![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এবারের রাজনৈতিক সহিংসতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের মৃত্যু। আগে সংঘাত বা সহিংসতায় মারা যেতেন রাজনৈতিক কর্মীরা। এর মধ্যে পড়ে কখনো কখনো সাধারণ মানুষ মারা যেতেন।
কিন্তু এক মাসের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মারা যাওয়া ৫৮ জনের মধ্যে ৪৩ জনই নিরীহ মানুষ। এই পরিসংখ্যান এবং অতীতের তুলনামূলক চিত্র বলছে, দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ধরন বদলাচ্ছে। আগে হত্যাকাণ্ড ঘটত মারামারি বা গোলাগুলিতে। আর এখনকার প্রায় সব মৃত্যু হচ্ছে পেট্রলবোমায় বা নৃশংসভাবে আগুনে পুড়ে।
১৯৯৬ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার পরিসংখ্যান বলছে, ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সহিংসতা ও আক্রমণের লক্ষ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দিক থেকে সাধারণ মানুষের দিকে ঘুরে গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘এবার যে ধরনের আন্দোলন দেখতে পাচ্ছি তা অতীতে কখনোই দেখিনি। এবারই প্রথম পেট্রলবোমার ব্যবহার হচ্ছে। আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমা মেরে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।’ তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে বোমা মেরে রাজনৈতিক সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের টানা অবরোধ চলছে গত ৬ জানুয়ারি থেকে। কর্মসূচি চলাকালে নিহত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ১৫ জন। বাকি ৪৩ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে পেট্রলবোমা ছুড়ে বা যানবাহনে আগুন দিয়ে। আর রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা মারা গেছেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে। এর বাইরে এই সময়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন আটজন।
বিশ্লেষণে পাওয়া যায়, নৃশংসতার মাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ১৩ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুরে চলন্ত বাসে ছোড়া পেট্রলবোমায় পুড়ে মারা গেছেন নারী-শিশুসহ ছয়জন। প্রায় একই রকম হামলায় গতকাল ভোররাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে চলন্ত বাসে পেট্রলবোমা হামলায় পুড়ে মারা গেছেন নারী-শিশুসহ সাতজন। সারা দেশে অবরোধের আগুনে পুড়েছেন বা পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়েছেন আরও শতাধিক মানুষ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে মৃত্যুর কারণ হচ্ছে মানুষের মধ্যে হিংসাত্মক প্রবণতা বেড়ে যাওয়া। যারা এতে অংশ নিচ্ছে বা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে (অবরোধকারীরা), তাদের মধ্যে সাবধানতা বেশি। এ জন্য তারা নিহত-আহত হচ্ছে কম। কিন্তু সাধারণ মানুষকে তো বাইরে বের হতেই হয়, বাসের মধ্যে তো আর সাবধানতা নেওয়া যায় না। এ জন্য তারাই বেশি সংখ্যায় মারা যাচ্ছে।’
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আরও বলেন, আগে নিজেরা নিজেরাই (রাজনৈতিক কর্মী) মারামারি করত, এতে রাজনৈতিক কর্মীরা হতাহত হলেও সাধারণ মানুষের মৃত্যু কম হতো।
অতীতে রাজনৈতিক সহিংসতায় কারা কীভাবে মারা গেছেন—এ বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য বিভিন্ন সংসদ নির্বাচনের আগের কয়েক মাসের সংবাদপত্রের খবর পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো। এ সময়সীমা বেছে নেওয়ার কারণ হলো, বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরগুলোতেই রাজনৈতিক সহিংসতা বেশি হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ ও ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচন হয়। দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় ৮২ জন মারা গেছেন, যাঁদের মধ্যে ৬৮ জনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এই ৬৮ জনের মধ্যে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী মারা গেছেন ৩৬ জন, আর সাধারণ মানুষ মারা গেছেন ২৯ জন। অন্য তিনজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন হয়। নির্বাচনের আগের দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের সংবাদপত্র থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, এই দুই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৯৬ জন মারা গেছেন। তাঁদের ৭৭ জনই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, অন্যান্য দুজন। সাধারণ মানুষ মারা গেছেন ১৭ জন।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে নবম সংসদ নির্বাচনের কথা থাকলেও রাজনৈতিক সহিংসতায় তা হয়নি। ওই বছরের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই তিন মাসে ৩২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ২৮ জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বাকি চারজন সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক সহিংসতায় বেশির ভাগই মারা যান দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে নয়তো পুলিশের গুলিতে। আর সাধারণ মানুষ মারা যান সংঘর্ষের মাঝে পড়ে। কিন্তু পেট্রলবোমা বা ককটেল হামলায় একজনও মারা যায়নি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের পুরোটা বছরই ছিল রাজনৈতিক সহিংসতার বছর। এ বছর প্রাণ হারান ৫০৭ জন, যার মধ্যে ১৯৬ জনই সাধারণ মানুষ। ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের ডাকা লাগাতার অবরোধে এই সময়ে ১২০ জন প্রাণ হারান। এঁদের মধ্যে ৭০-৮০ জনই সাধারণ মানুষ। অবরোধের আগুন, পেট্রলবোমা ও ককটেল হামলায় এঁদের মৃত্যু হয়েছে। ২২ জন মারা যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এ ছাড়া পুলিশ ও বিজিবির ১৯ জন সদস্য মারা যান।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘আন্দোলনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতা-কর্মীরা মারা যেত, অতীতে এমনটাই দেখেছি। কিন্তু এবার বেশি মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বোমা মেরে মানুষ মারার রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। সে জন্য দরকার রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের শুভবুদ্ধির। তাঁরা আলোচনার টেবিলে বসলেই সমস্যার সমাধান হবে।’
©somewhere in net ltd.