নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- বারো)

১৩ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:০০

বারো

মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে বিভ্রান্ত-মোহাবিষ্ট করার পর কৌশিকী পারের এক জন্মনের ঘাটে একনাগাড়ে তিনদিন অতিবাহিত করে গতকাল সন্ধ্যায় গণিকাদের তরণী নোঙর করেছে ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের সবচেয়ে নিকটবর্তী স্থানে। জন্মনের অস্থায়ী হাট থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয় করা হয়েছে। গিরিকার বেশ ভাল লেগেছিল জন্মনটি, অপরাহ্ণে কন্যাদের নিয়ে নদীর পার ধরে জন্মনের পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। গৃহী মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। নদীর পারের একটা পরিবারের সাথে তো বেশ ভাব জমে গিয়েছিল তার। তার ইচ্ছে ছিল গত রাত আর আজকের দিনটাও জন্মনের ঘাটে কাটিয়ে আসার। কিন্তু কন্যাদের পীড়াপীড়িতে গতকালই আসতে হয়েছে এই জন্য যে তারা ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতে আরোহণ করার বায়না ধরেছে। প্রথমে তারা বায়না ধরেছিল ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করার জন্য, কিন্তু রঘু যখন তাদেরকে জানিয়েছে যে ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়া নদী থেকে দেখা গেলেও আসলে তার অবস্থান অনেক দূরে, অসংখ্য ছোট-মাঝারি পর্বত অতিক্রম করে সেখানে যেতে হয়, পথ এতোই দূর্গম যে কৌশিকী নদী থেকে সর্বোচ্চ চূড়ায় যেতেই একদিন সময় লাগে, আর ওই ঝুঁকিপূর্ণ এবং দূর্গম পথে হেঁটে যাওয়া এতোটাই শ্রমসাধ্য যে কন্যাদের পক্ষে যাওয়া মোটেই সম্ভব নয়, তবে ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়া ঘিরে থাকা কোনো ছোট বা মাঝারি পর্বতে আরোহণ করে অপরাহ্ণের মধ্যেই ফিরে আসা সম্ভব; তখন কন্যারা আবদার করেছে যে তারা ওই ছোট বা মাঝারি পর্বতেই আরোহণ করবে, তবু তারা পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চায়।

তাই আজ পুব আকাশ রক্তিমবর্ণ ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনকন্যা যাত্রা শুরু করেছে পর্বতারোহণের উদ্দেশ্যে। তাদের পথ প্রদর্শক, রক্ষী এবং খাদ্যদ্রব্য বহনকারী হিসেবে সঙ্গে যাচ্ছে রঘু, শ্যাম এবং সুকেতু; আর যাচ্ছে রাঁধুনী উলুপী। ইচ্ছে থাকলেও বয়সের কারণে যাবার সাহস করেন নি গিরিকা, চড়াই-উৎড়াইয়ের পথ পাড়ি দেবার শক্তি তার নেই। তার সঙ্গে তরণীতে রয়ে গেছে অন্য দুই দাঁড়ি বলাই আর ললিত। রঘু অবশ্য নিজে না গিয়ে বলাই অথবা ললিত যে কোনো একজনকে পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু রঘুর বয়সের অভিজ্ঞতা আর বিচক্ষণতার জন্য গিরিকার নির্দেশে তাকেও আসতে হয়েছে, যাতে কোনো বিপদের সম্মুখীন হলে সে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। রঘুর নির্দেশে সুকেতু সরু বুনো বাঁশ কেঁটে লাঠি বানিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে সকলের হাতে; লাঠি হাতে থাকলে পর্বত থেকে নামতে যেমনি সুবিধা হবে, তেমনি আচমকা সামনে সাপ কিংবা অন্য কোনো প্রাণি সামনে পড়লেও আত্মরক্ষা করা যাবে।

