![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুয়েকটি পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে, বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট ডিসেম্বর মাসে সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দিতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ঢাকার বাইরে দুয়েকটি জনসভা করেছেন আরো কয়েকটি সভার সূচি নির্ধারিত ছিল, জামাতের ডাকা হরতালের কারণে তা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। শিগগির তা হতে যাচ্ছে। বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিসহ শীর্ষ পর্ষদের নেতাদের সঙ্গে, একই সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এসব বৈঠকের পরই বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে আভাসইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
ডিসেম্বরজানুয়ারি মাস শীতকাল। এ সময়টা আন্দোলনের অনুক‚ল পরিবেশ হিসেবেও ভাবা হয়, তাই ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ ডাকার কথাও দলটি ভাবছে বলে পত্রপত্রিকায় ধারণা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া গত বছর ডিসেম্বর মাসে ২০ দলীয় জোট ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক কর্মসূচি পালন করেছিল। ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ নামে ঢাকা চলো কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল। সেই কর্মসূচি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সরকার বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও শেষ করতে পেরেছিল। নিকট অতীতের সেসব ঘটনা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। এখন মনে হচ্ছে বিএনপি বছর শেষে বা পূর্তি উপলক্ষে আন্দোলন করার কথা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়ে ২০ দলীয় জোট এই আন্দোলনের সূত্রপাত করতে চায় বলে মনে হচ্ছে।
তবে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটের জন্য যেটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তা হচ্ছে, জনগণ সেই ডাকে সাড়া দেবে কিনা তা বোঝা। গত এক বছর ধরে ২০ দলীয় জোট আন্দোলনের ডাক দেয়ার ঘোষণা অনেকবারই দিয়েছিল, কিন্তু কোনোবারই তারা ঘোষিত সময় অনুযায়ী কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি। জনগণের মধ্যেও এসব আন্দোলনের কর্মসূচির প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ লক্ষ করা গেছে তেমনটি বলা যাচ্ছে না। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, বিএনপির সমর্থকদেরও অনেককেই দেখা গেছে রাজনীতি, আন্দোলনসংগ্রাম, হরতাল ইত্যাদি নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য না করতে। এই মুহ‚র্তে কোনো আন্দোলন সংগ্রামে সাধারণ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কোনো মনোভাব দেখছেন বলে মনে হয় না। এর কতোগুলো বাস্তব কারণ রয়েছে। প্রথমত মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়, কেন গেলো বছর বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলো। যতোই বলা হোক যে, সরকার চায়নি বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। এমন দাবি শিশুসুলভ। সরকার চাইলেই বিএনপির মতো একটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না এটি মানা যায় না। মানলে বিএনপির নিজস্বতাই যে নেই, তা মানতে হবে, স্বীকার করতে হবে। বিএনপি যখন এমনটি বলে তখন তারা রাজনৈতিকভাবে নিজেদের হেয় করে। বিএনপি এখন হয়তো কর্মীসমর্থকদের সান্ত¡না দেয়ার জন্য এটি বলতে পারে। তবে গেলো বছরের বাস্তবতা গভীরভাবে মনে রেখে দেখলে মানতে হবে যে, বিএনপির এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে অন্য রকম হিসাবনিকাশ ছিল, বিবেচনা ছিল। সেই হিসাবনিকাশ সফল হয়নি, ব্যর্থ হয়েছে। আর সরকার যেনতেনভাবে হলেও একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে উতরে যেতে পেরেছে। যদি উতরে যেতে না পারতো তাহলে বিএনপির পরিকল্পনাই সফল হতো। তাহলে সহজেই প্রশ্ন জাগে, বিএনপির পরিকল্পনা বা হিসাবনিকাশ কী ছিল? বিএনপির পরিকল্পনা এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট, তা হচ্ছে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে না দেয়া। নির্বাচন করতে না পারলে আওয়ামী লীগ জনরোষে পড়বেই, জনগণ বের হয়ে আসবেই সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবেই, তাতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি বাংলাদেশে বড় ধরনের জনরোষে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, এর বিপরীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বিএনপি বা ২০ দলীয় জোটের উত্থান ঘটবে অনায়াসেই। তখন আওয়ামী লীগকে যা করার তা করা যাবেই। এর বাইরে অন্য কোনো পরিকল্পনা বা হিসাবনিকাশ থাকার মতো কিছু দেখা যায় না। বিষয়টি তখন অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল যে, বিএনপি কেন নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করতে গেলো, যেখানে শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলাপ করাসহ নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা যখন নমনীয় হয়েছিলেন, তখন খালেদা জিয়া কঠোর অবস্থানে গেলেন এবং নিজস্ব পরিকল্পনা মতো এগিয়ে যেতে থাকেন। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে যেটি খুবই দুঃসহ স্মৃতি হিসেবে ভেসে ওঠে তা হচ্ছে গেলো বছর সরকার উৎখাত, নির্বাচন প্রতিহতসহ বিভিন্ন দাবি দিয়ে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা দেশব্যাপী যে তাণ্ডব শুরু করেছিল তা ছিল অবিশ্বাস্য। জামাতশিবিরের নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্য গাছ কাটা, রাস্তা কাটা, ব্যারিকেড দেয়া, গাড়ি পোড়ানো, যাত্রীদের লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করা, মানুষ পুড়িয়ে মারা হেন কোনো অপরাধ নেই তা করেনি। ট্রেনে আগুন দেয়া, লাইন উপড়িয়ে ফেলা ইত্যাদি চরমপন্থার অবতারণা করা হয়েছে।
অতীতে দেশে সরকারের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন হয়েছে। গাড়ি ভাঙচুর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গেলো বছরের আন্দোলন সকল সহিংসতার মাত্রা অতিক্রম করেছিল। তাতে একদিকে যেমন জনমনে প্রচণ্ড ভীতি ও জীবনমরণ অবস্থা তৈরি হয়েছিল, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয়উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, জনগণের বিরুদ্ধে ২০ দলের অবস্থান বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। ফলে মানুষ ২০ দলের দাবিদাওয়া আন্দোলন ও কর্মসূচি প্রতি একাত্ম হওয়ার পরিবর্তে এর থেকে মুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। মানুষ ভোট বা নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। এ কারণেই ৫ জানুয়ারির পর সরকার যখন নির্বাচনটি যেভাবেই হোক শেষ করে দিতে সক্ষম হয়, সাধারণ মানুষ ৬/৭ তারিখ থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। নির্বাচন ভালো হয়েছে কি মন্দ হয়েছে তা নিয়ে ভাবতে চায়নি, বিচার করতে যায়নি। বাংলা প্রবাদ ‘ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলাও’ এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে দাঁড়াতো ‘নির্বাচন চাই না, ‘আন্দোলন’ সামলাও’। এর জন্য জনগণ নয়, বিরোধী দলই দায়ী এটি স্বীকার করতে হবে। কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি যদি এতোটা নিষ্ঠুর, নির্দয়, অমানবিক এবং পোড়াপুড়ি নির্ভর হয়ে পড়ে তাহলে জনগণ তো সেই আন্দোলনকে ভয় পাবেই, পালাবেই। ২০১৩ সালের বিরোধী দলের তথাকথিত আন্দোলন মানুষকে কতোটা ভীতসন্ত্রস্ত করেছে তা যদি বিএনপির মতো দল এখনো বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ না করে তাহলে জনগণের সমর্থন লাভের কর্মসূচি দেয়ার বিষয়গুলো তারা কতোটা নিতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
