![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনুমতি ব্যতিত কোনো লেখা বা লেখার অংশ কপি করবেন না। এই নিন্দনীয় কাজটা আমিও করি না, আশা করবো আপনিও করবেন না।
মিষ্টি আর দইয়ের প্যাকেট ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে ড্রয়িং রুমে সোফায় বসলাম। মিলিকে বললাম –ফ্যান ছাড়।
মিলি ফ্যান ছেড়ে আমার পাশে বসল। বলল –আজকে তাড়াতাড়ি চলে আসলা যে? আবার মিষ্টিও এনেছো, ঘটনা কি?
আমি মুখ হাসি হাসি করে বললাম –ঘটনা আছে।
মিলিও হাসি হাসি মুখে বলল –কি ঘটনা?
-নাইম কি করে?
-স্যারের কাছে পড়ছে।
-আবিরের জ্বর কমেছে?
-এখন কিছুটা কম। ঘুমাচ্ছে। বল্লা না মিষ্টি কেন এনেছো?
-মিলি, আমার ঐ চাকরিটা হয়ে গেছে।
-কোন চাকরি?
-ঐ যে সামীর গ্রুপে মার্কেটিং ডিরেক্টর পোস্টে ইন্টারভিউ দিলাম না গত মাসে! আজ আমাকে কনফার্ম করল যে আমাকে ওরা সিলেক্ট করেছে।
মিলির মুখটা খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। -কংগ্রেচুলেশন। এটা তো দারুণ একটা নিউজ। কবে জয়েন করছ?
-ডিসেম্বর মাসের এক তারিখ জয়েন করব ইনশাআল্লাহ্।
-তোমার স্যালারি কত ধরেছে?
-স্যালারি তিন, প্লাস একটা ফুলটাইম গাড়ি দিবে। অন্যান্য আরো ফ্যসিলিটি তো আছেই।
-গ্রেট। বাবা মাকে জানিয়েছো?
-না, এখনো জানাইনি।
-মিষ্টি দিই তোমাকে? খাবা এখন?
-দাও।
মিলি উঠে মিষ্টি আনতে চলে গেল। আমি শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে একটু আরাম করে বসলাম।
মিলি একটা বাটিতে মিষ্টি এনে আমার সামনের টেবিলে রাখল। আমি বললাম –কি ব্যাপার, তুমি খাবেনা?
মিলি হেসে বলল –তোমার সাথে খাব।
আমিও হেসে দিলাম। বললাম –তাহলে খাইয়ে দাও।
মিলি আমার পাশে বসে আমাকে মিষ্টি খাইয়ে দিতে লাগল এবং নিজেও খেতে লাগল।
রাতে ঘুমানোর আগে মিলি ড্রেসিং টেবিলে বসে চুল আচড়াতে আচড়াতে বলল –তোমাকে একটা কথা বলি?
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে পেপার পড়ছিলাম। মিলির দিকে ফিরে বললাম –কি কথা?
-উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট কিনার ইচ্ছা অনেকদিনের। কিনবে এবার?
আমি হেসে বললাম –এখনো চাকরিতে জয়েনই করলাম না, আর তুমি এখনি ফ্ল্যাট কিনার জন্য বসে আছো?
মিলি চুল আঁচড়ানো বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল -আমি কি তোমাকে এখনি কিনতে বলেছি? জয়েন করো। তারপর না হয় কিনলাম।
-হুম, ঠিক আছে। কিনা যায়! আর চিন্তা করছি বাবা মাকেও ঢাকায় নিয়ে আনব। একটা বড় বাসাও দরকার। এই বাসাটা একটু ঘিজিবিজি হয়ে গেছে।
-বাবা মা আসবে বলে তো মনে হয় না! গত ঈদে কত সাধাসাধি করলাম। কিন্তু কিছুতেই এলেন না।
-এবার আবির আর নাইমকে দিয়ে বলাব। দেখা যাক বাবা মা রাজি হয় কিনা!
