নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শেষ পর্যন্ত লেখাটাই থাকে। টিভি, রেডিও, ওয়েবসাইট, চলচ্চিত্র, মঞ্চ, বিজ্ঞাপণ, ব্লগ - লেখার যতো মাধ্যম সবখানেই লিখতে হবে। পৃথিবী পাল্টে গেছে - এখন আমরা দুহাতের দশ আঙুলেই লিখি।

মুম রহমান

পেশাদার ও নেশাদার লেখক, মাঝে মাঝে কবি

মুম রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

গেরিলা ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র

০৩ রা এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:১০





মুক্তি : ১৪ এপ্রিল ২০১১

পরিচালনা : নাসির উদ্দীন ইউসুফ

প্রযোজনা : এশা ইউসুফ

চিত্রনাট্য : এবাদুর রহমান, নাসির উদ্দীন ইউসুফ

কাহিনী : সৈয়দ শামসুল হক

অভিনয় : জয়া আহসান, ফেরদৌস, শতাব্দী ওয়াদুদ, আহমেদ রুবেল, আজাদ আবুল কালাম, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্পা রেজা, এটিএম শামসুজ্জামান

সঙ্গীত : শিমুল ইউসুফ

শিল্প নির্দেশনা : অনিমেষ আইচ

চিত্রগ্রহণ : সমীরন দত্ত



স্যামুয়েল গোল্ডউইন (১৮৭৯-১৯৭৪) আমেরিকার অন্যতম চলচ্চিত্র প্রযোজক ছিলেন, হলিউডের একাধিক ফিল্ম স্টুডিও’র স্থপতি হিসাবেও তিনি কাজ করেছেন। দীর্ঘজীবি এই প্রযোজক চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা ও সংকটকে দেখেছেন একান্ত ঘনিষ্ঠভাবে। তিনি বলেছিলেন, Why should people go out and pay money to see bad films when they can stay at home and see bad television for nothing?| । আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তার কথাটি জরুরি মনে হয়। যখন দর্শকরা হল বিমুখ, একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো তখন ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে টিভি চ্যানেল। টিভি দর্শক বরাবরই আলসে, তারা ফোনে কথা বলতে বলতে টিভি দেখে, খেতে খেতে টিভি দেখে, হাতের আর পাঁচটা কাজ করতে করতে টিভি দেখে। কিন্তু সিনেমার দর্শক হয় একনিষ্ঠ, একাগ্র এবং চিন্তাশীল। সিনেমার দর্শক প্রস্তুতি নিয়ে, নগদ পয়সা ব্যয় করে হলে যায়। তাই সিনেমার দর্শকের চাহিদা ও ক্ষুধা বরাবরই বেশি। হয়তো সেই চাহিদা বা ক্ষুধা মেটাতে পারছি না বলেই আমরা হলের দর্শক হারাচ্ছি বলে মনে করি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে তাকে অবশ্যই এমন ভাষা আর ভঙ্গি খুঁজে নিতে হবে যা হবে বিছানায় হেলান দিয়ে টিভি দেখার চেয়ে বলিষ্ঠ। সা¤প্রতিক কালের একাধিক বাংলা ছবি দেখে তাই মনে হয়।