মানুষ এখনো গেলো বছরের দুঃসহ দিনের কথা ভাবতে শিউরে ওঠে। মানুষের রুটিরুজি যদি কোনো দল বন্ধ করে দেয়, তাদের জীবন যদি বিপন্ন করে দিতে কুণ্ঠাবোধ না করে তাহলে সেই আন্দোলনে জনগণের সমর্থন বা অংশগ্রহণ কখনই বৃদ্ধি পাবে না। কেবলমাত্র দলীয় নেতাকর্মীসমর্থকদের দিয়ে আন্দোলন করা যায়, কিন্তু জনসমর্থন বাড়ানো যায় না। বাড়াতে হলে সে ধরনের কর্মসূচি থাকতে হয়, নিজেদের করণীয় কি তা জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হয়। সেটি ২০১৩ সালের কোনো আন্দোলনেই ছিল সরকার পতনের লক্ষ্যাভিমুখী কোনো পরিকল্পনা গোপন থাকে না। ৫ মে হেফাজতের সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৬ তারিখ ঢাকায় ‘তাহরির স্কয়ার’ করার পরিকল্পনা লুকানো যায়নি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহত করার নামে সাংবিধানিক সংকট এবং সরকার উৎখাতের পরিকল্পনাও গোপন থাকেনি, এসব বিষয় এরই মধ্যে বহুলভাবে আলোচিত হচ্ছে, যতোই মিডিয়ায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কতিপয় আলোচক একভাবে সরকারকে দায়ী করে বক্তব্য দেন, কিন্তু রাজনীতির বিশ্লেষণ যাদের চিন্তাভাবনায় উপস্থিত তারা বিষয়টিকে অতোটা সরলভাবে উত্তর দিতে পারেন বলে মনে হয় না। তারপরও অনেকেই সে রকমই কিছু দিয়ে থাকেন। সেটিই আমাদের শুনতে হয়।
তবে এখন বিএনপি যে আন্দোলনের ডাক দেবে বলে বলা হচ্ছে তার প্রতি জনগণের প্রতিক্রিয়া কী হবে তা ডাক দেয়ার পরই দেখা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত মানুষ এ নিয়ে নির্বিকার এটিই দেখা যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, গেলো বছরের দুঃসহ স্মৃতি, দ্বিতীয় হচ্ছে গেলো বছর বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি, বর্জন করেছে, তা প্রতিহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। এখন এক বছর যেতে না যেতে এমন কী হয়ে গেছে যে, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে। নির্বাচনের কোনো পরিবেশই তৈরি হয়নি এমনটি সবাই দেখছে। দেশে পরবর্তী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে এখন থেকেই নির্বাচন ব্যবস্থা, কমিশনসহ অনেক কিছুতেই আইনি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। সেসব দাবিদাওয়া যুক্তিসঙ্গতভাবে সরকারের কাছে তুলে ধরা জরুরি হতে পারে। ভবিষ্যৎ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কেমন হবে সেটিও আলোচনায় আসা উচিত। এ নিয়ে সরকার এবং বিএনপির মধ্যে আলোচনার পরিবেশ তৈরির দাবি করা যেতে পারে। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে করণীয় বিষয়সমূহ নির্ধারণ না করে এখন আন্দোলনের ডাক দেয়ার অর্থ নির্বাচন নয়, নিজেদের দলীয় কোনো বিবেচনা, জামাতকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা এমন কিছু একটা হতে পারে জনগণ তো তাই মনে করছে। তেমন আন্দোলনে জনগণ কতোটা সাড়া দেবে তা বলা মুশকিল। তবে ২০ দলীয় জোট আন্দোলন করতে চাইলে কিছুদিন হরতাল বা অন্যকিছু দিয়ে মাঠ কিছুটা উত্তপ্ত করতে পারে। শেষ বিচারে সেই আন্দোলনের ফলাফল কী হবে তা দেখা যাবে পরে যেমনটি গেলো বছরের অন্তঃসারশূন্য ফলাফল দেখা গেছে জানুয়ারির ৫ তারিখের পর থেকে। সুতরাং বিএনপি ভেবেচিন্তেই কর্মসূচি দেবে তেমনটিই রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করতে পারেন।
©somewhere in net ltd.