![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার মত আমার জীবন, আমি জীবনকে লালিত করি । জীবন সে তো কাগজের নৌকা ।
এক অর্থে সকল অভিব্যক্তি, বিশেষভাবে যাকে আমরা শৈল্পিক অভিব্যক্তি বলি তা মূলত মাধ্যম থেকে মাধ্যমান্তরের অনুবাদ বা তর্জমা-করণ বৈ কিছু নয়। শিল্পী যদি লেখক হন তবে তিনি তার ভাব পদানুপদিক বা শব্দঘটিত অভিব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেন; বা যদি হন চলচ্চিত্রকার তবে শ্রুতিচিত্রের মাধ্যমে তা প্রকাশ করে থাকেন; ভাস্করের বেলায় ঘটে ঐক্ষিক ও যথাসম্ভব স্পর্শগ্রাহ্য অভিব্যক্তির মাধ্যমে; অথবা সঙ্গীত আয়োজকের ক্ষেত্রে বিষয়টি রূপ নেয় শ্রাবণিক ও (হয়তোবা) বাচনিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে… মিডিয়ামের অনুবাদের ইত্যাকার আরো নানা দৃষ্টান্ত টানা যায়। তাৎক্ষণিকভাবে আমি অন্যান্য নির্দিষ্ট শ্রেণির শিল্পীদের কথাউদাহরণস্বরূপ বলতে পারতাম (যেমন চিত্রকর, চিত্রনাট্যকার এবং মৃৎশিল্পী), কিন্তু আমি মনে করি আমি যা বলতে চাইছি তা পরিষ্কার_সকল শিল্প যা আমি এবং আমরা সৃজনীকর্ম হিসাবে পরিগণন করি, তা মূলত অবস্থানগত(স)ঠিক দৃষ্টির প্রেক্ষিতে একপ্রকার অনুবাদ-ক্রিয়া। শৈল্পিক আঙ্গিকে অনুভূতি ব্যক্ত করা হল তর্জমা কর্মের সৃষ্টিশীল দিক, যদি শৈল্পিক অভিব্যক্তিকে আমরা মাত্র যা বললাম সে অনুযায়ী বিবেচনা করি তবে(শুধু)অনুবাদকর্মকে স্বপ্রাণতার সাথে দক্ষতা ও সুরুচি সহকারে সাধিত শিল্পসুলভ সৃষ্টি বলা বাহুল্য নয় নিশ্চয়।
স্বভাবতই আমি অনুবাদ-ক্রিয়ার সৃজনীদিকটির উপর জোর দিতে চাই, যেটার সংজ্ঞা কি না আবার প্রচলিত অভিধানেও অনুপস্থিত! আধুনিক ইংরেজি অভিধানে ‘অনুবাদ’-র তিনপ্রকার সংজ্ঞা দেখতে পাওয়া যায়, যেমন:
১। এক ভাষা হতে অন্য ভাষায় ভাষান্তর
২। অবয়ব, হাল, প্রকৃতি-র পরিবর্তন
৩। সহজ পরিভাষায় ব্যাখ্যাকরণ
শেষ সংজ্ঞাটি আমার ধর্তব্যের মধ্যে পড়ছে না বিধায় আমি তা বর্জন করছি, কেননা আমি অনুবাদের উদ্দেশ্য সহজ ভাষায় ‘প্রকাশ-প্রকল্প’ বলে মনে করি না… প্রথম সংজ্ঞাটি অর্থাৎ এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় ভাষান্তর সম্ভবত অনুবাদের সবচেয়ে পরিষ্কার তরজমা এবং আমার মনেও এটা প্রথম কড়া নেড়েছে। এটা ঐরকমের অনুবাদ যা রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ সালে ইংরেজিতে গীতাঞ্জলী প্রকাশকল্পে করেছিলেন, সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন পরের বছর তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এহেতু। তবে, অনুবাদের দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি (অবয়ব, হাল, প্রকৃতি-র পরিবর্তন) আমি বক্ষ্যমাণ আলোচনার শিরোনামে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছি। দ্বিতীয় সংজ্ঞাটির ব্যাখ্যা হেতু আমরা আবার ফিরে যাব ঠাকুরের কাছে।
১৮৯২ সনে তিনি চিত্রাঙ্গদা নামে একটি নাটক রচনা করেন, যা চার দশক পর নাটক চিত্রাঙ্গদার অবয়ব, হাল, প্রকৃতি-র পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদারূপে অনূদিত হয়। কেউ হয়তো তর্কের খাতিরে বলতেই পারেন মূল চিত্রাঙ্গদাও (১৮৯২) অনুবাদের ২য় সংজ্ঞার আওতাভুক্ত যেহেতু কিনা এটি মহাভারতের কাহিনী হতে উৎসারিত…তা বটে; এটি কমবেশি প্রতীয়মান যে ঠাকুরের কিছু নাটক মহাভারতের কাহিনী দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই সৃষ্টিশীল কাজগুলি যেকোনো উপায়েই ২য় সংজ্ঞাটিকে সমর্থন করে। এক্ষণে, এটা বললে অত্যুক্তি হয় না যে, গত কালে সৃজিত কর্ম থেকে পরিবর্তন প্রবাহের মধ্যে দিয়ে উত্তরকালে ভবিষ্যৎ(রূপ) নির্মিত হয়। তদুপরি, পূর্বে উদ্ধৃত যাবতীয় অনুবাদকর্ম একপক্ষে মৌলিক কর্ম, অন্যপক্ষে ব্যুৎপত্তিগত নিদর্শন।
