নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- সতের )

২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:০৮

সতের

চম্পানগরী এখন উৎসবমুখর, নিভু নিভু হয়ে জ্বলতে থাকা মানুষের আশার প্রদীপটি হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠে ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে শুরু করেছে গণিকারা মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করে নিয়ে আসায়; একে তো মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে মহারাজ লোমপাদের একমাত্র কন্যার বিবাহ হবে, তার ওপর বহুদিন বাদে অঙ্গরাজ্যে বৃষ্টিপাত হতে চলেছে, বহু অপেক্ষার পর পূরণ হতে চলেছে অঙ্গরাজ্যের মানুষের প্রত্যাশা; মিটতে চলেছে অঙ্গরাজ্যের তৃষিত ভূমি, বৃক্ষ, লতা-পাতার তৃষ্ণা! যদিও জনরব শোনা গিয়েছিল যে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ’র পবিত্র চরণ চম্পানগরীর ভূমি স্পর্শ করামাত্র বৃষ্টি হবে, তা অবশ্য হয় নি। এখন নগরীর রন্ধনশালা থেকে হাট-ঘাট সর্বত্র এই আলোচনা হচ্ছে যে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে রাজকন্যা শান্তার বিবাহের পর বৃষ্টি নামবে। নগরীর কোনো কোনো জ্যোতিষী জনরব ছড়িয়েছে যে বিবাহের রাত্রে বৃষ্টি হবে; আবার কোনো কোনো জ্যোতিষী জানিয়েছে যে বিবাহের রাত্রে নয়, মুনিকুমার আর রাজকুমারীর পুষ্পশয্যার রাত্রে বৃষ্টি হবে। এই নিয়ে হাটে-ঘাটে সর্বত্র চলছে তর্ক-বিতর্ক। তর্ক-বিতর্ক যাই-ই হোক একটি ব্যাপারে প্রায় সকলেই নিশ্চিত যে অঙ্গরাজ্যে বৃষ্টি হবেই, সবাই এখন সেই অপেক্ষাতেই আছে।

সঙ্গত কারণেই রাজা লোমপাদও কন্যার বিবাহের ব্যাপারে কালক্ষেপণ করতে চাইলেন না, যতো তাড়াতাড়ি রাজ্যে বৃষ্টি নামে ততোই মঙ্গল। তাছাড়া মহর্ষি বিভাণ্ডক যদি কোনোক্রমে লোকমুখে সংবাদ শুনে রাজবাড়ীতে উপস্থিত হন এবং বিবাহ পণ্ড করে তার পুত্রকে নিয়ে যান তখন তো আর রাজ্যে বৃষ্টিই নামবে না। তাই রাজপুরোহিত আর রাজজ্যোতিষীর বিধান অনুযায়ী দু-দিন পরই তিনি ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে কন্যার বিবাহের দিন ধার্য করলেন। তড়িঘড়ি বিবাহের আয়োজন করায় দূরবর্তী অনেক বন্ধু-রাজ্যের রাজা এবং সুহৃদবর্গকে নিমন্ত্রণ করারও সময় পেলেন না। ঠিক করলেন আগে মুনিকুমারের সঙ্গে কন্যার বিবাহ সম্পন্ন হোক, ইন্দ্রদেবের আশির্বাদে রাজ্যে বৃষ্টি হোক, তারপর সুবিধা মতো সময়ে এক মহাভোজের আয়োজন করে বন্ধু-রাজ্যের রাজা এবং সুহৃদবর্গকে নিমন্ত্রণ করবেন। আপাতত রাজ্যের মানুষকে নিয়েই তিনি বিবাহ উৎসব পালন করতে চাইলেন।

