নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- নয়)

০৯ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:২৩

সাত

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সারাজীবনে ওই একবারই আমি আমার স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করেছি। কী করবো বলুন, ধৈর্যে আর কুলোলো না। শুনুন, জীবনটা আমার, কিন্তু বিয়ের পর থেকে ঊনসত্তুর বছর বয়স পর্যন্ত জীবনটা আমি ব্যয় করেছি স্ত্রী আর তিন সন্তানের জন্য। এই সময়ের মধ্যে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি আমার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কারো প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। কখনো কখনো দরিদ্র কিছু আত্মীয় এবং প্রতিবেশিকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছি, কিন্তু সেটা তপতীকে না জানিয়ে, লুকিয়ে। এমনকি আমার গ্রামের বাড়ির কাউকে কিছু উপহার দিলে, সেটাও লুকিয়ে দিতে হয়েছে। ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগ্নে-ভাগ্নিরা চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এলে, লুকিয়ে ওদের পকেটে টাকা গুঁজে দিতে হয়েছে। অশান্তি এড়াতে আমাকে এই গোপনীয়তার পথ বেছে নিতে হয়। অথচ তপতীর সামনে যদি আমি এই কর্তব্যগুলো পালন করতাম, কিংবা আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে এই দায়িত্বগুলো যদি তপতী পালন করত, তাহলে ওর ভাবমূর্তি-ই উজ্জ্বল হতো স্বজন-প্রতিবেশিদের কাছে।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে জন্ম নেওয়াটাই একটা চাপের বিষয় বুঝলেন, এখানে জন্ম নেওয়ামাত্র দুধের শিশুর ঘাড়ে বিপুল বৈদেশিক ঋণের বোঝা চাপে! শিশু বড় হয় আর উত্তরোত্তর চাপ বাড়ে। চাকরি জোগার এবং স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের ভরণপোষণের চাপ হলো মূখ্য চাপ। আর স্ত্রী যদি খুব কড়া ধাঁচের হয় এবং ভোগ-বিলাসের অধিক চাহিদা থাকে, তাহলে সেই চাপ আরও বেড়ে যায়, তার ওপর ছেলে-মেয়েরা কথা না শুনলে চাপের ওজন আরও বাড়ে! এই সব চাপ আমাকে সামলাতে হয়েছে, এতসব চাপে আমার জীবনটা আর আমার থাকেনি! সারাজীবন নিজের সাধ-আহ্লাদ তেমন পূরণ করতে পারিনি। গোপনে দুঃখ বয়ে বেরিয়েছি, কোনো কোনো মানুষ যেমনি বয়ে চলে জন্মগত নিজের শরীরের বিকল অঙ্গ। গৌতম বুদ্ধ দুঃখকে আটটি পর্যায়ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মরণ দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিচ্ছেদ দুঃখ, ইপ্সিতের অপ্রাপ্তি দুঃখ এবং পঞ্চোপাদান স্কন্ধ এই দেহ ও মন দুঃখে পরিপূর্ণ।’

আমার দুঃখ- অপ্রিয় সংযোগে। এই অপ্রিয় সংযোগ আমার জীবনে অপরিমেয় দুঃখ নিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে মনে হতো গৌতম বুদ্ধের মতো সংসার ছেড়ে কোথাও চলে যাই। কত রাতে কল্পনায় গৌতম বুদ্ধের মতো পরিব্রাজন করেছি জনপদের পর জনপদ আর জীবনের সমস্ত দুঃখ কিভাবে লাঘব করা যায় সেই চিন্তা করেছি। কিন্তু সকালের সূর্যের আলো কল্পনার জগৎ থেকে আমাকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। পারিনি সংসার ছেড়ে যেতে। গৌতম বুদ্ধের মতো বৈভব ছেড়ে সাধারণ হবার ঔদার্য্য এবং মনের জোর আমার ছিল না। আমি স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে সংসারে থেকেই নিজের মতো একটা জগৎ তৈরি করে যতটা সম্ভব দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি।