এ প্রসঙ্গে আরো বলা যায় ঠাকুরের ছোটগল্প নষ্টনীড় (১৯০১) এবং সেলুলয়েডে চারুলতা (১৯৬৫) শিরোনামে সত্যজিৎ রায় অনূদিত সংস্করণের কথা।
অদ্য আমি ঠাকুর এবং রায়ের শেষোক্ত কাজ দু’টির প্রশ্নে তিনটি বিশেষ অংশের উপর আলোক নিক্ষেপ করতে চাই_প্রথমত: উভয় শিল্পকর্মের আত্মজৈবনিক/জৈবনিক প্রকৃতি এবং (প্রকৃত) ঘটনার অস্তিত্ব বা বাস্তবতা মেনে নিতে রায়ের অনুবাদ কীভাবে আমাদের বাধ্য করে; দ্বিতীয়ত: সৃজনশিল্পী রায় কীভাবে চিত্রকল্পের ফ্রেমে, কখনো শব্দের সহচরে বা অনুপস্থিতিতে ঠাকুরের বাচনিক প্রয়াসকে বন্দী করলেন; এবং তৃতীয়ত: দিনশেষে কোন শৈলীগত পন্থা হেতু ছোটগল্প এবং সিনেমা উভয়ের মূলসুরে ঠাকুরের অ্যাপোলজিয়া স্ফুটিত হয়।
উপস্থিত অবাঙ্গালীদের মধ্যে যারা ঠাকুরের এই গল্প সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন না তাদের জ্ঞাতার্থে আমি একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি। এটি সবে একুশে পা ফেলা চারুলতার গল্প, যে বালিকাবধূরূপে দশ কি পনের বছরের জ্যেষ্ঠ (স্বামী) ভূপতির গৃহে বৎসর কালাধিক আগে প্রবেশ করেছে। স্বামীর সংসারে চারুলতা শারীরিক ও মানসিক গঠনে পরিপক্বতা লাভ করে, যদিও ভূপতির সদয় উপেক্ষা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভূপতি নিজের ধান্ধায় আন্ধা থাকত, তার একমাত্র আগ্রাসী স্পৃহা ছিল ঔপনিবেশিক কলকাতায় ইংরেজি বুলিতে দৈনিক রাজনৈতিক সন্দেশ প্রকাশ করা। ভূপতির চলনে-বলনে মনে হয় তার বউ যেনবা ঘরে থাকে না বরং বিস্মরণের নদীতে কেলি করে দিনমান! (যেন) সে প্রায় বিস্মৃত তার স্ত্রীর উপস্থিতির প্রশ্নে!
আর এমন মুহূর্ত থেকেই গল্পের চাকা সচল হয়।
ঐ বাড়িতে আর ছিল লেখক হয়ে উঠার মহাপ্রাণতায় বিভোর কলেজ পড়ুয়া ভূপতির কাকাত ভাই অমল। চারু এবং অমল প্রায় সমবয়সী ও তারা ভূপতির তুলনায় পরস্পরের নিকট ভাবাপন্ন। এই নিকট সমসাময়িকদ্বয় পরস্পরের সাথে যেমন ভাই-বোনের মত সহজ ছিল, তেমনি সম মনন-মানসিকতা বা তদানীন্তন কলকাতার সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপারে উত্তেজিত-অভিভূত তরুণ কৌতূহলী পাঠকের মত পারস্পরিক বান্ধবের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো অন্দরসজ্জায় চারুলতার বসবাস হলেও উচ্চবংশীয় অভিজাত পরিবারের লোকাচারের দরুন বাইরের পৃথিবীর আলো-বাতাস যেখানে প্রবেশের ফাঁকটুকুন পেত না সেথায় ঠাকুরপো অমল যেন বাইরের দুনিয়াকে প্রাতিনিধিকভাবে চারুর ঘরে এনে হাজির করে, যা চারুর নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুমাত্রায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে বৈ কি! সম্ভাব্য ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পাঠকের মনে মনে এটি সহজবোধ্য হয় যে বৌঠানের সাথে অমলের বোঝাপড়া হয়তো আবেগের সীমানা পেরিয়ে সম্পর্কের নিষিদ্ধ কাঁটাতারে জড়িয়ে পড়ার ইশারা দিচ্ছে। যাহোক, অমল নিজেকে প্রত্যাহার করে; চারু ভাঙ্গা হৃদয়ে বিধ্বস্ত_একা রয়ে যায়; ভূপতি বিষণ্ন বদনে বিশ্বাসঘাতক মিছরির পরশ অনুভব করে। আর এভাবেই গল্পটি ফুরোয়…।