আশ্রম থেকে ফেরার পর শবরী গিরিকাকে যে বৃত্তান্ত জানিয়েছে তাতে গিরিকা তার কন্যার ওপর ভীষণ সন্তুষ্ট এবং তিনি খুবই আশবাদী যে মুনিকুমারকে তারা চম্পানগরীতে নিয়ে যেতে পারবেন। তার ধারণা নিশ্চয় মুনিকুমার শবরীর মোহে পড়েছে এবং পুত্রকে প্রলোভিত করার কারণে মহর্ষি বিভাণ্ডক এখন ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, তিনি নিশ্চয় আশপাশের অরণ্যে প্রলোভনকারীর সন্ধান করবেন এবং পুত্রকে কড়া প্রহরায় রাখবেন যাতে কেউ তার কাছে ঘেঁষতে না পারে। এজন্য আশ্রমের নিকট থেকে তারা সরে এসেছেন যাতে বিভাণ্ডক তাদেরকে খুঁজে না পান। কাউকে না পেয়ে দিন কয়েক পর নিশ্চয় তাঁর প্রহরা কিছুটা শিথিল হবে, পুনরায় পূর্বের মতো দিনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন পিতা-পুত্র। আর তখনই কন্যাদের নিয়ে আবার যেতে চান গিরিকা। যেহেতু কন্যার কর্মে তিনি সন্তুষ্ট, তাই তিনি কন্যাদের পর্বতারোহণের আবদার মেনে নিয়েছেন।

পর্বতারোহণের ইচ্ছেটা আসলে বেশি জেগেছে উমার। উমা-ই কথাটা প্রথমে বলেছে শবরীকে, শবরী শুরুতে কিছুটা দ্বিধান্বিত থাকলেও উমার পীড়াপীড়িতে নিজের দ্বিধা কাটিয়ে মাকেও রাজি করিয়েছে। যে কোনো আমোদ-প্রমোদের বিষয়ে বরাবরই সকলের চেয়ে শবরীর আগ্রহ বেশি থাকে, কিন্তু এবার তার দ্বিধার কারণ এই যে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকেই তার চিত্তের শান্তি উড়ে গেছে। বাইরে সকলের সঙ্গে হাসি-খুশি থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে খুব বিচলিত। সকলের মাঝে থেকেও সে যেন বিচরণ করছে অন্য কোথাও! এ কারণেই প্রথমে সে পর্বতারোহণের ব্যাপারে দ্বিধায় ছিল।

আশ্রম থেকে ফেরার পর চতুর্পার্শ্বের কোনোকিছুতেই যেন শবরীর কৌতুহল নেই, তার একমাত্র কৌতুহলের বিষয় মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ। জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ কিশোরের ন্যায় সরলতামাখা ঋষ্যশৃঙ্গ’র সুন্দর প্রশান্ত মুখশ্রী, তার আলিঙ্গন-চুম্বন, গন্ধ-স্পর্শ কিছুতেই সে ভুলতে পারছে না। ঋষ্যশৃঙ্গ’র ভাবনায় ডুবে বিমনা হয়ে থাকছে। উমা আর সুলোচনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার কাছ শুনেছে ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলোভিত করার গল্প। সেও নিখুঁতভাবে বলেছে সকল বৃত্তান্ত, এতোটুকুও ফাঁক রাখে নি। ঋষ্যশৃঙ্গ’র কথা বলতে পেরে ভীষণ সুখানুভূতি হয়েছে তার। যুবক ঋষ্যশৃঙ্গ তাকে পুরুষ তপস্বী ভেবেছে, আর কিছু না জেনেই কেবল তাৎক্ষণিক সুখ অনুভব করে তার সঙ্গে ঊরুপণ্ডহন করেছে শুনে উমা আর সুলোচনা হেসে ঢলে পড়েছে একে অন্যের শরীরে! কিন্তু ওরা দুজনের কেউই হয়তো জানতে পারে নি শবরীর অন্তরের কথা। জীবনে কামলীলায় পটু অনেক কামুক নাগর তার শরীর ভোগ করেছে, তাকে সুখী তো করেছেই, সুখ অতিক্রান্ত করে তাকে কান্তও করেছে; আর ঋষ্যশৃঙ্গ’র কাছ থেকে সে সঙ্গম সুখ পায় নি, প্রবল কামতৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সংযত রেখে মুনিকুমারকে ছেড়ে এসে ঝিরির শীতল জলের স্রোতের মুখে উপবেশন করে আঁজলা ভরে জল নিয়ে মাথা ভিজিয়ে আর জলপান করে কামোত্তেজনাপূর্ণ তপ্ত শরীর জুড়িয়েছে! তারপরও অন্য কোনো পুরুষ নয়, কামকলায় অনিপুণ মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গই তার অন্তরে রেখাপাত করেছে। যতো না কামলালসা, তার চেয়ে অধিক মুনিকুমারের জন্য তার হৃদয় নদীতে জমেছে স্নেহের পলি। বালকের মতো এমন সরল আর মায়াময় চোখের অকপট যুবক সে জীবনেও দেখে নি!

