নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:৩৪

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবার ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে জাতীয়ভাবে পালিত হয়েছে। সিদ্ধান্তটি যে ঐতিহাসিক, তা ইতিহাসমনস্ক মানুষ মাত্রই স্বীকার করবেন। সেই সঙ্গে এমন কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ২৫ মার্চ শুধু বাংলাদেশে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবেই প্রতিপালিত হবে না, আন্তর্জাতিকভাবেও যেন দিবসটি প্রতিপালিত হয়, যেন ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তার জন্যও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ভাষাশহীদ দিবস হিসেবে প্রতিপালিত হতো। এখন সে দিনটি ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে হিসেবে জগত্জুড়ে উদ্যাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রসঙ্গটি বিশ্ব প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে। সে এক অসামান্য গৌরবের বিষয় বাংলাদেশের জন্য, বাংলা ভাষার জন্য। তেমনি ২৫ মার্চও যখন আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হবে, তখন বাংলাদেশের জাতীয় বেদনা একটি বিশ্ববেদনার বিষয় হয়ে উঠবে, গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়বে, এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠবে। বাংলাদেশ হবে এই মানবিক দাবি উত্থাপনের উদ্গাতা। সেটি বাংলাদেশের জন্য এক মহা গৌরবের বিষয় হবে, বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত মানুষের গণবিপর্যয় রোখার ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী অনুপ্রেরণা জোগাবে। বাংলাদেশের আলো বিশ্বব্যাপী আলো জ্বালাবে।
১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ রাতের বেলা পাকিস্তান হানাদার বাহিনী উন্মত্ত আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিদ্রিত নগরী ঢাকার ওপর। কাণ্ডজ্ঞানহীন যা খুশি হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠল তারা। সে রাতেই শুরু হয় ভয়ংকর গণহত্যা। অতিদ্রুত তারা গণহত্যার এলাকা বিস্তৃত করতে থাকল এবং সমগ্র বাংলাদেশকে তারা তাদের গণহত্যার আওতায় নিয়ে এলো। আধুনিককালের এই গণতন্ত্রের যুগের, সর্বজনীন মানবাধিকার সংরক্ষার এই উদার কালের প্রেক্ষাপটে কী ভয়ংকর, কী কুৎসিত, কী নির্মম, কী নির্বিচার মানবহত্যার দৃষ্টান্ত স্থাপন করল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পরবর্তী ৯ মাস ধরে চলে সেই গণহত্যা। পাকিস্তান শোচনীয়ভাবে পরাভূত হয়ে আত্মসমর্পণ করল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেই ভয়াবহ ৯ মাসে পাকিস্তান বাহিনী ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করল। আধুনিককালের রাজনৈতিক ইতিহাসে অতি নির্মম অধ্যায় রচনা করল পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের জীবন হননের মধ্য দিয়ে।
এটি একটি ঘটনা। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন এমন কোটি মানুষ এখনো জীবিত। এ কোনো কিংবদন্তি নয়। এই নরহত্যার ঘটনার মধ্যে আটকে আহত হয়েছেন, আহত হয়ে পঙ্গু হয়েছেন এমন বহু মানুষ এখনো জীবিত আছেন। তাঁরা কোনো কিংবদন্তির চরিত্র নন। তাঁরা আমাদের সঙ্গে জীবিত আছেন, রক্ত-মাংসের মানুষ। এখানে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। সংশয়ের অবকাশ যে নেই সেটিই হচ্ছে আমাদের পক্ষে থাকা সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি বিশ্বময় ঘটনাটি উপস্থাপনের জন্য। এর বিশ্বাসযোগ্যতাকে নিঃসংশয় করে তোলার জন্য। দেরি হয়ে গেছে যথেষ্ট, তবে এত দেরি হয়ে যায়নি যে অনুমোদনের জন্য বিশ্বময় বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি উপস্থাপিত করতে কোনো অসুবিধা হবে।