সাহিত্য থেকে রবি ঠাকুরের জীবনের দিকে নজর ফেরালে আমরা এই গল্পের মত ঠাকুরবাড়িতে কিছু প্রাসঙ্গিক ঘটনার বাতাবরণ দেখতে পাই; আমি সংক্ষেপে কিছু নির্বাচিত ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরছি।
রবীন্দ্রনাথের অন্যতম জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী পরিচয়ে বালিকা বধূ কাদম্বরী দেবীর বর্ধিষ্ণু ঠাকুরবাড়িতে আগমন ঘটে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতামাতার জীবিত সন্তানদের মধ্যে চৌদ্দতম এবং সর্বকনিষ্ঠ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর চেয়ে বয়সে বছর পনেরর বড়। কাদম্বরী দেবী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিঠাপিঠি বয়সের ছিলেন, এ সম্পর্কে ঠাকুরের সবচেয়ে প্রামাণিক জীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায় লেখেন: “বিয়ের পর থেকেই তারা পরস্পরের খেলার সাথী এবং সহচরে পরিণত হয়।”[১] ১৮৮৩ সনের ৯ ডিসেম্বর বাইশ বছরের রবি ঠাকুর এগার বছরের এক বালিকার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, পরে যার নাম দেন মৃণালিনী। মৃণালিনী-ঠাকুর দম্পতি সুখের সাথে জীবন অতিবাহিত করেন, ১৯০২ সনে মৃণালিনীর অকালিক মৃত্যুর আখেরি দম পর্যন্ত। জীবনীকার মুখোপাধ্যায় বাবুর ভাষায় ১৮৮৩ সনে ঠাকুরের বিয়েটা “আচমকা এবং অপ্রত্যাশিতভাবে’ ঘটে।”[২] সেই বছর ঠাকুর এবং মৃণালিনীর বিয়ের মাস চারেকের মাথায় এপ্রিলের শেষে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন; কেন তিনি তার জীবন হনন করলেন তা যদি পরিজনদের জানাও থাকে তবুও তা কখনোই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু নিয়ে জীবনীকার মুখোপাধ্যায় বাবু লেখেন, “কারণটি রহস্যের আচ্ছাদনে অবগুণ্ঠিত। কিন্তু হেথায় যে কতিপয় পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ ছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।”[৩]
কাদম্বরী দেবীর প্রয়াণ ঠাকুরকে যে প্রগাঢ়ভাবে নাড়া দিয়ে যায় তা ক্ষণকাল বাদে নির্দ্বিধায় তার জবানে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯১৭ সনে অমিয় চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে লেখেন,“একদা, যখন আমি তোমার বয়সী ছিলাম, আমিও তোমার ন্যায় বিধ্বস্তকর শোকের ভোগান্তি সয়েছি। আমার অতি ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় আত্মহত্যা করেন, যিনি আমার কৈশোরকাল থেকে পরবর্তী জীবনে সার্বিক সমর্থন যুগিয়ে গেছেন। তাই তাঁর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুসংবাদ যেন আমার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরিয়ে দিলো, একইরূপে আমার আকাশ যেন ঢাকা পড়লো আঁধার কালো মেঘে। আমার বিশ্ব যেন অসীম শূন্যতায় ধৃত হল, জীবনের যাবতীয় উচ্ছ্বাস কোথায় জানি মিলিয়ে গেল।”[৪]
ঠাকুর বিরচিত অসংখ্য কবিতায় কাদম্বরী দেবীর প্রাণবিয়োগের বিষয়টি ঘুরে-ফিরে এসেছে। বৌঠানের প্রাণত্যাগের কিয়ৎকাল বাদে কুড়ির কোঠায় বাস করা ঠাকুর লিখলেন ‘কোথায়’ কবিতাটি, সেখান থেকে আমি নির্বাচিত অংশ তুলে ধরছি-
‘হায়, কোথা যাবে!
অনন্ত অজানা দেশে, নিতান্ত যে একা তুমি!
পথ কোথা পাবে!
হায়, কোথা যাবে!