তপতী কেবল একজন চড়া স্ত্রী ছিল তাই-ই নয়, ছিল একজন ভয়ংকর রকমের কড়া মা! সন্তানদেরকে ছোট থেকেই কড়া শাসনে রাখত, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে খিটমিট করত, মারধর করত। আমার খারাপ লাগত সন্তানদের জন্য, ওদের জীবনে কোনো স্বাধীনতা ছিল না, তপতী ওদেরকে সারাক্ষণ লেখাপড়ার চাপে রাখত। সন্তানদেরকে লেখাপড়ার জন্য বেশি চাপ দিতে, ওদের সঙ্গে খিটমিট কিংবা ওদেরকে মারধর করতে নিষেধ করতাম আমি। কিন্তু তপতী ধমক দিয়ে আমাকেই চুপ করিয়ে রাখত, ‘আমি যখন ছেলে-মেয়েদের শাসন করব, তুমি কথা বলবে না।’

‘কিন্তু তুমি যদি কারণে-অকারণে ওদের সঙ্গে এত বেশি খিটমিট করো, ওদেরকে বকাঝকা করো, তাহলে একটা সময় ওরা রিঅ্যাক্ট করতে শুরু করবে। ওরাও বেপরোয়া আচরণ করবে, তখন তুমি ওদেরকে সামলাতে পারবে না।’ আমি বলতাম।

‘ছেলেমেয়েদের কিভাবে শাসন করব বা না করব তা তোমার কাছ থেকে আমাকে শিখতে হবে না। আমি তোমার মতো হলে ওরা আর মানুষ হবে না।’
তপতীর ধারণা ছিল অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ভালো করা, বড় হয়ে ভালো চাকরি করা মানেই মানুষ হওয়া। সন্তানরা কিভাবে বিনয়ী, সৎ, সংবেদনশীল আর মানবিক মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে সেই শিক্ষা তপতী ওদেরকে দিত না।

আমি ছিলাম গ্রামের ছেলে, প্রায় পাখির মতো স্বাধীন আমার জীবন ছিল! আমার বাবা-মা কখনো আমাকে লেখাপড়ার জন্য অতিরিক্ত চাপ দেননি। আমি চাইতাম আমার সন্তানরাও কিছুটা স্বাধীনতা নিয়ে বেড়ে উঠুক, কড়া শাসন নয়, ওদের প্রয়োজন ছিল শুধু একটু পথ দেখানো, ভালো-মন্দের তফাৎটা ওদের মনে গেঁথে দেওয়া। কিন্তু তপতীর ধারণা ছিল কড়া শাসনে রাখলে সন্তানরা সারাজীবন তার হাতের মুঠোয় থাকবে, তার মুখের ওপর কথা বলতে পারবে না, তাকে ভয় পাবে, শ্রদ্ধা করবে। এটা ছিল ওর ভুল ধারণা। উল্টো বাড়ন্ত বয়স থেকেই সন্তানরা তাদের মায়ের ওপর বিরক্ত-বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল, ফলে মাকে এড়িয়ে চলতে চাইত তারা। ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় থেকেই ওরা মায়ের মুখে মুখে তর্ক করত, রীতিমতো ঝগড়া করত মায়ের সঙ্গে, মায়ের হাতে মারও খেত।

লেখাপড়ার বাইরে সন্তানদের অন্য কোনো গুণ থাকলে বাবা-মায়ের উচিত ওদের সেই গুণের প্রশংসা করা, যাতে সেই গুণগুলো আরও বিকশিত হতে পারে। আমাদের বড়ো ছেলে অমিয়’র ছেলেবেলায় ছবি আঁকার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। ছবি এঁকে খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের দেখাত। আমি সবসময়ই ওর আঁকা ছবির প্রশংসা করতাম, ওকে আরও ভালো ছবি আঁকতে উৎসাহ দিতাম। কিন্তু তপতী ছবিতে একবার দৃষ্টি বুলিয়েই কড়া স্বরে বলত, ‘যাও, এখন এইসব আঁকা-আঁকি রেখে পড়তে বসো।’

