নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- উনিশ)

২৪ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:৫৭

সতেরো

জাহানারা যেদিন আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল, তারপর তিনটে রাত আমি ভালোমতো ঘুমাতে পারিনি। অনবরত নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ চলেছে। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, জাহানারার ভালোবাসার ডাকে আমার সাড়া দেওয়া উচিত কি না? আমি জন্মেছি এবং বেড়ে উঠেছি গ্রামের মধ্যবিত্ত একটি পরিবারে, ফলে মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ দাড়িপাল্লা হাতে আমার সামনে দাঁড়ায় পাপপূণ্য নির্ণয় করতে! আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ আমাকে শিখিয়েছে- শিক্ষক হচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে পিতার মতো। শিক্ষকের পিতৃসুলভ সেই ইমেজ ভেঙে বেরিয়ে আমি আমার প্রাক্তন ছাত্রীর প্রেমিক হবো? ঘরে স্ত্রী থাকতেও জাহানারার সঙ্গে প্রেম করলে আমি কি চরিত্রহীন পুরুষ হয়ে যাব? সমাজের মানুষ জানতে পারলে আমায় থুথু দেবে? স্ত্রী-সন্তানেরা জানতে পারলে আমার দিক থেকে তারা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে? তিনটে দিন আমি খুব বিচলিত ছিলাম, ভীষণ অন্যমনস্ক ছিলাম, উদাসীন হয়ে বসে থাকতাম, সেটা তপতীও লক্ষ্য করেছিল। বলেছিল, ‘কী হয়েছে তোমার? কলেজে কোনো ঝামেলা?’

‘কলেজে তো নানা ঝামেলা আছেই, শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।’ মিথ্যে বলেছিলাম।

আসলে ততদিনে জাহানারার সঙ্গে আমি এতটাই জড়িয়ে পড়েছি, ওর সঙ্গ এতটাই উপভোগ করতে শুরু করেছি যে, ও আমার যাপিত জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। মনে মনে ওকে আমার জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেখলাম যে আমার জীবনের দক্ষিণের জানলাটা বন্ধ হয়ে গেল, দম বন্ধ লাগলো, একটু বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগলাম। বুঝলাম যে ওকে আমার জীবন থেকে বাদ দেওয়া কঠিন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ব্যবধান অতিক্রম করে কবে যেন আমরা হয়ে উঠেছি একে-অন্যের ভালো বন্ধু। তপতী আমার কাছে ছিল জানলাবিহীন বদ্ধ ঘর। আর জাহানারা ছিল দক্ষিণের খোলা জানলা, আমার জন্য আলো-হাওয়া নিয়ে আসত, বৃষ্টির ছাঁট আর পূর্ণিমার জ্যোৎস্না নিয়ে আসত, ষড়ঋতুর ফুলের গন্ধ নিয়ে আসত! আমার বেঁচে থাকা উপভোগ্য করে তুলেছিল জাহানারা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে এক কদম এগিয়ে এসে জাহানারা আমাকে ভালোবাসার কথা বলার পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কিংবা সেই বন্ধুত্বটুকু বজায় রেখে ওর সঙ্গে আর মেশা সম্ভব নয়, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। হয় ওর ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে আমাকে এক কদম এগিয়ে যেতে হবে, অথবা ওর কাছ থেকে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিতে হবে। কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজে তিনদিনের লড়াই শেষে আমি বুঝতে পারলাম যে ওর কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব, অসহায় হয়ে পড়ব, মানসিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাব। তপতী ছিল আমার বিবাহিত স্ত্রী, আমরা একই বাসায় থাকতাম, একই হাঁড়ির ভাত খেতাম, একই বিছানায় ঘুমাতাম, মাঝে মাঝে সঙ্গম করতাম। কিন্তু তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের রসায়ন ছিল একই পাত্রে রাখা তেল আর জলের মতো। সে সাংঘাতিক রকম গুছিয়ে সংসারও করতে পারত, তবে সেটা তার নিজের মতো করে, সেখানে অন্যের সুবিধা-অসুবিধা বা ভালোলাগা-মন্দলাগা ছিল তার কাছে গুরুত্বহীন। তাই সে কখনই আমার আশ্রয় হতে পারেনি। যে-কোনো সংকট কিংবা কষ্টে আমি তার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে নির্ভার থাকতে পারিনি। অথচ শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝেও জাহানারা আমার আশ্রয় হয়ে উঠেছিল, আমার সংকট কিংবা দুঃখ-কষ্ট হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতি। তাই জাহানারা আমার জীবনে নেই, এটা ভাবতেই নিজেকে আশ্রয়হীন অনাথ মনে হলো আমার। সকল দ্বিধা, মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ঝেড়ে ফেলে আমি জাহানারাকে ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আপনা-আপনিই আমার ভেতরে ওকে কেন্দ্র করে একটা নতুন স্বপ্ন তৈরি হলো, ওর প্রতি আরও দায়িত্ব পালনের দায় অনুভব করলাম আমি। যদিও ওর প্রাক্তন শিক্ষক হিসেবে কিছু দায়িত্ব আমি আগে থেকেই পালন করছিলাম।

