নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
পনেরো
প্রথম সপ্তাহে চারটে ভিডিও আপলোড করা হলো আমাদের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেইসবুক পেইজে। প্রথমটা পরান বাউলের গান, দ্বিতীয়টা আয়েশা বেগমের হাঁসের মাংস রান্না, তৃতীয়টা বেণুদির গাওয়া একটা রবীন্দ্র সংগীত এবং চতুর্থটা আলপনার গাওয়া অতুল প্রসাদের গান। ফেইসবুক-ইউটিউব দুই মাধ্যমেই প্রচুর ভিউ হলো ভিডিওগুলোর। সবচেয়ে বেশি ভিউ হলো পরান বাউলের গানের, তারপরেই আয়েশা বেগমের হাঁসের মাংস রান্নার ভিডিওটির। প্রত্যেকটি ভিডিও’র নিচে অনেক দর্শক-শ্রোতা মন্তব্য করলেন, বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধদের নিয়ে এমন উদ্যোগের প্রশংসা করলেন দর্শকরা। যাকে বলে একেবারে ভাইরাল, তেমন না হলেও প্রচুর শেয়ার হলো ভিডিওগুলোর। কানাডা থেকে ভিডিও দেখে আমার মেয়ে বিতস্তা আমাকে ভিডিও কল করল, ‘বাবা, তুমি কেমন আছো?’
বললাম, ‘ভালো আছি মা। তোরা কেমন আছিস, জামাই আর দাদুভাইরা ভালো আছে তো?’
‘হ্যাঁ, আমরা সবাই ভালো আছি। তোমার শরীর ঠিক আছে তো বাবা?’
‘হ্যাঁ, শরীর একদম ঠিক আছে।’
‘তোমাদের ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওগুলো দেখলাম। রান্নার ভিডিওটায় তোমার উপস্থাপনা খুব ভালো হয়েছে, তোমাকে দেখতেও সুন্দর লাগছিল।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ মা।’
‘বাবা, তুমি তো ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারো। আবৃত্তির ভিডিও দিও তুমি।’
‘দেব দেব। সবে আমাদের চ্যানেলের যাত্রা শুরু হলো। আমাদের অনেক পরিকল্পনা আছে, আরও অনেক ভিডিও দেব।’
‘আই লাভ ইউ বাবা, আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ। বাট স্যরি…।’ কেঁদে ফেলল বিতস্তা।
সন্তানদের কান্না আমাকে বিচলিত করে, নিজেকে অপরাধী মনে হয়, মনে হয় ওদের কান্নার জন্য আমি-ই দায়ী। ওদের ছোটবেলায় তপতী ওদেরকে মারলে বা রাগ করলে ওরা যখন কাঁদত, আমারও চোখ ভিজে উঠত। মনে হতো আমার সন্তানরা কাঁদবে কেন, ওদের তো কাঁদার জন্য জন্ম হয়নি, ওরা শুধু আনন্দ করবে, হাসি-আনন্দে থাকবে। বিতস্তা এসএসসিতে আশানুরূপ রেজাল্ট করতে না পেরে খুব কেঁদেছিল, ওর মা ওকে সান্ত্বনা দেবার পরিবর্তে উল্টো গজগজ করছিল, ওকে কটু কথা শোনাচ্ছিল। আমি তপতীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলাম, ‘তুমি যদি ওর রেজাল্ট নিয়ে আর একটা কথা বলো, আমি মেয়েকে নিয়ে এখনই বাসা থেকে বেরিয়ে যাব, আর ফিরবো না।’
এই কথায় কাজ হয়েছিল, তপতীর মুখ বন্ধ হয়েছিল। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে বা আশানুরূপ না হলে ছেলেমেয়েরা এমনিতেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। অনেকে আত্মহত্যাও করে। বড়দের কটু কথা ওদেরকে আরও ট্রমার দিকে ঠেলে দেয়, আত্মহননের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
আমি ভয় পেয়েছিলাম যে বিতস্তাও ওর মায়ের ওপর অভিমান করে তেমন কিছু করে বসে কি না। কান্নারত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আমি সারাটা বিকেল-সন্ধ্যা বসে ছিলাম। ওকে বলেছিলাম, ‘মা, তুই যে রেজাল্ট করেছিস, আমি তাতেই খুশি হয়েছি। তুই হয়ত আরও ভালো রেজাল্ট আশা করেছিলি, কিন্তু রেজাল্ট আশানুরূপ হয়নি বলে তোর জীবন এখানেই থেমে থাকবে না। একাডেমিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে না পারলেও মানুষের জীবনে ভালো কিছু করার অনেক সুযোগ আছে। এমনকি