নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- এগারো)

১২ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:২৫

নয়

কেউ হয়ত বলবে- আমার ভাগ্যে এমনটাই লেখা ছিল। কেউ বলবে- এটাই নিয়তি, নিয়তিকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না। আবার কেউ হয়ত বলবে- পূর্বজন্মের কোনো পাপের ফলে আমি এমন নিঃসঙ্গ হয়েছি। আমি বলব- এটা বাস্তবতা, এর সঙ্গে পূর্বজন্মের কোনো সম্পর্ক নেই। জন্মান্তরবাদ মানুষের কল্পনা মাত্র। এই পরিস্থিতির জন্য আমি কাউকে দোষও দিই না। জীবন এমনই, চিরদিন একইরকম যায় না কারো। জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত আসে, দুঃখ আসে, বার্ধক্য আসে, জরা আসে, আসে সর্বগ্রাসী মৃত্যু। কারো আপনজন মারা গেলে, কারো বড় কোনো অসুখ হলে কিংবা স্বাভাবিক মৃত্যু হলে, আমাদের সমাজের কেউ কেউ বলে থাকেন- পূর্বজন্ম কিংবা ইহজন্মের পাপের ফল। এগুলো অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক কথা, মানব মনের অসুন্দর প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণের মতো অতবড় একজন কূটনীতিক এবং রাজাকেও সামান্য ব্যাধের তীরের আঘাতে মরতে হয়েছিল, মানবদরদী যীশুকে ক্রুশকাঠে পেরেক বিদ্ধ হয়ে মরতে হয়েছিল, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মুহাম্মদকেও বিষের যাতনা ভোগ করে মরতে হয়েছিল। এর কোনোটাই নিয়তি নয়, পাপের ফল নয়, তারা সবাই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন।

আমি বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করার চেষ্টা করলাম। ঢাকা শহরে আমার যে-সব বন্ধু-বান্ধব ছিল, তাদের কেউ কেউ তখন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, আর যারা বেঁচে ছিল তাদেরও বেশিরভাগই অসুস্থ, দু-তিনজনের সঙ্গেই কেবল মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। এই বয়সে এসে মানুষের খুব বেশি বন্ধু-বান্ধব থাকে না, পরিবারের সান্নিধ্যেই সময় কাটে বেশিরভাগ মানুষের।

আমার পরিচিত কয়েকজনকে বলে রেখেছিলাম সার্বক্ষণিক একজন গৃহকর্মী ঠিক করে দেবার জন্য। যাতে রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা সব কাজ একাই করতে পারে। কিন্তু মুশকিল হলো- একা পুরুষের বাসায় কোনো নারী গৃহকর্মী থাকতে রাজি হচ্ছিল না। যতই বৃদ্ধ হই, পুরুষ তো! তপতী বেঁচে থাকতে গৃহকর্মী না থাকলে বেশিরভাগ দিন আমাকে রান্না করতে হতো, ঘরের অন্যান্য কাজও করতে হতো। আমি কোনো ব্যাপারেই কখনো তপতীর ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না। আমার কাজ-কর্ম যতটুকু আমি নিজেই করতাম আর গৃহকর্মীরা কিছুটা করত। তো সেই দিক থেকে আমার খুব বেশি অভাববোধ ছিল না। তবে একটা ব্যাপার কী জানেন, দীর্ঘদিন কোনো কিছুতে আপনি অভ্যস্ত হয়ে গেলে, হঠাৎ-ই সেটার অভাব আপনার জীবনে ছন্দপতন ঘটাবেই। আপনার ভেতরে শূন্যতা তৈরি করবেই। আমার ভেতরেও শূন্যতা তৈরি করেছে যেটা, সেটা হলো তপতীর বকবকানি আর ধমকানি। হাসবেন না, সত্যি বলছি, সে যতক্ষণ জেগে থাকত বকবক করেই চলত। পান থেকে চুন খসলেই ধমকাত। এটারই তীব্র অভাব বোধ হলো আমার! যেটা আমাকে সারা জীবন জ্বালিয়েছে, আমার জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে। সেটার অভাবেই আমার ভেতরটা খাঁ খাঁ করতে শুরু করল!

