![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবীজুড়েই জঙ্গিবাদের আগ্রাসন বেড়ে চলছে। তবে এর সিংহভাগই ঘটছে মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহে। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, মধ্য আফ্রিকা, উত্তর আফ্রিকা, গোটা মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, পাকিস্তান- কোথায় নেই ইসলামের নাম ব্যবহারকারী উগ্রপন্থার জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর অমানবিক তৎপরতা। অনেক বছরই ভাবা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত থাকবে। যুক্তি ছিল- এখানকার মাটি অন্যরকমের। এখানকার মানুষ এক সময়ে সুফিবাদের প্রভাবে অসাম্প্রদায়িক। এখানে সব ধর্মের মানুষ যুগ যুগ ধরে এক ছাতার নিচে বসবাস করে এসেছে। কথাটি এক অর্থে ঠিক। অন্য অর্থে ঠিক নয়। এক অর্থে বলতে মধ্যযুগের দীর্ঘ সময়ের জন্য পুরোপুরি ঠিক। কিন্তু বিশ শতকের বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী সময় থেকে পরিস্থিতি ভেতরে ভেতরে পাল্টে গেছে। সরলীকরণ এখানে করা যাবে না। বিশ শতকের পৃথিবী আধুনিক প্রযুক্তি ও সম্ভারে যেমন ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি প্রায় দেড়শত নতুন রাষ্ট্র আবির্ভাবের চ্যালেঞ্জে পড়েছে। একে ধারণ করার জ্ঞানতাত্তি¡ক চর্চার ধারাবাহিক উত্তরণ না ঘটায় আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ মৌলিক চিন্তার সংকটে পড়েছে। আধুনিক রাষ্ট্র এবং মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণার দ্ব›েদ্ব সাধারণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি বেড়ে ওঠেছে। একসময় প্যান ইসলামিজম সেটিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। সারা বিশ্বের মুসলমানের এক ও অভিন্ন পরিচয়ের রাষ্ট্রের ধারণাটি অনেকটা সর্বহারাদের আন্তর্জাতিকতাবাদের কাছ থেকে বিকৃতভাবে ধার করে নেয়া মতবাদের রূপান্তর। বিশ শতকের পৃথিবীতে নতুন নতুন রাষ্ট্র-চিন্তার আবেগে ভেসে গেছে অনেক অঞ্চল, সে ক্ষেত্রে মুসলিম সাধারণ মানুষ কখনো খিলাফত প্রতিষ্ঠা, কখনো প্যান ইসলামিজম, কখনো আরব বিশ্ব তত্ত্ব, আরব লীগ ইত্যাদি চিন্তায় আপ্লুত হয়েছে। তবে এসব তত্ত্বের গভীরে কমই প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে। এটা অনেকটা মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় ভাবাদর্শের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মতো যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য গঠন। এ সাম্রাজ্যের পেছনে ছিল ভেটিকানের পোপতন্ত্র। কিন্তু সেই পোপতন্ত্রও টিকে থাকেনি। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা থেকে ক্যাথলিক অধ্যুষিত পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপীয় রাষ্ট্র, অর্থোডক্সোসীয় ভাবাদর্শের বলকান ও সøাভ রাষ্ট্রপুঞ্জ, প্রোটেস্টান্ট অধ্যুষিত উত্তর ইউরোপীয় রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদিক থেকে বৌদ্ধধর্ম পৃথক কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তত্ত্বীয় লড়াইয়ে নামেনি। তবে বিশ শতকের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের বিভাজনের পেছনে স্বার্থবাদী মার্কিন এবং ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির স্রষ্টা ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী নানাভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে। সেই ফাঁদে পা দিয়েছে অনেকেই। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এখানকার জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিবর্তন নিশ্চিত হলে যে ধরনের রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল তা ঘটতে পারেনি অভ্যন্তরীণ নানা গোষ্ঠীতান্ত্রিক পক্ষের দ্ব›দ্ব-সংঘাতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার ভুল নীতি ও কৌশলের কারণে। সাদ্দামকে উচ্ছেদ করে আইএস সৃষ্টির পথ প্রশস্ত কে করেছে? তারাকি-হাফিজুল্লাহকে উৎখাত করে আফগানিস্তানে তালেবানদের আমদানি করিয়েছে কে? গোটা মধ্যপ্রাচ্য এখন চলছে ভয়ানক এক অনিশ্চয়তার মধ্যে। তারপরও মুসলিম অধ্যুষিত অন্যান্য দেশে রাষ্ট্র রাজনীতিতে ‘জেহাদ’ ‘বিপ্লব’, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেগ চলছে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো গোষ্ঠী সেই আবেগের পেছনে অর্থ, অস্ত্র এবং জেহাদিতত্ত্ব বিনিয়োগ করছে।
