নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
তেরো
গণিকারা মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সঙ্গে সঙ্গেই রাজবাড়ীতে ব্রাহ্মণদের সন্তুষ্টির জন্য যজ্ঞের আয়োজন শুরু হয়েছিল। রাজবাড়ীর কর্মচারীবৃন্দ রাজ্যের দিকে দিকে তরণী এবং রথারোহণে ছুটে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণদেরকে নিমন্ত্রণপূর্বক তাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার জন্য। অধিক রুগ্ন এবং নাবালক ব্যতিত বালক থেকে বৃদ্ধ, প্রায় সকল ব্রাহ্মণই সানন্দে যজ্ঞানুষ্ঠানে যোগদান করেছেন। বিপ্রগণের অংশগ্রহণে মঙ্গলমতো যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। যজ্ঞের চারজন প্রধান ঋত্বিক ছিলেন ঋষি বলদেব, রাজপুরোহিত, চম্পানগরীর দুইজন বেদজ্ঞ পণ্ডিত রুদ্রসেন এবং প্রভাস। ঋত্বিকদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাশীল ব্রহ্মার দায়িত্ব পালন করেছেন ঋষি বলদেব, যজ্ঞবেদির দক্ষিণে উপবেশন করে নিন্মমধুর স্বরে জপ এবং যজ্ঞক্রিয়া তত্ত্বাবধান করেছন। উদাত্তকণ্ঠে মন্ত্র পাঠ করে হোতার দায়িত্ব পালন করেছেন রাজপুরোহিত, মন্ত্র গান করে উদ্গাতার দায়িত্ব পালন করেছেন রুদ্রসেন এবং আহুতি দিয়ে অধ্বর্যু’র দায়িত্ব পালন করেছেন প্রভাস।
দেবরাজ ইন্দ্রকে উৎসর্গ করে শতাধিক পশু বলি দেওয়া হয়েছে, যজ্ঞানুষ্ঠান শেষে অতিথি ব্রাহ্মণগণ পেট পুরে ভোজন করেছেন। এমনিতে মাংস ভোজন ব্রাহ্মণের জন্য বিধিসম্মত নয়, কিন্তু যজ্ঞের মন্ত্রপূত মাংস ভোজন বিধি সম্মত। যজ্ঞ ব্যতিত মাংস ভোজন রাক্ষস বিধি বলে স্বীকৃত।
যজ্ঞানুষ্ঠান এবং ভোজন শেষে বিদায়কালে ব্রাহ্মণদেরকে প্রচুর কড়ি, স্বর্ণ, বস্ত্র প্রভৃতি দান করেছেন রাজা লোমপাদ। রাজার কাছ থেকে দান গ্রহণ করে ব্রাহ্মণগণ খুশি চিত্তে প্রাণভরে আশির্বাদ করে গৃহাভিমুখে যাত্রা করেছেন।
এদিকে গণিকা দ্বারা মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করার কথাটি যথাসম্ভব গোপন রাখতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত আর গোপন থাকে নি। চম্পানগরীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই সংবাদ, আর নগরীর বাইরে থেকে যজ্ঞানুষ্ঠানে আগত ব্রাহ্মণদের দ্বারা সংবাদটি হয়তো-বা নগরীর বাইরেও প্রচারিত হয়েছে। যজ্ঞানুষ্ঠান ভালভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে চম্পানগরীর আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই গণিকাদের ফেরার অপেক্ষায় আছে। আশায় বুক বেঁধে আছে যে গণিকারা মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে আসবে, রাজ্যে বৃষ্টি নামবে, ফসল ফলবে, ক্ষুধা মিটবে, দূর হবে মরার আকাল। সকলেই ভাবে যে আজ হয়তো গণিকারা মুনিকুমারকে নিয়ে আসবে, কিন্তু দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, গণিকারা আর আসে না। পরদিন আবার স্বপ্ন বোনে যে আজ নিশ্চয় আসবে, সেই মতো অতি উৎসাহী কেউ কেউ গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসেও থাকে, কিন্তু গণিকাদের দেখা মেলে না। এমনিভাবে আশা-নিরাশায় ছয়দিন পেরোনোর পর কারো কারো আশার উজ্জ্বল প্রদীপটি আশঙ্কার বাতাসে মৃদু কাঁপতে শুরু করে, আট দিন পেরোনোর পর কারো কারো আশার প্রদীপের তেলেও টান পড়ে, আর দশদিন পেরোনোর পর আশার প্রদীপটি এখন নিভু নিভু; অনেকে গণিকাদের ফেরার আশা ছেড়েই দিয়েছে। অনেকেরই ধারণা যে গণিকারা আর বেঁচে নেই, বেঁচে থাকালে এতোদিনে নিশ্চয় তারা ফিরতো। বাল্য-কৈশোরে বড়োদের মুখে শোনা গৌতম মুনির অভিশাপে তার পত্নী অহল্যার প্রস্তরখণ্ড হবার আখ্যান প্রাপ্ত বয়স্কদের স্মৃতিতে চাগাড় দিয়ে ওঠে। নিজের মতো করে অনভিজ্ঞ-অপ্রাপ্ত বয়স্কদেরকে শোনায় সেই আখ্যান, মুখে মুখে আরো অনেকের মাঝে তা ছড়িয়ে পড়ে। অভিজ্ঞ বৃদ্ধরা বিপণী কিংবা বিষ্ণু মন্দিরের চাতালের সামনের জটলায় এই সিদ্ধান্ত দেয় যে- নিশ্চয় গণিকারা মহর্ষি বিভাণ্ডকের অভিশাপে ভস্ম নয়তো প্রস্তরখণ্ড হয়ে অরণ্যে পড়ে আছে; বেচারা দাঁড়িদের কপাল মন্দ, তাই তাদেরও একই দশা হয়েছে!