যারা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেনি বা লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি, চাইলে তারাও অনেক কিছু করতে পারে জীবনে। আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি কখনো একাডেমিক পরীক্ষায় বসেননি, স্কুলে পাঠিয়েও তাকে দিয়ে একাডেমিক লেখাপড়া করানো যায়নি। কিন্তু তিনি কি ভালো কাজ করেননি? করেছেন। তার সৃষ্টি অমর হয়ে আছে। কাজী নজরুল ইসলাম মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দেন, তাতে তার সাহিত্য-সংগীত সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়নি। তোকে আরেকজন ইন্টারেস্টিং মানুষের কথা বলি- যুক্তরাজ্যের সমুদ্র উপকূলের লাইম রেজিস নামক স্থানে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন ম্যারি অ্যানিং নামের একটি মেয়ে। তার বাবা আসবাবপত্র বানিয়ে বিক্রি করতেন আর সমুদ্রের শামুক-ঝিনুক এবং নানা প্রকার জীবাশ্ম কুড়িয়ে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতেন। ম্যারি অ্যানিংও শামুক, ঝিনুক আর জীবাশ্ম কুড়োতেন। দারিদ্রতার কারণে স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি তিনি, কিন্তু লিখতে-পড়তে পারতেন। তার বয়স যখন বারো বছর, তখন তিনি এবং তার ভাই জোসেফ জীবাশ্ম খুঁজতে গিয়ে বড় আকৃতির খুলির মতো কিছু একটা দেখতে পান। ম্যারি অ্যানিং মাটি খুঁড়তে থাকেন, খুঁড়তে খুঁড়তে দেখতে পান যে সেটা বিশাল আকৃতির একটি প্রাণির কঙ্কাল। এই আবিষ্কারের ফলে ম্যারি অ্যানিংয়ের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় কঙ্কালটি একটি সামুদ্রিক সরীসৃপের, যা প্রায় বিশ কোটি বছর আগের। কঙ্কালটির নাম দেওয়া হয়- ইকথিওসরাস। এই ঘটনার পর জীবাশ্ম আবিষ্কারের নেশায় পেয়ে বসে ম্যারি অ্যানিংকে। তিনি নিজে নিজেই ভূতত্ত্ববিদ্যা বিষয়ে লেখাপড়া করে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলেন, জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা করেন এবং জীবাশ্মবিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো কোনা জীবাশ্মবিজ্ঞানী তাকে অবহেলা-উপেক্ষা করতেন। কিন্তু ম্যারি অ্যানিং দমে যাবার মানুষ ছিলেন না, তিনি তার কাজ চালিয়ে গেছেন। পরবর্তীকালে তিনি প্লেসিওসরাসের সম্পূর্ণ কঙ্কাল আবিষ্কার করেন, যেটা ছিল আবিষ্কৃত হওয়া প্রথম প্লেসিওসরাস। এরপর সর্বপ্রথম পাখাযুক্ত ডায়নোসর আবিষ্কার করেন, যার নাম-টেরোডাক্টাইল। আরও অনেক জীবাশ্ম তিনি আবিষ্কার করেন। তার আবিষ্কৃত জীবাশ্মগুলো বর্তমানে লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। মানুষের জীবনে ইচ্ছাশক্তি থাকাটাই বড় কথা, কিছু করার জন্য কারো ভেতর অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনো বাধাই তাকে আটকে রাখতে পারে না। তাই বলে আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করতে বলছি না, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পেলে সেটা অবশ্যই ভালো। কিন্তু সুযোগ না পেলেও জীবনে ভালো কিছু করার অনেক রাস্তা খোলা থাকে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন- “পড়ালেখাকে কখনো দায়িত্ব হিসাবে দেখো না বরং এটাকে কোনো কিছু শেখার একটা সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করো।” তোর রেজাল্ট হয়ত আশানুরূপ হয়নি, কিন্তু শেখার রাস্তা তো বন্ধ হয়ে যায়নি। জীবনের ভালো-মন্দ সবকিছু থেকে শিক্ষা নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হয়।’
