নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

yakub ali

yakub ali › বিস্তারিত পোস্টঃ

মাসুদ রানা গোপন শতরু ১৫১-২০৬ শেষ

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৩:২৯

১৫১



নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু প−্যানটা তো পুরোপুরি আমার নিজের তৈরি।

প−্যানটা না বলে বলা উচিত প−্যানগুলো। শুধু তো তেল আবিষ্কার

করার ব্যাপার ছিল না। পানির তলায় বিশাল ফ্যাসিলিটি তৈরি

করতে হয়েছে। মোবাইল প−াটফর্ম, কার আইডিয়া? ফাটলের

কিনারায় খনি বিশেষজ্ঞ আর তেল শ্রমিকল্ডে কলোনি, কার বুদ্ধি?

তারপর ধরুন তেল পরিবহন, ক্রেতা নির্বাচন, ল্ড নির্ধারণ, বিল

আদায়Ñআরে ভাই, সবই তো এই অধমকে করতে হয়েছে।’

রানা কিছু বলল না। আবার যমুনার কথা ভাবছে ও। ভাবছে

সোহেলের কথাও। ওর সীট থেকে রকেটম্যানের মনিটরস্ক্রীন

পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে কোন এয়ারক্রাফট

থাকলে ওটায় তার ইমেজ ফুটবে। তবে কি ওর ব্যাক আপ

হিসেবে টমাহকের পিছু নেয়নি সোহেল?

খানিক পর কবীর চৌধুরী বলল, ‘আপনি অন্যমনস্ক হয়ে

পড়ছেন, ব্রিগেডিয়ার। জানি কার কথা ভাবছেন। আপনার

প্রাইভেট সেক্রেটারি অসাধারণ রূপসী, একটু চিন্তা হওয়া

স্বাভাবিক।’

‘আমি ওর অসুস্থতার কথা ভাবছি, মিস্টার চৌধুরী,’ বলল

রানা। ‘ওর নিরাপত্তা সম্পর্কে নয়। মিস্টার ভবনিয়া নিজে যখন

দুর্গে রয়েছেন, ওর কোন বিপদ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’

হঠাৎ হেসে উঠল কবীর চৌধুরী, যেন মজার কি একটা মনে

পড়ে গেছে তার। ‘আপনার ধারণা ভুল, ব্রিগেডিয়ার। বিপদ একটা হবে।’

উত্তেজিত বা অস্থির হতে রাজি নয় রানা। হাসিমুখে জানতে

চাইল, ‘আপনি ঠাট্টা করছেন, রাইট?’

‘বিপদ্মা আসবেও মিস্টার ভবনিয়ার তরফ থেকে,’ বলল

কবীর চৌধুরী। ‘তবে সেটা মিস সাজনীনের নয়, আপনার বলেই

মনে করি।’

১৫২

মাসুল্ডানা-৩১৬



‘আমার বিপদ?’ রানা ভাব দেখাল কৌতুক বোধ করছে।

‘মিস সাজনীনকে হারাতে হলে সেটাকে আপনি নিজের বিপèলে গণ্য করবেন না?’ জিজ্ঞেস করল কবীর চৌধুরী, এখনও

হাসছে।

‘আমি তাহলে সাজনীনকে হারাচ্ছি?’

‘ওকে সম্ভবত শ্রীলঙ্কায় রেখেই দেশে ফিরে যেতে হবে

আপনাকে,’ বলল কবীর চৌধুরী। ‘কারণটা আমাকে ব্যাখ্যা

করতে দিন, প−ীজ। দুর্গে ফিরেই দেখতে পাবেন, সাজনীন

আপনাকে এড়িয়ে চলছে। সে যজ্ঝিাপনার সঙ্গে কথা বলতে

অস্বীকার করে তাতেও আমি আশ্চর্য হব না।’

‘কিন্তু কেন? এরকম আচরণের কারণটা কি হবে?’

‘কারণ বিরুপিল−াই ভবনিয়ার জাদু। পয়েন্ট পেড্রোর ওই দুর্গে

ঘন-ঘন আসতে হয় আমাকে, আমি দেখেছি। সাবেক ব্রিটিশ

মন্ত্রীর কন্যা বা নেপালের রাজকুমারীকেও ছাড়েননি তিনি। মেয়ে

পটাতে তাঁর মত ওস্তাদ লোক দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা

সন্দেহ। আর একবার যদি কোন মেয়ের ওপর চোখ পড়ে, সেই

মেয়ে তাঁর ক্রীতদাসী না হয়ে পার পাবে না। একে আপনি জাদু

ছাড়া আর কি বলবেন?’

রানার কিছু বলা হলো না, কারণ হেডসেট হয়ে সবার কানে

রকেটম্যানের কথাটা বোমার মতই বিস্ফোরিত হলো, ‘পিছনে

আপদ জুটেছে। সম্ভবত একটা হেলিকপ্টার। বিশ মাইল দূরে।’

মনিটর স্ক্রীনে তাকিয়ে রানাও দেখতে পেল ইমেজটা।

অস্পষ্ট, পে−ন না হেলিকপ্টার বোঝা যাচ্ছে না। ওর পালস রেট

বেড়ে গেল। হেলিকপ্টার হলে নিশ্চয়ই ওটায় সোহেল আছে।

পাইলট বলল, ‘আমরা রওনা হবার সময়ও রাডারে ছিল

ওটা। পিছিয়ে পড়েছিল, এখন আবার কাছে চলে আসায় রাডারে

দেখতে পাচ্ছি। ছোট, স্যার। সম্ভবত টু-সিটার।’

গোপন শত্র“

১৫৩



কবীর চৌধুরী সরাসরি রানার দিকে তাকাল। ‘আপনার

ব্যাকআপ নয় তো, ব্রিগেডিয়ার খাস্তগীর? আইএসআই-এর কোন

হেলিকপ্টার? ওটায় হয়তো আপনার বডিগার্ডরা আছে।’

‘হাসালেন দেখছি। বন্ধুল্ডে সঙ্গে দেখা করতে এসেছি,

ব্যাকআপ বা বডিগার্ড ল্ডকার হবে কেন?’ টু-সিটার হলে ওটায়

সোহেল নেই, জানে রানা।

রকেটম্যান ও পাইলট, দু’জনকেই প্রশ্ন করল কবীর চৌধুরী,

‘হাবভাব কেমন বুঝছ? কোন খারাপ মতলব আছে বলে মনে

হচ্ছে?’

‘মনিটরে দেখে কিছুই বোঝা যাবে না,’ পাইলট জবাব দিল।

‘কাছে আসুক, খালি চোখে দেখি, তখন বলতে পারব।’

‘উটকো ঝামেলা পছন্দ করি না,’ বিরক্ত হয়ে বলল কবীর

চৌধুরী। ‘মেসেজ পাঠিয়ে সাবধান করে দাও, তারপরও যদি পিছু

না ছাড়ে, রেঞ্জের মধেঞ্জাসা মাত্র রকেট ছুঁড়ে ফেলে দাও

পানিতে।’

‘ইয়েস, স্যার!’ রকেটম্যান তার উল−াস চেপে রাখতে পারল

না।

পরবর্তী আধ ঘণ্টায় পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নিল। দুটো

হেলিকপ্টারের দূরত্ব কমে পাঁচ মাইলে এসে স্ফাড়াল। পাইলট

রেডিও মেসেজ পাঠিয়ে জানতে চাইল কোত্থেকে আসছে ওটা,

উদ্দেশ্যই বা কি। পিছনের টু-সিটার থেকে কোন সাড়া-শব্দ নেই।

পাইলট তৃতীয়বার মেসেজ পাঠিয়ে বলল, ‘সাড়া না দিলে

তোমাল্ডেকে শত্র“ বলে গণ্য করা হবে। এরপর কোন

আলটিমেটাম দেয়া হবে না, রকেট ছুঁড়ে আঘাত করা হবে

তোমাল্ডে।’

টু-সিটার থেকে পাইলট এবার রানাকে বিপদে ফেলে দিয়ে

বলল, ‘কাল ভোরে ব্রিগেডিয়ার মহব্বতজান খাস্তগীরের রেডিও

১৫৪

মাসুল্ডানা-৩১৬



মেসেজ পেয়ে করাচী থেকে রওনা হয় তারা। যান্ত্রিক ত্র“টির

কারণে রওনা হতে দেরি হয়ে যায় তাল্ডে। আজ দুপুরে পয়েন্ট

পেড্রোয় পৌঁছে দেখে দুর্গের ছাদ থেকে একটা হেলিকপ্টার

বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হচ্ছে। ‘আমরা ব্রিগেডিয়ারের

বডিগার্ড, কাজেই আপনাল্ডে হেলিকপ্টারে ব্রিগেডিয়ার আছে কি

না জানতে চাই আমরা।’

‘উনি আমাল্ডে সঙ্গে আছেন, এবং বহাল তবিয়তে,’ জবাব

দিল পাইলট। ‘আমরা একটা গোপন মিশনে যাচ্ছি, কাজেই দয়া

করে অনুসরণ করবেন না।’

টু-সিটারের পাইলট বলল, ‘ব্রিগেডিয়ার আপনাল্ডে সঙ্গে

আছেন, আছেন নিরাপদেই, এর প্রমাণ পেতে হবে আমাল্ডে।

ব্রিগেডিয়ার কোড করা সঙ্কেত দিলেই বুঝতে পারব তিনি

হেলিকপ্টারে আছেন, এবং ভাল আছেন। তিনি কোন বিপল্ডে

মধ্যে নেই, এটা জানতে পারলেই দুর্গে ফিরে গিয়ে তার জনেঞ্জপেক্ষা করব আমরা।’

রানার দিকে চোখ গরম করে তাকাল কবীর চৌধুরী। ‘এটা

আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন, মিস্টার খাস্তগীর। একবার তো

অস্বীকার করে বলেছেন আপনার কোন ব্যাকআপ নেই, বডিগার্ডও

নিয়ে আসেননি। তাহলে?’

‘আমি সত্যি কথাই বলছি, মিস্টার চৌধুরী। ওল্ডে কোথাও

ভুল হচ্ছে। কোড? কিসের কোড? আমি কাউকে কোন রেডিও

মেসেজ পাঠাইনি, মিস্টার চৌধুরী। ওল্ডেকে আমি চিনিও না।’

‘ঠিক বলছেন, কোথাও কোন ভুল হচ্ছে না?’ কবীর

চৌধুরীকে সিরিয়াস দেখাল।

রানা ভাবছে, টমাহক থেকে রকেট ছুঁড়ে আইএসআই-এর

একটা হেলিকপ্টার ফেলে দিলে ওর কি? ‘আমার ধারণা, মিছে

কথা বলছে ওরা, উদ্দেশ্য কাছাকাছি থেকে দেখা আমরা কোথায়

গোপন শত্র“

১৫৫



যাই, কি করি। আমার আরও ধারণা, ওই হেলিকপ্টারে আমাল্ডে

কমন শত্র“ মাসুল্ডানা আছে।’

‘আপনার কথায় যুক্তি আছে,’ সায় দিল কবীর চৌধুরী।

‘তাহলে ওটাকে আকাশ থেকে ফেলে দেয়াই ভাল, কি বলেন?’

‘অযথা খুন-খারাবি আমি পছন্দ করি না,’ বলল রানা। ‘তবে

আপনি যে সিদ্ধান্তই নেন না কেন, আমি আপত্তি করব না।’

‘ভেরি গুড,’ বলে রকেট অপারেটরকে জিজ্ঞেস করল কবীর

চৌধুরী, ‘সুপারট্যাংকারটা আর কত দূরে?’

‘একদম কাছে চলে এসেছে, স্যার। খুব বেশি হলে ত্রিশ

মাইল দূরে।’

‘ওটার ডেকে নেমে ফুয়েল নেব আমরা, টু-সিটারকে এটা

দেখতে দেয়া যাবে না। তার আগেই আকাশ খালি করো তুমি।’

‘ইয়েস, স্যার!’ কনসোলের ওপর ঝুঁকে যান্ত্রিক ফড়িং

শিকারের প্রস্তুতি নিচ্ছে রকেট অপারেটর।

কথায় আছে, পিপীলিকার পাখা গজে মরিবার তরে, আইএস-

আই-এর টু-সিটারেরও যেন তাই গজিয়েছে। মারাত্মক হুমকি

শোনার পরও টমাহকের আরও কাছে চলে এল পাকিস্তানী

পাইলট। পরপর দুটো রকেট ছুঁড়ে ককপিট আর রোটর উড়িয়ে

দিল টমাহকের অপারেটর। এক মুহূর্তের ঘটনা, কিন্তু তার

পরিণতি হলো ভয়ানক। রকেটের আঘাত টু-সিটারকে ভাল ভাবে

টুকরো করার সময়ও পেল না, বিস্ফোরিত ফুয়েল ট্যাংক ওটাকে

একটা কমলা রঙের প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করল। সাগরে

পড়ার পর কিছুই তার অবশিষ্ট থাকল নাÑনা ভাঙা টুকরো, না

আগুন।

‘সত্যি কথা বলবেন, আপনি দুঃখ পাননি তো?’ মুচকি হেসে

জিজ্ঞেস করল কবীর চৌধুরী।

রানা জবাব দিল, ‘কংগ্রাচুলেশন্স!’

১৫৬

মাসুল্ডানা-৩১৬















এগারো



গে−াবাল পজিশনিং সিস্টেম-এর সাহায্যে নিজেল্ডে অবস্থান

সম্পর্কে নিশ্চিত হবার সুযোগটা কবীর চৌধুরী গ্রহণ করছে না।

কারণ হিসেবে রানাকে সে জানাল, তাতে নাকি সংশি−ষ্ট

স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ ফোরবল-এর

আন্ডারওয়াটার ফ্যাসিলিটির হদিশ পেয়ে যেতে পারে।

বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে আধঘণ্টা ধরে এদিক-ওদিক ওড়াউড়ির

পর পাইলট খানিকটা উদ্বেগের সঙ্গেই জানাল, সারফেসে সে

কোন বয়া দেখতে পাচ্ছে না। তার উদ্বেগ কবীর চৌধুরীকে স্পর্শ

করল কিনা বোঝা গেল না, তবে সময় নষ্ট না করে ম্যাপ খুলে

নিজেল্ডে অবস্থান জানার জনেল্ট্যস্ত হয়ে পড়ল সে। সীমাহীন

সাগরে কোন ল্যান্ডমার্ক নেই, কাজেই মাপকাঠি হিসেবে সূর্যের

অবস্থান, ঘড়ির কাঁটা, অক্ষ ও দ্রাঘিমার সাহায্য নিল সে। তার

নির্দেশে আরও প্রায় একশো মাইল উত্তর-পুব দিকে সরে এল

পাইলট। ওল্ডে কথাবার্তা থেকে রানা ধারণা করল, এই মুহূর্তে

বাংলাদেশের উপকূল থেকে প্রায় দুশো মাইল দূরে রয়েছে ওরা।

কবীর চৌধুরীর কাছে বিভিন্ন ধরনের কয়েকটা রিমোট

কন্ট্রোল ডিভাইস রয়েছে, তারই একটা বের করে সুইচ টিপল

সে।

বঙ্গোপসাগর এই মুহূর্তে একদম শান্ত, সারফেস আয়নার মত

গোপন শত্র“

১৫৭



মসৃণ। আলোড়নটা সেজন্যেই চোখে পড়ল। টমাহক শূন্যে স্থির

হয়ে আছে, সরাসরি নিচে উথলে উঠল সাগরের পানি। ধীরে ধীরে

সাগর থেকে মাথাচাড়া দিচ্ছে চৌকো একটা প−্যাটফর্ম। দৈর্ঘেদ্দ

প্রস্থে খুব একটা বড় নয় ওটা, তবে একসঙ্গে দুটো হেলিকপ্টার

ল্যান্ড করতে পারবে।

কবীর চৌধুরী বলল, ‘নানা কাজে এরকম বেশ কয়েকটা

প−্যাটফর্ম বল্টহার করি আমরা, এটাই সবচেয়ে ছোট।’

রানা লক্ষ করল, হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার সময় প−্যাটফর্মটা

দুলল না বা নড়ল না। এর মানে হলো, এটা ভাসমান নয়;

সাগরের তলায় পোঁতা রয়েছে এর গোড়া। টমাহক ল্যান্ড করতে

যা দেরি, সঙ্গে-সঙ্গে প−্যাটফর্মের পাশে ভুশ করে একটা সাবমেরিন

ভেসে উঠল। কপ্টার থেকে নেমে প−্যাটফর্মের কিনারায় এসে

স্ফাড়াল কবীর চৌধুরী ও রানা। গায়ের জ্যাকেটটা পাইলটের

সীটের পিঠে ঝুলিয়ে রেখে এসেছে রানা। ওটার ভেতরে ভাঙা

সুটকেসের একটা ছোট টুকরো আছে, যমুনা নিজের হাতে কাপড়ে

মুড়ে সেলাই করে দিয়েছে।

বাপের মতই অফ-হোয়াইট রঙের দামী কাপড়ের সুট

পরেছে, সাবমেরিনের কনিং টাওয়ার থেকে বেরিয়ে এল খায়রুল

কবীর। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে রানার

সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল কবীর চৌধুরী। ‘আমাল্ডে

আন্ডারওয়াটার ফ্যাসিলিটির চীফ এঞ্জিনিয়ার, আমার একমাত্র পুত্র

খায়রুল কবীর; খায়রুল, ইনি আইএসআই-এর ডেপুটি ডিরেক্টর

ব্রিগেডিয়ার মহব্বতজান খাস্তগীর।’

হ্যান্ডশেক করল ওরা। খায়রুল কবীরকে গম্ভীর ও চিন্তিত

দেখাচ্ছে।

কবীর চৌধুরী জিজ্ঞেস করল, ‘এনিথিং রঙ, মাই সান?’

