নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- পাঁচ)

০৪ ঠা আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:৫৬

চার

একটা বউ পিটানো সমাজে বেড়ে উঠেছি আমি, যেখানে কারণে-অকারণে বউকে শাসন করা, বকাঝকা করা আর মারধর করাই ছিল পুরুষের সংস্কৃতি! ছেলেবেলায় আমার দাদুকে দেখেছি- তিনি বৃদ্ধ বয়সেও পান থেকে চুন খসলেই আমার বৃদ্ধা ঠাকুমাকে বকাঝকা করতেন, মাঝে মাঝে কিল-চড়ও মারতেন, রাগ হলে হাতের কাছে যা পেতেন ছুড়ে মারতেন ঠাকুমার দিকে! তার মুখের বহু ব্যবহৃত একটা সংলাপ ছিল- ‘ধুর মাগী, তুই কী বুঝিস!’ কোনো বিষয়ে আমার ঠাকুমা নিজের মতামত দিতে গেলেই ঠাকুরদা ধমকের সুরে তার উদ্দেশে এই সংলাপ বলতেন আর ঠাকুমা প্রাণির স্পর্শ পাওয়া লজ্জাবতী লতার মতো নিজেকে গুটিয়ে নিতেন। আমার বাবা প্রায়ই মাকে মারতেন, জ্যাঠা জেঠিমাকে মারতেন, আর কাকা কাকিমাকে মারতেন নৃশংসভাবে। বউ পিটানো কুবিদ্যা আমার কাকার চেয়ে ভালো কেউ জানত না আমাদের গ্রামে, এই বিষয়ে কয়েক গ্রামের মধ্যে তার কুখ্যাতি ছিল ঈর্ষনীয়! আমাদের পাড়া-পড়শিদের মাঝেও বউ পিটানোর প্রচলন ছিল ব্যাপকভাবে, বেশিরভাগ পুরুষই তাদের বউকে পিটাতো। আমাদের পরিবারের মতো স্বচ্ছল পরিবারের পুরুষেরা যেমনি বউ পিটাতেন; তেমনি যেসব পরিবারে দুইবেলা ভাত জুটত না, সেইসব পরিবারের পুরুষেরাও বউ পিটাতেন। শিক্ষিত পুরুষেরা যেমনি বউ পিটাতেন, তেমনি অশিক্ষিত পুরুষেরাও পেটাতেন। আমাদের সমাজে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তীব্র বৈষম্য থাকলেও বউ পিটানোর ক্ষেত্রে একেবারে সাম্যবাদী ব্যবস্থা ছিল! সেই সমাজে বউ পিটানো ছিল খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়, মাঝে মধ্যে বউ পিটানোকে কেউ অপরাধ হিসেবে দেখত না। কারণ, কম-বেশি সব বাড়িতেই এই ঘটনাটি ঘটত। কোনো বাড়ির কোনো পুরুষ যখন বউ পিটাতো, তখন প্রায় সারা পাড়ার মানুষ সেই বাড়িতে জড়ো হতো। সাহসী কেউ এগিয়ে গিয়ে স্বামীর মারের হাত থেকে বউটাকে রক্ষা করত। আমরা ছোটরা দূরে দাঁড়িয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখতাম। ছেলে বউ পিটালে কোনো কোনো মা খুশি হতেন, বীরপুরুষের জন্ম দিয়েছেন ভেবে তৃপ্তিলাভ করতেন! কোনো কোনো মা তুচ্ছ কারণে ছেলেকে উসকেও দিতেন বউ পিটানোর জন্য, আর বলতেন- ‘মাঝে মাঝে ঠ্যাঙানি না দিলি বউ ঠিক থাহে না, যৈবনকালে আমরাও কতো ঠ্যাঙানি খাইছি ভাতারের হাতে!’