ভয়াবহ গণহত্যার পটভূমিতেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। গণহত্যার সঙ্গে বাংলাদেশের ৯ মাসব্যাপী যুদ্ধ ও যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা অর্জনের আত্মিক সম্পর্ক। সে বিষয়ে বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রই অবহিত, অন্তত ১৯৭১ সালে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধকে খুব কাছে থেকে অবলোকন করেছেন। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন আসে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটে ভয়ংকর উপায়ে। সে পরিবর্তন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আঘাত করে। গণহত্যার বিষয়টিও ভাবে-রূপে-তত্ত্বে-তথ্যে বিকৃত হতে শুরু করে।
বাংলাদেশের আইনপ্রণেতারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে এ দেশে সংঘটিত গণহত্যার বিষয়টিকে তাঁরা নিজেরা যে শুধু স্বীকার করছেন তা নয়, আন্তর্জাতিকভাবে ২৫ মার্চকে যেন গণহত্যা দিবস হিসেবে মান্য করা হয়, সে ব্যাপারে তাঁরা প্রচেষ্টা চালাবেন এবং সে ব্যাপারে তাঁরা সাফল্য লাভ করবেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি দৃঢ় অঙ্গীকার প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা আশা করি, গণহত্যা দিবস প্রতিপালনের জন্য প্রধানমন্ত্রী যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিমণ্ডিত হবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি কিভাবে, কী পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তার পূর্বাপর আমরা জানি। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার পূর্বাপরও আমরা অনুমান করতে পারি। বুঝতে পারি এ উদ্যোগ সফল হবে, তবে কঠিন যে হবে সেও বুঝতে পারি। কঠিন হবে এ জন্য যে পাকিস্তান সহজে এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হতে দেবে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রবিরোধী, মানবাধিকারবিরোধী, মানুষের অস্তিত্ববিরোধী ভয়াবহ সব কর্মসূচি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে পরিচালনা করেছে, সেটি পাকিস্তান চক্রান্ত হিসেবে চালিয়ে দিতে চায়। তবে পাকিস্তানে লেখক-সাংবাদিকদের মধ্যে সংখ্যায় খুব কম হলেও এমন বিবেকমান মানুষ পাওয়া যায়, যাঁরা বলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে বর্বর নির্মমতা প্রদর্শন করেছে। সে জন্য তাদের দুঃখ প্রকাশ করা উচিত। তবে সরকারিভাবে যেমন, বেসরকারিভাবে ও সাধারণভাবে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পর্যন্ত অত্যন্ত আপত্তিকর। বিদেশে পাকিস্তানি লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নিষ্পন্ন গণহত্যা সম্পর্কে কথা উঠলে তাঁদের অনেকে বলেন, তাঁরা এ ব্যাপারে কিছু জানেন না, তবে অনেকে বলেন, তাঁরা এসব বিশ্বাস করেন না, একে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন। তাঁরা বলেন, পাকিস্তানকে অপদস্থ করার জন্য বাংলাদেশ গণহত্যার কথা বলছে।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ৯ মাসব্যাপী গণহত্যার কথা যখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনার জন্য উপস্থাপিত করবে এবং ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে প্রতিপালন করার দাবি জানাবে, তখন পাকিস্তান এ উদ্যোগ রোখার চেষ্টা করবে। তবে যা দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে প্রচণ্ডভাবে সাহায্য করবে—এমন দেশ এখন অনেক কম। পাকিস্তান ক্রমেই নির্বান্ধব হচ্ছে। এখন চীন ও তুরস্ক ছাড়া পাকিস্তানের কোনো মজবুত বন্ধু নেই। তবে প্রশ্ন, যেখানে বাংলাদেশে গণহত্যা এবং বাংলাদেশ যখন এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করবে, তখন