মিলি আবার চুল আঁচড়াতে লাগল। তারপর হঠাৎ মনে পরে গেছে এমন ভঙ্গীতে বলল –শোন, আজকে টিভিতে দেখলাম তোমাদের স্কুলের রজতজয়ন্তী হবে ডিসেম্বর মাসের তিরিশ তারিখ। রেজিস্ট্রেশন চলছে। যাবা নাকি?
আমি শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে বসতে বললাম –যেতে হয়। কতদিন স্কুলে যাই না! সেই দশ বছর আগে একটা রিইউনিয়নে গিয়েছিলাম। আর যাওয়া হয়নি। যেতে হবে এবার। তুমি যাবা নাকি?
-আমি গিয়ে কি করব? শুধু শুধু বসে থাকতে হবে। আমি যাবনা। তুমি একাই যেও।
আমি মুচকি হেসে বললাম –হুম, ঠিক। তোমার গিয়ে কাজ নেই। আমরা বন্ধুরা সব একসাথে আড্ডা দিব। সেই আড্ডায় বাইরের মানুষ থাকলে সমস্যা। আর স্মৃতিচারণ পর্বে কতজনের কত কিচ্ছা ফাঁস হবে কে জানে! তোমার না যাওয়াই উত্তম।
মিলিও মুচকি হেসে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল –আমি লাইট নিভিয়ে দিচ্ছি। পেপার রাখ।
আমি বললাম –আরেকটু বাকি আছে। একটু দাঁড়াও। পাঁচ মিনিট।
-এক মিনিটও দাঁড়ানো সম্ভব না। পেপার বাদ দাও। ঘুমাও। রাত কয়টা বাজে দেখেছো? কালকে অফিস আছে না? লাইট বন্ধ করে দিলাম।
মিলি লাইট বন্ধ করে মশারীর ভিতর ঢুকল। আমিও পেপার রেখে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম।
নতুন অফিসে কাজকর্ম ভালই লাগছে। কাজের পরিবেশ সুন্দর, নিজস্ব একটা গাড়ি আছে, আর মাসের শেষে ঐ মোটা অঙ্কের টাকা তো আছেই। কাজের চাপ থাকলেও কাজ করে শান্তি আছে।
-স্যার, এমডি স্যার আপনারে সালাম দিছে।
আমি একটা ফাইল চেক করছিলাম। চোখ তুলে তাকালাম। পিয়ন আজাদ দাঁড়িয়ে আছে দরজা ধরে। আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম –যাও, আসছি।
এমডি স্যার কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। আমাকে বসতে বলে উনি ফোনে কথা বলতে লাগলেন।
কথা শেষ করে উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন –কেমন আছেন মুহিত সাহেব?
-জ্বী স্যার, আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
-আছি আল্লাহ্র রহমতে ভালই। তা অফিস কেমন লাগছে?
আমি হেসে বললাম –ভাল লাগছে স্যার।
এমডি স্যার আমার দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললেন –দেখেন তো এই অর্ডারটা আমরা নিতে পারব কিনা?
আমি স্যারের হাত থেকে ফাইলটা নিলাম। নতুন একটা ডিজাইন। একটু অন্যরকমই মনে হচ্ছে। আমি বললাম –স্যার একটু চেক করে দেখতে হবে।
-দেখেন চেক করে। দেখে আমাকে জানান। আজকে তো ১৮ তারিখ। আপনি ২২ তারিখের মধ্যে আমাকে জানান।
-ওকে স্যার।
-আর আপনার স্কুলের রিইউনিয়ন আছে সামনে। আপনি যাচ্ছেন নাকি?
আমি কিছুটা অবাক হলাম। স্যার হঠাৎ এই প্রশ্ন করল কেন? মাথা নেড়ে বললাম –যাব ইনশাআল্লাহ্।
স্যার সম্ভবত আমার অবাক হওয়া ভাবটা ধরতে পারলেন। বললেন –আমিও ঐ স্কুলের ছাত্র। আমিও ইনশাআল্লাহ্ যাচ্ছি।
-তাই নাকি স্যার! আপনি কোন ব্যাচ?