দেখা যাচ্ছে না, তবে ঘাড় ফিরিয়ে বাংলাদেশ উপকূল রেখার

১৫৮

মাসুল্ডানা-৩১৬



দিকে তাকাল খায়রুল। ‘ঠিক বুঝতে পারছি না, ড্যাড। এই

পাঁচ-সাত ঘণ্টা আগে থেকে আমাল্ডে ইকো সাউন্ডারে এমন কিছু

পালস পাচ্ছি, মনে হচ্ছে পতেঙ্গার কাছে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী

হঠাৎ বড় বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর

আসা-যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।’

‘হয়তো কোন মহড়ার আয়োজন চলছে,’ বলল কবীর

চৌধুরী। ‘আর কিছু, বাবা?’

‘শুধু সোনার নয়, ড্যাড; রাডার থেকেও অস্বাভাবিক রীডিং

পাচ্ছি,’ বলল খায়রুল কবীর। ‘কাছাকাছি আসছে না, তবে এক

ঝাঁক ফাইটার জেট উপকূল এলাকার ওপর কড়া নজর রাখছে।

কেন, কি ব্যাপার, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।’

‘মিগ?’ এবার একটু যেন উদ্বিগ্ন দেখাল কবীর চৌধুরীকে।

‘হ্যাঁ, মিগ। একটা পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে চলে এসেছিল,

সেজন্যেই তো বয়াগুলো পানির নিচে টেনে নিয়েছি।

এঞ্জিনিয়ারল্ডেও বলে দিয়েছি, পানির ওপর আপাতত যেন কোন

বুদ্বুদ না ওঠে।’

কবীর চৌধুরী গম্ভীর হয়ে গেল। ‘তুমি সাবমেরিনের

কমিউনিকেশন রূমে থাকো, খায়রুল,’ বলল সে। ‘একটা

সুপারট্যাংকার আসছে তেল নিতে, আসতে নিষেধ করে দাও।

মনিটরে চোখ রাখো, সন্দেহজনক কিছু দেখলেই আমাকে

জানাবে।’

‘ইয়েস, ড্যাড!’ কনিং টাওয়ার থেকে মই বেয়ে সাবমেরিনের

নিচে নেমে গেল খায়রুল কবীর।

রানার দিকে ফিরল কবীর চৌধুরী, সরাসরি ওর বুকে একটা

আঙুল তাক করল, তারপর চোখ গরম করে বলল, ‘আমি একটা

ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছি!’

রানার বুক ধক করে উঠল। ‘কি রকম?’

গোপন শত্র“

১৫৯



প−্যাটফর্মের ওপর উত্তেজিতভাবে পায়চারি শুরু করল কবীর

চৌধুরী। ‘হিসেবেও আমার একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে!’

আপনমনে বিড় বিড় করছে সে।

‘মি. চৌধুরী, আপনার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।’

শঙ্কিত বোধ করছে রানা। কবীর চৌধুরীর আচরণে পাগলামির

ভাব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

রানার সামনে থামল কবীর চৌধুরী। ‘এ ষড়যন্ত্রের হোতাকে

আমি চিনি! সে আমার জন্মশত্র“ মাসুল্ডানা!’ হিসহিস করে বলল

সে। ‘মিস্টার ভবনিয়ার এজেন্ট মলি−কা রতœপ্রভাকে খুন করার

আগে নিশ্চয়ই ইন্টারোগেট করেছিল রানা, তখনই জেনে ফেলে

তেলখনিটা বাংলাদেশের জলসীমার শেষ প্রান্তে কোথাও।’

‘হ্যাঁ, একটা সম্ভাবনা বটে,’ রানার গলায় সমর্থনের সুর।

‘তথন্ধা পেয়ে শালা আর দেরি করেনি,’ স্ফাতে স্ফাত চেপে

বলল পথভ্রষ্ট বিজ্ঞানী, ‘বাংলাদেশের নৌ ও বিমানবাহিনীকে

সতর্ক করে দিয়েছিল। আর আজ, আমরা পয়েন্ট পেড্রো থেকে

রওনা হবার পর, আমাল্ডে লোকেশনও জানিয়ে দিয়েছে।’

‘আমারও তাই সন্দেহ,’ বলল রানা।

কপ্টারের খোলা ল্ডজা দিয়ে পাইলটের গলা ভেসে এল,

‘মিস্টার চৌধুরী, মনিটরে এক ঝাঁক ফাইটার পে−ন দেখতে

পাচ্ছি। কাছে আসছে না, দূর থেকে চক্কর দিচ্ছে।’

হঠাৎ গলা ছেড়ে হেসে উঠল কবীর চৌধুরী।

‘কি ব্যাপার, মিস্টার চৌধুরী?’ একটা ঢোক গিলল রানা।

‘তাহলে প্রথম থেকে খুলে বলতে হয়,’ হাসি থামিয়ে বলল

উন্মাদ বিজ্ঞানী। ‘আমার ধারণা ছিল ফোরবল-এর আস্তানা

হিসেবে মিস্টার ভবনিয়ার দুর্গে হানা দেবে রানা। সেভাবে

প্রস্তুতিও নেয়া হয়। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, ধরতে

পারলে ওই শালাকে জ্যান্ত কবর èে। কিন্তু মিস্টার ভবনিয়া

১৬০

মাসুল্ডানা-৩১৬



চাইছেন, শিকারী বাজপাখিকে দিয়ে ঠুকরে প্রথমে ওর চোখ তুলে

নেবেন।’

‘মিস্টার ভবনিয়া কি বাজপাখি পোষেন?’ জিজ্ঞেস করল

রানা। যতই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুক, মুখোশের ভেতর

ঘামছে ও, বুকটাও ধড়ফড় করছে।

‘সময়ের অভাবে দুর্গটা তো আপনাকে ঘুরে দেখানো হলো

না। বাজপাখি পোষেন মানে? গণ্ডায় গণ্ডায় পোষেন। ওগুলো

তিনি আরব শেখল্ডে কাছ থেকে উপহার পেয়েছেন। ট্রেনিং দেয়া

বাজ, শিস বাজিয়ে নির্দেশ দিলেই আপনার চোখ তুলে নেবে...’

‘আমার?’

‘কথার কথা বলছি আর কি। আপনি যদি মাসুল্ডানা হন,

তো আপনারই। তবে আপনি যেমন বাজ পাখির কথা শুনে অবাক

হচ্ছেন, রানা কিন্তু হবে না। কারণ, দুর্গে এক রাত ছিল সে, তখন

বাজপাখির একটা পালক পড়ে থাকতে দেখেছে। ব্যাটার চোখও

তো বাজপাখির মতই তীক্ষè। তো যা বলছিলাম। রানাকে কিভাবে

মারা হবে তা নিয়ে আমার ও মিস্টার ভবনিয়ার মধ্যে মতপার্থকঞ্জাছে। আপনিও যেহেতু আমাল্ডে একজন পার্টনার, এ-ব্যাপারে

আপনার মতামতও আমাল্ডে জানা ল্ডকার। বলুন, মি. খাস্ত

গীর, আপনি কিভাবে খুন করতে চান মাসুল্ডানাকে?’ অস্থির ও

উ™£ান্ত লাগছে কবীর চৌধুরীকে।

‘খুন করাটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়,’ বলল রানা।

‘যে-কোন একটা পদ্ধতি বেছে নিলেই হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো

ইন্টারোগেট করে তথঞ্জাদায়। আমি অন্তত সাতদিন বাঁচিয়ে

রেখে কথা বলাতে চাই ওকে।’

‘হুম। আইডিয়াটা মন্দ নয়।’ আবার পায়চারি শুরু করল

কবীর চৌধুরী। ‘আমরা সাবমেরিনে চড়ে নিচে নামছি না কেন

বলুন তো? আগে শুনতে চাই আমার ছেলে কি রিপোর্ট করে। ওর

গোপন শত্র“

১৬১



রিপোর্ট থেকে আন্দাজ পাওয়া যাবে মাসুল্ডানা কতটা বাড়

বেড়েছে।’

‘হিসাবে কি একটা ভুলের কথা বলছিলেন যেন?’

‘আমার ধারণা ছিল দুর্গে হানা দেবে রানা,’ বলল কবীর

চৌধুরী। ‘কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এক ঢিলে দুই পাখি মারার

প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। দুর্গেও ঢুকবে, আবার আমাল্ডে আন্ডারওয়াটার

ফ্যাসিলিটিতেও হানা দেবে।’

‘এখন তাহলে উপায়?’ রাবারের মুখোশ এতই পাতলা যে

রানার মুখে চিন্তার রেখাগুলো প্রায় হুবহু ফুটল তাতে। ‘ধরুন,

এখন যèিাংলাদেশী নৌ ও বিমান বাহিনী ছুটে আসে, কি করব

আমরা?’

‘এই প−্যাটফর্ম আর সাবমেরিন যদি এখানে না থাকে, ওরা

জানবে কিভাবে তেলখনির মুখটা কোথায়?’ পাল্টা প্রশ্ন করল

কবীর চৌধুরী।

‘কিন্তু আপনিই তো এইমাত্র বললেন যে রানা আপনাল্ডে

আন্ডারওয়াটার ফ্যাসিলিটিতে হানা দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।’

একটু থতমত খেয়ে গেল কবীর চৌধুরী। ‘হ্যাঁ, বলেছিÑহানা

দেবে, বা দিতে পারবে, যজ্ঝিামাল্ডে মধ্যে তার কোন চর

লুকিয়ে থাকে।’

‘আছে নাকি?’

‘এখানেও হিসেবে একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি আমি,’

বলল কবীর চৌধুরী। ‘চর একজন আছে। বোকার মত আমি

তাকে সার্চ না করে এখানে নিয়ে এসেছি। সে আমার বোকামির

সুযোগ নিয়ে খবর পাঠাচ্ছে...’ কথা বলছে, একই সঙ্গে হাত দিয়ে

ইশারাও করছে সে।

চোখের কোণ দিয়ে রানা লক্ষ করল, কপ্টারের পাশে স্ফাড়ানো

গানার ও রেডিও অপারেটরের হাতে পিস্তল বেরিয়ে এসেছে।

১৬২

মাসুল্ডানা-৩১৬



অত্যন্ত সাবধানে, দু’দিক থেকে ধীর পায়ে রানার দিকে এগিয়ে

আসছে তারা।

কিন্তু রানার কাছে তারা পৌঁছাবার আগে আরেক ঘটনা

ঘটল। কনিং টাওয়ারে আবার উদয় হলো খায়রুল কবীর।

সাংঘাতিক নার্ভাস। ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, ড্যাড। জ্ঝোর কামিং!’

‘হোয়াট!’ বাঘের মত হুঙ্কার ছাড়ল কবীর চৌধুরী।

‘ওল্ডে চালাকি আমরা ধরতে পারিনি, ড্যাড!’ বলল খায়রুল,

থরথর করে কাঁপছে। ‘তিনটে সাবমেরিন আসছেÑবাংলাদেশী

উপকূল থেকে নয়, ভারতের দিক থেকে। সেজন্যেই ওগুলোকে

বাংলাদেশী বলে চিনতে দেরি হয়ে গেছে, ড্যাড। আর মাত্র

পঞ্চাশ মাইল দূরে ওগুলো।’

গানার ও রেডিও অপারেটরের দিকে তাকাল কবীর চৌধুরী।

‘অ্যারেস্ট হিম!’ গর্জে উঠল সে। ‘তারপর সার্চ করো! ওর কাছে

নিশ্চয়ই মাইক্রোফোন আছে।’

‘হোয়াট!’ খায়রুল যেন আকাশ থেকে পড়ল। ‘কে উনি? কি

করেছেন?’

‘বলো কি করেনি!’ নিজের মাথার চুলে আঙুল চালাল কবীর

চৌধুরী। ‘তবে ও শালা যা-ই করুক, সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে

বসেছি আমি নিজেই। ও মাসুল্ডানা, খায়রুল! আমি ওকে নিয়ে

একটু নাটক করতে চেয়েছিলাম, এখন তার খেসারত দিতে

হবে...’

অকস্মাৎ প্রচণ্ড একটা শব্দ হলো, যেন কাছেই অত্যন্ত

শক্তিশালী কোন বোমা ফাটল।

‘সনিক বুম!’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল খায়রুল।

সে থামতে না থামতে ওল্ডে মাথার ওপর দিয়ে সগর্জনে ছুটে

গেল একটা মিগ ফাইটার পে−ন। সাউন্ড ব্যারিয়ার ভাঙার ওই

বিকট শব্দ আরও কয়েকটা শোনা গেল, মাথার ওপর দিয়ে

গোপন শত্র“

১৬৩



সুপারসনিক স্পীডে ছুটে গেল এক ঝাঁক মিগ।

সাদা কভারঅল পরা এক লোককে দেখা গেল কনিং

টাওয়ারের মুখে। আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে আছে তার চোখ।

‘এটা একটা ফুল-ফ্লেজড্ অ্যাটাক, স্যার! উপকূল থেকে এক ঝাঁক

হেলিকপ্টার গানশিপ রওনা হয়েছে। পিছু নিয়ে আসছে তিনটে

যুদ্ধ জাহাজ। সাবমেরিনগুলোও ফুল স্পীডে ছুটে আসছে।’

রানার দিকে আঙুল তাক করল খায়রুল কবীর। ‘কিল হিম,

ড্যাড! কিল হিম!’

‘ওয়েট!’ একটা হাত তুলে ছেলেকে থামিয়ে দিল কবীর

চৌধুরী। ‘ওকে নিয়ে কি করব, সে আমার মনই জানে। তুমি

সাবমেরিন নিয়ে নিচে যাও, খায়রুল। রেড অ্যালার্ট ঘোষণা

করো, সবাইকে জানিয়ে দাও দশ মিনিটের মধেঞ্জান্ডারওয়াটার

ফ্যাসিলিটি ত্যাগ করতে হবে...’

‘কিন্তু ড্যাড, দশ মিনিটের মধ্যে কি করে তা সম্ভব!’ প্রতিবাদ করল খায়রুল। ‘ফল্টের নিচে আমাল্ডে এক্সপার্ট ও

টেকনিশিয়ানরা কাজ করছে, উঠে আসতেই তো বিশ মিনিট

লাগবে...’

‘সেক্ষেত্রে ওল্ডেকে কিছু জানাবার ল্ডকার নেই,’ বলল কবীর

চৌধুরী। ‘শুধু কলোনিতে যারা আছে তাল্ডেকে অন্য দুটো

সাবমেরিনে উঠতে বলো। বাকি যারা থেকে যাবে, তাল্ডে কপাল

খারাপ।’

‘ড্যাড, তুমি আমাল্ডেকে পালাতে বলছ কেন?’ খায়রুল

হতভম্ব। ‘আমরা জানতাম এরকম পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে,

সেজন্যে যথেষ্ট প্রস্তুতিও নেয়া আছে। তিন ন¤ল্ফ প−্যাটফর্মে

আমাল্ডে যে ফায়ার পাওয়ার মজুল্ডাখা হয়েছে, ওগুলো কাজে

লাগালে বাংলাদেশ নৌ আর বিমানবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হবে...’

১৬৪

মাসুল্ডানা-৩১৬



‘আপাতত। কিন্তু তারপর? ওরা আমাল্ডে ফ্যাসিলিটির

পজিশন জেনে ফেলেছে, খায়রুল। কাজেই এখন...’

রানার দিকে আবার আঙুল তাক করল খায়রুল। ‘এই একটা

লোকের কাছে বারবার হার মানতে হবে আমাল্ডে?’

