![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফাইনাল পরীক্ষা, সে তো যেন পরীক্ষা নয়, যেন এক মহাযুদ্ধ। এ যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন শ্বাস নেয়ারও সময় থাকে না। যাক ষষ্ঠ সেমিস্টার শেষ, ভালো হোক আর মন্দ হোক শেষ তো হয়েছে, কতদিন শান্তি করে ঘুমানো হয় না! আজ একটু আরাম করে ঘুমাবো। ভাবতে ভাবতে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আজিমপুরের দিকে যাচ্ছিলো ফারুক। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে সে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়। তারপর বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম তাকে জাপটে ধরে। বিকেল ৪ টার দিকে তার ঘুম ভাঙে তার ফোনের রিংটোনে। ঘুম ঘুম চোখে সে দেখে তার বন্ধু পারভেজ তাকে কল দিয়েছে। কল ধরতেই পারভেজ বলে- “পারভেজ- হ্যালো বন্ধু! ফারুক- হ্যা, বলো। পারভেজ- কই তুমি? ফারুক- এইতো রুমে শুয়ে আছি। পারভেজ- চলো কার্জন হলের এলাকা থেকে আজ একটু ঘুরে আসি, কতদিন যাওয়া হয় না। আসো দোস্ত। ফারুক- আচ্ছা আচ্ছা, আমি রেডি হয়ে আসছি, তা আমি কোথায় মিট করবো তোমার সাথে? পারভেজ- টিএসসিতে আসো। ফারুক- ওকে, সি ইউ সুন, গুড বাই! পারভেজ- গুড বাই দোস্ত!” মোবাইল রেখে দিয়ে ফারুক দ্রুত রেডি হয়, সে পরে একটা সূতি পাঞ্জাবী জিন্সের প্যান্ট আর একটি চাদর। রিকশায় করে টিএসসিতে যায় সে। টিএসসিতে এসে দেখে পারভেজ জনতা ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফারুককে দেখে সে মিষ্টি করে হেসে দিলো। ওর এই হাসি ফারুকের খুব পছন্দ। কাছে এসে ফারুক পারভেজকে বলে- “দোস্ত তোমার এই হাসিতে জাদু আছে, এই হাসি দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়।” পারভেজ- “হইছে হইছে, আর পাম মারা লাগবে না।” তার এই কথাতে ফারুক হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর তারা হাঁটতে লাগলো কার্জন হলের দিকে। শীতের বিকেল, হালকা বাতাস বইছে, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের গাছগুলো পাতা ঝড়িয়ে মাঘের সন্ন্যাসীতে পরিণত হয়েছে, চা ওয়ালা আর বাদাম ওয়ালারা ছোটা-ছুটি করছে এদিক-ওদিক। শত শত প্রেমিক দম্পত্তি মুখোমুখি বসে খোশগল্পে মগ্ন হয়ে আছে, কিছু দম্পত্তি আবার ফুসকা খাওয়ায় ব্যাস্ত। অন্যদিকে ধূলো উড়িয়ে ক্রিকেট খেলছে কিছু ছেলে। এসব দেখতে দেখতে কার্জন হলে পৌঁছে গেলো ফারুক আর পারভেজ। প্রথম তারা কার্জন হলের পুকুর পাড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর তারা উঠে পুরো এলাকা একবার ঘোরে। সবুজ ঘাস আর গাছগুলো তাদের মনকে চাঙ্গা করে তোলে। তারা গত সেমিস্টার, আগামী সেমিস্টার, তাদের গ্রাম আর তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে অনেক গল্প করে। সন্ধ্যা লাগলে তারা কার্জন হল এলাকা থেকে বের হয়ে আসে। তারা হাঁটতে থাকে নিশ্চুপ হয়ে। নীরবতা ভাঙায় পারভেজ, সে বলে-“হলের খাবার আর মেসের খাবার তো অনেক খাইলাম, আসো একদিন আমরা নিজেরা রান্না করে খাই, পিকনিকের মতই মনে করো।” ফারুক বলে-“রান্না করবে কে? আমি তো