বিতস্তা পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, ভালো রেজাল্ট করেছে, এখন চাকরিও করছে। ওর কান্না দেখে আমিও কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম, কিন্তু তা ওকে বুঝতে দিলাম না। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘কাঁদিস না মা। তোদের কান্না আমি সহ্য করতে পারি না।’
‘বাবা, তোমার তিন সন্তান থাকতেও তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হচ্ছে। আই অ্যাম রিয়্যালি স্যরি বাবা।’
‘পাগলী কোথাকার, তাতে কী হয়েছে! এর জন্য আমি তোদের কাউকে তো দোষ দিচ্ছি না, জীবনের বাস্তবতা আমি বুঝি। আমাকেও তো আমার বাবা-মাকে গ্রামে রেখে শহরে এসে লেখাপড়া করতে হয়েছে, জীবিকার জন্য চাকরি করতে হয়েছে। আর আমি এখানে খুব ভালো আছি।’
‘তবুও, আমরা থাকতে তুমি বৃদ্ধাশ্রমে থাকছ, এটা মেনে নেওয়া কষ্টের! জানো তো, তোমার জামাই একটু অন্যরকম, নইলে আমি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতাম।’
‘আমি তা বুঝি রে মা। তুই আমাকে নিয়ে একদম ভাবিসনে। আমি এখানে খুব ভালো আছি, আনন্দচিত্তে আছি। এখানকার কর্মীরা আমাদের খুব সেবাযত্ন করে। তাছাড়া এখানে কথা বলার মতো অনেক মানুষ আছে। তুই নিজেকে অপরাধী ভাবিস না মা।’
মেয়ের সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। আমি জানি আমার মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসে, ওর পক্ষে সম্ভব হলে আমাকে নিজের কাছে নিয়ে যেত।
আমি সন্তানদেরকে না জানিয়েই বৃদ্ধাশ্রমে এসেছি। এখানে আসার বেশ কিছুদিন পর যখন বুঝলাম যে এখানে আমার মানিয়ে নিতে কোনো অসুবিধা হবে না, তখন ফোন করে সন্তানদেরকে জানিয়েছি। আমি বাসা ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে এসেছি শুনে বিতস্তার মন খারাপ হয়েছিল। অমিয় আর অমিত জানিয়েছিল যে আমি যেখানে কমফোর্ট ফিল করি, সেখানেই থাকতে পারি, ওদের কোনো আপত্তি নেই।
আমি ঘরে বসে সন্তানদের কথা ভাবছিলাম। বাঁধন এসে বলল, ‘কাকু, লক্ষ্মী খালা এখন আচার বানাবেন, উপস্থাপনার জন্য আপনি তৈরি হয়ে নিন। আর বিকেলে কিন্তু আপনার আবৃত্তির ভিডিও করবো।’
বললাম, ‘আমাকে দুটো মিনিট সময় দে বাবা। আমি কী পরবো বলতো?’
বাঁধন আলনার দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে বলল, ‘আকাশী রঙের শার্টটা পরুন এখন। আর কবিতা আবৃত্তির জন্য বাসন্তী রঙের ওই পাঞ্জাবীর ওপর ঘিয়ে রঙের কটিটা পরে নেবেন।’
‘বেশ। তুই সব রেডি কর, আমি আসছি।’
বাঁধন চলে গেলে আমি পোশাক পরতে পরতে ভাবছিলাম যে আচার তৈরির ভিডিওতে কী কথা দিয়ে শুরু করব। লক্ষ্মী খাতুন ভীষণ উদার একজন নারী। বয়স ষাট-বাষট্টি। তিনি তার পেনশনের টাকায় বছরের বিভিন্ন সময়ে কাঁচা আম, তেঁতুল, বরই, জলপাই, আমলকী, চালতা ইত্যাদি ফল এবং গুড় আর মশলাপাতি কিনে আচার তৈরি করে কাঁচের বয়ামে ভরে ডাইনিংরুমের মিটসেলফে রেখে দেন সবার জন্য। আমাদের যার যখন খুশি ওখান থেকে আচার নিয়ে খাই। তার ঘরেও আচারের বয়াম সাজানো থাকে। আমরা গোধূলিবাড়ির সদস্যরা বারোমাস নানা রকম সুস্বাদু আচারের স্বাদে ডুবে থাকি।