কবীর চৌধুরীর নির্দেশ মত গানার ও রেডিও অপারেটর

রানার হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধেছে ঠিকই, কিন্তু ঘটনার

আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ায় এখনও ওকে সার্চ করেনি।

‘না, খায়রুল, এটা আমাল্ডে পরাজয় নয়,’ বলল কবীর

চৌধুরী। ‘পরাজয় বলা যেত, যদি তেলখনিটা আমাল্ডে কাছ

থেকে কেড়ে নিতে পারত ওরা। তা তো পারছে না। তবে রানা

যে বারবার আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, এর একটা চূড়ান্ত

বিহিত না করলেই নয় আর। জানি, জিজ্ঞেস করলে জবাব

দেবেÑআমাল্ডে বিরুদ্ধে লাগাটা ওর দেশপ্রেমের অঙ্গ।’ হঠাৎ

হাসল সে। ‘তুমি শুনে খুশি হবে, মাই সান, রানার ওই

দেশপ্রেমের কঠিন একটা পরীক্ষা নেব আজ আমি। এখুনি প্রমাণ

হয়ে যাবে, ওর দেশপ্রেম কতটা নির্ভেজালÑসত্যি কি নিজের চেয়ে

দেশকেই বেশি ভালবাসে ও? এই প্রশ্নটা অনেক দিন ধরে বিরক্ত

করছে আমাকে। আজ আমি উত্তরটা চাই।’ সুটের ভেতরের

একটা পকেটে হাত ঢোকাল সে।

এই সময় পশ্চিম আকাশে একটা বেসামরিক হেলিকপ্টার

দেখা গেল। দেখেই চিনতে পারল রানা। এটাই ভাড়া করেছিল

যমুনা। গায়ের ইন্টারপোল লেখাটা পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে। বিশেষ

কেমিকেল কমপাউন্ডের প্রলেপ দেয়ায় কবীর চৌধুরীর রকেট

অপারেটরের মনিটরে বা কোন রাডারে এতক্ষণ ধরা পড়েনি

ওটা। রানা জানে, ওর আর কবীর চৌধুরীর সব কথা

মাইক্রোফোন হয়ে সোহেলের কানে পৌঁছে গেছে, সব শোনার

পর ওই হেলিকপ্টার থেকেই বাংলাদেশকে সতর্ক করে দিয়েছে

গোপন শত্র“

১৬৫



সে।

মিগ ফাইটারগুলো ঝাঁক বেঁধে চক্কর দিচ্ছে আকাশে।

আরেকটা ঝাঁক দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেছে, কে জানে কোথায়।

উত্তর দিগন্তে এক সারিতে কয়েকটা যুদ্ধজাহাজ উদয় হলো,

মাস্তুলে পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশী পতাকা, ছুটে আসছে

ফুল স্পীডে। ওগুলোর মাথার ওপর দেখা গেল এক ঝাঁক

হেলিকপ্টার গানশিপ।

‘ড্যাড!’ সাবমেরিনের কনিং টাওয়ার থেকে চিৎকার করে

উঠল খায়রুল। ‘ঠিক কি করতে চাইছ বলো আমাকে। তোমাকে

এরকম বিপল্ডে মুখে ফেলে কোথাও আমি যাচ্ছি না।’

পকেট থেকে হাতটা এতক্ষণে বের করল কবীর চৌধুরী।

ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসছে সে। ‘চিনতে পারছ, মাই সান?

তোমার নিজের হাতে তৈরি ডিভাইস এটা। লাল বোতামটা

টিপতে যা দেরি, পানির তলায় গিরিখাল্ডে দুপাশের দেয়ালে

বসানো দুই টন জেলিগনাইট বিস্ফোরিত হবে। কয়েক লাখ টন

মাটি আর পাথর ধসে পড়বে, চিরকালের জনেল্টন্ধ হয়ে যাবে

ফল্টেটা, সেই সঙ্গে চাপা পড়বে তেল খনির উৎসমুখ...’

‘না, ড্যাড, না!’ হাহাকার করে উঠল খায়রুল। ‘এত বড়

একটা সম্পদ এভাবে ধ্বংস করে দিয়ো না...’

‘যে জিনিস আমাল্ডে কোন কাজে লাগবে না, তাকে সম্পèলি কিভাবে? তাছাড়া, এই তেলখনি থেকে টাকা তো আমরা কম

কামাইনি, খায়রুল।’

‘তাই বলে ধ্বংস করে দিতে হবে!’

‘রানা যাল্ডেকে খবর দিয়ে আনিয়েছে তাল্ডে সুবুদ্ধির উদয়

হলে ধ্বংস করার প্রয়োজন পড়বে না,’ বলল কবীর চৌধুরী।

‘বাংলাদেশ ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে একটা আপস রফায়

আসতে পারে।’

১৬৬

মাসুল্ডানা-৩১৬



‘কিন্তু ড্যাড, তুমি কি ওল্ডেকে প্রস্তাব দেয়ার সময় পাবে?’

উদ্বেগে অসুস্থ দেখাচ্ছে খায়রুলকে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে

যুদ্ধজাহাজ ও হেলিকপ্টার গানশিপ কত কাছে এল দেখে নিল সে,

তারপর মিগগুলোর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করল।

‘রানাকে নিয়ে এখন আমি হেলিকপ্টারে চড়ব,’ বলল কবীর

চৌধুরী। ‘ওর কাছে নিশ্চয়ই মাইক্রোফোন আছে, কাজেই

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে কোন সমস্যা হবে না। আমার

প্রথম শর্ত, আধাআধি বখরা চাই। দ্বিতীয় শর্ত, রানার বেঁচে থাকা

চলবে না। তেলের অর্ধেক বখরা পাবার বিনিময়ে ওকে হারাতে

হবে। শুধু এই দুটো শর্ত মানা হলে আন্ডারওয়াটার ফ্যাসিলিটি

যেমন আছে তেমনি থাকবে। তা না হলে এই ডিভাইস বল্টহার

করব আমি, লাল বোতাম টিপে èে। শক ওয়েভ সাবমেরিনের

মারাত্মক ক্ষতি করবে, মাই সান, কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব

দূরে সরে যাও তোমরা...’

‘কিন্তু তুমি যে বললে রানাকে পরীক্ষা করবে?’ ঘন ঘন

মিগগুলোর দিকে তাকাচ্ছে খায়রুল। পশ্চিমে হারিয়ে যাওয়া দুটো

মিগ ফিরে এল আবার।

কবীর চৌধুরী হাসল। ‘হ্যাঁ, করবই তো। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস

করাটা কি উচিত হবে? তুমি যাও, খায়রুল।’

বাপের নির্দেশ মেনে নিতে পারছে না খায়রুল। ‘কিন্তু,

ড্যাড...’

খায়রুলের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চিন্তা করার খানিকটা সময় এনে দিল

রানাকে। কবীর চৌধুরী বলছে, হেলিকপ্টার নিয়ে আবার আকাশে

উঠবে সে, তার সঙ্গে রানাও থাকবে। জানা কথা, রানাকে জিম্মি

হিসেবে বল্টহার করতে চায় সে, ওর সঙ্গে থাকা মাইক্রোফোনের

মাধ্যমে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে নিজের শর্ত জানিয়ে আপস রফার

প্রস্তাব দেবে।

গোপন শত্র“

১৬৭



কবীর চৌধুরীর প্রস্তাবে পাগল ছাড়া আর কেউ রাজি হবে

না। বাংলাদেশেরও রাজি হবার কথা নয়। প্রথম কারণ, একজন

সন্ত্রাসীর কাছে নতি স্বীকার করা যে-কোন দেশের জনেঞ্জত্যন্ত

অসম্মানজনক ও নীতিবিরুদ্ধ একটা কাজ। দ্বিতীয় কারণ, যে

চুক্তিই হোক, কবীর চৌধুরী সে চুক্তি ভেঙে ছলে-বলে-কৌশলে

বেশিরভাগ বা পুরোটা তেল মেরে দেয়ার চেষ্টা করবে। না, কবীর

চৌধুরীর সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বের বল্টসা করা বাংলাদেশের

উচিত হবে না। কিন্তু কবীর চৌধুরী তো প্রস্তাবের সঙ্গে জিম্মিকে

খুন করার শর্তও দেবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কি করবে?

দেশের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিতে রানার আপত্তি নেই। কিন্তু

নিজের প্রাণের বিনিময়ে দেশ উপকৃত হবে কিনা, এ-ব্যাপারে

পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে ওকে।

দ্রুত হিসাব করল রানা। হাতে খুব একটা কম সময় নেই।

খায়রুল এখনও কনিং টাওয়ারে স্ফাড়িয়ে বাপের সঙ্গে তর্ক

করছে। সাবমেরিন নিয়ে সারফেস ত্যাগ করার পরও

আন্ডারওয়াটার ফ্যাসিলিটি ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে অন্ত

ত পনেরো থেকে বিশ মিনিট সময় লাগবে তার। ছেলের

নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে জলমগ্ন গিরিখাল্ডে গায়ে

বসানো বিস্ফোরক ফাটাবে না কবীর চৌধুরী। এই সময়সীমার

ভেতরই কিছু একটা করতে হবে রানাকে। হাত বাঁধা থাকলেও,

ওর যে কিছু করার নেই তা নয়।

পিছমোড়া করে বাঁধা রানার হাতের আঙুল বেল্টের একটা

বোতাম ছুঁয়ে আছে। বেল্টটাই রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস, ইচ্ছে

করলে এখুনি হেলিকপ্টারটা উড়িয়ে দিতে পারে রানা। প−্যাটফর্মটা

খুব বড় নয়, হেলিকপ্টারের ফুয়েল ট্যাংক বিস্ফোরিত হলে

পাইলট, গানার, রকেট অপারেটর, রানা ও কবীর চৌধুরীর মারা

যাবার কথা; এমনকি কনিং টাওয়ারে স্ফাড়িয়ে থাকা খায়রুলও

১৬৮

মাসুল্ডানা-৩১৬



হয়তো বাঁচবে না।

হঠাৎ কোন আবেগ নয়, অকাট্য যুক্তি রানাকে আত্মহত্যা

করার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে বলছে। হিসাবটা এত সহজ যে

লোভটা সামলানো অত্যন্ত কঠিন বলে মনে হলো ওর। সাগরের

তলায় রয়েছে শত-সহস্র কোটি টাকার তরল সোনা, এর

পুরোটারই বৈধ মালিক বাংলাদেশ। এই তেল পেলে তেরো কোটি

বাঙালী প্রাচুর্যের মুখ দেখবে, একজন লোকও গরীব থাকবে না।

তেরো কোটি মানুষকে ধনী করে দেয়ার বিনিময়ে যদি মরে যেতে

হয়, সেই মৃতুশু চেয়ে গৌরবের আর কিছু আছে কি? এই মুহূর্তে

যদি কবীর চৌধুরী মারা যায়, তেল খনির উৎসমুখ হাজার কোটি

টন পাথরের নিচে চাপা পড়বে না। আর তাকে মারতে হলে,

নিজেকেও রানার মারতে হবে। সহজ হিসাব, দুইয়ে দুইয়ে চার।

কবীর চৌধুরী ছেলের ওপর বিরক্ত, বলছে, ‘তুমি অযথা সময়

নষ্ট করিয়ে দিচ্ছ, খায়রুল। এক ঢিলে দুই পাখি মারার এই

সুযোগ আমি ছাড়তে পারি না। বাংলাদেশ সরকার আমার শর্ত

দুটো মেনে নিলে কি লাভ ভেবে দেখেছ? তেল বিক্রির টাকা

এখন চার ভাগ হয়ে যাচ্ছে, তখন হবে দু’ভাগÑঅর্থাৎ আমাল্ডে

আয় আরও বাড়বে। ফোরবল-এর কোন অস্তিত্বই থাকবে না।

লাভ শুধু এখানেই নয়Ñমাসুল্ডানা না থাকলে আমাল্ডে প্রতিটি

প্রজেক্ট এখন থেকে সাফলেশু মুখ দেখবে...’

‘কিন্তু, ড্যাড...,’ খায়রুল আতঙ্কিত, কারণ যুদ্ধজাহাজগুলো

আর দশ মাইল দূরেও নয় এখন।

‘শাট আপ!’ গর্জে উঠল কবীর চৌধুরী। ‘বেআদবি না করে

যা বলছি করো। এখুনি নেমে যাও সাবমেরিন নিয়ে।’ হাতঘড়ি

দেখল সে। ‘এখন থেকে ঠিক পনেরো মিনিট পর বোতামে চাপ

èে আমিÑওরা যজ্ঝিামার শর্ত না মানে। আর কোন কথা নয়,

খায়রুল, এবার তুমি যাও।’

গোপন শত্র“

১৬৯



‘সরি, ড্যাড,’ দৃঢ় একটা ভঙ্গি নিয়ে বলল খায়রুল।

‘তোমাকে ফেলে কোথাও যাচ্ছি না আমি।’ কনিং টাওয়ার থেকে

বেরিয়ে এল সে, লাফ দিয়ে সাবমেরিন থেকে প−্যাটফর্মে চলে

এল। ‘হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে উঠবে? বেশ, আমিও তোমার

সঙ্গে থাকব।’ অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে হেলিকপ্টারের দিকে

এগোল সে।

ছেলের পিছু নিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল কবীর

চৌধুরী।

গানার ও রকেট অপারেটর বন্দী রানাকে নিয়ে কপ্টারে

চড়ল। জ্যাকেটটা সীটের পিঠ থেকে নিয়ে রানার কোলের ওপর

ফেলল পাইলট। খায়রুল বসল রানার ডানপাশের খালি সীটটায়,

একটু পিছনে; আরেক দিকে কবীর চৌধুরী, আগের সেই বাঁ

পাশের সীটেই।

‘খায়রুল, সীটের সঙ্গে বাঁধো রানাকে,’ ছেলেকে নির্দেশ দিল

কবীর চৌধুরী। ‘কখন কি করে বসে, সাবধানের মার নেই।’

পাইলটের কাছ থেকে এক প্রস্থ রশি চেয়ে নিয়ে সীটের সঙ্গে

পেঁচিয়ে রানাকে বাঁধল খায়রুল।

সবাই আবার হেডসেট পরছে মাথায়, কবীর চৌধুরী বলল,

‘রানার মাথাতেও পরাও। ওর মাধ্যমেই বাংলাদেশকে প্রস্তাবটা

èে আমি।’

রানার মনে আশ্চর্য এক উল−াস। ওর একটা আঙুল এখনও

রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসের বোতামটা ছুঁয়ে আছে। দু’বার টিপে

দিলেই কোলের ওপর রাখা শক্তিশালী জেলিগনাইট বিস্ফোরিত

হবে। সৌভাগ্যই বলতে হবে, একা শুধু কবীর চৌধুরী নয়, তার

কুখ্যাত ছেলে খায়রুলও হেলিকপ্টারে উঠেছে। বোতাম টিপলে

শুধু যে চৌধুরী বংশ ধ্বংস হবে, তা নয়, সেই সঙ্গে তেলখনিটাও

অক্ষত অবস্থায় পেয়ে যাবে বাংলাদেশ। এখন শুধু ল্ডকার

১৭০

মাসুল্ডানা-৩১৬



আত্মত্যাগের ইচ্ছাটাকে কাজে পরিণত করা।

তবে আবেগের বশে হুট করে কিছু করে বসতে রাজি নয়

রানা। দেশের স্বার্থে প্রাণ দিতে হয় দেবে, তবে তার আগে এ-ও

দেখবে যে এমন কোন বল্টস্থা করা যায় কিনা যাতে সাপও মরে

আবার লাঠিও যেন না ভাঙে।

ইতিমধ্যে সারফেস থেকে নিচে নেমে গেছে সাবমেরিন।

প−্যাটফর্মকে ঘিরে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর চারটে হেলিকপ্টার

গানশিপ চক্কর দিচ্ছে বিরতিহীন। গোটা আকাশ নিজেল্ডে

নিয়ন্ত্রণে রেখে ঝাঁক বেঁধে চারদিকে উড়ছে মিগ ফাইটারগুলো।

তিনটে যুদ্ধজাহাজ প−্যাটফর্ম থেকে এখন মাত্র তিন কি চার মাইল

দূরে।

হেলিকপ্টার প−্যাটফর্ম ত্যাগ করার পর কবীর চৌধুরী

পাইলটকে নির্দেশ দিল, ‘রেডিও অন করো, হে। দেখো কার

সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো। পরিচয় জানিয়ে তাকে বলো,

রানা কথা বলতে চায়।’

অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল রানা। ‘সোহেলকে তো তুমি

চেনোই, কবীর চৌধুরী। আমাল্ডে সব কথা শুনতে পাচ্ছে ও।

শুধু তাই নয়, বিসিআই চীফ, অর্থাৎ আমার বসের সঙ্গেও সরাসরি

যোগাযোগ আছে ওর।’ খোলা ল্ডজা দিয়ে বাইরে তাকাল ও।

‘যুদ্ধজাহাজগুলোর মাথার ওপর ওই যে বেসামরিক হেলিকপ্টারটা

দেখছ, ওটাতেই আছে সোহেল। একটু চেষ্টা করলেই ওর

ফ্রিকোয়েন্সি পেয়ে যাবে পাইলট। সোহেলই তখন জানাবে

তোমার প্রস্তাব শুনে বাংলাদেশ কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’

‘ভেরি গুড!’ উল−াসে অধীর হয়ে উঠল কবীর চৌধুরী। ‘এখন

দেখার বিষয়, আমার জীবনের মূর্তিমান অভিশাপ মাসুল্ডানাকে

কোটি কোটি ব্যারেল তেল পাবার বিনিময়ে বলি দিতে রাজি হয়

কিনা বিসিআই তথা বাংলাদেশ। আগেই বলেছি, তোমার জন্যে গোপন শত্র“

১৭১



এটা একটা কঠিন পরীক্ষা, রানা। গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনব আমরা

সোহেলকে তুমি কি বলো। তোমার দেশপ্রেম কি এতই প্রবল যে

সোহেলকে অনুরোধ করবে বাংলাদেশ যাতে আমার প্রস্তাব মেনে

নেয়? দেশকে ভালবেসে আমার হাতে মরতে তুমি আপত্তি করবে

না?’

‘আবার না কেঁদে ফেলে,’ রানার আরেক পাশ থেকে বলল

খায়রুল। ‘সমস্ত অতীত অপরাধের জন্যে ক্ষমা চেয়ে প্রাণ ভিক্ষার

জন্যে তোমার হাতে-পায়ে ধরলে আমি একটুও অবাক হব না।’

‘ধ্যাত্! নাহ্!’ কবীর চৌধুরীর গলায় কৃত্রিম তিরস্কার,

হাসছে। ‘রানাকে এত ছোট করে দেখা তোমার উচিত হচ্ছে না,

মাই সান। তুমি কি বলতে চাইছ, ওর আত্মসম্মান জ্ঞান বলতে

কিছুই নেই?’

