নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখতে ও মন লাগে , ভাব নিতে হয় । ভাবস মারো ।

ভাইস চ্যান্সেলর

আমার মত আমার জীবন, আমি জীবনকে লালিত করি । জীবন সে তো কাগজের নৌকা ।

ভাইস চ্যান্সেলর › বিস্তারিত পোস্টঃ

নিমকহারাম

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৩৩

কি কারণে টগরের মন খারাপ তা শত চেষ্টা করেও জানতে পারলাম না।

রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত আমরা শাহবাগের সব রাস্তা চষে ফেললাম। এর মধ্যে আমি জাদুঘরের সামনে টগরকে বলেছি, পায়ে ধরি দোস্ত, কি কারণে তোর মন খারাপ তা আমাকে বল।



টগর হাসতে হাসতে বলেছিল, পা ধরতে হবে না। কিছু হয়নি।



কি আশ্চর্য!



রাত সাড়ে বারোটায় বাসায় ফিরলাম। দেখি মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফ্রেশ হয়ে আমরা খেতে বসলাম।



ভেবেছিলাম মন খারাপের কারণে টগর হয়তো বা আজ খাবে না। অথচ এক বাটি মাংস প্লেটে ঢেলে নিয়ে কি নির্বিকার ভাবে খেতে লাগলো টগর!



আমার বড় মায়া লাগলো। আমার তো শুধু বাবা মারা গিয়েছে। টগরের মা-বাবা দুজনেই মারা গেছেন। আমার ধারণা, টগরের মা বেচে থাকলে প্রতি রাতে অফিস থেকে ফিরে টগর ওর মাকে বলতো, মা, তুমি ভাত খাইয়ে দাও। না হলে আমি খাবো না।



টগর এতোটাই ছেলেমানুষ।



ঘটনা বুঝলাম একটু পর। খাওয়া শেষে বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে টগর বেসিন ভাসিয়ে বমি করে ফেললো।



আমি খাওয়া রেখে ওকে জাপটে ধরলাম। দেখলাম, ওর চোখ লাল। রাগী গলায় বললাম, কি খেয়েছিস তুই?



টগর কান্ত শরীরে ঠোটে হাসি এনে বললো, ভাত, ডাল আর এক বাটি গরুর মাংস। তোর সামনেই খেয়েছি।



আমি হেসে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে জল চলে এলো। মনে হলো, আমিও কি আমার মা মারা যাওয়ার পর ওর মতো অসহায় হয়ে যাবো?



রাত আড়াইটায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে টগর আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে দিল।



জড়ানো গলায় বললাম, কিরে টগর?



কোনো রকম ভূমিকা না রেখে আমার গলায় হাত রেখে টগর বললো, আমার বোনটার সন্তান হবে!



সন্তান হবে, এটা তো ভালো কথা। ঘুমা।



সন্তান তো বড়আপার হবে না। জয়ার হবে।



ও। জয়ার বিয়ে দিলি কবে? ওর হাজব্যান্ড কি করে?



জয়ার এখনো বিয়ে হয়নি।



আমি চমকালাম। তড়াক করে উঠে বসে লাইট জ্বালিয়ে দেখি আমার বন্ধুটা দুই হাতে শক্ত করে মুখ ঢেকে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।



আমি লাইট অফ করে বারান্দায় এসে মিনাকে ফোন দিলাম।



কল দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন রিসিভ হলো। খুব মৃদু স্বরে মিনা আমাকে বললো, ভাইয়া, এক সপ্তাহ আগে আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছে। তাই টগরের মন ভালো করার জন্য আমি কল দিতে পারবো না।



পরদিন সকালেই টগর ফরিদপুর চলে গেল।



যখন আমি মাস্টার্স পড়ি তখন টগরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। প্রচ- ইমোশনাল একটা ছেলে। যখন আমি শুনলাম ওর মা-বাবা কেউ নেই তখন থেকেই ওকে আপন ভাইয়ের মতো দেখতে শুরু করলাম। ওর তিন বোন গ্রামে থাকে। বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ইংল্যান্ড প্রবাসী। ছোট দুই বোনকে ওর বড়আপাই দেখাশোনা করেন। আর টগর বর্তমানে একটা সাধারণ চাকরি করে।