ঘোষকেরা ঢেঁড়া পিটিয়ে রাজকন্যা শান্তা আর মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ’র বিবাহের সংবাদ চম্পানগরীতে ঘোষণা করলো; রাজ্যের চৌদিকে দূত গিয়ে জনপতি, বিশপতি এবং জন্মনপতিদের নিমন্ত্রণ করে এলো; নিমন্ত্রণ করা হলো ব্রা‏‏হ্মণদেরকে। বিবাহ উৎসবের ঢেঁড়ার সঙ্গে সমগ্র নগরীর মানুষের হৃদয়ের ঢেঁড়াও এখন বাজছে। কিন্তু যার বিবাহ, তার মনে সুখ নেই! গণিকাদের চম্পানগরীতে ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় অন্য অনেকের মতো রাজকুমারী শান্তার মনেও এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল যে মহর্ষি বিভাণ্ডকের রোষে গণিকারা নিহত হয়েছে, নয়তো প্রস্তরখণ্ড কিংবা বৃক্ষ হয়ে অরণ্যে পড়ে আছে। তাই বিষাদ কাটিয়ে একটু একটু করে পূর্বের ন্যায় আনন্দমুখর হয়ে উঠছিল সে। কিন্তু গণিকারা ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করে ফিরে আসায় হঠাৎ-ই তার হৃদয়ের আনন্দকুঞ্জে বজ্রাঘাত হয়েছে! অভিমানে, রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, ঘৃণায়, বিষাদে যেন ঝলসে গেছে তার হৃদকুঞ্জ! সে কেবলই শয্যাশায়ী হয়ে কাঁদে। সখিরা তাকে অনেক বোঝায়, ঋষ্যশৃঙ্গ সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলে, তবু তার মন বুঝতে চায় না। সে ব্যতিত রাজবাড়ীর সকলেই ঋষ্যশৃঙ্গ’র মুখদর্শন করেছে, এমনকি রাজবাড়ীর যে অন্ধ ভৃত্য গো-দুগ্ধ দোহন করে সেও তার অন্তর চক্ষু দিয়ে দর্শন করেছে অন্যের মুখে ঋষ্যশৃঙ্গ’র শারীরিক বিবরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনে!

বিবাহের ক্ষণ যতোই ঘনিয়ে আসছে, ততোই শান্তার মনে হচ্ছে সে যদি এক দৌড়ে এই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে অন্য কোথাও হারিয়ে যেতে পারতো; কিংবা পারতো অদৃশ্য হয়ে যেতে! আবার কখনো তার মনে হচ্ছে, না এ হতে পারে না। সে রাজকুমারী, রাজকুমারীর সঙ্গে মুনিকুমারের বিয়ে হয় নাকি? এ তার দুঃস্বপ্ন, দীর্ঘমেয়াদী এক দুঃস্বপ্নের ভেতরে অবস্থান করছে সে! কিন্তু যখনই সে বাতায়নের বাইরে তাকিয়ে লক্ষ্য করছে ভৃত্যদের ব্যস্ত পদচারণা, বিবাহের আয়োজন; তখনই নিষ্ঠুর বাস্তবতা তাকে তীক্ষ্ণ প্রস্তরখণ্ডের ন্যায় আঘাত করছে।

