নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি বাংলায় কথা কই

আমি অতি সাধারণ মানুষ

মুহিত আলম

অনুমতি ব্যতিত কোনো লেখা বা লেখার অংশ কপি করবেন না। এই নিন্দনীয় কাজটা আমিও করি না, আশা করবো আপনিও করবেন না।

মুহিত আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

দোকান পর্ব-২

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৮:২৪

প্রথম পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link





মাসখানেক পরের কথা। ঐদিন রাতেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। মনু মিয়া নয়টার দিকে দোকানের ঝাঁপি ফেলে দেয়। এই বৃষ্টির মাঝে আর লোকজন আসবে না। তাছাড়া এখন আর খুব একটা লোকজন আসেও না মনু মিয়ার দোকানে। ইমাম সাহেব মারা যাওয়াতে খুব লোকজন ভয় পেয়েছে। আয় রোজগার এখন আর খুব বেশি হয় না।

সন্ধ্যার দিকেই রান্না বান্না শেষ করে রেখেছিল মনু মিয়া। এখন খেতে বসবে। কারেন্ট চলে গেছে একটু আগে। মনু মিয়া খাবার গুছিয়ে টেবিলে রাখে। মোম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নতুন একটা মোম ধরায় সে।

ঠক ঠক। ঠক ঠক।

কেউ একজন এসেছে। বাইরে দোকানের ঝাঁপিতে আঘাত করছে। এই বৃষ্টির মাঝে কে এল? মনু মিয়া জিজ্ঞেস করে –কেডা? কেডা বাইরে?

ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে কেউ উত্তর দেয় –ভাই দরজা একটু খুলবেন? দরকার আছিলো।

-আপনে কেডা?

-আমারে চিনবেন না। ভাই দরজাডা একটু খুলেন। প্লিজ ভাই। দরজাডা খুলেন। তাড়তাড়ি খুলেন, লোকটার কন্ঠে আকুলতা।

মনু মিয়ার মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছে। দোকান খুলবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। লোকটা আবারো দোকানে আঘাত করল। -ভাই দয়া কইরা একটু দরজাডা খুলেন। অনেক বিপদে পইরাই আসছি আপনের কাছে। দরজাডা খুলেন ভাই। জলদি খুলেন।

মনু মিয়া ধীরে ধীরে দোকানের ঝাঁপি খুলে দেয়। একজন মধ্যবয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে চুপসে গেছে। ঠাণ্ডায় রীতিমত কাঁপছে। মনু মিয়া দোকান খোলার সাথে সাথে লোকটা ভিতরে ঢুকে পড়ল। কাঁপতে কাঁপতে বলল –ঝাঁপি ফালাইয়া দেন।

-ক্যান? পাল্টা প্রশ্ন করে মনু মিয়া।

-যা কইলাম ভাই তাই করেন। দেরি কইরেন না। ফালাইয়া দেন।

মনু মিয়া লোকটার কথামত দোকানের ঝাঁপি ফেলে দেয়। তারপর লোকটার দিকে ভাল করে তাকায়।

-আপনে কে ভাই?

-আমি রাসু।

-আমার এইখানে কি চান?

-ভাই আমি আপনের এইখানে কিছুক্ষণ থাকমু। তারপর চইলা যামু।

-ক্যান?

-ভাই আমারে কিছু লোক খুঁজতাছে। তারা আমারে খুঁইজা পাইলে মাইরা ফালাইবো।

-আপনে কি করছেন? আপনারে মারব ক্যান?

-আমি কিছু করি নাই ভাই।

-আপনে কিছু না করলে আপনারে মারব ক্যান?

-সে অনেক কথা ভাই। অনেক ইতিহাস আছে............... আপনে একটু চুলাডা ধরাইবেন? আগুন পোহাইতাম। খুব শীত লাগতাছে।

মনু মিয়া চুলায় আগুন দিয়ে চায়ের কেতলি বসায়। লোকটাকে জিজ্ঞেস করে –চা খাইবেন? বানামু?