মোরা কেহ সাথে রহিব না,
মোরা কেহ কথা কহিব না।
মোরা বসে কাঁদিব হেথায়,
শূন্যে চেয়ে ডাকিব তোমায়;
মহা সে বিজন মাঝে হয়তো বিলাপধ্বনি
মাঝে মাঝে শুনিবার পাবে,
হায়, কোথা যাবে!’[৫]
১৯১৯ সনে সবুজপত্র পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত ও পরে ‘লিপিকা’ (১৯২২) রচনা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত ‘প্রথম শোক’ শিরোনামে কবিতাটিতেও লক্ষ্য করা যায় ‘কোথায়’-এর মত কথামালা। এই কবিতাগুলিতে বারেবারে এক নারীর কথা ফিরে ফিরে ঘুরে আসতে থাকে। সেই নারী যাকে স্বয়ং ঠাকুর ‘সতের বছর’ কবিতায় খুঁজে ফিরছেন। এই সতের বছর কি কাদম্বরী দেবীর বালিকা-বধূরূপে ঠাকুরবাড়িতে আগমনের কালকে নির্দেশ করে, নাকি আগমন পরবর্তী আত্মহনন-এর পূর্ব পর্যন্ত অতিবাহিত কালকে!
এই প্রশ্নের একটি আংশিক উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় রবি ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ নামক ছোটগল্পে; যেটি সাধারণত পিরিয়ড পিস বা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বদা পাঠ করা হয়, তথাপি এটি বাস্তব জীবনের একটি ক্রান্তিকালকে চিহ্নিত করে – যার মধ্যে রোপিত আছে বাস্তব চরিত্র ও ঘটনাপ্রবাহ। অতি অবশ্যই বাস্তব ঘটনা ও কল্পনা-সঞ্জাত কাহিনীর মাঝে খাপ খাওয়াতে কিছু অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে।
যেমন-
(স্বাভাবিকভাবেই) নামগুলি পালটে ফেলা হয়েছে; পারিবারিক সম্পর্কের গ্রন্থিগুলি ভিন্নরূপে বিন্যস্ত; ‘নষ্টনীড়’ ছোটগল্পে ভূপতি চরিত্রটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও অমলকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিমূর্তি বলা যায় এবং তারা সম্পর্কে কাকাতো ভাই, বাস্তব জীবনের ন্যায় সহোদর নয়… এরকম আরো অনেক পার্থক্য গল্পজুড়ে ছড়িয়ে আছে কিন্তু একটি প্রশ্নও জেগে উঠে: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এবং কাদম্বরীর জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনাগুলি কেন্দ্র করে গড়ে উঠা গল্পকে কেন আমরা ঐতিহাসিক বাতাবরণের ঘেরাটোপে পাঠ করি বা করে থাকি! এই প্রশ্নের সবচাইতে অনাড়ম্বর উত্তর হলো সত্যজিৎ রায় চারুলতায় এমন ঢংয়েই আমাদের নষ্টনীড় দেখিয়েছেন। একবার যে সিনেমাটা দেখেছে, সে ঠাকুরের ছোটগল্পটির মাঝে আবশ্যিকভাবে গভীর সমৃদ্ধ একটি অর্থের নিশানা পায়। তাহলে, রায়বাবুর ঠাকুরের গল্পটিকে ছায়াচিত্রে তর্জমা করার সত্যতা প্রতিপাদক যুক্তিটা কোথায়!?!
১৯৭১-এ ম্যারি সীটন সত্যজিৎ রায়ের জীবনকর্ম ঘিরে রচিত ‘Portrait of a Director: Satyajit Ray’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, ১৯৫০-র শেষের দিকে রায় যখন নষ্টনীড়-কে চলচ্চিত্রে রূপান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন রায়ের হাতে একটি পাণ্ডুলিপি আসে…সীটনের কথায়, “ঠাকুরের পাণ্ডুলিপির মার্জিনে যে মন্তব্য বা সঙ্কেত দেখা যায় তার সাথে বৌঠানের নামের ইঙ্গিত পাওয়া যায়…যা গল্পের মূল চরিত্র চারুর সাথে সাযূজ্যপূর্ণ।”[৬] সীটন আরো বলেন যে, বাঙ্গালীদের বিশ্বাস কাদম্বরীর মৃত্যুর সাথে রবি ঠাকুরের বিবাহ কারণটি জড়িত মানে “রবি ঠাকুরের বিয়েই বৌঠানের মৃত্যুর কারণ।”[৭]