এসব আমার নিজের চোখে দেখা। কারো কারো স্ত্রী শারীরিক-মানসিক অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যাও করত। কিন্তু এজন্য কখনো কোনো পুরুষকে জেল খাটতে দেখিনি। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যেত, পোস্টমর্টেমও হতো, কিন্তু নিপীড়ক পুরুষের কিছু হতো না, কী করে যেন থানা-পুলিশ ম্যানেজ হয়ে যেত। পরদিন থেকেই সেই বিপত্নীক পুরুষ বুক ফুলিয়ে চলত, কিছুদিন বাদে আবার বিয়ে করে ঘরে নতুন বউ আনত আর নতুন বউয়ের গা থেকে হলুদের গন্ধ মিলিয়ে যেতে না যেতেই যথারীতি পিটাতে শুরু করত।

কোনো কোনো নারী স্বামীর মুখে মুখে ঝগড়া করত না তা নয়, ঝগড়া করত, মারও খেত। যে নারী স্বামীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করত কিংবা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করত, দজ্জাল বউ হিসেবে তার নামে দূর্নাম রটত। তবে হাজার মার খেলেও স্বামীর বাড়ি ছেড়ে এক পা নড়তে দেখিনি কোনো নারীকে, কারণ তাদের যাবার মতো এমন কোনো জায়গা ছিল না, যেখানে গেলে নিশ্চিন্তে খাওয়া-পরা জুটবে।

আজকাল নারীদের শিক্ষার হার বেড়েছে, অনেক নারী-ই স্বনির্ভর। আত্মনির্ভরশীল একজন নারী চাইলেই নিপীড়ক স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারে। ফলে নারী নির্যাতনের হার আগের চেয়ে কমেছে। তারপরও পত্রিকায় পাতায় প্রায়ই অনেক শিক্ষিত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নারীর বরের হাতে নির্যাতনের খবর ছাপা হয়। আসলে বউ পিটানো আবহমান বাংলার প্রাচীন কু-প্রথা, নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের জরিপ দেখলে বোঝা যায় যে সেই প্রাচীন কু-প্রথা এখনো প্রবল পরাক্রমেই টিকে আছে আমাদের সমাজে!

তবে সকল পুরুষই যে বউ পিটাত এমন নয়, দু-চারজন নিশ্চয় ব্যতিক্রম ছিল। যারা ব্যতিক্রম ছিল, বউয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল, বউয়ের কথা মান্য করত, আড়ালে কেউ কেউ তাদেরকে বলত- ভ্যাদামাছ কিংবা বউয়ের আঁচল ধরা মেনি বিড়াল! আবার সারা গ্রামে এমনও এক কী দুজন পুরুষের দেখা মিলত, যারা বউয়ের অত্যাচারে মরমে মরে থাকত, এমনকি বউয়ের হাতে কিল-চড়ও খেত। আমাদের পাশের গ্রামে মোবাশ্বেরা নামের কলহপ্রিয় এক নারী তার স্বামীর অণ্ডকোষে লাথি দিয়ে মেরে ফেলেছিল। জেল খেটেছিল মোবাশ্বেরা। ওদের ছোট্ট ছেলেটা বড় হয়ে ডাকাত হয়েছিল। বউয়ের মুখ ঝামটা শোনা কিংবা বউয়ের হাতে মার খাওয়া পুরুষের সমাজে কোনো মূল্য ছিল না, সমাজের মানুষ তাকে মানুষ বলেই গণ্য করত না! তবে সংখ্যার বিচারে এগুলো ছিল নগন্য এবং ব্যতিক্রম ঘটনা।

