নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- আট)

০৭ ই আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৩:৪৭

ছয়

শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনীতি, বিজ্ঞান, কোনো বিষয়েই তপতীর আগ্রহ ছিল না। আমার বুকশেলফ ভরা বই, কিন্তু কোনোদিন সে একটা বই হাতে নিয়ে দ্যাখেনি। আমি একদিন বলেছিলাম, ‘তুমি সাহিত্য পড়ার অভ্যাস করো, তোমার সময় ভালো কাটবে।’

পাল্টা জবাব পেয়েছিলাম, ‘আর সংসারের কাজ করবে কে, তুমি?’
‘সংসারের কাজ করেও তো তোমার হাতে সময় বাঁচে, তাছাড়া কাজের মেয়েও আছে, কিছুটা সময় বের করে তো পড়তে পারো। কত নারী আছেন যারা সংসার সামলে কেবল পড়ছেনই না, লিখছেনও।’
‘ওসব নভেল-কবিতা পড়লে মানুষ উচ্ছন্নে যায়। তোমার মতো অলস মানুষেরা টাকা নষ্ট করে ওসব বই কেনে আর পড়ে।’

আমি আর কথা বাড়াইনি। আমার বই কেনা নিয়েও তপতীর অনেক আপত্তি, আমি নাকি টাকা নষ্ট করি। দাম্পত্য জীবন মানে তো কেবল একসঙ্গে থাকা আর যৌনতা নয়। একটা মানুষের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টার বিশ মিনিট না হয় যৌনতায় অতিবাহিত করা যায়, আট ঘণ্টা না হয় ঘুমিয়ে কাটনো যায়, কিন্তু বাকি পনের ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট? দীর্ঘ এই সময়টা কাটানোর উপলক্ষ্য তো থাকা চাই। সেই উপলক্ষ্য আমার আর তপতীর মধ্যে ছিল না, আমরা দুজন ছিলাম দুই মেরুর মানুষ। আর জাহানারা ছিল তপতীর ঠিক উল্টো চরিত্রের। সত্যিকারের বিদ্যানুরাগী, শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী। জাহানারা কিন্তু কোনো শিল্পানুরাগী পরিবারের মেয়ে নয়, কোনো ধরনের শিল্পচর্চা বা শিল্পের প্রতি আগ্রহ ওর পরিবারের কারো ছিল না। ও ছিল নিন্মবিত্ত পরিবারের মেয়ে, অন্নের চিন্তাই ছিল ওর পরিবারের সবার প্রধান চিন্তা। ওই রকম পরিবারে জন্ম নিয়ে কী করে শিল্পের প্রতি ওর এতটা টান জন্মালো, সেটা ভাবলে অবাক হতে হয়। নিজে তো চারুকলার ছাত্রী ছিলই, শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম চলচ্চিত্র, সংগীত, সাহিত্যের প্রতিও দারুণ আগ্রহ ছিল। বই পড়তে খুব পছন্দ করত। ওর এইসব গুণের কারণেই ওর সঙ্গ আমার কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল।

জাহানারার জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। ও যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে শ্বশুরবাড়ি না গিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসে এবং বরকে ডিভোর্স দিতে চায়, তখন ওর মা ব্যতিত আর কেউই পাশে ছিল না। ওর বাবা এবং ভাইয়েরা চাইছিল ও শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গিয়ে বরের সঙ্গে সংসার করুক, মেয়েদের অত লেখাপড়া করে কী হবে! কিন্তু জাহানারা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল, মাকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করেছিল। ওর লড়াই কেবল বর এবং শ্বশুরবাড়ির লোকদের বিরুদ্ধে ছিল না, নিজের বাবা, ভাইয়েরা এবং সমাজের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হয়েছিল। সে নিন্মবিত্ত পরিবারের মেয়ে, ডিভোর্সের পর আবার যখন লেখাপড়া শুরু করে, তখন বাবা এবং ভাইয়েরা তার লেখাপড়ার খরচ বহন করতে চায়নি। সে টিউশনি করে নিজেই নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগার করত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল টিউশনির জমানো টাকায়। ভর্তির পরে ওর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে বাবা মাঝে মাঝে কিছুটা আর্থিক সাহায্য করত, কিন্তু সেটা ওর লেখাপড়া এবং জীবনযাপনের খরচের তুলনায় খুবই সামান্য। সে যে চারুকলায় ভর্তি হয়েছিল বাড়ির লোকেরা তা জানত না, বাড়িতে বলিছিল যে তার বিষয়- সমাজবিজ্ঞান। ঢাকায় আসার পর কয়েক মাসের মধ্যে টিউশনি জোগার করে ফেলেছিল। টিউশনির আয়ে নিজের খরচ চালাত।