লক্ষ্মী খাতুনের নাম শুনে অনেকে অবাক হয়। আমিও ভেবেছিলাম লক্ষ্মী খাতুন বুঝি হিন্দু ছিলেন, ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন আর লক্ষ্মী নামের সঙ্গে খাতুন যোগ করেছেন। কিন্তু তা নয়, জন্মসূত্রেই তিনি মুসলমান। তার পিতা বেলায়েত হোসেন কাজ করতেন একটি হিন্দু গৃহস্থবাড়িতে, সেই বাড়িতে বারোমাস নানা পূজা-পার্বন হতো, কোজাগরি পূর্ণিমায় লক্ষ্মী প্রতিমা গড়িয়ে খুব আয়োজন করে পূজা করতেন তারা। অনেক মানুষের সমাগম হতো। লক্ষ্মী দেবীর মূর্তি বেলায়েত হোসনের ভালো লাগত। তাছাড়া হিন্দু বাড়িতে কাজ করার সুবাদে তিনি জেনেছিলেন যে দেবী লক্ষ্মী হচ্ছেন ধন-সম্পদের দেবী। শান্ত-সুবোধ কোনো মেয়েকে দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। একারণেই বেলায়েত হোসেনের প্রথম সন্তান কন্যা হলে তিনি নাম রাখেন লক্ষ্মী খাতুন। মেয়ের নাম লক্ষ্মী রাখার কারণে তার সমাজের অনেকেই তাকে কটু কথা বলত, হাসাহাসি করত। লক্ষ্মীকেও স্কুল-কলেজ জীবনে মুসলমান মেয়েদের থেকে অনেক কটুক্তি শুনতে হয়েছে।
সাধারণত আজকালকার দিনে হিন্দুদের দেবদেবীর নামে কোনো বাঙালি মুসলমান সন্তানের নাম রাখা হয় না। এমনকি বাংলা নামও রাখা হয় খুব নগন্য সংখ্যক মুসলমান সন্তানদের। আবার কেউ কেউ সন্তানের নাম কাগজে-কলমে আরবীতে রাখে আর একটা ডাক নাম রাখে বাংলায়। কিন্তু একটা সময় মুসলমানরাও তাদের সন্তানদের নাম বাংলায় তো বটেই, এমনকি দেবদেবীর নামেও রাখত। ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হলেও বাঙালির নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। এমনকি লক্ষ্মীপূজা, মনসাপূজা, শীতলাপূজা, গাসসি ইত্যাদি পূজাপার্বণও করত। নারীরাও সাজগোজ করত, পায়ে আলতা পরত, কপালে টিপ পরত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে হাজী শরীয়তুল্লাহ মক্কা থেকে ফেরার পর বাঙালির এসব নিজস্ব আচার অনুষ্ঠানকে শিরক আখ্যা দিয়ে ফরায়েজী আন্দোলন গড়ে তোলেন। মুসলমান সমাজ সংস্কারের নামে তিনি মুসলমানদেরকে পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি থেকে মূলোৎপাটন করেন। যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে ভাষাগত, চিন্তাগত, আচরণগত বেশ পরিবর্তন হয়। এমনকি মুসলমানদের খাদ্যসংস্কৃতিও বদলে যায় যায়। আমার স্কুল-কলেজের বন্ধুরা দূর্গাপূজা-লক্ষ্মীপূজার সময় আমার কাছে নাড়ু, খই, শিঙা, মোয়া, লুচি ইত্যাদি ধরনের খাদ্যদ্রব্য খাবার জন্য আবদার করত। কারণ ওদের বাড়িতে এসব তৈরি হতো না। মানে ওদের মা-চাচীরা এসব তৈরি করতে পারতেন না। নিরামিষ, সুক্ত, পায়েস জাতীয় খাবারও রান্না করতে পারতেন না। আমার ছেলেমেয়েদের কাছেও ওদের বন্ধুরা এসব খাবার খেতে চাইত। হাজী শরীয়তুল্লাহ নাড়ু, খই, মোয়া, পায়েসের মধ্যেও শিরক দেখতে পেয়েছিলেন! শিরক আখ্যা দিয়ে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি থেকে, নিজের পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি থেকে মুসলমানদের দূরে সরিয়ে দিয়ে তিনি তাদের ওপর আরব্য সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছিলেন ফরায়েজী আন্দোলনের মাধ্যমে। তার মৃত্যুর পর ফরায়েজী আন্দোলন এগিয়ে নেয় তারই পুত্র দুদুমিয়া। আজকের সমাজের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে এত বিভেদ, এত ঘৃণা, এত সাংস্কৃতিক পার্থক্য, ভাষাগত পার্থক্য, আচরণগত পার্থক্য, এর অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে হাজী শরীয়তুল্লাহ’র উগ্রবাদী-সাম্প্রদায়িক ফরায়েজী আন্দোলন।
অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হয়েও ইন্দোনেশিয়া কী সুন্দরভাবে লালন করে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। ভারতীয় পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের ভাস্কর্য শোভা পায় তাদের দেশের পথে-ঘাটে। জাভায় অনেক মুসলমান ভাস্কর আছেন, যারা এসব ভাস্কর্য তৈরি করেন। জাভা দ্বীপের হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান ও বৌদ্ধ মন্দির বরোবুদুরসহ অনেক মন্দির তারা যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করে রেখেছে। লক্ষ লক্ষ পর্যটক জাভায় যায় মন্দিরগুলো দেখতে। বিষ্ণুর বাহন গড়ুরপাখির নামে তাদের বিমানের নাম রেখেছে- ‘গড়ুর’। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসে ভাস্কর উইলিয়াম পেরির তৈরি দেবী সরস্বতীর চমৎকার একটি ভাস্কর্য রয়েছে। আজও ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় গ্রন্থ- রামায়ণ। তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় এবং পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের নামে সন্তানদের নাম রাখতে লজ্জাবোধ করে না। কারো প্ররোচনায় তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও খাদ্য ত্যাগ করেনি।
ইন্দোনেশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে কিন্তু তারা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ত্যাগ করেনি। তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তাদের কাছে লজ্জার ও ঘৃণার নয়, বরং গৌরবের! ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিহীন জাতি উন্মুল গাছের মতো! কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানের কাছে তার শিকড়, তার ঐতিহ্য, তার সংস্কৃতি, সবই লজ্জার এবং ঘৃণার! অনেকে নিজেকে বাঙালি বলেও স্বীকার করেন না, নিজেকে কেবলই একজন মুসলমান মনে করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধী, রাজাকার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত আসামী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ওয়াজ মাহফিলে প্রচার করে বেড়াতেন বাংলাদেশের মুসলমানরা বাঙালি নন, শুধুই মুসলমান। তার লক্ষ লক্ষ ভক্ত এবং অনুসারীরা তাই বিশ্বাস করতেন, এখনও করেন।
দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর আগেও আরও অনেকে এই মতবাদ প্রচার করতেন এবং লক্ষ লক্ষ মুসলমান নিজেদের বাঙালি জাতিসত্ত্বা অস্বীকার করতেন। এখনও অনেক মুসলমান আত্মপরিচেয়ের সংকটে ভোগেন।
লক্ষ্মী খাতুন টক-মিষ্টি-ঝাল এবং টক-ঝাল আমের আচার বানালেন। আমি উপস্থাপন করলাম। চেখে দেখলাম, দারুণ সুস্বাদু আচার। লক্ষ্মী খাতুনের আম কাটা থেকে শুরু করে আচারের জন্য প্রস্তুত করা, সবটার ভিডিও করে রেখেছিলেন ইয়াসিন শেখ, সেই ভিডিও এবং এখনকার আচার তৈরির ভিডিও সম্পাদনা করে টক-মিষ্টি-ঝাল পর্বটি আগামীকাল ইউটিউব ও ফেইসবুকে আপলোড করবে বাঁধন। লক্ষ্মী খাতুন আম দিয়েই অন্তত দশ প্রকার আচার তৈরি করতে পারেন। প্রত্যেক প্রকার আচার তৈরির ভিডিও ধারণ করে আলাদা পর্ব করে ইউটিউবে ছাড়া হবে।
বিকেলে কবিতা আবৃত্তির জন্য প্রস্তুত হলাম আমি। বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী, ঘিয়ে রঙের কটি, আর বাদামী রঙের প্যান্ট পরলাম। একটু পরেই বাঁধন পুকুরপাড়ে আমার কবিতা আবৃত্তির ভিডিও ধারণ করবে বলেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে এগোতেই দেখলাম রোজকার মতোই বেঞ্চে বসে উল-কাঁটা দিয়ে কিছু একটা বুনছেন আলপনা।
আমি বেঞ্চে বসতেই আলপনা বললেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ।’
হঠাৎ ধন্যবাদের কারণ বুঝতে না পেরে বললাম, ‘ধন্যবাদ পাবার মতো তো কিছু করিনি!’
