নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হোসেন মৌলুদ তেজো

লিখতে ভালোবাসি

হোসেন মৌলুদ তেজো › বিস্তারিত পোস্টঃ

হুজুরের দারবার এবং আবেদের রবিবার

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:০৮

আমরা তখনও জানতে পারি না যে, আমরা নিজেদের অগোচরেই উপেক্ষা করছি নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের কমজ্ঞান ভূলে নিমগ্ন থাকি ভ্রান্ত মৈথুণে। আমাদের সমস্খ ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে উদ্দেশ্যহীন অদৃশ্য গন্তব্যের যাত্রা। আমারা তখনও জানি না কি আমাদের ধর্ম, কি আমাদের কর্ম। কি আমাদের গন্থব্য, কোথায় আমাদের নোঙর। পাল তোলা নৌকার মতো পৃথিবী নামক অথৈ সাগরে আমরা আমাদের জীবন নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছি, যার পালে সময় নামক বাতাসের দোলা………..। আমরা একটু বোধের অভাবে উপেক্ষা করি প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অতঃপর সেই প্রজন্ম চিন্তায় যখন নৈরাশ্য আর ধ্বংষের ঘূণ বাসা বাধে, তখন আমরা হয়তো জাগি, হয়তো জাগিনা, কিন্তু এর কোনটাই আমাদের কাজে আসেনা……….।

হুজুরের এই মনভোলা বয়ানে আচ্ছন্ন হয়ে যায় সবাই। গ্রামের অদুরে এই মাজারে প্রতি রবিবার বসে বয়ানের আসর। পরকাল প্রত্যাশী ধমভীরু মানুষেরা এই বিশেষ দিনটাতে মাজারে আসে হুজুরের বয়ান শুনতে। জাগতিক সব প্রয়জোন আর মৈথুণ ভুলে নিমগ্ন হয় বয়ানে, যেন এই বয়ানই তাদের পরকালে তরী পারের একমাএ ভরসা। রাতভর নিমগ্ন ঋষির মতো এরা বয়ান শুনে আর হুজুরের কৃপা কামনা করে। আল্লাহু, আল্লাহু শব্দে ভারী হয়ে উঠে মাজারের চারপাশ। সে জিকিরের শব্দ বাতাস ভেদ করে, গাছে ফাঁক গলিয়ে গ্রামে ঢুকলে, গায়ের মা-ঝিরা আপসোস ভরা চোখে মাজারের মিট-মিট আলো দেখে আর তাদের চোখে-মুখে পুরুষ হতে না পারার হতাশা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তাদের কেউ কেউ আবার উদ্বিগ্ন চোখে বাড়ীর কর্তার জন্য বসে থাকে। কিন্তু ধ্যানমগ্ন ঐসব মানুষগুলো তখন দিব্যি ভূলে যায় তাদের সংসার, জীবন, যৌবন, আহার, পান, মৈথুণ…… তাদের শুধু ধ্যান আর ধ্যান। কিন্তু সেই একটা রাতই সার…. বাকি ছয়টা দিনের ভন্দামি, প্রতারণা আর নোংরামীর সনদ তারা এই রাতেই নিয়ে আসে। জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব ভূলে গিয়ে রতাভর বয়ান শুনে আর আল্লহু-আল্লহু জিকিরে গলা বসিয়ে সকালে বাড়ি ফেরার পথে খেয়া ঘাটের নৌকার র্টাকা না দেয়ার চিন্তাটাই মাথায় আসে সবার আগে…………। যারা সপ্তাহভর কাজকর্মে নমগ্ন থাকে, তারা এই একটা রাত গুছিয়ে রাখে পাপ মুচনের প্রত্যাশায়। হুজুরের বয়ানের মর্ম তারা বোঝতে পারে বলে মনে হয়না, তবুও হুজুরের লম্বা-সফেদ দাড়ী অদের অন্যরকম আকৃষ্ট করে, কেউ কেউ ওই দাড়ীতে নুরের ঝিলিক দেখতে পায়। কেউ কেউ বয়ানের একটু একটু বুঝে, কেউ কেউ কিছুই না বোঝে শুধু মাথা দোলায়। এদের মনে কখনও প্রশ্ন জাগেনা…… বেঁচে থাকা ছাড়া কি মানুষের অন্য কোন কাজ নেই? শুধুই কি এবাদতের জন্য মানুষের সৃষ্টি? জীবনের এই মর্ম উদ্দারের বিন্ধু মাএ চেষ্টা এদের মাঝে নেই, জীবন বলতে এরা বোঝে খাওয়া, কর্ম, আর স্থী মৈথণ। হুজুর এদের ভিতরের জীবনবোধকে জাগ্রত করতে চান না জীবনবধের অপমৃত্য ঘটান এটা তারা কখনও চিন্তাও করেনি।

