![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাঙালি জাতিকে শরৎচন্দ্র এবং কাজী নজরুল ইসলাম যতটা তাদের উচ্ছ্বাস দিয়ে প্রভাবিত করতে পেরেছেন, ততটা প্রভাবিত করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী এবং আবু সয়ীদ আইয়ুব। বাঙালি জাতি এখনো দর্শন ও যুক্তিতে দুর্বল। রবীন্দ্রনাথ আপে করেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি।’
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বড়মুখ করে যে, কবির আক্ষেপ বাঙালি মোচন করেছে। তার সাড়ে তিন বছরের মাথায় গোনাগোষ্ঠীসহ বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যা করে তার উচ্ছ্বাসের জবাব দিয়েছে খুনিরা।
আমাদের একজন বড়মাপের লেখক হুমায়ুন কবির। তাকে নিয়ে কোনো আলোচনাই দেখি না বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়। অসামান্য দুটো বই লিখেছেন তিনি। নাম ‘বাঙলার কাব্য’ ও ‘শরৎ সাহিত্যের মূলতত্ত্ব’। তিনিও লিখেছেন, ‘বাঙলা চিরকালই কবিতার দেশ।’ একেবারে অক্ষয় সত্য কথা। দর্শন, বিজ্ঞান, যুক্তি, মননগুণ এসবের বালাই নেই সাধারণ বাঙালির মধ্যে, কবিতার উচ্ছ্বাস আছে, ষোলো না। মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য তার প্রভাব দিয়ে বাঙালিকে কবিই বানিয়েছেন। প্রথম আধুনিক বাঙালি রাজা রামমোহন রায় ছিলেন যুক্তিবাদী, পরিশ্রমী, বহু ভাষাবিদ, লড়াকু মানুষ। কিন্তু তার কোনো প্রভাব নেই বাঙালির মধ্যে। কেননা বাঙালির নাড়ির মধ্যে উচ্ছ্বাস এবং দৈন্য দুটোই আছে। বই কেনার প্রতি স্বৈরাগী দেখে সৈয়দ মুজতবা আলী বাঙালি জাতিকে বলেছেন, ‘হটেনটট’। বিদ্যাসাগর বাঙালি সমাজের ওপর বিরক্ত হয়ে বাড়িঘর-ত্যাগ করে এক বাউলপাড়ায় সময় কাটাতেন। বিদ্যাসাগরকে এক লোক বলেছিলেন, ‘আপনাকে ওই লোকটি ক্ষতি করতে চায়।’ বিদ্যাসাগর বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কেন? আমি তো তার কোনো উপকার করিনি।’
তা হলে বুঝুন, বাঙালি কী চিজ? বাঙালি উপকারের প্রতিদান কীভাবে দেয়। রবীন্দ্রনাথ তার ‘চিঠিপত্র’ নবম খন্ডে হেমলতা দেবীকে বলেছেন, ‘আর বাঙালি হয়ে জন্মগ্রহণ করতে চাই না।’ বড় দুঃখের কথা। সালাম আজাদ নামে একজন লেখক রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি বই লিখেছেন। নাম ‘রবীন্দ্রনাথের নাইট হুড প্রত্যাখানের দলিল ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। এ বইয়ের অন্যতম প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ এবং তার নিন্দুকরা।’ এ প্রবন্ধে পেলাম, ‘১৪/১০/১৯৩০ তারিখে ইন্দিরা দেবীকে এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে আমাকে অপমানিত করা যত নিরাপদ এমন আর কাউকে নয়। মহাত্মাজি, চিত্তরঞ্জনকে ছেড়েই দেওয়া যাক, বঙ্কিম, শরৎ, হেম বাড়–য্যে, নবীন সেন কাউকে আমার মতো গাল দিতে কেউ সাহস করেনি।’
মনে প্রশ্ন জাগে, রবীন্দ্রনাথ কি ঘন ঘন বাইরে ছুটে যেতেন বঙ্গভূমির কণ্টকশয্যা থেকে একটু নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য? কিন্তু মরেও রবীন্দ্রনাথ নিষ্কৃতি পাননি, ড. আহমদ শরীফের রবীন্দ্র বিদ্বেষই তার প্রমাণ।