সেই উদভ্রান্ত তিনটে দিন পর কলেজের ক্লাস শেষে আমি চারুকলায় গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করলাম। দুজনে রিক্সা নিয়ে চাঁনখার পুলে গেলাম ভাত খেতে। এমনিতে প্রায়ই দুপুরবেলা আমরা চাঁনখার পুলে হোটেলে ভাত খেতে যেতাম। জাহানারা যত্ন করে আমার পাতে নানা প্রকার ভর্তা আর ঝোল তুলে দিত, আমার ভীষণ ভালো লাগতো ওর এই যত্নটুকু। আর এদিন থেকে ভালোলাগা যেন অন্য মাত্রায় পৌঁছালো। ভাত খেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে আমরা গেলাম রমনায়। লেকের পাড়ের বেঞ্চে বসে গল্প করতে লাগলাম। তারপর একসময় আমি বললাম, ‘তুমি আমার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছ যে তোমাকে ছেড়ে থাকা আমার জন্য ভীষণ কষ্টকর।’

হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি জাহানারা।’

জাহানারা আমার হাতটা ধরল, মুখ টিপে হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলে আমার হাতটা ওর মুখে ঘষতে লাগল। আমি ওর দিকে সরে বসে ওকে আমার শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘পাগলী কোথাকার, কাঁদছ কেন?’

ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলাম। ও আমার মুখের দিকে চোখ তুলে বলল, ‘পাবার আনন্দে, আমি কী অমূল্য বৈভব পেয়েছি, তা কেবল আমি-ই জানি। আপনি বুঝবেন না!’
আমি ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললাম, ‘আর আপনি নয়, এখন থেকে তুমি।’
জাহানারা আমার কপালে কপাল রেখে কাঁদতেই লাগল।

সেদিনের পর থেকে আমার অবস্থা এমন হলো যে একটা দিনও জাহানারাকে না দেখে থাকতে পারতাম না। ক্লাস শেষ করে আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম টিএসসিতে। ও আগে থেকেই আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকত। তারপর ওখান থেকে কোনোদিন খেতে যেতাম চাঁনখার পুল, কোনোদিন রমনায় যেতাম, আবার কোনোদিন ওর সঙ্গে দেখা করেই সরাসরি বাসায় ফিরতাম। কখনো কখনো বিকেলে যেতাম, সারাটা বিকেল আর সন্ধ্যা ওর সঙ্গে কাটাতাম। যত ঝড়-বৃষ্টিই হোক, সারাদিনে একবার ওর মুখ দর্শন করা চাই-ই চাই। আমার ভেতরে যেন তখন কিশোরের আবেগ ভর করেছিল! এমনটা হওয়ার কারণ হয়ত এই ছিল যে তখনও পর্যন্ত আমি মা-মাসি-পিসি ব্যতিত অন্য কোনো নারীর প্রকৃত ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলাম! তাই হয়ত জাহানারার ভালোবাসা এক ধাক্কায় আমার বয়স কমিয়ে আমাকে বানিয়েছিল আবেগী কিশোর!