এইসব আশঙ্কার কথা বাতাসের বেগে ছড়ায় নগরীতে। আবার অনেকের ধারণা গণিকারা বেঁচে থাকলেও মানুষরূপে নেই; মহর্ষি বিভাণ্ডকের অভিশাপে হয়তো বানর হয়ে অরণ্যের ফল-মূল আহার করে দিনযাপন করছে অথবা বৃক্ষ হয়ে মিশে আছে অরণ্যের অন্যান্য বৃক্ষের মাঝে; শত কি সহস্র বছরেও তাদের মুক্তির আর কোনো আশা নেই! রাজসভা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের শয্যাকক্ষ, রন্ধনশালা, তাঁতশালা, শৌণ্ডিকালয়, গঙ্গা-চম্পানদীর ঘাট, নগরীর সর্বত্র এখন এইসব আলোচনা চলছে। অঙ্গরাজ্যে বৃষ্টির সকল সম্ভাবনা শেষ ভেবে কেউ কেউ তার চাষের ফাটা চৌচির ভূমির চিত্র মনে করে কপাল চাপড়ে কাঁদছে, কেউ কেউ অঙ্গরাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে বসতি গড়ার কথা ভাবছে, কেউবা হতভাগিনী গণিকাদের করুণ পরিণতির কথা চিন্তা করে তাদের জন্য চোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। নগরীর কবিগণ লিখছেন হতভাগিনী গণিকাদের নিয়ে বিয়োগাত্মক কাব্যগাঁথা! আবার নগরীর কোনো শৌণ্ডিকালয়ে পান করতে করতে কোনো কোনো পানশৌণ্ড শবরী কি সুলোচনার কথা বলতে বলতে ভেউ ভেউ করে কাঁদছেও!
রাজা লোমপাদ দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত্রি পার করছেন, শরীর ভেঙে পড়ছে তার। ভাবছেন, এবার বুঝি সত্যি সত্যি রাজত্ব ছেড়ে অরণ্যে গিয়ে তপশ্চর্যা করে তাঁর দেহ ক্ষয় করা উচিত। পতির নিরন্তর হাতাশা আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখাবয়ব দেখে রাজমহিষী বর্ষিণীর চোখেও ঘুম নেই। পতি রাজত্ব ত্যাগ করে অরণ্যবাসী হলে তাঁকেও তো তাঁর সঙ্গ নিতে হবে। পতি বিনা এই রাজবাড়ীতে একটি দিনও তিনি বাঁচতে চান না। শত হতাশার মাঝেও তিনি পতির পাশে থেকে পতিকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন। শয্যায় শয়ান পতির কেশে হাত বুলাতে বুলাতে রাজমহিষী বর্ষিণী বললেন, ‘আপনি ভেঙে পড়বেন না, দেখবেন গণিকারা ঠিক ফিরে আসবে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে সঙ্গে নিয়ে।’
লোমপাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, ‘মিথ্যে আশায় আর কতো বুক বাঁধবো রানি!’