এখন পর্বতের চড়াই-উৎড়াই ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে বারবার তার হৃদয়পটে আবির্ভুত হচ্ছে ঋষ্যশৃঙ্গ। তার বড়ো জানতে ইচ্ছে করছে এখন মুনিকুমার কেমন আছে, কী করছে। শ্যামের কণ্ঠে কোকিলের ডাক শুনে আশ্রম ছেড়ে চলে আসবার সময় মুনিকুমার কামাতুর হয়ে ভূমিতে শয়ান করে অবোধ বালকের মতো অসহায় সুরে বারবার আবদার করছিল পুনরায় তাকে আলিঙ্গন এবং চুম্বন করার জন্য। নিশ্চয় তাকে খুঁজে না পেয়ে মন খারাপ হয়েছে মুনিকুমারের, হয়তো-বা পিতার ভর্ৎসনাও শুনতে হয়েছে।

পর্বতের পথে হাঁটতে হাঁটতে সে ভীষণভাবে অনুভব করছে ঋষ্যশৃঙ্গকে। মনে হচ্ছে পথের কোনো এক বাঁকে ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে তার দেখা হবে, কোনো এক বৃক্ষতলায় কি ঝরনার পাশের প্রস্তরখণ্ডে উপবশন করে ঋষ্যশৃঙ্গ তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার এই উন্মনা ভাব লক্ষ্য করে কাছে এসে উমা বললো, ‘সখি, ক’দিন যাবৎ লক্ষ্য করছি কোনোকিছুতেই তোর মন নেই। এখন এই চমৎকার পর্বতারোহণেও তোর কোনো উচ্ছ্বাস দেখছি না। কী হয়েছে তোর বলতো?’

তার এই মনের গোপন রোগের কথা কাউকেই জানাতে ইচ্ছে করছে না। উমা তার প্রিয় সখি, তবু মনে হচ্ছে ওকেও বলার দরকার নেই, গোপন রোগের কথা গোপনই থাক। জোর করে ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বললো, ‘কই, কিচ্ছু হয় নি! চল একটু জোরে পা চালাই, আমরা যে পিছিয়ে পড়ছি।’

বেশ কিছু ছোট ছোট পর্বত ডিঙিয়ে ওরা এখন অনেকটা ওপরে চলে এসেছে। সকলেই তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছে। উমা তৃষ্ণার কথা রঘুকে জানাতেই কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেবার সিদ্ধান্ত নিলো রঘু, তার প্রৌঢ় শরীরও একটু বিশ্রামের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। একটা বৃক্ষের তলায় বসলো সকলেই, উলুপীর হাতের হালকা জলখাবার আহার আর জল পান করে শ্রান্তি দূর হলো সকলের। কিছুক্ষণ বাদেই আবার যাত্রা শুরু করলো। যেতে যেতে পর্বতের পাদদেশে ঋষিদের একটা আশ্রম চোখে পড়লো, বেশ পরিপাটী আর সুনসান কুটীরের দেহলীতে উপবেশন করে একজন ঋষি নিমীলিত চোখে ধ্যান করছেন। দুটো পর্বত অতিক্রম করার পর আরও একটি আশ্রম দেখতে পেলো তারা, কিন্তু এখানে কাউকেই দেখতে পেলো না; ঋষিরা হয়তো-বা কুটীরের ভেতরে আছেন অথবা অন্যত্র কোথাও গেছেন। তারা আশ্রম অতিক্রম করে ক্রমশ ওপর দিকে ধাবিত হলো।

শবরী একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে না, উমা আর সুকেতু ইচ্ছে করে বারবার পিছনে পড়ছে। সকলে বাঁক ঘুরে এগিয়ে গেলেও ওরা চোখের আড়ালেই পড়ে থাকছে। ব্যাপারটা রঘুর চোখেও ধরা পড়েছে। আর রঘু ইচ্ছে করেই শবরীকে অন্তত দু-বার বলেছে, ‘মাতা আমরা একটু আস্তে যাই, সুকেতু আর উমা মাতা বুঝি পিছনে পড়ে গেছে।’

তারপর উমা আর সুকেতু এলে ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে একসময় রঘু সুযোগ বুঝে সুকেতুর কানের কাছে গিয়ে শাসিয়েছে, ‘এরা রাজবাড়ীর অতিথি, এমন-তেমন কিছু যদি করিস তো মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেবে রাজবাড়ীর কর্তারা!’