রাষ্ট্রপতি জিয়া খুন হবার দিন দুপুরে টিএসসি’তে যখন জাহানারার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তখন সে যেমনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল, তেমনি ছিল শারীরিকভাবে দূর্বল এবং ক্ষুধার্ত। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল দুটি কারণে- প্রথম কারণ অবশ্যই ওর প্রাক্তন বর, যে তাকে পুনরায় বিয়ে করে সংসার করার জন্য চাপ দিচ্ছিল, ভয়ভীতি দেখাচ্ছিল; দ্বিতীয় কারণ আগের মাসেই ওর টিউশনি চলে গিয়েছিল ছাত্রের বাবার বদলিজনিত কারণে সপরিবারে ঢাকা ত্যাগ করায়। ফলে ওর হাতে টাকা ছিল না। আগের মাসটি ধার করে চালিয়েছিল, কিন্তু চলতি মাসটিতে আর চলতে পারছিল না। সেদিন সকাল থেকেই না খেয়ে ছিল। প্রথমে এসব কথা আমাকে বলতে চায়নি। ওর মুখটা ছিল শুকনো আর শরীর দূর্বল, আমার মনে হয়েছিল যে দুপুরে সে কিছু খায়নি, হয়ত সকালেও না। কিন্তু খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেতে চাইলো। শেষে আমার প্রশ্নের মুখে সবকিছু খুলে বলতে বাধ্য হয়। বললাম, ‘আমার সঙ্গে নীলক্ষেত চলো।’

আমার কণ্ঠে এমন আদেশের সুর ছিল যে ও আর না করতে পারেনি। একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম দুজনে। নীলক্ষেতে এসে একটা হোটেলে ঢুকে ভাত আর মুরগির মাংস অর্ডার করলাম দুজনের জন্যই, আমারও ক্ষুধা পেয়েছিল। সামনে সাদা ভাত আসতেই ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বললাম, ‘কেঁদো না, ভাত খাও।’
খাওয়া শেষ হলে হোটেলের বিল মিটিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটতে লাগলাম। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের উল্টোদিকে একটা শিরীষগাছের নিচে এসে আমরা বসলাম। জাহানারা শূন্যে দৃষ্টি রেখে বলল, ‘স্যার, আমার মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। আমি আর পারছি না।’

মৃদু ধমক দিয়ে বললাম, ‘ভুলেও কখনো এই কথা ভাববে না। তুমি লড়াকু মেয়ে, লড়াই করে এই পর্যন্ত এসেছ, এখন মাঝপথে এসে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। শোনো, কোনো প্রতিকূলতাই মানুষের জীবনকে থামিয়ে দিতে পারে না। একদিন তোমার জীবনেও সুদিন আসবে। আজ থেকে দশ কি পনের বছর পর আজকের এই লড়াইয়ের কথা ভাবলে তুমি যেমনি বাড়তি উদ্যম পাবে, তেমনি তোমার আত্মহত্যা করার মতো ছেলেমানুষী চিন্তার কথা মনে পড়লে তুমি নিজেই হাসবে- যে জগতে কী তুচ্ছ কারণে তুমি আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলে। তোমার মতো আমিও আত্মহত্যা করার কথা ভাবতাম, এখন সেইসব কথা ভাবলে মনে হয় তখন আমি কী বোকা ছিলাম!’

পকেট থেকে একশো টাকার দুটো নোট বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘এটা রাখো।’

নিতে চাইলো না দেখে হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘টাকাটা রাখো। যে কয় মাস তুমি আরেকটা টিউশনি পাবে না, সেই কয়মাস ঢাকা কলেজে গিয়ে আমার থেকে টাকা নিয়ে আসবে। জানি তোমার টাকা নিতে খারাপ লাগবে। তবু তুমি নেবে। ভবিষ্যতে যেদিন তুমি শিল্পী হিসেবে সুনাম অর্জন করবে, তোমার আঁকা ছবি হাজার হাজার টাকায় বিক্রি হবে, সেদিন শোধ করে দিও।’

ও বলল, ‘স্যার আপনি কথা দিন যে তখন টাকা ফেরত নেবেন?’
‘কথা দিলাম, আমি টাকা ফেরত নেব। কিন্তু তুমি না খেয়ে আর একটা দিনও কাটাবে না। যখন টাকার প্রয়োজন হবে ঢাকা কলেজে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবে।’
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো জাহানারা।