অ্যান্ড্রু রবিনসন তাঁর ‘Satyajit Ray: The Inner Eye’ গ্রন্থে সীটনের ব্যক্ত তথ্যের পুনরাবৃত্তি করে বিশদ ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন যে, রায় ‘নষ্টনীড়’-র একদমই প্রাথমিক অবস্থার একটি খসড়া দেখেছিলেন “যেথায় পৃষ্ঠার খালি জায়গায় অসংখ্যবার হেকিট শব্দটির উল্লেখ আছে”, আর ঠাকুরের দেয়া কাদম্বরী দেবীর উপনাম ছিল হেকিট।[৮] হেকিট ছিল গ্রীক দেবী_যার নাম আর্তেমিস সহ অন্যান্য দেবীদের সাথে উচ্চারিত হয় এবং তদনুযায়ী চন্দ্রের সাথেও সম্পৃক্ত ছিল, এমনকি পার্সেফনের সাথেও তার নাম জড়িত থাকার ফলে প্রেতলোকের ডাকিনীবিদ্যা এবং জাদুটোনার ব্যাপারে হেকিটের নাম ছিল। শেক্সপীয়ারের নাটকে হেকিটের এহেন বিচিত্র মূর্তিতে আবির্ভাবের বিষয়টি বারবার এসেছে। এই উপনামটির দ্বারা অনুমান করা যায় যে বৌঠানের সঙ্গে ঠাকুরের একপ্রকার ঘনিষ্ঠ ও ঠাট্টা-মশকরার সম্পর্ক বজায় ছিল; আর এটি একইসাথে ঠাকুরের পাণ্ডিত্যপূর্ণতা জ্ঞাপন করে। তাছাড়া, রায় যে পাণ্ডুলিপিখানি দেখেছিলেন তাতে কাদম্বরী দেবীর ছবিও আঁকা ছিল…রায়ের কাছ থেকেই রবিনসনের এসব শোনা। এই তথ্য/নিদর্শনসমূহ রায়কে এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, নষ্টনীড় লেখার টাইমে ঠাকুরের মননে কাদম্বরী দেবীর উপস্থিত ছিল। এ উপলব্ধির ফলাফলস্বরূপ রায় পর্দায় অনূদিত নষ্টনীড়ের সময় হিসেবে ১৮৭৯-৮০ সনকে বেছে নেন; এর ভিতর দিয়ে রায়বাবু এটি পুনরায় নিশ্চিত করলেন নষ্টনীড়-এর উপযুক্ত পাঠ হল ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পঠন; যেখানে প্রধান চরিত্রত্রয়ের মাঝে রবি ঠাকুর, তাঁর বৌঠান এবং বৌঠানের স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছায়া দেখা যায়।
আমি প্রস্তাব রাখতে চাই কাদম্বরী দেবীর ভাগ্য সম্পর্কে জানার পরও গল্প ও সিনেমাতে বয়ানের যে সংস্করণটি মুদ্রিত হয়েছে তা যদি পিরিয়ড পিসরূপে আমরা পাঠ করি তবেই আখ্যানের শক্তিমত্তাটা উপলব্ধি করা যায়।
চলমান আলোচনার দ্বিতীয় উদ্বেগ বা পয়েন্ট শুরু করার পূর্বে এটা বলা জরুরী যে, রায় কীভাবে ঠাকুরের বচনকে ইমেজে অনুবাদ করেছেন…। আমি চেষ্টা করব সিনেমাটির ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা ব্যতিরেকে সিনেমার উজ্জীবিত বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করতে। ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ এক স্তরের আপোষমূলক বৈবাহিক জীবনের গল্প বলে। এটি রূপকার্থে একটি নীড় বা অভয়ারণ্যের বয়ান যা অনুমানসিদ্ধভাবে বিবাহ দ্বারা শর্তাধীন এবং দম্পতির নিজ নিজ কর্মগুণে দুর্যোগের মুখে পড়ে। এই গল্প আমাদের (নির্দিষ্ট করে) ১৮৮০ সনের কলকাতার উচ্চবিত্ত শ্রেণির বর্ধিষ্ণু পরিবারের প্রেক্ষাপটে মানবজীবনের সাধারণ সম্পর্ক-সূত্রের কথা বলে। এটি মানবীয় যোগাযোগ ও যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থতার গীতমালা; একই সাথেনারীর ব্যতিক্রমী প্রতিভার প্রতিমূর্তি দেখি যা নাকি আবেগ ও ধীশক্তি কাতর।
এই সম্পর্ক সূত্রগুলি ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় ‘বৌঠান-ঠাকুরপো’-এর সম্পর্কের ভেতর দিয়ে। বাঙ্গালি সমাজে বৌঠান-ঠাকুরপোর সম্পর্ক আদ্যোপান্ত লোকাচার অনুমোদিত অসাধারণ মধুর সম্পর্ক। যেখানে প্রচলিত লোকাচারে বাড়ির বউ অপরিচিত কোনো পুরুষের সামনে আসতে পারে না, সেখানে ঠাকুরপোর সাথে অবাধ মেলামেশাকে বরং উৎসাহিত করা হয়। এধরনের সম্পর্ক ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক বটে।
