নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছিটমহল চুক্তিতে বাংলাদেশ সফল

২১ শে মে, ২০১৫ সকাল ৯:৩৮

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট ভারতীয় আইনসভার উভয় কক্ষেই স্থলসীমান্ত চুক্তি বিলটি পাস হয়েছে। সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে বিলটির পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসেও এটি একটি বিরলদৃষ্ট ঘটনা। একটি কারিগরি ত্রুটির কারণে বিলটি আবার সংসদে উপস্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিলেও আশা করা যায় ত্রুটি সংশোধনের পর একইভাবে তা উভয় সভায় অনুমোদিত হবে (এই লেখাটি লেখার আগেই সংশোধিত বিলটি রাজ্যসভায় পাস হয়ে গেছে)। বিলটি পাস হওয়ার ফলে একচল্লিশ বছর আগে ভারত ও বাংলাদেশ এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পাদিত স্থলসীমান্ত চুক্তি

বাস্তবায়নের পথে আইনগত একটি বড় বাধা দূর হবে। অবশ্য বাধাটা এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নয়, ভারতের দিক থেকেই ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দুই দেশের সীমান্ত চিহ্নিতকরণের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিজ নিজ দেশের পক্ষে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর ওই বছরই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে তা অনুমোদিত হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতকে অর্পণও করে। কিন্তু নানা সমস্যা ও অজুহাতে ভারত তার দিক থেকে গত চার দশক এই চুক্তিটি কার্যকর করার পথে অগ্রসর হয় নি বা হতে পারে নি। কখনো এই চুক্তি বা তার কোনো অংশ কার্যকর করার বিরুদ্ধে আদালতের স্থগিতাদেশ চেয়ে ভারতীয় নাগরিকদের কারো মামলা, কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা, কখনো কোনো রাজ্য সরকার বা তার শরিক দলের আপত্তি, কখনো স্থানীয় জনগণের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ ভারতকে চুক্তি বাস্তবায়নের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে কিংবা থাকতে সাহায্য করে। রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপনের সময় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যে বিলটি বাস্তবায়নে বিলম্বের জন্য ‘নানা সময়ে নানা কারণে নানান উদাসীনতা’কে দায়ী করেছেন, বলা বাহুল্য সে ‘উদাসীনতা’ বাংলাদেশের তরফ থেকে ততটা ছিল না যতটা ছিল ভারতের দিক থেকে। এমন নয় যে, ১৯৭৫ এ বাংলাদেশে রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতায় আসা সামরিক সরকার বা তাদের উত্তরসূরিদের তরফ থেকে এ ব্যাপারে কখনোই কোনো রকম উদ্যোগ বা তাগিদ ছিল না। আমাদের মধ্যে যাঁরা তা বলছেন তাঁরা জেনে বা না-জেনে আসলে সত্যের অপলাপ করছেন। এ ব্যাপারে ভারতের মনোভাবটা ছিল, ভারত বিশাল ও এক গণতান্ত্রিক দেশ, ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও রাজ্য সরকারের মতামতকে তার গ্রাহ্যের মধ্যে নিতে হয়। আর আদালতের রায় বা বিচার প্রক্রিয়ায়ও সরকার সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যুক্তি হিসেবে কথাটা যে একেবারে গুরুত্বহীন বা ফেলনা, তা আমরা বলব না। তবে তার ফলেই চুক্তিটি বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করতে ভারতের এতগুলো বছর পার করতে হল। আর তার শিকার হতে হল উভয় দেশেরই কয়েক হাজার ছিটমহলবাসী মানুষকে। দেশ-ঠিকানাহীন ‘ছিটের মানুষ’ হিসেবে কিভাবে তারা বছরের পর বছর নাগরিক ও মানবিক সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রায় মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে, দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা এ দুটি বাংলাদেশী ছিটমহলের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা তা বুঝতে পারি।