সেদিন ওকে বিদায় দিয়ে বাসায় চলে এলাম। এর পরের তিনমাস ও নতুন কোনো টিউশনি পায়নি। এই তিনমাস আমি ওকে হাত খরচের টাকা দিয়েছি। এই তিনমাসে আমাদের অনেকবার দেখা হয়েছে। তখনো পর্যন্ত আমাদের মধ্যে ভালোবাসার চারাগাছটিও জন্ম নেয়নি, আগের মতোই শিক্ষক-ছাত্রী সম্পর্ক ছিল।
একদিন জাহানারা বলল, ‘স্যার, আমি আপনার একটা পোর্ট্রেট আঁকবো। আমাকে একদিন সময় দেবেন?’

আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম, ‘ধুর, আমার আবার কী পোর্ট্রেট আঁকবে!’
‘আপনি না করতে পারবেন না স্যার, আমাকে এই সুযোগটা দিন প্লিজ।’
‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’
‘আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন স্যার। কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়ছিনে। আগামী রবিবারে আপনি সময় দেবেন।’
‘কী মুশকিল!’
‘আগামী রোববারে সকাল দশটায় আপনি আমার হলের সামনে এসে দাঁড়াবেন। রমনাপার্কে গিয়ে আপনার পোর্ট্রেট আঁকবো।’

জাহানারার জোরাজুরিতে আমাকে সময় দিতেই হলো। সেদিন আমি পড়েছিলাম আকাশী রঙের একটা শার্ট আর কালো প্যান্ট, পায়ে চামড়ার কালো জুতো। জাহানারা গাছের নিচে ওর পছন্দমতো একটা জায়গায় আমাকে বসালো যাতে আমার মুখে ঠিকমতো আলোটা পড়ে। আমি তখন চিত্রকর্ম ভালো বুঝতাম না, চিত্রকর্মে আলোর ব্যবহার সম্পর্কে কোনো ধারনাই ছিল না। ও আমাকে যেভাবে বসিয়ে দিলো আমি ঠিক সেভাবেই বসে থাকলাম যতটা সম্ভব নড়াচড়া না করে। মাঝে মাঝে মশায় উৎপাত করছিল, সন্তর্পণে মশা তাড়াচ্ছিলাম, চুলকাচ্ছিলাম।

জাহানারা ক্যানভাসে আমাকে আঁকতে শুরু করলো, অ্যাক্রেলিক রঙে। বসে থাকতে থাকতে আমার পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে গেল, তবুও আমি উঠলাম না ওর কাজের অসুবিধা হবে ভেবে।

আমি চুপ করে থাকলেও জাহানারা মাঝে মাঝে কথা বলছিল, আমি শুনছিলাম। একসময় ও বলল, ‘স্যার আপনি এখন কথা বলতে পারেন।’
তারপর আবার বলল, ‘স্যার আপনার ফেস খুব পজিটিভ। কিন্তু আপনি সহজে হাসেন না। আপনার মুখে সারাক্ষণ কী যেন এক বেদনা ফুটে থাকে। কলেজে পড়ার সময়ও আমরা মেয়েরা আপনার মুখের এই বেদনা ফুটে থাকার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতাম।’
আমি মুখ টিপে হেসে বললাম, ‘তোমরা কলেজে এইসব নিয়েও আলোচনা করতে!’
‘হ্যাঁ, স্যার। আপনাকে নিয়ে মেয়েরা আরও কত সব কথা বলত! সে-সব আপনাকে বলা যাবে না। তবে একটা কথা আপনাকে বলি, আমার এক বন্ধবী আপনার প্রেমে পড়েছিল।’
আমি বললাম, ‘বিথীকা।’
জাহানারা অবাক হয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি জানলেন কী করে?’
‘তা নাইবা জানলে।’
আরও কিছুক্ষণ বসে থাকার পর জাহানারা বলল, ‘স্যার আপনি এখন ফ্রি।’

আমি উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে পায়ের ঝিঁঝিঁ ধরা দূর করলাম। তারপর জাহানারার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম, অবিকল আমি! জাহানারা ক্যানভাসে ফাইনাল টাচ দিতে দিতে বলল, ‘ঠিক আছে, স্যার?’

