমার সন্তানের ঔরসজাত পিতা, আপনার মঙ্গলই আমার কাম্য। আমি চাই আমার সন্তানের পিতা জগদ্বিখ্যাত হোক। আপনার আদেশ আমি নিশ্চয় পালন করবো।’

এরই মধ্যে শিশুটি জেগে উঠে হাত দিয়ে মায়ের মুখ স্পর্শ করতে থাকে, মুখের সামনে আসা একগুচ্ছ চুল ধরে টানতে শুরু করে। উর্বশী দেহলীতে উপবেশন করে শেষবারের মতো দুগ্ধ পান করানোর জন্য স্তন অনাবৃত করে পুত্রের মুখে পুরে দেয় স্তনবৃন্ত। দুগ্ধভরা স্ফীত গৌড়বর্ণ স্তন তাঁর দৃষ্টিতে পড়তেই যেন পাথরে পাথরে ঘর্ষণ হয়, আর আগুন ছড়িয়ে পড়ে তার শরীরে। কিন্তু তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত করেন।

শিশুপুত্র প্রাণভরে দুগ্ধপান করে, কিন্তু ও জানে না যে এই তার শেষ মাতৃদুগ্ধ পান। পেট ভরলে স্তন ছেড়ে দিয়ে পুনরায় মায়ের চুলের গোছা নিয়ে খেলতে থাকে সে।

উর্বশী উঠে আঙিনায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘মুনিবর, এবার পুত্রকে গ্রহণ করুন।’

তিনি আসন ছেড়ে উঠে দেহলী থেকে আঙিনায় নেমে উর্বশীর কাছে গিয়ে দাঁড়ান। উর্বশীর শরীর সুগন্ধ ছড়াতে থাকে, তাঁর মনে হয় যতো তাড়াতাড়ি উর্বশী বিদায় নেয়, ততোই মঙ্গল; নইলে তাঁর চিত্ত দূর্বল হতে পারে।

উর্বশী শেষবারের মতো পুত্রকে নিবিড়ভাবে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে, পুত্রের ললাটে-গালে-মস্তকে চুম্বন করে আদর করে, পুত্রের গালে নিজের গালের পরশ বুলায়। এতোক্ষণ তার অশ্রুপূর্ণ নয়ন ছলছল করছিল, এখন একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে পুত্রের গালে। সঙ্গে সঙ্গে পুত্রের গালে পড়া অশ্রুবিন্দু উত্তরীয় দিয়ে মুছে পুত্রকে তুলে দেয় তাঁর হাতে।

তাঁর দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে উর্বশী কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘পুত্রকে আমার এই আশির্বাদ রইলো, সে তার পিতার মতোই তপস্বী হোক। আমি আসি মুনিবর।’

‘এসো, কল্যাণ হোক তোমার।’

উর্বশী আর দাঁড়ায় না, নূপুরে নিনাদ তুলে আশ্রমের পথ ধরে ফিরে যায়। তিনি অনুভব করেন, উর্বশীর নূপুর একদিন তার হৃদয়ে শৃঙ্গার ধ্বনি তুলেছিল, আর আজ তুললো করুণ নিনাদ। উর্বশী আশ্রমের পথে মিলিয়ে গেলে তিনি পুত্রের দিকে তাকান। মায়ের কোলচ্যূত হয়ে পুত্র একটুও কাঁদে না, বরং অরদ হাসির ঝলক ছড়িয়ে কচি হাতে পিতাশ্রীর দাড়ি ধরে টানতে টানতে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে!

