নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- ষোলো )

২২ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:৩২

ষোল

রৌদ্রজ্জ্বল দ্বিপ্রহরে তরণী ভেসে চলেছে চম্পানগরীর দিকে, আর মাত্র দুই ক্রোশ পথ পাড়ি দিলেই চম্পানগরী। রঘুর নির্দেশে এরই মধ্যে মাস্তুলে অঙ্গরাজ্যের ধ্বজার নিচে আরও একটি বর্ণিল ধ্বজা উড়িয়েছে সুকেতু। গণিকারা সফলভাবে ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করতে পারলে নগরী থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে থাকতেই মাস্তুলে অঙ্গরাজ্যের ধ্বজার নিচে বর্ণিল ধ্বজাটি উড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন অন্নদামঙ্গল, যাতে তরণী দূরে থাকতেই ধ্বজা দেখে নগরীর ঘাটের সংবাদ-বাহক ঋষ্যশৃঙ্গ’র আগমন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চটজলদি সুসংবাদ পৌঁছে দিতে পারে রাজবাড়ীতে। দুটো ধ্বজাই এখন বাতাসে পতপত করে উড়ছে।

তরণী যতো চম্পানগরীর দিকে ধাবিত হচ্ছে, শবরীর বক্ষের ভেতরটা ততো তোলপাড় করছে। এখনো ঋষ্যশৃঙ্গ’র ওপর তার পূর্ণ অধিকার বিরাজমান, কিন্তু তরণী চম্পানগরীর ঘাটে নোঙর করলেই তার আর কোনো অধিকার থাকবে না ঋষ্যশৃঙ্গ’র ওপর। জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ মুনিকুমারকে হয়তো বিপুল অভ্যর্থনায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে রাজবাড়ীতে, মহাসমারোহে রাজকন্যার সঙ্গে তার বিবাহ হবে। আর সে ফিরে যাবে গণিকালয়ে, অভ্যস্ত হয়ে পড়বে পূর্বের জীবনে। হয়তো আর কোনোদিন ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে তার দেখাই হবে না। রাজজামাতা হবার পর রাজকুমারী শান্তার মতো রূপবতী পত্নী পেয়ে সে কি আর মনে রাখবে এক সামান্য গণিকাকে? তবে একথা সত্য যে ঋষ্যশৃঙ্গ তাকেই প্রথম ভালবেসেছে, এটুকু প্রাপ্তিটুকুই সঞ্চিত হয়ে থাকবে তার জীবনাভিজ্ঞতার ঝুলিতে।

শবরীর কপোল বেয়ে একফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো ঋষ্যশৃঙ্গ’র কপালে আর শবরী চেয়ে রইলো সেই অশ্রুবিন্দুর দিকে। ঘুম থেকে উঠে ঋষ্যশৃঙ্গ’র প্রাতঃকৃত্য, স্নান এবং প্রাতঃরাশের পর গল্পে গল্পে শবরী তাকে কয়েক পাত্র মদ্য পান করিয়েছে, যাতে সে আশ্রমে ফিরে যাবার কথা ভুলে থাকে। মদ্যপানের পর শয্যায় শুয়ে শবরীর কোলে মাথা রেখে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে ঋষ্যশৃঙ্গ। গিরিকা একবার এসে শবরীকে তাড়া দিয়ে গেছেন ঋষ্যশৃঙ্গকে ঘুম থেকে জাগিয়ে রাজপরিচ্ছদ পরিয়ে সাজানোর জন্য। মাত্র দুই ক্রোশ পথ পাড়ি দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু ঋষ্যশৃঙ্গকে জাগাতে ইচ্ছে করছে না শবরীর, তার ঊরুতে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমানো ঋষ্যশৃঙ্গ’র নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভীষণ ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে এই ঘুমন্ত মুখ তো আর কখনো দেখতে পাবে না সে। চোরের মতো চুপি চুপি ঘুমন্ত প্রিয়জনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকায় যে অবর্ণনীয় দারুণ সুখ অনুভূত হয় চিত্তে তা এই প্রথম অনুভব করলো সে। কিন্তু পরমুহূর্তে যখনই মনে হলো তার এই সুখ ক্ষণকালের, আর কোনোদিন সে এই সুখ অনুভব করতে পারবে না, তখনই বিষাদে ভরে গেল তার চিত্ত। আবার ক্ষণকাল পরই কাল রাতের কথা মনে পড়তেই বিষাদের মেঘের মাঝেও এক চিলতে রোদের মতো হাসি ঔজ্জ্বল্য ছড়ালো তার ওষ্ঠে! ওষ্ঠে ওষ্ঠ চেপে অশ্রুসিক্ত চোখে হাত বুলাতে লাগলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র কেশে। কালরাতে আশ্রমে ফিরে যাবার জন্য একগুঁয়ে বালকের মতো জেদ ধরেছিল, আর আজ অনেক বেলায় ঘুম থেকে উঠে আশ্রমে ফিরে যাবার কথা মুখেও আনে নি; উল্টো বলেছে, ‘প্রেয়সী, তোমাদের এই আশ্রমটি আমাদের আশ্রম অপেক্ষা অধিক উত্তম, চলমান হওয়ায় নদীপারের অনেক কিছু দৃষ্টিগোচর হয়!’

শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র কপালে আলতো চুম্বন করলো। ক্ষণকাল পর আপনা-আপনিই ঋষ্যশৃঙ্গ’র ঘুম ভাঙলো। ঋষ্যশৃঙ্গ কিছু বুঝে উঠার আগেই শবরী দ্রুত চোখের জল মুছে ফেললো। ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীর মুখে দৃষ্টি রেখে বললো, ‘প্রেয়সী, আমি তোমার সঙ্গে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝি?’

শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র কেশে হাত বুলিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ তপোধন, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে।’

তারপর মাথা নিচু করে আলতো করে চুম্বন করলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র কপালে, ঋষ্যশৃঙ্গও চুম্বন করলো শবরীর কপালে।

শবরী বললো, ‘এখন ওঠো, আমরা আমাদের আশ্রমের কাছাকাছি চলে এসেছি। আমাদের তৈরি হতে হবে।’

উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙলো ঋষ্যশৃঙ্গ, হঠাৎ বাতায়ন দিয়ে গঙ্গাবক্ষে ভাসমান একটি তামার পাত্রে দৃষ্টি পড়তেই সে বললো, ‘প্রেয়সী, ওটা কী ভেসে যাচ্ছে?’

শবরী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো তামার পাত্রটিকে, পাত্রের গায়ে সিঁদূর মাখানো, আর লতার জাল দিয়ে মুখ ঢাকা। সে বললো, ‘হয়তো মধুপুরী, প্রয়াগ, পাঞ্চাল প্রভৃতি অঞ্চলের কোনো অনার্য জাতি জীবিত অথবা মৃত শিশু পাত্রে রেখে ভাসিয়ে দিয়েছে।’

অবাক হয় ঋষ্যশৃঙ্গ, ‘শিশু! কেন?’

‘যদি কোনো অবিবাহিত কন্যা শিশুটির জন্ম দিয়ে থাকে, তবে সে শিশুটিকে ভাসিয়ে দিয়েছে এজন্য যে যাতে তার কলঙ্ক না হয়, ওই যে দেখছো পাত্রের গাত্রে রক্তিমবর্ণ সিঁদূর মাখানো, ওটা মঙ্গল চিহ্ন, যে শিশুটিকে ভাসিয়ে দিয়েছে সে শিশুটির মঙ্গল চায়, সে চায় শিশুটিকে কেউ পেয়ে লালন-পালন করুক। আর যদি শিশুটি মৃত হয়, তাহলেও এই কামনা করে ভাসিয়ে দিয়েছে যদি কোনো বৈদ্য শিশুটিকে পেয়ে জীবিত করতে পারে এই আশায়! কেবল অনার্য জাতি নয়, আজকাল অনেক আর্য জাতিও সিঁদূর ব্যবহার করে। হতে পারে পাত্রটি কোনো আর্য নারী-ই ভাসিয়েছে, তবে অনার্য হবার সম্ভাবনাই বেশি। আবার এমনও হতে পারে যে শিশু না হয়ে অন্য কোনো মূল্যবান বস্তু রয়েছে পাত্রের মধ্যে।’

পাত্রটি ভাসতে ভাসতে ঋষ্যশৃঙ্গ’র দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। গিরিকা এসে তাড়া দিলেন, ‘কী লো, তুই এখনো বসে আছিস? তপোধনকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দে।’

‘দিচ্ছি।’

ঋষ্যশৃঙ্গ স্নান করেছে সকালেই, শবরী তাকে নিয়ে স্নানাগারে গিয়ে হাত-মুখ ধুইয়ে, ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিলো। তারপর কক্ষে ফিরে এসে দেখলো উমা গিরিকার কাছ থেকে সুবর্ণ এবং রৌপের কারুকাজ করা মহামূল্যবান রাজকীয় পরিচ্ছদ এনে শয্যায় রাখছে। শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র শরীরের সাধারণ পরিচ্ছদ খুলে উমার সাহায্যে তাকে রাজকীয় পরিচ্ছদ পরিধান করাতে লাগলো।

ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘প্রেয়সী, তোমাদের আশ্রমে যেতে হলে বুঝি এইসব মূল্যবান পরিচ্ছদ পরিধান করতে হয়?’
‘হ্যাঁ তপোধন, সেটাই আমাদের রীতি।’

গিরিকা গহনার পুটলি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন, সঙ্গে সুলোচনা, পুটলি খুলে শয্যার ওপর রাখলেন বিভিন্ন ধরনের নয়টি মহামূল্যবান সুবর্ণমাল্য এবং অমূল্য রত্নখচিত ছয়টি অঙ্গুরীয়। শবরী হৃদয়ের কান্না গোপন করে একে একে নয়টি মহামূল্যবান সুবর্ণমাল্য পরিয়ে দিলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র কণ্ঠে, দুই হাতের আঙুলে পরিয়ে দিলো ছয়টি অঙ্গুরীয়। তারপর চন্দনের পাত্র হাতে নিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে সাজাতে বসলো সে। ঋষ্যশৃঙ্গ তাকে নিয়ে সকলের এতো আগ্রহ এবং আড়ম্বরপূর্ণ সাজসজ্জা দেখে নানা প্রশ্ন করতে লাগলো আর তার সকল প্রশ্নের চৌকস উত্তর দিতে লাগলেন গিরিকা।

হঠাৎ বাদ্যযন্ত্রের শব্দ কানে আসতেই কেঁপে উঠলো শবরী, যেনবা বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনির প্রতিধ্বনি শুরু হলো তার বক্ষের ভেতর! হাত কাঁপার ফলে ঋষ্যশৃঙ্গ’র কপালে চন্দন লেপটে গেল, লেপটানো চন্দন মুছে সে পুনরায় নিখুঁতভাবে চন্দন পরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। ক্রমাগত বাদ্যযন্ত্র বাজছে আর সেই সঙ্গে কাঁপছে তার বক্ষ। চেষ্টা করেও সে তার বক্ষের এই অস্বাভাবিক স্পন্দন ছন্দে আনতে পারলো না, ফলে তার হাত কাঁপতে লাগলো আর এর প্রভাব পড়তে লাগলো চন্দনের নকশায়। তাই চন্দনপাত্র সুলোচনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘তুই চন্দন পরা সখি, আমার ভাল হচ্ছে না।’

সুলোচনা অবিশ্বাসের সুরে বললো, ‘আমাদের মধ্যে তুই সবচেয়ে ভাল চন্দন পরাতে পারিস, আর তুই কি-না বলছিস ভাল হচ্ছে না!’
‘সত্যিই আমার ভাল হচ্ছে না, তুই নে সখি।’

উমা আড়চোখে তাকালো শবরীর দিকে। সুলোচনা আর কথা না বাড়িয়ে শবরীর হাত থেকে চন্দনপাত্র নিয়ে নিখুঁতভাবে পরিয়ে দিলো। বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি ক্রমশ জোরে বাজছে কানে। ঋষ্যশৃঙ্গ জানতে চাইলো, ‘কিসের শব্দ প্রেয়সী।’

‘বাদ্যযন্ত্র বাজছে তপোধন, তোমাকে অভিবাদন জানাতে।’

রাজকীয় পরিচ্ছদে সুসজ্জিত ঋষ্যশৃঙ্গকে রাজপুত্রের মতোই লাগছে! তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে শবরীর। সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে স্নানাগারে গেল। আপন মনে কিছুক্ষণ কাঁদলো একা একা। তাকে না দেখে স্নানাগারে খুঁজতে এসে থমকে দাঁড়ালো উমা। আস্তে করে হাত রাখলো শবরীর ঘাড়ে, ‘সখি…।’

শবরী কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলো উমাকে। উমা শবরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘তুই না বললেও আমি তোর মুখ দেখে আগেই বুঝেছি সখি, যে তুই তপোধনের ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিস। তোর দোষ নয় সখি, দোষ অদৃষ্টের; নইলে নগরে এতো এতো গণিকা থাকতে তপোধনকে হরণ করার জন্য আমাদেরকেই কেন যেতে হলো, আর নগরে এতো এতো মানুষ থাকতে একজন মুনিকুমারই বা কেন তোকে আকর্ষণ করলো। তুই মনটাকে শান্ত কর। তপোধন এখন হবু রাজজামাতা। তুই মনকে প্রবোধ দিয়ে তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা কর সখি।’

‘আমি ওই চাঁদমুখ কী করে ভুলে থাকবো সখি! ও আমার থেকে দূরে চলে যাবে ভাবতেই আমার হৃদয়ে ঝড় বইছে!’

