![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঢাকা-চট্টগ্রামের তিন সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে এমন একটা আশার সঞ্চার হয়েছে যে, দেশের বর্তমান প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, খিস্তিখেউর ও কাদা ছোড়াছুড়ির নোংরা পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির নান্দনিক পথটা বেছে নেবে। দেশের যেসব বেসরকারি ব্যবসায়ী নিজেদের মেধা, শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে উন্নত বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন, তারা আশা করছেন গত তিন মাসের সহিংস রাজনীতির প্রচণ্ড ধাক্কা সামলে ওঠার সুযোগ ও সম্ভাবনার বহুমাত্রিক 'দুয়ার' খুলে যাবে। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট সচেতন মানুষ ভাবছেন, দিশাহারা জাতীয় রাজনীতি আবার দিশা খুঁজে পাবে। তিন সিটির নির্বাচন জাতীয় কোনো নির্বাচন নয়, নেহাতই স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এর আগে আরও পাঁচটি সিটি নির্বাচন হয়েছে- রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুরে। এটা একেবারেই নিকট অতীতের ঘটনা। আরও কাছের অতীতের ঘটনা ছিল দেশব্যাপী উপজেলা নির্বাচন। আগের ওইসব নির্বাচন তিন সিটি নির্বাচনের মতো দেশ-বিদেশের জনমনকে এতটা আলোড়িত ও এতটা আন্দোলিত করেনি। স্বয়ং জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও এই তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে মুখ খুলেছেন। ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক নোটে বলা হয়, 'সিটি করপোরেশন নির্বাচন যেন স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং বিশ্বাসযোগ্য হয় তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ মহাসচিব সংশ্লিষ্ট সব প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মহাসচিব আরও আশা করেন, শিগগিরই রাজনৈতিক দলগুলো দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থে নিজেদের মতপার্থক্য মিটিয়ে ফেলার পথ খুঁজে পাবে।'
গত তিন মাস দেশবাসীর সময় কেটেছে অশান্তিতে, অস্বস্তিতে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে কার্যত ৫ জানুয়ারি থেকেই দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি চলতে থাকে। দুই মাস শুক্র ও শনি ছুটির দিন বাদে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ দিন করে হরতালও চলে আসছিল। শনিবার রাতে গোপন আস্তানা থেকে 'ফরমান জারি' হতো ৭২ ঘণ্টা হরতালের (রবি, সোম ও মঙ্গলবার), মঙ্গলবার রাতে আবার 'ফরমান' আসত ৪৮ ঘণ্টা (বুধ ও বৃহস্পতিবার) হরতালের। ২০-দলীয় জোট ঘোষিত লাগাতার এই কর্মসূচির সর্বনাশা ও ভয়ঙ্কর দিক ছিল সহিংসতা ও নাশকতা। সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বহু দল ও বহু মতের সহাবস্থানের একটা সৌন্দর্য আছে। আন্দোলন-মিটিং-মিছিল এমন কি হরতাল-অবরোধ-অসহযোগও অবৈধ কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। তবে সব কর্মসূচি অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ হতে হবে। কিন্তু গত তিন মাসের অবরোধ-হরতাল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব সীমা লঙ্ঘন করেছে। তাতে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ১৪০ জনের। পেট্রলবোমা-আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৭৯ জন। আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সংঘর্ষ ও অন্যভাবে মারা গেছেন ৬১ জন। দগ্ধ হয়েছেন প্রায় ৩৫০ জন। আহতের সংখ্যা প্রায় ১৫০০। সড়ক পরিবহনে ৩১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ২১০০ যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রেলপথ ও ট্রেনে নাশকতা হয়েছে ৮০ স্থানে। দৈনিক গড়ে ২ হাজার ২৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা করে অর্থনীতিতে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। কৃষকের ক্ষতি, ভোক্তাসাধারণের ক্ষতি, লেখাপড়ার ক্ষতি তো আছেই। দেড় মাস পর অবরোধ অকার্যকর হয়ে পড়ে অনেকটাই। হরতালও হয়েছে ঢিমেতালে। কিন্তু জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল না। মানুষের মধ্যে একটা ভয়ানক আতঙ্ক বিরাজ করছিল।