অন্যদিকে সমগ্র চম্পানগরীতে শবরীর নামে হই-চই পড়ে গেছে, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের মুখে মুখে এখন শবরীর নাম। কপর্দকহীন ভবঘুরের দল গণিকালয়ের সদরদ্বারের সামনে ভিড় করে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করে, তাদের ঠ্যাঙাতে দ্বাররক্ষীর আর বিরাম নেই! এই আকালের দিনেও গুড়ের মাছির মতো নগরীর বিলাসী পুরুষেরা টেঁক ভর্তি কড়ি নিয়ে ভিড় জমাচ্ছে গিরিকার গণিকালয়ে, সকলেই শবরীর সান্নিধ্য চায়। মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করার মতো এমন অসাধ্য সাধন যে করেছে তাকে একবার চোখে দেখতে চায়, তার গন্ধ-স্পর্শ পেতে চায়, তার দেহঝর্ণায় সুখময় অবগাহন করতে চায়। ক’দিন ধরেই দিন-রাতের যেন কোনো ভেদ নেই, নাগর আসতেই থাকে। শুধু কি চম্পানগরীর মানুষ? ভিন রাজ্যের যে-সব বণিকেরা চম্পানগরীতে বাণিজ্য করতে আসে, লোকমুখে শবরীর কথা শুনে তারাও ছুটে আসে টেঁক ভারী করে। কিন্তু যার জন্য এতো কিছু সেই শবরী এখন জগত সংসার সম্পর্কে নির্লিপ্ত, ক্ষুধা-তৃষ্ণার প্রতি উদাসীন, কামনা-বাসনার প্রতি বীতশ্রদ্ধ! গণিকালয়ে পা দেবার পর থেকে একজন নাগরকেও সে তার শয্যায় গ্রহণ করে নি। শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে গৃহের কপাট বন্ধ করে সে শুয়ে থাকে। কন্যাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন গিরিকা, কিন্তু মাতার কোনো কথাই এখন আর তোয়াক্কা করছে না সে। ফলে গিরিকাকে প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে, এতো এতো ধনী নাগর তো আর হাতছাড়া করা যায় না। নগরীর মানুষের মনে শবরীকে নিয়ে আবেগ-উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। দ্বাররক্ষী আর ভৃত্যদের মুখে তিনি শুনেছেন, নগরীর কবিগণ শবরীকে নিয়ে গীত লিখেছেন আর বাউণ্ডলে গায়কেরা শৌণ্ডিকালয়ে কিংবা মানুষের জটলায় গাইছে সেই গীত। গায়কবৃন্দের মাধ্যমে সেই গীত এখন পানশৌণ্ড আর নগরীর মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। আর সেই গীত শুনেই নাকি শবরীর প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে উল্লোলিত কল্লোলের মতো! এই আকালের দিনেও সৌখিন পুরুষদের টেঁকের কড়ি বাইরে আসার জন্য খয়রা মাছের মতো খলবল করছে, এইতো সময় মানুষের আবেগ-উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে ধনভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার! এহেন আবেগ-উত্তেজনা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না; তাই যতোক্ষণ আবেগ-উত্তেজনা, ততোক্ষণই সুযোগ! অথচ কন্যা তার বিষয়-বুদ্ধিহীন, আবেগী আর যোগিনী ধাঁচের। তাই বলে তাকেও তো কন্যার মতো নির্বোধ হলে চলবে না। তিনি ওই খয়রা মাছের মতো খলবল করতে থাকা কড়িগুলো তার ধনভাণ্ডারে ভরতে চান, সে কারণেই ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন। এক শবরী বেঁকে বসেছে তো কী হয়েছে, তার তো আরো শবরী আছে! তিনি অচেনা-অজানা নাগরদের উমা-সুলোচনা-বিশাখাদের শয্যায় পাঠাচ্ছেন ওদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করে, ওরা প্রত্যেকেই এখন শবরী। অতি উৎসাহী কোনো নাগর ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করার গল্প শুনতে চাইলে ওরা শবরীর মুখে শোনা গল্প নিপুণভাবে উপস্থাপন করছে; নাগরেরা বিপুল উৎসাহে গল্পে, নখক্ষতে, দন্তদংশনে, চুম্বনে, আলিঙ্গনে, মুখমেহনে, লেহনে, মর্দনে, সঙ্গমে অথৈ দেহসুখ আহরণ করছে; আর গিরিকা অতল আনন্দে নিজের কক্ষে বসে কড়ি গুনছেন তাম্বূল চিবোতে চিবোতে!

ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে অতিবাহিত করা সময়ের সুখস্মৃতিগুলো শবরীকে তাড়িত করছে প্রবলভাবে। পুনরায় ঋষ্যশৃঙ্গ’র ওই কিশোরসুলভ নিষ্পাপ রূপ দর্শনের জন্য তার চিত্ত ছটফট করছে, একটি বার আলিঙ্গনের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে তার শরীর, একটি বার চুম্বনের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে তার ওষ্ঠ! রাজপুত্রের সঙ্গে না হয়ে মুনিকুমারের সঙ্গে রাজকুমারীর বিবাহ হবে বলে আশ্রমে যাবার পথে উমা তাকে বলেছিল যে এতোদিন রাজকুমারীর সৌভাগ্যকে সে ঈর্ষা করতো, কিন্তু এখন আর করে না, বরং রাজকুমারীর জন্য ওর করুণা হচ্ছে; আর এখন শবরীর হচ্ছে ঠিক উল্টো অনুভূতি, রাজকুমারীর সৌভাগ্যকে সে ভীষণ ঈর্ষা করছে! তার হৃদয় জ্বলে যাচ্ছে!

মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ আর রাজকুমারী শান্তার বিবাহ উৎসবের নিমন্ত্রণ রক্ষা এবং শোভাবর্ধন করতে গণিকালয়ের সকলেই আজ রাজবাড়ী গেছে, যায় নি কেবল শবরী। রাজবাড়ীর রথ এসে নিয়ে গেছে সকলকে, দ্বাররক্ষী এবং ভৃত্যরাও গেছে রথের পিছু পিছু হেঁটে। সবাই মিলে জোরাজুরি করেও নিতে পারে নি শবরীকে। বাড়িতে এখন সে একা, বুক ভরা ব্যথা নিয়ে হাঁটছে গৃহের ছাদে, মরে আসা অপরাহ্ণের সূর্যের লালচে আভা একবার তার ডান গালে হাসছে তো আরেকবার বাম গালে।

ছাদ থেকে গণিকালয়ের সামনের রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়। নগরীতে যে বহুদিন বাদে উৎসবের ধুম লেগেছে শবরী তা বেশ বুঝতে পারছে পথচারীদের আসা-যাওয়া, তাদের হাস্যজ্জ্বল মুখ আর পরিপাটী বেশভূষা দেখে। মানুষেরা পায়ে হেঁটে, ডুলি-শিবিকারোহণে, রথারোহণে রাজবাড়ীর দিকে যাচ্ছে। তাদের সদরদ্বারের সম্মুখে কোনো কোনো পথচারী থমকে দাঁড়াচ্ছে, শিবিকা এসে থামছে; কিন্তু সদরদ্বার বন্ধ দেখে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মুখে একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে।

রাস্তা থেকে দৃষ্টি গুছিয়ে এনে শবরী কয়েক মুহূর্ত রাখলো ছাদের কোনে, তারপর পুনরায় দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলো আকাশের দিকে। কোথায় মেঘ! শিমুল তুলোর মতো ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ বহু ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে। এই মেঘে কি বৃষ্টি হবে? যে বৃষ্টির জন্য এতো কৌশল খাটিয়ে মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে নিয়ে এলো সে, রাজকুমারীর সাথে মুনিকুমারের বিবাহের আয়োজন হলো, কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি সত্যিই হবে তো! সারা রাজ্যের মানুষ বৃষ্টির প্রত্যাশা করে আছে, অথচ মেঘের রূপ মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। নাকি আজ বিবাহের রাত্রে নয়, পুষ্পশয্যার রাত্রে রাজকুমারী শান্তার সঙ্গে ঋষ্যশৃঙ্গ মিলিত হলেই দক্ষিণের সমুদ্র থেকে রাশি রাশি মেঘ দক্ষিণের রাজ্যগুলোর ওপর দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ভেসে এসে প্রবেশ করবে অঙ্গরাজ্যে? অদেখা রাজকুমারীর সঙ্গে ঋষ্যশৃঙ্গ’র মিলনের কথা ভাবতেই শবরীর চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো, দূর আকাশের মেঘ যেন আরো দূরে সরে গেল আর তার চিত্তের মেঘ নয়নাকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লো তার অধরে।