‘এই ঝড় তোকে শান্ত করতেই হবে সখি। লক্ষ্মী সখি আমার, চোখ-মুখ ধুয়ে নে, ঘাটের কাছে চলে এসেছি, এখন চল।’

উমা শবরীকে ছেড়ে দিয়ে জলের বড়ো মুটকি থেকে ছোট ঘড়ায় জল তুলে ঢেলে দিলো শবরীর হাতের আঁজলায়, মুখ-হাত ধুয়ে ফেললো শবরী। তারপর উত্তরীয় দিয়ে হাত-মুখ মুছে স্নানাগার থেকে বেরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো।

ঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছে তরণী, অসংখ্য মানুষের কোলাহল আর শঙ্খ-ভেরী-মৃদঙ্গ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রে মুখর নদীর ঘাট। সারা নগরীর মানুষ যেন ভেঙে পড়েছে ঘাটে রাজজামাতাকে দেখতে! উলুপী এসে কপাটের বাইরে দাঁড়ালে তার উদ্দেশে গিরিকা বললেন, ‘দেখো মা, সবকিছু ঠিক মতো গুছিয়ে নিও। কিছু ফেলে যেও না যেন।’

ঘাড় নাড়লো উলুপী।

তরণী ঘাটে নোঙর করতেই হালকা একটা ঝাঁকুনিতে সামান্য টললো সকলেই। টাল সামলে গিরিকা শয্যার ওপর রাখা সুবর্ণ এবং রত্নখচিত মুকুট হাতে নিয়ে পরিয়ে দিলেন ঋষ্যশৃঙ্গ’র মাথায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে অমাত্য অন্নদামঙ্গল উঠে এলেন তরণীতে। কর্মকর্তারা কপাটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলেও অন্নদামঙ্গল কক্ষে প্রবেশ করলেন। ঋষ্যশৃঙ্গ’র সম্মুখ থেকে পাশে সরে দাঁড়ালো সকলে। অন্নদামঙ্গল ঋষ্যশৃঙ্গ’র উদ্দেশে বললেন, ‘অভিবাদন আপনাকে রাজজামাতা! আপনার পবিত্র চরণের স্পর্শে অঙ্গরাজ্যের ভূমি পবিত্র হোক। অঙ্গরাজ্যে বারি বর্ষিত হোক, ধুয়ে যাক সকল পাপ আর জরা-ব্যধি। আবার শান্তি বর্ষিত হোক অঙ্গরাজ্যে।’

ঋষ্যশৃঙ্গ হয়তো এসব কথার কোনো অর্থ বুঝলো না, সে তার বাঁ-পাশে দাঁড়ানো শবরীর মুখের দিকে তাকালো। অন্নদামঙ্গল গিরিকা এবং তার তিনকন্যার উদ্দেশে বললেন, ‘অসাধ্য সাধন করার জন্য তোমাদেরকেও অভিবাদন! তোমাদের নামে জয়ধ্বনি পড়ে গেছে নগরে।
জয় হোক তোমাদের। রাজজামাতাকে বাইরে নিয়ে এসো।’

বলেই কক্ষের বাইরে চলে গেলেন অন্নদামঙ্গল।
শবরীর কাঁধে হাত রেখে ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘প্রেয়সী, এরা কারা?’
‘এরা তোমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন তপোধন।’

শবরীর কাঁধে হাত রেখেই কক্ষের বাইরে এলো ঋষ্যশৃঙ্গ, সরু পথ দিয়ে শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র হাত ধরে আগে আগে হেঁটে তরণীর গলুইয়ের কাছে এসে হাত ছেড়ে দিয়ে পিছনে দাঁড়ালো; তার পাশেই গিরিকা, সুলোচনা এবং উমা। রাজবাড়ীর পুরনারীরা ঋষ্যশৃঙ্গ’র হাত ধরে তরণী থেকে নামাতে গেলে ঋষ্যশৃঙ্গ পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে বললো, ‘এরা আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন প্রেয়সী? আমি তোমার সঙ্গে যাব, তোমার সঙ্গে ব্রত পালন করবো।’

‘এখন এরা যা বলবেন সেটা পালন করাই তোমার কর্তব্য। তুমি আমার চেয়েও অধিক গুনবতী নারীর সঙ্গে ব্রত পালন করবে, এটাই এখানকার রীতি, যাও।’