অকস্মাৎ বাপ-বেটার গালে যেন কষে চড় মারল পাইলট।

‘স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে! দুটো সুপারট্যাংকার থেকে মেডে কল

পাচ্ছি আমি। মিগ ফাইটার থেকে রকেট ছোঁড়া হয়েছে, দুটোতেই

আগুন ধরে গেছে...’

‘এতক্ষণে বোঝা গেল দুটো মিগ কোথায় গিয়েছিল,’ স্ফাতে

স্ফাত চেপে হিসহিস করে বলল খায়রুল।

‘গোক্ষুরের লেজে পা দিয়েছে বাংলাদেশ,’ হেডসেটে কবীর

চৌধুরীর গলা পেল রানা। ‘এর পরিণতি যে কি ভয়াবহ হবে, ওরা

তা কল্পনাও করতে পারছে না। আমি এমন প্রতিশোধ নেব...’

‘তুমি শুধু হুমকিই দাও,’ অভিযোগের সুরে বলল খায়রুল,

‘সুযোগ থাকতে সেই হুমকি কাজে পরিণত করো না। আমি বলি

কি, ড্যাডÑমুঠোয় যখন পেয়েছি, আর দেরি করার কোন মানে হয়

না, মাথায় একটা গুলি করে রানাকে সাগরে ফেলে দাও এখুনি।’

‘আরও একটা দুঃসংবাদ, স্যার,’ বলল পাইলট; এটাকে চড়

না বলে পদাঘাত বলাই উচিত। ‘দুই ট্যাংকারের মেডে কল-এর

১৭২

মাসুল্ডানা-৩১৬



জবাবে ওল্ডে শিপিং কোম্পানি লা মর্তে ল্যাম্পি জানাচ্ছে, প্রশান্ত

ও আটলান্টিক মহাসাগরে ওল্ডে যে আরও পাঁচটা সুপাট্যাংকার

রয়েছে, সেগুলো থেকেও মেডে কল রিসিভ করছে তারা।’

‘হোয়াট!’

‘ওগুলোতেও আগুন জ্বলছে, স্যার। সন্দেহ করা হচ্ছে, রানা

এজেন্সির ডুবুরীরা নোঙর করা দুটো ট্যাংকারে লিমপেট মাইন

আটকে রেখে গিয়েছিল। তৃতীয় ট্যাংকারে বারোটা গ্রেনেড ছোঁড়া

হয়েছে গ্রেনেড লঞ্চারের সাহায্যেÑপাশ কাটাবার সময় একটা

ইয়ট থেকে। বাকি দুটো ট্যাংকারে বেসামরিক হেলিকপ্টার থেকে

বোমা ফেলা হয়েছে। প্রতিটি স্যাবটাজের জনেশুানা এজেন্সিকেই

দায়ী করছে লা মর্তে ল্যাম্পি।’

‘কেন?’

‘কোম্পানির হেড অফিসকে টেলিফোনে প্রস্তাব দেয়া

হয়েছিল, তাল্ডে সবগুলো সুপারট্যাংকার যেন চট্টগ্রাম বন্দরে

পাঠিয়ে দেয়া হয়। শুনে হাসাহাসি করছিল ওরা। তারপরই এই

ঘটনা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেলিফোনটা করা হয়েছিল রানা

এজেন্সির হেড অফিস, লন্ডন থেকে।’

কবীর চৌধুরী বলল, ‘রানা এজেন্সির কপালও তাহলে পুড়ল।

দ্যুমা স্ফ্যেতা চেরোকির সঙ্গে লাগার ফল এবার টের পাবে ওরা।’

‘না, স্যার,’ তাড়াতাড়ি বলল পাইলট। ‘আমি আরও যে-সব

মেসেজ পাচ্ছি, তাতে দেখা যাচ্ছে দ্যুমা স্ফ্যেতা চেরোকি অসুস্থ

হয়ে পড়েছেন। হসপিটালের বেড থেকে বলেছেন, যেহেতু

আপনি তাঁকে এই বল্টসায় নামিয়েছেন, তাই রানা এজেন্সির

বিরুদ্ধে যা করার আপনাকেই করতে হবে। আপনি এই দায়িত্ব

পালনে ব্যর্থ হলে চেরোকি আপনাকে এক হাত দেখে নেবেন বলে

হুমকিও দিয়েছেন।’

সে থামতেই খায়রুল বলল, ‘আমি বলি কি, ড্যাড, রানার

গোপন শত্র“

১৭৩



সঙ্গে তোমার পাইলটকেও সাগরে ফেলে দাও। একের পর এক

এত দুঃসংবাদ, মনটাই ভেঙে দিচ্ছে...’

‘তুমি প্রলাপ বকছ!’ ছেলেকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিল

কবীর চৌধুরী। তারপর পাইলটকে বলল, ‘ওর মাথার ঠিক নেই,

তুমি কিছু মনে কোরো না। এখন দেখো দেখি, সোহেলের

ফ্রিকোয়েন্সি পাও কিনা।’

‘কিন্তু, স্যার...,’ শুরু করেও থেমে গেল পাইলট, যেন কথা

বলতে ভয় পাচ্ছে। ‘না, থাক।’

‘কি ব্যাপার? আরও কোন দুঃসংবাদ নাকি?’ মারমুখো হয়ে

জানতে চাইল খায়রুল।

‘মাফ করবেন, স্যার,’ ভয়ে ভয়ে বলল পাইলট। ‘ঘরে বউ-

বাচ্চা আছে, আপনারা আমাকে সাগরে ফেললে তারা না খেয়ে

মরবে।’

‘তারমানে তুমি কোন মেসেজ চেপে যাচ্ছ।’ কবীর চৌধুরীর

গলায় অবিশ্বাস। ‘কি! এত বড় স্পর্ধা তোমার? কার মেসেজ

তাড়াতাড়ি বলো, তা না হলে...’

‘আমি এখন যাই কোথায়!’ প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা হলো

পাইলটের। ‘বাপ বলেন ঝেড়ে কাশ, ছেলে বলে মরতে চাস,

আমার তো গলায় ফাঁস।’

‘এটা কাব্যচর্চার সময় নয়,’ ধমক দিল কবীর চৌধুরী। ‘কার

মেসেজ? কি বলল?’

‘আমাল্ডে মাত্র একটা সাবমেরিন পালাতে পেরেছে, স্যার,’

বলল পাইলট। ‘বাকি দুটোকে টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দিয়েছে

ওরা।’

খায়রুলের প্রতিক্রিয়া হলো তাৎক্ষণিক। ‘ড্যাড, এখনও তুমি

রানাকে বাঁচিয়ে রাখবে?’

‘শাট আপ!’ ছেলেকে চুপ করিয়ে দিয়ে কবীর চৌধুরী

১৭৪

মাসুল্ডানা-৩১৬



পাইলটকে বলল, ‘এই মেসেজ কে দিল তোমাকে?’

‘কেউ দেয়নি, স্যার,’ বলল পাইলট। ‘ঢাকা থেকে রাহাত

খান নামে কোন ভদ্রলোককে রিপোর্ট করছিল বাংলাদেশ নৌ-

বাহিনীর একজন ন্যাভাল অফিসার, সেই রিপোর্ট আমি শুনে

ফেলেছি। আরও শুনলাম...’

‘থামলে কেন, বলো আর কি শুনলে!’

‘ঢাকার ওই ভদ্রলোক সোহেল নামে এক ভদ্রলোককে কিছু

তথদ্দ নির্দেশ দিলেন, স্যার।’

‘তথ্য? নির্দেশ?’

‘জ্বী, স্যার।’ ঘন ঘন ঢোক গিলছে পাইলট। ‘আমরা এখানে

যা বলছি, ওরা সব শুনতে পাচ্ছে, স্যার। আপনার প্রস্তাব শুনে

ভদ্রলোক বললেন, ওটা ভুয়া। আপনার শর্তে ওরা রাজি হলেও

আপনি নাকি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আন্ডারওয়াটার ফ্যাসিলিটি ধ্বংস

করে দেবেন। বলছেন, আপনি নাকি পাগল-ছাগল মানুষ, কথার

দাম নেই। তাই ওঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমাল্ডে সঙ্গে কোন

কথাই বলবেন না। শুধু তাই নয়, সাবমেরিন ও

যুদ্ধজাহাজগুলোকে প−াটফর্ম থেকে অন্তত পাঁচ মাইল দূরে সরে

যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

‘আমার ড্যাডকে পাগল-ছাগল বলল?’ খায়রুল হতভম্ব।

‘তারমানে ওরা তেল চায় না?’ কবীর চৌধুরী বিমূঢ়।

‘আমার কথা শেষ হয়নি, স্যার,’ বলল পাইলট। ‘আসল

তথন্ধাই আপনাকে বলা হয়নি।’

‘কি?’ নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখে জানতে চাইল

পাগল বিজ্ঞানী।

‘পানির তলার ওই তেলখনির মুখ আমরা ধ্বংস করে দিলে

ওল্ডে নাকি তেমন কোন ক্ষতিই হবে না,’ বলল পাইলট।

‘লোকেশনটা জানা থাকায় পাথর আর মাটি সরিয়ে ওটা ওরা

গোপন শত্র“

১৭৫



ঠিকই পেয়ে যাবে। বলছে, খুব বেশি হলে মাত্র তিন বছর সময়

লাগবে।’

‘শালা বুড়ো তো দেখছি ভারি ধড়িবাজ!’ বিড় বিড় করল

কবীর চৌধুরী। ‘কিন্তু রানা? রানার ব্যাপারে কি ভাবছে? নাকি

ওকে যে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটাও ভুয়া বলে মনে

করছে?’

‘ওই ভদ্রলোক, রাহাত খান, বললেনÑরানা নাকি নিজেকে

ঠিকই রক্ষা করতে পারবে।’

‘রেডিওর সঙ্গে আমার হেডসেটের কানেকশন দাও!’ থমথমে

গলায় নির্দেশ দিল কবীর চৌধুরী। কানেকশন পেতেই চিৎকার

জুড়ে দিল সে, ‘শুনুন, বিসিআই চীফ, বুড়ো বয়সে আপনাকে

ভীমরতিতে ধরেছে, তা না হলে আমার লোভনীয় প্রস্তাবটাকে ভুয়া

বলতেন না। শুনুন, বাংলাদেশের তেরো কোটি হাভাতের মুখ

চেয়ে শেষ একটা সুযোগ দিচ্ছি আমি, গ্রহণ করা না করা

আপনার ব্যাপার। দশ পর্যন্ত গুনব আমি, এর মধেঞ্জামার প্রস্ত

াবে রাজি না হলে দুই টন বিস্ফোরক ফাটিয়ে দিয়ে ফল্টটা বন্ধ

করে èে। তিন বছর নয়, জঞ্জাল সরিয়ে তেলখনির মুখটা বের

করতে সময় লাগবে আপনাল্ডে কম করেও পঞ্চাশ বছর, আর

খরচ পড়বে সব মিলিয়ে ছয়শো হাজার কোটি ডলার। এই

পরিমাণ অতিরিক্ত টাকা বাংলাদেশের নেই, কাজেই তেলের মুখ

কোনকালেই দেখতে পাবেন না। যাই হোক, প্রস্তাব না মানলে

প্রথমে রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসের বোতামে চাপ èে, তারপর

পিস্তলের ট্রিগারে। আজ আপনি কার মুখ দেখে উঠেছিলেন বলুন

তো? তেল ও রানা, দুটোই হারাতে যাচ্ছেন। আমি

গুনছিÑএক...দুই...তিন...’





১৭৬

মাসুল্ডানা-৩১৬













বারো



গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সাত বছরের ছোট্ট রানা কাশবনে

হারিয়ে গেছে, কাঁদতে কাঁদতে কখন নদীর ধারে চলে এসেছে

নিজেও জানে না, উঁচু পাড় থেকে গড়িয়ে ঝুপ করে পানিতে পড়ে

তলিয়ে গেল। রূপালি এক ঝাঁক মাছ দূর থেকে আড়চোখে

দেখছে ওকে। কাছেই ছিল এক নৌকার মাঝি। সেই প্রৌঢ়

মাঝির মুখ অনেক চেষ্টা করেও আজ আর মনে করতে পারে না

রানা। সেজনেল্টুকে একটা চিনচিনে কষ্ট লাগছে। হায়, তার

সেই ঋণ তো পরিশোধ করা হলো না!

রানা তখন বোধহয় আরও ছোট। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে

গেছে। ঘরের গাঢ় ছায়াগুলোকে জ্যান্ত প্রাণী মনে হচ্ছে, ভূতের

ভয়ে কাঁটা দিচ্ছে গা। কান্না শুনে বুকে টেনে নিলেন মা। মায়ের

গায়ের সেই গন্ধ আজও লেগে আছে নাকে। গায়ে-মাথায় হাত

বুলিয়ে সেদিন অভয় দিয়েছিলেন তিনি। চোখের সামনে আজও

তাঁকে দেখতে পাচ্ছে রানা, বলছেনÑ‘ভয় কি, বাপ, আমার

কাছেই তো আসবি...আয়, চলে আয়।’

নদীর কলকল, বৃষ্টির র্ঝির্ঝি, পাতার খসখস, পাখির

কলকাকলি, বাতাসের শোঁ-শোঁ, প্রকৃতি মায়ের সমস্ত বিচিত্র ¯ল্ফ

একযোগে একই দাবি জানিয়ে বলছে, ‘যেতে নাহি èি।’

তারপর চোখের সামনে ভিড় করে স্ফাড়াল অসংখ্য মানুষ, শিশু

গোপন শত্র“

১৭৭



থেকে বৃদ্ধ সব বয়সেরই আছে; কবে বা কিভাবে মনে পড়ে না,

শুধু মনে পড়ল এল্ডেকে বাঁচিয়েছিল ও। বলছে, ‘না! না!’

মেয়েগুলো সোহানার সঙ্গে এক জোট হয়ে চলে এল,

অনেককেই রানা ভাল করে চিনতে পারছে না। কান্না ভেজা সব

চোখে একই প্রশ্ন, ‘কেন যাবে? কোথায় যাবে?’

তারপর সোহেল। তাকে রানা রাগে ফেটে পড়তে দেখল।

‘এ কাজ করলে আমি তোকে ক্ষমা করব না। কখ্খনো না!’

তার জায়গায় রানা এখন রাহাত খানকে দেখতে পাচ্ছে।

হাসছেন তিনি। বললেন, ‘ইট’স আপ টু ইউ, মাই বয়। তুমি যা

ভাল বুঝবে তাই করবে! তোমার প্রতি আমার আশীর্বাদ থাকল।’

এরকম ছেঁড়া ছেঁড়া হাজারও স্মৃতি ভিড় করছে মনে।

তারপর রানা শুনতে পেল, কবীর চৌধুরী গুনছে,

‘...পাঁচ...ছয়...’

মাত্র এক কি দুই সেকেন্ডের মধ্যে জীবনের পুরো অতীত

ভ্রমণ করে এসেছে ও।

‘...সাত...আট...’

রানা ভয় পাচ্ছে না।

‘নয়...’ নাটকীয়তা আনার জন্যে বিরতি নিল কবীর চৌধুরী।

তারপর সুর করে উচ্চারণ করল, ‘দ-অ-অ-শ!’