দাম্পত্য জীবনে আমি এতটাই অসুখী এবং তপতীর ওপর বিরক্ত ছিলাম যে সারাজীবন ওর দোষগুলোই কেবল আমার চোখে তীব্রভাবে ধরা পড়েছে, গুণগুলো দোষের আড়ালে পড়ে ছিল, মৃত্যুর পর গুণগুলো আমার কাছে স্পষ্ট হতে থাকে, সেগুলোর অভাব বোধ করতে থাকি, আর ওর মৃত্যু কামনা করে বলা কথাগুলোর জন্য আমি আরও বেশি অনুতাপে পুড়তে থাকি। তপতী খুব গোছালো ছিল, ফ্ল্যাটটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখত। যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তখনও নিজে কাছে দাঁড়িয়ে থেকে গৃহকর্মীদের দিয়ে ফার্নিচারগুলো প্রতিদিন মোছাত। বাসার কোথাও একটু ধুলো জমতে দিত না। তপতী চলে যাবার পর আমি ধুলো মুছেছি আর আমার বুকের ভেতরটা হাহাকার করেছে। আর রান্নার কথা কী বলব, সত্যিই দারুণ রান্নার হাত ছিল ওর। রান্নার বই কিনে নিত্যনতুন সুস্বাদু সব পদ রান্না করত। শীত শুরু হতেই নানারকম পিঠায় সেজে উঠত ডাইনিং টেবিল। বিভিন্ন রকম পদ রান্না কিংবা পিঠা-পায়েস বানানো ছিল ওর সখ। ছেলে-মেয়েরা এতসব পিঠা-পায়েস খেতে না চাইলে রাগ করত তপতী, মাঝে মাঝে ঝগড়া লাগার উপক্রমও হতো। কখনো কখনো আমি বিরক্ত হয়ে বলতাম, ‘ওরা খেতে চায় না, তাহলে এত পিঠা-পায়েস বানাও কেন?’

তপতী বলত, ‘বাঙালির ছেলে-মেয়ে শীতের দিনে পিঠা-পায়েস খাবে না তো চীন-জাপানের খাবার খাবে!’

আমাদের জন্যই সে অত সব খাবার আর পিঠা পায়েস তৈরি করত, তাই না খেলে রেগে গজগজ করত, মন খারাপও করত। খাবার ইচ্ছা বা রুচি না থাকলেও অনেক সময় ওকে খুশি করতে আমি খেয়ে নিতাম। শেষের দিকে অসুস্থ শরীরে পারত না, তাও গৃহকর্মীদের সাহায্য নিয়ে পিঠা-পায়েস বানাতো।

তপতী চলে যাবার পর প্রায়ই ওকে স্বপ্ন দেখতাম- কখনো আমাকে বকাঝকা করছে, কখনো আমাকে পায়েস খেতে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে যে কেমন স্বাদ হয়েছে, কখনো বাজারের লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাজারে যেতে বলছে। যেদিন স্বপ্নে ওকে দেখতাম, সেদিন সারাটা দিন কী এক শূন্যতা যেন পেয়ে বসত।

তখন ফ্ল্যাটে প্রাণ বলতে বারান্দার টবের কয়েকটা গাছ, গোটা চারেক টিকটিকি, কিছু পিঁপড়া আর আমি। নীরবতায় আমি হাঁফিয়ে উঠতে লাগলাম। আর হাঁফিয়ে উঠলেই গাছ আর টিকটিকিগুলোর সাথে কথা বলা শুরু করতাম। কথা বলতে বলতে গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে দিতাম। গাছগুলোকে বলতাম, ‘তোরা এখন আমাকে সময় দে, আমি তোদের একদিন মুক্তি দেব, টব থেকে তুলে তোদেরকে মাটিতে লাগিয়ে দেব। তোরা মাটি থেকে অনেক রস পাবি, অনেক রকম পদার্থের স্বাদ পাবি শেকড়ে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পাবি, ঝলমলে রোদ পাবি, আর তরতর করে বেড়ে উঠবি।’

টিকটিকি তিনটা আমার কথা শুনতো না ঠিকমতো। ওরা পোকা ধরার জন্য ব্যস্ত থাকত। তবে লেজ কাটা যে টিকটিকিটার, সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনত। ড্যাবড্যাব করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত। বোধ হয় ওর লেজকাটা বলে অন্যরা ওকে এড়িয়ে চলত। তাই বুঝি চিনেছিল-রতনে রতন!