বাংলাদেশ সেই নেটওয়ার্কে আশির দশকেই সন্তর্পণে ঢুকেছে। বিএনপি জাতীয় পার্টির সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি সেই সুযোগ করে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সশস্ত্র যুদ্ধের তালিম নিয়ে যে সব গোষ্ঠী দেশে ফিরে এসেছে তারা কিছুটা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী সুপরিকল্পিতভাবে নিজেদের সংগঠিত ও তৈরি করেছে। গোটা আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এই শক্তি তরুণদের একটি অংশকে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে কাছে টেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল ধরনের আর্থিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে তাদের বড় ধরনের ভিত্তি তৈরি করতে তারা সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ‘সশস্ত্র বিপ্লবের’ শক্তি হিসেবে তৈরি করেছে। ২০০১ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় জামায়াত অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে, শহরে, সরকারে প্রশাসনসহ সর্বত্র নিজেদের অবস্থানকে সংহত করেছে। বিএনপি সেই সুযোগ জামায়াতকে বিনা দ্বিধায় করে দিয়েছে। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভিত্তি লাফিয়ে লাফিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। জামায়াত অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তিশালী দলে পরিণত হতে পেরেছে। একই সঙ্গে জামায়াতের আর্থিক শক্তি শনৈঃশনৈ করে বেড়েছে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশে একমাত্র জামায়াতই অসংখ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক যেখানে কর্মজীবী সবাই জামায়াতের আদর্শের ধারক এবং বাহক। ফলে জামায়াত গতানুগতিক পথে নয়, একেবারে ভিন্ন পথে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছে- যাদের গোপন উদ্দেশ্য বোঝার মতো জ্ঞান রাখে না এ দেশের রাজনীতি এবং এর বাইরের অনেকেই। বলা হয় বাংলাদেশে সবাই কমবেশি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কম করে হলেও ৭০ শতাংশ ভোটার কোনো না কোনো দলের সমর্থক। ৩০ শতাংশ ভোটার হয়ত এর বাইরে অবস্থান করছেন। যে ৭০ শতাংশ ভোটার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত বা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী বা সমর্থক তাদের মধ্যে জামায়াতের বাইরে যারা আছেন তাদের কত শতাংশ নেতা বা কর্মী দেশের রাজনীতি সম্পর্কে গভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার মতো লেখাপড়া করেন, জ্ঞান রাখেন তা নিয়ে স্বস্তির জায়গায় আমরা আছি বলে মনে হয় না। আমি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রবীণ নেতাদের বাদ দিয়েই কথা বলছি। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে এই দুই দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বললে আমাকে হতাশ হতে হয়। টিভি টকশোতে তাদের কারো কারো কথা শুনে মনে হয় না যে তারা দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার মতো পড়াশোনা করেন। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অবস্থাও বেশ হতাশাজনক। অন্যদিকে ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীদের রাজনীতি শুরুই হয় তাদের সাংগঠনিক পুস্তকাদি পঠন-পাঠনের মাধ্যমে- যা তাদের মধ্যে এমন এক বিশ্বাস ও আবেগ তৈরি করে শেষ পর্যন্ত এর জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করতে তৈরি থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং বাম গণতান্ত্রিক শক্তির দুর্বলতা, বিএনপির স্বার্থপরতা এবং জামায়াতের কাছে আত্মসমর্পণের সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে জামায়াতে ইসলাম- যাদের দলের অনুগত সশস্ত্র ক্যাডার, দলীয় নানা শৃঙ্খলায় আবদ্ধ আছে অসংখ্য ক্যাডার, নারী, পুরুষ, যুবক- যারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বের করে নিতে একটি ‘ইসলামি বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করতে এত বছরে তৈরি হয়েছে। জামায়াত দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে তাদের ঘাঁটিকে নিরঙ্কুশ করতে পেরেছে। সেটি ঘটেছে অনেকটাই নীরবে, তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকারের সুযোগ নিয়ে। ধর্মীয় সব প্রতিষ্ঠানেই তাদের শক্তি এরই মধ্যে একচ্ছত্র হয়েছে, শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের অবস্থান অত্যন্ত সংহত, ব্যবসা-বাণিজ্য, এনজিও ইত্যাদিতেও তাদের অবস্থান অবিশ্বাস্য রকমের।