‘করেছেন।’
জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম, ‘কী?’
‘আমি মৃতপ্রায় এক জীবন বয়ে বেড়াচ্ছিলাম, আপনি আমাকে জীবনের স্রোতে ফিরিয়েছেন।’
‘কেমন করে?’
‘সেদিন আপনি আমার গান গাওয়ার কথা বেণুদিকে না বললে আমার আর হারমনিয়াম ধরা হতো না। এখানে আসার পরও আমি মনমরা হয়ে থাকতাম। কিন্তু হারমনিয়াম নিয়ে বসার পর থেকে আমি যেন আবার আমার বিয়ের আগের জীবনে ফিরে গেছি! ভেতরটা কিশোরীর মনের মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে!’
‘শুনে খুশি হলাম যে আপনি জীবনের স্রোতে ফিরেছেন। শুনুন, আমরা এখন যে কটা দিন বাঁচি, পিছন পানে না চেয়ে, সামনে তাকিয়ে আনন্দে বাঁচা উচিত।’
‘সত্যি, অনেককাল পর আমি জীবন উপভোগ করছি।’
‘এটাই জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, জীবন উপভোগ করা, আনন্দে বাঁচা। আমি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- জীবনের অপ্রাপ্তি নিয়ে দুঃখ করে কোনো লাভ নেই, দুঃখ করা একেবারেই অর্থহীন এবং নির্বুদ্ধিতার কাজ, পরাজয়ের নিশান হাতে দুঃখ আসে মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গ্রাস করতে। তাই যে-কোনো উপায়েই হোক দুঃখকে জয় করার চেষ্টা করতে হবে, তাহলেই জীবন উপভোগ্য হয়ে উঠবে।’
‘আমি বোধহয় একটু একটু করে দুঃখ জয় করতে পারছি।’
‘দারুণ ব্যাপার! আপনাকে স্বাগত জানাই।’
আলপনা মৃদু হাসলেন। কয়েক পলকের নীরবতা শেষে আমি বললাম, ‘আপনার গানের অনেক ভিউ হয়েছে, অনেকে মন্তব্য করেছে, দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি। গানের ভিডিও দেখে গত কয়েকদিনে আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন ফোন করেছে।’
‘বাহ! এইতো জীবনের পাওয়া, এইতো জীবনের আনন্দ!’
‘জানেন, ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম রেডিওতে গান গাওয়ার। তারপর একটু বড় হয়ে টিভিতে গান গাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। সে-সব স্বপ্নের কিছুই পূরণ হয়নি।’
‘একদম আফসোস করবেন না। রেডিও-টিভির দিন শেষ! এখন ইউটিউবের দিন। আপনার ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে আরো আধুনিক মাধ্যমে। এজন্যই মানুষের কখনোই স্বপ্ন দেখা ছাড়তে নেই, আমৃত্যু স্বপ্ন দেখতে হয়।’
আলপনা মৃদু হেসে বললেন, ‘সত্যিই আমরা এক আশ্চর্য যুগে এসে পড়েছি। আমাদের যৌবনে এসব আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না।’
বললাম, ‘আশ্চর্য যুগই বটে। তবু আমরা খুবই ভাগ্যবান যে জীবনের শেষলগ্নে এসে হলেও এসব দেখতে পেলাম।’
আমরা ইউটিউব-ফেইসবুকের ভিউ আর পাঠকের মন্তব্য নিয়ে কথা বলছিলাম। কিছুক্ষণ পরই ক্যামেরা হাতে বাঁধন চলে এলো, সঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমের কর্মী হাসান। বলল, ‘কাকু আপনি রেডি?’
‘হ্যাঁ, আমি রেডি। এখানেই ভিডিও ধারণ করবি?’