সরাইল গাঁও নামের এই গ্রামটির পূবদিক বরাবর মাজারটা। গ্রাম থেকে মাজারে যেতে বেশ বড় একটা খেয়া পাড়ি দিতে হয়। তার জন্য আছে অসংখ্য খেয়া নৌকা। মাজারের হুজুর যেমন এই রবিবার দিনটার অপেক্ষায় থাকেন, খেয়াঘাটের মাঝিরাও তেমনি এই দিনটার জন্য অপেক্ষায় থাকে। প্রতি রবিবার মাজারের চারপাশ ভাল করে পরিস্কার করা হয়। গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ আসে হুজুরের বয়ান শুনতে। হুজুরও তার রাশভাড়ি কন্ঠে আচ্ছন্ন করে রাখেন মাজারের আগন্তুকদের আর আতরমাখা এইসব মানুষগুলো নির্দিধায়, গোগ্রাসে গিলতে থাকে বয়ান। কিছুক্ষণ পরপর সমস্বরে জিকির পড়ে- আল্লাহু, আল্লাহু……….। হুজুর সন্তুষ্টচিত্তে এদের দেখেন, তিনি কল্পনা করেন মাজারের লোক বাড়ছে, বাড়ছে মাজারের নজরানা। দূর দুরান্তের গ্রাম থেকে মানুষ আসছে, তিনি তার বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন আর সবাই মন্থমুগ্ধের মতো তা শুনে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে শুরু হয় প্রশ্নোত্তর-পর্ব। হুজুরের মুরিদরা তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা হুজুরের দরবারে পেশ করে, হুজুর তার যথাযথ উত্তর আর সমাধান দিতে থাকেন, সবাই সন্তুষ্টচিত্তে হুজুরের কথা মেনে নিয়ে হুজুরকে সালাম করে জিকিরে মেতে উঠে। বাহিরে খাবারের আয়োজন চলে, রাত বাড়ার সাথে সাথে দরবারের লোক কমতে থাকে। সবাই যার যার বাড়ীর পথে রওয়ানা করে, কেউ কেউ আবার দরবারেই রাত্রি যাপন করে। হুজুরের দোয়াপ্রাথীরা হুজুরের জন্য নজরানা রেখে যান, হুজুর তাদের দু-হাত ভরে ইহকাল আর পরকালিন শান্তি কামনা করেন।