বেতন যা পায় তার অর্ধেকের বেশিই চলে যায় থাকা-খাওয়ায়। তাই আমি মাকে বলে টগরকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলাম।



ঢাকাতে আমরাও ভাড়া থাকি। মা আর আমি। আমার এক বোন সপরিবারে কানাডা থাকে। আমরা আর্থিকভাবে ধনী নই। কিন্তু গর্ব করে বলতে পারি, আমার মা মনের দিক দিয়ে ফেরেশতা সমতুল্য। আর আমি হলাম সেই মহিলা ফেরেশতার ছেলে।



তিনদিন পর টগর ফিরে এলো। গ্রামে থেকে আদর-অনাদরে বড় হয়ে ওর ভাবমূর্তি এতো নির্বিকার হয়ে গিয়েছে যে, আমি অবাক হলাম!



ফিরে এসেই গোসল না করে মাকে বললো, খালাআম্মা, খেতে দেন। গ্রামে গিয়ে তিন দিন কিছু খেতে পারিনি। আমার বড়আপার রান্না এতো বাজে!



মা কোনো প্রশ্ন না তুলে টগরকে ভাত দিলেন।



আমার কৌতূহল আটকাতে পারলাম না।



টগর খাচ্ছিল।



আমি চোখ সরু করে ওর দিকে মাথা বাড়িয়ে বললাম, টগর, ঘটনা কি? কি হলো শেষ পর্যন্ত?



এ প্রশ্নে টগর এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমি কি জানতে চেয়েছি সেটা টগর বুঝতেই পারছে না। মুখ ভর্তি ভাত নিয়ে বললো, ঘটনা মানে? কোন ঘটনা?



ওই যে জয়া ...।



আমার কথা শেষ না হতেই ওর ছোট বোনকে উদ্দেশ করে বললো, আরে, শালার ফালতু মাইয়া। মানসম্মান যা ছিল তা ডুবায় ফেলছে। আরে আমরা এত্তো বড় ...।



এবার আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। ওর কথায় আঞ্চলিকতা চলে এসেছে। এ লক্ষণ ভালো নয়।



রাতে আমি সব শুনলাম। ঘটনাটা এ রকম :



জয়ার সঙ্গে জাফর নামে একটা ছেলের সম্পর্ক ছিল তিন বছর ধরে। জাফর জয়াকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। ধারণাটি জয়ার মনে খুব ভালো ভাবেই গেথে যায়। বোকা মেয়েটা একবারের জন্যও বুঝতে পারে না জাফর কি পরিমাণে প্রতারক। হয়তো উঠতি বয়সের আবেগ আর ভালোবাসার বশ হয়ে জয়া ফেরাতে পারেনি জাফরকে। তাকে সপে দিয়েছে একুশ বছর ধরে ওড়নায় পেচানো শরীর। ভালোবাসার তাপদাহে জয়া কুণ্ঠাবোধ করেনি সলজ্জ দুই পা প্রসারিত করতে। ফলে সে হয় প্রতারণার শিকার। জাফর হয় প্রতারক।



জাফর বিয়ে করার জন্য অনেকবার বলেছে জয়াকে। জয়া সময় চেয়েছে। যখন জয়া বুঝেছে সে মা হবে তখন তার মতো অবাক পৃথিবীর আর কেউ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যেদিন জয়া বুঝতে পারলো তার শরীরে আরেকজনের উপস্থিতি ঠিক তার তিন দিন পর সে জাফরকে জানায় ব্যাপারটি।



জাফর প্রত্যাখ্যান করে জয়াকে।



এ ব্যাপারটির পর জয়া নাকি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিল।