বাংলায় সাধারণত ভালবাসার তিন রকমের সংজ্ঞা পাওয়া যায়- ‘স্নেহ, ভালবাসা, প্রেম।’ স্নেহ বলতে স্বভাবত সন্তানের প্রতি প্রতিপালকের মমতাকে বোঝানো হয়। প্রেম বলতে রোমান্টিক প্রকৃতির প্রবল আবেগপূর্ণ ভালবাসাকে নির্দেশ করা হয়। এই ত্রয়ীর মাঝে ভালবাসা সবচেয়ে নিরীহ প্রকৃতির অর্থ ধারণ করে। ‘ভালবাসা’ স্নেহ বা প্রেম উভয়ই হতে পারে তবে সাধারণত প্রবল ইতিবাচক আবেগের প্রকাশকে বোঝানো হয়।
বৌঠান-ঠাকুরপোর সম্পর্ক অবশ্যই স্নেহের এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার। বিপদের কথা হল – এই স্নেহের সম্পর্ক কখনো কখনো স্বাভাবিকভাবে প্রেমে বিকশিত হতে পারে যেটা ‘নষ্টনীড়’-এ চারুর বেলায় ঘটেছে। চারু বা অমল কেউ তো নয়ই এমনকি ভূপতিও অনুধাবন করতে পারেনি যে স্নেহের সীমার শেষ পিলার কোথায় গাঁথা বা কখন সেই সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে। এই বিড়ম্বনা সমগ্র ব্যাখ্যান জুড়ে সমাসীন থাকে। চারু-অমল কেউ ধরতে পারে না তাদের সম্পর্কের গলদটা কী এবং স্নেহের সম্পর্ক যে কখন আকাঙ্ক্ষা-বাসনার সম্পর্কে মোড় নিয়েছে সে প্রশ্নেও তারা অবচেতন থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত বিষয়টি অমলের উপলব্ধিতে আসে। অমল নিজ থেকেই জানতে পারে তার এবং চারুলতার সম্পর্কের মাঝে ভয়াবহ ভুল কিছু ঘটে গেছে। এটাই অমলের ইপিফানি এবং গল্পের টার্নিং পয়েন্ট।
গল্পের টার্নিং পয়েন্টে পৌঁছানোর পথে পরিবারের মধ্যে আরো কিছু কোলাহল লক্ষ্য করা যায়। যার অধিকাংশই সরাসরি ভূপতির মনে অভিঘাত সৃষ্টি করে। এই বিষয়গুলি ঠাকুর উপমার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন; তিনি একই প্রকৃতির উপমার প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপন করেছেন কীভাবে ভূপতির পায়ের তলা থেকে জমিন সরে সরে যাচ্ছে। প্রথম ঘটনা ভূপতির হাতে অমলের ভাই উমাপতির অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ধরা পড়ে। সে যাত্রায় ভূপতি ক্ষমা করলে উমাপতি তার নামে কসম খেয়ে পাই পাই টাকা ফেরত দেয়ার শপথ করে।
উমাপতির প্রতারণার হেতু আশু ক্ষতির মুখে পতিত ভূপতি তার পরম প্রিয় সংবাদপত্রকে বাঁচাতে পরিচিত মতিলালের কাছে পাওনা টাকা দাবী করতে গেলে মতিলাল প্রথমে কপর্দকশূন্যের ভান করে…পরে ভূপতির পীড়াপীড়িতে বলে বসে ঐ টাকা ফেরত দেবার কোনো চারা নেই। সবার কাছ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রতারিত বিধ্বস্ত ভূপতিও যখন দিশেহারা তখন তার মনে পড়ে চারুলতার বদনখানি… সবাই ফেরালেও চারু কখনো তাকে ফেরাবে না। কিন্তু, বিধি বাম চারুও যে তাকে হতাশ করে! তবে তুলনামূলকভাবে নিরীহ উপায়ে একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে। ভূপতি যখন ঘরে ঢোকে তখন চারু তার লেখার খাতাটা তড়িঘড়ি করে চোখের আড়াল করতে গেলে তা ভূপতির নজরবন্দী হয়ে যায়, খাতার সাথে সাথে গ্রেফতার হয় অমল আর চারুর সাহিত্য বাসরীয় সখ্যতার উপেক্ষিত পালা। বিধ্বস্ত ভূপতির মনে আপাত নির্মল এই গোপন কথাই যেন বজ্রসম আঘাত হানে।
এর কিছুপরেই অমল বাড়ি ফিরলে প্রবেশমাত্রই থমথমে পরিবেশে সহজে আঁচ করে ফেলে ক্ষণেক আগে বয়ে যাওয়া ঝড়ের আভাস। ভূপতির বিমর্ষ চেহারা আর চারুর কম্পিত চাহনি দেখে চারুকে বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করতেই সে সবিস্তারিলে অমলের ইপিফানির সংক্রমণ ঘটে! ঠাকুরের টেক্সটে এই ইপিফানির পরিচলন ঘটে পরিমিতভাবে বর্ধিত উপমার মাধ্যমে। এই উপমাগুলি যদিও দৈর্ঘ্যে বিস্তার লাভ করেনি যা সচরাচর ঘটে থাকে। তথাপি উপমাগুলি প্রতিক্ষণে ন্যারেটিভকে নির্দিষ্ট গতিতে সম্মুখ পানে ঠেলে দিয়েছে।