এই সব কথাই মনে পড়ে গেলো নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত গেরিলা চলচ্চিত্র সম্পর্কে কিছু বয়ান করতে গিয়ে, প্রাসঙ্গিকভাবেই। গেরিলা চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট আর মূল ভাবনা জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র করার সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই আছে। প্রথমত মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির প্রাণের উৎসধারায় বহমান, আমাদের চেতনার বিরাট জমিন দখল করে আছে মুক্তিযুদ্ধ, কাজেই ছবির বিষয় যখন মুক্তিযুদ্ধ তখন অনেকটা অবলীলায় তা আমাদের সমীহ ও সমর্থন কেড়ে নেয়। অন্যদিকে বিচার করার কালেও মুক্তিযুদ্ধের ছবির কাছে আমাদের দায়বদ্ধতা, চাহিদা ও প্রত্যাশা বেশি। এই সুযোগে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের একটি সংক্ষিপ্ত চালচিত্র দেখে নেয়া যেতে পারে। ১৯৬৭ সালে খান আতাউর রহমান পাকিস্তান আমলেই তৈরি করেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ঐতিহাসিক ও জীবনী নির্ভর এই ছবিতেই বাঙালির মুক্তি আকাঙ্খা লক্ষ করা যায়। ’৬৯-এর গণঅভুত্থানের পর ১৯৭০ সালে জহির রায়হান তৈরি করলেন তার অনবদ্য রাজনৈতিক ছবি জীবন থেকে নেয়া। পারিবারিক প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য তুলে ধরা হয় এই ছবিতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই জহির রায়হানই ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা নিয়ে নির্মাণ করলেন স্টপ জেনোসাইড (১৯৭২)। দেশ-বিদেশে আলোচিত হয় তার এই তথ্যচিত্র। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে তিনি তৈরি করলেন আরেকটি তথ্য চিত্র এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭২)। একই বছর জহির রায়হানের পথ ধরেই আলমগীর কবির তৈরি করলেন লিবারেশন ফাইটার্স ও বাবুল চৌধুরী তৈরি করলেন ইনোসেন্ট মিলিনিয়নস। এই তিনটি তথ্যচিত্রই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতা পেয়েছে এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নানা দিক তুলে ধরেছে দায়িত্বের সাথেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাহিনী চিত্র নির্মাণের প্রথম দাবীদার চাষী নজরুল ইসলাম। তার ওরা ১১ জন (১৯৭২) চলচ্চিত্রে ১১ যুবকের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ও তাদের অবদানকেই তুলে ধরা হয়। শৈল্পিক, নান্দনিক নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কাহিনীচিত্র হিসাবে এটি দর্শকের আবেগকে উদ্বেলিত করেছে। সেই আবেগকে কেন্দ্র করেই সুভাষ দত্ত তৈরি করলেন অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)। এখন পর্যন্ত এটিই একমাত্র চলচ্চিত্র যা যুদ্ধ শিশু’র বিষয়টি নিয়ে ভাবায়। এরপর একে একে তৈরি হলো জয় বাংলা (১৯৭২, ফখরুল আলম), রক্তাক্ত বাংলা (১৯৭২, মমতাজ আলী), বাঘা বাঙালী (১৯৭২, আনন্দ)। এই ছবিগুলোর বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ, এর বাইরে আর আলাদা করে বলার কিছু নেই। আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল (১৯৭৪), হারুনুর রশীদের মেঘের অনেক রং (১৯৭৬) স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশকের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি। চলচ্চিত্র শুধু যৌগিক শিল্প নয়, ব্যবসাও বটে। দুঃখজনক হলেও সত্য শুরুর দিকের বেশ কটি চলচ্চিত্রেই মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবসায়িক দিক থেকে দেখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গল্পে যুদ্ধ, নারী ধর্ষন ইত্যাদিকে পূঁজি করে আমার জন্মভূমি (১৯৭৩, ), বাংলার চব্বিশ বছর (১৯৭৪, ) আজো ভুলিনি (১৯৭৫, ) ঘরাণার সুলভ ছবিও তৈরি হয়েছে। চাষী নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সংগ্রাম (১৯৭৪), হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), ধ্র“বতারা (২০০৬) নামে আরও চারটি ছবি করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম ও সর্বাধিক ছবি করার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। তবে শৈল্পিক বিচারে এই ছবিগুলো সে অর্থে দিকনির্দেশনাকারী হয়ে ওঠেনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মূলধারায় বেশ কিছু ছবি হলেও তাদের শিল্পমান ও বাণিজ্যিক মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে বিকল্প ধারায় বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ চলচিচত্র নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে মোরশেদুল ইসলামের আগামী (১৯৮৪), নাসিরউদ্দিন ইউসুফের একাত্তরের যীশু (১৯৯২), তারেক মাসুদের মুক্তির গান (১৯৯৫) এবং তানভীর মোকাম্মেলের নদীর নাম মধুমতি (১৯৯৬) উল্লেখযোগ্য। বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ হলেও তা নিয়ে গর্ব করার মতো ছবি সে অর্থে নেই। যে অর্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব সেরা বেশ কিছু চলচ্চিত্র হয়েছে সে অর্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মাইলফলক সৃষ্টিকারী ছবি অপ্রতুল। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লা জেয়াদের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব। আমাদের অহঙ্কার। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রে, বিশেষত মূলধারার চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের প্রাপ্য সম্মান অনুযায়ী স্থান দেয়া হয়নি।’ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পেরিয়ে তাই মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে নতুন করে ভাবনার আবশ্যিকতা রয়েছে। এই ভাবনায় নতুন করে উদ্যম যোগায় নাসির উদ্দিন ইউসুফের নতুন চলচ্চিত্র গেরিলা। গুণি এই নির্মাতা ইতোপূর্বে একাত্তরের যীশু নির্মাণ করে দর্শকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্যজগত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। সর্বোপরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার রয়েছে সাহসী ও সক্রিয় ভূমিকা। এই নাসিরউদ্দিন ইউসুফ যখন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাসের সঙ্গে নিজের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তখন সহজেই তা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে যায়। অস্ট্রেলিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক, অভিনেতা ও সুরকার ইয়াহু সিরিয়াস (১৯৫৩ -) বলেন, Movies are a complicated collision of literature, theatre, music and all the visual arts.। চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে সাহিত্যের একাত্মতা, থিয়েটারের সঙ্গম, সুর আর চিত্রের সমন্বয় নাসির উদ্দিন ইউসুফ সুচারুভাবে অনুধাবন করেন তা ইতোপূর্বেই প্রতীয়মান। তাই তার গেরিলা নিয়ে উচাকাঙ্খা লক্ষ করা যায় ছবির নির্মাণের কালেই। তার নিজের কাছেও এই ছবি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবী করেন, ‘বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার উপহার ‘গেরিলা’’ এবং ‘এটি ১৯৭১ সালের একটি শিল্প দলিল।’ তার ভাষ্য থেকেই আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, নতুন প্রজন্মের জন্য নির্মিত এই ছবি একাধারে শৈল্পিক ও সত্যনিষ্ঠ।