রাজবাড়ীর পুরনারীরা ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে তরণী থেকে ভূমিতে পদার্পণ করলো। শবরী আর কোনো কথা বলতে পারলো না, কান্নায় তার কণ্ঠ রোধ হয়ে গেছে, অশ্রুপূর্ণ চোখে সে তাকিয়ে রইলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র দিকে। রাজপুরোহিত এবং রাজবাড়ীর সুসজ্জিত নারীগণ বরণডালায় সাজানো অগ্নি, পুষ্প, মাল্য, বিল্বপত্র, ধান্য-তিল-তুলসী প্রভৃতি দিয়ে হবু রাজজামাতাকে বরণ করছে। তাদের পিছনে রথ, তিনজোড়া শিবিকা, বাদকদল, গায়ক-গায়িকাবৃন্দ, ভৃত্য, মাহুতসহ কয়েকটি অতিকায় হস্তী। বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন জনতা উল্লাস করছে, জনস্রোতের সামনে বাঁধের মতো দাঁড়িয়ে আছে অশ্বারোহী এবং পদাতিক সৈন্য। নগরের মানুষের এতোদিনের রোগার্ত, শোকার্ত, মুমূর্ষু, ব্যথাতুর, বিপর্যস্ত হৃদয়-নদীতে হঠাৎ যেন নতুন জীবনের স্পন্দন ফিরে এসেছে! বিচলিত এবং ক্রমশ ম্রিয়মাণ প্রাণ হঠাৎ অধিক চঞ্চল হয়ে উঠেছে। নগরের শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ, নারী-পুরুষ যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল সংবাদ শোনামাত্র যেন তারা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ছুটে এসেছে, একে অন্যকে ঠেলেঠুলে মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছে হবু রাজজামাতাকে। অশ্বারোহী এবং পদাতিক সৈন্যবাহিনী জনতার ভিড় সামলাতে গলদঘর্ম হয়ে উঠছে।

এতো যে বাঁধভাঙা আনন্দ, এতো যে উচ্ছ্বাস; অথচ এসবের কিছুই যেন স্পর্শ করছে না শবরীকে। জনতা তাদের নামে, বিশেষত তার নামে জয়ধ্বনি করছে, সে-সবও তার কানে পৌঁছচ্ছে না। তরণীর ওপর স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে, কিন্তু মানুষের ভিড়ের মাঝে সে এখন কেবল ঋষ্যশৃঙ্গ’র সুবর্ণমুকুটটি দেখতে পাচ্ছে।

বরণ করে ঋষ্যশৃঙ্গকে কয়েক পা হাঁটিয়ে রথে তোলার ক্ষণকাল পরেই রাজবাড়ীর উদ্দেশ্যে ছুটতে শুরু করেছে রথ। রথের পিছু পিছু ছুটছে উৎসাহী জনতা, আকাশে মেঘ নেই তবু অলৌকিক মেঘ আর বৃষ্টির আশায় কেউ কেউ তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে; আর লৌকিক মেঘ জমেছে শবরীর হৃদয়াকাশে, অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে তার নয়নাকাশ থেকে!


(চলবে.....)

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩১

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:



অলৌকিক মেঘ আর বৃষ্টির আশায় কেও কেও তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে ;
আর লৌকিক মেঘ জমেছে শবরীর হৃদয়াকাশে , অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে তার
নয়নাকাশ থেকে
এক অসাধারন বিবরণ শবরীকে ঘিরে ।

শবরীর মর্মব্যাথা দারুনভাবে ফুটে উঠেছে এপর্বের পুরাটা জোরে।

পরের পর্ব দেখার অপেক্ষায় রইলাম ।

শুভেচ্ছা রইল

২২ শে অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩২

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ।

২| ২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৪০

শুভ_ঢাকা বলেছেন: আখ্যানের অন্তিম পর্ব পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।

২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৫২

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

৩| ২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:০০

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর। পড়ে আনন্দ পাচ্ছি।

২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:১৯

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৪| ২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:১০

আনমোনা বলেছেন: শবরীর জন্য কষ্ট লাগছে।
ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীকে ছেড়ে রাজকুমারী শান্তাকে কিভাবে নেয় দেখার প্রতীক্ষা করছি। রাজকুমারী কি পারবে মুনিপুত্রকে নগর উপযোগী করে গড়ে তুলতে?

২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:২২

মিশু মিলন বলেছেন: এখন কিছুই বলবো না, বললে পাঠের আনন্দ কমে যাবে। ধন্যবাদ।

৫| ২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:২১

রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ।

ভালো থাকুন। করোনা ভাইরাস থেকে সাবধান থাকুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.