একদিন সান্ধ্যভ্রমণ শেষে বাসায় ফেরার পথে দেখলাম সাদা রঙের একটা ছোট বিড়ালের বাচ্চা ম্যাও ম্যাও করছে, বোধ হয় কেউ ফেলে গিয়েছিল বাচ্চাটিকে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বাচ্চাটা আমার পায়ের কাছে চলে এলো, পায়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে গন্ধ শুকতে থাকল আর থেকে থেকে ম্যাও ম্যাও করতে লাগল। বাচ্চাটিকে বাসায় নিয়ে এলাম। ছেলেবেলা থেকেই কুকুর-বিড়াল পোষার শখ আমার, আমাদের গ্রামের বাড়িতে সবসময়ই কুকুর-বিড়াল থাকত। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও বাসায় কুকুর-বিড়াল পুষতে পারিনি কখনো। তপতী কুকুর-বিড়াল পোষা পছন্দ করত না, বরং বলা ভালো কুকুর-বিড়ালকে ঘৃণা করত। বিতস্তা আমার মতো কুকুর-বিড়াল ভালোবাসে। একবার স্কুল থেকে ফেরার সময় একটা কুকুরের বাচ্চা ওর পায়ের কাছে এলে ও বাচ্চাটিকে আদর করে কোলে তুলে নিয়েছিল। তপতীর ধমক খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নামিয়েও দিয়েছিল বাচ্চাটিকে, তারপরও বাসায় ফিরে চড় খেতে হয়েছিল তপতীর হাতে। আমি যেদিন বিতস্তাকে স্কুল থেকে আনতে যেতাম, সেদিন ও ইচ্ছে মতো রাস্তার কুকুরকে আদর করত, আমার থেকে টাকা নিয়ে বিস্কুট কিনে খাওয়াতো কুকুরদের।

যাইহোক, বিড়ালের বাচ্চাটির সঙ্গে আমার বেশ ভালো সময় কাটতে থাকে। মেয়ে বিড়াল, গায়ের রঙ ফুটফুটে সাদা বলে ওর নাম রাখলাম- জুঁই। সারাক্ষণ আমার পিছে পিছে ঘুরতে থাকে জুঁই। বই পড়া কিংবা সিনেমা দেখার সময় আমার কোলের মধ্যে এসে বসে। আমি ওকে ঘাড়ের ওপর বসিয়ে রান্না করতাম, বাসন মাজতাম-ধুতাম।

তপতীর মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই আমার ছোটভাই অনিমেষ বলছিল বাড়িতে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসার জন্য, সবার মাঝে থাকলে মনটা ভালো থাকবে তাই। জুঁইকে সঙ্গে করে প্রায় পাঁচ বছর পর পা বাড়ালাম বাড়ির পথে। যাবার আগে ফ্ল্যাটের একটা চাবি রেখে এলাম রায়ের বাজারে আমার ভাগ্নির কাছে, আর বলে এলাম যে আমার ফিরতে দেরি হলে ও যেন কয়েকদিন পর পর বাসার টবের গাছগুলোতে জল দিয়ে আসে। শেষবার বাড়িতে গিয়েছিলাম আমার দাদা মারা গেলে। আমাদের আগের প্রজন্মের আর কেউ বেঁচে নেই। আমাদের প্রজন্মের মধ্যে আমার বড় দাদা-বৌদিও নেই। ছোটভাই আর ওর বউ আছে। এখন বাড়ি সরগরম রাখে নতুন প্রজন্ম, ভাতিজাদের সন্তানরা।