শুরুতেই বিবেচনায় আনা যায় ইউসুফের ছবির বিষয়বস্তুকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের অন্যতম কারণ হলো গেরিলা বাহিনী। মূলত গেরিলা আক্রমণই ছিলো ’৭১-এর বিজয়ের মূল শক্তি। সেই গেরিলাদের নিয়ে তিনি ছবি তৈরি করেছেন। ইতোপূর্বে জনপ্রিয় লেখক, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ আগুনের পরশমণি (১৯৯৪) ছবিতে মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা আক্রমণের দিকটি প্রথম তুলে ধরেন। তার সা¤প্রতিকতম শ্যামল ছায়া(২০০৪) ছবিতেও গেরিলা আক্রমণের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তুএকজন গেরিলা যোদ্ধার হওয়ার অভিজ্ঞতাকে সরাসরি কাজে লাগিয়েছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ নিজের ছবিতে। তারচেয়েও বড় কথা, তিনি একজন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে কেন্দ্র করেই ছবির গল্প সাজিয়েছেন। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র বিলকিস যেন ’৭১-এর ইলেকট্রার প্রতিবাদী উত্তরাধিকার। উল্লেখ করা বিবেচ্য মনে করি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর কোন ছবিতে নারীকে এমন প্রাধান্য দেয়া হয়নি। যদিও ইতিহাস বলে, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীর অবদান যথেষ্ট গুরুত্ববাহী। বিলকিস, মিসেস খান ও শাহীনের মতো নারীদের অবদান আমাদের সেলুলয়েডে বন্দী করে নাসির উদ্দিন ইউসুফ একটি দায় পূরণ করেছেন।

এই ক্ষণে ছবির গল্পটি আলোচনা করে নিলেন সুবিধা হয়। কেননা, গল্পের ধারা ধরেই বাকী আলোচনা সম্পন্ন করা যেতে পারে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের উত্তাল রাতে গল্পের সূচনা হয়। নেপথ্যে জয় বাংলা ধ্বণি শোনা যায়। এমন প্রেক্ষিতেই বাড়ি থেকে কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিতে যাচ্ছেন সাংবাদিক হাসান। স্ত্রী বিলকিস এই দুঃসময়ে তাকে যেতে দিতে নারাজ। হাসান চলে যায়। শুরু হয় ভয়াল কালো রাত্রির থাবা, ঘুমন্ত ঢাকা শহরবাসীর উপর পাক বাহিনীর হামলা। নিঁখোজ হয় হাসান। বিলকিস স্বামীর খোঁজে নানা জায়গায় যায়। হাসানের অবর্তমানে ব্যাংক কর্মী বিলকিস দায়িত্ব নেয় অসুস্থ শ্বাশুড়ি আর গৃহকর্মী বিন্নীর। পুরুষ শূন্য এই পরিবারকে আগলে রাখে হাসানের দুধ ভাই তসলিম সর্দার। এদিকে বিলকিস ক্রমশ জড়িয়ে পড়ে মুক্তি সংগ্রামে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত গেরিলা পত্রিকার প্রকাশনা ও বিতরণে সাহায্য ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কার্যক্রমে সাহায্য করে সে। কবি, গীতিকার আলতাফ মাহমুদের ধারণ করা মুক্তিযুদ্ধের গানের স্পুল ভারতে পাঠানোর দায়িত্ব নেয় সে। এদিকে পুত্রশোকে মারা যায় হাসানের মা, বিন্নীকে ধর্ষণ করে রাজাকার বাহিনী। অভিজাত শ্রেণীর মিসেস খানের সঙ্গে সে পাকিস্তানি আর্মিদের পার্টিতে যায়। সেখানে টয়লেটে বোমা রেখে আসে। কিন্তু মিসেস খানকে রেখেই চলে আসতে বাধ্য হয় সে। বাইরে থেকে মুক্তি বাহিনীরা আক্রমণ করে, ভেতর থেকে বোমা ফোটে। অভিযান সফল হলেও দুয়েকজন সহযোদ্ধা ধরা পড়ে। মেজর সরফরাজের অত্যাচারের শিকার তাদেরই একজন জানিয়ে দেয় এই হামলায় জড়িতদের নাম, এর মধ্যে বিলকিস ও আলতাফ মাহমুদের নামও বলা হয়। আলতাফ মাহমুদকে আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়। বিলকিসের বাড়িতে মেজর সরফরাজ দলবল নিয়ে হাজির হয়। ইতোমধ্যে বিলকিস পালাতে সক্ষম হয়। রাজাকার বাহিনীর হাতে নিহত হয় তসলিম সর্দার। পলাতক বিলকিস নিজের বাড়ি জলেশ্বরের দিকে যাত্রা শুরু করে। ট্রেনে সে রাজাকারদের তৎপরতা দেখে। এক সময় ট্রেন থেমে যায়। মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার খোকন ও তার বাহিনী রেলব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। তাই ট্রেন আর এগুতে পারে না। বিলকিস পায়ে হেঁটে রওনা হয়। তাকে অনুসরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ। সিরাজ খোকন কমাণ্ডারের দলের। আর বিলকিস খোকন কমাণ্ডারের বোন। সিরাজকে নিয়ে ভাইয়ের কাছে পৌঁছতে চায় বিলকিস। কিন্তু পথেই জানতে পারে, খোকন কমাণ্ডার ধরা পড়েছে এবং তাকে কুখ্যাত ডাকাত ও ভারতের দালাল হিসাবে চিহ্নিত করে পাকিস্তানের উন্নতিকল্পে ‘কোরবানি’ দেয়া হয়েছে। এমনকি তার জানাযাও নিষিদ্ধ করা হয়। ইলেকট্রার মতোই খোকনের মৃতদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বিলকিস ও সিরাজ। ক্যাপ্টেন সমশেদের সামনে তাকে নেয়া হয়। এদিকে খোকন কমাণ্ডার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল। আর ক্যাপ্টেন সমশেদ বিলকিসের সম্ভ্রম হানি করতে চায়। বিলকিস গ্রেনেড ফাটিয়ে আত্মঘাতি হামলা করে আর্মি ক্যাম্পটি উড়িয়ে দেয়, নিজেও শহীদ হয়।