এবার অন্তত প্রতিশ্র“তি ঠিকই রক্ষা করল কবীর চৌধুরী।

রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসটা তার হাতে আগেই বেরিয়ে এসেছিল,

দশ পর্যন্ত গোনা শেষ হতে লাল বোতাম পর-পর দু’বার টিপে

দিল।

বিস্ফোরণের কোন আওয়াজই ওরা শুনতে পেল না, তবে

দেখতে পেল নিচে থেকে মাথাচাড়া দিচ্ছে সাগরের বিশাল একটা

অংশ। দুশো ফুট ওপরে রয়েছে ওল্ডে হেলিকপ্টার, সরাসরি নিচে

সাগরের শান্ত সারফেস হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে উঠল, যেন প্রকাণ্ড

১৭৮

মাসুল্ডানা-৩১৬



একটা কুঁজ তৈরি হচ্ছে, তারপর কুঁজের সংখ্যা বাড়তে লাগল,

আকৃতি বদলে প্রতিটি বিপুল জলরাশির স্তম্ভ হয়ে উঠছে, জ্যান্ত

দানবের মত নাগাল পেতে চাইছে ওল্ডে। সাগরের এই

আকস্মিক উত্থান নিঃশব্দ নয়, তবে এর সঙ্গে তুলনা করা চলে

এমন কোন আওয়াজের সঙ্গে কেউই ওরা পরিচিত নয়। স্তম্ভগুলো

একেকটা পাহাড় যেন, স্বপ্ন; ভেতরে দেখা যাচ্ছে প্রকাণ্ড আকারের

পাথর, ভাঙা টাওয়ার ও প−্যাটফর্মের টন-টন লোহা ও ইস্পাত,

অক্সিজেন ভরা ট্যাংক, সাবমেরিনের ভাঙা অংশ, শত-শত মোটা

পাইপ আর মানুষের লাশ।

সাগরের তলায় চেইন রিয়্যাকশনে যতক্ষণ বিস্ফোরকগুলো

ফাটল, একের পর এক নতুন নতুন কুঁজ ও স্তম্ভ দেখতে পেল

ওরা। এক সময় ধীরে ধীরে নিচু হলো স্তম্ভগুলো, তার বদলে প্রায়

দুই বর্গমাইল জুড়ে শুরু হলো প্রবল আলোড়ন। যেন সবকিছু

উলটপালট করে দিয়ে সাগরের তলায় ভূমিকম্প হচ্ছে। উথলে

ওঠা সাগর থেকে দৈত্যাকার ঢেউ তৈরি হলো, একেকটা চলি−শ

থেকে পঞ্চাশ ফুট উঁচু। তিন কি চার মাইল দূরে স্থির হয়ে থাকা

যুদ্ধজাহাজগুলো ঘণ্টায় ষাট মাইল গতিতে ছুটে আসা সেই

ঢেউয়ের ধাক্কায় খড়কুটোর মত ভেসে যাচ্ছে আরও দূরে।

স্তম্ভগুলো ভেঙে পড়লেও, গোটা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে

বিপুল জলকণা, সূর্য সহ দশ দিগন্ত সেই ঘন কুয়াশার ভেতর

ঢাকা পড়ে গেল।

যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার গানশিপ, নিঃসঙ্গ বেসামরিক

হেলিকপ্টার বা মিগ ফাইটারগুলোকে ওরা এখন আর দেখতে

পাচ্ছে না, এমনকি সাগরের আলোড়িত সারফেসও কুয়াশার

আড়ালে পড়ে গেছে।

নিঃস্তব্ধতা ভাঙল কবীর চৌধুরী। ‘ছি-ছি, রানা, এই তোমার

দেশপ্রেম?’ হেসে উঠল সে। ‘বাংলাদেশের এত বড় একটা ক্ষতি

গোপন শত্র“

১৭৯



চোখের সামনে ঘটতে দেখেও একটিবার বাধা দিলে না তুমি?’

শান্ত ও চুপচাপ, রানাকে যেন বোবায় ধরেছে।

‘ভেবেছিলাম তোমার দেশপ্রেমের একটা পরীক্ষা নেব,’

আবার বলল পাগল বিজ্ঞানী। ‘কিন্তু তুমি যে এভাবে সাদা খাতা

জমা দেবে, কল্পনাও করিনি।’

রানা সাড়া দিচ্ছে না।

পাইলট বলল, ‘এখন আমরা কি করব, স্যার?’

‘রিটার্ন জার্নি শুরু করার আগে আরেকটা কাজ বাকি আছে,’

মনে করিয়ে দেয়ার সুরে বলল খায়রুল। ‘ড্যাড, মাথায় একটা

গুলি করে রানাকে নিচে ফেলে দিই?’

‘বোকার মত কথা বোলো না!’ ছেলেকে ধমক দিয়ে থামিয়ে

দিল কবীর চৌধুরী।

‘কিন্তু তুমিই তো বলছিলে যে...’

‘কি বলেছি ভুলে যাও,’ বলল কবীর চৌধুরী। ‘রানাকে এখন

মেরে ফেললে আমাল্ডে কি হবে ভেবে দেখেছ? এই হেলিকপ্টার

আকাশে রাখবে ওরা? অতগুলো গানশিপ আর মিগ ফাইটারের

সঙ্গে আমরা পারব?’

খায়রুল ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। ‘এখন তাহলে কি

হবে?’

‘রানাকে যতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখব ততক্ষণ ওরা গুলি করবে না,’

বলল কবীর চৌধুরী। এক মুহূর্ত চিন্তা করল সে, তারপর

পাইলটকে বলল, ‘পয়েন্ট পেড্রোতে ফিরে চলো, হে। রানাকে

আপাতত ওখানেই আমরা বন্দী করে রাখব। ভেবে দেখতে হবে,

ওকে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে বিসিআই-এর কাছ থেকে কত টাকা

চাওয়া যায়।’

দিক বদলে পশ্চিম দিকে রওনা হলো হেলিকপ্টার।

‘গানশিপ আর ফাইটার পিছু নেবে,’ মন্তব্য করল খায়রুল,

১৮০

মাসুল্ডানা-৩১৬



ভয় পেয়েছে সে।

কবীর চৌধুরী হাসল। ‘বাপের ওপর আস্থা রাখো, খায়রুল।

পিছনে ওরা কতক্ষণ থাকবে? ফুয়েলের হিসাব রাখতে হবে না?

আমার তো ধারণা, কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে মিগ বা

গানশিপ কিছুই আমরা দেখতে পাব না।’ পাইলটের মাথার

পিছনে টোকা দিল সে। পাইলট ঘাড় ফেরাতে ইঙ্গিতে নির্দেশ

দিলÑরেডিও অফ করো।

এক মিনিট পরই ঘন কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল

ওল্ডে হেলিকপ্টার। কবীর চৌধুরীর ধারণাই ঠিকÑমিগগুলো এরই

মধেঞ্জাকাশ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, ফিরতি পথে রয়েছে

হেলিকপ্টার গানশিপের ঝাঁকটা। এমনকি যুদ্ধজাহাজগুলোও উত্তর

দিকে ঘুরে গেছে।

‘আর কোন ভয় নেই,’ সহাসেল্টলল কবীর চৌধুরী। ‘এবার

তুমি তোমার অনেক দিনের সাধ পূরণ করতে পারো, মাই সান।’

‘মানে?’ খায়রুল বাপের কথা ঠিক বুঝতে পারছে না।

‘তোমার বাপকে রানা কম অপমান করেছে? আর ক্ষতি?

যখনই বড় কোন কাজে হাত দিয়েছি, তখনই কোত্থেকে ছুটে এসে

সব লণ্ডভণ্ড করে করে দিয়েছে রানা। তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও

না?’

‘চাই না আবার! কিন্তু তুমি বলছিলে বিসিআই-এর কাছ

থেকে মুক্তিপণ...’

‘আরে বোকা, তখন তো রেডিও অন করা ছিল।’ হাসল

কবীর চৌধুরী। ‘যা বলেছি ওল্ডেকে শুনিয়ে। এখন ওরা

আমাল্ডে পিছু নিয়ে আসছেও না, আমাল্ডে কথা শুনতেও পাচ্ছে

না। কাজেই, ওকে নিয়ে যা খুশি করতে পারো তুমি।’

‘আমার বিচার খুব নির্মম, ড্যাড।’ খায়রুল গম্ভীর। ‘এটা

ফৌজদারী আদালতও নয়, আমার আইনও সাধারণ কোন আইন

গোপন শত্র“

১৮১



নয়।’ রানার দিকে তাকাল সে। ‘এটা সামরিক ট্রাইবুনাল, রানা।

এই ট্রাইবুনালে কোন আপিল চলে না। এই গ্রহটাকে স্বর্গে

পরিণত করার মহান সাধনায় তুমি বিঘœ সৃষ্টি করেছ বারবার, এই

অপরাধে আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলাম। এবং এই দণ্ড

এখুনি কার্যকর করা হবে।’

‘আমিও তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম,’ অনেকক্ষণ পর এই প্রথম

মুখ খুলল রানা। হাসছে ও। ‘একা শুধু তোমাকে নয়, তোমার

উন্মাদ জনক কবীর চৌধুরীকেও ওই একই শাস্তি দিলাম।

তোমাল্ডে বিরুদ্ধে একটাই অভিযোগÑমানবতার বিরুদ্ধে

অপরাধ। তোমাল্ডে সহযোগী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করলাম

পাইলট, গানার আর রকেট অপারেটরকেও। ওল্ডেকেও মৃত্যুদণ্ড

দিলাম।’

‘ড্যাড, কি বলছে ও?’ খায়রুল বিরক্ত।

‘ওর কথায় কান দিয়ো না,’ বলল কবীর চৌধুরী। ‘হয় ও

পাগল হয়ে গেছে, নয়তো ব−াফ দেয়ার চেষ্টা করছে। তুমি তোমার

কাজ শুরু করো। পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দুটো যেমন আছে

তেমনি থাকুক, তবে সীটের সঙ্গে বাঁধা রশিটা খুলে নাও। শুধু

সাগরে ফেলে দিলেই চলে, হানড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত হবার জন্যে মাথায় একটা গুলি করো। সাবধানে, কেমন? সবচেয়ে ভাল হয়

খুলিতে মাজল ঠেকিয়ে ট্রিগার টানলে।’

কবীর চৌধুরী থামতেই হেসে উঠল রানা।

‘ড্যাড, ও হাসছে কেন?’ খায়রুল অস্বস্তি বোধ করছে।

‘হাসছি এই জন্যে যে আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করবে না,

তাই,’ বলল রানা।

‘তোমার কি কথা বিশ্বাস করব না?’ খায়রুল অনেক কষ্টে

নিজেকে সামলে রাখছে।

‘তোমাকে আর তোমার বাপকে একটা কথা ভেবে দেখতে

১৮২

মাসুল্ডানা-৩১৬



বলি,’ বলল রানা। ‘আমার বস্ রাহাত খান কি বলেছেন?

বলেছেন, আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারব। তাঁর এ-কথার

তাৎপর্য কি, ভেবে দেখো।’

পাইলট বলল, ‘হ্যাঁ, সোহেল আহমেদকে এই কথা রাহাত

খান সতিল্টলেছেন, আমি নিজের কানে শুনেছি...’

‘তুমি চুপ করো!’ ধমক দিল কবীর চৌধুরী। ‘খায়রুল!’

‘ইয়েস, ড্যাড!’

‘বোকার মত কিছু করে বোসো না।’ ছেলেকে পরামর্শ দিল

কবীর চৌধুরী। ‘রানাকে আমার বিশ্বাস নেই। সীটে জড়ানো

রশিটা খোলার আগে ভাল মত সার্চ করো ওকে।’

‘সার্চ করার ল্ডকার নেই,’ বলল রানা। ‘রিমোট কন্ট্রোল

ডিভাইস আর ডেটোনেটর সহ জেলিগনাইট কোথায় আছে আমিই

বলে দিচ্ছি।’

‘হোয়াট!’ হেলিকপ্টারের ভেতর যেন বোমা পড়ল, থর থর

করে কাঁপছে খায়রুল। ‘ড্যাড...’

‘ড্যাড-ড্যাড কোরো না তো!’ স্ফাতে স্ফাত ঘষল কবীর

চৌধুরী। ‘আমার বিশ্বাস রানা ব−াফ দিচ্ছে।’

রানা বলল, ‘আমার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা উচিত

হয়নি তোমাল্ডে। ওগুলো সামনে থাকলে আমি কি আর রিমোট

কন্ট্রোল ডিভাইসের নাগাল পেতাম?’

‘জানি...,’ নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে খায়রুল বলল,

‘আমি একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি!’

‘আমি সবাইকে নিয়ে মরতে চাই, এটাকে যদি তোমরা

ষড়যন্ত্র বলো, আমার কোন আপত্তি নেই।’ রানা হাসছে।

এঞ্জিনের গর্জনকে বাদ দিলে কপ্টারের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে

এল। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে রানা আবার বলল, ‘কি আশ্চর্য,

তোমরা ডিভাইস আর বিস্ফোরক দেখতেও চাইবে না? মৃত্যুকে

গোপন শত্র“

১৮৩



এত ভয় পেলে চলে কি করে?’

সরাসরি রানার দিকে তাকাল কবীর চৌধুরী, ‘ও-সব তোমার

কাছে আছে, এ আমি বিশ্বাস করি না।’

‘আমার কোলে পড়ে রয়েছে, এটা তাহলে কি?’ চোখ ইশারায়

জ্যাকেটটা দেখাল রানা।

সবাই জ্যাকেটটার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

‘আমি অনুমতি না দিলে জ্যাকেটে কেউ হাত দিয়ো না,’

সাবধান করে দিল রানা। ‘কেউ হাত দিতে যাচ্ছে দেখলেই

বোতামে চাপ èে আমি।’

‘তুমি সত্যি কথা বলছ কিনা বুঝব কিভাবে?’ রুদ্ধস্বরে

জানতে চাইল খায়রুল।

‘ঘাড় বাঁকা করে দেখো আমার ডান হাতের আঙুলগুলো

কোথায় রয়েছে,’ বলল রানা। ‘সাবধান, আমার হাত বা আঙুল

ছুঁয়ো নাÑসঙ্গে সঙ্গে হেলিকপ্টার বিস্ফোরিত হবে।’

ঘাড় বাঁকা করে রানার পিঠের নিচের দিকে তাকাল খায়রুল।

‘তোমার ডান হাতের আঙুল তো শার্টের নিচে হারিয়ে গেছে,

দেখব কিভাবে?’

‘শার্ট সরাবার অনুমতি চাও।’

‘চাইলাম।’

‘খুব সাবধানে শার্টের কিনারা ধরে একটু উঁচু করো,’ বলল

রানা। ‘আবার সতর্ক করছি, হাত বা আঙুল ছোঁবে না।’

শার্ট তুলে খায়রুল দেখল রানার কোমরে জড়ানো বেল্টের

বাইরের দিকে সত্যি একটা বোতাম রয়েছে, সেই বোতামে রানার

একটা আঙুলও ছোঁয়ানো; ওর আরও দুটো আঙুল বেল্ট ও

শিরস্ফাড়ার মাঝখানে ঢোকানোÑহঠাৎ কেউ টান দিলেও হাতটা বা

আঙুলগুলো বেল্ট ছেড়ে সরে আসবে না।

‘কি দেখছ?’ ধৈর্য হারিয়ে জিজ্ঞেস করল কবীর চৌধুরী।

১৮৪

মাসুল্ডানা-৩১৬



‘একটা বোতাম সতিঞ্জাছে,’ বলল খায়রুল। ‘বেল্টের

ভেতর দিকে ডিভাইস থাকতে পারে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।’

পাইলট শুকনো গলায় বলল, ‘বোতাম যখন আছে...’

‘চোপ!’ রানার দিকে তাকাল কবীর চৌধুরী। ‘আমি এখনও

মনে করি তুমি আমাল্ডেকে ধোঁকা দিয়ে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা

করছ...’

‘জ্যাকেটের ভেতর যে জেলিগনাইট আছে, এবার তাহলে তা-

ও দেখাতে হয়।’ হাসল রানা। ‘শক্ত মোড়কের ভেতর ভরা ওটা,

জ্যাকেটের ভেতর দিকে কাপড় দিয়ে সেলাই করা। খুলে

দেখাবার উপায় নেই, হাতের স্পর্শ দিয়ে অনুভব করতে পারো।’

‘ড্যাড...’

খায়রুলকে থামিয়ে দিল কবীর চৌধুরী। ‘হাত দিয়ে দেখো,

খায়রুল,’ নির্দেশ দিল সে।

‘শুধু ছুঁয়ে বা একটু টিপে দেখবে,’ বলল রানা। ‘টান দিয়ে

কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলেÑবুম!’

দুই ঊরুর মাঝখানে জ্যাকেটটা আটকে রেখেছে রানা।

খায়রুল অত্যন্ত সাবধানে হাত বুলাল সেটায়। এক কি দুই

সেকেন্ড পরই চট করে হাতটা টেনে নিল সে। ‘ওহ্, গড! ওহ্,

গড!’ হাতটা ঘনঘন শূন্যে ঝাড়ছে সে, যেন গরম ছ্যাঁকা খেয়েছে।

‘কি হলো? অমন করছ কেন?’ কবীর চৌধুরী জিজ্ঞেস করল।

‘আছে, ড্যাড। শক্ত কিছু একটা আছে!’

‘আমার বউটা সু›ল্ডী, তার বিয়ে হয়ে যাবে,’ বলল পাইলট।

‘কিন্তু বাচ্চাগুলো একদম ছোট, খালি পেটে রাস্তায় রাস্তায়...’

‘চোপ! আমাকে চিন্তা করতে দাও!’

