নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- তেত্রিশ)

২০ শে নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:৫৮

ছাব্বিশ

অপরাহ্ণে ঝরনার কাছে পাথরের ওপর উপবেশন করে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঋষি দেবায়ণীর হৃদ চরাচরে হাহাকার জাগানিয়া বাতাস বয়ে যায় আর সে-চরাচরের কোথাও এতটুকু রঙের ছিটেফোঁটাও যেন অবশিষ্ট নেই; নদী শুভ্র, আকাশ-মেঘ শুভ্র, বৃক্ষরাজি শুভ্র, তৃণভূমি শুভ্র, শুভ্র পুষ্পদামে অসংখ্য শুভ্র প্রজাপতির মেলা আর এমনও শুভ্রতার মাঝে অধিক শুভ্র তার মনপাখিটা বিরহী সুরে ডেকে উঠে শুভ্রতাময় চরাচর বিদীর্ণ করে দেয় যেন! ঝরনার জলকণা বাতাসে ভেসে এসে স্থিত হয় তার অঙ্গে; কেশে ও চোখের পাপড়িতে লেগে থাকে প্রভাতকালের দূর্বাঘাসের ডগার শিশিরের মতো। তারই মাঝে তার দু-চোখ বাষ্পাকুল হয়ে ওঠে, যে পথ নেমে গেছে নিচের দিকে, সে-পথের দিকে তাকিয়ে ঝাপসা হয়ে যায়; আর মন বলে ওই ঝাপসা পথেই হঠাৎ যদি একটা শরীর দৃশ্যমান হয়ে উঠত, একজন মানুষ, একজন বেভুলো মানুষ যদি পথ ভুলেও একটি বার ওই পথ ধরে হেঁটে আসত, আহা, নয়ন জুড়োত, শান্ত হত এ চঞ্চল অন্তর! মানুষটা গত বসন্তের পূর্বের বসন্তে এসেছিলেন অনেকগুলো পলাশপুষ্প হাতে নিয়ে, প্রায় দেড় বৎসর হতে চলল তার কোনো দেখা নেই! সে-বার আশ্রমে ছিলেন বেশ কয়েকদিন, অন্যসব বারের মতই তাকে আশাহত করেন দেবায়ণী, কিন্তু তার আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেননি। তারপর অন্যসব বারের মতোই একদিন প্রভাতে মানুষটি বিদায় নেন অন্তরের ব্যথা সঙ্গী করে। মানুষটিকে আশাহত করলেও তাকে প্রাণের সখা মনে করেন দেবায়ণী, এমন সখা জীবনে আর পাননি তিনি, এমনকি তার স্বামীও প্রাণসখা ছিলেন না। চক্ষু মুদে অন্ধের মতো মানুষটাকে বিশ্বাস করা যায়, যে-কোনো ব্যাপারে তার ওপর নির্ভর করা যায়, বিরক্ত করলেও যিনি রেগে যাবার পরিবর্তে হাসি উপহার দেন। জগতে এমন প্রাণসখা সহজে মেলে না। বারবার দেবায়ণী মানুষটিকে শূন্য হাতে ফিরিয়েছেন, তবু মানুষটি তার কাছে আসতেন অন্তরের ব্যথা লুকিয়ে হাস্যমুখে পুষ্পহাতে, কিন্তু কী হলো মানুষটির, কোথায় নিরুদ্দেশ হলেন তিনি!

দেবায়ণীর সেই পরম প্রাণসখা গল্প কথক কুথান, কুথানের সঙ্গে দেবায়ণীর সখ্যতা অনেক দিনের। আগে ঘন ঘন আশ্রমে আসতেন কুথান, সুন্দর সুন্দর গল্প বলতেন, নানা স্থানের সৌন্ধর্যের বর্ণনা দিতেন, শাস্ত্রীয় আলোচনা হত, তর্ক-বিতর্ক চলতে চলতে রাত্রি গভীর হত। কুথান নাস্তিক আর দেবায়ণী প্রচলিত অনেক রীতির প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাবাপন্ন হলেও ঈশ্বরে বিশ্বাসী, এই নাস্তিকতা এবং ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে দুজনের অনেক মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হত, কিন্তু তা কখনোই ঝগড়ায় রূপ নেয়নি বা দুজনের বন্ধুত্বে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। দুজন দুজনের বিশ্বাসে অটুট থেকে কেবল একে অন্যকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। আশ্রমের অন্য কন্যারাও দুজনের তর্ক শুনত, মাঝে মাঝে নিজেরাও তর্কে যোগ দিত, নানা প্রশ্ন করত কুথানকে, সকলের প্রশ্নবাণ একের পর এক ধাবিত হতো কুথানের দিকে, কুথান ঠান্ডা মাথায় তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। আশ্রমের অন্য কন্যারা কুথানকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতো সম্মান করত, সেবাযত্ন করত। কন্যারা প্রায়ই দেবায়ণীর কাছে কুথানের প্রসঙ্গ তোলে, এই সেদিন যেমন বৃন্দা বলছিল ‘দিদি, ভ্রাতাশ্রী আসেন না কেন? ভ্রাতাশ্রী এলে বাইরের জগত সম্পর্কে কত কিছু জানা যায়, ভ্রাতাশ্রীর জন্য মন কেমন করে। কী যে হলো ভ্রাতাশ্রীর!’