এই কাহিনী স্রেফ কাল্পনিক নয়, কেননা, নিষিদ্ধ লোবানের গল্পের কাঠামোর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফের ব্যক্তি অভিজ্ঞতা যেমন যুক্ত হয়েছে, তেমনি ইতিহাসের অনেক উপাদানও বিদ্যমান। সারা আরা মাহমুদ ‘আমার স্বামী’ প্রবন্ধে আলতাফ মাহমুদ সম্পর্কে বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে। কেউ কেউ বাসায় আসেন। আবার চলে যান। বেশ ক’টি আর্মস তখণ আমাদের বাসার মাটির নিচে লুকানো।’ গেরিলা ছবিতে আমরা এর সত্যতা দেখি। আমরা দেখি, আলতাফ মাহমুদ নিজে গর্ত করে অস্ত্র লুকাচ্ছেন। রফিকুল ইসলামের ভাষ্যের সাথেও এ ছবিতে আলতাফ মাহমুদের পরিণতি মিলে যায়, ‘‘৩০ আগস্ট রাত ৩টায় মিলিটারী আসে আলতাফ মাহমুদের বাড়ীতে, সঙ্গে পথ প্রদর্শক চাদর ঢাকা একটা লোক। জিজ্ঞেস করে ‘আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?, আলতাফের পেছনে রাইফেল ধরে নিয়ে যায় বাড়ীর আঙিনায় যেখানে মাপির নীচে পোঁতা ছিল ঐ বিস্ফোরক বোঝাই ট্রাঙ্ক। আলতাফকে দিয়ে মাটি খুঁড়িয়ে ট্রাঙ্কটা বের করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রচন্ড মারপিট, রাইফেলের বাটের প্রচন্ড আঘাত আর পশুদের বুটের লাথি। রক্তাক্ত আলতাফ মাহমুদকে টেনে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায় পশুরা। সঙ্গে নিয়ে যায় পাঁচ তরুণ আত্মীয়কে। নুহেল, খায়রুল, নওফেল, মঞ্জুরুল, বারেক এবং আরও পাঁচজন প্রতিবেশী যুবককে।’ ’ এই বর্ণনার নিঁখুত চিত্রায়ণই ছবিতে দেখা যায়। রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম তার আরেক গ্রন্থ লক্ষ প্রাণের বিনিময়েতে উল্লেখ করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ২০টিরও বেশি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে কিছু মুদ্রিত হলেও অধিকাংশই ছিলো ‘সাইক্লোস্টাইল’ করা বা হাতে লেখা।’ এমনই একটি সাইক্লোস্টাইল করা পত্রিকা ‘গেরিলা’। কাজেই ঐতিহাসিক সত্যতার দিক থেকে এই ছবি যথেষ্ট বিশ্বস্ততার দাবী রাখে। সে অর্থে কাহিনী ও তথ্যের সম্মিলনে গড়ে উঠেছে এ ছবি। তবে একটি তথ্য ঐতিহাসিকভাবে ভুল। ছবিতে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলার জন্যে পাকিস্তানি অফিসার বলছেন, ওকে ইণ্ডিয়া পাঠিয়ে দাও। কিন্তু হামদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টের ২৬০ নং স্বাক্ষী কর্ণেল মনসুরুল হক জানিয়েছেন, মুক্তিবাহিনী কিংবা আওয়ামী লীগ কর্মীর কাউকে ধরা হলে তাদের মেরে ফেলার সাংকেতিক ভাষা ছিলো, ‘বাংলাদেশ পাঠিয়ে দাও’। এই বাক্যের অর্থই ছিলো কোন রকম তদন্ত বা বিচার ছাড়া তাৎক্ষণিক মেরে ফেলা।