কবীর চৌধুরীর ধমক খেয়ে থেমে গেল পাইলট। কপ্টারের

ভেতর আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল।

কবীর চৌধুরী কি নিয়ে চিন্তা করছে বলা মুশকিল, তবে

গোপন শত্র“

১৮৫



রানার চিন্তার বিষয় হলো যমুনা। বিসিআই-এর ট্রেনিং পাওয়া

প্রথম শ্রেণীর এজেন্ট সে, তার কোন কাজে খুঁত বা ত্র“টি থাকা

প্রায় অসম্ভব, বিশেষ করে সেই কাজের ওপর যজ্ঝিারেকজন

স্বদেশী এজেন্টের জীবন-মৃতুশু প্রশ্ন জড়িত থাকে। ত্র“টি থাকার

প্রশ্ন যেমন ওঠে না, তেমনি বেঈমানী করার প্রশ্নও ওঠে না; অথচ

দুটোর যে-কোন একটা সত্যি।

কবীর চৌধুরী দশ গোনা শেষ করতে পারেনি, তার আগেই

রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসে চাপ দিয়েছিল রানা। কিন্তু ওর

জ্যাকেটে লুকিয়ে রাখা জেলিগনাইট বিস্ফোরিত হয়নি।

সোহেল ও রাহাত খান নিজেল্ডে মধ্যে তেলখনি নিয়ে কি

আলাপ করেছেন তার সম্ভবত কোন গুরুত্বই নেই; বেশিরভাগ

সম্ভাবনা আলাপটা করা হয়েছে কবীর চৌধুরীকে ধোঁকা দেয়ার

জন্যেÑতেলখনি ধ্বংস করলেও বাংলাদেশের তেমন কোন ক্ষতি

হবে না, এ-কথা জেনে কবীর চৌধুরী যদি প−্যানটা বাদ দেয়

ভেবে। মাটি ও পাথর সরিয়ে তেলখনির উৎসমুখে পৌঁছাতে তিন

বছর লাগবে, এই হিসাবটা যুক্তিগ্রাহল্টলে মনে হয়নি রানার।

বরং কবীর চৌধুরীর হিসাবটা অনেক বেশি বাস্তব। পঞ্চাশ বছর

না হলেও, ত্রিশ বছর তো লাগারই কথা। খরচাও হয়তো ছয়শো

হাজার কোটি ডলারের কাছাকাছি পড়ে যাবে। দেশের মানুষের

ঘাম ঝরানো এতো কোটি টাকার চেয়ে নিজের দাম বেশি বলে

মনে করতে পারেনি রানা, সেজন্যেই বোতামে চাপ দিতে

বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেনি। যমুনার ত্র“টি দায়ী হোক বা

বিশ্বাসঘাতকতা, রানা এখনও বেঁচে আছে; তবে বাংলাদেশ

পিছিয়ে গেছে আরেক হিসাবে কম করেও একশো বছর। এর

জন্যে যমুনা দায়ী। জেলিগনাইট কেন ফাটেনি, এর জবাব

অবশ্যই তাকে দিতে হবে।

ফাটেনি, ফাটবেও না। তবে চৌধুরীরা সে-কথা জানে না।

১৮৬

মাসুল্ডানা-৩১৬



তাল্ডে এই অজ্ঞতাকে পুঁজি করে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে রানা।

যে বিস্ফোরক ওকে খুন করতে পারেনি দেখা যাক পরিবর্তিত

পরিস্থিতিতে সেই বিস্ফোরকই এখন ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে

কিনা।



‘ফিফটি-ফিফটি চান্স,’ নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল কবীর চৌধুরী।

‘রানার জ্যাকেটে ওটা বিস্ফোরক হতে পারে, আবার না-ও হতে

পারে।’

‘এখন তাহলে আমরা...’

ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে কবীর চৌধুরী বলল, ‘আমরা কোন

ঝুঁকি নেব না। ভালয় ভালয় পয়েন্ট পেড্রোতে পৌঁছাই, তারপর

দেখা যাবে।’

খায়রুল বলল, ‘কিন্তু ড্যাড, ভুলে গেলে চলবে না যে মি.

ভবনিয়ার দুর্গে রানার একজন সহকারিণী আছে। সে-ও নিশ্চয়ই

বিসিআই এজেন্ট...’

‘তার ব্যাপারে মি. ভবনিয়ার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে,’

বলল কবীর চৌধুরী। ‘মেয়েটিকে খুব ভাল লেগে যাওয়ায় নিজের

কাছে রেখে দিতে চান তিনি। আমি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছি, যমুনা

যদি দল বদলে রাজি হয় তবেই যেন তাকে গ্রহণ করা হয়।

আমার বিশ্বাস, ভবনিয়ার যে ক্ষমতা আর ধনসম্পদ, যমুনা দল

বদলে রাজি না হয়ে পারবে না।’

রানাকে নিয়ে কি করা হবে বা ওল্ডেকে নিয়ে রানা কি

করবে, এই দুটো প্রশ্ন সযতেœ এড়িয়ে গেল বাপ ও ব্যাটা।

রানা আপাতত খুশি। তবে দুর্গে পৌঁছাবার পর কি ঘটবে, ও

জানে না। ধোঁকা দিয়ে যে বেশিক্ষণ টিকে থাকা যাবে না, এটা

পরিষ্কার।



গোপন শত্র“

১৮৭













তেরো



কিছুটা সূর্যের পিছু নিয়েই দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ছুটল হেলিকপ্টার।

কবীর চৌধুরী রেডিও অন করে সাংকেতিক ভাষায় কার সঙ্গে

আলাপ করল বোঝা গেল না, তবে পাইলটকে নির্দেশ দিয়ে

বলল, ভারতীয় জলসীমার ভেতর ঢুকে কালো রঙ করা একটা

বার্জ খুঁজতে হবে।

ব্যাপারটা লক্ষ করে খায়রুল জিজ্ঞেস করল, ‘সাংকেতিক

ভাষায় কথা বললে যে, ড্যাড? তার মানে কি আমাল্ডে কথা

এখনও ওরা শুনতে পাচ্ছে?’

‘শুনতে না পাবার কোন কারণ আছে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল

কবীর চৌধুরী। ‘আমরা কি রানাকে সার্চ করে মাইক্রোফোনটা

কেড়ে নিয়েছি?’

একমুহূর্ত পর খায়রুল বলল, ‘কিন্তু খালি চোখে বা মনিটরে

কিছুই তো দেখছি না। কোথায় বা কিসে বসে আমাল্ডে কথা

শুনছে ওরা?’

‘খালি চোখে দেখছি না, কারণ দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই। আর

মনিটরকে নির্ঘাত কোনভাবে ফাঁকি দিচ্ছে। বেসামরিক যে

হেলিকপ্টারটাকে ঘুর-ঘুর করতে দেখেছিলাম, আমার ধারণা

ওটায় সোহেল আছে। কুয়াশা থেকে বেরুবার পর ওটাকে কেউ

তোমরা দেখেছ? আমি অন্তত দেখিনি।’

১৮৮

মাসুল্ডানা-৩১৬



সবাই চুপ করে থাকল।

‘আমার ধারণা, ওই হেলিকপ্টার নিয়ে আমাল্ডে সামনে আছে

সোহেল,’ আবার বলল কবীর চৌধুরী।

সামান্য একটু দিক বদলে বার্জটাকে খুঁজে নিতে পাইলটের

কোন সমস্যা হলো না। ক্রুরা তৈরি হয়েই ছিল, হেলিকপ্টার

নামতেই দ্রুত ফুয়েল ভরে দিল ট্যাংকে, দশ মিনিট পর আবার

রওনা হলো হেলিকপ্টার। ইতিমধেঞ্জাটশো কিলোমিটার, প্রস্থ

অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছে ওরা; সূর্য ডোবার খানিক আগেই

পৌঁছে যাবে পয়েন্ট পেড্রোতে।

পাইলটকে দিয়ে রেডিও অন করিয়ে সাংকেতিক ভাষায়

আবার কার সঙ্গে যেন আলাপ শুরু করল কবীর চৌধুরী। তবে

রানা বাধা দিতে আলাপটা সংক্ষেপে সেরে যোগাযোগ কেটে দিতে

বাধ্য হলো সে।

রানা বলল, ‘এমন ভাব কোরো না, যেন আমি তোমাল্ডে

হাতে জিম্মি।’

‘তুমি কি বলতে চাও, আমরা তোমার হাতে জিম্মি?’ বিদ্রƒপের

সুরে জানতে চাইল খায়রুল। ‘তাই যদি হয়, আমাল্ডে ইচ্ছা

অনুসারে হেলিকপ্টার পয়েন্ট পেড্রোয় যাচ্ছে কিভাবে? পাইলটকে

তুমি বাংলাদেশে যেতে বাধ্য করছ না কেন?’

‘এটা আসলে স্টেলমেট,’ বলল রানা। অচলাবস্থা। ‘তোমরা

আমাকে পয়েন্ট পেড্রোতে নিয়ে যাচ্ছ না, আমি নিজেই ওখানে

যাচ্ছি।’

‘কেন?’ বাপ-ব্যাটা একসঙ্গে জানতে চাইল।

রানা হাসছে। ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস করা কি উচিত হবে?’

‘তারমানে দুর্গে পৌঁছে তুমি আমাল্ডে পরীক্ষা নিতে চাও?’

জিজ্ঞেস করল কবীর চৌধুরী।

‘ঠিক ধরেছ।’

গোপন শত্র“

১৮৯



দুই চৌধুরী নিরবে দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপর বড় চৌধুরী,

বলল, ‘জানি না ঠিক কি করার কথা ভাবছ তুমি, রানা। তবে

যমুনার সাহায্য নিয়ে তুমি যজ্ঝিামাল্ডেকে শায়েস্তা করার কথা

ভেবে থাকো, নেহাতই বোকামি হবে সেটা।’

‘কেন?’ রানা চাইছে এ-প্রসঙ্গে আরও কথা বলুক কবীর

চৌধুরী।

‘একটু আগে মিস্টার ভবনিয়ার সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার,’

বলল কবীর চৌধুরী। ‘যা আশা করেছিলাম, তোমার কপাল

আরেকটু পুড়েছে, রানা।’

‘কি বলতে চাও?’

‘বিসিআই এজেন্ট যমুনা ভবনিয়া বাহিনীর প্রধান মিস্টার

ভবনিয়ার প্রাইভেট সেক্রেটারি হতে রাজি হয়েছে।’ কবীর

চৌধুরীর সারা মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি। ‘তোমার ও নিজের আসল

পরিচয় তো স্বীকার করেছেই, বিসিআই-এর গোপন কর্মকাণ্ড

সম্পর্কে সব কথা ফাঁস করে দিতেও আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে

সে। আরও শুনবে? যমুনা বলেছে, সে তার বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য প্রমাণ করার জন্যে নিজের হাতে তোমাকে খুন করতেও রাজি।

আমি তোমাকে জ্যান্ত কবর দিতে চাই শুনে মিস্টার ভবনিয়া

দুর্গের উঠানে মাটি খুঁড়ে রেখেছে, এ-সব দেখেশুনে যমুনার নাকি

খুব অভিমান হয়েছে। কেন? না, সে নিজের হাতে তোমাকে খুন

করতে চায়।’

পাইলট জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা কি তাহলে কবরের পাশেই

নামব?’

যমুনা বিশ্বাসঘাতিনী, এটা রানা মেনে নিতে পারছে না। তার

সম্পর্কে মনে সংশয় জেগেছে ঠিকই, কিন্তু এ-ও আশা করছে যে

ওর নির্দেশ অমান্য করে ওকে বিস্ফোরক না দেয়ার কারণটা

ব্যাখ্যা করতে পারবে যমুনা। ওর এই বিশ্বাস আরও একটু দৃঢ়

১৯০

মাসুল্ডানা-৩১৬



হলো কবীর চৌধুরীর কথা শুনে। নিজের হাতে ওকে খুন করতে

চায়, যমুনার এ-কথা বলার পিছনে আসল উদ্দেশ্য হয়তো কবীর

চৌধুরী যাতে রানাকে দুর্গে ফেরার পথে খুন না করে।

ওল্ডে, যমুনা ও রানার, একটা প−্যান আছে। রানা বহাল

তবিয়তে দুর্গে ফিরলেই শুধু তা কার্যকরী করা সম্ভব। ওকে

নিজের হাতে খুন করতে চায় বলে যমুনা নিশ্চয়ই দুর্গে ওর

ফেরাটা নিশ্চিত করতে চাইছে।

সূর্য এইমাত্র ডুবে গেল, তবে দিনের আলো এখনও উজ্জ্বল।

পাইলট রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘দুর্গের উঠানে নামতে যাচ্ছি আমরা,

স্যার। মিস্টার ভবনিয়ার হেলিকপ্টারের ঠিক পাশেই। কিন্তু

তারপর কি হবে, স্যার?’

‘মনিটরে কিছু আছে?’ জিজ্ঞেস করল খায়রুল। ‘কিংবা খালি

চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে?’

‘না।’

হেলিকপ্টার নিরাপদেই ল্যান্ড করল দুর্গের উঠানে। শুধু সশস্ত্র

কয়েকজন গার্ডকে দেখা গেল, কাঁধে রাইফেল নিয়ে চারদিকে

টহল দিচ্ছে। ভবনিয়া বা যমুনাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

উঠানের আরেক প্রান্তে রোলসরয়েস ও মার্সিডিজগুলোকে দেখা

গেল।

‘এখন কি হবে?’ রানাকে জিজ্ঞেস করল কবীর চৌধুরী।

‘অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর জন্যে তোমাল্ডেকে আমি

মুক্তি èে,’ বলল রানা। ‘তবে শর্ত আছে।’

‘আমাল্ডেকে তুমি মুক্তি দেবে?’ খায়রুলের চোখে-মুখে নগ্ন

সন্দেহ।

‘তুমি চুপ করো!’ বলল কবীর চৌধুরী। ‘কি শর্ত, রানা?’

‘তোমাল্ডে বদলে এই হেলিকপ্টারে আমি যমুনাকে চাই,’

বলল রানা।

গোপন শত্র“

১৯১



সঙ্গে সঙ্গে খায়রুল জিজ্ঞেস করল, ‘ড্যাড, গার্ডল্ডে ডেকে

বলি, বিসিআই এজেন্টকে নিয়ে আসুক?’

‘ভাবছি,’ চিন্তিত দেখাল কবীর চৌধুরীকে, ‘মিস্টার ভবনিয়া

কি যমুনাকে ছাড়তে রাজি হবেন?’

‘তাহলে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছ তুমি, ড্যাড?’ রাগ চেপে

জিজ্ঞেস করল খায়রুল। ‘কেমন বন্ধু সে যে তোমার প্রাণ বাঁচাবার

জন্যে সামান্য একটা মেয়েকে হারাতে রাজি হবে না?’

ছেলের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কবীর চৌধুরী রানাকে বলল,

‘ধরো, মিস্টার ভবনিয়া রাজি হলেন, কিন্তু যমুনা আসতে চাইল

না। তখন কি হবে?’

‘তুমি বলো।’

‘এই অচলাবস্থার অবসান ঘটাবার সহজ একটা সমাধান আছে

আমার কাছে,’ বলল কবীর চৌধুরী। ‘ভেবে দেখো পছন্দ হয়

কিনা।’

‘আমি শুনছি।’

‘গার্ডল্ডে নিয়ে আমরা সবাই হেলিকপ্টার থেকে নেমে যাব,’

বলল কবীর চৌধুরী। ‘তুমিও হেলিকপ্টার নিয়ে যেখানে খুশি চলে

যাবে।’

‘ড্যাড!’ অবিশ্বাসে চেঁচিয়ে উঠল খায়রুল। ‘হাতে পেয়েও

শয়তানটাকে তুমি ছেড়ে দিতে চাইছ?’

‘ছেড়ে না দিয়ে আর কোন উপায় আছে?’ খেঁকিয়ে উঠল

কবীর চৌধুরী। ‘দেখতে পাচ্ছ না, রিমোট কন্ট্রোলের বোতামে

এখনও ও আঙুল ঠেকিয়ে রেখেছে?’

‘দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, ছেলেটাকে তুমি মানুষ

করতে পারোনি,’ বলল রানা। ‘স্রেফ একটা শিক্ষিত গাধা

বানিয়েছ...’

বাধা দিল কবীর চৌধুরী। ‘আমার প্রস্তাব সম্পর্কে বলো।’

১৯২

মাসুল্ডানা-৩১৬



‘তোমরা যে বাংলাদেশের এত বড় ক্ষতি করলে,’ বলল রানা,

‘ভেবেছ তার শাস্তি না দিয়েই তোমাল্ডেকে আমি ছেড়ে èে?’

কবীর চৌধুরীর মুখে তৃপ্তির হাসি। ‘যাক, শেষ পর্যন্ত তাহলে

স্বীকার করলে যে বাংলাদেশের খুব বড় একটা ক্ষতি হয়েছে। তা,

শাস্তিটা কিভাবে তুমি দিতে চাও, শুনি? বিস্ফোরক ফাটিয়ে?

জেলিগনাইট বিস্ফোরিত হলে তুমিও তো মারা যাবে। আর তুমি

যে একটা কাপুরুষ, মরতে ভয় পাও, সেটা তো তখনই প্রমাণ

হয়ে গেছে যখন আমি আন্ডারওয়াটার ফ্যাসিলিটি উড়িয়ে দেয়ার

হুমকি দিলাম, অথচ তুমি রিমোট কন্ট্রোলের বোতামে চাপ দিলে

না।’

অপমানটা রানা গায়ে মাখল না। ‘সব কথা কি তোমাকে

আমি বলেছি, না বলব? শোনো, নিজেকে বাঁচিয়ে তোমাকে শাস্তি

দেয়ার উপায় আমার জানা আছে। আমি সংকেত দিলেই সোহেল

দলবল নিয়ে চলে আসবে। তবে বাধ্য না হলে আমি চাইব না যে

একটা খুনোখুনি বাধুক বা রক্তগঙ্গা বয়ে যাক। যা বলছি,

শোনোÑযমুনাকে ডেকে পাঠাও।’

এক মুহূর্ত চিন্তা করল কবীর চৌধুরী। তারপর জিজ্ঞেস করল,

‘তুমি তোমার প্রতিশ্র“তি থেকে সরে যাবে না তো? যমুনাকে

পেলে আমাল্ডেকে নেমে যেতে দেবে?’