আমাদের মেয়ে বিতস্তা নাইন-টেনে উঠার পর ছুটির দিনে মাঝে-মধ্যে দু-একটি পদ রান্না করতে চাইত। ও যখন রান্না করত তখন আমি বারবার গিয়ে দেখতাম যে কিভাবে রান্না করছে, আমার উপস্থিতিতে ও খুশি হতো, রান্নার প্রতি ওর আগ্রহ আরও বেড়ে যেত। রান্না যেমনই হোক খেতে বসে আমি ওর রান্নার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতাম, ভীষণ খুশি হতো বিতস্তা। অন্যদিকে তপতী কোনোদিন লবণ হয়নি, কোনোদিন ঝাল হয়নি, কোনোদিন আলু কি পটল ভালো সিদ্ধ হয়নি, এসব খুঁত বের করত। আর বিতস্তা যেদিন রান্না করত, কাকতালীয়ভাবে এর বেশিরভাগদিনই কিছু না কিছু বিষয় নিয়ে তপতীর মেজাজ চড়ে যেত, আমার ওপর চোটপাট করত। আমি শান্ত থাকলেও তপতী একাই মুখ চালিয়ে যেত। বিতস্তা যখন ওর রান্নাগুলো টেবিলে সাজিয়ে আমাদের খেতে ডাকত, তপতী পরে খাবে বলে ওকে ধমক দিত, কিংবা একটা বাঁকা কথা বলত। যে আগ্রহ নিয়ে, যে আনন্দ নিয়ে বিতস্তা রান্না করত, সেই আগ্রহ-আনন্দ ম্লান করে দিত তপতী।

কোনো দম্পতির একাধিক সন্তান থাকলে, একেকজনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একক রকম হয়, লেখাপড়ার বাইরে একেকজন একেক গুণাবলী নিয়ে বেড়ে ওঠে। এই গুণাবলীর কারণেই কখনো কখনো কোনো কোনো সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের একটু বেশি দূর্বলতা, ভালোবাসা বা মুগ্ধতা জন্ম নিতে পারে। কিন্তু সৎ ও সুবিবেচক বাবা-মায়ের উচিত সেই দূর্বলতা, ভালোবাসা বা মুগ্ধতা নিজের মনের মধ্যেই গোপন রাখা, কখনোই সন্তানদের সামনে প্রকাশ না করা। প্রকাশ করলে একজন হয়ত খুশি হয়, কিন্তু বাকিরা আহত হয়, কষ্ট পায়। সন্তানদের একজনের সঙ্গে আরেক জনের তুলনা করাও উচিত নয়, একজন কোনো ভুল করলে বা কোনো কিছু করতে অপারগ হলে, আরেকজনের গুণ তুলে ধরে খোঁটা দেওয়া উচিত নয়। তাতে যে ভুল করে বা কোনো কিছু করতে অপারগ, সে হীনমন্যতায় ভোগে, আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়ে। অথচ এই কাজগুলো তপতী প্রতিনিয়ত করত। সে বরাবরই ছোটছেলে অমিতকে বেশি ভালোবাসতো, অমিতের প্রতি ওর পক্ষপাতিত্ব ছিল প্রকাশ্য। এটা অমিয় আর বিতস্তাকে আহত করত। আমি বহুবার নিষেধ করেও সন্তানদের প্রতি তপতীর এই আচরণ সংশোধন করতে পারিনি।