গল্প বলার ক্ষেত্রে এ ছবি প্রায়শই আগুপিছু করেছে, অর্থাৎ বর্তমানের সঙ্গে ফিরে ফিরে এসেছে ফ্ল্যাশব্যাক। খোকন ও হাসানের ফ্ল্যাশব্যাকগুলো যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সাথেই চিত্রায়িত হয়েছে। বিশেষ করে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, মৃত খোকনের মুখ হাতড়াতে হাতড়াতে বিলকিসের হাতে আলগোছে ওঠে আসে ছেলেবেলার সেই পাখির বাচ্চাটি। তখনই স্বপ্ন ভেঙে সামনে হাজির হয় পাক বাহিনী। খোকনের মৃত্যু যেন শৈশব, কৌশরের মৃত্যু, বাঙালির সরলতার মৃত্যু যা একটি পাখির প্রতীকে ওঠে এসেছে। এমনি আরেকটি অসাধারণ ফ্ল্যাশব্যাক শুটকির আড়তে ছোট্ট খোকনের হাতে লাটিম নিয়ে লুকোচুরি খেলার দৃশ্যটি। ফ্ল্যাশব্যাক চলচ্চিত্রের পুরনো কৌশল। কিন্তু এই কৌশলটিকে সূক্ষèতা আর মুন্সিয়ানারা সাথে কাজে লাগিয়েছেন পরিচালক ইউসুফ। ব্যাগ থেকে স্পুল বের করে তোষকের নিচে রাখার সময় সেখান থেকে বেরিয়ে আসে পিস্তল। আর পিস্তলের সঙ্গে পরিচালক চলে যান স্বামী হাসান টার্গেট ঠিক করা শেখাচ্ছেন বিলকিসকে সেই ফ্ল্যাশব্যাকে। তবে রেলগাড়িতে কিংবা নৌকা হাসানের ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যগুলো অতোটা প্রয়োজনীয় মনে হয়নি। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে নির্যাতন করার দৃশ্যেটিতে ক্যামেরা সঞ্চালন, আলো-ছায়ার খেলা, বাইরের বিদুৎ ঝলক, শটের বৈচিত্র সব মিলিয়ে পরিচালকের দৃঢ় ও কৌশলি নির্মাণের ছাপ সুস্পষ্ট। চারিদিকে সবুজ প্রান্তর, পেছনে রেল ব্রিজের থেকে পোড়া ধোঁয়া আসছে, রেললাইন ধরে সাদা শাড়ি পরা বিলকিসের হেঁটে যাওয়া, পেছনে মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের অনুসরণ এমনি অসংখ্য সব দৃশ্যে পরিচালকের বাহাদুরী সুস্পষ্ট। চিত্রগ্রাহক সমীরন দত্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন একাধিক বৃষ্টি ও রাতের দৃশ্যের চিত্রায়নে। এমন বৃষ্টির চিত্রায়ন বাংলা ছবিতে যথার্থই দুর্লভ। নিঃসন্দেহে এ সব ক্ষেত্রে আলোক পরিকল্পনাকারী তার সফল সহযাত্রী ছিলো। শাহাদাত আর আলমের সাথে বিলকেসের গাড়ির ভেতরের দৃশটিতেও চিত্রগ্রাহকের নৈপুণ্য প্রমাণ করে। লং শট, ক্লোজ শট, হাই এঙ্গেল, লো এঙ্গেল সব দিক থেকে সবভাবেই ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন সমীরন। অধিকাংশ শটের ক্ষেত্রে তার ক্যামেরা সঞ্চালন ছিলো যুক্তিযুক্ত। বিন্নীর ধর্ষন দৃশ্যটিতে ভাঙা পুরনো জমিদার বাড়ি ঘিরে ক্যামেরার সঞ্চালন অদ্ভূত বেদনার সৃষ্টি করে। অনিমেষ আইচের শিল্প নির্দেশনা এই ছবির চিত্রায়ন গুণকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ৪০ বছর আগের বাংলাদেশের রাজপথি, গলি, গ্রামের আল এই সব কিছুকেই আজ ধারণ করা দুরূহ। যেভাবে মোবাইল কোম্পানি আর বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সারা দেশে তাদের বিজ্ঞাপণে বাংলাদেশকে মুড়ে দিয়েছেন তাতে করে চিত্রায়ন করার মতো অরক্ষিত ভূমি পাওয়া দূর্লভ। এরমাঝেই লোকেশন নির্বাচন আর অনিমিষের সুচিন্তিত শিল্পনির্দেশনা পুরো ছবিতেই ’৭১-এর ছাপ রাখতে পেরেছে। মিষ্টির দোকান, মিসেস খানের অভিজাত গৃহকোণ, পাকিস্তানের ট্রেন, শুটকির আড়ত এই সব দৃশ্যেই শিল্প নির্দেশনা উল্লেখযোগ্য। বিলকিসের বাড়ির বাথরুমটি অবশ্য কিছুটা বিসদৃশ্য লাগে। সে সময়ে এ ধরণের বেসিন ও কল হয়তো ছিলো না। সময় নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে পোশাকও একটি বড় ভূমিকা রাখে। বিলকিস, তৈয়ব, রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, কমাণ্ডার সবার পোশাকই যথার্থ ছিলো। বিশেষ করে বিলকিসের পোশাক নিয়ে অনেক ভাবতে হয়েছে। নব বিবাহিত বিলকিস স্বামীর সঙ্গে ট্রেনে, আবার স্বামী হারা বিলকিস ট্রেনে, আর্মিদের পার্টিতে বিলকিসের উজ্জ্বল সাজ, মিসেস খানের অভিজাত পোশাক ইত্যাদি ক্ষেত্রে পোশাক পরিকল্পনাকারী শিমুল ইউসুফ স্বার্থক। বিলকিস, মিসেস খান, শমসাদ ইত্যাদি চরিত্রের মেকআপও চরিত্র নির্মাণে সাহায্য করেছে। শিমুল ইউসুফ সঙ্গীতেও সমান পারদর্শী। তার কণ্ঠে তেপান্তরের পারে গানটি ইতোপূর্বেই জনপ্রিয়। এই ছবিতে এই গানটির পূনঃব্যবহার স্বার্থকভাবে করা হয়েছে। পরিচালক পুরো গান ব্যবহার না করে তার পরিমিতি বোধের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা ছবিতে এমন পরিমিত আর পরিকল্পিত সঙ্গীত ব্যবহারের নজির কম। আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি’র দৃশ্যায়নে দেখা যায় আলতাফ মাহমুদের কন্যা হারমোনিয়ামে গানটি বাজাচ্ছে, অথচ নেপথ্যে আমরা পিয়ানোর সুর শুনি। একটু সতর্কতায় এই অসঙ্গতিটুকু হয়তো কাটানো যেতো।