-আসলে আমি ওখানে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছিলাম।
-ও।
-আর অনুষ্ঠানের মূল স্পন্সর হচ্ছে সামীর গ্রুপ। সো আমি যাচ্ছি।
-তাই নাকি! জানতাম না।
এমডি স্যার কিছু না বলে হাসলেন। -ঠিক আছে মুহিত সাহেব, আপনি আসুন। ফাইলটা চেক করে আমাকে জানান।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম –জ্বী আচ্ছা স্যার। আসসালামুয়ালাইকুম।
দিনকাল বেশ দ্রুত কেটে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে ৩০ ডিসেম্বর এসে গেল। আমি অধীর আগ্রহে এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কতদিন পর আবার স্কুলে যাব। স্কুলের সেই বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হবে। যাদের সাথে জীবনের স্মরণীয় দশটি বছর কাটিয়েছিলাম। খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জানলাম যে ২০-২৫ জনের মত আসবে।
সকাল থেকেই অনুষ্ঠান শুরু। চলবে সারাদিন। সকাল, দুপুর আর বিকেলে হবে স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান। আর সন্ধ্যায় হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমি সকাল সকালই চলে গেলাম। গাড়ি নিতে ইচ্ছা করল না। সারাজীবন স্কুলে এসেছি রিকশায়, আজকেও রিকশা নিলাম। স্কুলে পৌছলাম নয়টায়।
স্কুলকে দারুণভাবে সাজানো হয়েছে। মাঠে বিশাল প্যান্ডেল করা হয়েছে। মানুষজন এখনো খুব বেশি আসেনি। আমি স্কুল ঘুরে দেখা শুরু করলাম।
স্কুলের ক্লাসরুমের পাশে দিয়ে হাটছি আর জানালা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিচ্ছি। কত ছোট লাগছে ক্লাসরুমগুলোকে! ঐ বেঞ্চিগুলোতেই গাদাগাদি করে বসে ক্লাস করতাম। স্যাররা বোর্ডে অংক করাতো আর আমরা পিছনে বসে খাতায় ক্রিকেট খেলতাম। টিফিন পিরিয়ডে যদি টিফিন দুএকটা বেশি থাকত তবে ঐ টিফিন নিয়ে কাড়াকাড়ি করতাম। একই মাঠের মধ্যে একই গোলপোস্টে একই সাথে কয়েকটা টিম ফুটবল খেলতাম! পাশাপাশি তিন চারজন গোলরক্ষক দাঁড়িয়ে থাকত এক গোলপোস্টে!
হাঁটতে হাঁটতে টেবিল টেনিসের বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ালাম। টেবিল টেনিসের বোর্ড দখল করা নিয়ে সি সেকশনের সাথে সেই বাজি ধরা ম্যাচটার কথাও মনে পড়ছে, মাইনুদ্দিন যেই ম্যাচে অসাধারণ খেলে আমাদের জিতিয়ে দিয়েছিলো। আহা, কি অসাধারণই না ছিল সেই দিনগুলি!
ফোন বেজে উঠল। তমাল ফোন দিয়েছে। -হ্যালো, আসছিস?
-হুম আসছি আমি আর রাকিব। তুই কই?