লোকটার চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠে। -আপনে শুধু পানি বসায়া দেন। আর চা পাতা, চিনি কই আছে আমারে বলেন। আমি চা বানাই দেই। আপনে খান, আমিও খামু।

মনু মিয়া অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে -আপনে চা বানাইবেন ক্যান?

-ভাই, আমি চা বানানের একটা ইস্পেশাল ফর্মুলা জানি। যেই লোক এই চা একবার খাইব সে আর এর স্বাদ ভুলতে পারব না।

মনু মিয়া আরো অবাক হয়। বলে কি এই লোক! লোকটার কথাবার্তার আগামাথা কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। মনু মিয়া চায়ের পাতা আর চিনি নামিয়ে সামনে রাখে। লোকটা তার ভিজে যাওয়া প্যান্টের পকেট থেকে একটা পলিথিনে মোড়ানো পুটলি বের করে। পুটলির মধ্যে কি আছে বুঝা যাচ্ছে না।

পানি ফুটলে লোকটা চায়ের পাতা ঢালে। তারপর দুটা কাপে চিনি নেয়। এরপর সেই পলিথিনে মোড়ানো পুটলি থেকে চামচ দিয়ে কিছু কালোমত জিনিস বের করে দুটা কাপে ঢেলে দেয়। মনু মিয়া জিজ্ঞেস করে –কি দিলেন এইগুলা?

লোকটা কেতলি থেকে চা কাপে ঢালতে ঢালতে বলে –এইগুলা একটা গাছের পাতার চূর্ণ। এই পাতাগুলা চায়ের সাথে মিশাইয়া দিলে চায়ের স্বাদ দারুণ হইয়া যায়।

চামচ দিয়ে চিনি আর ঐ রহস্যময় পাতা মিশিয়ে দেয় রাসু। তারপর কাপের উপর ভাসা কিছু পাতার টুকরা চামচ দিয়ে ফেলে দেয়। একটা কাপ মনু মিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে –খান।

মনু মিয়া কাপটা হাতে নিয়ে বলে –আপনে আগে খান।

রাসু হেসে চায়ে চুমুক দেয়। আস্তে আস্তে ফুঁ দিয়ে চা খেতে থাকে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রাসুর চা খাওয়া দেখে মনু মিয়া। তারপর ফুঁ দিয়ে আস্তে করে অতি সাবধানতার সাথে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।

এবং প্রচন্ড রকম চমকে উঠে। এত অপূর্ব স্বাদের চা এর আগে কখনো খায়নি মনু মিয়া। এর স্বাদ অবিশ্বাস্য, ঘ্রাণ অসাধারণ। এই চা তুলনাহীন। চা খাওয়ার সাথে সাথে দেহে আশ্চর্য এক প্রশান্তি নেমে আসে। মনু মিয়া হতবুব্ধির মত তাকিয়ে থাকে কাপের দিকে। তারপর রাসুর দিকে তাকায়।

রাসু মিটিমিটি হাসছে। মনু মিয়া জিজ্ঞেস করে –কি গাছের পাতা এইটা?

-নাম জানি না। এরম গাছ আমি দেহি নাই কুনুখানে। আমাগো বাড়ির পিছনে একটা আছিলো। ঐ গাছেরি পাতা এইগুলা।

-এহন আর ঐ গাছ নাই?

-লাগাইছি আরেকটা। বড় হইছে মোটামুটি। চা ভাল্লাগছে না?

-ভাল্লাগবো না মানে! এত দারুণ স্বাদের চা আমি কুনুদিন খাই নাই। আপনে আমারে এই গাছের পাতার গুড়াগুলা দিবেন?

-দিবার পারি। তয় শর্ত আছে।

-কি শর্ত?

-আপনের দোকানের যা লাভ হইব তার অর্ধেক আমার। রাজি আছেন?