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াত আন্তর্জাতিক মহলকে প্রভাবিত করতে যে ধরনের আর্থিক বিনিয়োগ করেছে- তা জামায়াতের পক্ষেই কেবল সম্ভব হয়েছে। এ থেকে জামায়াতের আর্থিক শক্তির উৎস সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আর্থিক এবং প্রচারের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কেও যে ধারণা পাওয়া যায়- তা কি বাংলাদেশের বড় দুটো দলের কারোই রয়েছে? আমরা তেমন বাস্তবভিত্তির কোনো ধারণাই পাচ্ছি না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের এই বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াত ছাত্র শিবিরকে যেভাবে প্রস্তুত করেছিল তার বহিঃপ্রকাশ নানাভাবেই ঘটতে দেখা গেছে গত বছরগুলোতে। ছাত্র শিবিরের কর্মীরা ১৯৭১-এর ইতিহাসকে জামায়াতের মতো করেই ধারণ করেছে। তারা জামায়াতের প্রশিক্ষণের দীক্ষা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনায় বেড়ে উঠেছে। সে কারণে তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারকে আইন, নৈতিকতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা থেকে কোনোভাবেই গ্রহণ করেনি, বরং সম্পূর্ণ অন্ধ রাজনৈতিক দীক্ষা থেকেই তা নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ১৮ দলীয় জোটের প্রতিটি পথসভায় উপস্থিতি দর্শকদের বেশির ভাগই ছিল জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। সেই সভাটি যদি দেশের অন্যপ্রান্তে হত তাহলেও তারা ছুটে গেছে জনসভাটিকে ‘সফল’ করতে। তাদের উপস্থিতির একটি অংশ ছিল জামায়াত-শিবিরের ব্যানারসহ, কৌলশগতভাবে অনেকেই ব্যানার ছাড়া থাকত। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের আস্থা বৃদ্ধিতে এ ধরনের কার্যক্রমে তারা দলীয় নির্দেশেই অংশ নিয়েছিল। মামলার রায় প্রকাশের পর দেশব্যাপী যে সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছিল তাতে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। হেফাজতে ইসলামকে মাঠে নামানোর আর্থিকসহ সব শক্তিই জুগিয়েছিল জামায়াত। উদ্দেশ্য ছিল সরকার উৎখাতের প্রাথমিক ধাক্কাটি অন্যদের দিয়ে দেয়া। ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বরও পরিকল্পনা ছিল ঢাকায় ‘তাহরির স্কয়ার’ সৃষ্টি করা, সরকার উৎখাত করা, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সহিংসতার গোটা পরিকল্পনায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা যুক্ত ছিল। উদ্দেশ্য ছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ভণ্ডুল করা। এরপর দেশে যে সাংবিধানিক শূন্যতার সংকট তৈরি হতো তার ভেতর দিয়ে দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশোধ নেয়া। বলা চলে ২০০৯ সাল পরবর্তী সময় থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের প্রতিটি কর্মী, নেতা ও সমর্থক সক্রিয়ভাবেই সেই যুদ্ধে রয়েছে। জামায়াত মরণ কামড় দিতে এবার ৫ জানুয়ারির পর আবার মাঠে নেমেছে, পেট্রলবোমার কারিগর, যোগনদাতা, নিক্ষেপকারী এবং ভাড়াটে নির্ধারণ করার বিষয়টি পরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে। তবে তাদের ভাণ্ডারে সন্ত্রাস এবং যুদ্ধজয়ের আর কী কী অস্ত্র বা কৌশল রয়েছে- সেটি আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না হলেও বোঝা যাচ্ছে যে, জামায়াত সব শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে, একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে তারা অবতীর্ণ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হচ্ছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ভূমিকা। বিএনপির চেয়ারপারসনের নামে গোপন জায়গা থেকে হরতাল এবং অবরোধের লাগাতার কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে, এর সুযোগ নিচ্ছে জামায়াত-শিবির। তারা পেট্রোলবোমাসহ নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে হামলা