যাইহোক, এহেন বউ পিটানো সমাজে বেড়ে উঠার পরও আমি কখনো তপতীর গায়ে হাত তুলিনি। আমার রুচি হয়নি মারধর করার। ছেলেবেলায় আমি আমার বাবার হাতে মাকে মার থেকে দেখেছি, মা ঘরে শুয়ে শুয়ে কাঁদতেন, আমার খুব কষ্ট হতো মায়ের জন্য। জেঠিমাকেও জ্যাঠার হাতে মার খেয়ে কাঁদতে দেখেছি, জেঠিমার জন্যও খারাপ লাগত। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হতো কাকিমার জন্য, কাকা কাকিমাকে ভয়ানকভাবে পিটাতেন, কাকিমার শরীরে জখম হয়ে যেত প্রায়ই, শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফুলে উঠত। এইসব দেখে সেই ছেলেবেলায়-ই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, বড় হয়ে আমি যদি কখনো বিয়ে করি, তাহলে আমার বউকে আমি কখনোই মারব না। নিজের কাছে করা সেই প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করেছি।

আমি ছেলেবেলা থেকেই লাজুক আর মুখচোরা স্বভাবের হলেও কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের পর থেকে আমার লাজুক আর মুখচোরা ভাবটি ক্রমশ কেটে যেতে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে পড়াতেই আমি গুছিয়ে কথা বলতে শিখে ফেলি। সত্যি বলতে কী আমার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে কলেজে পড়াতে পড়াতেই। আমি চেষ্টা করতাম তপতীকে বোঝাতে, ওর ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে। কিন্তু তপতী ছিল বোঝাপড়ার বাইরের এক অবুঝ মানুষ, বোঝাতে গেলে উল্টো ঝগড়া শুরু করে দিত। আমি আর ওকে কী বোঝাবো, উল্টো ওর কথার স্রোতে আমি ভেসে যেতাম!

কলেজ থেকে বাসায় ফিরতে একটু দেরি হলেই তপতীকে কৈফিয়ত দিতে হতো। পেশাগত কারণে ঢাকা বা অন্য কোথাও যেতে হলে, কেন যাচ্ছি, কী করতে যাচ্ছি, অন্য কেউ না গিয়ে আমাকেই কেন যেতে হচ্ছে, এরকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। আমার বাবা হয়ত কাউকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছেন যে আমাকে বাড়িতে যেতে হবে, এটা নিয়েও তার প্রশ্নের শেষ ছিল না। লেখাপড়ার জন্য বাড়ির বাইরে যখন পা রাখি, তখন থেকেই আমি স্বাধীন, কোনো বিষয়ে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হতো না কাউকে। অথচ বিয়ের পর কৈফিয়ত দিতে দিতে আমার জীবন জেরবার! একদিন কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে সে কৈফিয়ত চাইলে আমি বলেই ফেললাম, ‘এত কৈফিয়ত চাও কেন তুমি, কলেজ থেকে ফিরতে একটু দেরি হতে পারে না?’

সে বলল, ‘পুরুষ মানুষে কোনো বিশ্বাস নেই!’
‘কেন?’
‘পুরুষ মানুষ কখন কোথায় যায়, কার সাথে কী করে তার কী কোনো ঠিক আছে!’
‘তুমি কি আমার মধ্যে তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখেছ?’
‘দেখিনি, তবে ভবিষ্যতে যে দেখবো না এমন কোনো নিশ্চয়তা তো নেই! তোমার মনের মধ্যে কী চলছে, সে খবর তো আর আমি জানি না!’

আমি শুনে থ হয়ে গেলাম, যার সঙ্গে সংসার করছি সেই মানুষটি কিনা আমাকে বিশ্বাস করে না, করে সন্দেহ! বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তোমার এই সন্দেহবাতিক দূর করো, তাহলে তুমিও শান্তিতে থাকতে পারবে, আমিও স্বস্তিতে থাকতে পারব।’