-আমি টিটির বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
-দাঁড়া ঐখানে। আমরা আসছি।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। এখন চলছে স্মৃতিচারণ পর্ব। আমাদের ব্যাচের সবাই প্যান্ডেলের মাঝামাঝি বসেছি। কতদিন পর আমি, তমাল, রানা, রাকিব, জাহিদ, সাজ্জাদ, শান্ত, রুমি, মুন্না একসাথে হয়েছি। আরো অনেকেই এসেছে। আমরা অনুষ্ঠান খুব একটা দেখছি না। নিজেদের মাঝেই গল্প করছি।
হঠাৎ মাইকে আমাদের ব্যাচের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে শুনলাম। কাহিনী কি! আমাদের ব্যাচের নাম কেন মাইকে নিচ্ছে? নিজেদের মধ্যে আলোচনা বাদ দিয়ে কান খাড়া করলাম কি বলে শুনার জন্য।
-৮৭ ব্যাচের কেউ কি আছেন? আপনারা মঞ্চে আসুন। আপনাদের স্মৃতিচারণ পর্ব হবে এখন। কেউ কি আছেন?
সবাই ঠেলাঠেলি করে আমাকে পাঠিয়ে দিল। আমি মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলাম। কি বলব তাই চিন্তা করছি। কত ঘটনাই তো মনে পরে যাচ্ছে।
মঞ্চে উঠে মাইক হাতে নিলাম। -ধন্যবাদ আমাকে কিছু বলার জন্য। প্রিয় বন্ধুরা, বড় এবং ছোটভাইয়েরা, সবাইকে আসসালামুয়ালাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আশা করি সবাই ভালো আছেন। আমি আসলে কখনো এভাবে স্টেজে উঠে কথা বলিনি। আজ আমার বন্ধুরা আমাকে ঠেলাঠেলি করে পাঠিয়ে দিল। তাই এখানে আসা। স্কুল নিয়ে অনেক আনন্দের স্মৃতি আমার আছে। তবে আজ আমি আপনাদের একটা মজার ঘটনার কথা বলব। আমার যেই বন্ধুকে নিয়ে ঘটনাটা ঘটেছে তার নাম রাকিব। ও আজকে এখানে এসেছে।
তখন আমরা ক্লাস টেনে পড়ি। আমাদের স্কুলে দুইজন মিজান স্যার ছিলেন। একজন কৃষি মিজান স্যার। আরেক জন সাইন্সের মিজান স্যার। তো চেনার সুবিধার্তে আমরা কৃষি মিজান স্যারকে ডাকতাম কৃমি। আর সাইন্সের মিজান স্যারের চোখ ছিল ট্যারা। ওনাকে সংক্ষেপে ডাকতাম টিএম(TM)। মানে ট্যারা মিজানের সংক্ষিপ্ত রূপ। একদিন টিএম স্যারের ক্লাস। উনি তখনো ক্লাসে আসেননি। মন্ডল স্যার ক্লাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের ক্লাসে স্যার নেই দেখে উনি ক্লাসে ঢুকে বললেন, এখন কার ক্লাস?
রাকিব ছিল ক্লাস ক্যাপ্টেন। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল-স্যার এখন টিএম স্যারের ক্লাস। আমরা পুরা ক্লাস প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়লাম। রাকিব খুব দ্রুতই সামলে নিয়ে বলল-স্যার, এখন মিজান স্যারের ক্লাস। এদিকে আমরা হেসেই যাচ্ছি। টিএম স্যারের এই আনঅফিসিয়ালি নামটা সবাই জানত। মন্ডল স্যার আমাদের সামনে হাসতে না পেরে ক্লাসের বাইরে থেকে হেসে আসলেন। বললেন স্যার একটু পরেই আসবেন। তোমারা চুপচাপ বসে থাক। চিল্লাচিল্লি করো না। রাকিব এরপর আর কোনোদিন মিজান স্যারকে টিএম নামে ডাকেনি।
আমি কথা শেষ করলাম। সবাই বিপুল করতালির মাধ্যমে আমার স্মৃতিচারণের জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছে। ভাল লাগল। মানুষকে আনন্দ দেয়ার মাঝে অনেক আনন্দ আছে।
সারাটা দিন কিভাবে কেটে গেল টের পেলাম না। দেখতে দেখতে অনুষ্ঠান প্রায় শেষপ্রান্তে চলে এসেছে। উপস্থাপক আমাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য। তারপর বললেন –এবার সমাপনী বক্তব্য রাখবেন এই অনুষ্ঠানের স্পন্সর সামীর গ্রুপের এমডি সামীর আহমেদ। আমি সামীর আহমেদকে মঞ্চে আসার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
এমডি স্যারের নাম শুনে আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। স্যারের এই অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল। কখন এলেন টের পাইনি। আমি কথাবার্তা বন্ধ করে মঞ্চের দিকে তাকালাম।
