![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আদিবাসী সমাজে ‘অন্তর্ঘাত’ কেন,
জবাব দিতে হবে শিবু, অর্জুনদেরই
মৃণালকান্তি দাস
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শিবু সোরেন কেমন?
—জবাব নেই।
অর্জুন মুন্ডাদের দলের অবস্থা এখন কেমন?
—এবারেও কোনো জবাব নেই।
এবারে লোকসভা ভোটে...
—কথা থামিয়ে বললেন, ‘গরিব জনতা কো আমির সরকার... ছোটে ছোটে কিষাণ কো মুদ্দা বানা দিয়া হ্যায়’।
দু’চার কথার ফাঁকেই মুখ খুলেছিলেন কিষাণ মাহাতো। পঞ্চাশোর্ধ মলিন মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় রাঁচি স্টেশনে। কলকাতা যাবেন। কাজের খোঁজে। ঝাড়খণ্ডের মাটি ছুঁয়েই কিষাণ মাহাতোর কথায় এই ‘আদিবাসী প্রধান’ রাজ্যের হালহকিকৎ খানিক টের পেয়েছিলাম বটে।
হ্যাঁ, এটাই প্রকৃত ভারতবর্ষ।
যেখানে বিপুল আদিবাসী মানুষের জীবন কাটে দারিদ্রসীমার নীচে। তাদের জীবনযাপনের দু:সহ প্রয়াস, তাদেরই শ্রম আর জীবনীশক্তি নি:শেষে নিংড়ে বিত্তবান শ্রেণীর প্রাচুর্যে স্ফীতকায় হয়ে ওঠে। সরকার নামক এক হৃদয়হীন অচলায়তনের একটানা পাশবিকতা, পরিকল্পনা আর প্রকল্পের নামে দরিদ্র মানুষকে আরো বহুমাত্রিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত করে তোলে।
হ্যাঁ, এটাই প্রকৃত ভারতবর্ষ।
যেখানে ত্রাণ আর পুনর্বাসনের নামে দরিদ্রতম জনসংখ্যার দুর্দশাকে বাহারি পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খরাত্রাণকে যেখানে বলা হয় ‘দ্রুত বিকাশমান শিল্প’। গ্রামে এই ত্রাণই আবার তখন ‘তিসরা ফসল’।
ব্রিটিশ উপনিবেশের কাল থেকেই আত্মশাসনের দাবিতে যে বৃহত্তর আন্দোলনের শুরু, যার শীর্ষবিন্দু রূপে আজও ইতিহাস চিহ্নিত হয়ে আছে সিদো-কানহুর ‘হুল’, বিরশা মুণ্ডার ‘উলগুলান’, তিলকা মাঝির বিদ্রোহ। সেইসব আন্দোলনই ছিলো হারানো অরণ্য, নদী আর আকাশের অধিকার ফিরে পাওয়ার, আদিবাসী সমাজের ক্ষীয়মাণ সংহতি পুনরুদ্ধার করার এবং আদিবাসী সংস্কৃতির ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন। তার বর্শামুখ ছিল শোষক-উৎপীড়ক হিন্দু মহাজন, বহিরাগত জবরদখলকারী ভূস্বামী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ প্রশাসনের দিকে নিবদ্ধ। ঔপনিবেশিকতার অবসানেও সেই আদিবাসী শোষণ বা আত্মপরিচয়ের সংকট কাটলো না। এমনকি ছোটনাগপুর ও সাঁওতাল পরগণার আদিবাসী প্রধান জেলাগুলি নিয়ে ঝাড়খণ্ড গঠনের আট বছর পরেও।
সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা হতদরিদ্র আদিবাসী মানুষদের সামাজিক স্বীকৃতি দিতে যে ঝাড়খণ্ডের পত্তন হয়েছিলো, সেই রাজ্যেই গত কয়েক দশকে উচ্ছেদ হয়েছেন অন্তত দশ লক্ষ আদিবাসী। রাজ্যভাগ করে অন্তত কোনো সমস্যার সমাধান হয় না, আট বছর আগেই সেকথা শুনিয়েছিলো সি পি আই (এম)। তীব্র বিরোধিতাও করেছিলো বামপন্থীরা। শোনেনি কেন্দ্রের সরকার। ইতিহাস তো বরাবরই অনিবার্যতার সঙ্গেই আপোষ করেছে। বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড হয়েছে। আর অরণ্যের অধিকার হারিয়ে উচ্ছেদ হয়েছে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী। ঘর ভাঙা, জঙ্গল থেকে উচ্ছেদে মিলেছে সরকারী প্রশাসনের পূর্ণ সমর্থন। বেড়েছে কেন্দুপাতা মাফিয়া, খনি মাফিয়া, টিম্বার মাফিয়াদের অবাধ গতিবিধি। মাওবাদী হিংসাও।
আট বছরে ছ’বার সরকার বদল। সরকার গড়ার প্রক্রিয়ায় সে তো একের পর এক উলাট পুরাণের গল্প। মসনদের গদির জন্য দড়ি টানাটানির গল্প শেষে এখন রাষ্ট্রপতি শাসন। অন্যান্য রাজ্যের রাজনীতির সঙ্গে এরাজ্যের রাজনীতির ফারাক কই?