অমিয় ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ময়মনসিংহ মেডিকেলে চান্স পেয়ে ওখানে হোস্টেলে চলে গেল, আর এমবিবিএস শেষ করে চলে গেল আমেরিকায়। বিতস্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে হোস্টেলে চলে গেল। ছোট ছেলে অমিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল আর সেও বাসা ছেড়ে হোস্টেলে উঠল। তখন আমাদের বাসা ধানমন্ডিতে, চাইলে বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসেই যাতায়াত করতে পারত অমিত। কিন্তু সে হোস্টেলে থাকতে চাইল, আমি নিষেধ করলাম না, কারণ আমি বুঝেছিলাম যে সে মায়ের থেকে দূরে থাকতে চাইছে, স্বাধীনতা চাইছে। তপতীর সঙ্গে ঝগড়া করেই সে হোস্টেলে উঠল। হোস্টেলে থাকাকালীন ওরা কেউই বাসায় আসতে চাইত না, এমনকি এত কাছে থেকে অমিতও নয়। অনেকদিন পরপর বাসায় আসত, কেননা বাসায় এলেই কিছু না কিছু নিয়ে মায়ের সঙ্গে ওদের মতবিরোধ হতো, এমনকি ঝগড়াও। মন খারাপ করে ওরা হোস্টেলে ফিরে যেত। বাবা-মায়েদের হওয়া উচিত বটবৃক্ষের মতো, যেখানে এলে সন্তানরা প্রশান্তির ছায়া পাবে, নিশ্চিন্তে ঘুমাবে, হাসবে, ঘুরবে-ফিরবে। অথচ আমাদের বাসা সন্তানদের কাছে গ্রীষ্মের দুপুরের মরুভূমির মতো ছিল! যেখানে সন্তানেরা ফিরতে চাইত না। কলহের ভয়ে বাসায় আমিও সন্তানদেরকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে পারিনি। সন্তানদের হয়ে কোনো কথা বললেই পারিবারিক অশান্তি চরমে উঠত।

সন্তানরা কথা শুনত না বলে তপতী প্রথমে ওদের সঙ্গে চিৎকার করে ঝগড়া করত, তারপর ওদের সঙ্গে যুক্তিতে না পেরে কিংবা নিজের সিদ্ধান্ত ওদের ওপর চাপিয়ে দিতে না পেরে কাঁদত। আমি কখনো কখনো পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করেছি। একবার কোনো কারণে বিতস্তার সঙ্গে তপতীর তুমুল ঝগড়া লাগলো, বিতস্তা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, বাড়িতে এসেছিল ছুটিতে। মা-মেয়ে দুজনকেই আমি শান্ত করার চেষ্টা করলাম। মেয়ে তখন আমার দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘তোমার জন্যই তোমার বউয়ের এত বাড় বেড়েছে, কোনোদিন শাসন করোনি বলে সে কাউকেই পরোয়া করে না। নিজে বলদের মতো খেটেছ, আর তোমার বউ তোমার টাকায় সবাইকে দেমাগ দেখিয়ে বেরিয়েছে! নিজের বউকে কন্ট্রোল করতে পারো না, তুমি একটা…..!’

ও কথা শেষ না করেই থেমে গেল, হয়ত বলতে চেয়েছিল- স্ত্রৈণ! কিন্তু আমি ওর জন্মদাদা পিতা বলেই হয়ত শেষ পর্যন্ত বলতে পারল না। আমার গ্রামের বাড়ির স্বজন এবং পাড়া-পড়শিরা আড়ালে আমাকে বলত ‘মেন্দামার্কা পুরুষ’! কী জানি, আমি হয়ত তাই!

মেয়ে বিয়ে দিয়েছি কানাডা প্রবাসী এক ছেলের সঙ্গে, পাত্র বিতস্তার বান্ধবীর ভাই, ও নিজেই পছন্দ করেছে পাত্রকে। অনার্স শেষ করে অমিতও চলে গেল ওর দাদার কাছে। তিন সন্তানের কেউ-ই আর দেশে রইলো না। অমিয় আমেরিকা প্রবাসী এক ভারতীয় মেয়েকে বিয়ে করেছে, আর অমিত বাংলাদেশে এসে বিয়ে করে পরে বউ নিয়ে গেছে।