সে-দিনের সেই শিশুপুত্রই আজকের যুবক তপস্বী ঋষ্যশৃঙ্গ, যার জন্য তার ব্যাকুল পিতা শিলাখণ্ডের ওপর বসে তাকিয়ে আছেন কৌশিকীর বক্ষে অথচ কিছুই দেখছেন না; শুনছেন না কৌশিকী আর ঝিরির মিলনের শব্দ কিংবা পাখির কলকাকলি, প্রকৃতির স্পন্দন অনুভব করতে পারছেন না। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে পুত্রের তপশ্চর্যা বিনষ্ট করার জন্য কোনো অশুভ শক্তি হাত বাড়িয়েছে, নইলে এই বিজন অরণ্যে নারী আসবে কোথা থেকে! বহু কষ্টে প্রকৃতির ঝড়-ঝাঁপটা আর বন্যপশুর হাত থেকে তিনি পুত্রকে রক্ষা করেছেন। মৃগ’র দুগ্ধ দোহন করে পান করিয়েছেন। পুত্রের জন্য শীতবস্ত্র এবং অন্যান্য আহারের দ্রব্য সংগ্রহ করার জন্য তিনি প্রায়ই ছোট্ট তরণী চালিয়ে যেতেন কৌশিকীর ভাটির দিকের অনেক দূরের কোনো জনপদে। ভিক্ষা সংগ্রহ করে ভিক্ষান্নের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়ে আসতেন পুত্রের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। ফেরার সময় কৌশিকীর উজানে ছোট্ট তরণী বাইতে ভীষণ কষ্ট হতো তাঁর, দীর্ঘক্ষণ সময় লাগতো। আশ্রমের পথে পা দিতেই তার কানে ভেসে আসতো কুটীরবদ্ধ পুত্রের কান্নাজড়িত চিৎকার। সেই সব মুহূর্তে তার পিতৃহৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠতো। চটজলদি কুটীরের কপাট খুলে পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে স্নেহচুম্বনে ভরিয়ে দিতেন পুত্রের নোনা গাল। জনপদে যাবার সময় তিনি শক্ত করে কুটীরের কপাট রুদ্ধ করে যেতেন, তারপরও প্রায়ই তাঁর মনে হতো কপাট ভেঙে কোনো বন্যপ্রাণি কুটীরে প্রবেশ করে পুত্রকে অরণ্যে নিয়ে গিয়ে ভক্ষণ করে নি তো! এইসব ভেবে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তিনি তরণী বাইতেন। সহস্র ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করেও তিনি পুত্রকে বড়ো করেছেন, গড়ে তুলেছেন নিজের মতো করে। পুত্র এই বয়সেই শাস্ত্র অধ্যায়ন এবং তপশ্চর্যায় তাঁর অভীষ্টের চেয়ে অধিক উন্নতি সাধন করেছে। পূর্বে তিনি যেমন পুত্রকে সেবাযত্ন করতেন তেমনি পুত্রও এখন তাঁর সেবাযত্ন করে। আশ্রমের যাবতীয় পরিচর্যা করে। তিনি কেবল ফলমূল সংগ্রহ করেন আর কালেভদ্রে তরণী বেয়ে জনপদে যান ভিক্ষা মাগতে। ভিক্ষান্ন দিয়ে সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন পরিধেয় বস্ত্র এবং আশ্রমের কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্য। আর কালেভদ্রে এক-দুদিনের জন্য ঋষভকূট কিংবা ত্রিযোজন পর্বতে যান অন্যান্য ঋষিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে, শাস্ত্রীয় আলোচনা করতে। তখন পুত্র একাই আশ্রমে থাকে। পিতার অবর্তমানে তার এতোটুকুও ভুল-ত্রুটি হয় না কখনো। পুত্র কোনোদিন তাঁকে অমান্য করে নি, তাঁকে অবিশ্বাস করে নি। আশ্রমের একটি মৃগকে সে তার মাতা বলে জানতো, মৃগটি অনেকদিন আগেই প্রাণত্যাগ করেছে। এখনো সেই বিশ্বাসই তার মধ্যে অটুট আছে।