রাজি হয়ে যায় মনু মিয়া।

-তাইলে এই নেন পাতার গুড়া। আর এই নেন কিছু বীজ। এইগুলা এই গাছের বীজ। এই বীজগুলা আপনে এই দোকানের পিছনে মাটিতে লাগাইয়া দিয়েন। তাইলেই হইব।

মনু মিয়া বীজ আর পাতার গুড়া গুলা হাতে নিল। মোমবাতির সামনে ধরে দেখার চেষ্টা করল কি রকম দেখতে।

-বীজ বুনার পর কি করতে হইব?

-শুধু নিয়মিত পানি দিবেন। তাইলেই হইবো।

চা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় রাসু। -আমি এহন যাই।

-কই যাইবেন?

-চইলা যামু।

-আপনে না কইলেন আপনের বিপদ, আপনারে মারার লাইগা লোকজন আপনারে খুঁজতাছে। তাইলে এহন গেলে আপনের বিপদ হইবো না?

-এতক্ষণে ওরা চইলা গেছেগা অন্যখানে। আমি যাইগা। দেরি করন ঠিক হইবো না।

-আপনে বরং এইখানে আজকে থাইকা যান। কাইলকা জাইয়েন।

-না। এহনি যাই গা। আমি তো আবার আসমুই। আপনের লগে তো আমার চুক্তি হইছেই। লাভের অর্ধেক আমার। যাই ভাই। আল্লাহ্‌ হাফেজ।

দোকানের ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে যায় রাসু। বৃষ্টি এখনো কমেনি। মনু মিয়া জিজ্ঞেস করে –কবে আইবেন আবার?

-দেহি। আমুনি কুনু এক সময়।

বৃষ্টির মাঝেই রাসু এগিয়ে যায় ভিজতে ভিজতে। তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে মনু মিয়া।

পরদিন খুব সকাল সকাল মনু মিয়া দোকান খুলে। খদ্দেরের জন্য সে বসে থাকে। কিন্তু বেলা দশটার আগে কেউ আসে না।

দশটার দিকে রমজান আলী মনু মিয়ার দোকানে আসে চা খাওয়ার জন্য। মনু মিয়া চা বানিয়ে দেয়। রমজান আলী চায়ে চুমুক দিয়ে অবাক হয়ে যায়। মনু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে –এই চা কই পাইলা মনু ভাই? এইটা কি চা?

মনু মিয়া হেসে জবাব দেয় –এইটা আমার ইস্পেশাল চা। কেমুন?

-জব্বর স্বাদ। আগে কুনুদিন এরাম স্বাদের চা খাই নাই। কি দিয়া বানাইলা?

মনু মিয়া মাথা নাড়ে আর মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বলে -সেইটা তো ভাই কন যাইব না। তোমারে দিমু আরেক কাপ?

-হ দেও।

মনু মিয়া আরেক কাপ চা বানিয়ে দেয় রমজান আলীকে। রমজান আলী তৃপ্তি সহকারে চায়ে চুমুক দেয়।

মনু মিয়ার চায়ের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। তার দোকানে খদ্দেরের সংখ্যা তিন চার গুন বেড়ে যায়। মনু মিয়া একা একা খদ্দের সামাল দিতে হিমশিম খায়। তাই দুইজন ছেলে রাখে তার দোকানে। ভোর থেকে তার দোকানে খদ্দেরের লাইন শুরু হয়। রাত এগারোটা পর্যন্ত তার দোকানে ভিড় থাকে। দোকানের “কুফা” কেটে যায়।





(দশ বছর পর)