সুকেতু পাল্টা মুখ ঝামটা দিয়েছে রঘুকে, ‘সবকিছুতেই তোমার ভয় তাত। কন্যাটি খোলা মনের তাই আমার সাথে গল্প করছে, আমরা তরণী নিয়ে কোথায় কোথায় যাই, সেইসব দেশের মানুষ কেমন, এইসব জানতে চাইছে, তাই বলছি। আর তুমি ধরে নিলে আমি এমন-তেমন করছি!’

শ্যাম হাঁটছে চুপি চুপি সকলের আগে, তার কাঁধে একটি মোট, হাতে লাঠি, গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। এখন তার পিছেই হাঁটছে শবরী আর উমা। উমা তার উদ্দেশে বললো, ‘কী গো দাঁড়ি, তোমার মুখে যে কোনো কথাই নেই! এমন চুপ করে থাকো কেন?’
মুহূর্তের জন্য শ্যাম একবার তাকালো পিছন ফিরে, তারপর বললো, ‘এমনি।’

‘তা সেদিন তো হাট থেকে মণ্ডা কিনে এনে খাওয়ালে আমার সখিকে, আজ আবার কোনো বুনো ফল খাওয়াবে নাকি?’

‘পেলে খাওয়াবো।’

শ্যামের মধ্যে প্রথম দিনের সেই আড়ষ্টভাব আর নেই। এই কদিনে গিরিকা এবং তিন কন্যার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার জড়তা কেটে গেছে, বিশেষত জন্মনের ঘাটে তরণী নোঙর করে তিনদিন থাকার সময় যখন সে আর বলাই গুলি-ডাণ্ডা খেলেছে নদীর পারে তখন থেকে। গুলি-ডাণ্ডা খেলায় সে দারুণ চৌকস, সুকেতু-বলাই-ললিত ওরা কেউ একবারও তার সঙ্গে জিততে পারে নি। আর কী কারণে কে জানে শবরী শ্যামকেই সমর্থন করেছে, উমা আর সুলোচনা সমর্থন করেছে সুকেতুকে। বলাই আর ললিতের ভাগ্যে কারো সমর্থন জোটে নি।

শ্যাম ভাল খেললে শবরী তাকে উৎসাহ দিতে হাততালি দিয়েছে, আবার সুকেতু ভাল খেললে হাততালি দিয়েছে উমা আর সুলোচনা। কিন্তু দারুণ লড়লেও শেষ পর্যন্ত সুকেতু শ্যামের সঙ্গে পেরে ওঠে নি। কৌশিকী নদীতে সাঁতার প্রতিযোগিতাও হয়েছে একদিন, সাঁতারে অবশ্য জয় হয়েছে সুকেতুর। তখন উমার সে কী উচ্ছ্বাস!

দুই পর্বতের মাঝখানে একটা ছোট্ট ঝরনা দেখে বালিকার মতো আপ্লুত হয়ে ছুটে গেল শবরী, ঝরনার জলে পা ডুবিয়ে আঁজলায় জল নিয়ে হাত-মুখ ধুতে লাগলো। ওকে দেখে ছুটলো উমা আর সুলোচনাও। এরপর সকলেই হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া উপহারের মতো ঝরনার জলের সদ্ব্যবহার করতে লাগলো। উলুপী আর সুকেতু জলের ঘড়ার খালি অংশটুকু পূর্ণ করে নিলো।

জলপান-বিশ্রাম শেষে আবার যাত্রা শুরু হলো।

পর্বতে অসংখ্য বৃক্ষ এবং লতাপাতা, অগণিত কদলীগাছ, তারই ভেতর দিয়ে সরু পথ, দেখেই অনুমিত হয় যে মানুষের চলাফেরায় এই পথ তৈরি হয়েছে। এদিকে ঋষিদের আশ্রম যেমনি আছে, তেমনি আশপাশের পর্বতে বিভিন্ন অনার্যগোষ্ঠীও বাস করে। তাদের নিত্য চলাফেরায় এই পথ তৈরি হয়েছে। সরু পথ দিয়ে হাঁটার সময় অরণ্যের বৃক্ষ-লতার দারুণ গন্ধ পাওয়া যায়।

রঘু ভূমিতে নিজের ছায়া দেখে সকলের উদ্দেশে বললো, ‘আর কিছুক্ষণ বাদেই সূর্যদেব মাথার ঠিক ওপরে অবস্থান করবেন। সামনের ওই উঁচু পর্বতটায় উঠেই আমরা যাত্রা শেষ করবো। ওখানে বসে আহার সেরে আবার ফেরার পথ ধরবো।’

উঁচু পর্বতে উঠার পর জল পান করে সকলেই যে যার মতো পা ছড়িয়ে সুস্থির হয়ে বসলো, হাঁটুর ওপর বড্ড ধকল গেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর যে যার মতো পর্বতটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। শবরী হাঁটতে হাঁটতে পর্বতটির উত্তর দিকের ঢালের কাছে চলে এলো।

এখান থেকে নিচের পর্বতগুলো চমৎকার লাগে দেখতে; অজস্র বৃক্ষের সমারোহে চতুর্দিকে কী সুন্দর সবুজ! একেকটি পর্বতকে তার মনে হচ্ছে একেকজন ধ্যানী ঋষি, যেন অনন্তকাল ধরে তপশ্চর্যা করে চলেছে! পর্বতের ঢালে অনেকগুলো কদলীবৃক্ষে কাঁদি কাঁদি কদলী পেকে আছে, একটা টিয়াপাখি ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে কদলী। খানিকটা দূরে একটা জামগাছে পেকে আছে পাকা জাম, খাদক যথারীতি পাখিরা। নগরীতে মানুষের খাদ্য তো বটেই পাখিদের খাদ্যেরও বেজায় অভাব এখন, আর এখানে পাখিদের খাদ্যের প্রাচুর্য দেখে নগরীর মানুষও ঈর্ষান্বিত বোধ করবে। হঠাৎ উমা আর সুলোচনাকে ডাকলো শবরী, ‘সখি এদিকে আয়, দেখ…।’

ওরা এলে আঙুল দিয়ে দূরের একটা জন্মন্ দেখিয়ে বললো, ‘দেখ, কী সুন্দর জন্মন্!’

উমা বললো, ‘তাই তো খুব সুন্দর!’

এতো দূর থেকে ওরা কোনো মানুষ দেখতে পেলো না, কেবল দেখতে পেল সবুজ প্রকৃতির মাঝখানে একটু পর পর দাঁড়িয়ে থাকা কিছু গৃহ।

কিছুক্ষণ পরই উলুপী দ্বিপ্রহরের আহারের আহ্বান জানালো সকলকে, সকলে লাইন দিয়ে বসলে উলুপী সকলকে কদলীপাতায় আটার রুটি আর কুক্কুটের মাংস পরিবেশন করলো। আহার করতে করতে শবরী বললো, ‘তোমাদের রান্না খুব সু-স্বাদু উলুপী, কিন্তু এখন যেন আরো বেশি সু-স্বাদু লাগছে!’

পর্বতারোহণ করে সকলেই খুব ক্ষুধার্ত, নিত্যদিনের চেয়ে অধিক আহার করলো সকলেই। আহার শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর ফেরার পথ ধরলো। পর্বত থেকে নামার সময় পিছন থেকে অদৃশ্য দৈত্য যেন অনবরত ফুঁ দিয়ে নিচের দিকে ঠেলে দেয়! তিনকন্যাকে হুড়হুড় করে নামতে দেখে সতর্ক করলো রঘু, ‘মাতারা শরীর ছেড়ে দিয়ে অমন হুড়হুড় করে নামবেন না, পড়ে গেলে বিপদ হতে পারে। শরীর নিয়ন্ত্রণে রেখে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটুন।’

দেখতে দেখতে দুটো পর্বত পেরিয়ে আবার সেই ঝরনার কাছে এসে দাঁড়ালো সবাই। পর্বতে উঠতেই যতো সময় আর শক্তি ব্যয় হয়, নামতে দুয়ের-ই হয় সাশ্রয়। উলুপী আর সুকেতু জলের ঘড়াগুলো ভরে নিলো। কন্যারাও পুনরায় ভিজিয়ে নিলো মুখ, হাত-পা।