‘আমি এক কথার মানুষ।’

‘ঠিক আছে। তাই হোক।’ কপ্টারের ল্ডজা খুলে হাত

ইশারায় গার্ডল্ডে ডাকল কবীর চৌধুরী।



একা যমুনা নয়, তার সঙ্গে ভবনিয়াও দুর্গের ভেতর থেকে উঠানে

বেরিয়ে এল। পরস্পরের হাত ধরে আছে ওরা, ভবনিয়ার কি

একটা কথায় হেসে উঠল যমুনা; হাসতে হাসতে যাকে বলে

একেবারে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা।

গোপন শত্র“

১৯৩



‘কেমন বুঝছ, রানা?’ জিজ্ঞেস করল কবীর চৌধুরী। ‘এখন

বিশ্বাস হচ্ছে তো তোমার কপাল সত্যি পুড়েছে?’

রানা হতভম্ব, বোকার মত হাঁ করে যমুনার দিকে তাকিয়ে

আছে।

যমুনা নির্লজ্জের মত ঢলাঢলি শুরু করল, তার এলোমেলো

পা ফেলা দেখে কারও আর বুঝতে বাকি থাকল না যে সে নেশা

করেছে।

‘কি ব্যাপার? কে ডাকে আমাকে?’ হেলিকপ্টারের খোলা

ল্ডজার সামনে এসে স্ফাড়াল যমুনা, ভবনিয়ার একটা কাঁধ ধরে

তাল সামলাচ্ছে।

‘তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে, যমুনা,’ বলল রানা। ‘আমি

চাই তুমি হেলিকপ্টারে উঠে আমার পাশের সীটে বসবে। তুমি

বসলে ওরা সবাই নেমে যাবে...’

রানার দিকে ভুলেও তাকাল না যমুনা, তাকিয়ে আছে সরাসরি

কবীর চৌধুরীর দিকে। রানার কথা শেষ হয়নি, বাধা দিয়ে বলল,

‘এই লোকটার কথা শোনার জনেঞ্জামাকে ডাকা হয়েছে?’

প্রবলবেগে মাথা নাড়ল। ‘অসম্ভব! ওর সঙ্গে আমার কোন কথা

নেই। ও কে? ওকে তো আমি চিনিই না!’ ভবনিয়ার দিকে

তাকাল। ‘কি, বস্, ওকে আমি চিনি?’

ভবনিয়া মুচকি হেসে কবীর চৌধুরীর উদ্দেশে একটা চোখ

টিপল।

‘যদি কিছু শুনতেই হয়, আমি আপনার কথা শুনব, মিস্টার

চৌধুরী,’ আবার বলল যমুনা। ‘আপনি আমার বসের বন্ধু, কাজেই

আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ও কে? ও তো স্রেফ একটা

আপদ, বাতিল মাল।’

‘ঠিক আছে, আমিই সব বলছি,’ বলল কবীর চৌধুরী।

সংক্ষেপে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করল সে।

১৯৪

মাসুল্ডানা-৩১৬



‘জেলিগনাইট? রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস?’ কবীর চৌধুরী

থামতেই প্রশ্ন করল যমুনা। তারপর গলা ছেড়ে হেসে উঠল।

হাসতে হাসতেই বলল, ‘হায় আল−াহ, কি বোকাই না বানিয়েছে

আপনাল্ডে! ওই বেল্ট আমিই ওকে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম

ওটায় রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস ফিট করা আছেÑলকটা আছে

বেল্টের ভেতর দিকে, সেটা খুলতে হলে আঙুল দিয়ে লিভারটা

একপাশে সরিয়ে দিতে হবে, তারপর বাইরের বোতামে চাপ

দিলেই জ্যাকেটে লুকানো জেলিগনাইট বিস্ফোরিত হবে।

বলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সত্যি কথা বলেছিলাম নাকি মিথ্যে কথা,

ও যাচাই করেনি। তাহলেই বুঝুন কেমন গর্দভ ও। আপনারাও

কম যান না, ওর কথা বিশ্বাস করে মৃত্যুভয়ে ঠক-ঠক করে

কাঁপছেন! নেমে আসুন, নেমে আসুন।’

যমুনার কথা শেষ হতে যা দেরি, হেলিকপ্টার থেকে হুড়মুড়

করে বেরিয়ে গেল সবাই।

‘কি আশ্চর্য, ওকেও তো নামাতে হবে!’ বলল যমুনা, কারও

জনেঞ্জপেক্ষা না করে নিজেই হেলিকপ্টারে উঠে পড়ল। প্রথমে

রানার সঙ্গে সীটে জড়ানো রশিটা খুলল সে। তারপর ওর দুই

ঊরুর মাঝখান থেকে জ্যাকেটটা নিয়ে ছুঁড়ে দিল বাইরে। দুই

হেলিকপ্টারের মাঝখানে, পাকা উঠানে পড়ল সেটা। ‘এই দেখুন,

রিমোট কন্ট্রোলের বোতামে চাপ দিচ্ছিÑ,’ রানার ডান হাতটা

টেনে শিরস্ফাড়ার কাছ থেকে সরাল, বেল্টের ভেতর দিকে আঙুল

ঢোকাল একটা । ‘লিভার ঠেলে এই খুললাম লক।’ সেই আঙুল

দিয়েই বেল্টের বাইরের দিকে বসানো বোতামটায় চাপ দিল,

বারবার দিতেই থাকল। ‘কই, ফাটছে?’

প্রথমে খায়রুল শুরু করল, দেখাদেখি আরও অনেকে,

তারপর ভবনিয়া, এবং সবশেষে কবীর চৌধুরীÑতবে ওল্ডে

হাততালির শব্দকে ছাপিয়ে উঠল যমুনার তীক্ষè কণ্ঠ¯ল্ফ, ‘এখুনি

গোপন শত্র“

১৯৫



হাততালি কিসের? আপদ্মাকে আগে বিদায় করি, তারপর না!’

কপ্টার থেকে নেমে এসে ভবনিয়ার সামনে হাত পাতল। ‘একটা

পিস্তল দিন, বস্। আর গার্ডল্ডে বলুন, ওকে কপ্টার থেকে

নামিয়ে পাঁচিলের সামনে স্ফাড় করাক।’

‘কিন্তু কথা ছিল ওই শালাকে আমরা মারব...,’ শুরু করল

খায়রুল।

ঝট্ করে তার দিকে তাকাল যমুনা। ‘ও আবার কে? ওকে

তো চিনলাম না, বস্! একজন ভদ্রমহিলার সামনে বাজে শব্দ

বল্টহার করছে!’

চাপা গলায় গর্জে উঠল কবীর চৌধুরী, ‘খায়রুল, তুমি কি

আমার মান-সম্মান ডোবাবে?’ তারপর যমুনার দিকে তাকিয়ে

অমায়িক হাসল। ‘ও আমার ছেলে, খায়রুল কবীর। অত্যন্ত

ব্রিলিয়ান্ট, ইলেকট্রনিক্স এক্সপার্ট...’

‘বস্।’ খায়রুল সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল যমুনা,

ভবনিয়ার আরও কাছে সরে এসে তার ঊরুতে নিতম্ব ঘষল।

‘পিস্তলটা।’

‘ওহ্, শিওর,’ বলে শোল্ডার হোলস্টার থেকে নিজের পিস্তলটা

বের করে যমুনাকে দিল ভবনিয়া।

‘হ্যাঁ, মিস যমুনা,’ কবীর চৌধুরী একটু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,

‘আমার একটা বিশেষ অনুরোধ ছিল...’

‘অনুরোধ?’

‘দেখুন, মাসুল্ডানা বলতে গেলে আমার জন্মশত্র“। নিজের

কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ধরতে পারলে ওকে আমি জ্যান্ত কবর

èে। সে-কথা মিস্টার ভবনিয়াও জানেন...’

‘আমিও জানি,’ বলল যমুনা। ‘বস্ আপনার অনুরোধে মাটিও

খুঁড়ে রেখেছেÑওই দেখুন।’ হাত তুলে পাঁচিলের দিকটা দেখাল

সে। দিনের শেষ আলোয় গর্তটা পরিষ্কারই দেখতে পেল সবাই।

১৯৬

মাসুল্ডানা-৩১৬



‘কিন্তু জ্যান্ত কবর দেয়ার প্রচলন এখন আর পৃথিবীর কোথাও

নেই, মিস্টার চৌধুরী। ওটা শুধু অমানবিক, জেনেভা

কনভেনশনের বরখেলাপ বা কুৎসিত নয়, রীতিমত একটা

স্যাডিস্টিক নোংরামি।’

কবীর চৌধুরীর চেহারা কালচে হয়ে এল। ‘কিন্তু, মিস যমুনা,

আপনি যদি জানতেন রানা আমার কি ক্ষতি করেছে...’

‘দেখুন, নিজেল্ডে মধ্যে ঝগড়া করে শত্র“র আয়ু বাড়াবার

কোন মানে হয় না,’ বলল যমুনা। ‘আপনি আমার বসের বন্ধু,

আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, কাজেই আপনার অনুরোধ ফেলাও

সম্ভব নয়।’ পিস্তলটা ভবনিয়াকে ফিরিয়ে দিল সে। ‘দিন, তাহলে

আপদ্মাকে জ্যান্তই কবর দিন। তবে, এই জঘন্য কাজটা আমাকে

আপনারা দেখতে বলবেন না। বস্ তো আমাকে নিয়ে চলে যাবার

প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছেন, কাজেই আগে আমরা বিদায় নিই,

তারপর রানাকে নিয়ে যা খুশি তাই করুন আপনি।’

‘সেই ভাল! ড্যাড, আমারও একটা অনুরোধ আছে তোমার

কাছে। তুমি ওকে জ্যান্ত কবর দিতে চাইছ, দাও; কিন্তু তার

আগে পায়ে আর পেটে গুলি করে ওকে আমি খানিকটা

ভোগাবÑকথা দিচ্ছি, শুধু আহত হবে, মরবে না।’

‘চুপ!’ চাপা গলায় ধমক দিল কবীর চৌধুরী।

‘বস্, এ-সব কথা শুনে আমার নেশা তো ছুটে গেছেই, এবার

না আমি বমি করে ফেলি!’ কবীর চৌধুরীর দিকে তাকাল যমুনা।

‘আমরা হেলিকপ্টারে চড়ে জাহাজে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এক

হাজার টন সোনা, সোনার সঙ্গে স্বয়ং বসের থাকা ল্ডকার।

ভবনিয়া বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যকে আগেই জাফনার উদ্দেশে

পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা রওনা হবার পর যা করার করবেন

আপনারা। অন্তত রোলসরয়েস জেটিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত

অপেক্ষা করবেন। মোটকথা, গুলির শব্দ বা এই লোকটার চিৎকার

গোপন শত্র“

১৯৭



আমি যেন শুনতে না পাই।’

‘ঠিক আছে, তাই হবে,’ কথা দিল কবীর চৌধুরী। ‘তবে অন্য এক প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন...’

‘বলুন?’

‘আমার লোকজনরা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল কবীর চৌধুরী।

‘তাল্ডে একজনকেও তো দেখছি না।’

যমুনা হাসল। ‘এর জবাব দেবেন মিস্টার ভবনিয়া।’

খুক করে কেশে ভবনিয়া বলল, ‘তেলখনি হাতছাড়া হবার পর

পার্টনারশিপ বল্টসারও সমাপ্তি ঘটেছে, মি. চৌধুরী। ফোরবল-এর

আর কোন অস্তিত্ব নেই। আমার নতুন প্রাইভেট সেক্রেটারির

পরামর্শে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন আর লাভের অংশ কাউকে

দেয়া হবে না।

‘এই সিদ্ধান্ত সবার ভাল না-ও লাগতে পারে, তাই আপনার

লোকজনকে পাকিস্তানী জাহাজটায় তুলে বিদায় করা হয়েছে।

আর ভবনিয়া বাহিনীর সংখ্যা এখানে এত বেশি ছিল যে তারা

একজোট হয়ে বিদ্রোহ করলে সোনা তো হারাতামই, প্রাণেও

বাঁচতাম না। তাই ওল্ডেকেও জাফনায় পাঠিয়ে দিয়েছি। সে-ও

আমার নতুন প্রাইভেট সেক্রেটারির পরামর্শে...’

সবার সামনে ভবনিয়াকে একটা চুমো খেলো যমুনা। ‘ওহ্,

বস্! আপনি এত প্রশংসা করছেন যে আমার লজ্জাই লাগছে।

আর সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না, চলুন এবার...’

রাগে ফোঁস-ফোঁস করছে কবীর চৌধুরী, কিন্তু প্রতিবাদ করে

কিছু বলতে পারছে না। দুর্গে সে আর তার ছেলেই রয়েছে শুধু,

সাহায্য করার মত আর কেউ নেই। কিন্তু ভবনিয়ার বিশ্বস্ত শিষশুা

সংখ্যায় কম হলেও, প্রত্যেকে সশস্ত্র। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল

রানার ওপর। ‘খায়রুল, ওই শালাকে কপ্টার থেকে বের করো!

কবরের কিনারায় স্ফাড় করাও। তারপর দু’জন মিলে একশোটা

১৯৮

মাসুল্ডানা-৩১৬



গুলি করব শালার পায়ে। হাঁটুর নিচে পা বলে কিছু রাখবই না।

তারপর জ্যান্ত মাটি চাপা èে...’

‘আমরা জেটিতে পৌঁছাবার আগে নয়,’ মনে করিয়ে দিল

যমুনা।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে আমার,’ হিসহিস করে বলল কবীর

চৌধুরী। ‘এবার দয়া করে যান আপনারা!’











চোদ্দ



কপ্টার থেকে নামানো হলো রানাকে। সদ্য খোঁড়া কবরটা ত্রিশ

কি পঁয়ত্রিশ গজ দূরে, পাঁচিল ঘেঁষে খোঁড়া হয়েছে। পিস্তল দিয়ে

রানার পিঠে খোঁচা মারল খায়রুল, ঠেলতে ঠেলতে কবরের দিকে

নিয়ে যাচ্ছে। তার ঠিক পিছনেই রয়েছে কবীর চৌধুরী।

আক্রোশে এখনও ফুঁসছে সে, ঘাড় ফিরিয়ে বারবার

রোলসরয়েসটার দিকে তাকাচ্ছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় চারদিকে

গাঢ় হচ্ছে ছায়া, তবে এখনও অনেকদূর দৃষ্টি চলে।

রোলসরয়েসটা রয়েছে গাড়ি-বারান্দার মুখের কাছে,

ধাপগুলোর কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে। রোলসরয়েসের পিছনে

রয়েছে দুটো মার্সিডিজ আর একটা জীপ। ভবনিয়া আর যমুনাকে

কবীর চৌধুরী দেখতে পেল না, তারা ইতিমধ্যে রোলসরয়েসে

উঠে পড়েছে।

রোলসরয়েসের ড্রাইভিং সীটে বসেছে ভবনিয়ার অতি বিশ্বস্ত

গোপন শত্র“

১৯৯



একজন গেরিলা। ‘ঠিক আছে, নম্রসিংমে, গাড়ি ছাড়ো,’ নির্দেশ

দিল ভবনিয়া।

ভবনিয়ার গায়ে ঢলে পড়ল যমুনা! ‘ধ্যাত! ধ্যাত!’

‘কি হলো, মাই ডিয়ার?’ ভবনিয়া অবাক।

যমুনা বলল, ‘নম্রসিংমে, এক মিনিট, ভাই।’ তারপর

ভবনিয়ার কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিস করল, ‘মেয়েলি ব্যাপার,

বস্, খুলে বলা যাবে না।’ নিজের দিকের ল্ডজা খুলে ফেলেছে

সে। ‘আমি একটু বাথরূম থেকে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করে

আনি।’

খিকখিক করে চাপা স্বরে হাসল ভবনিয়া। ‘ঠিক হ্যায়,

ডার্লিং। তবে দেরি কোরো না, কেমন?’

‘যাব আর আসব,’ চুমো খাবার সময় ভবনিয়ার কানের

লতিতে ছোট্ট একটা কামড় দিল যমুনা।

ওদিকে কবরের দিকে পিছন ফিরিয়ে স্ফাড় করানো হয়েছে

রানাকে। দশ হাত পিছিয়ে গেছে খায়রুল। তার হাতে পিস্তল,

তবে এখনও সেটা রানার দিকে তোলেনি। ছেলের পাশেই

স্ফাড়িয়ে রয়েছে কবীর চৌধুরী, তার হাতে একটা মেশিন পিস্তল।

সে তাকিয়ে আছে রোলসরয়েসের দিকে। ‘ডাইনীটা আবার যাচ্ছে

কোথায়!’ যমুনাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে বিড় বিড় করল

সে।

শুনে খায়রুলও ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। জোড়া হেলিকপ্টারের

মাঝখানের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল ধাপ বেয়ে দ্রুত উঠে যাচ্ছে

যমুনা। তার হাতে একটা হ্যান্ডব্যাগ রয়েছে। ধাপের মাথায়

কয়েকটা মোটা পিলার দেখা যাচ্ছে, তারপর বিল্ডিঙে ঢোকার

ল্ডজা। কিন্তু ল্ডজার দিকে গেল না যমুনা। একটা পিলারের

আড়ালে পড়ল সে। সেই আড়াল থেকে বেরুবে, এই আশায়

তাকিয়ে থাকল দুই চৌধুরী।

২০০

মাসুল্ডানা-৩১৬



ওল্ডে কাছ থেকে বিশ গজ দূরে স্ফাড়িয়ে রয়েছে চারজন

গেরিলা, পাইলট, গানার ও রকেট অপারেটর। ওল্ডে দেখাদেখি

তারাও ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে একশো গজ দূরের পিলারটার

দিকে। কিন্তু পিলারের আড়াল থেকে যমুনা বেরুচ্ছে না।

‘ড্যাড!’ খায়রুলের গলাটা একটু কেঁপে গেল। ‘ব্যাপারটা

আমার কিন্তু ভাল ঠেকছে না।’

‘হ্যাঁ, আমারও সন্দেহ হচ্ছে...’