১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর মধ্যে উভয় দেশের সীমান্ত চিহ্নিতকরণ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা আজ নুন-নেহেরু চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ির উত্তরাংশটি ভারতের ও দক্ষিণাংশটি পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। কিন্তু ভারতের অনাগ্রহ কিংবা তাদের তরফে সৃষ্ট নানা জটিলতার (সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা, লোকগণনার অসুবিধা ইত্যাদি) কারণে চুক্তি বাস্তবায়নের কাজটি পরে আর অগ্রসর হতে পারে নি। দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা এ সময় ভারতের এলাকাভুক্ত ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির শর্তে ভারতকে বেরুবাড়ি হস্তান্তরের পরিবর্তে বাংলাদেশকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা এই দুটি ছিটমহল নিজেদের দখলে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই সাথে ছিটমহল দুটির মানুষ যাতে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে, তার জন্য তিনবিঘায় স্থায়ীভাবে একটা করিডোর দেওয়ার কথাও চুক্তিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় জনগণের আন্দোলনের মুখে ভারত সরকার বাংলাদেশকে তিনবিঘা লিজ দেওয়ার সেই শর্ত পূরণ থেকে পিছিয়ে যায়। এমন কি বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে যথাক্রমে ভোট গ্রহণ ও আদমশুমারির প্রয়োজনে তিন-তিনবার দহগ্রাম যাওয়ার চেষ্টা করেও স্থানীয় ভারতীয় জনগণের প্রতিরোধের মুখে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এরশাদ আমলে দু-দেশের সরকারের মধ্যে করিডোরের ব্যাপারে একটা সমঝোতা এবং তার ভিত্তিতে নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, ‘কুচলিবাড়ি সংগ্রাম কমিটি’র (১৯৭৯ সালে গঠিত) রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট সে চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে। ১৯৯০ সালে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়; কিন্তু সেবারও ‘কুচলিবাড়ি সংগ্রাম কমিটি’ তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে। তাদের আহ্বানে এ সময় এলাকায় দু-দুটি বনধ পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের দ্বিতীয় বড় শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরেক বামপন্থী দল এসইউসি ছাড়াও কংগ্রেস ও বিজেপির স্থানীয় শাখাও সে আন্দোলনে শরিক হয়। এমন কি যে-সীমান্ত বিলটি এবার প্রথমে রাজ্যসভা ও পরে লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হল, দু-বছর আগে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার যখন সে বিলটিই রাজ্যসভায় পেশ করে তখন বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস ও অসম গণপরিষদ একযোগে তার বিরোধিতা করেছিল। এবারও বিলটি পাসের আগে এ ব্যাপারে অসম গণপরিষদের আপত্তির কথা শোনা গিয়েছিল। এমনও শোনা গিয়েছিল আসামকে বাদ দিয়েই আপাতত সীমানা চিহ্নিতকরণের ব্যাপারটি চূড়ান্ত হবে। লোকসভায় বিলটি নিয়ে আলোচনাকালেও আসাম থেকে নির্বাচিত একজন সাংসদসহ কয়েকজন তাঁদের ভিন্নমত তুলে ধরেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধ রেখে তাঁরাও শেষ পর্যন্ত বিলটির পক্ষেই ভোট দিয়েছেন। অবশ্য সংসদে বিলটি পাস হওয়া মানেই তা বাস্তবায়নের পথে সমস্ত বাধা দূর হয়ে যাওয়া, এমন কিন্তু নয়। যেহেতু এটি সাধারণ কোনো আইন নয়, একটি সংবিধান সংশোধনী বিল, তাই বাস্তবায়ন পর্যায়ে যাওয়ার আগে এর পক্ষে ভারতের রাজ্য বিধান সভাগুলোর অন্তত অর্ধেকের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। বাংলা ভাষায় একটা কথা আছে, ‘না আঁচালে বিশ্বাস নেই’। আমরাও তাই আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি, যাকে বলে সতর্ক আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো পর্যবেক্ষণ করতে চাই। আর তা কেবল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের বেলায়ই নয়। উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাকি সমস্যাগুলোর নিষ্পত্তি এবং সম্পর্ক উন্নয়নের আর পাঁচটি ক্ষেত্রেও। ভারত বিভাগের পর ইতিমধ্যে আটষট্টি বছর পার হয়ে গেছে, স্যার র‌্যাডক্লিফ ও তাঁর বাউন্ডারি কমিশনের সদস্যদের তাড়াহুড়ো ও খামখেয়ালির শিকার বাংলাদেশ ও ভারতের মোট ১৬২টি (বাংলাদেশের ৫১ ও ভারতের ১১১) ছিটমহলের অধিবাসীরা অতঃপর দ্রুত তাদের নাগরিক অধিকার ফিরে পাক, পূর্ণ নিরাপত্তার মধ্যে আপন ইচ্ছা অনুযায়ী তারা তাদের বসবাসের ঠিকানা খুঁজে নিক, উভয় দেশের অপদখলকৃত জমিগুলো উদ্ধার ও পুনর্বণ্টনের পর উভয় দেশের সীমান্ত স্থায়ী শান্তির এলাকা হিসেবে গণ্য হোক, কাঁটাতারের বেড়া উঠে যাক, সেই সঙ্গে অবৈধ অনুপ্রবেশও বন্ধ হোক, বিএসএফ বা বিডিআর কাউকে যেন আর গুলি ছুঁড়তে না হয়, এই কামনা আমাদের।