ঝরনা থেকে নিচের দিকে নামতে প্রথম বাঁকটা ঘুরতেই তীর-ধনুক আর ভল্ল হাতে দশ-বারোজন নারী-পুরুষ আচমকা সামনে থেকে এসে তাদের ঘিরে ধরলো। কন্যারা ভয়ে চিৎকার করে হাতের লাঠি ফেলে একে-অপরকে জড়িয়ে ধরলো। শ্যাম আর সুকেতু সঙ্গে সঙ্গে মোট এবং জলের ঘড়া ভূমিতে নামিয়ে কন্যাদের আড়াল করে দাঁড়ালো অস্ত্রধারীদের সামনে। কন্যারা ভীতচোখে অস্ত্রধারীদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো এরা কী মানুষ না দৈত্য! সকলেরই গাত্রবর্ণ অমাবশ্যার রাত্রির ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ; ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো অধিবাস নেই, নিন্মাঙ্গে অতিশয় ক্ষুদ্র বাস। সকলেরই মাথায় দীর্ঘ কৃষ্ণবর্ণ কেশ। উদোম বক্ষের স্ফীত স্তন দেখে কয়েকজনকে নারী হিসেবে চি‎হ্নিত করা যায়। নারী-পুরুষ উভয়েরই খাঁদা নাক-স্ফীত নাসারন্ধ্র, মাথায় পাতার মুকুট, কানে দুল, কণ্ঠে বড়ো বড়ো পুঁতি আর তামার চাকতির মাল্য, বাহুতেও পুঁতির মাল্য। তীর-ধনুক আর ভল্ল তাক করে তীক্ষ্ণ চোখে চোখে তাকিয়ে আছে তারা। ভীত রঘুর মুখ থেকে অস্ফুটে বের হলো একটি শব্দ, ‘রাক্ষস!’


(চলবে.....)


সহায়ক গ্রন্থ

১. বেদ -অনুবাদ: রমেশ চন্দ্র দত্ত
২. মনুসংহিতা -অনুবাদ: সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. রামায়ণ -মূল: বাল্মীকি; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৪. মহাভারত -মূল: কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাস; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৫. কামসূত্র -বাৎসায়ন
৬. কথা অমৃতসমান (দ্বিতীয় খণ্ড) -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৭. দণ্ডনীতি -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৮. জীবনীকোষ ভারতীয়-পৌরাণিক -শ্রীশশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার
৯. দেবলোকের যৌনজীবন -ডঃ অতুল সুর
১০. ভারতে বিবাহের ইতিহাস -ড: অতুল সুর
১১. প্রাচীন ভারতে শূদ্র -রামশরণ শর্মা
১২. প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস -ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ
১৩. ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য -সুকুমারী ভট্টাচার্য



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:৩৯

রাজীব নুর বলেছেন: আপনার যদি সমস্যা হয় তাহলে একেবারে শেষ পর্বে সহায়ক গ্রন্থের নাম গুলো দিতে পারেন।

আপনি ভালো লিখেন অথচ আপনার ব্লগে কেউ আসে না। এর কারন আপনি কারো পোষ্টে জান না।

১৩ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৭

মিশু মিলন বলেছেন: আপনি ভালো লিখেন অথচ আপনার ব্লগে কেউ আসে না। এর কারন আপনি কারো পোষ্টে জান না

আপনার অভিযোগ অনেকটাই সত্য। তবে অন্যের ব্লগে গিয়ে গিয়ে পাঠক তৈরি করতে হবে এই বিনিময় ব্যাপারটি আমার অপছন্দ। ভালো লেখা চোখে পড়লে পড়ি, তেমনিভাবে আমার লেখা কারো ভালো লাগলে পড়বে, অথবা পড়বে না। ভালো থাকবেন।

২| ১৯ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:৩৩

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:



পর্বত আরোহনের বিবরন বিশেষ করে পাহারের পাকৃতিক দৃশ্যাবলী ও
গাছ ,লতা পাতা , ফল ফুলের বিবরণ মনোমুগ্ধকর হয়েছে।

একটি সফল উপন্যাসের সব কটি বৈশিষ্টই লেখাটিতে প্রতিফলিত হয়েছে বলে অনুভুত হলো।

প্রতিটি পর্বের শেষে কোন বিশেষ ঘটনা ও তথ্যের সুত্র সহ সহায়ক গ্রন্থের নামের সাথে এর প্রকাশকাল , প্রকাশক
ও সম্ভব হলে পুস্তকগুলির কোন অনলাইন লিংক সংযুক্ত করে দিলে আমাদের মত অনেক পাঠক সংস।লিষ্ট বিষয়গুলি
সহজে পাঠ করে নীজের জানার পরিধিকে বৃস্তিত করতে পারবেন বলে মনে করি।

একটি সুখপাঠ্য নাগরী উপন্যাস সহজ সরল বাংলায় পর্বাকারে উপস্থাপনের জন্য ধন্যবাদ ।

শুভেচ্ছা রইল

২০ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:০৯

মিশু মিলন বলেছেন: উপন্যাসটি চার বছর আগে লেখা। তাই ঘটনা বা সূত্রের সঙ্গে বিস্তারিত তথ্য জানানো এখন একটু কঠিন, তাহলে আমাকে আবার বইগুলি নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হবে। আগের পর্বগুলিতে গ্রন্থগুলির নাম দিয়েছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.