অকস্মাৎ বিরুপিল−াই ভবনিয়া ও নম্রসিংমেকে বিদায় জানিয়ে

বিস্ফোরিত হলো রোলসরয়েস। ভয়ে নয়, শক ওয়েভের ধাক্কায়

বাপের গায়ের ওপর ছিটকে পড়ল খায়রুল, দু’জনেই পড়ে গেল

উঠানে। এরকম একটা কিছু ঘটার অপেক্ষায় ছিল রানা, তা

সত্ত্বেও ধাক্কাটা সামলাতে পারল না, ঝাঁকি খেয়ে কবরের মধ্যে পড়ে গেল।

বিস্ফোরণটা এত শক্তিশালী যে রোলসরয়েসের পুরো ছাদ্মাই

উড়ে গেছে। ওটাকে এখন আর গাড়ি বলে চেনার কোন উপায়

নেই, স্রেফ আগুনের একটা কুণ্ড। এরপর ফুয়েল ট্যাংক

বিস্ফোরিত হলো, অগ্নিকুণ্ডটা পাঁচ-সাত ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল

চারদিকে, দুই মার্সিডিজেও আগুন ধরে গেল।

নিজে স্ফাড়াল কবীর চৌধুরী, তারপর খায়রুলকে স্ফাড়াতে

সাহায্য করল।

আগুনের উজ্জ্বল ও লাল আভায় সিঁড়ির ধাপ ও তার ওপরের

অংশ উদ্ভাসিত হয়ে আছে, কবরের নিচে স্ফাড়িয়ে সেদিকে

তাকাতে রানা দেখল পিলারের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে

যমুনা, তাকিয়ে আছে এদিকেই, হ্যান্ডব্যাগটা দু’হাতে বুকের কাছে

ধরা। হঠাৎ চোখের কোণে কিছু নড়তে দেখল রানা। দৃষ্টি ফিরিয়ে

আনতেই দেখতে পেল জোড়া কপ্টারের মাঝখানে স্ফাড়িয়ে চার

সৈনিক একযোগে যমুনার দিকে রাইফেল তুলছে। পাইলটের পিছু

গোপন শত্র“

২০১



নিয়ে রকেট অপারেটর ও গানার লাফ দিয়ে উঠে পড়ল কপ্টারে।

আঁচড়াআঁচড়ি করে কবর থেকে উঠল রানা। বেল্টের ভেতর

একটা আঙুল ঢোকানোই ছিল, লিভারটা একপাশে ঠেলে লক

খুলল, আরেক আঙুল দিয়ে চাপ দিল বাইরের বোতামটায়।

বিস্ফোরণ ও আগুনের তীব্র ঝলক চার সৈনিককে রকেটের

মত ছুঁড়ে দিল শূন্যে। দুটো হেলিকপ্টারই কাত হয়ে গেল।

আগুন তো নয়, যেন নিñিদ্র মোড়ক হিসেবে গায়ে শোভা পাচ্ছে

গাঢ় কমলা রঙের চাল্ড। শূন্য থেকে খসে পড়ার পর তাতে

পুড়ছে চার সৈনিকের লাশ। ওখান থেকে বিশ গজ দূরে আবার

উঠানের পাকা মেঝেতে ছিটকে পড়েছে দুই চৌধুরী। এবার

খায়রুল প্রথমে স্ফাড়াতে পারল। কিন্তু বাপকে স্ফাড়াতে সাহায্য না

করেই সে নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে দৌড় দিল, হাতের ঝাপটা

মেরে সুটের আগুন নেভাবার চেষ্টা করছে।

‘একটু স্ফাড়াও!’ পিছন থেকে ভারী গলায় নির্দেশ দিল কবীর

চৌধুরী। ‘আমার কাঠের পা উড়ে গেছে!’ আগুন জ্বলছে তার

সুটেও।

একটু থমকাল খায়রুল। ‘কতবার বলেছি ক্রাচ বল্টহার

করতে, কিন্তু আমার কথা শুনলে তো! এখন কি তোমার জন্যে নিজের প্রাণটাও হারাব আমি?’ আবার ছুটল সে, কবরটাকে পাশ

কাটিয়ে এসে পাঁচিলে ওঠার চেষ্টা করছে।

এক পায়ে লাফাতে লাফাতে কবীর চৌধুরীও ছুটল সেদিকে,

সে-ও হাত ঝাপটা দিয়ে কাপড়ের আগুন নেভাচ্ছে। একটু দূরে

কাঠের পা-টা পেয়ে চটজলদি পরে ফেলল।

আগুনের আঁচ সহ্য করতে না পেরে রানা এবার নিজেই

কবরে লাফিয়ে পড়েছে। মাটিতে পড়ে বসে নেই, পিছমোড়া করে

বাঁধা হাত দুটো অনবরত মুচড়ে বাঁধনটা খোলার চেষ্টা করছে।

হঠাৎ শরীরের নিচে কয়েকবার কেঁপে উঠল মাটি, আওয়াজ শুনে

২০২

মাসুল্ডানা-৩১৬



বোঝা গেল আরও বড় কয়েকটা বিস্ফোরণ ঘটল কোথাও।

গিঁটগুলো আগেই আলগা করা ছিল, বাঁধন খুলে ফেলল রানা।

আগুনের আঁচ এড়াবার জন্যে কবরের উল্টোদিক থেকে উঠানে

উঠছে।

পাঁচিলটা অনেক উঁচু, ইতিমধ্যে খাঁজ ও গর্তে পা দিয়ে ওটার

মাথায় উঠে পড়েছে খায়রুল। কিন্তু কবীর চৌধুরী অর্ধেকটা ওঠার

পর সুবিধে করতে পারছে না, পাঁচিলের গায়ে প্রকাণ্ড একটা

টিকটিকির মত সেঁটে আছে। ‘এই ইডিয়ট, হাতটা ধরে টেনে

তোলো আমাকে!’ এরকম বেকায়দা অবস্থায় পড়েও গাম্ভীর্য ও

ব্যক্তিত্ব হারাতে রাজি নয় সে, কথার সুরে ধমক যেমন আছে,

তেমনি শে−ষেরও অভাব নেই। ‘এমন আচরণ কোরো না লোকে

যাতে বলে একটা অকৃতজ্ঞ সিংহ জন্ম দিয়েছি আমি।’

পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে উল্টোদিকে পড়তে যাচ্ছিল খায়রুল,

বাপের কথা শুনে থমকাল। কুত্তা-বিড়াল-শেয়াল-ছুঁচো ইত্যাদি না

বলে বাপ তাকে সিংহ কেন বলছে, এটা বুঝতে না পারার মত

বোকা সে নয়। মুচকি হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। পাঁচিলের মাথায়

তিন পা হাঁটল সে, ঝুঁকে বাপের একটা কনুই ধরল। ‘কিন্তু এখানে

ইঁদুর বা বক, কিছুই তো আমি দেখছি না!’ বলে হ্যাঁচকা টান দিল।

‘নিচে,’ বলল রানা, লাফ দিল কবীর চৌধুরীর অক্ষত পা

লক্ষ্য করে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে ওই পা পাঁচিলের মাথায় টেনে নিয়েছে

কবীর চৌধুরী। দ্বিতীয়বার লাফ দিয়ে তার দ্বিতীয় পায়ের নাগাল

পেয়ে গেল রানা, ধরতেও পারল। কবীর চৌধুরীর হাঁটু থেকে

আধহাত লম্বা কাঠের ভাঙা পা-টা খসে এল ওর হাতে। সেই

মুহূর্তে বাপকে নিয়ে পাঁচিল থেকে উল্টোদিকে লাফিয়ে পড়ল

খায়রুল।

একটু পর পাঁচিলের মাথায় উঠল রানা। নিচের জঙ্গল ও

গোপন শত্র“

২০৩



অন্ধকার থেকে একটা গুলি হলো, কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল

বুলেটটা। খালি হাতে ধাওয়া করাটা বোকামি, বাধ্য হয়ে আবার

কবরের পাশে নেমে পড়ল রানা।

পাঁচিলের দিকে পিছন ফিরতেই হকচকিয়ে গেল ও। গোটা

দুর্গে দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে। মনে মনে যমুনার প্রশংসা

করতে হলো। ওর অনুপস্থিতির সুযোগে শুধু যে বিরুপিল−াই

ভবনিয়ার মনোরঞ্জন করে সময় কাটিয়েছে, তা নয়, গাড়িতে আর

দুর্গের বিভিন্ন জায়গায় জেলিগনাইটও বসিয়েছে।

মাথার ওপর একটা হেলিকপ্টার উড়ে এল। এল জেটি ও

সাগরের দিক থেকে। আগুনের আভায় যমুনাকেও দেখতে পেল

রানা, ধাপ বেয়ে নেমে এসে উঠান ধরে ছুটে আসছে ওর দিকে,

চিৎকার করে বলছে, ‘রানা! রানা!’

হেলিকপ্টারটা উঠানের মাঝখানে নামছে।

ছুটে এসে রানার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল যমুনা।



আলিঙ্গন সাধারণত এত দীর্ঘ হয় না। কিন্তু যমুনা এত বেশি

কাঁপছে যে রানা তাকে ছাড়তে পারছে না। শুধু যে কাঁপছে, তা-ও

নয়, অদম্য কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে তার পিঠ। ‘এই বোকা, তুমি

তো হাসবে!’ বলল রানা, যমুনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ‘একার

চেষ্টায় এত বড় একটা ঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়ে কাঁদে কেউ?’

দু’হাত দিয়ে রানার গাল ধরল যমুনা। ‘এ আমার আন›েল্ড

কান্না, রানা। যে-কাজ করেছিলাম, ভাবিনি তোমাকে জীবিত

দেখব আবার...’

‘তুমি বোধহয় ওই লোকটার কথা বলছ।’

‘হ্যাঁ। আমি জানতাম তেলখনি রক্ষা করার প্রয়োজনে তুমি

মরতেও পিছপা হবে না, তাই কিছুতেই তোমাকে বলতে পারিনি

যে ডিভাইসটায় লক করার সিস্টেম আছে। কিন্তু তুমি চলে যাবার

২০৪

মাসুল্ডানা-৩১৬



পর দুশ্চিন্তায় পাগল হবার অবস্থা হলো আমার। বুঝলাম,

ঝোঁকের মাথায় মারাত্মক ভুল করে ফেলেছিÑলকের কথা না

জানার কারণেই তুমি হয়তো মারা যেতে পারো...’

‘দেখতেই পাচ্ছ তা যাইনি,’ বলল রানা। ‘জেলিগনাইট যখন

ফাটল না, তোমার ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল আমার, এমনকি তুমি

বিশ্বাসঘাতকতা করলে কি না এই সন্দেহও জেগেছিল মনে। কিন্তু

ভুল হোক আর বোকামি হোক, তোমার ওই ভুল বা বোকামির

জন্যেই এখনও আমি বেঁচে আছি, এই সতন্ধা তো অস্বীকার

করতে পারছি না। তাছাড়া জীবনের চেয়ে বড় আর কি আছে?’

যমুনাকে একটা চুমো খেতে যাচ্ছে ও।

হঠাৎ খুক করে কে যেন কাশল। ‘বসকে আর কতক্ষণ

অপেক্ষা করিয়ে রাখবি তোরা?’

পরস্পরকে ছেড়ে দিয়ে ঘাড় ফেরাল ওরা। পাঁচ হাত দূরে

স্ফাড়িয়ে রয়েছে কাবাব যে হাড্ডিÑসোহেল।

‘হাই, সোহেল ভাই! বসও এসে হাজির?’ রুমাল বের করে

চোখ মুছল যমুনা। ‘ভবনিয়ার ভব-যন্ত্রণা শেষ, কিন্তু তার সোনার

কি হবে?’

‘ওগুলোর বৈধ মালিক আসলে মলি−কা রতœপ্রভার মা-বাবা ও

ভাই-বোনÑএখনও যদি বেঁচে থাকে তারা,’ বলল সোহেল।

‘কারণ, মলি−কার কাকা রতœগিরির টাকা দিয়েই ওই সোনা কেনা

হয়েছে।’ যমুনাকে মাঝখানে নিয়ে কপ্টারের দিকে হাঁটছে ওরা।

‘আমরা খবর দিয়েছি, গেরিলাল্ডে ছদ্মবেশ নিয়ে সরকারী সৈনশুা

পয়েন্ট পেড্রোতে যে-কোন মুহূর্তে পৌঁছে যাবে। জাহাজে

কয়েকজন ক্রু ছাড়া আর কেউ নেই, কাজেই ওটাকে দখল করে

কলম্বোয় নিয়ে যেতে ওল্ডে কোন সমস্যা হবে না।’

‘কিন্তু তেলবিক্রির টাকা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

যমুনা বলল, ‘ভবনিয়ার একটা কমপিউটর ডিস্ক চুরি করেছি

গোপন শত্র“

২০৫



আমি। তাতে তেলবিক্রির টাকার হিসাব, যে সব সুইসব্যাংকে

টাকাগুলো জমা রাখা হয়েছে সেগুলোর নাম, নমিনির নাম,

অ্যাকাউন্টগুলোর কোড নাম্বার ইত্যাদি সমস্ত তথ্য ঠাসা। আমার

মনে হয়, সরকারী পর্যায়ে চেষ্টা করা হলে তেলবিক্রির সমস্ত টাকা

আমরা উদ্ধার করতে পারব।’

‘ভেরি গুড,’ বলল সোহেল। ‘বস্ সম্ভবত এ-ব্যাপারেও

তোল্ডে সঙ্গে আলাপ করতে চাইছেন।’

রানা জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বুঝতে পারলি, স্যার কি আমার

ওপর খেপে আছেন?’

‘তোর ওপর খেপবেন?’ সোহেল অবাক। ‘কেন?’

‘না, মানে, কবীর চৌধুরীর সঙ্গে একই হেলিকপ্টারে থাকা

সত্ত্বেও তাকে আমি বাধা দিতে ব্যর্থ হলাম, তেলখনিটা রক্ষা

করতে পারলাম না...’

‘তেলখনি? ওটা আগে যেমন বাংলাদেশের ছিল, এখনও

তেমনি বাংলাদেশেরই আছে। রাগ করা তো দূরের কথা, বস্

বলছিলেন তোর নিরাপত্তার কথা ভেবে গত কয়েক ঘণ্টায় তাঁর

বয়স নাকি দশ বছর বেড়ে গেছে।’

‘আর আমার ওপর?’ চট্ করে জিজ্ঞেস করল যমুনা। ‘এই যে

লক সিস্টেমের কথা চেপে যাওয়া...’

‘বস্ শুধু একটা কথাই বলেছেন: মেয়েটার প্রতি গোটা

বি.সি.আই-এর প্রত্যেকে আমরা কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম!’

চুলের গোড়া পর্যন্ত লাল হয়ে গেল যমুনার মুখটা, তাই দেখে

হাসল সোহেল।

‘উনি আরও বললেন: রানার প্রতি ওর বিম্বাস ও ভক্তির

পরিমাণটা বোঝা গেল। আর শেষের অভিনয়টুকুর তো কোনও

তুলনাই হয় না!’

দেখার মত হলো যমুনার চেহারাটা। রানার দিকে ফিরল

২০৬

মাসুল্ডানা-৩১৬



সোহেল, ‘আর তোর সম্পর্কে বললেন: আমার পাগলা ছেলেটা

গেছিল আরেকটু হলে। ওকে ফিরে পেয়ে বড় ভাল লাগছে,

সোহেল!’

‘যাহ্, এ-কথা বস্ বলতেই পারেন না। তুই মিথ্যে...’

‘খোদার কসম, একটুও বানিয়ে বলছি না।’

রানার চোখে সন্দেহ। ‘তুই হঠাৎ এত সিরিয়াস হতে শিখলি

কবে থেকে? ভেতরের সব কথা জানলিই বা কি করে?’

যমুনা বলল, ‘রানা, আমার কাছে ছোট্ট একটা রেডিও

আছে।’

‘রেডিও আছে...তো?’ রানা অবাক।

‘সোহেল ভাইয়ের সঙ্গে এক সুযোগে কথা বলি আমি,’ বলল

যমুনা। ‘লক সিস্টেমের কথা জানাই ওঁকে। উনি বসকে জানান।

সেজন্যেই আমরা সবাই প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় ভুগছিলাম।’

‘শুধু-শুধু।’ বলল রানা। ‘লক সিস্টেম থাক বা না থাক,

বোতামটায় আমি চাপ দিইনি...’

‘মিথ্যে কথা! বোতামে তুমি চাপ দিয়েছ!’ প্রতিবাদ করল

যমুনা। ‘তা না হলে কি করে তুমি ভাবলে আমি বিশ্বাসঘাতকতা

করতে পারি?’

সোহেল স্ফাড়িয়ে পড়ল। এক হাতে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে

ধরল রানাকে। থরথর করে কাঁপছে সোহেল। গাল বেয়ে নামছে

জলের ধারা।



***

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.