করছে। ফলে সারা দেশে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এভাবে জিম্মি করে দীর্ঘদিন ধরে রাখা গেলে এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন অদূরভবিষ্যতে হয়ত পশ্চাৎমুখী হয়ে যেতে পারে- সেটিই তাদের লক্ষ্য। একইভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরীক্ষাকে জিম্মি করে ধরে রাখা গেলে দেশের নতুন প্রজন্ম মেধাশূন্য হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নিয়ে এমনই এক ‘ভাতে মারবো, পানিতে মারবো, পেট্রোলবোমায় মারবো’ কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে জামায়াত। এর নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ সবকিছু বাস্তবায়নে লিপ্ত রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে সরকার যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে তা কি যথেষ্ট? সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে-এর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা সরকারের মেকানিজমে নেই। রাষ্ট্রের সঙ্গে যখন এমন যুদ্ধ ঘোষণা করে কোনো অপশক্তি তখন রাষ্ট্রকে সব বৈধ সংস্থা এবং বাহিনীকে দিয়ে তা প্রতিহত করতে সব চেষ্টা করবেই। এটিই স্বাভাবিক। সরকার শুরু থেকেই তা করে আসছে। সরকার তেমনটি করতে পারছে বলেই এ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় ঘটানো জামায়াত ও শিবিরের সন্ত্রাসীদের পক্ষে এখনো পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তবে তাদের পরিকল্পনাতে নাশকতার বড় ধরনের কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারে এমন আভাস গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সীমিত সম্পদ এবং লোকবল নিয়ে এ ধরনের চোরাগোপ্তা হামলাকে যথাসম্ভব প্রতিহত করে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই।
যা জরুরি দরকার তা হচ্ছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেশে জনমত তৈরিতে কাজ করা। আমাদের দেশে এখনো অনেকেই জঙ্গিবাদ কাকে বলে, এরা কারা, এরা সফল হলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নাগরিকদের জীবনযাপন কেমন হবে- এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা, প্রচার-প্রচারণা নেই। জামায়াত বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত একটি ভয়াবহ জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করবে- যেখানে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা কত মানুষকে নতুন করে হত্যা করবে, তাদের আদেশ-নির্দেশ মানতে বাধ্য করবে- এসব বিষয় অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। সাধারণ সন্ত্রাসী এবং দুর্বৃত্তদের থেকে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য কী, কোথায়- তা মানুষকে স্পষ্ট করা খুবই জরুরি। এসব নিয়ে গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া জরুরি। সাধারণ মানুষ যখন রাজনৈতিকভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবে তখনই কেবল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি দুর্বল হবে। জামায়াত-শিবিরের আসল চেহারাটি উন্মোচন করা না গেলে মানুষ এদের সম্পর্কে নানা ধরনের বিভ্রান্তিতে থাকবে, যেমনটি এখনো অনেকের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবেই প্রচার অভিযানে নামতে হবে সব গণতান্ত্রিক শক্তিকেই। একই সঙ্গে বিএনপির ভোটারদের কাছেও বিষয়টির গূঢ় চরিত্র তুলে ধরতে হবে। কাজটি সাংগঠনিক এবং প্রচার মাধ্যমে এমনভাবে করা দরকার যাতে মানুষ জঙ্গিবাদী শক্তির মতাদর্শকে সহজেই রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে আলাদা করে বোঝার সুযোগ পায়। সে ধরনের পরিকল্পিত ও প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থায় গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। তাহলেই জামায়াত-শিবিরের জঙ্গিবাদী রাজনীতি অকার্যকর হতে বাধ্য হবে। বিষয়টি করতে হবে কার্যকরভাবে যেখানে এদের স্বরূপটি উন্মোচিত হবে, মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থাটির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবে- যেমনিভাবে ১৯৭১ সালে সাধারণ মানুষই মুক্তিযুদ্ধে মরণপণ লড়াই করেছিল। এখন প্রয়োজনে তাই করতে তারা যেন প্রস্তুত হয়। সেটিই হবে কার্যকর ব্যবস্থা।