সেই পরিচিত দলবাজি, সেই দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, যোগ্যতা নির্বিশেষে পরিবারের সকলকে ভোটের টিকিট পাইয়ে দেওয়া, সমর্থনের বিনিময়ে দর হাঁকা, বেচাকেনার হাটে নিজেকে সওদা করতে বেরোনো। এই গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা একান্ত ভাবেই এদেশের উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের দলগুলোর। যা দীর্ঘকাল ধরে জাতীয় দলগুলি এদেশে অনুশীলন করে এসেছে। এখন তো ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী নেতারাও দিব্যি তা-ই করছেন।
ঝাড়খণ্ডে কে রাজা? শিবু সোরেন, না অর্জুন মুন্ডা, নাকি অন্য কেউ। সে তো এখন পুরাণ কথার পাদটীকা মাত্র। কুশীলব হিসেবে তাঁরা ছাড়াও মারান্ডি, এক্কা, মাহাতো, মাঝি প্রমুখ রয়েছেন বটে, তবে তাঁরা নিতান্তই পুতুল। তাঁদের সুতো ধরা রয়েছে অর্জুন সিং, সুবোধকান্ত সহায়, অরুণ জেঠলি, রাজনাথ সিং, সোনিয়া গান্ধী কিংবা লালকৃষ্ণ আদবানিদের হাতে। অর্থাৎ আদিবাসী স্বার্থে গঠিত ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের ভাগ্য আর আদিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তা নিয়ন্ত্রণ করছেন সেই উচ্চবর্গীয়রা, সেই বহিরাগত ‘দিকু’রাই, যাঁরা এতো কাল শোষণ আর বঞ্চনায় আদিবাসীদের স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিলেন। আর আদিবাসী নেতা শিবু সোরেন বা অর্জুন মুণ্ডা, বাবুলাল বা স্টিফেন মারান্ডিরা এখন যে রাজনীতির পরিভাষা ব্যবহার করছেন, তা-ও উত্তরোত্তর হিন্দি বলয়ের রাজনৈতিক ভাষারই প্রতিধ্বনি। আসলে এ হলো জাতীয় রাজনীতিতে প্রান্তিক আদিবাসী সমাজের প্রতি অন্তর্ঘাত।
জয়পাল সিংয়ের নেতৃত্বে গঠিত ঝাড়খণ্ড পার্টি ১৯৪৯-এর নির্বাচনে আদিবাসী জেলাগুলির অধিকাংশ আসন দখল করে। গোটা পঞ্চাশের দশক ধরে বিহারের বৃহত্তম দল ছিলো ঝাড়খণ্ড পার্টি। তবুও জয়পাল সিংয়ের দাবি মেনে স্বতন্ত্র ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠন করেনি দিল্লির শাসকরা। উলটে ১৯৬৩সালে জয়পাল সিংকেই কংগ্রেস সদলে গ্রাস করে নেয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ঝাড়খণ্ড আন্দোলন। এরপর নতুন করে আন্দোলন সংহত হতে হতে তার বিভাজনও বাড়তে থাকে। নেতাদের ব্যক্তিগত অহমিকা এবং কর্তৃত্বপরায়ণতা উপদলীয় কোন্দলের জন্ম দেয়। আন্দোলনে উচ্চবর্গীয় দিকুদের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। পৃথক রাজ্য হাসিল করার সময় দেখা গেলো, ততদিনে গোটা আন্দোলনই বিজেপি, কংগ্রেসের পেটে।
একা শিবু সোরেন তাঁর ‘মুক্তি মোর্চা’ নিয়ে আদিবাসীর স্বাধিকারের পুরনো ঐতিহ্যের অবশেষ বয়ে বেড়াচ্ছেন বটে, তবে জয়পাল সিংয়ের মতো তিনিও কংগ্রেসের অনুগত থেকেই নিজের আত্মপরিচয় টিকিয়ে রেখেছেন। এ জন্য কখনও তাঁকে লোকসভায় নরসিমা রাও সরকারের গরিষ্ঠতা বজায় রাখতে কংগ্রেসকে আস্থা ভোটে জেতাতে হয়, কখনও মনমোহন সিং সরকারের শরিক হয়ে রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাধতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় শিবু সোরেনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার কংগ্রেসায়ন যেমন হয়েছে, তেমনই ধূলিসাৎ হয়েছে ‘গুরুজি’র মহিমা। আদিবাসী সমাজে হারিয়ে গেছে শিবু সোরেনের বিশ্বাসযোগ্যতা। তাঁর শিষ্যপ্রবররা আগেই সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের আদিবাসী আত্মপরিচয় খুইয়েছেন। ধনুর্বাণ তো আগেই ফেলে দিয়েছেন তাঁরা।
রাজ্যভাগের এ কি মহিমা !
সেই যে হাসতে হাসতে কিষাণ মাহাতো বলে গেলেন, ‘এ রাজ্যে আদিবাসী, গরিব মানুষরা জানোয়ারের মতোই বেঁচে আছে। ভোটওয়ালারাও জানেন। সবই শরীর যেন সয়ে গেছে’।
রাঁচি স্টেশনের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকেছি বহুক্ষণ। ভাবছি, এই হাসি বোধহয় কান্নার চেয়েও অনেক বেশি অর্থবহ।
©somewhere in net ltd.