মনু মিয়া এখন আর দোকানে থাকে না। তার বসতভিটা সংস্কার করে এখন আবার বাড়িতেই থাকে। বিয়ে করেছে আজ ছয় বছর। তার দুজন ছেলেও হয়েছে। বড়জনের বয়স চার বছর। ছোটজনের বয়স এক বছর। সুখের সংসার। সেই রহস্যময় চা তার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এখন সে অনেক টাকা পয়সার মালিক। জংশনে বড় একটা হোটেল দিয়েছে। সেই হোটেল থেকেও রোজগার ভালই হয়। তবে মনু মিয়া এখনো সেই “কুফা” দোকান ছাড়েনি। এখনো সে রোজ সকালে ওখানে চা বানায়। সারা সকাল ওখানে চা বানিয়ে বিকেলে যায় জংশনের হোটেলে। রাত পর্যন্ত হোটেলেই চা বানায়।

আজকে মনু মিয়া একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরেছে। তার স্ত্রী আজ বাড়িতে নেই। বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে দুই সন্তান নিয়ে। কয়েকদিন থাকবে ঐখানে। বাড়িতে আজ মনু মিয়া আর তার দোকানের এক কর্মচারি আছে।

রাত বারোটার দিকে মনু মিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। বাইরের দরজা কেউ ধাকাচ্ছে। এত রাতে এই শীতের মধ্যে কে এল? মনু মিয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। পুরো শরীর চাদরে মোড়ানো। আজ আকাশে চাঁদ আছে। তবে চাঁদের আলোতেও লোকটার চেহারা বুঝা যাচ্ছে না।

-কেডা? মনু মিয়া প্রশ্ন করে।

খসখসে গলায় লোকটা জবাব দেয় –আমি রাসু।

মনু মিয়া চমকে উঠে। এই লোক এতদিন পরে কেন আসল? সে কি তার দাবি চাইতে এসেছে? মনু মিয়া নিজেকে সামলে নেয়। বাইরে এসে দাঁড়ায়। ভাল করে তাকায় রাসুর মুখের দিকে। হ্যাঁ, রাসুই। এই দশ বছরে চেহারা ভেঙে গেছে। তবু চেনা যাচ্ছে।

-আছেন কেমুন রাসু ভাই?

-খুব একটা ভালা নাই। আমি আইছি আমার পাওনা নিতে।

-হ্যাঁ। আপনের পাওনা তো আপনে পাইবেনই। তা হিসাব নিকাশ কইরা দেখতে হইবো না।

-হিসাব নিকাশের সময় নাই। আমার অবস্থা খুব খারাপ। আপনে আমারে আপাতত আশি হাজার টেকা দেন। আমি জানি আপনের বাড়িতে এহন এই টেকা আছে। আপনে বাড়ি রঙ আর নতুন কইরা প্লাস্টার করার লাইগা আইজকা ব্যাংক থেইকা এই টেকা উঠাইছেন। ঐডাই দেন আপাতত। আমি যাইগা।

মনে মনে ভীষণ চমকে উঠলেও অভিব্যাক্তিতে তা প্রকাশ করে না মনু মিয়া। রাসুকে অপেক্ষা করতে বলে আবার বাড়িতে ঢুকে সে। দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। কাজটা করতে হবে খুব সাবধানে, ঠাণ্ডা মাথায়।

একটি ফল কাটার ছুড়ি চাদরের নিচে লুকিয়ে ধীরে ধীরে উঠানের দিকে এগিয়ে যায় মনু মিয়া।

পরদিন পুকুরঘাটে মনু মিয়ার রক্তাক্ত দেহ দেখতে পায় লোকজন। দোকানের “কুফা” আবার ফিরে এসেছে –গ্রামময় এই খবর রটতে খুব একটা সময় লাগে না।



©Muhit Alam

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৮:৩৫

আহসান২০২০ বলেছেন: মনু মিয়া খারাপ লোক। অত্যন্ত লোভী একজন। তার এইরাম শাস্তি হওয়াই উচিত ছিল।

২| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৮:৩৯

পথহারা সৈকত বলেছেন: আহসান২০২০ বলেছেন: মনু মিয়া খারাপ লোক। অত্যন্ত লোভী একজন। তার এইরাম শাস্তি হওয়াই উচিত ছিল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.