এমডি স্যার মঞ্চে উঠলেন। মাইক হাতে নিলেন।
-এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে আসসালামুয়ালাইকুম। আশা করি আপনারা সবাই ভাল আছেন এবং এই অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন। সামীর গ্রুপ এই অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরে ধন্য হয়েছে। আমি সামীর গ্রুপের পক্ষ থেকে এই অনুষ্ঠানে আসার এবং অনুষ্ঠান সফল করার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আমি আপনাদের খুব বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না। আমি নিজেও এই স্কুলের একজন ছাত্র। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমি এই স্কুলে পড়েছি। এরপর আর পড়ালেখা আমার ভাগ্যে জোটেনি।
আমি চমকে উঠলাম কথা শুনে। চারিদিকের গুঞ্জন হঠাৎ করে থেমে গেল। বলে কি স্যার!
-আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখি আমার বাবা মারা গেছেন। আমার বাবা সামান্য বেতনের একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা ছিলেন গৃহিনী। আমি ছিলাম বাবা মার বড় সন্তান। আমার দুইজন ছোট ভাইবোন আছে। একজনের বয়স ছিল তখন ৮ বছর আর অন্যজনের ৫ বছর। বাবার পেনশনের সামান্য কিছু টাকা পেলাম আমরা। কিন্তু সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। আমি স্কুল ত্যাগ করি। এক দুঃসম্পর্কের চাচার মেশিনারী বিক্রির ব্যবসা ছিল। আমি ওনার ঐখানে চাকরি নেই।
ওনার ঐখানে প্রায় ৫ বছর চাকরি করি। আমার মা সংসার চালানোর জন্য সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। আমি অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে ৫ বছরে বেশ কিছু টাকা জমিয়ে ফেলি। মাও কিছু টাকা জমায়। ঐ টাকা দিয়েই আমি ব্যবসা শুরু করি।
আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আমার ব্যবসা ভাগ্য খুব ভাল। আমি এখন পর্যন্ত যত ব্যবসায় হাত দিয়েছি কোনোটাতেই ব্যর্থ হইনি। আল্লাহ্ আমাকে অনেক সম্পদ দিয়েছেন, অনেক। মোটামুটি শূন্য অবস্থা থেকে আমাকে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক করেছেন। কিন্তু একটা জিনিস আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন।
আমার শৈশব আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। আমি আমার সারা জীবনের অর্জিত সব সম্পদ দিয়েও এই শৈশব আর ফিরে পাব না। সেই অসাধারণ সময়টা আমি আর পাব না।
মাঝে মাঝে আমি যখন কোনো স্কুলের পাশে দিয়ে যাই, তখন কিছুক্ষণ গাড়ি থামিয়ে আমি বাচ্চাদের আনন্দ দেখি। বলতে দ্বিধা নেই আমার ঐ বাচ্চাদের দেখলে হিংসা হয়। তারা যেই বয়সটায় আনন্দ করছে , আমি সেই বয়সে এই ঢাকা শহরের একটা ছোট্ট অফিসে চাকরি করি।
আজকে আমি একটা ঘোষণা দিচ্ছি এখানে। আমি এই স্কুলের জন্য একটা ফান্ড করেছি। এই স্কুলের যেসব দরিদ্র ছাত্ররা পড়ালেখা করতে পারবে না, তাদের পড়ালেখার দায়িত্ব সামীর গ্রুপ ইনশাআল্লাহ্ বহন করবে। আর এই ফান্ড দেখাশুনা করবে এখানে উপস্থিত, আমার একসময়ের সহপাঠী, সামীর গ্রুপের মার্কেটিং ডিরেক্টর মুহিত আলম। আমি যদি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে আমি ৮৭ ব্যাচের সাথে পাশ করতাম। আমি ৮৩ সালের ক্লাস সেভেনের ডি সেকশনের ছাত্র ছিলাম।
আমি রীতিমত চমকে উঠলাম। বলে কি স্যার! উনি আমার সহপাঠি! ক্লাস সেভেন...............ক্লাস সেভেন........................আমার আবছা আবছা মনে পড়ছে। সেই রোগা, হালকা পাতলা ছেলেটা, সেই কি সামীর? হঠাৎ করে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল, সেই কি সামীর? ওর বাবা মারা গিয়েছিল শুনেছিলাম, এই সামীরই তাহলে সেই সামীর?