তবে দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যা সমাধানের তাগিদ থেকে যতটা না, তার চেয়ে বেশি মনে হয়, ভারতের ‘জাতীয় স্বার্থে’ বিজেপি-কংগ্রেস-কমিউনিস্ট নির্বিশেষে সবকটি রাজনৈতিক দল আজ শূন্য-বিরোধিতা ভোটে পার্লামেন্টে এই বিলটি পাস করিয়ে দিল (সংসদে বিলটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই ‘জাতীয় স্বার্থে’র কথা খোদ ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজই বলেছেন)। নিকট অতীতে, একমাত্র ১৯৭১ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়টি ছাড়া, আর কখনো এই দলগুলো সংসদে বা সংসদের বাইরে কোনো বিষয়ে এ রকম ঐকমত্যের পরিচয় দিয়েছে বলে মনে পড়ে না। এমন কি এই মুহূর্তেও ভূমি অধিগ্রহণ বিলসহ নানা ব্যাপারে কংগ্রেস, তৃণমূল, কমিউনিস্ট, সমাজবাদী প্রভৃতি দল ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। তবে বাংলাদেশের ব্যাপারে কী তাদের ‘জাতীয় স্বার্থ’ যা পার্লামেন্টের প্রকাশ্য বিতর্কের আগে বা তার বাইরে তাদের নেপথ্য সমঝোতাকে সম্ভব করে তুলল? আর তা এই সময়ে এসে? কৌতূহলী ও চিন্তাশীল মানুষের মনে এ প্রশ্নটা জাগা কি স্বাভাবিক নয়? আগামী দিনগুলোতে হয়তো এ-প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলীয় নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ ইতিমধ্যেই ভারতীয় পার্লামেন্টে সীমান্ত বিল পাসের এই ঘটনাটিকে তাঁদের সরকারের সাফল্য বলে দাবি করেছেন। অবশ্যই তাঁরা তা করতে পারেন। এমনিতেও রাজনীতিকরা সাধারণত তাঁদের শাসনামলে ঘটা যে-কোনো ভালো ঘটনার কৃতিত্ব নিজেরা নেন, আর খারাপ যা কিছু তার দায়দায়িত্ব বিরোধীদের ওপর চাপিয়ে দেন। বিশেষ করে আমাদের দেশে সব সময় এমনটাই দেখা যায়। নিশ্চয় ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন ইত্যাদির মতো ব্যাপারগুলোতে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের ভূমিকার আমরা ভূয়সী প্রশংসা করব। এ বিষয়গুলোতে তাঁর সরকার জাতীয় স্বার্থরক্ষায় যে অনমনীয়তার পরিচয় দিয়েছে, দরকষাকষির ক্ষেত্রে যে সামর্থ্য দেখিয়েছে, তা যে কোনো স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটাকে যখন কেউ এভাবে ব্যাখ্যা করতে চান যে, বাংলাদেশের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আছে বলেই ভারত সীমান্ত চুক্তি বিল পাসের উদ্যোগ নিয়েছে ও সেদেশের পার্লামেন্ট তা পাস করেছে, তখন তাঁদের সে বক্তব্যের পেছনে যে মনোভাব সক্রিয় থাকে, তা আমাদেরকে শঙ্কিত করে তোলে। তাদের বক্তব্য সত্যি হলে, সে ক্ষেত্রে ভারত সরকারের অভিপ্রায় এবং চুক্তি বাস্তবায়নে সদিচ্ছার মাত্রা নিয়েও সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের বদলে ভবিষ্যতে অন্য কোনো দল বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে তখন কি চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া থেমে যাবে? এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এখানে অতীত একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।