ঠাকুর আমাদের যা তাঁর সর্বজ্ঞ শব্দের মাধ্যমে জানাচ্ছেন বর্ণনাকারীর বরাতে…যেমন অমলের মানসিক দশা। সে পাহাড়ি পথে ভ্রমণরত অবস্থায় গভীর সংকীর্ণ উপত্যকার বনে ঢুকে যাচ্ছে… সত্যজিৎ রায় একটি দৃশ্যের মাধ্যমে ঐ প্রতিবেশটি তুলে ধরেছেন। এর পূর্ববর্তী দৃশ্যে দেখা যায় উমাপতি ভূপতিকে ধোঁকা দিয়েছে। ছোটগল্পের মতিলাল চরিত্রটি অবশ্য সিনেমা থেকে উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু, রায়ের বর্ণনায় ভূপতি শুধুই বিষণ্ন চেহারা নিয়ে হাজির হয় না।
অমলের যখন উপলব্ধি ঘটে সেই ইপিফানিক মুহূর্তে রায় আমাদের পর পর দু’টি কাট শটে একবার অমল আরেকবার চারুকে দেখান। ক্যামেরা অমলের কাঁধের পেছন থেকে তাক করায় যেন আমরা চারুকে দেখি অমলের চোখ দিয়েই। তার আবির্ভাব ঘটে অমল থেকে দূরে এবং দূরের দেখা থেকেই সে আড়ালে চলে যায়। তার চকিত দৃষ্টি ছিল অমলের পানে, সে দৃষ্টিতে যেন সম্পূর্ণভাবে ভূপতির দুর্দৈব সম্পর্কে অসচেতন। রায়ের তর্জমাতে অমলের পাহাড়ি পথে ভ্রমণের ইমেজটি অনুপস্থিত। এর বদলে রায় অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠির বাণী ব্যবহার করছেন ভূপতির জবানিতে। ঠাকুর যা বলতে চেয়েছেন কাদম্বরী দেবী অনুপস্থিতি হেতু সেই কথাগুলি ভূপতি বলে যখন সে জানতে পারে উমাপতি তার সাথে প্রতারণা করেছে।
ছায়াচিত্রের বাচনিক ইমেজগুলির প্রকৃতি ঠাকুরের বর্ধিত উপমার সাথে তুলনীয় যা কিনা ইপিফানিক মুহূর্তগুলিকে জাজ্বল্যমান করে তোলে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখশ্রীর অভিব্যক্তির দরুন ভূপতির কথায় অমলের অনুভূতি চাপা পড়ে না; দর্শকমাত্রই তা আমূলে অনুভব করেন এবং তা গল্পের শব্দের চাইতেও বেশি উচ্চকিত। মূল গল্পের অনুসরণে রায়ের তর্জমায় অমলের উপস্থিতি আরো সংক্ষিপ্ত। এরপর অমল প্রেক্ষাপট থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, রয়ে যায় শুধু তার কণ্ঠের আবৃত্তিমালা।
যদিও রায়ের সিনেমায় গল্প থেকে সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে তদুপরি তাঁর অনুবাদের শক্তি মোক্ষমভাবে চোখে পড়ে নির্বাক দৃশ্যগুলিতে। চারুলতার চূড়ান্ত দৃশ্যে আমরা দেখি স্থিরচিত্রমালার সিরিজ, সাথে ভূপতির সন্তাপিত বদনে বাড়ি ফেরা এবং বৈবাহিক সম্পর্কটা টেকাতে আপাত ‘স্থির’ চারুর দূরে সরে যাওয়া স্বামীকে ঘরে ফেরানোর আরজ করতে। স্থিরচিত্রগুলির জমাটবাঁধা মেজাজ মূলত জ্ঞাপন করে সম্পর্কের শীতল-নিশ্চল-আবেগিক দশাকে_যদিও বরফ গলনের ক্ষীণ সম্ভাবনা তখন দেখা যায়। ঠাকুর তার গল্পের উপসংহার টানেন অনেক বেশি নিশ্চায়কভাবে মূলভাবের অনুকূলে। গল্পে ভূপতি দক্ষিণ কলকাতার হাভেলি এবং চারুকে ছেড়ে অন্যথায় যেতে উদ্যত হলে ‘আতঙ্কিত’ চারুলতা পথ আগলে তাকে সঙ্গে নেবার মিনতি জানায়। ভূপতি প্রথমে ‘না-না’ করলেও চারুর অনুনয়ে তার নিষ্ঠুর অভিপ্রায় ত্যাগ করে এবং তাকেও আসতে বলে…। আর চারু তখন উদাসীন ও নৈমিত্তিকভাবে তার তথা গল্পের শেষ কথাটি বলে ‘থাক’।