তিন ভাষায় সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে এ ছবিতে, বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি। প্রমিত বাংলার সাথে কোথাও কোথাও আঞ্চলিক বাংলাও ব্যবহৃত হয়েছে। তসলিম সর্দারের ঢাকাইয়া সংলাপ চিত্তকর্ষক, ক্ষেত্র বিশেষে সাহসী। প্রচলিত বাংলা চলচ্চিত্রের নামকরণ থেকে নাচে, ধর্ষণ দৃশ্যে কিংবা খলনায়ক কর্তৃক নায়িকাকে উত্যক্ত করার দৃশ্যে আমরা যথেষ্ট অশ্লীলতার পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু সংলাপের ব্যাপারে একটা শুচিবাই আমাদের কাজ করেছে। ডিপজল কিংবা মান্না অবলীলায় গালি ব্যবহার করলেও কাহিনী বা চরিত্রের প্রয়োজনেও আমাদের শৈল্পিক বাংলা ছবি শুচিবাই রীতি মেনে চলেছে। সেই বিবেচনায় এ ছবির সংলাপ প্রথা ভেঙেছে। কিছু সংলাপের উদাহরণ দেয়া যাক Ñ

: মওলানা এইসব জ্ঞানবুদ্ধিগিনি তুমি ছাগলের কানে দিও। মজলুম আর জালেমের ফারাক কিন্তু আমি বুঝি।

: তাসলিম ভাই একদিন আপনি আমি পাকিস্তান হাসিল করেছিলাম। হাজার শহীদের লহুর বদলায় লাখো কোরবানির এই ফসলের জিমাদ্দার আমরা।

: কী কইবার চাও সাফ সাফ কয়া ফালাও।

: আমরা ইসলামের ঝাণ্ডা কায়েম রাখতে চাই। ইণ্ডিয়ার দালাল, জয় বাংলার পার্টি যে অত্যাচার করছে... আপনাকে এই এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে না? শান্তি কমিটির মেম্বারিতে নাম লেখাইতে হবে। এই ফর্মটা দে।

(ফর্ম দেয়। ছুঁড়ে মারে তসলিম সর্দার।)

: মওলানা, কী কমু! তুমি আমার বাড়িতে আইছো। আমার মাইনসের সামনে ধামকি দিছো। আইজ থাইকা চল্লিশ বচ্ছর আগে কুষ্টিয়ার এতিমখানা থাইকা তোমারে এইখানে আনছিলাম, আমাগোর মসজিদের ইমাম বানাইছিলাম। আইজ তুমি শান্তি কমিটির ফরম নিয়া আইছো আমারে সাইন করাইবার লাইগা! তুমার এই শান্তি কমিটিরে, অর মেম্বারগো, আর তামাম রাজাকার বাহিনীরে আমি টিকটিকি দিয়া * * *। * * *পোলা বাইর হ এইখান থাইকা।

এই সংলাপ অংশে উর্দু ও ঢাকাইয়া ভাষা এবং গালির ব্যবহার লক্ষণীয়। ছবির শেষ দিকের সংলাপেও আমরা দেখি উর্দু ও ইংরেজির মিশেল। সেখানে গা ঘিনঘিনে নোংরা কথাও হয়ে উঠেছে সুপ্রযুক্ত।

: তুম হিন্দু হো! ক্যাপ্টেন শমসাদ ক্যায়া লাকী হে তু, তেরে কো হিন্দু আওরত মিলগ্যায়ে। আই হ্যাভ নেভার টেস্টেড হিন্দু উইম্যান ইন মাই লাইফ। আই এম গেটিং হট নাও। আই মাস্ট সে ইউ আর সো লাকি। সাচ্চি মুসলমান কি খিদমত করনে কা মোওকা মিল গ্যায়া তুমে। কওমে কাম আয়া তুমে। পাকিস্তানি হুকুমত কায়েম রাখনে কে লিয়ে... হামারে সাথ মুসলমান বাচ্চা পয়দা করোগে তুম। জরুর করোগি, করোগি না?

এই সংলাপের পরেই আমরা দেখি বিলকিস গ্রেনেডের পিন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। আকস্মিক গ্রেনেড হামলা করে সে নিজের ও দেশের সম্ভ্রব রক্ষা করে। গেরিলা আক্রমণের মতোই এই ছবির সংলাপও ধারালো, আকস্মিক এবং মোক্ষম। এটি অবশ্যই উল্লেখ্য যে উপন্যাসের ভাষা আর চলচ্চিত্রের ভাষা এক নয়। কুরোশাওয়া থেকে সত্যজিৎ সবাই সাহিত্য নির্ভর ছবিতেও মূল সাহিত্যকে ভেঙেছেন গড়েছেন নিজের মতো করে। এ ছবিতেও তা লক্ষ করি। শেষোক্ত সংলাপের সাথে মূল উপন্যাসের সংলাপের তুলনা করলেই ব্যাপারটি সুস্পষ্ট হবে। নিষিদ্ধ লোবানে সৈয়দ শামসুল হকের ভাষা, ‘আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খুঁটি মুসলান হবে, খোদার ওপর ঈমান রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানী হবে, চাও না সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, যারা হিন্দু নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানী রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবো।’’ নিঃসন্দেহে এই সাহিত্য ভাষার চেয়ে গেরিলা ছবির সংলাপকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত, মৌখিক করতে হয়েছে। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দূ মিলিয়ে এই ছবির সংলাপ যথার্থই সরস ও প্রাণবন্ত। তবে ‘হোয়াটস আপ বিচের’ মতো ইংরেজি সে সময় প্রচলিত ছিলো না বলেই জানি।

