![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৭১ সালে ভুট্টো-ইয়াহিয়া মাতালের মতো প্রলাপ বকে যাচ্ছিলো। পরাজয়ের হতাশা থেকে আর পতনশীল অহমিকার উত্তাপ থেকে ভুল দম্ভবাণী উচ্চারণ করে যাচ্ছিলো ভুট্টো- ইয়াহিয়া। তারেক রহমানরাও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপদ এলাকায়, অভিজাত হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রমাণিত, মীমাংসিত ইতিহাসের আদ্যশ্রাদ্ধ করছেন হতাশার জ্বরের ঘোরে। কোনো সুস্থ মানুষ এভাবে ইতিহাসের পবিত্র পৃষ্ঠাগুলোর ওপর বিষ্ঠা নিক্ষেপ করতে পারে না। ইতিহাসে যাদের কানাকড়ির স্থান নেই, তারাই পারে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ছেদন করে দিতে। তারাই পারে ইতিহাসের কালোত্তীর্ণ মহাপুরুষদের অপমান করতে। কাউকে অপমান করা সহজ, সম্মান করাই কঠিন। অবশ্য কোনো মহাপুরুষকে সম্মান দিতে হলেও যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। সেই যোগ্যতা যাদের নেই, তারাই পারে ইতিহাস নির্মাণকারী, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে অসম্মান করতে। সব কিছুর সীমা আছে কিন্তু অজ্ঞতার সীমা নেই।
মহান দার্শনিক সক্রেটিস বিপদে পড়েছিলেন একথা বলে যে, ‘আগে নিজেকে চেনো।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার সমকালের স্বঘোষিত প-িতদের মুখোশ খুলে যায়। সক্রেটিস প্রমাণ করে দিয়েছিলেন নকল প-িতরা যত আস্ফালন করে, তত বিদ্বান তারা নয়; তারা লেফাফা দূরস্ত। এটাও প্রমাণিত হয়েছিলো যে, সক্রেটিসের জ্ঞান সীমাহীন আর অন্যেরা প্রমাণসাইজ। যারা প্রমাণসাইজ, তারাই সক্রেটিসকে ঈর্ষা করতো। যোগ্য কখনো অযোগ্যকে ঈর্ষা করে না, অযোগ্যই যোগ্যকে ঈর্ষা করে। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন অবশ্য অন্যকথা, ‘সমকক্ষকে ঈর্ষা করা বাঙালির প্রধান বৈশিষ্ট্য।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না জিয়ার মতো প্রমাণসাইজ ধুরন্ধরের। জিয়া সমকক্ষ ছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহর, তাই তাকেই ঈর্ষা করতেন। সেই ক্রোধ বঙ্গবন্ধুর ওপর পড়েছিলো। রাজনীতিতে অভিজ্ঞ বঙ্গবন্ধু জিয়াকে চিনতেন। তাকে সন্দেহ করতেন। এ প্রসঙ্গে লে. কর্নেল হামিদের কিছু কথা তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘যে কোনো কারণেই হোক, শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়াকে উচ্চাকাক্সক্ষী বলে মনে করতেন। জেনারেল ওসমানীও জিয়াকে ভালো চোখে দেখতেন না। এমনকি ঐ সময় জিয়াকে পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে আর্মি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি হয়ে যায়।’ (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা- ৪র্থ সংস্করণ, পৃঃ ১৬-১৭)।
চতুর জিয়া কর্নেল হামিদের মাধ্যমে রাজ্জাক তোফায়েলকে ধরে এই বদলি স্থগিত করান। ব্রিটিশ সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার বইতে জিয়ার এক সহকর্মীর দীর্ঘ জবানবন্দী তুলে ধরেছেন। তার এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘তিনি আবেগকে দারুণভাবে সামলিয়ে নিতে পারতেন। এমনকি রাতেও তিনি কালো ‘সানগ্লাস’ পরতেন যাতে করে কেউ তার চোখ স্টাডি করে তার মনের গতি অনুধাবন করতে না পারে।’
একই জবানবন্দীর অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর জিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভ্যুত্থান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে, জেনারেল জিয়া যেভাবে তার নিজের সৈন্যদের ওপর ব্যাপকহারে হত্যাকা- চালান; এই উপমহাদেশের ইতিহাসে কোনো জেনারেল এমনটি করেছেন বলে নজির নেই।’ (বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ-পৃঃ ১৩২-৩৩)।
একই জবানবন্দীতে বলা হয়েছে, ‘জিয়া এমন এক মানুষ ছিলেন, যিনি এক হাতে হত্যা আর অন্য হাতে আহার করতে পারতেন’ (ঐ)। ওই জবানন্দীতে লেখা আছে জিয়া কীভাবে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে দেশের ৭ম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ওই জবানবন্দীতে বলা হয়েছে, ‘এর আগের বছর ২৮ নভেম্বর জিয়া সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রেসিডেন্ট সায়েমকে এক সঙ্গে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রাখা তার জন্যে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। দু’টি পদেই প্রেসিডেন্ট সায়েম তার ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করে আসছিলেন। এই সময় হঠাৎ করে সায়েমের মতের বিরুদ্ধে পরবর্তী ফেব্র“য়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য করেন জিয়া। এর পেছনে প্রকৃত কারণ ছিল, জিয়া ঐ সময়ে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি নির্বাচন দিয়ে তার ঐ পরিকল্পনার মূলে কুঠারাঘাত করতে চাইলেন না। অথচ বিচারপতি সায়েম প্রতিশ্র“তি মোতাবেক ফেব্র“য়ারিতে নির্বাচন দিতে চাইছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই প্রেসিডেন্ট সায়েম জিয়ার প্রতি খুশি থাকতে পারেননি। প্রেসিডেন্টের একজন নিজস্ব লোকের মাধ্যমেই জিয়ার কাছে খবর চলে যায় যে, দেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্যে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সরিয়ে অন্য একজন অধিকতর কম উচ্চাভিলাষী লোককে নিয়ে আসতে পারেন। ব্যাপারটিতে আদৌ কোনোরকম সত্যতা ছিল কি না আমি নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে, তা চির সন্দেহভাজন জিয়ার মনে ত্বরিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তিনি সায়েমকেই পাল্টা সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।’ (ঐ পৃঃ ১৩৪)। ওই জবানবন্দীতে জিয়ার সহকর্মী বলেন যে, ‘জিয়ার উচ্চাভিলাষের সীমা ছিল না। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার বাসনা মনে পোষণ করতে থাকেন।’ বলা হয় ওই জবানবন্দীতে, ‘১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছিলো যাতে জিয়া সামরিক পোশাকে বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। একজন সাংবাদিক তাকে ‘সাফারি স্যুট পরিহিত জেনারেল’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ….জিয়া বিরোধীদলগুলোকে মাত্র ৪০ দিনের নোটিশে নির্বাচনে আহ্বান করেন এবং মাত্র ২৩ দিন তাদের প্রচারণার সুযোগ দেন। অন্যদিকে তিনি নিজের নির্বাচনি প্রচারণার জন্যে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে পুরোপুরি কাজে লাগান। সরকারি মালিকানাধীন টিভি, রেডিও এবং সংবাদপত্রকে একচ্ছত্রভাবে কাজে লাগানো হয়। সর্বোপরি জেনারেল জিয়া একাধারে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ছিলেন। আর কিছু ঘটুক বা নাই ঘটুক, এই সকল ক্ষমতার বলে এটা নিশ্চিত হয়েছিলো যে, পুলিশ এবং সরকারি কর্মচারীরা তার পক্ষে কাজ করবে। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল খলিলুর রহমানের মতে, একজন সিনিয়র জেনারেল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঊর্ধŸতন পুলিশ অফিসারদের উদ্দেশে এক ভাষণে নির্দেশ প্রদান করেন যে, ‘যে কোনো উপায়ে হোক নির্বাচনে জেনারেল জিয়ার বিজয় সুনিশ্চিত করতে হবে। তবে শতকরা ৭০ ভাগের বেশি ভোট যেন জিয়ার পক্ষে না দেখানো হয়।’ (ঐ- পৃঃ ১৩৬)। স্বয়ং জিয়া কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশÑ ১৯৭৮ অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী হতে পারবেন না যিনি সরকারি চাকরি করেন এবং বেতন গ্রহণ করতে থাকেন। জিয়া এই অধ্যাদেশ লংঘন করে অবৈধভাবে ১৯৭৮ এর নির্বাচনে দাঁড়িয়ে অবৈধ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ‘জিয়া সেই সময়ের ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এরশাদকে ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করলেও তিনি ১৯৭৮-এর ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চিফ অব আর্মি স্টাফের দায়িত্বভার নিজ হাতে রেখে দিয়েছিলেন। ১৯৭৮-এর ১ ডিসেম্বর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের উপস্থিতিতে জেনারেল এরশাদকে তার অফিসে ডেকে এনে হাতে লিখে ১৯৭৮ এর এপ্রিল মাসের তারিখ দিয়ে তাকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগের পত্র জারি করেন। জানা যায়, কিছু সাংবিধানিক সমস্যা কাটানোর জন্যেই এই রকম ‘ব্যাক-ডেট’ দিয়ে কাজটা সমাধা করা হয়।’
‘জিয়া তার নিজের প্রমোশনের ব্যাপারেও কয়েকবার সেই আদেশ সংশোধন করে সর্বশেষ ৯/৪/১৯৭৯ইং তারিখে ৭/৮ ডি-১/১৭৫-২৭০ নম্বর বিশিষ্ট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিজেকে ২৯/৪/১৯৭৯ইং থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং ৯/৪/১৯৭৯ইং তারিখে আর একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৯/৪/১৯৭৮ইং থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই দলিল থেকেও এটা প্রমাণিত হয় যে, ১৯৭৮-এর জুনে তার নির্বাচন ছিল অবৈধ এবং অসাংবিধানিক।’
‘এই বৈধতা নিয়ে নির্বাচনের পূর্বে সেনাবাহিনীর একটা অংশ প্রশ্ন তোলে যে, জেনারেল জিয়া একই সঙ্গে সিএনসি, সিএমএলএ এবং সিএএস হিসেবে বহাল থেকে নির্বাচনে অংশ নিলে, তা সংবিধানের পরিপন্থি এবং তা আইন ও গণতন্ত্রের মূলনীতির বরখেলাপ বলে বিবেচিত হবে।’ (ঐ-পৃঃ ১৩৭-৩৮)।
হায় কপাল, এহেন চৌকস, ধূরন্ধর জেনারেল শতকরা ১০০ ভাগ অবৈধ পন্থায় দেশের হর্তাকর্তা হয়েছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তার ক্ষমতাগ্রহণকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছিলো। এখন তারই গুণধর পুত্র বলে কি না ‘শেখ মুজিব অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।’ দেশের আরেক অবৈধ রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের কাছ থেকে তারেক রহমানরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এরপরও তারেক রহমানদের কাছ থেকে আমাদের ‘বৈধ অবৈধ’ সম্পর্কিত বয়ান শুনতে হবে?
©somewhere in net ltd.