চীন পাকিস্তানকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন নাও করতে পারে। নানা আন্তর্জাতিক ফোরামে চীন ভারতকে যেভাবে রোখার চেষ্টা করছে, সেভাবে বাংলাদেশকে চীন রুখবে না বলেই বিশ্বাস করা চলে। আমেরিকা আগেকার আমলে পাকিস্তানকে যতটা সমর্থন করত, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ততটা সমর্থন করবে বলে মনে করি না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি গণতান্ত্রিক সংস্থা। মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো তাদের নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যার স্বীকৃতি প্রশ্নে এবং ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার প্রশ্নে তারা বাংলাদেশকে সমর্থন করবে বলেই আশা করা যায়। রাশিয়ার পক্ষ থেকে সমর্থন পাওয়া যাবে, সেটি ধরেই নেওয়া যায়। ভারতের সমর্থন থাকবে। অর্থাৎ আশা করা যায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপিত ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার প্রশ্নে যথেষ্ট সমর্থন মিলবে। কথা থাকবে বাংলাদেশ যেন এ ব্যাপারে হোমওয়ার্কটি করে নেয় চমত্কার করে। শুধু দাবি তোলা নয়, দাবি যেন অকাট্য হয়। দাবি অকাট্য হবে, হবেই। কেননা ঘটনা সত্য ও সত্যকে উপস্থাপিত করার মতো শক্তিও যথেষ্ট আছে আমাদের। দেশে ও দেশের বাইরে এমন কিছু লেখা হয়েছে এবং মত প্রকাশ করা হয়েছে, যা গণহত্যার সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে প্রয়াশ পায়। সে কোনো সত্যিকার প্রয়াশ নয়, অপপ্রয়াস। এর পেছনে কোনো ঐতিহাসিক প্রশ্নের সমর্থন নেই। কবে, কে, কোথায় কী লিখলেন বা বললেন, সেটি খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার দরকার নেই। গণহত্যা পৃথিবীতে আগেও হয়েছে এবং যেসব দেশ গণহত্যার শিকার হয়েছে, তারা তাদের গণহত্যার ঘটনাবলিকে কিভাবে তথ্যবদ্ধ করেছে ও কী পদ্ধতিতে উপস্থাপিত করেছে সে মডেলটি আমাদের অনুকরণ করা দরকার। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যদি ঘটে থাকে কিছু, তাহলে সেগুলো কী এবং কেন, সেসব গবেষণাসম্মতভাবে বিবেচনা করা দরকার। বিশ্বসভায় উপস্থাপনের জন্য আমাদের একটি শক্তিশালী বক্তব্যপত্র রচনা করতে হবে। তার পেছনে থাকবে যথেষ্ট সমর্থনপত্র। সে সমর্থপত্রাবলি মুদ্রণমাধ্যম ছাড়া অডিও-ভিডিও মাধ্যমেও থাকতে পারে।
আমাদের একটি অত্যন্ত বড় সুযোগ যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাজের মধ্যেই পড়ে গণহত্যার বিষয়টিকে প্রকাশ্যভাবে উপস্থাপন করা। জাদুঘর এ বিষয়ে বিশ্ব প্রেক্ষাপট জানে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তো জানেই। আজ প্রশ্ন যখন উঠেছে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়টি বিশ্বসভায় উপস্থাপন করা ও ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করার, তখন এর উদ্যোক্তা যদি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে প্রভূত সাহায্য করতে পারে। পৃথিবীর নানা গবেষণাকেন্দ্র থেকেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। পুরো বিষয়টির জন্য একটি শক্তিশালী সামগ্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে কয়েকটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা প্রয়োজন। মতবিনিময় সভা থেকেই পুরো উদ্যোগের একটি রূপরেখা বেরিয়ে আসবে। এ উদ্যোগ যত শিগগির গ্রহণ করা হয়, ততই ভালো। সময় অনেক গড়িয়েছে। সেই সুযোগে কেউ কেউ নিজ নিজ ধারণা চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল করছেন। কোনো কূটকৌশলই টিকবে না জানি। তবে একটি অতি যোগ্য উদ্যোগ যেন অতি শিগগিরই গৃহীত হতে পারে—এই আমাদের আশা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.