অপরদিকে রায়ের তর্জমাটি বরং তুলনামূলক নাটকীয়, মূলের চাইতে অধিক দ্ব্যর্থবোধক এবং কম উপসংহারিক। এমনকি চূড়ান্ত ফ্রিজ শট দ্বারা তিনি কী অর্থ সংযোগ করলেন তাও নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় না, যদিও নির্মাতার জায়গা থেকে যেটি সঠিক মনে হয়েছে তিনি তাই করেছেন। রায়ের ভাবনা অনুসারে গল্প অনুযায়ী শেষ উপসংহারে ‘থাক’ শব্দটি জুড়ে দিলে হয়তো সিনেমার মূল সুরের তাল কেটে যেতে পারতো। তাই বলতেই হয়, “সিনেমার ক্ষেত্রে মীমাংসাসূচক বা সংকটপূর্ণ মূহুর্তগুলি শব্দহীন থাকাই বাঞ্ছনীয়।”[৯]
সবশেষে, আমার তৃতীয় পয়েন্ট– ঠাকুরের ছোটগল্পটি একটি অ্যাপোলজিয়া।
অ্যাপোলজিয়া শব্দটি নিয়ে অনাবশ্যক বিভ্রান্তি এড়াতে আমি পরিভাষাটি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই… আমি অ্যাপোলজিয়া অর্থে আপন বিশ্বাস, মতাদর্শ ইত্যাদির সমর্থনে প্রদত্ত বক্তব্য বা আত্মপক্ষসমর্থনের কথা বলছি না। আমি বোঝাতে চাইছি এর প্রাথমিক অর্থ যথা অভিপ্রেত কৃতকর্মের অভিযোগাদি হতে মুক্তি দেওয়ার নিমিত্তে যে বিবৃতি দেওয়া হয় সেটিকে। স্পর্শকাতরভাবে সুলিখিত, অত্যন্ত শিল্পকৌশল দক্ষতার সাথে রচিত গল্পটির মাধ্যমে ঠাকুর বলতে চাইছেন গল্পে যে পরিণতি বিধৃত হয়েছে তার জন্য তিনি দায়ী নন বা সেটি তার দোষ নয়। আমি বলব যে, এই সাহিত্যকর্মকে এক্সোরসিজম হিসাবে দেখতে, এটি দুই দশক ধরে পুষে রাখা বেদনা প্রশমিত করার একটি উপক্রম যার দ্বারা রবি ঠাকুর নিজেই নিজেকে বোঝাতে চাইছেন কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর জন্য তিনি দণ্ডিত হতে পারেন না, কারণ তিনি সম্মানসূচক ব্যবহার বজায় রেখেছিলেন।
রায়ের ছায়াচিত্রে এই বিষয়টা যত্নসহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। উভয় টেক্সটে ‘অমল’ চরিত্রটি জাগরণের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যায়, যে জাগরণে সে উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় কোনো না কোনোভাবে তার দ্বারা শিষ্টাচার লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রতিক্রিয়া হেতু সে তাৎক্ষণিকভাবে চারু ও ভূপতির বাড়ির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিজের পথে হারিয়ে যায়। অধিকন্তু, সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে তার জ্যেষ্ঠ কাকাত ভাইকে সমর্থন যোগানোর যদিও তার দাদা অনবধানবশত মনে করছে অমল তাকে প্রতারিত করেছে। এই কাল্পনিক চরিত্রটি ঠাকুরের মূল কর্মে এবং রায়ের তর্জমায় হাজির থেকে বলতে চেয়েছে “দেখো, আমি দোষী নই। আমার আর কীইবা করার ছিল?”
অমল চরিত্রটি মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছিল চারুর কাছ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে, সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে; কিন্তু, ঠাকুর এই স্মৃতির নিকট বারংবার আবেগের বশে ফিরে আসেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এমনকি পেইন্টিং-এর মধ্যেও। নন্দলাল বসুর মতে-“লেখনীর তুলনায় পেইন্টিংয়ে কবিগুরু আকারে/বিকারে,ছায়া/প্রচ্ছায়ায় সবচেয়ে অপূর্ব ও আবেগমণ্ডিত কায়দায় ঠাকুরের প্রাণপ্রিয় কাদম্বরী দেবীকে চর্মচক্ষুর সামনে হাজির করেছেন।”[১০] দেবীকে নিয়ে লিখা আরেকটি কবিতা থেকে পাঠের মধ্যে দিয়ে আমি ইতি টানছি-
“হায়, কোথা যাবে!
যাবে যদি যাও, অশ্রু তব মুছে যাও,
এইখানে দুঃখ রেখে যাও।
যে বিশ্রাম চেয়েছিলে তাই যেন সেথা মিলে – -
আরামে ঘুমাও।
যাবে যদি, যাও।”[১০
ক্লিনটন বি সীলি
ভাষান্তর: ইমরান ফিরদাউস•
©somewhere in net ltd.