মেধা এবং অন্যান্য সখিরা শান্তাকে স্নানাগারে নিয়ে গিয়ে তার সর্বাঙ্গে হলুদ মাখলো। কাঁচা হলুদের গন্ধ শান্তার বরাবরই ভাল লাগে, কিন্তু আজ যেন হলুদে ইঁদুরপচা গন্ধ! হলুদে আগুনের আঁচ, যা তার সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরাচ্ছে! তার অন্তর দগ্ধ হচ্ছে, আর সেই দগ্ধ আগুনে পুড়িয়ে মারতে ইচ্ছে করছে শবরী নামের সেই গণিকাকে, যাকে কখনো দেখে নি সে, কিন্তু তার মনে হচ্ছে পাতকিনী শবরী এক মায়াবী ডাইনী! সেই লোভী ডাইনীটাই প্রাসাদ, সুবর্ণ অলংকার, কড়ি প্রভৃতির লোভে তার জীবনে অন্ধকার টেনে এনেছে! ডাইনীটা যদি ঋষ্যশৃঙ্গকে আনতে না যেতো তাহলে আজ তার জীবন এমন অন্ধকারময় হতো না। তার জীবনের সমস্ত আনন্দ-আহ্লাদ বাতাসে সুগন্ধীর ন্যায় মিলিয়ে যেতো না।
সখিদের ঢেলে দেওয়া জলে তার শরীর শীতল হলেও অন্তর শীতল হলো না। সখিরা তার গাত্র মার্জন করলো, রিঠাফল ভেজানো জল দিয়ে তার কেশ ধুয়ে স্নান করিয়ে দিলো। কৌতুকমঙ্গল শেষ হলে সখিরা অনেক যত্নে বিবাহের সাজে সাজাতে শুরু করলো শান্তাকে, মুখে চন্দন-কুঙ্কুমের প্রলেপ দিলো; মূল্যবান পরিচ্ছদ পরানোর পর সুবর্ণ হার, কানের দুল, নাকফুল, মেখলা, চুড়ি, অঙ্গুরীয় প্রভৃতি বহুবিধ অলংকারে শোভিত করলো। রাধা চন্দনের আলপনা দিয়ে সাজালো তার প্রিয় সখিকে। তারপর সকল সখি মিলে শান্তাকে নিয়ে যাত্রা করলো বিবাহের যজ্ঞস্থলের উদ্দেশ্যে।

রাজপুরোহিত বিবাহের পৌরহিত্য করবেন। তিনি বেদী রচনা করে গন্ধপুষ্প, যবাঙ্কুরযুক্ত চিত্রকুম্ভ, ধূপাধার, শঙ্খাধার, লাজপাত্র প্রভৃতি দ্বারা অলংকৃত করেছেন। বেদীর ওপর দর্ভ অর্থাৎ দূর্বা, কুশ প্রভৃতি ছয় রকম তৃণ বিছিয়ে অগ্নিস্থাপন করে হোম আরম্ভ করলেন। সুসজ্জিত ঋষ্যশৃঙ্গকে যজ্ঞস্থলে নিয়ে আসা হয়েছে, সে আসনে উপবেশন করে চুপচাপ রাজপুরোহিতের কর্মকাণ্ড দেখছে। চম্পনগরীতে পা রাখার পর থেকেই তাকে নিয়ে একের পর এক যে আচার-অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে এবং তাকে যে ভাবে আদর-আপ্যায়ন করা হচ্ছে তাতে সে রীতিমতো বিস্ময়োৎফুল্ল হয়ে পড়েছে! তার বিস্ময়ের ঘোর কিছুতেই কাটছে না!