তপতীর এই সন্দেহবাতিকের কারণ আমি পরে উদ্ধার করেছিলাম। ওর বাবার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা থাকায় বাবা-মায়ের দাম্পত্যজীবন ছিল কলহময়-অসুখী, যা পুরুষ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনার জন্ম দেয় তপতীর মনে এবং সে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সব পুরুষ সম্পর্কেই ওর ধারণা ছিল এই যে- পুরুষমানুষ সুযোগ পেলেই অন্য নারীতে আসক্ত হয়! এই কারণেই তপতী আমাকে সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখার চেষ্টা করত এবং নানা বিষয়ে কৈফিয়ত চাইত।

তপতীর এই নজরদারি, কৈফিয়ত, আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আর ওর মুখরা স্বভাবের কারণে আমি মানসিকভাবে ক্রমশ ওর থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম। ও আমাকে চোখে চোখে, কাছে কাছে রাখতে চাইত। কিন্তু শারীরিকভাবে কাছে থাকলেও যে মানসিকভাবে মানুষ মানুষের থেকে অনেক দূরে সরে যেতে পারে, আবার হাজার মাইল দূরে থেকেও যে প্রিয়জনের কাছে থাকা যায়, এই বোধ ওর ছিল না। মানসিকভাবে আমি তপতীর থেকে হাজার মাইল দূরের কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে অবস্থান করতাম, একা, নিঃসঙ্গ!

তপতীর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়েই আজন্ম ঘরকুনো আমি বাহিরমুখী হয়েছিলাম, আমার বাসায় থাকতে ইচ্ছে করত না। কখনো কখনো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কলেজে চলে যেতাম, দুপরের পর পর কলেজ থেকে ফিরে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে কলেজ শিক্ষকদের ডরমেটরিতে যেতাম দাবা খেলতে। মনটাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করে আমি কিছুটা মুক্তি চাইতাম সংসার থেকে। দাবা খেলা নিয়েও অশান্তি করত শুরুর দিকে, প্রথমদিকে বাড়িওয়ালার ছোট ছেলেকে দিয়ে খোঁজ নিত যে সত্যিই আমি ডরমেটরিতে আছি কি না?

একথা সত্য যে তপতী আমাকে ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গলাভের কথা কখনো ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করত না। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা। আমার মনে হতো যে ওর হৃদয়ের সবটুকু জুড়েই ছিলাম আমি এবং সংসার আর সন্তানরা। অন্য কোনো পুরুষকে হৃদয়ে স্থান না দিলেও, সে কি আমাকে ভালোবাসত? এই প্রশ্ন আমি নিজেই নিজেকে করেছি বহুবার। ভালোবাসার মানুষকে কারণে-অকারণে এত কটুবাক্য বলা যায়? ভালোবাসার মানুষের ওপর সারাক্ষণ প্রভুত্ব করা যায়? নাকি ভালোবাসা এমনও হয়, এটা ভালোবাসার ভিন্ন এক শৈলী? মনোবিদরা হয়ত ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কিন্তু আমার মনে হতো ভালোবাসার মানুষ নয়, আমি ছিলাম তার প্রয়োজন, তার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তাবলয়। এই যে পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ সামাজিক রীতি মেনে বিয়ে করে, সারাটি জীবন একজন সঙ্গী বা সঙ্গীনির সঙ্গে সংসার করে কাটিয়ে দেয়, তা কি শুধুই ভালোবেসে? আমার তা মনে হয় না। কেউ কেউ হয়তো ভালোবেসে সংসার করে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই সামাজিকতার খাতিরে, শারীরিক চাহিদার কারণে, নিজের প্রয়োজনে একসঙ্গে জীবন পার করে দেয়।

আমি একবার তপতীকে বলেছিলাম, ‘চলো, আমরা দুজনই মনোবিদের কাছে যাই। আমরা তো মানুষ, কেউই নির্ভুল নই। আমাদের আচরণে অনেক ত্রুটি থাকতে পারে। মনোবিদের পরামর্শ পেলে আমরা আমাদের ভুল আচরণ কিছুটা হয়ত শুধরে নিতে পারবো। তাতে আমাদের চলার পথ হয়ত আরো সুন্দর হবে।’