একদিন পার্কে বসে জাহানারা আমার কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘আমি যে পুরুষের ঔরসে জন্মেছি, পরিবারের যে-সব পুরুষদের মাঝে আমি বেড়ে উঠেছি, আমার পাড়ায় যে-সব পুরুষকে আমি দেখেছি, যে পুরুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল এবং শ্বশুরবাড়িতে আমি যে-সব পুরুষকে দেখেছি, তারা কেউ-ই আমার শ্রদ্ধা অর্জন করতে তো পারেইনি, বরং কাউকে কাউকে আমি তীব্র ঘৃণা করি। এদের কারণেই আমি পৃথিবীর সব পুরুষকে একই পাল্লায় মাপতাম, মনে মনে পুরুষদেরকে ঘৃণা করতাম। পুরুষ সম্পর্কে আমার মনোভাব বদলে দিয়েছ তুমি!’

জাহানারার মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমি খুশি যে হলাম না তা নয়, তবে কিছুটা অপরাধবোধও হলো এজন্য যে ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আমি প্রেম করছি আমারই প্রাক্তন ছাত্রীর সঙ্গে! আমি তপতীর সঙ্গে কথা বলে সুখ পেতাম না, উল্টো ওর খিটমিট স্বভাবের কারণে ওর থেকে পালিয়ে থাকতে চাইতাম। আমি ভীষণ একাকিত্ব আর বিষন্নতায় ভুগতাম। এই একাকিত্ব এবং বিষন্নতাই আমাকে ঠেলে দিয়েছিল জাহানারার দিকে। আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বলছি না, ঘরে স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোটা হয়ত আমার ভুল, হয়ত অন্যায়ও, কিন্তু দিন শেষে আমিও তো মানুষ, একটাই জীবন, সেই জীবনে আমারও তো একটু ভালোবাসা পেয়ে আনন্দে বাঁচার অধিকার আছে। জীবনসঙ্গী কেমন হবে সেই ব্যাপারে প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দ থাকে, সেই পছন্দ অনুযায়ী জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে পারিনি আমি। আমি যা পছন্দ করি, ঠিক তার উল্টো স্বভাবের স্ত্রী পেয়েছিলাম আমি। আর জাহানারার মধ্যে আমার পছন্দের প্রায় সব গুণাবলীই পেয়েছিলাম।

জাহানারা বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল, দ্বিতীয় বর্ষে উঠার পর আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে সে। আমি কখনো ছাত্র রাজনীতি করিনি, কোনো ধরনের রাজনীতিই করিনি, আমি সব সময় রাজনীতি থেকে দূরে থাকতাম। সত্যি বলতে কী আমি খুব বেশি রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলাম না। জাহানারার সঙ্গে প্রেম করার আগে রাজনীতির টুকটাক খোঁজখবর রাখলেও রাজনীতি নিয়ে আমার খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। রাজনীতির প্রতি আমার অনাগ্রহের কথা শুনে একদিন জাহানারা বলল, ‘যে-কোনো মানুষেরই রাজনীতি সচেতন হওয়া উচিত। তুমি শিক্ষক আর আমি শিল্পচর্চা করি, আমাদের তো আরো বেশি রাজনীতি সচেতন হওয়া উচিত। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, “মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই রাজনৈতিক প্রাণি।” রাজনীতিতে তোমার যতই অনাগ্রহ থাকুক, রাজনীতিকে তুমি যতই ঘৃণা কর না কেনা, তোমার জীবন কিন্তু রাজনীতির বাইরে নয়। তুমি প্রতিদিন যে পোশাক পরছো, পছন্দের যে জিনিসটি কিনছো, ভালো-মন্দ যা-ই খাচ্ছো, তার দাম কিন্তু নির্ধারিত হয় রাজনীতির মাধ্যমেই। মানুষের ভালো-মন্দ সবকিছুর নিয়ন্ত্রক রাজনীতি। মানুষ রাজনীতি-সচেতন না হলে, মানুষ তার অধিকার বুঝে নিতে না শিখলে, শাসক মানুষকে আরও বেশি শোষণ করার সুযোগ পায়। আর শাসক কিন্তু এটাই চায় যে মানুষ রাজনীতি-সচেতন না হোক, যাতে তারা নির্বিঘ্নে শাসন-শোষণ করতে পারে। তাই রাজনীতিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমরা কেউ-ই রাজনীতির বাইরের মানুষ নই। বর্তমান পৃথিবীর কোনো মানুষই রাজনীতির বাইরের নয়।’