টগর বাড়ি গিয়ে কিছুই করতে পারেনি। শুধু পেরেছে জয়াকে কিনিকে নিয়ে সন্তানটাকে মেরে ফেলতে।



আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এখন যদি জয়ার মৃত্যু সংবাদ আসে তাহলে সব থেকে বেশি খুশি হবে টগর এবং সবচেয়ে যে বেশি কষ্ট পাবে সেও এই টগর।



বন্ধু হিসেবে টগরকে আমি কতো ভালোবাসি তা অনেকের অবিশ্বাস্য মরে হবে। এ টগরকে নিয়েই পরবর্তী ঘটনা।



কয়েকদিন ধরে টগরকে বেশ ব্যস্ত দেখছিলাম। কাগজপত্র নিয়ে কি সব দৌড়াদৌড়ি। আমাকে কিছু বলে না।



আমিও ঘাটাই না।



একদিন টগর আমাকে খাবার টেবিলে একটা কথা বললো। মাও পাশে ছিলেন।



টগর বললো, দোস্ত, তিন লাখ টাকা দরকার। জয়ার একটা সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে পক্ষের দাবি-দাওয়াসহ তিন লাখ টাকা খরচ হবে। জয়ার একটা গতি হলে বাচি।



টগর এবার বাড়িতে গিয়ে জয়া আর বিথীকে ওর ছোট মামার বাসায় রেখে এসেছিল। বড়আপার শ্বশুরবাড়িতে নাকি এ নিয়ে খুব অশান্তি।



বললাম, কি করবি?



ফরিদপুরে আমাদের ভালো কিছু জমি আছে। ভাবছি সেটা বেচে দেবো। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু সম্ভব নয়। টাকা ১৭ তারিখের মধ্যে লাগবে। ফারুক, তুই এক কাজ কর। তিন লাখ টাকার ব্যবস্থা কর। সামনের মাসে আমি জমি বেচে টাকা ফেরত দেবো।



আমার অতো টাকা ছিল না। তাই দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু জয়ার কথা চিন্তা করে আমি সব কথা মাকে বললাম।



আগেই বলেছি আমার মা সম্পর্কে।



মা আমাকে তার সেভিংস থেকে দুই লাখ টাকা দিলেন।



টাকা টগরকে দিলাম।



টগর বললো, ২১ তারিখ বিয়ে। ২০ তারিখে আমাকে আর মাকে টগর নিয়ে যাবে।



আমরা টগরের গ্রামের বাড়ি চিনি না।



টগর টাকা নিয়ে পরদিন চলে গেল।



টগর মোবাইল ফোন ব্যবহার বাদ দিয়েছিল মিনার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার পর থেকে। তাই কয়দিন ওর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হলো না।



আশ্চর্য! ২০ তারিখ হয়ে গেল, টগরের কোনো দেখা নেই। আমি নিরুপায় হয়ে অনেক কষ্টে টগরের বড়আপার নাম্বার জোগাড় করে ফোন দিলাম, আপা, আমি ফারুক। টগরকে দেন।



আপা অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, টগর কি বলেছে ও এখন ফরিদপুরে?



হ্যা। কাল তো জয়ার বিয়ে। আজ আমাদের নিয়ে যাওয়ার কথা।



আমার কথার উত্তরে আপা যা বললেন তাতে এতো অবাক হলাম যে, শব্দ করে কেদে ফেললাম। আপা বললেন, জয়ার বিয়ে-টিয়ে কিছু নয়। টগর গতকাল মালয়শিয়া চলে গিয়েছে।



আপারাও নাকি ভালোমতো জানতো না টগরের বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারটি। আর বেচার মতো টগরদের জমিজমা থাকলেও তা নাকি তিন লাখ টাকার সমতুল্য নয়।



টাকার জন্য আমার যতোটা না কষ্ট লাগছিল তার থেকে বেশি খারাপ লাগছিল টগরের কথা ভেবে। ও যে এতো বড় একটা প্রতারণা আমার সঙ্গে করবে তা ভাবিনি। ওর জন্য আমি কি করিনি? বন্ধুকে ভালোবাসার প্রতিদান যে এতো বড় প্রতারণা হবে তা কল্পনাও করতে পারি না।



আমার মাকে দেখেও আমি অবাক হলাম!



