![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আর্থিক বিন্যাস প্রভৃতি সমস্ত কিছুই গড়িয়া তোলে মানুষ; এই মানুষের ইতিহাসই যথার্থ ইতিহাস। এই মানুষ সম্পূর্ণ মানুষ; তাহার একটি কর্ম অন্য আর-একটি কর্ম হইতে বিচ্ছিন্ন নয় এবং বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিলে দেখা ও পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না ...’- এমন সত্যে পরিচয় পাওয়া যায়, কীভাবে বাঙালি একটি জাতি হয়ে উঠল- এই নির্ধারিত ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে। ভাষাই তো সংস্কৃতি, মর্যাদা ও পরিণতিও। সেটি শুধু প্রকাশভঙ্গি নয়, ব্যক্তিত্বও বটে। সমস্ত সাধ, আহ্লাদ আর আবেগ তাতে জড়িত। সকলেই চিনে নেয়, অস্তিত্বের প্রশ্নটি- বাঁচার প্রশ্নটি; সংগ্রামের ক্ষেত্রটি। তাই পূর্ব-পাকিস্তানে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল মুসলিম লীগের বিপরীতে যুক্তফ্রন্টের জয়। ভাষার প্রশ্নটিতে বাঙালি মুসলমান আত্মপরিচয়ের সিদ্ধান্তটি তখনই নিতে পেরেছিল। তার সাথে সাথে আরও একটি ব্যাপার যুক্ত হয়, সেটি হলো অসাম্প্রদায়িক ও মানবাধিকারের মতো আদর্শের সচেতনতা।
তাই বলা যায়, ভাষা আন্দোলন শুধুই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বললে শেষ হয় না। এটি পূর্ণাঙ্গভাবে একটি জাতি গঠন, তার আত্মপরিচয়, আধুনিকতা, সাম্যের পক্ষে লড়াই, সবকিছুর সঙ্গে জড়িত। বলা যায়, সংস্কৃতির রক্ষাকবচ ওই ভাষাআন্দোলন। যেখান থেকে বাঙালি চিনে ফেলেছিল নিজেকে, তার ভাষা ও ভূখণ্ডকে। তাই পরের পর্বটি হয় আরও জোরালো, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। হাজার হাজার বছরের সাধনাপ্রসূত কাঙ্খিত কাব্যময় সে বাণীভাষ্য। যেটি শুধু অপেক্ষার ছিল, তাই একটি নির্ধারিত ঐক্যের কেন্দ্রে পৌঁছাল। ইতিহাসেরও সত্যটি তাই। এই জন্যই স্বাধীন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির তীব্রতর ও আকুল প্রত্যাশা ছিল এর জন্য। তাই স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা এবং মুক্তি। অর্থনৈতিক-শাসনতান্ত্রিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সবরকম অপ-সবকিছুর কবল থেকে মুক্তি। সেটি ঘটে যায়, ওই মুক্তিমন্দ্র উচ্চারণে। প্রকৃত অর্থে, এটিই নিশিভোরের ডাক। যে ডাকে অবারিত-উদ্বাহু হয়ে পড়ে সকলেই। ছড়ায়ও সর্বত্র। মফঃস্বল-গ্রাম-চর-নদী-বিল পর্যন্ত পৌঁছায়। কারণ, প্রস্তুতিটা অনেককালের এবং তা ছিল সর্বরকমের কর্মসংগ্রামের ভেতর দিয়ে। সকলের মনে তা গেঁথে যায়, সব ধর্মের মানুষের মনে জায়গা পায়। কারণ, তাতে ছিল না কোনো চাতুরি-দ্বিধা-স্বার্থ-সন্দেহ। বঙ্গবন্ধু জনতার নেতৃত্ব চলে আসেন। তারপর মরণজয়ী একাগ্রতা আর গর্ভযন্ত্রণার ঝড়ো রূপে অতঃপর এই ভূখণ্ডের বাংলাদেশ, আর জাতি বাঙালি।
২.