-আমি আমার বক্তব্য আর দীর্ঘায়িত করব না। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ কষ্ট করে আমার কথাগুলো শোনার জন্য। আসসালামুয়ালাইকুম।
স্যার তার বক্তব্য শেষ করলেন। সব মানুষ তাদের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। মুহুর্মুহু করতালিতে পুরো অনুষ্ঠান চত্বর মুখরিত হয়ে যাচ্ছে। আমিও সবার সাথে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছি।
[কিছু কথাঃ আমি তখন ক্লাস ফাইভে আলী আহমদ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি। একদিন একটা ছেলে আমাদের ক্লাসে আসে। ছেলেটাকে এর আগে দেখিনি। স্যার রোল ডাকার সময় ঐ ছেলেটার রোল ডাকলে সে প্রেজেন্ট দেয়। স্যার জিজ্ঞেস করেন-এতদিন কই ছিলি?
রফিক নামে আমার সেই সহপাঠী জবাব দেয়-স্যার বাসায় একটু সমস্যা আছিলো।
-তোর বাসা কই?
-গোড়ানেই বাসা।
-বাবা কি করে?
-রিক্সা চালায়।
আমি আশ্চর্য হই। আমার এক সহপাঠীর বাবা রিক্সা চালায় ব্যাপারটা মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়।
রফিক নামের সেই ছেলেটা কিছুদিন ক্লাস করার পর আবার উধাও হয়ে যায়। তারপর আর ওকে দেখিনি ক্লাসে। আমিও স্কুল চেঞ্জ করে অন্য স্কুলে ভর্তি হই। ক্লাস টেনে পড়ার সময় একদিন আমি দেখি ও রিক্সা চালাচ্ছে!
রফিকের সাথে আমি কখনি কথা বলিনি। কিন্তু এই ছেলেটার জন্যই আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। খুব খুব খারাপ হয়ে যায়।
নটরডেমে পড়ার সময় আমরা তিন বন্ধু একসাথে কলেজে যেতাম। একদিন সকালে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। রফিক তার খালি রিক্সা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ওর রিক্সায় চড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাই আমার ছিল না। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই আমার অন্য দুই বন্ধু রিক্সা ঠিক করে ফেলে। বাধ্য হয়ে তখন রফিকের রিক্সায় চড়েই আমার কলেজে যেতে হয়।
কিছুদিন আগেও দেখলাম রফিককে। এখনো রিক্সা চালায়। মাঝে মাঝে যখন নিজের জীবনে কি পেলাম আর কি পেলাম না এসব নিয়ে হাহুতাস করি তখন রফিকের কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পরে। আল্লাহ্ আমাকে অনেক ভাল রেখেছেন। অনেক অনেক ভাল রেখেছেন। এরচেয়ে বেশি ভাল থাকা সম্ভব না।]
উৎসর্গঃ সমস্ত রফিকদের। যাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় শৈশব হারিয়ে গেছে।
©Muhit Alam
©somewhere in net ltd.