পুত্র এখন যেন তাঁর নয়নমণি। পুত্র ব্যতিত তিনি তার জীবন ভাবতেও পারেন না এখন। তিনি অসুস্থ হলে পুত্র ব্যতিত কে তার শুশ্রূষা করবে, কে তার আহার এবং পানীয় জল সংগ্রহ করে আনবে, কে তার শয্যা আর আশ্রম পরিচ্ছন্ন রাখবে? তারপর তিনি যখন আরও বৃদ্ধ হবেন, তখন কে তাকে লালন-পালন করবে? জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি একা এবং পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে অতিবাহিত করেছেন, এখন এই শেষ বয়সে অন্য ঋষিদের আশ্রমে গিয়ে থাকতে তার অসুবিধে হবে নিশ্চয়। তাই তাঁর কাছ থেকে পুত্র হারিয়ে গেলে তিনি নিঃস্ব হয়ে যাবেন। স্নেহ-ভালবাসার কথা উহ্য রাখলেও এখন পুত্রকে তার ভীষণ প্রয়োজন।

হঠাৎ এক পশলা জোর বাতাসে বিভাণ্ডক যেন সম্বিত ফিরে পেলেন আর অনুভব করলেন তাঁর দু-চোখ ঝাপসা এবং অধর বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে নামছে শ্মশ্রুমাঝে। সচেতন হয়ে তিনি হাত দিয়ে অশ্রু মুছলেন, তারপর হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, এই অশ্রুই পৃথিবীর মায়া। মানুষ কিংবা পশুপাখি, কেউই এই মায়ার উর্ধ্বে নয়; হোক সে ঋষি কিংবা গৃহী, দয়ালু কিংবা নিষ্ঠুর; গৃহপালিত পশুপাখি কিংবা অরণ্যের মৃগ অথবা হিংস্র ব্যঘ্র; সকলেই কোনো না কোনোভাবে মায়ায় আবদ্ধ। পৃথিবীটা মায়ার সংসার।


(চলবে......)


সহায়ক গ্রন্থ

১. বেদ -অনুবাদ: রমেশ চন্দ্র দত্ত
২. মনুসংহিতা -অনুবাদ: সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. রামায়ণ -মূল: বাল্মীকি; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৪. মহাভারত -মূল: কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাস; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৫. কামসূত্র -বাৎসায়ন
৬. কথা অমৃতসমান (দ্বিতীয় খণ্ড) -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৭. দণ্ডনীতি -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৮. জীবনীকোষ ভারতীয়-পৌরাণিক -শ্রীশশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার
৯. দেবলোকের যৌনজীবন -ডঃ অতুল সুর
১০. ভারতে বিবাহের ইতিহাস -ড: অতুল সুর
১১. প্রাচীন ভারতে শূদ্র -রামশরণ শর্মা
১২. প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস -ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ
১৩. ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য -সুকুমারী ভট্টাচার্য



মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:১৮

রাজীব নুর বলেছেন: সয়াহক গ্রন্থের ১০ নম্বর বইটা কি কোলকাতার?

০৯ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:১১

মিশু মিলন বলেছেন: হ্যাঁ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত। ধন্যবাদ।

২| ১০ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৮:৫৪

রাশিয়া বলেছেন: ঋষিগণ পরনারীর সাথে কামকলায় লিপ্ত হলেও কোন অন্যায় হয়না, আর অন্যায় হলেও তা ঢাকার জন্য অলীক অবাস্তব কল্পকাহিনী ছড়িয়ে দেয়। কিয়েক্টাবস্থা!

১০ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:০১

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৪৪

আনমোনা বলেছেন: বিভাণ্ডক ঋষি মানব চরিত্র সম্পর্কে ভালোই ধারনা রাখে। উর্বশী কোথায় গেল, জানা যাবে কি?

লেখা ভালো লাগছে।

১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৩৮

মিশু মিলন বলেছেন: উর্বশী সুন্দরী কামশিল্পী (বারবনিতা), অর্থের বিনিময়ে নৃত্য-গীত করে এবং দেহসুখ দিয়ে সমাজের সম্ভান্ত শ্রেণির মানুষের মনোরঞ্জন করাই তার কাজ। সে সেই পথেই পা বাড়িয়েছে।

৪| ১৯ শে অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৭:৫৫

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:


পরের পর্ব দেখতে চল্লাম ।

২০ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:১১

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.