তিন সিটি নির্বাচনকে উপলক্ষ করে শুধু তিন সিটিতেই নয়, সারা দেশেই আন্দোলনের নামে সহিংসতা-নাশকতা বন্ধ হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষসমূহের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয়েরই 'ফসল' এই পরিবর্তিত স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি। উদ্ভূত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির জন্য একক কোনো পক্ষকে দায়ী করা সঠিক হবে না। কেন ২০-দলীয় জোট এমন একটা 'অস্বাভাবিক' রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল তার একটা ব্যাখ্যা তো তাদের আছেই। তবে তিন মাস জনজীবনে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং তা থেকে জনগণকে রক্ষার ব্যর্থতায় উভয় পক্ষের দায় আছে। ২০-দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্ট করে বলেছেন, পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে ও গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ মারার সঙ্গে তারা জড়িত নন। অপরদিকে যে ৬১ জন মানুষ বিনাবিচারে নানাভাবে মারা গেলেন সে দায়ও নিচ্ছে না সরকার। তাহলে এসব ঘটল কেন, কীভাবে? কারা করল এসব? বিএনপি চেয়ারপারসন দায় অস্বীকার করলেই মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে ভাবার কোনো কারণ নেই। পেট্রলবোমা ও আগুন দিয়ে মানুষ মারার বীভৎস তাণ্ডব চলেছে তার ঘোষিত কর্মসূচির ছাতার নিচে থেকেই। বলবেন অন্য কেউ করেছে? হ্যাঁ, করতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল থেকে সহিংসতা-নাশকতা বন্ধের পৌনঃপুনিক তাগাদা দেওয়ার পর গত এক মাসে তা কমে আসায় এবং বর্তমানে প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেউ এটা বলতেই পারেন যে, বিশেষ করে বিদেশিদের চাপে ২০-দলীয় জোট ধ্বংসাত্দক কার্যকলাপকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না বলেই এখন পরিস্থিতি শান্ত। তারা যদি শুরু থেকেই সহিংসতা-নাশকতাকে 'না' বলতেন, তাহলে অন্য কারও পক্ষেই এসব অপকর্ম করা সম্ভব ছিল না।
তিন সিটি নির্বাচন সরকারের সিদ্ধান্ত। সব পক্ষের-প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা-সমঝোতার ভিত্তিতে না হলেও বিবদমান পক্ষসমূহের মধ্যে সদ্ভাব সৃষ্টি এবং উভয়ের ভুল ও ব্যর্থতাকে কাটিয়ে সহনীয় ও গ্রহণীয় রাজনৈতিক পথে প্রত্যাবর্তনের একটা সূত্র হিসেবে নিজ থেকেই যদি সিটি নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকে শেখ হাসিনার সরকার তাতে অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ২০-দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তও প্রশংসনীয় অবশ্যই। দুই নেত্রীর এই দুই সিদ্ধান্তের মধ্যে কোথাও যেন একটা যোগসূত্র আছে বলে মনে হয়। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও এক মাসে তা সংশ্লিষ্ট থানায় না পৌঁছা, হঠাৎ করে বিএনপি নেত্রীর আদালতে হাজিরা দেওয়ার সিদ্ধান্ত, তার জামিন আবেদনে সরকার পক্ষের আপত্তি না করা, তার জামিন মঞ্জুর এবং তিন মাস পর গুলশান অফিস থেকে তার বাসায় ফিরে যাওয়া আমাদের উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি ও স্বস্তির শীতল বাতাস প্রবাহের মতোই। এটা এমনি এমনি হয়ে গেছে বলে মনে হয় না। ধারণা করাই যায় যে, এ জন্য আড়ালে-অন্তরালে কিছু কাজ হয়েছে এবং এমন কেউ কাজটি করেছেন উভয় পক্ষের কাছেই যিনি বা যারা সর্বদা সমীহ আদায় করে থাকেন। এটাও মনে করা যায় যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটা 'পূর্ণাঙ্গ ডিজাইন' নিয়ে কোথাও না কোথাও কাজ হয়েছে, হচ্ছে। তিন সিটি নির্বাচন সেই পূর্ণাঙ্গ 'ডিজাইনের'ই অংশ হয়তোবা। সাত বছর পর লীগ সরকারের এই নির্বাচন দেওয়া এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা থেকে সরে এসে বিএনপির এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা তাই অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে হিংসা