পৃথিবীজুড়েই জঙ্গিবাদের আগ্রাসন বেড়ে চলছে। তবে এর সিংহভাগই ঘটছে মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহে। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, মধ্য আফ্রিকা, উত্তর আফ্রিকা, গোটা মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, পাকিস্তান- কোথায় নেই ইসলামের নাম ব্যবহারকারী উগ্রপন্থার জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর অমানবিক তৎপরতা। অনেক বছরই ভাবা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত থাকবে। যুক্তি ছিল- এখানকার মাটি অন্যরকমের। এখানকার মানুষ এক সময়ে সুফিবাদের প্রভাবে অসাম্প্রদায়িক। এখানে সব ধর্মের মানুষ যুগ যুগ ধরে এক ছাতার নিচে বসবাস করে এসেছে। কথাটি এক অর্থে ঠিক। অন্য অর্থে ঠিক নয়। এক অর্থে বলতে মধ্যযুগের দীর্ঘ সময়ের জন্য পুরোপুরি ঠিক। কিন্তু বিশ শতকের বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী সময় থেকে পরিস্থিতি ভেতরে ভেতরে পাল্টে গেছে। সরলীকরণ এখানে করা যাবে না। বিশ শতকের পৃথিবী আধুনিক প্রযুক্তি ও সম্ভারে যেমন ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি প্রায় দেড়শত নতুন রাষ্ট্র আবির্ভাবের চ্যালেঞ্জে পড়েছে। একে ধারণ করার জ্ঞানতাত্তি¡ক চর্চার ধারাবাহিক উত্তরণ না ঘটায় আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ মৌলিক চিন্তার সংকটে পড়েছে। আধুনিক রাষ্ট্র এবং মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণার দ্ব›েদ্ব সাধারণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি বেড়ে ওঠেছে। একসময় প্যান ইসলামিজম সেটিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। সারা বিশ্বের মুসলমানের এক ও অভিন্ন পরিচয়ের রাষ্ট্রের ধারণাটি অনেকটা সর্বহারাদের আন্তর্জাতিকতাবাদের কাছ থেকে বিকৃতভাবে ধার করে নেয়া মতবাদের রূপান্তর। বিশ শতকের পৃথিবীতে নতুন নতুন রাষ্ট্র-চিন্তার আবেগে ভেসে গেছে অনেক অঞ্চল, সে ক্ষেত্রে মুসলিম সাধারণ মানুষ কখনো খিলাফত প্রতিষ্ঠা, কখনো প্যান ইসলামিজম, কখনো আরব বিশ্ব তত্ত্ব, আরব লীগ ইত্যাদি চিন্তায় আপ্লুত হয়েছে। তবে এসব তত্ত্বের গভীরে কমই প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে। এটা অনেকটা মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় ভাবাদর্শের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মতো যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য গঠন। এ সাম্রাজ্যের পেছনে ছিল ভেটিকানের পোপতন্ত্র। কিন্তু সেই পোপতন্ত্রও টিকে থাকেনি। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা থেকে ক্যাথলিক অধ্যুষিত পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপীয় রাষ্ট্র, অর্থোডক্সোসীয় ভাবাদর্শের বলকান ও সøাভ রাষ্ট্রপুঞ্জ, প্রোটেস্টান্ট অধ্যুষিত উত্তর ইউরোপীয় রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদিক থেকে বৌদ্ধধর্ম পৃথক কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তত্ত্বীয় লড়াইয়ে নামেনি। তবে বিশ শতকের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের বিভাজনের পেছনে স্বার্থবাদী মার্কিন এবং ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির স্রষ্টা ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী নানাভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে। সেই ফাঁদে পা দিয়েছে অনেকেই। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এখানকার জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিবর্তন নিশ্চিত হলে যে ধরনের রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল তা ঘটতে পারেনি অভ্যন্তরীণ নানা গোষ্ঠীতান্ত্রিক পক্ষের দ্ব›দ্ব-সংঘাতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার ভুল নীতি ও কৌশলের কারণে। সাদ্দামকে উচ্ছেদ করে আইএস সৃষ্টির পথ প্রশস্ত কে করেছে? তারাকি-হাফিজুল্লাহকে উৎখাত করে আফগানিস্তানে তালেবানদের আমদানি করিয়েছে কে? গোটা মধ্যপ্রাচ্য এখন চলছে ভয়ানক এক অনিশ্চয়তার মধ্যে। তারপরও মুসলিম অধ্যুষিত অন্যান্য দেশে রাষ্ট্র রাজনীতিতে ‘জেহাদ’ ‘বিপ্লব’, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেগ চলছে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো গোষ্ঠী সেই আবেগের পেছনে অর্থ, অস্ত্র এবং জেহাদিতত্ত্ব বিনিয়োগ করছে।