মধুমতি নদীর তীরে আমাদের গ্রাম। দু-চোখ জুড়োনো প্রকৃতি! আমাদের কৈশোর-যৌবনে আরও সুন্দর ছিল, আরও সবুজ। এখন গ্রামের বাহ্যিক চেহারা যেমনি বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে মানুষও। আমরা যাদের স্নেহ পেয়েছি, তাদের বেশিরভাগকেই পৃথিবী বিদায় করে দিয়েছে, তাদের বিদায় করে বরণ করে নিয়েছে নতুন প্রজন্মকে।

গ্রামে এখন পাকা রাস্তা। বিদ্যুৎ চালিত ইজিবাইক আর ভ্যানে চড়ে সহজেই হাট-বাজার বা অন্য কোথাও যাওয়া যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থার দারুণ উন্নতি হয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুৎ, বেশিরভাগ বাড়িতেই টেলিভিশন আর ডিশ লাইন, ব্রডব্যন্ড ইন্টারনেটও চলে এসেছে। নাগরিক সব সুবিধা গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে, এটা খুব ভালো ব্যাপার। উপজেলা পর্যায়ে যথেষ্ট পরিমাণ কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে পারলে অনেক মানুষ নিজের গ্রামেই থেকে যাবে, বড় বড় শহরগুলোতে মানুষের চাপ কমবে।

গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলেছে, অনেক বাড়িতেই বিল্ডিং এবং ওয়াল করা টিনের ঘর। বিশ বছর আগেও যে-সব পরিবারের পক্ষে তিনবেলার ভাত জোটাতে কষ্ট হতো, পরিবারের কাউকে কাউকে হয়ত একবেলা ভাত না খেয়ে কিংবা আধপেট খেয়ে থাকতে হতো, তারাও এখন বেশ স্বচ্ছন্দে আছে, দেখে ভালো লাগলো আমার। যার জমিজমা নেই, সেও কোনো কাজ করে দিন এনে দিন খাচ্ছে, কিন্তু আগের মতো একবেলা ভাত না খেয়ে বা আধপেটা হয়ে থাকতে হচ্ছে না কাউকে। গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখে আমি যতটা আনন্দিত হলাম, মানবিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় দেখে ততটাই আহত হলাম। মানুষে মানুষে বিভেদ, রেষারেষি। মারামারির ঘটনাও বিরল নয়। কোথাও গান-বাজনার চর্চা নেই, বই পড়ার চর্চা নেই, কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই, এমনকি খেলাধুলাও নেই। আগে গ্রামে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতি চর্চার মধ্যমণি ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা, নিন্মবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও অংশগ্রহণ করত। এখন মধ্যবিত্ত-নিন্মবিত্ত কোনো শ্রেণির মধ্যেই ক্রীড়া ও সংস্কৃতির চর্চা নেই!

গ্রামের মাঝখানে তিন রাস্তার মোড়ের বটগাছতলায় কয়েকটা চা আর সিঙ্গা-পুরির দোকান আছে, বিকেল হলে কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, নানা বয়সের মানুষ সেখানে জমা হয়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, মধ্যবিত্ত-নিন্মবিত্ত সব শেণির মানুষই আসে। সারা গ্রামের কোথায় কী হলো, কার কী হলো, কে কী করল, সব খবর পাওয়া যায় এখান থেকে। পরচর্চা-পরনিন্দা হয়, গজব ছড়ায়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের স্ক্যান্ডাল, ক্রিকেট, টিকটকারদের জোকারিপনা, ভারতীয় ধনকুবের অনিল আম্বানী কত টাকার মালিক কিংবা অনিল আম্বানীর স্ত্রী নীতা আম্বানী কত লক্ষ টাকা দামের কাপে চা খান ইত্যাদি আলোচনায় মশগুল থাকে।

অল্প বয়সীরা এসবে অংশ নেওয়া ছাড়াও ফাঁকে ফাঁকে মোবাইলে গেমস খেলে, টিকটক দেখে। সময় উড়িয়ে দেয় সিগারেটের ধোঁয়ার মতো! বিশ-বাইশ বছরের ঊর্দ্ধে যাদের বয়স, তারা কিছুদূর অন্তর অন্তর পাটি পেতে কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে তাস খেলে। যৌবনের কী নিদারুণ অপচয়! বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সরগরম থাকে এই এলাকাটুকু।