মা আমাকে অবাক করে বললেন, থানায় যা ফারুক। নিমকহারামটার উচিত শিক্ষা দেয়া উচিত।



ভেবেছিলাম মা নির্বিকার থাকবেন। আমি থানায় গেলাম না। অনেক কিছু করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোনোটাই প্রয়োগ করলাম না।



দিনগুলো আমার প্রবল শূন্যতা মাখা বিষাদে কেটে যেতে থাকলো।



এর ঠিক ছত্রিশ দিন পরের কথা। ২৫ জানুয়ারি টগরের বড়আপা আমাকে ফোন দিলেন। তিনি বললেন, আগামীকাল যেন আমি ফরিদপুর আসি। বিশেষ দরকার। আমাকে ঠিকানা দিয়ে সব বুঝিয়ে দিলেন।



আমি নিশ্চিত, আপা আমার টাকার ব্যবস্থা করেছেন। ভাইয়ের ঋণ শোধ করতে চান হয়তো।



আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অতো টাকা তো আর মাফ করে দেয়া যায় না!



পরদিন সকাল সকাল রওনা হলাম।



পৌছাতে দুপুর হয়ে গেল।



আমি যখন টগরদের বাসায় পৌছালাম তখন সবাই খেতে বসেছিল।



আমি টগরদের যে বাসায় গিয়েছিলাম সেটা ছিল ওদের বাসা। আপার বাড়িও নয়, মামার বাড়িও নয়।



খাওয়ার ঘরে ঢুকে আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম।



দেখি লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে টগর ভাত খাচ্ছে।



আমি যতোটা চমকালাম তার থেকে দ্বিগুণ চমকালো টগর। খাওয়া বাদ দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। হাত না ধুয়ে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে ফেললো টগর।



রাগ করে বললাম, এটা তুই কি করলি টগর?



উত্তরে টগর মুখস্থ বলে গেল, তোর টাকা আমি ঠিকই ফেরত দিতাম। কিন্তু ঝামেলা হয়ে গেল। ওরা আমাকে পাঠিয়ে দিল। তোর টাকাগুলোও নেই, আমার কিচ্ছু নেই। সব স্বপ্ন শেষ।



টগরের কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।



আমি ওকে থামিয়ে দিলাম।



টগর বললো, তুই চিন্তা করিস না। দুলাভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তোকে সব শোধ দেবো।



বললাম, দুলাভাইয়ের কাছ থেকে আগে কেন টাকা নিলি না?



তুই জানিস না ফারুক, আমার দুলাভাই হলো একটা শুয়োরের বাচ্চা। আমি চাইনি ওর টাকা খরচ করি।



রাতে আমরা উঠানে বসে গল্প করছিলাম। আমাদের সঙ্গে দুটো পরীও ছিল। জয়া আর বিথী। শুনলাম জয়ার নাকি সত্যি সত্যি বিয়ের কথা চলছে। সমস্যা হয়েছে টাকার।



আমি দৃঢ়কণ্ঠে বললাম, পরীদের বিয়ে হতে টাকা-পয়সা লাগে নাকি? জয়ার বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার। আমার হাতে অনেক ছেলে আছে। বিয়ে দিতে টাকা লাগবে না।



এ কথায় চোখের নিমেষে জয়া ছুটে ঘরে চলে গেল।



টগর বললো, তোর ফেরেশতা সাজার মানে কি? উদ্দেশ্যটা বলবি?



টগরের এ কথার জবাবটা লম্বা করে দিতে পারতাম। দিলাম না। কেবল আপা আর বিথীকে চমকে দিয়ে আমি শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে টগরকে একটা চড় মেরে ঘরে চলে এলাম।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.