বাংলাদেশ সেই নেটওয়ার্কে আশির দশকেই সন্তর্পণে ঢুকেছে। বিএনপি জাতীয় পার্টির সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি সেই সুযোগ করে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সশস্ত্র যুদ্ধের তালিম নিয়ে যে সব গোষ্ঠী দেশে ফিরে এসেছে তারা কিছুটা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী সুপরিকল্পিতভাবে নিজেদের সংগঠিত ও তৈরি করেছে। গোটা আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এই শক্তি তরুণদের একটি অংশকে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে কাছে টেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল ধরনের আর্থিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে তাদের বড় ধরনের ভিত্তি তৈরি করতে তারা সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ‘সশস্ত্র বিপ্লবের’ শক্তি হিসেবে তৈরি করেছে। ২০০১ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় জামায়াত অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে, শহরে, সরকারে প্রশাসনসহ সর্বত্র নিজেদের অবস্থানকে সংহত করেছে। বিএনপি সেই সুযোগ জামায়াতকে বিনা দ্বিধায় করে দিয়েছে। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভিত্তি লাফিয়ে লাফিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। জামায়াত অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তিশালী দলে পরিণত হতে পেরেছে। একই সঙ্গে জামায়াতের আর্থিক শক্তি শনৈঃশনৈ করে বেড়েছে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশে একমাত্র জামায়াতই অসংখ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক যেখানে কর্মজীবী সবাই জামায়াতের আদর্শের ধারক এবং বাহক। ফলে জামায়াত গতানুগতিক পথে নয়, একেবারে ভিন্ন পথে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছে- যাদের গোপন উদ্দেশ্য বোঝার মতো জ্ঞান রাখে না এ দেশের রাজনীতি এবং এর বাইরের অনেকেই। বলা হয় বাংলাদেশে সবাই কমবেশি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কম করে হলেও ৭০ শতাংশ ভোটার কোনো না কোনো দলের সমর্থক। ৩০ শতাংশ ভোটার হয়ত এর বাইরে অবস্থান করছেন। যে ৭০ শতাংশ ভোটার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত বা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী বা সমর্থক তাদের মধ্যে জামায়াতের বাইরে যারা আছেন তাদের কত শতাংশ নেতা বা কর্মী দেশের রাজনীতি সম্পর্কে গভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার মতো লেখাপড়া করেন, জ্ঞান রাখেন তা নিয়ে স্বস্তির জায়গায় আমরা আছি বলে মনে হয় না। আমি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রবীণ নেতাদের বাদ দিয়েই কথা বলছি। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে এই দুই দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বললে আমাকে হতাশ হতে হয়। টিভি টকশোতে তাদের কারো কারো কথা শুনে মনে হয় না যে তারা দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার মতো পড়াশোনা করেন। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অবস্থাও বেশ হতাশাজনক। অন্যদিকে ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীদের রাজনীতি শুরুই হয় তাদের সাংগঠনিক পুস্তকাদি পঠন-পাঠনের মাধ্যমে- যা তাদের মধ্যে এমন এক বিশ্বাস ও আবেগ তৈরি করে শেষ পর্যন্ত এর জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করতে তৈরি থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং বাম গণতান্ত্রিক শক্তির দুর্বলতা, বিএনপির স্বার্থপরতা এবং জামায়াতের কাছে আত্মসমর্পণের সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে জামায়াতে ইসলাম- যাদের দলের অনুগত সশস্ত্র ক্যাডার, দলীয় নানা শৃঙ্খলায় আবদ্ধ আছে অসংখ্য ক্যাডার, নারী, পুরুষ, যুবক- যারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বের করে নিতে একটি ‘ইসলামি বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করতে এত বছরে তৈরি হয়েছে। জামায়াত দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে তাদের ঘাঁটিকে নিরঙ্কুশ করতে পেরেছে। সেটি ঘটেছে অনেকটাই নীরবে, তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকারের সুযোগ নিয়ে। ধর্মীয় সব প্রতিষ্ঠানেই তাদের শক্তি এরই মধ্যে একচ্ছত্র হয়েছে, শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের অবস্থান অত্যন্ত সংহত, ব্যবসা-বাণিজ্য, এনজিও ইত্যাদিতেও তাদের অবস্থান অবিশ্বাস্য রকমের।