এই প্রাণবন্ত সংলাপগুলো শিল্পমার্গে পৌঁছে দিয়েছেন অভিনয় শিল্পীরা। মার্কিন পরিচালন জন ফ্রাঙ্কেনহাইমার (১৯৩০-২০০২) বলেছেন, Casting is 65 percent of directing। মিরানা জামান, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্পা রেজা, এটিএম শামসুজ্জামান এর মতো অভিজ্ঞ প্রবীণ অভিনেতাদের পাশাপাশি এই প্রজন্মের জয়া আহসান, শতাব্দী ওয়াদুদ, আজাদ আবুল কালাম, আহমেদ রুবেল এর মতো ঝানু অভিনেতাদের সম্মিলন পরিচালককে যথার্থই ৬৫ ভাগ এগিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে, প্রধানত এবং মূলত এই ছবির কেন্দ্র জুড়ে রয়েছেন জয়া আহসান। অভিমানী স্ত্রী, স্বামী হারা স্ত্রী, ভাই হারা বোন, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা এমনি কতো রূপেই না আমরা তাকে দেখেছি। আর্মি ক্লাবের লাস্যময়ী রূপ থেকে মৃত ভাইয়ের জন্যে হাহাকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সমুজ্জ্বল। আমাদের সময়ের এক বর্ণিল, সাহসী ও বলিষ্ট অভিনেত্রী তিনি। চরিত্রের উপস্থিতির মাপ দিয়ে অভিনেতার সাফল্য নির্ভর করে না। এ কথা প্রমাণ করেছেন শম্পা রেজা ও আজাদ আবুল কালাম। এই দুই মহান শিল্পীই স্বল্প উপস্থিতিই দেখিয়ে দিয়েছেন অভিনয় তাদের মজ্জাগত। বাধ্য হয়ে তসলিম সর্দারের গলায় ছুরি চালানোর পর নিজের হাতের দিকে তৈয়ব যে বিস্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে ছিলো তা বহুদিন মনে থাকবে দর্শকের। রাজাকার তৈয়ব চরিত্রে আজাদ আবুল কালাম নিঁখুত আর নিপুন। একই কথা বলা যায় ’৭০ এর অভিজাত শ্রেণীর মিসেস খান চিত্রায়ণে শম্পা রেজার ক্ষেত্রে। পরিশিলিত ইংরেজি উচ্চারণ আর দৃঢ় বাচন শৈলী তার চরিত্রকে দিয়েছে শৈল্পিক মাত্রা। মৃত্যু অবধারিত জেনেও যে করুণ মেকি হাসি তার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে তা অভিনয় শৈলীর চূড়ান্ত প্রকাশের নমুনা। ঢাকাইয়া সর্দার হিসাবে এটিএম শামসুজ্জামান অনবদ্য। তিনি নিজেকেই অতিক্রম করে যান বারবার। আহমেদ রুবেল ছাড়া আর কাউকে হয়তো আলতাফ মাহমুদ চরিত্রে ভাবাও দুষ্কর হবে। তার ভারী কণ্ঠস্বর আর ব্যক্তিত্ব এই চরিত্র উচ্চতা দান করেছে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে গেরিলা ছবিতে সবচেয়ে বেশি করে বলতে হয় শতাব্দী ওয়াদুদের কথা। এই অভিনেতা ছবিতে দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রথমে তিনি ঢাকার মেজর সরফরাজ। অত্যন্ত নাক উঁচু, অভিজাত, বাঙালি বিদ্বেষী এই চরিত্রে শতাব্দী যোগ্য অভিনেতা। দ্বিতীয় পর্বে হিটলারী গোফ অলা জলেশ্বরের সুবেদার শমসাদ চরিত্রে তিনি কিছুটা কমিকাল এবং টিপিক্যাল। ‘হোয়াটস ইউর নেইম স্টিংকি’, ‘আই কেন স্মেল ইউর রটেন’ ইত্যাদি সংলাপে ও ম্যানারিজমে তিনি যথেষ্ট বিকৃত ও বিভৎস। সাধারণ দর্শকের ঘৃণার পাত্র হয়েছেন সুবেদার শমসাদ আর অভিনেতা হিসাবে এটাই তার বড় প্রাপ্তি। অবশ্য একই অভিনেতাকে দুটি প্রধান চরিত্রে ব্যবহার করে কিছুটা দ্বিধার সৃষ্টি হয় শুরুতে। হয়তো পরিচালক সব পাকিস্তানি আর্মি অফিসারকে এক ছাঁচে দেখাতে চেয়েছেন, কিন্তু সেটি কি দুইজন আলাদা অভিনেতা ব্যবহার করেও দেখানো যেতো না। শতাব্দী অবশ্য উভয় চরিত্রেই সফল।