সরাইল গ্রামের আর সবার মতো আবেদেরও হুজুরের দরবারের প্রতি প্রচন্ড টান। প্রতি রবিবার রাত সে হুজুরের দরবারে কাটায়। গ্রামের এক পাশে পৈত্রিক ভিটায় তার ছনের ছাউনি আর বাঁশের বেড়ার ঘরে সে, তার বউ আর তার আট বছরের মেয়ের বসবাস। প্রতি রবিবার সে হুজুরের দরবারে একটা ছেলের জন্য আরতি করে আর একটা আরতি অবশ্য তার আছে যদিও সেটা সে প্রকাশ করেনা। তার বিশ্বাস হুজুরের দরবারের উছিলায় সে কোন অলৌকিক সম্পদের মালিক হয়ে যেতে পারে। তবে, আজ এতো বছর ধরে না পেলেও সে হাল ছাড়ে না। কারণ হুজুরের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস……. তার মনবাসনা পূরন না হওয়ার জন্য বরং সে নিজেকেই দায়ী করে। সে ভেবে নেয় নিস্চয়ই তার কোন অজানা পাপ আছে…… কোন ভূল আছে। তবে সে বিশ্বাস করে হুজুরের দুয়া থাকলে একদিন তার বাসনা পূরন হবেই। সে বিশ্বাস করে হুজুরের দারবার থেকে কেউ খালি হাতে ফেরে না। তাই আর সবার মতো প্রতি রবিবার সো চলে আসে হুজুরের দশণ লাভের জন্য। আল্লাহু, আল্লাহু জিকিরে ভারী করে তুলে মাজারের পরিবেশ। হুজুর এসে তার মাথায় হাত রাখেন, আনন্দে সে কেঁদে ফেলে হুজুরের কৃপা হয়েছে এই ভেবে। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়, তার জিকিরের গতি বেড়ে যায়। ওইদিন অনেক রাত করে সে বাড়ি ফেরে……… তার স্থী আর মেয়ে তখন গভীর ঘূমে অচেতন, সেও তাদের পাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। তার চোখে-মুখে রাজ্যের তৃপ্তি, সে তার স্থীর দিকে তাকায়। সে মনে মনে ভাবে আজ তার মাথায় হুজুরের হাতের স্পর্ষ পরেছে…… তার আজকের মৈথুণ বৃথা যেতে পারে না, ছেলে তার চাই। সে তার স্থীকে তার দিকে ফেরায়…… আকাশের অষ্টাদশী চাঁদের আলো তখন মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলে।

আজ কয়েকটা দিন হলো আবেদের মনটা ভালো নাই। এখন ফাল্গুন মাস, কার বাড়িতে কোন কাজ নেই…… আর কাজ নেইতো ভাতও নেই। দু-বেলা ঠিকমতো খাবারও জোগার করতে পারছে না সে। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা সে। ঘরের কয়েকটা সিদ্ধ চাল আর সিদ্ধ কচু দিয়ে চলছে কয়েকটা দিন। মেয়েটা ক্ষিদের জ্বালায় ছটফট করে আবেদের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই……. যতো ব্যস্ততা সবই যেন তার স্থীর। সে তার স্থীর তলপেট ভালো করে পরখ করে, কিন্তু কোন পরিবতন তার চোখে পড়েনা। তার মেজাজটা আরও খারাপ হয়ে যায়, সে একটা নাসির বিড়ি টানতে, টানতে হাটের দিকে রওয়ানা দেয়। অনেক রাত করে সে বাড়ী ফেরে……. খালি হাতেই। তার স্থী তাকে কিছুই বলার সাহস পায়না, নিয়তির কাছে সবাই হারে…… কিন্তু সে করেছে আত্মসমপণ। আবেদ রাতে ঘুমানর সময় তার স্থীকে জানায় যে সে চিন্তা করছে আহামি পুরো-সাপ্তাহ সে হুজিরের দরবারে কাটাবে, প্রাথনা করবে, হুজুরের কৃপা কামনা করবে। আবেদের স্থী কিছুই বলেনা…. শুধু নিশ্চুপ হয়ে শুনে যায়।