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াত আন্তর্জাতিক মহলকে প্রভাবিত করতে যে ধরনের আর্থিক বিনিয়োগ করেছে- তা জামায়াতের পক্ষেই কেবল সম্ভব হয়েছে। এ থেকে জামায়াতের আর্থিক শক্তির উৎস সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আর্থিক এবং প্রচারের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কেও যে ধারণা পাওয়া যায়- তা কি বাংলাদেশের বড় দুটো দলের কারোই রয়েছে? আমরা তেমন বাস্তবভিত্তির কোনো ধারণাই পাচ্ছি না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের এই বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াত ছাত্র শিবিরকে যেভাবে প্রস্তুত করেছিল তার বহিঃপ্রকাশ নানাভাবেই ঘটতে দেখা গেছে গত বছরগুলোতে। ছাত্র শিবিরের কর্মীরা ১৯৭১-এর ইতিহাসকে জামায়াতের মতো করেই ধারণ করেছে। তারা জামায়াতের প্রশিক্ষণের দীক্ষা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনায় বেড়ে উঠেছে। সে কারণে তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারকে আইন, নৈতিকতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা থেকে কোনোভাবেই গ্রহণ করেনি, বরং সম্পূর্ণ অন্ধ রাজনৈতিক দীক্ষা থেকেই তা নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ১৮ দলীয় জোটের প্রতিটি পথসভায় উপস্থিতি দর্শকদের বেশির ভাগই ছিল জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। সেই সভাটি যদি দেশের অন্যপ্রান্তে হত তাহলেও তারা ছুটে গেছে জনসভাটিকে ‘সফল’ করতে। তাদের উপস্থিতির একটি অংশ ছিল জামায়াত-শিবিরের ব্যানারসহ, কৌলশগতভাবে অনেকেই ব্যানার ছাড়া থাকত। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের আস্থা বৃদ্ধিতে এ ধরনের কার্যক্রমে তারা দলীয় নির্দেশেই অংশ নিয়েছিল। মামলার রায় প্রকাশের পর দেশব্যাপী যে সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছিল তাতে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। হেফাজতে ইসলামকে মাঠে নামানোর আর্থিকসহ সব শক্তিই জুগিয়েছিল জামায়াত। উদ্দেশ্য ছিল সরকার উৎখাতের প্রাথমিক ধাক্কাটি অন্যদের দিয়ে দেয়া। ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বরও পরিকল্পনা ছিল ঢাকায় ‘তাহরির স্কয়ার’ সৃষ্টি করা, সরকার উৎখাত করা, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সহিংসতার গোটা পরিকল্পনায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা যুক্ত ছিল। উদ্দেশ্য ছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ভণ্ডুল করা। এরপর দেশে যে সাংবিধানিক শূন্যতার সংকট তৈরি হতো তার ভেতর দিয়ে দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশোধ নেয়া। বলা চলে ২০০৯ সাল পরবর্তী সময় থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের প্রতিটি কর্মী, নেতা ও সমর্থক সক্রিয়ভাবেই সেই যুদ্ধে রয়েছে। জামায়াত মরণ কামড় দিতে এবার ৫ জানুয়ারির পর আবার মাঠে নেমেছে, পেট্রলবোমার কারিগর, যোগনদাতা, নিক্ষেপকারী এবং ভাড়াটে নির্ধারণ করার বিষয়টি পরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে। তবে তাদের ভাণ্ডারে সন্ত্রাস এবং যুদ্ধজয়ের আর কী কী অস্ত্র বা কৌশল রয়েছে- সেটি আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না হলেও বোঝা যাচ্ছে যে, জামায়াত সব শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে, একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে তারা অবতীর্ণ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হচ্ছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ভূমিকা। বিএনপির চেয়ারপারসনের নামে গোপন জায়গা থেকে হরতাল এবং অবরোধের লাগাতার কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে, এর সুযোগ নিচ্ছে জামায়াত-শিবির। তারা পেট্রোলবোমাসহ নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে হামলা করছে। ফলে সারা দেশে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এভাবে