‘কিন্তু আপনি ভেঙে পড়লে তো চলবে না। সবাই তাকিয়ে আছে আপনার দিকে, আপনাকে তো শক্ত থাকতে হবে।’
‘কী উপায়ে শক্ত থাকবো রানি? ভূমিতে ফসল নেই, নদীতে মৎস্য নেই, অরণ্যে পশুপাখি নেই; প্রজাদের নিজেদেরই উদর পূর্তির অন্ন নেই, কর দেবে কী করে! তার ওপর একের পর এক যজ্ঞানুষ্ঠান করতে করতে রাজকোষ শূন্য হতে চলেছে! মগধরাজ রাজ্য আক্রমণের জন্য অস্ত্রে শান দিচ্ছেন। আমি যে দু-চোখে ঘোর অমানিশা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এবার বুঝি আমাকে রাজ্য ত্যাগ করে বনবাসী হতে হবে।’
‘অনেক ধৈর্য ধরেছেন আপনি। আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন; আরেকটু ধৈর্য ধরুন। আমার মন বলছে গণিকারা মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করে নিশ্চয় আনবে, তারা হয়তো সুযোগের অপেক্ষায় আছে।’
লোমপাদ শূন্যে দৃষ্টি রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুটস্বরে আওড়ালেন, ‘ধৈর্য…ধৈর্য…আরো ধৈর্য….! আমি আর পারছি না রানি।’
গণিকারা ফিরে না আসায় সমগ্র চম্পানগরীতে হয়তো আনন্দ চিত্তে আছে কেবল রাজকন্যা শান্তা আর তার সখিরা! গত ক’দিন ধরেই শান্তা আর কাঁদছে না, মন খারাপ করে গৃহকোনে বসেও থাকছে না। সখিদের সঙ্গে একটু-আধটু হাসি-ঠাট্টাও করছে। আজ মধ্যাহ্নে যেমন প্রিয় সখি রাধাকে বললো, ‘রাধা, গণিকারা নিশ্চয় মরেছে; তোমার কী মনে হয়?’
‘নিশ্চয় মরেছে সখি; লোভী গণিকারা নিশ্চয় এখন কেউ প্রস্তরখণ্ড, কেউ ভস্ম হয়ে অরণ্যে পড়ে আছে, কেউবা বৃক্ষ হয়ে অরণ্যে দাঁড়িয়ে আছে আর পাখপাখালি ওদের ওপর মলত্যাগ করছে!’
রাধার এই কথায় হেসে গলে পড়লো শান্তা, হাসি সামলাতে না পেরে ঢলে পড়লো শয্যায়! হাসির দমক কিছুটা সামলে বললো, ‘মাতা গো, তুমি পারোও সখি!’
রাধা উৎসাহ পেয়ে শান্তাকে আরো হাসাতে বললো, ‘শুধু কী পাখপাখালি? মনে করো গণিকা শবরী প্রস্তরখণ্ড হয়ে অরণ্যে পড়ে আছে, আর ইয়া বড়ো একটা বন্যহস্তী ওই পথ দিয়ে যাবার সময় প্রস্তরখণ্ডের ওপর এই এতোটা মলত্যাগ করেছে!’
দু-হাত প্রসারিত করে পরিমাণ বোঝালো রাধা। তার কথা শেষ হতেই শান্তা পুনরায় অট্টহাস্য করে বললো, ‘সখি তুমি চুপ করো, চুপ করো; মাতা গো, হাসতে হাসতে আমার দম রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে!’
সখিরা এভাবেই শান্তাকে হাসি-আনন্দে রাখার চেষ্টা করছে, আর শান্তার মনে ক্রমশ এই বিশ্বাস দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে যে গণিকারা আর কখনোই চম্পানগরীতে ফিরে আসবে না; নিশ্চয় তারা ভস্ম নয়তো প্রস্তরখণ্ড পড়ে আছে অরণ্যে অথবা বৃক্ষ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে!
(চলবে.......)
১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১:০৪
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
২| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:৫৭
নেওয়াজ আলি বলেছেন: অনবদ্য ,লিখে যান,,
১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:১৮
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
৩| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৪৮
আনমোনা বলেছেন: মুনিকুমারকে নিয়ে আসলে কি সত্যিই বৃষ্টি হবে? হলে, তার কারণ কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
চমৎকার লেখা।
১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:২৮
মিশু মিলন বলেছেন: সেটা এখনই বলে দিলে পাঠের আনন্দ নষ্ট হয়ে যাবে। শেষের দিকে সেই রহস্য উন্মোচিত হবে। ধন্যবাদ।
৪| ২০ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১:২৪
ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
ভাল লেগেছে ।
পরের পর্ব দেখতে চললাম ।
শুভেচ্ছা রইল
২০ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:০৩
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১২:২৫
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা। সুন্দর ইতিহাস।