ওর কথাগুলো আমার ভালো লেগেছিল। এমন করে তো কখনো ভাবিনি আমি। জাহানারা যখন মানুষ, দেশ, রাজনীতি নিয়ে কথা বলত; আমি মন দিয়ে শুনতাম। ওর কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করতাম। বুঝতে পারতাম যে রাজনীতি ওকে ওর বয়সের চেয়ে বেশি পরিপক্ক করে তুলেছে। ওর বয়সে আমি এতটা পরিপক্ক ছিলাম না। এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম না। ওর বয়সে সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে কোনো ভাবনাই ছিল না আমার। ওর সংস্পর্শ-ই আমাকে রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করে তোলে, আমি ক্রমশ রাজনীতি-সচেতন মানুষ হয়ে উঠি।

পরবর্তীকালে জার্মান নাট্যকার বার্টল্ট ব্রেখট পড়ার সময় রাজনীতি সম্পর্কে তার বিখ্যাত উক্তি আমার মন ছুঁয়ে যায়। তিনি বলেছেন, ‘নিকৃষ্টতম অশিক্ষিত হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে রাজনৈতিকভাবে অশিক্ষিত। সে শুনতে চায় না, বলতে চায় না, রাজনৈতিক বিষয়ে অংশগ্রহণ করে না। সে জানে না জীবনের মূল্য, ধান-মাছ-আটা-বাসা ভাড়া-জুতা বা ওষুধের দাম। সবকিছু নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। এই রাজনৈতিক অশিক্ষিতরা এতই মূর্খ যে, বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলে, রাজনীতিকে ঘৃণা করি! এই নির্বোধ জানে না, তার রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান, সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ভণ্ড রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ ও দেশি-বিদেশি কর্পোরেট কোম্পানির ভৃত্য দালাল।’

আমার বলতে এতটুকু দ্বিধা বা লজ্জা নেই যে জাহানারাই আমাকে রাজনীতিকে তলিয়ে দেখতে শেখায়, সত্যিকারের রাজনৈতিক-শিক্ষিত করে তোলে। রাজনীতির প্রতি আমার অনাগ্রহের কথা শুনে জাহানারা সেদিন আমাকে রাজনীতি সচেতনতার কথা বলতে গিয়ে অ্যারিস্টটলের উক্তি বলেছিল, সে ইচ্ছে করেই বার্টল্ট ব্রেখটের উক্তিটি আমাকে বলেনি, বললে নিজেকে ‘রাজনৈতিক অশিক্ষিত’ ভেবে আমি যদি কষ্ট পাই, তাই সে বলেনি।

এরই মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেল, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ওই দিন বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত ভাষণে তিনি বলেন, ‘জনগণের ডাকে সাড়া দিতে হইয়াছে, ইহা ছাড়া জাতির সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।’

একথা সত্যি যে কিছু মানুষ এরশাদের এই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে স্বাগত জানিয়েছিল। শেখ ফজলুল করিম সেলিম সম্পাদিত আওয়ামী লীগপন্থী দৈনিক পত্রিকা ‘বাংলার বাণী’ এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। পত্রিকাটি মোনাজাতরত এক নারীর ছবি ছাপিয়ে ক্যাপশন দিয়েছিল- ‘সামরিক আইন জারি হওয়ায় তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন।’