‘হ্যাঁ, একদম পারফেক্ট।’ আমি বললাম। নিজেকে ক্যানভাসে দেখে সত্যিই আমার আনন্দ হচ্ছিল।
জাহানারা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘স্যার, আপনি আমার মডেল হবেন?’
‘এইতো এখনই তোমার মডেল হলাম।’
‘শুধু আজকের জন্য নয়, মাঝে মাঝেই আপনাকে মডেল করে আঁকতে চাই। আপনার মুখ এবং হাতের গড়ন খুব ভালো, ছবি আঁকার জন্য পারফেক্ট। বিদেশে হলে আপনি চিত্রশিল্পীদের মডেল হয়েই বেশ টাকা রোজগার করতে পারতেন।’
আমি হেসে বললাম, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’
‘আমি সিরিয়াস স্যার। আমি মডেল হিসেবে আপনাকেই চাই।’
জাহানারা পোর্ট্রেটের নিচের দিকে নিজের নাম সই করে, পোর্ট্রেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার, পোর্ট্রেটটা আমার থেকে আপনার জন্য উপহার।’
‘সত্যি বলছ?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।’

দিলাম বটে ওকে ধন্যবাদ। কিন্তু এই ছবি বাসায় নিয়ে গেলে যে তপতীর হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। হলোও তাই বাসায় ফেরা মাত্র ছবি সম্পর্কে জেরা শুরু হলো। আমি সত্য কথাই বললাম যে আমার একজন প্রাক্তন ছাত্রী চারুকলায় পড়ে, সে আমাকে উপহার দিয়েছে। কিন্তু এটা বললাম না যে ছবি আঁকার সময় আমি রমনাপার্কে সেই ছাত্রীর সামনে বসে ছিলাম।

শুনে তপতী বলল, ‘কী দিন এলো, ছাত্রী স্যারের ছবি এঁকে উপহার দেয়!’

সেই শুরু আমার মডেল হওয়ার। তারপর থেকে আমি প্রায়ই মডেল হতাম আর জাহানারা আমাকে দেখে ছবি আঁকতো। আমরা ঢাকা শহরের বাইরে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর পাড়ে এবং নদীর ওপাড়ের গ্রামে যেতাম। একটু নিরিবিলি জায়গা খুঁজে নিতাম আমরা, কেননা বেশিরভাগ দিনই জাহানারা আমার খালি গায়ের ছবি আঁকত। শুধু পরনে কোনোদিন প্যান্ট, আবার কোনোদিন লুঙ্গি থাকত। কখনো কোনো গ্রামে গিয়ে লুঙ্গি পরে গামছা গলায় ঝুলিয়ে গরুর গাড়ির ওপর বসতাম, কখনো পলো হাতে মাছ ধরার ভঙ্গিতে থাকতাম, কখনো কোদাল কোপানোর ভঙ্গিমায় থাকতাম। একেকদিন একেক চরিত্রের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকতাম। জাহানারাই ব্যাগে করে আমার জন্য লুঙ্গি, গামছা, স্যান্ডোগেঞ্জি ইত্যাদি নিয়ে নিত। আমি নিলে তপতীর চোখে ধরা পড়ব এইজন্য। আমার শরীরে বাড়তি চর্বি ছিল না, শরীরের গড়নও ছিল মজবুত, ফলে সব চরিত্রে আমাকে মানিয়ে যেত। প্রথম প্রথম অবশ্য আমার লজ্জা লাগত, পরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, বলা যায় আমি বেশ উপভোগই করতাম। একদিন বুড়িগঙ্গার ওপাড়ের একটা বটগাছের নিচে বসে ছবি আঁকার পর যখন আমরা শিল্প-সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে কথা বলছিলাম, তখন জাহানারা বলল, ‘স্যার, যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলি?’

‘বলো।’
‘রাগ করবেন না তো?’
‘না, রাগ করবো কেন!’
‘আমি যখন আমার বরকে ডিভোর্স দিই, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি আর কোনোদিন বিয়ে করব না। আপনার সঙ্গে মেশার পর সহজে আর কোনো পুরুষকে আমার পছন্দও হবে না। আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি স্যার।’

আমি অবাক হয়ে তাকালাম জাহানারার দিকে। ও আমার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘাসের দিকে রাখল। বাতাসে ওর খোলা চুল মুখের বামদিকের অনেকটা আড়াল করল। ক্ষণিকের জন্য আমরা যেন কথা বলার মতো শব্দ হারিয়ে ফেললাম। চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে জাহানারাই আবার নীরবতা ভাঙল, ‘আমি জানি আপনার সংসার আছে, স্ত্রী-সন্তান আছে, আমাকে ভালোবাসা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একতরফাভাবেই আমি আপনাকে ভালোবেসে যাবো। আমি আপনার সঙ্গ উপভোগ করি। এই সঙ্গটুকু থেকে আপনি আমাকে কখনো বঞ্চিত করবেন না, প্লিজ স্যার।’