তবে এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো এর সময়োপযোগীতা। যখন পুরো দেশ জুড়ে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের দাবী উঠেছে তখন এই ছবির মুক্তির নতুন প্রজন্মকে নতুন করেই ভাবাবে। জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি, হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমনি ও আনিসুল হকের মা গ্রন্থে আমরা বাংলার অকুতোভয় গেরিলাদের কথা পড়েছি। একাধিক মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে মুক্তিবাহিনীর বীরত্ব গাথা দেখেছি। কিন্তু ‘গেরিলা’র মতো সাহসী করে কোন ছবিতেই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের চিত্র তুলে ধরা হয়নি। নাসির উদ্দিন ইউসুফ নিজের অভিজ্ঞতার জোড়েই এদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। দুধঅলা নগেশ কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের প্যান্ট খুলে হিন্দু কি মুসলাম দেখা, বোরখা না পড়ায় ময়না বেওয়াকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং রাজাকারের সংলাপ ‘এইটা কি তোমার ইন্ডিয়া পাইসো, যে শরীর চিতায়া রাখসো’ ইত্যাদির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল আছে। অন্যদিকে বহু মুক্তিযুদ্ধের ছবি হলেও সেখানে সরাসরি গোলাম আযমের নাম বা জামায়াত ইসলামের কথা বলা হয়নি। এ ছবিতে নাসির উদ্দিন ইউসুফ ব্যানার দেখিয়েছেন যেখানে লেখা, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, প্রচারে জামায়েত ইসলাম।’ স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির এই উন্মোচনের মাধ্যমে নাসির উদ্দিন ইউসুফ যে যোদ্ধা আবারও তা প্রমাণ করলেন। তিনি তুমুল সাহসিকতায় একাত্তরের জামায়েত ইসলাম, রাজাকার ও আল বদরদের নৃশংসতা তুলে এনেছেন।

ইতোমধ্যেই এই ছবি ১৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছে। বাংলাদেশ সরকার এ ছবির সকল কর মওকুফ করে দিয়েছেন। এই সবই গেরিলা তথা মুক্তিযুদ্ধের ছবির জন্যে বিশেষ সম্মান জনক। আমরা বিশ্বাস করি, বাঙালির সবচেয়ে বড় গৌরবময় যে অর্জন সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন বস্তুনিষ্ঠ চলচ্চিত্র আরও তৈরি হবে, এবং নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেদের তৈরি করবে।



তথ্যসূত্র :

১. বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : পাঁচ দশকের ইতিহাস - আব্দুল্লাহ জেয়াদ, জ্যোতিপ্রকাশ, ২০১২

২. স্মৃ তি: ১৯৭১ - সম্পাদনা রশীদ হায়দার, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৮

৩. বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্র“ধারা - রফিকুল ইসলাম, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৩

৪. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে - রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, অনন্যা, প্রথম অনন্যা সংস্করণ, ১৯৯৬

৫. নিষিদ্ধ লোবান - সৈয়দ শামসুল হক, অনন্যা, ১৯৯০

6. The Oxford History of World Cinema - edited by Geoffrey Nowell-Smith, Oxfrod University press 1996

7. Peter’s Quotations - Dr. Laurence J. Peter, Quill, William Morrow, New York, 1977



৮. কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবি ‘গেরিলা’ - দৈনিক প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি ২০১২



মন্তব্য ৭ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:২১

মামুণ বলেছেন: ভালো লাগা রইল ।

২| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:৩২

তানভীরসজিব বলেছেন: জয়ার অভিনয় অস্বাধারন এ ছবিতে । ধন্যবাদ লেখার জন্য ।

৩| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:৩৬

লিঙ্কনহুসাইন বলেছেন: অসাধারণ পোষ্ট । ধন্যবাদ

৪| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৪:০১

হাবিবউল্যাহ বলেছেন: দারুন লিখেছেন!

৫| ১০ ই এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ১:৫৭

মুবিনুর রহমান বলেছেন: লেখাটি ঝরঝরে, মেদহীন আর সাবলীল। আপনার গল্পলেখার হাতের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। গেরিলা সাম্প্রতিকতা বিবেচনায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরিচালকের কয়েকটি সবলতার পাশাপাশি দূর্বলতায় যে রয়েছে মুম ভাই। বেশ কিছু দৃশ্যে স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন আগুন লাগার দৃশ্য, বোমা ফাটার পর আগুন ইত্যাদি তৈরিতে দূর্বলতা ছিল। অনেক জায়গায় তা মেকি মনে হয়েছে। তারপরও এরকম একটি ছবি তৈরির জন্য নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও তা বিশ্লেষণ করে লেখার জন্য আপনাদের দুজনকেই অসংখ্য ধন্যবাদ।

৬| ১১ ই মে, ২০১২ রাত ১২:৫৪

মোহামমদ মশিউর রহমান বলেছেন: সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করার
লিনকটি দেখুনhttp://www.somewhereinblog.net/blog/parvezy/29593613/invite

৭| ১১ ই মে, ২০১২ রাত ১:০৫

ই লু শ ন বলেছেন: দারুণ লিখেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.