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দও এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে অখুশি ছিলেন না, সেটা তারা প্রকাশ্যে বলেওছিলেন। এটা আমাকে বিস্মিত করেছিল। আমি এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ মেনে নিতে পারিনি। গায়ের জোরে সেনাবাহিনী কেন দেশ শাসনের চেয়ারে বসবে? দেশের জন্য সেনাশাসন কখনোই মঙ্গলজনক নয়, দেশ শাসন করা সেনাবাহিনীর কাজ নয়। দেশ শাসন করতে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক শিক্ষা লাগে। তীক্ষ্ণ মগজ লাগে। লাঠিয়ালকে দুষ্কৃতিকারী ঠেঙানোর কাজে ব্যবহার করা যায়, দেশ শাসনের চেয়ারে বসানো যায় না। সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করা পাকিস্তানের দেখানো পথ। ওই পথে হাঁটবো না বলেই তো পাকিস্তান আমলে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিলেন, একাত্তরে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। অথচ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া সেই আওয়ামী লীগের উত্তরসূরীরাই কিনা জানালেন- সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে তারা অসুখী নন! আমার মতো আরো অনেক সাধারণ মানুষই এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা মেনে নিতে পারেননি। বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ অখুশি না হলেও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ছিল অখুশি। দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিরাট অংশ ছিল এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিরোধী।

এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং দেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রায় প্রতিদিন-ই জাহানারা আর আমি কথা বলতাম। জাহানারা আমাকে বলত, ‘তুমি দেখে নিও, আজ যারা এরশাদকে সমর্থন করছে, অচিরেই তাদের মোহভঙ্গ হবে। তারাও এই স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। গণতন্ত্রের আলো একদিন আসবেই।’

আমিও তাই বিশ্বাস করতাম যে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হবেই। পাকিস্তানের এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এক নয়, যে কারণে মাত্র চব্বিশ বছরেই পাকিস্তান ভেঙে গেছে। সেই একই কারণেই এই দেশের মাটিতে দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাখা সম্ভব হবে না। সেনাশাসনবিরোধী গণজোয়ার উঠবেই।

আমি আর জাহানারা সময় বের করে আগের মতোই ঢাকার আশপাশে যেতাম আর ও আমাকে মডেল করে ছবি আঁকত। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারির শেষদিকে একদিন সাভারের হেমায়েতপুরে ধলেশ্বরী নদীর ওপরে গিয়েছিলাম আমরা। তখন তো ধলেশ্বরীর ওপর ব্রিজ ছিল না, ধলেশ্বরী আরও চওড়া ছিল। আমরা নৌকায় নদী পার হয়ে বেশ নির্জন একটা জায়গায় অশ্বথগাছের নিচে বসেছিলাম। আমাকে পজিশন মতো বসিয়ে ও ছবি আঁকছিল। বসে থাকতে থাকতে আমার ঘুম পেয়েছিল। চোখ বুজে আসছিল আর আমি সামনের দিকে দু-বার ঢুলেও পড়েছিলাম। সেটা দেখে ও বলল, ‘ও মা, তোমার ঘুম পাচ্ছে? দাঁড়াও আমি ঘুম না আসার ওষুধ দিচ্ছি তোমাকে!’

বলেই কাছে এসে দু-হাতে আমার মুখ ধরে ঠোঁটে চুম্বন করল। ঘটনার আকর্ষিকতায় শুরুতে একটু হোঁচট খেলেও অল্পক্ষণের মধ্যেই আমিও চুম্বনক্রীয়ায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করলাম এবং বেশ উপভোগও করলাম। জাহানারাকে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলাম, কখনো ওকে কোলের মধ্যে নিয়ে বসে রইলাম, আবার কখনো ওর কোলে মাথা রেখে ঘাসের ওপর শুয়ে রইলাম আমি। ছবি আঁকা সিঁকেয় উঠল!

আমি ওর কোলে মাথা রেখে বললাম, ‘জাহানারা….।’
ও আমার মাথার চুলে চিরুনির মতো করে আঙুল বোলাচ্ছিল, বলল, ‘বলো।’
বললাম, ‘আমাদের ভালোবাসার পরিণতি কী হবে?’
‘যা হবার হবে, কালকের কথা ভেবে আজকে সময় নষ্ট করব নাকি! কাল কী হবে, তা নিয়ে কালই ভাবব। আমি আজকের দিনটা উপভোগ করতে চাই, এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে চাই।’
বলেই মাথা নিচু করে আমার কপালে চুম্বন করল, আমি ওর মাথার পিছনে হাত রেখে মাথাটা আরও নিচে নামিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করলাম, ও আমার জিভ চুষতে লাগল!