বিদ্বেষ ও উচ্ছ্বাস থেকে আসে, বিশ্লেষণ ও যুক্তিহীনতা থেকে আসে। রবীন্দ্রনাথের গদ্যে যুক্তি ও দর্শন মৌলিক উপাদান। এটি বাঙালি আত্মস্থ করতে পারেনি বিধায় বাঙালি সমাজে বরীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাজে, কদাকার কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে।
মননশীলতায় অনেক ঘাটতি বাঙালির। সেই যে মহাবীর আলেকজান্ডার এ দেশে এসে জোয়ার-ভাটা দেখে বিচলিত হয়েছিলেন, তার তাৎপর্য এখনো হারিয়ে যায়নি। বাঙালির মননজগতে সেই ভারসাম্যহীনতা রয়েই গেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার উচ্ছ্বাস দেখে হতবাক হয়ে যাই। সামান্য একটা টেস্ট খেলায় জিতলেও বাংলাদেশের উচ্ছ্বাসের বান ডেকে যায়। আর হেরে গেলে ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যায়। এটাকে আদিখ্যেতা বলা ছাড়া আর উপায় নেই। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী পর্যন্ত বিবৃতি দিতে থাকেন অর্থাৎ খেলাকে খেলা হিসেবে দেখার যোগ্যতা বাঙালির নেই।
প্রমথ চৌধুরী ‘সাহিত্যে খেলা’ নামে প্রবন্ধটি লিখেছেন। খেলার মধ্যে যে নির্দোষ আনন্দ তাই খুঁজতে হবে সাহিত্যে। তবে জুয়াখেলা এবং খেলা কিন্তু এক জিনিস নয়, বলেছেন প্রমথ চৌধুরী। বলেছেন, সাহিত্য ছেলের হাতের খেলনাও নয়। অথচ বাঙালি এখনো ওই পর্যায়ে রয়েছে। মননগুণ থাকলে এমনটি হতো না।
বর্তমানে বাংলাদেশে এমনকি পশ্চিম বাংলায় মৌলবাদের ভয়ঙ্কর বিস্তার ঘটেছে। অথচ এ দেশে আরজ আলী মাতুব্বরের মতো দার্শনিকের জন্ম হয়েছে। এ দেশে বিশের দশকে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন হয়েছিল। তাদের পত্রিকায় নাম ছিল ‘শিখা’। তাই তাদের বলা হতো ‘শিখা’ গোষ্ঠীর লেখক। বাঙালির সাংস্কৃতিক অধ্যায়ের গৌরবময় অংশ সেটি। বলেছিলেন তারা, ‘বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ কিন্তু তারা টিকে থাকতে পারেননি। তাদের প্রভাব বাঙালি সমাজে তেমন কাজ করেনি। যারা একদা অগ্নিপুরুষ ডিরোজিওকে অপমান করেছিল তাদের অধস্তনরাই শিখা গোষ্ঠীর লেখকদের অপমান করে। এ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের কথাটি গভীর মূল্য দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। বলেছিলেন, ‘এতদিন আমি জানতাম আমি একাই কাফের, এখন দেখছি আরও অনেক কাফের আছে। এতে আমি আনন্দিত।’ নজরুলের এ কথার তাৎপর্য বাঙালি ধরতেই পারেনি।
মনীষী মোতাহের হোসেন চৌধুরীর একটি মাত্র বই ‘সংস্কৃতি-কথা’। আর দরকার নেই। একই কথা বারবার বলে লাভ কী? ‘আমাদের দৈন্য’ নামে যে প্রবন্ধটি লিখেছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাতে ধরা পড়েছে বাঙালি মুসলমানরা মনের দৈন্য। বলেছেন তিনি যে, ‘আমরা নিজের উন্নতিতে অতটা পারদর্শী নই, যতটা পরের দোষ দিতে পারদর্শী।’ আর্থিক দৈন্যের গুরুত্ব তিনি দিয়েছেন, তবে মনের দৈন্যকে ভয় পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। আর প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘যে জাতির মনের ঘর শূন্য তার ধনের ঘরও শূন্য।’
গত ৪ এপ্রিল চলে গেল ড. সনজীদা খাতুনের জন্মদিন। তিনি আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিছক কট্টর সমালোচকের ভাষা এ নয়। গ্রহিষ্ণু পাঠকের আনন্দের দীপ্তিতে পূর্ণ করে এ লেখা।’ (প্রবন্ধ সংগ্রহ-পৃ: ৪৬১) এমন কথা বাঙালি কবে বুঝবে?
মাহমুদুল বাসার, কলাম লেখক ও গবেষক
©somewhere in net ltd.