তপতী আমার কথা শুনে বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কি পাগল যে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাব! আমার চৌদ্দগুষ্ঠিতে কেউ পাগল ছিল না, এখনো নাই। তোমার দরকার হলে তুমি যাও পাগলের ডাক্তারের কাছে।’
মৃদু হেসে বললাম, ‘শুধু কি পাগলেরাই মনোবিদের কাছে যায়? মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য যে-কোনো মানুষই মনোবিদের কাছে যেতে পারে। চলো না, একবার গিয়ে দেখি। তোমার ভালো না লাগলে এরপর আর যেও না।’

সে রেগে গিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে পাগল ভাবো, যে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিতে চাও? তিন সন্তানের মা হয়ে গেলাম আমি, আর তুমি এখন আমাকে পাগল ভাবো, চালাকি করে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিতে চাও! কেমন মানুষের সাথে আমি সংসার করি!’

শেষ কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলল তপতী। আমি আর কথা বাড়ালাম না। কারণ, এরপর কিছু বলতে গেলে সে হয়ত প্রচণ্ড জেদে দেয়ালে মাথা ঠুকতে শুরু করত।

যে মানুষ সামান্য কারণে রেগে যায়, খুব বেশি রেগে গেলে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে, তারপর দেয়ালে মাথা ঠোকে আর কাঁদে, তার যদি মনোবিদের পরামর্শের প্রয়োজন না থাকে, তাহলে আর মনোবিদের পরামর্শ কার প্রয়োজন কে জানে!

আমি চেয়েছিলাম তপতী সারাক্ষণ বাসায় না থেকে বাইরে যাক, বাইরের মানুষের সঙ্গে মিশুক, বাইরের পরিবেশ যদি ওর মানসিকতার কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারে তো ভালো। একদিন বললাম, ‘তুমি আবার লেখাপড়া শুরু করো, এমএ পরীক্ষা দাও।’
সে বলল, ‘আর লেখাপড়া করে কী হবে! লেখাপড়া করলেও তো সংসার আর বাচ্চা সামলাতে হবে। চাকরি তো আর করব না।’
‘তুমি চাকরি করতে চাইলে করবে। কাজের মেয়ে তো আছেই, ও বাসা সামলাবে। এখন তো অনেক মেয়েই চাকরি করছে। মেয়েদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না, আত্মনির্ভরশীল হয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’
সে ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে দিয়ে চাকরি করাতে চাও?’
‘আমি করাতে চাইছি না, তোমার নিজের প্রয়োজনেই তোমার লেখাপড়া এবং চাকরি করা উচিত। কেবল তুমি নও, সব মেয়েদেরই তাই করা উচিত। বাইরের পরিবেশে মিশলে মন-মানসিকতাও ভালো থাকে।’
সে খেঁকিয়ে উঠল, ‘লজ্জা করে না তোমার, বউকে দিয়ে রোজগার করাতে চাও?’
‘আশ্চর্য, রোজগার করা তো দোষের কিছু না! বরং চাকরি করলে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়!’

‘কোন বাপের ছেলে দেখতে হবে তো! লোভীর জাত। বিয়ের সময় আমার বাবা তোমাদের কাড়ি কাড়ি টাকা যৌতুক দিয়েছিল আমাকে দিয়ে চাকরি করানোর জন্য? নির্লজ্জ কোথাকার, বউ দিয়ে রোজগার করাতে চাও! আমি কি ফকিন্নীর মেয়ে, ফকিন্নীর ঘরে আমার বিয়ে হয়েছে যে আমি চাকরি করব!’