যজ্ঞস্থলের অদূরেই যন্ত্রশিল্পীরা নানা প্রকার বাদ্য বাজাচ্ছেন, শিল্পীরা নৃত্যগীত করছেন, কিছুক্ষণ পর সর্বাভরণভূষিতা রাজকুমারী শান্তাকে পুষ্পবর্ষণ করতে করতে যজ্ঞস্থলে এনে অগ্নির সমক্ষে ঋষ্যশৃঙ্গ’র অভিমুখে উপবেশন করানো হলো। রাজা লোমপাদ রাজপুরোহিতকে অনুসরণ করে ঋষ্যশৃঙ্গ’র উদ্দেশে মন্ত্রপাঠ করলেন, ‘এই আমার কন্যা শান্তা, তোমার সহধর্মচারিণী, একে তুমি নাও, তোমার পাণির দ্বারা এর পাণি গ্রহণ করো, তোমার মঙ্গল হোক। এই মহাভাগা প্রতিব্রতা সর্বদা ছায়ার ন্যায় তোমার অনুগামিনী হবে।’
লোমপাদ মন্ত্রপূত জল নিক্ষেপ করলেন।

ঋষ্যশৃঙ্গ এবং শান্তা উঠে দাঁড়িয়ে তিনবার যজ্ঞাগ্নি প্রদক্ষিণ করতে করতে মন্ত্রপাঠ করলো-তুমি আমি, আমি তুমি, তুমি স্বর্গ, আমি পৃথিবী, তুমি সাম, আমি ঋক্, এসো আমরা বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন করি।’

প্রতিবার প্রদক্ষিণের পর শান্তা জাঁতার উপর দাঁড়ালো আর ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘এই জাঁতার উপর পদক্ষেপ করো, পাথরের মতো দৃঢ় হও।’
এরপর লাজহোম, সপ্তপদীগমন, মধুপর্ক এবং পাণিগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।


(চলবে....)

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:১৩

নেওয়াজ আলি বলেছেন: সুন্দর উপস্থাপন I মুগ্ধ

২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:১৭

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৫

রাজীব নুর বলেছেন: গায়ে হলুদ মাখা বহু পুরোনো সংস্কৃতি।
সুন্দর লেখা।

২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:২০

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

৩| ২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:১০

আনমোনা বলেছেন: শবরীকে ছেড়ে মুনি এত শহজেই মানিয়ে নিল!
পরের পর্বের অপেক্ষায়।

২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:২৯

মিশু মিলন বলেছেন: ঋষ্যশৃঙ্গ জীবন-সমাজ-প্রেম-কাম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, তার মন বালকসুলভ। তাকে যা বলা হয়েছে সে সেটাই করেছে। সে ভেবেছে এটাই ব্রত'র নিয়ম। ধন্যবাদ।

৪| ২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৪৯

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:




যাহোক নির্বিঘ্নে বিবাহ অনুষ্টান সম্পন্ন হয়েছে।
শবরী নিজকে বিসর্জন দিয়ে স্বদেশ প্রেমের পরাকাষ্টা দিয়েছে ।
গনিকার হয়েও স্বদেশ প্রেমের যে স্বাক্ষর সে রেখেছে তা
তথাকথিত অনেক পুণ্যবান মনি ঋষির মাঝেও দেখা
যায়না , বরং প্রয়োজনে তারাও প্রবঞ্চনার আশ্রয়
নেয়।

গীরিকার কুটিল চরিত্র আরো বিষদভাবে এ
এপর্বে ফুটে উঠেছে ।

পরের পর্বে মনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ ও রাজকুমারী শান্তার
ক্রিয়া /প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় রইলাম ।

শুভেচ্ছা রইল

২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৫৯

মিশু মিলন বলেছেন: যাহোক নির্বিঘ্নে বিবাহ অনুষ্টান সম্পন্ন হয়েছে
শবরী নিজকে বিসর্জন দিয়ে স্বদেশ প্রেমের পরাকাষ্টা দেখিয়েছে।
গনিকার হয়েও স্বদেশ প্রেমের যে স্বাক্ষর সে রেখেছে তা
তথাকথিত অনেক পুণ্যবান মনি ঋষির মাঝেও দেখা
যায়না , বরং প্রয়োজনে তারাও প্রবঞ্চনার আশ্রয়
নেয়

দারুণ বলেছেন! ধন্যবাদ।

৫| ২৩ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৫৩

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:

< শবরী নিজকে বিসর্জন দিয়ে স্বদেশ প্রেমের পরাকাষ্টা দেখিয়েছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.