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বার্তায় তখন আমরা বেহুশ। হুশহারা হয়ে পড়লে তখন সুযোগ বুঝে নির্বিচারে ঢুকে পড়ে শত্রুরা, সুযোগসন্ধানীরা। ভেতরে ভেতরে তারা নস্যাৎ করতে থাকে সবকিছু। আত্মসাৎ করতে থাকে আমাদের জীবনের অনেকরকম বার্তা। বিপরীতে জমে ওঠে কালোমেঘ। পরাজিতরা মাথা চাড়া দেয়। প্রত্যাঘাত হয়ে আসার প্রস্তুতি নেয়। সে আঘাতে প্রতিশোধ চরমে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে জয়ী আমরা ওসব গোপন ষড়যন্ত্র বুঝে উঠতে পারি না। তখন দেশ-রাষ্ট্র-পতাকা-সংবিধান-সোনার বাংলা বলে আমরা আনন্দিত, মাতোয়ারা, দিশেহারা, প্রাণবন্ত, অহংতাড়িত। তখনই হঠাৎ জাতির পিতা সপরিবারে ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়েন। তারপর অনেককাল ঘোলা জলে নিপতিত। ঐক্যে আসে দ্বিখণ্ডন। ফিরে আসে পরাজিত শত্রুরা আরও বিশালরূপে। সামাজ্যবাদী গংরা তাদের প্রভূত সহায়তা ও সমর্থন দেয়, সাহস যোগায়। যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতর থেকে আমরা বেরিয়ে হয়েছিলাম ঐক্য, আবার সে রাষ্ট্রের ভেতরে ধর্মের লেবাসে ঢুকে যায় সবকিছু। দৃঢ়তরভাবে স্বাধীন দেশকে নিয়ন্ত্রণে নিতে দেখা যায় উর্দি পরিহিত শাসকদের। তোষামোদকারীরা জুটে যায়, ঐক্য ভাঙতে চায়- পুরনো আমলা, পুরনো সামরিক অফিসার, পুরনো মুসলিম লীগের আর প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থান্বেষী ও প্রভূত অপশক্তির দোসরকুল একত্রিত হয়ে জাতির জনকের হত্যার আস্ফালনের ওপর বাণীমন্ত্র শোনায়, রাষ্ট্রীয় বেতারযন্ত্রে। মূলত মুক্তিযুদ্ধের বিজয়টি নস্যাৎ করাই মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ইতিহাসের চাকাকে দেয় পিছিয়ে। এরূপে চলে বেশ অনেককাল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আইন-আদালত-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর বিভ্রান্তির জাল বুনিয়ে অপ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের বহুপরিব্যাপ্ত চারা রোপন হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের মতো ঐক্য ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে সামরিক শাসনের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা যেমন থাকে পরাহত তেমনি জীবনের মূল্যবোধ কিংবা খাওয়া-থাকা-পরার নিরাপত্তাও ক্রমশ দূরে সরে যায়। এরপর একটি দীর্ঘ সময়ের পরে আবার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রচিত হয়। ক্রমশ গণতন্ত্রের চর্চার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি একপ্রকার নিশানা পেতে শুরু করে। নতুন প্রজন্ম উঠে আসে, তারা জিজ্ঞাসা করে- জানতে চায়। তার ফলে আজকের প্রজন্ম আবার সত্য ইতিহাসের পথ খুঁজে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাই তার স্বপ্ন অনেক ভ্রান্তি-বিভ্রান্তিতে থাকলেও মেধা ও কর্মপ্রয়াসে সম্মুখ দিকেই অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হয়।
৩.
এই বাংলাদেশ এখন যে কোনো রাষ্ট্রের মতোই ইনফরমেশন টেকনোলজির সঙ্গে যুক্ত। ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা ডিজিটাল জীবন-যাপনে সকলেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিংবা বলা চলে বাধ্যও হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এখন সচেতনতা অনেক তুঙ্গে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে একমত। কেউ চায় না এদেশে জঙ্গিদের উত্থান হোক, চেপে বসুক কোনো অপশক্তি। এখন অনেকেই লেখাপড়ায় আগ্রহী, চাকরির জন্য উন্মুখ। দেশ গড়তে চায় সকলেই। দেশাত্মবোধেও তারা উজ্জীবিত। বিশাল জনশক্তি দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে চায়। প্রতিযোগিতায় দেশকে ঊর্ধ্বে দেখতে চায়, দুর্নীতিমুক্ত-স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ চায়। এই ভূখণ্ডকে বড় করে তুলতে চায়। ইতিহাসের স্বপ্নকে বড় করে দেখে। দেশে মানুষ সুস্থভাবে নিরাপত্তার সঙ্গে খেয়ে পরে বাঁচতে পারুক- সকলেরই তাই স্বপ্ন। দেশের অনেক মেধাবী মানুষ আছেন তারা মেধা বা যোগ্যতাবলে বিদেশে ভালো কাজ করছেন, দেশের হয়ে সুনাম কুড়াচ্ছেন। দেশকে নিয়ে গর্বও বোধ করেন তারা। এই মুক্তির স্বপ্নও তো ছিল- ওই মুক্তিযুদ্ধের সময়ও। এখন স্বাধীনতার পর গত কয়েক দশকে আমরা এগিয়েছি। হয়তো কাঙ্খিত সাফল্য আসেনি। কিন্তু উন্নতি ও উত্থান হচ্ছে স্বীয় উদ্যোগে, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়। গ্লোবাল বিশ্ব, কর্পোরেট বাণিজ্য বা পুঁজি এখন বিচিত্রভাবে আমাদের মুখোমুখি। এটা মোকাবিলা করা একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ, সবকিছুই উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কিত। উপযোগিতা থেকেই মানুষ তার ক্ষেত্রকে বেছে নেয়। কর্মচাঞ্চল্যের প্রবাহও তাতে তৈরি হয়। বিপুল জনশক্তির বাজার যে ধরতে পারবে সেই প্রতিষ্ঠা পাবে। ফলে, মানবিক মূল্যবোধগুলোর সেভাবেই তৈরি হয়। চিন্তার স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্যও সেভাবেই প্রস্তুত থাকে। কিন্তু এখনও বৈষম্য আছে। একদিকে বিপুল পরিমাণে চলছে ভোগবাদের উল্লাস অপরদিকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-ত্রাস-নিরাপত্তহীনতা কম নয়। পুঁজিবাজারে মানুষের বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্য থেকে ক্ষোভ-ক্রোধ-উষ্মা বাড়ছে। বৈধতার বদলে অবৈধ চিন্তা বাড়ছে, নিজের স্বার্থ কিংবা নিজের আখেরে লাভের হিসেবে সবাই ব্যস্ত। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব নির্বিশেষে অনেকটা মোহাচ্ছন্ন মানুষ। বোধ করি এটা কালেরও স্রোত। জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা তাই অপ্রতুল। সুতরাং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্বপ্ন এখনও পূর্ণাঙ্গ নয়, পূর্ণতা পায়নি। তাই আমাদের মুক্তিসংগ্রামও শেষ হয়নি।
এরূপ পরিপ্রেক্ষিতে জানাতে চাই, আমাদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কথাটিও। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যেমন আছে তেমনি প্রতিরোধের বিষয়টিও আমাদের রপ্ত করা জরুরি। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে মিডিয়া প্রীতি বেড়েছে, যোগ্য-অযোগ্য তফাৎ করা দুরূহ। জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সস্তা-স্থূল কিছু ক্রিয়াকর্ম। চিন্তাহীন বিনোদন সর্বব্যাপৃত। মিডিয়ার খাদ্য এখন অকেজো অনেককিছু। কালের অনিবার্য প্রবাহেই মানুষ ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু সুস্থ সাংস্কৃতিক উন্নতি জরুরি। মেধাশূন্য জাতি তৈরি নয়। এজন্য বিচিত্রমুখী জ্ঞানের পরিবেশ দরকার। নিম্নশ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মননশীল বা সৃজনশীল শিক্ষার বিস্তার জরুরি। বলতে চাই, আরও অতীতের মূল্যবোধগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে। প্রস্তুত হতে হবে অতীতকে নিয়েই। সতর্ক থাকতে হবে তাঁদের প্রতি যারা অতীতকে অস্বীকার করতে চায়। কেননা বিভ্রান্তির ভেতর দিয়ে তাঁরা আসলে সম্মুখের পথকে অবরুদ্ধ করতে চায়, পেছনে ঠেলতে চায়, রুদ্ধ করতে চায় অগ্রবর্তী চিন্তাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সমাজ কখনও পশ্চাৎমুখী নয়। প্রত্যেকটি সূর্যোদয়ই অরুণ আলোর যাত্রী, এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য-অনুগামী। সুতরাং প্রেরণাদায়ী, প্রতিশ্রুতিশীল মানুষ চাই; জাগানোর জন্য অনেককে একত্রিত করতে চাই, সবকিছুকে পেছনে ফেলে সামনে এগুতে চাই। এর জন্যই আমাদের অতীতের উন্মাতাল সময়গুলোর নবায়ন এবং তার দীক্ষা জরুরি। আমাদের বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়নের জন্য, দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগী ক্ষেত্র চিহ্নিত করা দরকার। সেখানে এক্সপার্টদের কাজে লাগিয়ে দশশালা বিশশালা পরিকল্পনার আওতায় গোটা দেশের কর্মপদ্ধতিকে বিকেন্দ্রীকরণ করে সুষম উন্নয়নের পথ সৃষ্টি করা যেতে পারে। লুটতরাজ, সন্ত্রাস, ছিনতাই, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি বন্ধ করতে হবে। এর বিকল্প নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমস্ত অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ভুল বা খারাপ উদাহরণ কোন দৃষ্টান্ত নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কি ছিল তা স্মরণে আনা শুধু নয়, বা স্লোগানসর্বস্ব বক্তৃতা শুধু নয়- কাজ করতে হবে। যে বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজের কথা আমরা জানি বা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দেশগড়ার কথা জানি তার মূল লক্ষ্য সুষম উন্নয়ন। এজন্য সন্ত্রাস নির্মূল শুধু নয় কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। একটি উন্নত সমাজ গঠনের জন্য সর্বরকম কঠোর এবং নিরপেক্ষ পদক্ষেপকে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য একটি জন-সাংস্কৃতিক বলয়টি জরুরি। বিশেষ করে তরুণদের। তাদেরই সজাগ ও সৃষ্টিশীল হতে হবে। নেতৃত্ব দেওয়ার শক্তি অর্জন করতে হবে। এজন্য সংস্কৃতিবান হওয়ার বিকল্প কী? কারণ, আমরা সবাই জানি সংস্কৃতিই সবচেয়ে বড় শক্তি। সংস্কৃতিই সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে। জাতিভিত্তিক স্বপ্নের ভূখণ্ডটি যেন সেই শক্তিতেই বলীয়ান হয়। কাজটিতে অবশ্যই নতুনদের শামিল করতে হবে। তবে তারা যেন কারো দাস না হয়, মেরুদণ্ড সোজা করুক। উচ্চশিরে দাঁড়াক। তবেই আশা ও সাফল্য।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
©somewhere in net ltd.