সন্তানদের শৈশব-কৈশোরের দুষ্টুমি, হাসি, আনন্দ, উৎসাহ, উদ্যম সবকিছুতে বাঁধ দিয়ে কেবল লেখাপড়া করার জন্য চাপ দিত তপতী। ফলে সন্তানদের শৈশব-কৈশোর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ওদের স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ওদের পরবর্তী জীবনে। ওরা ভীষণরকম ক্যারিয়ারিস্ট, যে-কোনো উপায়ে নিজের ক্যারিয়ার মজবুত করাই ওদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু ক্যারিয়ারের বাইরেও যে নিজের একটা জীবন আছে, পরিবার আছে, বন্ধু-বান্ধব আছে, সমাজ আছে, মানুষ আছে। সবার প্রতি-ই যে একটা দায়িত্ব আছে, তা ওরা ভুলে গেছে। সারা সপ্তাহেও সন্তানরা যখন একটা ফোন করত না, তখন তপতী অনুশোচনা করে বলত, ‘ছাইতে জল ঢালছি!

আমি বলতাম, ‘চারা রোপন করে যেমনভাবে লালন-পালন করেছ, তেমনই ফল পাচ্ছো। এখন দুঃখ করে আর কী করবে!’
তবু তপতী নিজের ভুল স্বীকার করত না, আমার জাত-গুষ্ঠির দোষ দিত! বলত, ‘তোমাদের জাতের রক্তই এমন!’

তপতী চেয়েছিল অমিত দেশেই থাকুক। কিন্তু অমিত দেশে থাকতে রাজি হয়নি। প্রথম প্রথম অমিতের জন্য প্রায়ই কাঁদত তপতী।

সন্তানরা ওদের মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। পালিয়েও ছিল। কিন্তু আমি? আমি তখন না পারি ফেলতে, না পারি গিলতে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তপতীর খিটমিট স্বভাব আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমি কলেজের চাকরি থেকে অবসর নেবার পর, কোথায় একটু শান্তিতে ঘুরে-ফিরে, হেসে-খেলে জীবন পার করবো। তা না সারাক্ষণ বাসায় থাকার কারণে অশান্তি যেন আরও জেঁকে বসলো। অবসরের পর গিন্নীর ফাই-ফরমাশ খাটতে খাটতে আমার জীবন কয়লা হয়ে গেছে! শরীরে নানান রোগের বাসা বাঁধিয়েছিল সে, তা একটা ধারালো চকচকে তরবারিও যদি আপনি দিনের পর দিন কাজ না করে ফেলে রাখেন, সেটাতেও তো জং ধরবে নাকি! বহুবছর ধরেই সকালে হোক কিংবা বিকালে, আমার হাঁটার অভ্যাস। অবসরের পর সকাল-বিকাল দু-বেলা হাঁটতে শুরু করি, আমার সঙ্গে অন্তত একবেলা তাকে হাঁটতে যেতে বলতাম, কিন্তু সে কখনোই হাঁটতে যেত না। সারাটা জীবন তো খুব একটা নড়ে চড়ে দেখলো না। গৃহকর্মী আর আমি অধম ছিলাম তার হুকুম পালন করার জন্য। শরীরে রোগ বাসা বাঁধবে না তো কী পেশিতে বিদ্যুৎ খেলা করবে!