শেষবার যখন কুথান আশ্রমে আসেন, তার আগে ছয় মাস এদিকে পা বাড়াননি। দেবায়ণী ছয় মাস না আসার কারণ জানতে চাইলে কুথান হেসে বলেন, ‘এলে যে হৃদয়ের ব্যথা বেড়ে যায়!’
দেবায়ণী বলেন, ‘আর না এলে ব্যথা বাড়ে না বুঝি!’
‘বাড়ে বৈকি; এ এমন এক ব্যথা, এলেও বাড়ে, না এলেও বাড়ে!’
‘তবে তো আসাই ভালো।’ দেবায়ণী মুখ টিপে মৃদু হাসেন।
‘এলে ভালো লাগে বটে, কিন্তু বিদায়বেলায় ভারী কষ্ট হয়।’

‘বিদায় নিতে কেউ তো বাধ্য করে না, আশ্রমে থেকে গেলেই কষ্ট হয় না আর। আসল কথা বলো যে, তোমার কেবল পাখির মতো উড়ে বেড়াবার নেশা!’
‘স্বীকার করছি উড়ে বেড়াবার নেশা আমার জন্মগত, তবে একথাও তো সত্য যে আমার মন পাখিটাকে কেউ ভালোবাসার খাঁচায় বন্দী করেনি বলেই আরো বেশি উড়ে বেড়াই, ভ্রমণে ব্যথা ভুলে থাকার চেষ্টা করি।’

আর কিছু বলেননি দেবায়ণী, কেবল মুচকি হেসেছেন, এরপর কিছু বলতে গেলে যে দায়টা নিজের ওপরেই বর্তায়।

দেবায়ণীকে ভালোবাসেন কুথান, বিবাহ করে সংসার করতে চান, অনেক ভ্রমণ করে কুথান বুঝেছেন যে তার জীবনে দেবায়ণীর মতো এমন প্রজ্ঞাবান নারী-ই প্রয়োজন, যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যাবে, তর্ক-বিতর্ক হবে, কিন্তু পুনর্বার তার সঙ্গেই কথা বলবার জন্য মন আকুলি-বিকুলি করবে, তার কথা শোনার জন্য কর্ণ উদগ্রীব হবে। অনেকবার আকারে-ইঙ্গিতে দেবায়ণীকে সে-কথা বুঝিয়েছেন কুথান, কিন্তু দেবায়ণী সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থেকেছেন। আকারে ইঙ্গিতে যখন কাজ হয়নি, তখন একদিন অপরাহ্ণে হাঁটতে হাঁটতে ঝরনার পাশে দাঁড়িয়ে কুথান দেবায়ণীকে বলেছিলেন, ‘সবই তো বোঝ, তবু না বোঝার ভান করে থেকে কেন আমাকে কষ্ট দাও, কী সুখ পাও আমাকে কষ্ট দিয়ে?’