রান্না পারি না ভাই।” পারভেজ-“আরে চিন্তা কি? আমি আছি না, আমি ভালো রান্না করতে পারি, একবার যদি আমার রান্না খাও তবে চিরকাল মনে থাকবে।” ফারুক-“তাই বুঝি?” পারভেজ-“ইয়েস মাই ডিয়ার।” ফারুক-“তাহলে জিল্লুরকেও বলি, তিনজন মিলে অনেক মজা করা যাবে।” পারভেজ-“হ্যা, ওকে না বললে বড় বেঈমানি করা হবে, আমি ওকে এখনি ফোন করে বলে দিই।” পারভেজ জিল্লুরকে তার পরিকল্পনার কথা বলে, জিল্লুর খুশি হয়ে পারভেজের প্রস্তাবে রাজী হয়।
ফারুক আর পারভেজ পলাশী বাজার থেকে বাজার করে নিয়ে আসে, রাত ৮ টার দিকে ফারুক, পারভেজ আর জিল্লুর রান্না শুরু করে। তাদের খাবারের আইটেম ছিল মুরগির মাংস, ডাল আর শশার সালাদ। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর রান্না শেষ হয়। তারা তিনজন খেতে বসে, ভাত তরকারী নিয়ে তারা খাওয়া শুরু করে, তরকারী মুখে নিয়ে ফারুক বলে ওঠে-“বাহ! সেই স্বাদ হইছে।” পারভেজ ধন্যবাদ জানায় ফারুককে। খাওয়ার এক পর্যায়ে জিল্লুর বলে-“একটু কাঁচা মরিচ হলে ভালো হত।” পারভেজ দ্রুত তিনটা কাঁচা মরিচ নিয়ে আসে। তারা আবার খাওয়া শুরু করে। মরিচে কামড় বসায় ফারুক, ঝাল তার সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পরে। সে বলে ওঠে-“ওরে বাবা! মরিচের কি ঝাল রে!” পারভেজ ফারুকের দিকে পানির মগ এগিয়ে দেয়। ঝালের চোটে সে ঢক ঢক করে সব পানি খেয়ে ফেলে। মরিচের এতো ঝাল ছিল যে ফারুকের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গিয়েছিলো। বার বার সে পানি খাচ্ছিল। পানি খেয়েই তার পেট প্রায় ভরে যায়, ভাত খেতে তার কষ্ট হচ্ছিলো, তারপরও অনেক কষ্টে সে তার প্লেটের ভাত শেষ করে। খাওয়ার পর তারা কিছুক্ষণ গল্প করে, এরপর সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার রুমের দিকে চলে যায়।
রুমে এসে ফারুক হাত-মুখ ধুয়ে নেয়, পোশাক পরিবর্তন করে সে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সারাদিনের বিভিন্ন ঘটনা তার মনের ভেতর আবর্তন করতে থাকে। সবচেয়ে যে ঘটনা তার মনে বেশি রেখাপাত করে তা হল বন্ধু পারভেজের রুমে ঝাল মরিচ খাওয়ার সেই অভিজ্ঞতা। হঠাৎ অনেকদিন আগের একটি ঘটনা তার মনে আসে। সে ঘটনাটিও ছিল মরিচ নিয়ে। সে অনেকদিন আগের কথা, এক শীতের বিকেলের কথা। ফারুক তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, লেখা-পড়ার দিকে তার মন খুব কমই ছিল, খেলা-ধূলার দিকেই তার মন পড়ে থাকতো। গ্রামে তার দুজন ভালো বন্ধু ছিল, তারা হল সুজন আর লালমিয়া। তাদের একটি বিশেষ দিক ছিল, আর তা হল তারা প্রতি শুক্রবার তাদের গ্রামের পাশের এক মরা নদীর তীরে বসে আড্ডা দিত। তেমনই এক শুক্রবার তারা সেই নদীর পাশে বসে ছিল, পড়ন্ত বিকেল, সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, একপাল পাঁতিহাস নদীর বুক চিরে পুব দিকে যাচ্ছিলো, দূরের গ্রামের সবুজ গাছপালাগুলো কুয়াশায় ঢেকে আছে, পাশেই একটি মসজিদ ছিল, আসরের আযান আসছিল সেখান থেকে, আযানের সুর ভেসে যাচ্ছিলো উত্তরের হাওয়ার সাথে। ঠাণ্ডা হাওয়া তাদের তিনজনের শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল। তারপরও