সন্ধ্যার পর গ্রামের রাস্তায় হাঁটলে আশপাশ থেকে গাঁজার গন্ধ ভেসে আসে নাকে। ফেনসিডিল-ইয়াবাও নাকি ঢুকে পড়েছে গ্রামে। মধ্যব্ত্তি পরিবারের শিক্ষিত বেশ কিছু ছেলে অনলাইনে জুয়া খেলে এরই মধ্যে তিন-চার লক্ষ টাকা হেরেছে। অথচ আগে গ্রামে খেলাধুলার চল ছিল, গান-বাজনার চর্চা ছিল, বই পড়ার চর্চা ছিল। যাত্রাপালা, বাউলগান, অষ্টক গান হতো। গ্রামের মানুষেরা যাত্রাপালায় অভিনয় করত, শুধু নায়িকা ভাড়া করে আনত। একটা অষ্টক গানের দলও ছিল। ফুটবল আর হাডুডু খেলায় আশপাশের দশ-বিশ গ্রামের মধ্যে দারুণ সুনাম ছিল আমাদের গ্রামের। পরের দিকে ক্রিকেট খেলার চলও হয়েছিল। এখন সে-সবের কিছুই নেই। আছে ওই সরগরম বটতলা। আর আছে দুটো মন্দির ও একটা মসজিদ। বছর বছর মন্দির-মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, গোলযোগ হয়, কমিটি বদল হয়। হিন্দুরা আড়ম্বরপূর্ণভাবে আয়োজন করে দূর্গাপূজা, কালিপূজা, নামযজ্ঞের। আর মুসলমানরা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ওয়াজ মাহফিলের পিছনে।

এই যে গ্রামে সাংস্কৃতিক চর্চা নেই, খেলাধুলা নেই, এর ফল কিন্তু পেতে শুরু করেছে মানুষ। পড়শিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তো আছেই, অধিকাংশ বাড়িতে ভাইদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব। জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব, টাকা-পয়সা নিয়ে দ্বন্দ্ব, আম-কাঠালের ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব। কোনো কোনো বাড়ির দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত, ভাইয়ে-ভাইয়ে মুখ দেখাদেখি নেই, বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে একজন আরেকজনকে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করে না। যে-বাড়িতে জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই, সেই বাড়িতেও আছে ভাইয়ে-ভাইয়ে কিংবা জা-দের মধ্যে নানা ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য। এক ভাইয়ের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, আরেক ভাইয়ের খারাপ, তা নিয়েও রেষারেষি, শীতল সম্পর্ক। এমন নয় যে দ্বন্দ্ব বা মামলা-মোকদ্দমা আগে ছিল না, কিন্তু এখন সেটার বিস্তার ভয়াবহ রকমের বেশি। আর মধ্যবিত্ত-নিন্মবিত্ত সবার মধ্যেই আশ্চর্য এক দম্ভ, কেউ কাউকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয় না। মুখে একরকম, কাজে ভিন্নরকম! আগে গ্রামে আমার বাবার মতো ধুরন্ধর দুই-চারজন মানুষ থাকত, যারা সারা গ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত। বাবার মতো দুই-চারজন মানুষের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল, তা এখন অধিকাংশ মানুষের মধ্যে দেখা যায়, সবাই মাতব্বর হতে চায়। আগে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলেও একজন শিক্ষিত-পণ্ডিত মানুষকে সবাই মান্য করত, সম্মান করত, তার কথার মূল্য দিতো। এখন যার অর্থ-সম্পদ নেই, তার কোনো মূল্যই নেই সমাজে, তা তিনি যত বড় পণ্ডিত বা গুণীজন হন না কেন! এই যে পণ্ডিত বা গুণীজনরা সমাজে অবহেলিত, যার ফলে জ্ঞান চর্চা, সংস্কৃতি চর্চা, পাণ্ডিত্যের প্রতি তরুণদের কোনো আগ্রহ নেই। গ্রামের শিক্ষিত মানুষের মুখেও কোনো মনীষী, জ্ঞানী-গুণীজনদের নাম, তাদের জীবন, কর্ম ইত্যাদির কথা শোনা যায় না।