বাসার গৃহকর্মীকে সারাদিন চরকার মতো ঘুরাত আর বকাঝকা করত। আরে বাবা, ওরা গরিব, পেটের জন্য পরের বাড়িতে কাজ করে, কিন্তু ওরাও তো মানুষ, ওদেরও তো আত্মসম্মানবোধ আছে। বাসায় যাকেই গৃহকর্মী হিসেবে রাখতাম, ক’দিনেই সে হাঁপিয়ে উঠত। তার কাজের খুঁত ধরত আর বকাঝকা করত। গৃহকর্মীরা যে পরিবারে জন্মেছে, যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, যে ধরনের কাজ শিখেছে; তার সঙ্গে তপতীর জন্ম, বেড়ে ওঠা ও কাজ শেখার ধরনে বিস্তর পার্থক্য ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক। ফলে একজন গৃহকর্মী আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে এসে খুব সহজেই গৃহকত্রীর চাহিদা অনুযায়ী কাজ করবে, সেটা ভাবা অনুচিত। ওদেরকে শিখিয়ে নিতে হবে, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেবার সুযোগ দিতে হবে। তারপরও ওরা গৃহকত্রীর শতভাগ চাহিদা মিটাতে পারবে না, সেটা আশা করাও উচিত নয়। একই সঙ্গে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা, দুই যমজ বোনের কাজের ধরনেও তো পার্থক্য থাকে। আর গৃহকর্মীরা তো আলাদা একটা শ্রেণি থেকে উঠে আসে। ফলে আমাদেরও খানিকটা ছাড় দিয়ে ওদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। ওদের যেমনি টাকার জন্য আমাদের বাসায় কাজ দরকার, তেমনি আমাদের বাসাটা সুন্দরভাবে চালানোর জন্যও ওদেরকে প্রয়োজন। এই বিষয়টি তপতী বুঝতে চাইত না। ওর বকাঝকা শুনে গৃহকর্মীরা প্রথম কয়েকদিন চুপ করে থাকত, কিন্তু ওদেরও তো সহ্য শক্তির একটা সীমা আছে, কয়েকদিন যেতেই সে উত্তর দিতে শুরু করত, আর লেগে যেত ঝগড়া। তপতী চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করত! ফলাফল? গৃহকর্মী কাজ ছেড়ে চলে যেত। ছয় মাসের বেশি কোনো গৃহকর্মী টিকত না। স্বীকার করছি যে কোনো কোনো গৃহকর্মীও ছিল ভীষণ ঘাড়ত্যাড়া, বারবার বললেও কিছু শেখার চেষ্টা করত না, বিরক্ত হতো, রেগে যেত। কিন্তু সবাই তো তেমন ছিল না। ।

গৃহকর্মী চলে গেলে তপতীর আর কী? ঠ্যালা সামলাতে হতো এই অধমকে! ঘর ঝাড়ু দাও, মোছো, জল ফুটাও, বেশিরভাগ পদ রান্না কর, গিন্নী এক পদ রান্না করলেও তার তরকারি কেটে ধুয়ে দাও, রাত-দুপুরে তার গরম জল দাও, কোমরে হট ওয়াটার ব্যাগের ছ্যাঁকা দাও, মেরুদণ্ডে মলম মালিশ কর! তাও যদি একটু ভালো মুখ দিতো! কী জীবন আমার, এই করতে করতেই বয়স ঊনসত্তর, তো এই বয়সে এসে আমারও তো একটু আরাম-আয়েশ করার সাধ জাগে না কী! সুস্থ থাকার জন্য একটু আরাম-আয়েশের দরকারও তো আছে।

সেদিন সকালবেলা আমার মেজাজটা বিগড়ে গেল। যাবে না কেন? আমিও তো মানুষ। দিন দশেক আগে কাজের মেয়েটা চলে যাওয়ায় আমাকেই বাসার সব কাজ সামলাতে হচ্ছিল। তার ওপর তপতী ছিল অসুস্থ, তার সেবা-যত্নও আমাকেই করতে হচ্ছিল। আমি সারারাত জল গরম করে হট ওয়াটার ব্যাগের ছ্যাঁকা দিয়েছি তার কোমরে। ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিলাম। খুব সকালে পিঠে অনুভব করলাম তার হাতের ধাক্কা। কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলেও চোখ খুলে তাকাতে পারছিলাম না। তার দিকে মুখ না ঘুরিয়েই ঘুম জড়ানো গলায় বললাম, ‘কী হলো?’