তারা এই অপরূপ দৃশ্যের কাছ থেকে দূরে যাচ্ছিলো না, যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের তিনজনকে বশ করে রেখেছিলো। মনে হচ্ছিলো তারা যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে। এই ঘোর ভাঙায় লালমিয়া, সে বলে-“সইন্ধ্যে নাগি গেইচে রে চলো এলা বাড়ি যাই।” ফারুক বলে-“হ চলেক।” তারা তিনজন বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। সে সময় সুজন দেখে যে পাশের মসজিদের টিউবওয়েলের পাড়ে একজন মহিলা বসে আছে, পেছন থেকে বেশি কিছু বোঝা যাচ্ছিলো না, শুধু এটুকুই বোঝা যাচ্ছিলো যে একটি মলিন সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছিল মহিলাটি সাথে একটি ব্যাগ। লালমিয়া বলল যে-“চল তো দেহি কি করে ওই বেটিছওয়া!” সুজন বলে-“কি দরকার দেহার? চল বাড়ি যাই।” ফারুক বলে-“আরে না, চল দেহি, আয় আমার সাথে আয়।” সুজন বলে-“যদি ছওয়াধরা হয়?” ফারুক বলে-“ধুর! কি কইস? চল, কিচু হবার নয়।” তারা তিনজন এগিয়ে যায় ওই মহিলার দিকে। কাছে গিয়ে ফারুক জিজ্ঞেস করে-“ও দাদী! এটাই কি করেন বাহে?” মহিলাটি তাদের দিকে তাকায়, তার মুখে হাসি, ফারুক সেই মহিলাকে আগে থেকেই চিনতো। সে বলে ওঠে-“আরে দাদী তোমরা এটাই এই সইন্ধ্যের সমায় কি কইরব্যার নাইগচেন?” সে মহিলাটি বলে-“পানি খাবার আইসলোং বাবা।” এই কথা বলে সে তার ব্যাগ থেকে তিনটি কাঁচা মরিচ বের করে। সুজন বলে-“মরুচ দিয়া কি কইরবেন?” মহিলাটি বলে-“এলা মরুচ খামো”। ফারুক বলে-“ক্যা? মরুচ খাইবেন ক্যা?” মহিলাটি একটু শুকনো হাসি হাসে, আর বলে-“এলা জারের দিন নোয়ায়? এলা তো তিয়াস নাগে না, সেই জন্যে আগোত মরুচ খাইম তারপরে ঝাল নাইগলে বেশি করি পানি খাইম। পানি বেশি করি খাওয়া নাগে বাবা।” মহিলাটি আবার বলে-“জারের দিন বাবা, আর বাইরা থাকেন না, এলা বাড়ি যাও।” তখন তারা তিনজন বাড়ির দিকে রওনা হয়। সুজন আর লালমিয়া কি ভেবেছিলো ফারুক তা জানে না, তবে তার কাছে ব্যাপারটা ঠিক মনে হয়নি। পানির পিপাসা লাগার জন্য কাঁচা মরিচ খেতে হবে? তার কাছে সবকিছু রহস্যময় মনে হয়েছে, তার মনে হয়েছে দাদী তাদের কাছে কিছু লুকিয়েছে। কিন্তু কি লুকিয়েছে তা ফারুক তখন বুঝতে পারেনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, ১২ বছর পেরিয়ে গিয়ে আর আজ সে বুঝতে পেরেছে সেই কাঁচা মরিচের রহস্য। যখন তার ঝাল লেগেছিল তখন সে বার বার পানি খেয়েছিল, আর তার পেট ভরে গিয়েছিলো পানি খেয়েই। ওই দাদী মরিচ খেয়েছিল পানির পিপাসা মেটানোর জন্য নয়, ক্ষুধা মেটানোর জন্য। হয়তো সেদিন তার খাবার জোটেনি, তাই পানি খেয়েই ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করেছে। ওই বৃদ্ধা দাদীর জন্য ফারুক কষ্টবোধ করে। সে ভাবে প্রতিদিন কত খাবার আমরা নষ্ট করি, আর অনেক মানুষ আছে যারা একমুঠো খাবারের আশায় কত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে। ফারুক তখন নিজের অজান্তেই বলে ওঠে-“দাদী যদি ওই সন্ধ্যার সময় বুঝতাম তুমি ক্ষুধার্ত তবে তোমাকে পেট ভরে ভাত খাওয়াতাম, কিন্তু আফসোস আমি বুঝিনি কিছুই।
©somewhere in net ltd.