আমার দাদার বড় ছেলে বিজয়ের পুত্র সুজয়, মানে আমার নাতি, সে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ে। ওর বিষয় হিসাব বিজ্ঞান। ওর সঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করে আমার নিজেরই লজ্জা লাগল। সুজয় পাঠ্য বইয়ের বাইরে কোনো সাহিত্য পড়েনি। পাঠ্যবইয়ে পড়া আর টেলিভিশন-খবরের কাগজে দেখা কয়েকজনের বাইরে আর কোনো কবি-কথাসাহিত্যিকের নাম জানে না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম জানে না, চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্ত্বিক ঘটককে চেনে না, চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের নামও শোনেনি। সুজয়ের সংগীতের রুচি আগে মাইক বাজিয়ে গ্রামে যারা ঝুড়িভাজা-আইসক্রিম বিক্রি করতে আসত, তাদের পর্যায়ের! দোষ কার, ওর নাকি গোটা সমাজ ব্যবস্থার? শিক্ষকদের কাজ-ই বা কী, যান্ত্রিক উপায়ে পাঠ্যবইয়ের পড়া মুখস্ত করিয়ে শুধু টাকা রোজগারের পথ দেখানো? অবশ্যই সমাজ ব্যবস্থাকে এই পর্যায়ে নামিয়ে আনার পিছনে বাংলাদেশের রাজনীতির ন্যাক্কারজনক ভূমিকা রয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দায়-ও কম নয়।

জ্ঞান যেখানে মূল্যহীন, সেখানে জ্ঞানচর্চার প্রশ্নই আসে না। গ্রামের মানুষেরা ছুটছে টাকার পিছনে। সমাজে যার টাকা হচ্ছে, সে-ই নিজেকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মনে করছে, তাতে তার শিক্ষা-সংস্কৃতি থাকুক বা না থাকুক। টাকা কোন পথে রোজগার করছে, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। টাকা রোজগারই মূখ্য বিষয়, টাকা থাকা মানে নিজের অবস্থানের শ্রীবৃদ্ধি হয়ে সম্মানের আসনে আসীন হওয়া! গ্রামের মন্দির কিংবা মসজিদে কিছু টাকা বা দশ বস্তা সিমেন্ট কিনে দিলেই সম্মানের আসন আরও পাকাপোক্ত! অবশ্য এটা এখন শুধুমাত্র আমাদের গ্রামের চিত্র নয়, সারা বাংলাদেশের চিত্রটাই এখন এমন! তবু নিজের গ্রামের এই অবনতি আমাকে ভীষণ পীড়া দিলো। বাড়িতে দিন পাঁচেক থেকে এইসব দেখে-শুনে আমি আরও হাঁফিয়ে উঠলাম! যেদিন ঢাকায় ফিরব বলে ঠিক করলাম, তার আগের রাতে মনে হলো এখান থেকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গেলে কেমন হয়? অনেকবার কক্সবাজার গেলেও কুয়াকাটা কখনো যাওয়া হয়নি। ফেরার সময় আর এদিক দিয়ে বাসে না এসে, লঞ্চে ঢাকায় যাওয়া যাবে। যা ভাবা, তাই-ই কাজ। পরদিন সকালেই জুঁইকে নিয়ে রওনা দিলাম কুয়াকাটার উদ্দেশে।



(চলবে..)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:৩৮

শায়মা বলেছেন: যাক তপতী মরে যাবার পরেও তার গুনগুলি জানা হলো।

১৩ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ১২:০৭

মিশু মিলন বলেছেন: হুম। ধন্যবাদ।

২| ১৩ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:১৮

রাজীব নুর বলেছেন: তপতী মৃত্যুর পরও হারিয়ে যায়নি। তার সৃতি ফিরে ফিরে আসছে।

৩| ১৩ ই আগস্ট, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩৫

মিশু মিলন বলেছেন: হ্যাঁ, মৃত মানুষের স্মৃতি আপনজনদের কাছে ফিরে ফিরে আসে, তারা যতদিন বেঁচে থাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.