আমি থ হয়ে গেলাম! মেয়েদের চাকরি করাকে যে ও অমর্যাদার-অসম্মানের মনে করে, তা আমার জানা ছিল না। আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।

১৯৮০ সালে আমার বদলির অর্ডার হয়, ঢাকা কলেজে যোগ দিই। মাস তিনেক আমি একাই ছিলাম ঢাকায়, আজিমপুরে বাসা নেবার পর ডিসেম্বরে তপতী এবং সন্তানদের ফরিদপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসি। তখন আমাদের দুইজন সন্তান ছিল, ছোট ছেলের জন্ম হয় ঢাকায় আসার পর। বসবাসের স্থান পরিবর্তন হলো ঠিকই, কিন্তু আমাদের দাম্পত্য জীবনে শান্তি এলো না।

ঢাকায় এসেও আমি কৌশলে আমার এক সহকর্মীকে দিয়ে তপতীর এমএ পরীক্ষা দেবার কথা বলিয়েছিলাম। তাতেও লাভ হয়নি, উপরন্তু আমার ওপর এই আদেশ জারি হয় যে আমি যেন আমার সেই সহকর্মীকে আর বাসায় না আনি! আমাদের ভালো করতে গিয়ে বেচারা দোষের ভাগীদার হলো!

তপতীর সঙ্গে সম্পর্কের রসায়নটা ঠিকঠাক না হওয়ায় আমার মনটা হাঁফিয়ে উঠত। মনের কথা খুলে বলার জন্য, পছন্দের বিষয়সমূহ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য মনটা ছটফট করত। মাত্র দুটি বিষয়েই তপতীর সঙ্গে আলোচনা করা যেত, সেটা সংসার আর পরনিন্দা-পরচর্চা। সংসারের প্রয়োজনীয় কথা তো অল্প সময়েই ফুরিয়ে যেত, পরনিন্দা-পরচর্চার কথা তুলতেই আমি হু হা করে এড়িয়ে বইয়ে মুখ গুঁজতাম। আমার বাড়ির লোকজন এবং আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে ওর অভিযোগের কোনো শেষ ছিল না, দিনের পর দিন যা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

শিল্প-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে তপতীর কোনো আগ্রহই ছিল না। আমার ঘরে তখনই দুটো বুকশেলফ ভরা দেশি-বিদেশি নানা লেখকের, নানা বিষয়ের বই। সে কোনোদিন একটা বই হাতে নিয়েও দ্যাখেনি। ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। শচীন দেব বর্মণ, জগন্ময় মিত্র, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র ছাড়াও আরও অনেক শিল্পীর গানের ক্যাসেট ছিল। উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্যাসেটও ছিল বেশকিছু। কোনোদিন একটা ক্যাসেট চালিয়ে ওকে গান শুনতে দেখিনি। বরং বাসা বদলের সময় বই আর ক্যাসেটের জন্য আমাকে অযথা কথা শোনাতো।

তপতী ছিল সাংঘাতিক রকমের ধর্মান্ধ আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ঈশ্বর, দেব-দেবতা, ভূত-প্রেত, যাদুটোনা, তাবিজ করা সবকিছুতেই ওর ছিল অন্ধ বিশ্বাস। আর আমি ছেলেবেলায় এসবে বিশ্বাস করলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই আমার বিশ্বাস বদলে যেতে থাকে, ঈশ্বর এবং অলৌকিক বলে খ্যাত সবকিছুর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। যেহেতু আমি কোনো ধর্মীয় আচার পালন করতাম না, তাই তপতী প্রায়ই আমাকে কটাক্ষ করত, ধর্মীয় আচার পালনের জন্য জোরাজুড়ি করত, এটা নিয়ে তর্কও হয়েছে বেশ কয়েকবার।



(চলবে........)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:৩৩

রাজীব নুর বলেছেন: সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয় আপনার এই ধারাবাহিকে উঠে আসছে।

০৪ ঠা আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:১৫

মিশু মিলন বলেছেন: সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

২| ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:০২

শায়মা বলেছেন: তারপর ?

০৪ ঠা আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:১৫

মিশু মিলন বলেছেন: আগামীকাল জানতে পারবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.