আমি শূন্যে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম। এই কথার উত্তরে কী বলা উচিত আমি তা বুঝতে পারছিলাম না। তপতীর সঙ্গে আমার মানসিক দূরত্বের বিষয়টি জাহানারা তখন জানত। হৃদয়ে আমি বেদনা বয়ে বেড়াতাম, কিন্তু তার প্রভাব যে আমার মুখেও প্রকাশ পেত, তা জাহানারাই আমাকে প্রথম বলেছিল। তাই ওকে একদিন বলেছিলাম আমার অসুখী দাম্পত্যের কথা। সব শুনে ও শুধু বলেছিল, ‘মানুষের জীবন বোধহয় এমনই স্যার, যে যা চায় সে তা পায় না। একজন নারী হিসেবে শুধু এটুকু বলতে পারি যে আপনার মতো মানুষকে যে নারী পায় তার উচিত হৃদয়ের ফ্রেমে আপনাকে অনেক যত্নে বাঁধিয়ে রাখা।’

সেদিন ওর মুখে এই কথা শুনে ভেতরে ভেতরে আমার অন্তর কেঁদে উঠেছিল। জাহানারা আমাকে ভালোবাসে শুনে ওর বলা ওই কথাগুলো আবার মনে পড়ল। প্রথমে খানিকটা অপরাধবোধ জাগলো এই ভেবে যে- জাহানারা ছোট একটা মেয়ে, ওর সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে, আর আমি বিবাহিত এবং তারুণ্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। ওর সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে আমার আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল, তাহলে হয়ত ও আমার প্রেমে পড়ত না।

আবার পর মুহূর্তেই অনুভব করলাম, আমি হয়ত জাহানারাকে প্রেমিকা হিসেবে ভাবিনি কখনো, কিন্তু গত এক বছরে ওর প্রতি আমি এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। ওর সঙ্গ তো আমিও উপভোগ করি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি ওর সঙ্গে আলোচনা করে আনন্দ পাই। আমার বদ্ধ দাম্পত্য জীবনের বাইরে ও যেন এক তেপান্তর! আমি শুধু বললাম, ‘তোমার সামনে একটা সুন্দর জীবন পড়ে আছে। তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আবার বিয়ে করে সংসার করবে।’

‘ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়! আমি আর বিয়ে করছিনে। তাছাড়া আমি তো বললামই যে আমি আপনাকে ভালোবাসি।’
‘এটা তোমার সাময়িক মোহ।’
‘আমার বয়স অল্প হতে পারে, কিন্তু পোড় খেয়ে এরই মধ্যে আমি অনেক অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছি, সাময়িক মোহে আচ্ছন্ন হবার মতো মেয়ে আমি নই। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেই আমি আপনাকে ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনার কাছে আমি অন্য কিছু চাই না, শুধু এখন যেভাবে মাঝে মাঝে আমাকে সময় দ্যান, সারাটজীবন সেভাবে সময় দিলেই হবে।’

আমি বিব্রতবোধ করছিলাম, জাহানারার দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছিল, বুড়িগঙ্গার বুকে ভেসে যাওয়া বড় নৌকার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেটা বুঝতে পেরে জাহানারা বলল, ‘আপনি লজ্জা পাচ্ছেন কেন! অবশ্য লজ্জা পেলে আপনার মুখের ওই বেদনার ভাবটি উধাও হয়ে যায়। ক্যামেরা থাকলে আপনার মুখের এই মুহূর্তের ছবি তুলে রাখতাম পরে আঁকার জন্য।’

ওর কথা বলার ধরন দেখে আমি হেসে ফেললাম, ও-উ হাসল। সুখ ও অস্বস্তি মিশ্রিত এক ধরনের অনুভূতি নিয়ে সে-দিন বাসায় ফিরলাম।


(চলবে.........)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই আগস্ট, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:২৫

শায়মা বলেছেন: তারপর? জাহানারার কি হলো?

০৭ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:৩৯

মিশু মিলন বলেছেন: অপেক্ষা করুন, জানতে পারবেন। ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

২| ০৭ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:৩৩

জ্যাক স্মিথ বলেছেন: সময় করে সবগুলো পর্ব একদিন পড়তে হবে।

০৭ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:২৫

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ০৭ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:৩৮

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর ঝরঝরে লেখা।
পড়ে ভালো লাগছে।

০৭ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:১৮

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.