বছরের পর বছর একটি অপ্রিয় মুখে চুম্বন করতে করতে, একজন অপ্রিয় মানুষের সঙ্গে সঙ্গম করতে করতে আমি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। হতে পারে তপতী আমার বিবাহিত স্ত্রী, কিন্তু কখনোই সে আমার প্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। যে মানুষটি সকাল থেকে শুরু করে রাত্রে বিছানায় যাবার পরও আমার ওপর নিজের প্রভাব খাটাত, আমাকে কটুবাক্য বলত, কারণে-অকারণে রেগে যেত, সত্যি বলতে কী সেই মানুষটির প্রতি আমার অন্তর থেকে ভালোবাসা জাগ্রত হতো না। রাত্রে একই শয্যায় ঘুমানোয় কাম জাগ্রত হতো, কিন্তু তা ভালোবাসা থেকে নয়, শরীরের সহজাত জৈবিক প্রবৃত্তির কারণে। বহুবার আহত হৃদয় আর তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে শরীরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সঙ্গম করেছি। তাতে শরীরের জৈবিক চাহিদা মিটেছে, কিন্তু হৃদয় জুড়ে থেকেছে বিষন্নতা।

জাহানারা আর আমার চুম্বন-আলিঙ্গন ছিল দুজনের হৃদয় থেকে উৎসারিত সহজাত ভালোবাসার। সেদিন ধলেশ্বরী নদীর পাড় থেকে আসতে ইচ্ছে করছিল না আমাদের। মনে হচ্ছিল অনন্তকাল দুজন ওখানেই কাটিয়ে দিই। বেলা গড়িয়ে যেতে থাকল বিকেলের দিকে, আমি তখনও জাহানারার কোলে মাথা রেখে ঘাসের ওপরে শোয়া, বললাম, ‘চলো, এবার আমরা উঠি।’
জাহানারা আমার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, ‘আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘আমারও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতে তো হবেই।’
‘এই চলো না, আমরা কয়েকদিনের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’
‘কোথায় যেতে চাও?’
‘তোমার যেখানে খুশি। কয়েকটা দিন আমরা নিজেদের মতো করে কাটাবো, আর আমি তোমার ন্যূড ছবি আঁকবো।’
আমি ওর গাল টিপে দিয়ে বললাম, ‘ওরে দুষ্টু!’
‘আমি ফান করছি না, সত্যি বলছি। ইয়োরোপ-আমেরিকার শিল্পীরা চাইলেই কোনো মডেলকে সামনে রেখে ন্যূড ছবি আঁকতে পারে। ওখানে পেশাদার মডেল আছে, যারা টাকার বিনিময়ে শিল্পীদেরকে নিজের নগ্ন ছবি আঁকতে দেয়। পাশ্চাত্যে এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। আর আমরা বাংলাদেশের শিল্পীরা এখনো নীলক্ষেত থেকে কেনা চটি বইয়ের নগ্ন ছবি দেখে আর্ট করি।’

সেদিনই আমরা ঠিক করলাম যে ফ্রেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি দুজনে কক্সবাজার যাবো। বাসায় ফিরে আমি তপতীকে বললাম যে কলেজ ভিজিটে গোপালগঞ্জ যেতে হবে। তপতী আমাকে একটুও অবিশ্বাস করেনি, ও কখনোই আমাকে অবিশ্বাস করত না। ওর ধারণা ছিল আমি গোবেচারা ধরনের মানুষ, ঘরে বউ রেখে অন্য নারীর সঙ্গে প্রেম করতে যে সাহস ও উদ্যোম লাগে তা আমার নেই! ফলে আমাকে নিয়ে ও একবারে নিশ্চিন্তে থাকত যে নারীঘটিত কোনো ব্যাপার আমার দ্বারা হবে না। এটা নিয়ে ওর কাকাত-জ্যাঠাত বোন এবং বাবার বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়দের কাছে গর্ব করে বলত- ‘আমার বরকে আমি হাতের মুঠোয় রাখি, আমার হাতের বাইরে যাবার সাহস আমার বরের নেই!’ তপতীর এই গর্ব করার বিষয়টি আমি জানতে পারি তখন, যখন আমার এক দূর সম্পর্কের শ্যালিকা একবার রসিকতা করে আমাকে বলেছিল, ‘জামাইবাবু, আপনি এতবড় একজন মানুষ, কিভাবে যে দিদির অতটুকু হাতের মধ্যে থাকেন!’