পরের রবিবার সন্ধ্যার দিকে আবেদ দরবারে যায়, অন্যদিনের মতো বয়ান শুনে, জিকির পড়ে, হুজুরের সেবা করে। তবে সে রাতে সে আর বাড়ি ফেরেনা। পরেরদিন দুপুরের সময় হুজুরের পা পরিষ্কার করার সময় সে হুজুরের কাছে তার মনের বাসনা ব্যক্ত করে…… একটা ছেলের জন্য তার মনের হাহাকের সে হুজুরের কাছে পেশ করে। হুজুর তাকে আশ্বস্ত করেন, বলেন তিনি দোয়া করে দিবেন, কাজ হয়ে যাবে। আবেদ খুশি হয়ে আরো যত্ন করে হুজুরের পা পরিষ্কার করে দেয়, হুজুরের উচ্ছিষ্ট খাবার সে গলাধঃকরন করে। সে দিব্যি ভূলে যায় তার স্থী, ত্যার মেয়ের কথা, তার চিন্তায় শুধু অলৌকিক কিছুর নেশা, আনন্দে হুজুরের দোয়া কামনা। সে অহনিশ হুজুরের সেবা করে যায়……. ভাগ্য উন্ননের নেশায়। কিন্তু সে জানতেও পারেনা যে, তার অগচরেই তারই পদতলে পিষ্ট হয় তার প্রজন্ম। শুধু কচু সিদ্ধ আর সিদ্ধ ভাত খেয়ে আবেদের মেয়ের পেতে ব্যাথা ধরে। প্রথম দিকে আবেদের স্থী গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু দিনকে দিন ব্যাথা বেড়েই চলে। ওদিকে আবার আবেদ এক সপ্তাহের জন্য হুজুরের দরবারে, তাকে ডাকাও যাবেনা। দিনে তাও গরম তেল দিয়ে ব্যথা কিছুটা কমানো যায়, কিন্তু রাতে তা অসয্য আকার ধারন করে। আবেদের মেয়েটা ব্যথায় ডুকরে ওঠে, কিন্তু কিছুই বলতে পারেনা। একটু একটু শব্ধ করে, কাদতেও পারে না, মার বকুনি খাওয়ার ভয়ে। আর আবেদের স্থী কিছুই বুজে উঠতে পারেনা কি করবে। আবেদকে দুইবার লোক পাঠিয়ে খবর দেয়া হয়েছে কিন্তু সে বলেছে, সে দরাবার ছেড়ে সে একন আসতে পারবেনা।

আজ রবিবার। আজ দরবারের তফসিলের দিন। আজ আবার মাজারে লোকসমাগম হবে হুজুরের রয়ান শুনার জন্য। যতারীতি হুজুরের বয়ান শুরু হয়….. আল্লাহু, আল্লহু জিকিরে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। গ্রামের একজন আবেদকে খবর দেয় যে তার মেয়ের অবস্থা খারাপ, সে এটা তেমন গুরুত্ব দেয় বলে মনে হয়না। হুজুরের কাছে দোয়া প্রাথনা করে সে আবার নিমগ্ন হয়ে যায়…… হুজুরের উপর মেয়ের ভার ছেড়ে দিয়ে যেন সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। হুজুর আশ্বাস দেন কিচ্ছু হবেনা। ওইদিকে আবেদের মেয়ের ব্যথা বাড়তেই থাকে…… মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে সে ব্যাথায় চিৎকার করতে থাকে আর আবেদের স্থী কিংকতব্যবিমূঢ়ের মতো শুধু দরজায় এপাশ-ওপাশ করেন। তার চিৎকার কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারেনা। সে দেক্তে পায় দূরে মাজারে মিট-মিট করে আলো জ্বলছে…… সে আলোয় আবেদ আল্লাহু, আল্লহু বলে সবশক্তি দিয়ে জিকির পড়ে, যেন আল্লাহকে সে আজ মাটিতে নামিয়ে আনবেই। কিন্তু সে তখনও বুঝতে পারে না যে, ব্যথ্যাতুর, এক নিষ্পাপ মেয়ের কষ্টের চিৎকার, এক মায়ের কিংকতব্যবিমূঢ়তাকে উপেক্ষা করে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দিতে পারেননা। এই মেয়েকে ব্যাথ্যা থেকে মুক্তি নে দিয়ে তিনি তার মুখোমুখি হতে পারেন না।

লেখকঃ হোসেন মৌলুদ তেজো
বইঃ অপ্রকাশিত।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:০৯

রাজীব নুর বলেছেন: পীর ফকির দরবার এসবের প্রতি কোনো দিনই আমার বিশ্বাস জন্মালো না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.