দেবায়ণী বুঝতে পেরেছিলেন যে কুথান কী বলতে চান, তিনি হেসে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন কুথানের কথা, ‘কষ্ট দেবার অধিকার কি কেবল পুরুষেরই আছে, নারীর নেই?’
‘তা থাকবে না কেন?’
‘তাহলে আর দোষ কী করেছি!’
‘দোষ তো তোমায় দিচ্ছি না। কেবল আমার হৃদয়টা উপলব্ধি করতে বলছি।’

দেবায়ণী হেসেছিলেন, ‘আমি মূর্খ, হৃদয় উপলব্ধি করবার মতো অতল জ্ঞান হয়ত আমার নেই!’
‘আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিও না দেবায়ণী, আমি ঐকান্তিকভাবে তোমার ভালোবাসা পেতে চাই। বিবাহ করতে চাই তোমাকে।’
‘সে-পথ বড় রুক্ষ-কঠিন আর প্রস্তরখণ্ডে ভরা। বন্ধুত্বের পথই অধিক মসৃণ এবং মধুর। তাছাড়া আমি সংসারে জড়ালে আমার তপশ্চর্যায় বিঘ্ন ঘটবে। আমি নিজের হৃদয়ে কান পেতে শুনেছি- আমার ঈশ্বর চান না আমি পুনরায় বিবাহ করে সংসারে আবদ্ধ হই, তিনি চান আমি যেন তারই আরাধনা করি!’
‘অস্তিত্বহীনের আরাধনা!’
‘এখন এই তর্ক করতে চাই না।’
‘আমি চাই তর্ক করতে, তোমার ঈশ্বরকে তর্কবাণে জর্জরিত করতে চাই; কারণ তোমার আর আমার মিলনে বাধা এই অস্তিত্বহীন ঈশ্বর। আচ্ছা, তোমার ঈশ্বর নারী না পুরুষ? তার হৃদয়ে বুঝি প্রেম নেই, তিনি বুঝি কাউকে ভালোবাসেন না! নাকি তিনিও তোমার মতোই………।’
‘আমার মতোই কী?’
‘হৃদয়টাকে পাথরচাপা দিয়ে রেখেছেন কি না!’

নৈঃশব্দ বিদীর্ণ করে শব্দ করে হেসে উঠেছিলেন দেবায়ণী, হাসি সহজে থামতেই চাইছিল না, হাসতে হাসতে তার চোখ বাষ্পাকুল হয়ে উঠেছিল।

সে-চোখের দিকে তাকিয়ে কুথান বলেছিলেন, ‘আমি জানি, তুমিও আমাকে ভালোবাসো। তোমার চোখ দেখেই আমি তা বুঝতে পারি। তুমি মুখে যতই আমায় দূরে ঠেলে দাও, তোমার হৃদয় আমায় ঠিকই ডাকে। সেই ডাক শুনেই আমি ছুটে আসি। কিন্তু তুমি…..।’

‘বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে, আকাশটা হঠাৎ একপাল নীলগাইয়ের মতো কালচে মেঘে ছেয়ে গেছে।’ বলেছিলেন দেবায়ণী।
‘তুমি নিজেকেও কষ্ট দিচ্ছ।’ দেবায়ণীর চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন কুথান।
‘এই অবেলায় ভিজতে চাইনে।’
‘তুমি কিছু বলো?’
‘চলো চলো, আশ্রমে চলো, বৃষ্টি এলো।’

অনেক আগেই সংসারে জড়াবার ইচ্ছে মরে গেছে দেবায়ণীর। যে পুরুষজাতি তাকে নির্দয়ভাবে ধর্ষণ করেছে, সেই পুরুষজাতির বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বুকে মুখ গোঁজার রুচি তার আর নেই। কুথানকে বিবাহ করার ব্যাপারে নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছেন তিনি, তার কেবলই মনে হয়েছে বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সঙ্গমের কালে কুথানকেও যদি তার ধর্ষক মনে হয়! কুথানের স্বাভাবিক আচরণেও যদি তার মনে হয় যে কুথান তাকে নির্যাতন করছে! তাহলে তার কাছে কুথান ছোট হয়ে যাবেন, কিন্তু কুথান তার কাছে ছোট হোক তা তিনি কখনোই চান না। কুথান তার প্রাণসখা, প্রাণসখা হয়েই থাকুক। এ কথা সত্য যে তিনি কুথানকে ভালোবাসেন, কুথানের সঙ্গ উপভোগ করেন, কুথানের সঙ্গে কথা শুরু করলে সময়জ্ঞান লোপ পায়, কুথান দীর্ঘদিন আশ্রমে না এলে বিরহে কাতর হন।
এখন যেমন ঝরনার কাছে উপবেশন করে তার অন্তর কুথানময় হয়ে আছে, বারবার তার দৃষ্টি পথের দিকে খুঁজছে কুথানকে!


(চলবে......)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:০৮

রাজীব নুর বলেছেন: আজকের পর্বটা দারুন রোমান্টিক হয়েছে।

২০ শে নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৪:১৭

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.