হ্যাঁ, যতই আমি বিবাহিত জীবনে অসুখী হই না কেন, একজন বিবাহিত পুরুষ হিসেবে কোনো নারীকে প্রেমের প্রস্তাব দেবার মতো সাহস সত্যিই আমার কোনোকালেই ছিল না। তাই বলে এই অসুখী আবদ্ধ জীবনে জাহানারার মতো কোনো নারী স্বেচ্ছায় দক্ষিণের খোলা জানলা হয়ে এলে তাকে সাদরে গ্রহণ করব না, অতটা গোবেচারাও আমি নই। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমার অপরাধবোধ হতো। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতাম- আমি দুঃশ্চরিত্র? আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে যে, আমি তো ঘুষ খাচ্ছি না, চুরি করছি না, খুন-ধর্ষণ করছি না, একজন নারীর সঙ্গে প্রেম-ই তো করছি! আর এই প্রেম করতে গিয়ে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালনেও তো অবহেলা করছি তা নয়, সুতরাং অত দুশ্চিন্তার কিছু নেই!

এরপর বেশ কয়েক দিন রমনা পার্কে বসে জাহানারা আর আমি ভ্রমণের সব রকম পরিকল্পনা করলাম। ১৪ ফ্রেব্রুয়ারি জাহানারার রাজনৈতিক কর্মসূচী থাকায় আমরা ১৭ তারিখে কক্সবাজার যাত্রার দিন ঠিক করলাম। দুজনে নিউমার্কেটে ঘুরে ঘুরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনলাম। বাসের টিকিটও কেটে ফেললাম। টিকিট, জিনিসপত্রসহ জাহানারাকে হলের গেটে পৌঁছে দিয়ে রিক্সা নিয়ে বাসায় ফেরার সময় মনে মনে তপতীর উদ্দেশে বললাম- থাকো তুমি তোমার গর্ব নিয়ে, বরকে হাতের মুঠোয় রাখার সুখ নিয়ে, আমি জাহানারাকে নিয়ে ঘুরতে যাব কক্সবাজার। সেখানে তোমার হাতের মুঠোয় থাকা বরকে হোটেলের ঘরে ন্যাংটা করে বসিয়ে ছবি আঁকবে জাহানারা! শুধু তো ছবি আঁকাতেই থেমে থাকবে না, আমরা দুজনও জল রঙ হয়ে একে-অন্যের শরীরে মিশে যাব, আধো-আলো আধো-ছায়া ঘরে শয্যার ক্যানভাসে নানা প্রকার মূর্ত-বিমূর্ত ছবি হয়ে উঠবো আমরাই!

আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে জাহানারা যেমনি আমার সান্নিধ্য কামনা করে, আমাকে ছেড়ে থাকতে ওর ভালো লাগে না, তেমনি আমারও। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে কক্সবাজার থেকে ফিরে এসে ওর জন্য দুই রুমের একটা বাসা নেব, ওকে আর হলে থাকতে দেব না। তাতে করে ওর ছবি আঁকারও সুবিধা হবে। ওর থাকা থাকা-খাওয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নেব। ওকে টিউশনিও করতে হবে না। শুধু ছবি আঁকবে, রাজনীতি করবে আর নিজের যত্ন নেবে। ওকে সারপ্রাইজ দেব বলে আমি এই কথাটা কক্সবাজার গিয়ে জানাবো বলে ঠিক করলাম।



(চলবে.....)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১২:২৮

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার একটা ইপন্যাস গোধূলিবাড়ি।
এই উপন্যাসে বহু বিষয় উঠে এসেছে। প্রেম ভালোবাসা, হাহাকার। রাজনীতি, ধর্ম, জীবনযাপন, অসহায়তা। কি নেই? সব কিছু এনেছেন। এমনকি ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রও বাদ যায়নি।
জাস্ট গ্রেট।

২৫ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:৪৪

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দেবার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.