যেন হাত ফসকে পড়া কাঁসার থালা ঝনঝনিয়ে উঠল, ‘সারারাত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ, আর পিঠের কাছে যে একটা মানুষ না ঘুমিয়ে সারারাত ব্যথায় কাতরাচ্ছে, সেই হুশ যদি থাকতো! যাও চা বানিয়ে আনো।’

সাতসকালে উঠে তার আবার আদা-লবঙ্গের চা ছাড়া চলত না। চিনি এক চামচের সামান্য কম, এর বেশিও নয়, কমও নয়। যেদিন চিনির পরিমাণটা একটু কম-বেশি হতো, সেদিন গৃহকর্মীদের সারাটা দিন খারাপ যেত। চিনি একটু কম হলে চক্ষুবাণে গৃহকর্মীদের বিদ্ধ করে বলত, ‘ঘোড়ার প্রসাব বানিয়ে নিয়ে এসেছে!’ আর বেশি হলে বলত, ‘এটা চা না কি ফুটপাতের শরবত!’ এই মিষ্টি চিনি-ই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দু-দুটো কাজের মেয়েকে বিদায় করেছে!

খুব কষ্টে চোখের পাতা ছাড়িয়ে গেলাম চা বানাতে, মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল আমার পৃথিবীটা দুলছে, মাথা ঘুরে পড়ে যাব। ঐ অবস্থায় গরম চা কাপে ঢালতে গিয়ে পাত্রটা আমার হাত ফসকে পড়ে গেল। অমনি ও ঘর থেকে তার চিৎকার, ‘ভাঙলো কী? একটা কাজ যদি তোমাকে দিয়ে হয়! কোনো কাজ করতে বললেই অকাজ করবে। পা পুড়েছে তো না কী! আমার আর শান্তি নেই!’

একে তো গরম চা পায়ে পড়েছে, তার ওপর গা জ্বালানো কথা আর সহ্য করতে পারলাম না। তার সামনে গিয়ে বললাম, ‘তুমি মরতে পারো না? তবে তো তুমিও শান্তি পাও, আমিও শান্তি পাই!’

সে পাথুরে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা কথাও বললো না। হয়ত এমনটা সে ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি।

রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে আবার চুলোয় চায়ের জল চাপিয়ে দিলাম। চা তৈরি করতে করতেই আমি অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করলাম, সারাটা জীবন যখন সব সয়ে এসেছি, জীবনের এই গোধূলিবেলায় এসে অসুস্থ মানুষটাকে এমন কড়া কথা না বললেই পারতাম। চা নিয়ে গিয়ে তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলাম। সে কোনো কথা বললো না। আমার দিকে তাকিয়েও দেখল না, চায়ের কাপটিও হাতে নিল না। ভাবলাম, রাগ করেছে, পরে ঠিক হয়ে যাবে। পরদিনও সে আমার সাথে কথা বললো না, তার পরদিনও না, আর কোনদিন-ই না। ছয় দিন পর সে সত্যি সত্যি পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল!


(চলবে.......)

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ২:২৯

দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: এতো বড় পড়তে সময় লাগে তাই ছোট করে কয়েক পর্বে দিলে অনেকেই পড়বে।

০৯ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ২:৪০

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ০৯ ই আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৩:০৪

অরণি বলেছেন: ছোট না হলে কেউ পড়বেনা।

৩| ০৯ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:৪২

শায়মা বলেছেন: বাপরে!!

এত অভিমান তার!!

এতদিনে নিশ্চয় বুঝেছো ভাইয়া যে তপতী একজন পারফেকশনিস্ট টাইপের মানুষ ছিলো তাই সবার জীবনে একদিন ভালো হোক এটাই চাইত আর তাই ছেলেমেয়েদেরকে অমন শাসন করত। এসব করতে করতে নিজেই বেরসিক হয়ে গিয়েছিলো।

০৯ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:৩৬

মিশু মিলন বলেছেন: এত বদরাগী, কর্তৃত্বপরায়ণ, দাম্ভিক, ধর্মান্ধ মানুষকে পারফেকশনিস্ট বলা যায় কি না, সেটা লেখক হিসেবে আমি বলতে পারি না, পাঠক-সমালোচক ভালো বলতে পারবেন। ধন্যবাদ, সাথে থাকার জন্য।

৪| ০৯ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: আপনার এই ধারাবাহিকটি আমি বেশ উপভোগ করছি।

০৯ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:৪৯

মিশু মিলন বলেছেন: জেনে খুশি হলাম। অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.