জিম্মি করে দীর্ঘদিন ধরে রাখা গেলে এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন অদূরভবিষ্যতে হয়ত পশ্চাৎমুখী হয়ে যেতে পারে- সেটিই তাদের লক্ষ্য। একইভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরীক্ষাকে জিম্মি করে ধরে রাখা গেলে দেশের নতুন প্রজন্ম মেধাশূন্য হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নিয়ে এমনই এক ‘ভাতে মারবো, পানিতে মারবো, পেট্রোলবোমায় মারবো’ কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে জামায়াত। এর নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ সবকিছু বাস্তবায়নে লিপ্ত রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে সরকার যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে তা কি যথেষ্ট? সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে-এর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা সরকারের মেকানিজমে নেই। রাষ্ট্রের সঙ্গে যখন এমন যুদ্ধ ঘোষণা করে কোনো অপশক্তি তখন রাষ্ট্রকে সব বৈধ সংস্থা এবং বাহিনীকে দিয়ে তা প্রতিহত করতে সব চেষ্টা করবেই। এটিই স্বাভাবিক। সরকার শুরু থেকেই তা করে আসছে। সরকার তেমনটি করতে পারছে বলেই এ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় ঘটানো জামায়াত ও শিবিরের সন্ত্রাসীদের পক্ষে এখনো পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তবে তাদের পরিকল্পনাতে নাশকতার বড় ধরনের কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারে এমন আভাস গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সীমিত সম্পদ এবং লোকবল নিয়ে এ ধরনের চোরাগোপ্তা হামলাকে যথাসম্ভব প্রতিহত করে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই।
যা জরুরি দরকার তা হচ্ছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেশে জনমত তৈরিতে কাজ করা। আমাদের দেশে এখনো অনেকেই জঙ্গিবাদ কাকে বলে, এরা কারা, এরা সফল হলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নাগরিকদের জীবনযাপন কেমন হবে- এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা, প্রচার-প্রচারণা নেই। জামায়াত বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত একটি ভয়াবহ জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করবে- যেখানে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা কত মানুষকে নতুন করে হত্যা করবে, তাদের আদেশ-নির্দেশ মানতে বাধ্য করবে- এসব বিষয় অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। সাধারণ সন্ত্রাসী এবং দুর্বৃত্তদের থেকে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য কী, কোথায়- তা মানুষকে স্পষ্ট করা খুবই জরুরি। এসব নিয়ে গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া জরুরি। সাধারণ মানুষ যখন রাজনৈতিকভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবে তখনই কেবল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি দুর্বল হবে। জামায়াত-শিবিরের আসল চেহারাটি উন্মোচন করা না গেলে মানুষ এদের সম্পর্কে নানা ধরনের বিভ্রান্তিতে থাকবে, যেমনটি এখনো অনেকের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবেই প্রচার অভিযানে নামতে হবে সব গণতান্ত্রিক শক্তিকেই। একই সঙ্গে বিএনপির ভোটারদের কাছেও বিষয়টির গূঢ় চরিত্র তুলে ধরতে হবে। কাজটি সাংগঠনিক এবং প্রচার মাধ্যমে এমনভাবে করা দরকার যাতে মানুষ জঙ্গিবাদী শক্তির মতাদর্শকে সহজেই রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে আলাদা করে বোঝার সুযোগ পায়। সে ধরনের পরিকল্পিত ও প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থায় গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। তাহলেই জামায়াত-শিবিরের জঙ্গিবাদী রাজনীতি অকার্যকর হতে বাধ্য হবে। বিষয়টি করতে হবে কার্যকরভাবে যেখানে এদের স্বরূপটি উন্মোচিত হবে, মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থাটির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবে- যেমনিভাবে ১৯৭১ সালে সাধারণ মানুষই মুক্তিযুদ্ধে মরণপণ লড়াই করেছিল। এখন প্রয়োজনে তাই করতে তারা যেন প্রস্তুত হয়। সেটিই হবে কার্যকর ব্যবস্থা। ( ভোরের কাগজের কলাম, মমতাজ উদ্দীন পাটোয়ারী)
©somewhere in net ltd.