আমরা জানি, ভারত ও পাকিস্তান এ দুটি দেশের সম্পর্ক প্রায় স্থায়ী বৈরিতার। দুটি দেশের জন্মের ইতিহাসের মধ্যেই সে বৈরিতার বীজ নিহিত। উপরন্তু কাশ্মীর সমস্যা দুটি দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ক্ষেত্রে আজও এক বড় বাধা হয়ে রয়েছে। পাকিস্তান প্রথম থেকেই অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে এবং কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকানি ও সাহায্য-সহায়তা দিয়ে সমস্যাটিকে জিইয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে। তবে কাশ্মীর সমস্যার জন্য পাকিস্তানকে একা দায়ী করাও ঠিক হবে না। যদি আমরা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাবটি (১৯৪৮) অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে নেহেরু বা ভারত সরকারের একগুঁয়েমির কথাটি মনে রাখি। যাই হোক, ১৯৭১ এর বাংলাদেশ সংকটেরও আগে শুধু কাশ্মীর নিয়েই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দু-দুটো যুদ্ধ হয়েছে। অথচ কাশ্মীর ও অন্যান্য প্রশ্নে এই বিবাদ ও বৈরিতার মধ্যেই ১৯৬০ সালে পাকিস্তান ও ভারত সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও প্রধানমন্ত্রী নেহেরু তাঁদের নিজ নিজ দেশের পক্ষে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। একে পৃথিবীর খুব কার্যকর পানিবণ্টন চুক্তির একটি বলে গণ্য করা হয়। এই চুক্তির ফলে সকল মওসুমে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে সিন্ধু নদীর অবাধ পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। বিশ্বব্যাংক এই সমঝোতার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করলেও, পাকিস্তান তার ‘জাতীয় স্বার্থ’কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই এই চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হয়েছিল। কাশ্মীর বা কচ্ছ কোনো সমস্যাই সেক্ষেত্রে তাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। অথচ পাকিস্তানেরই পূর্বাংশে পদ্মা বা অন্যান্য নদীর পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে তেমন কোনো সমঝোতার চেষ্টা পুরো পাকিস্তান আমলে হয়নি। ফারাক্কায় ভারতের বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধেও কোনো শক্ত অবস্থান পাকিস্তান সরকার নেয় নি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে তারা জাতীয় স্বার্থ হিসেবে দেখে নি।

প্রতিটি দেশ, দেশের নেতৃবৃন্দ তাদের জাতীয় স্বার্থকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এমনটাই হয়ে আসছে সব সময়। সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের বুলি আওড়েও রাশিয়া ও চীন কিন্তু তাই করেছে। আমেরিকা ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্বায়নের স্লোগানও আসলে তাদের জাতীয় স্বার্থবুদ্ধি থেকেই। এটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত সত্য। তাই ওসব দেশে সরকার বদলেও দেশগুলোর আর্থিক বাণিজ্যিক ও বৈদেশিক নীতির তেমন পরিবর্তন হয় না। দলমতের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে এই উপলব্ধি, আত্মসচেতনতা ও ঐক্যবোধ আমাদের মধ্যে দেখা দেবে কবে? দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার নেত্রী খালেদা জিয়া ভারতের পার্লামেন্টে সীমান্ত চুক্তি বিল পাসের এই ঘটনাটিকে ত্বরিত ও দ্বিধাহীন কণ্ঠে স্বাগত জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা একটা শুভলক্ষণ। ভারত বিভাগোত্তর দীর্ঘ ছয় দশকের অচলাবস্থা কাটিয়ে সীমান্ত চিহ্নিতকরণ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়া এই বিলটি যে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, এ সত্যকে কোনো দিক থেকেই অস্বীকারের সুযোগ নেই। আর যখন যারাই বাংলাদেশের বা ভারতের ক্ষমতায় থাকুক, ভারতের মতো একটি বৃহৎ প্রতিবেশী যার সঙ্গে আমাদের রয়েছে কয়েক হাজার মাইলের দীর্ঘ সীমান্ত, তার সঙ্গে বিরোধ জিইয়ে রেখে কিংবা তা নিষ্পত্তির সামান্যতম সম্ভাবনাকেও কাজে লাগানোর পরিবর্তে যাঁরা তা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা ওঠাতে চান, তাঁদের দূরদর্শিতা বা বাস্তববুদ্ধি কোনোটারই আমরা প্রশংসা করতে পারব না। ভারতভীতি ও ভারতপ্রীতি দুয়েরই ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিক, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কসহ বৈদেশিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে এই মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পাক, এটাই সকল অবস্থায় কাম্য।

রাজ্যসভায় বিলটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এই বিল প্রণয়নের ব্যাপারে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বা তাঁর সরকারের কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হন নি। সরাসরিই তিনি বলেছেন, ‘এই বিল মনমোহনজিরই। তাঁর শুরু করা কাজ আমরা সম্পন্ন করলাম।’ লোকসভায় বিলটি পাসের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজ আসন থেকে নেমে প্রথমে বিরোধী কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর এবং তারপর একে একে বিরোধী অন্য সব দলের নেতার কাছে যান ও বিলটি পাসে সহযোগিতার জন্য তাঁদের অভিনন্দিত করেন। ১৯৯১ সালে আমাদের দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন বিল পাসের সময় অনেকটা এরকমই একটা দৃশ্য আমরা দেখেছিলাম। জাতীয় স্বার্থে আমাদের নেতৃবৃন্দকে আবার কখনো কি আমরা এমন ভূমিকায় দেখব? আমরা আশাবাদী হতে চাই।
- See more at: Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.