ও হানাহানির পথ পরিহার করে একটা নূ্যনতম টলারেবল গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও রাষ্ট্রীয় স্থিতি প্রতিষ্ঠার একটি শুভ উদ্যোগের ধারণাটা যদি ঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে সিদ্ধান্তটা মূলত দুই নেত্রীর। নেপথ্যে সমঝোতার কোনো সংলাপ যদি হয়ে থাকে দুজনের সঙ্গেই হয়েছে, অন্য কাউকে ইনভলব করা হয়নি। যদি হতো, হঠাৎ করে অতি দ্রুত এভাবে বরফ গলত না। বরফ আরও জমাট বাঁধিয়ে দেওয়ার অপতৎপরতা চালাত স্বার্থবাজ ও অর্বাচীনরা। সংসদীয় রাজনীতির মৌলিক বিষয়াবলিকে অগ্রাহ্য করে প্রতিপক্ষের সব সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার হরণের কুপরামর্শ দলের গণবাহিনী ও কমিউনিস্ট অংশটি দিয়ে থাকতে পারেন বলে সাধারণের মধ্যে একটা ধারণা আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার বোধহয় কারও বদবুদ্ধি গ্রহণ করেননি। তাই বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে ঢোকানো হয়নি। এই সিদ্ধান্তে জাতীয় রাজনীতির চেহারা মুহূর্তেই পাল্টে গেছে। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
অপরদিকে বেগম খালেদা জিয়াও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্য কারও দ্বারা প্রভাবিত হননি বলে মনে হয়। বাইরে একটা ধারণা আছে যে, জামায়াত প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত একটি বর্ণচোরা মেকী জাতীয়তাবাদী গ্রুপ বাংলাদেশের সব মুসলিম ভোট ধানের শীষের বাঙ্ েএনে দিয়ে বেগম জিয়া এবং তারেক জিয়ার হাতে রাজত্ব তুলে দেওয়ার খোয়াব দেখিয়ে বিএনপি নেত্রীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করেন। তারেক রহমানের ওপরও এদের প্রভাব নাকি দিগন্তপ্লাবিত। কোনো কারণে বেগম জিয়াকে প্রভাবিত করতে না পারলে এরা নাকি সওয়ার হয় তারেক রহমানের ওপর। তাকে দিয়ে প্রভাবিত করে বেগম খালেদা জিয়াকে। বিএনপির আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো দুই কেন্দ্র- ঢাকা কেন্দ্র এবং বিলাত কেন্দ্র। ঢাকা কেন্দ্র এখন খুবই দুর্বল বলে ভাবা হয়। বিলাত কেন্দ্রই শক্তিশালী, দলের মূল নিয়ন্ত্রক। দলের নবীন-প্রবীণ অনেক নেতাই বেগম খালেদা জিয়া ঢাকায় থাকার পরও নানা উছিলায় বিলাতি হাওয়া গায়ে লাগান তারেক রহমানের আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য। গত তিন মাসের আন্দোলন কর্মসূচির ব্যাপারে সরকারি পক্ষ থেকে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তার বিভিন্ন বক্তৃতা জনগণকে শোনানো হয়েছে। তার বক্তৃতায় যেসব কৌশল অবলম্বনের নির্দেশ শোনা গেছে, তাই অনুসূত হতে দেখা গেছে অবরোধ-হরতালে। এটা ছিল অনেকটাই ১৯৭৪ সালে জাসদের হঠকারী রণকৌশলের মতো। জাসদ ব্যর্থ হয়েছে। হাজার হাজার তরুণ প্রাণ দিয়েছে নেতাদের উচ্চাভিলাষ ও হঠকারিতার কারণে। এবার ২০-দলীয় জোটের অবরোধ-হরতালে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সেভাবে মারা না গেলেও গুম, জেল, জুলুম, মামলা-মোকদ্দমায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দলটি। এই দায় কার? নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তাদের দলের ভিতর আলোচনা হবে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ভুল যদি তারেক রহমান করে থাকেন, তার সেই ভুল স্বীকার করা উচিত, সাবধান হওয়া উচিত ভবিষ্যতের জন্য। কেননা, যতই বিতর্ক থাক, তিনিই দলটির পরবর্তী কর্ণধার। তারেক রহমানকে সমালোচনা সহ্য করার গুণ অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে স্বার্থবাজ, চাটুকাররাই শুধু বলবে 'সব ঠিক হায়'। রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর প্রচার আছে যে, বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নিক তা নাকি তারেক রহমান চাননি। তিনি লাগাতার আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চেয়েছেন; কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া এবার ছেলেকে 'নো' বলতে পেরেছেন। কাজী সিরাজের লেখা থেকে, সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
©somewhere in net ltd.