‘না, নৌকায় চলুন। আলপনা মাসিমা আপনিও চলুন না প্লিজ, কাকু যে কবিতাটা আবৃত্তি করবেন, তার সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে অতুল প্রসাদের ‘‘সবারে বাস রে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে’’ গানটির হামিং দিতে পারলে খুব ভালো হবে।’
আলপনা মৃদু হেসে বললেন, ‘বেশ চলো।’
আমরা সবাই পুকুরের ঢাল বেয়ে নেমে ডিঙ্গি নৌকায় উঠলাম। হালে বসল হাসান। আমি হাসানের থেকে কিছুটা সামনে বসলাম। বাঁধন ট্রাইপডের ওপর ক্যামেরা বসিয়ে আমার দিকে তাক করল। আলপনা বসলেন ক্যামেরার পিছনে, তিনি আড়ালে থেকে হামিং দেবেন। তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, বিকেলের ক্লান্ত রোদ ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছে। বাঁধন ইঙ্গিত দিতেই আলপনা হামিং দিতে আরম্ভ করলেন। তারপর আমি একজন তরুণ কবির ‘মানুষ’ কবিতাটি আবৃত্তি শুরু করলাম-
মানুষ কি কেবলই মানুষ হবে? কিছুটা পাখি হ’লে ক্ষতি কী!
খড়-কুটোয় ঘর বেঁধেও পাখিরা স্বপ্ন দ্যাখে আকাশ ছোঁয়ার
ওদের স্বপ্নগুলো মানুষের স্বপ্নের মতো কংক্রিটে গাঁথা নয়,
ওদের আকাশটাও মানুষের আকাশের মতো ধাতু মোড়ানো নয়।
ওরা স্বপ্ন দ্যাখে, স্বপ্ন ছোঁয়, আকাশ ছোঁয় দু-ডানায় ভর রেখে
মানুষও আকাশ ছোঁয়- মানুষের পাঁজরের ওপর দাঁড়িয়ে!
মানুষ কি কেবলই মানুষ হবে? কিছুটা বাতাস হ’লে ক্ষতি কী!
বাতাসের নেই বর্ণবিদ্বেষ, তাই অসংকোচে হয়-
কালো মেঘ-সাদা মেঘের সারথী।
হিমালয়ের শরীর থেকে লোকালয়ে নিয়ে আসে স্বস্তির শীতলতা,
গরমের দুপুরে দক্ষিণের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে
রোদে পোড়া শরীরের ঘাম
কেমন চুমোয় চুমোয় শুষে নেয়!
মানুষ কি কেবলই মানুষ হবে? কিছুটা নদী হ’লে ক্ষতি কী!
পদ্মা না হোক, যমুনা না হোক
হোক ক্ষীণকায়া চন্দনা নদী।
জনপদের ভাগ্য বদলাবার সামর্থ্য নাইবা থাকল চন্দনার
দিনান্তে কিছু খেটে খাওয়া মানুষের উদোম শরীরে
প্রশান্তি তো দিতে পারে।
মানুষ কি কেবলই মানুষ হবে? কিছুটা পাহাড় হ’লে ক্ষতি কী
হিমালয় কিংবা কাঞ্চনজঙ্ঘা না হোক
হোক অন্তত অনুচ্চ গারো পাহাড়।
উচ্চতার গৌরব নাইবা থাকলো গারো পাহাড়ের
অজস্র প্রাণের আলয় হবার মমতা তো থাকে বুকে।
মানুষ কি কেবলই মানুষ হবে? কিছুটা বৃক্ষ হ’লে ক্ষতি কী!
বট-অশ্বথ না হোক, হিজল-শিরীষ বা অর্জুন-সেগুন না হোক
হোক একটা ভাঁট কিংবা আসশ্যাওড়ার গাছ
একটা মাকড়সা অন্তত জাল বুনে থাকুক।
মানুষ যদি কিছুটা পাখি হতো, কিছুটা বাতাস হতো
কিছুটা নদী, পাহাড় কিংবা বৃক্ষ হতো
তবে হয়ত মানুষের হৃদয়ে গ’ড়ে উঠত না
অজস্র হিংস্র প্রাণির বীভৎস অভয়ারণ্য।
(চলবে.......)
২২ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:১১
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
২| ২৩ শে আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৫:০১
রাজীব নুর বলেছেন: ইন্দোনেশিয়ার বিষয়টি এনে ভালো করেছেন।
২৩ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:২০
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২২ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:১৯
জ্যাক স্মিথ বলেছেন: সাজানো গোছানো পরিপাটি লেখা, সময় করে সবগুলো পর্ব একদিন পড়তে হবে।