![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চাঁদপুর লেডি প্রতিমা গার্লস হাই স্কুলে প্রাথমিক পর্ব শেষ করে গণি স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছিলাম আমি। লেডি প্রতিমায় সে সময়ে আমরা দু’জন মাত্র ছাত্র ছিলাম। আমি এবং অনুপ(চক্রবর্তী)। অনুপ ডিএন স্কুলে ভর্তি হয়।
১৯৬৫ সালের কথা। গণি স্কুলে ঢোকার মুখে হাতের ডান দিকে একটা বিশাল বকুল গাছ ছিল। ঢোকার মুখে বাঁ দিকে ছিল কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা বাগান। স্কুলের দালানটি যেখান থেকে শুরু হয়েছে প্রায় তার গা ঘেঁসে ছিল কুঁড়ে ঘর। এটাতেই থাকতেন ভুবন দা। পদবিতে তিনি ছিলেন দফতরি। কিন্তু দাপট ছিল।
সিদ্দীক স্যার বোধহয় তখন শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ। তিনি আমার মায়ের আপন এক মামারও শিক্ষক ছিলেন। সে সুবাদে আমি তার নাতি-ছাত্র - সে কথা একবার দুই বার শুনিয়েছিলেন। বয়স-জনিত কারণে তার ঘাড় কাঁপত। কিন্তু বাঘের থাবার মতোই শক্তিশালী ছিল তার থাপ্পড়। শুনেছি। খাইনি। মানে খাওয়ার মতো অপরাধ করার সাহস বা শক্তি কোনটাই ছিল না আমার। তবে ‘বেতাগাজি’র ওষুধ খেয়েছি অনেকবার। আমাদের ছাত্র জীবনে সব ছাত্র-ছাত্রীকেই এমন ‘মধুর’ দাওয়াই খেতে হতো। কারণ- অকারণে। কখনও ‘আদর’ করে দুয়েক ঘা ‘বেতাগাজি’ ঝেড়ে দিতেও দ্বিধা করতেন না কোনও কোনও শিক্ষক! আমরা এতে কিছুই মনে করতাম না। কারণ আমরা জানতাম শিক্ষক এবং মা-বাবা শরীরের যেখানে মারেন সে জায়গা বেহেস্তে যায়!আমার সেই নানা’র বড় ছেলে ওবায়েদও গণি স্কুলের ছাত্র ছিল।
অন্যদিকে প্রবীণ আরেক শিক্ষক ছিলেন দীনেশ চক্রবর্তী। হাতের বেতটা ছিল অলংকার । ব্যবহারের দরকারই পড়ত না। ধারালো বাক্যবাণ দিয়েই নাড়িভুঁড়ি ‘ছেঁদা’ করতে পারতেন। এ দুই শিক্ষকই ইংরেজি পড়াতেন।
দীনেশ স্যার ঘড়ি ধরে ক্লাসে ঢুকতেন। দেরি করতেন না। আর পড়ানো শেষ করতেন অমনি বেজে উঠত ঘণ্টা। এ হিসাবের হেরফের একবারই দেখেছিলাম। ক্লাস এইট বা নাইনের বছরের কথা। দীনেশ স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। চেয়ারে বসলেন। বেতটা রাখলেন সামনের টেবিলে । ‘বেমনা’ হয়ে তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে। আমরা হতভম্ব। ক্লাসে উশখুশ করছে। জানতে চাইলেন –আজ কি পড়ামুরে? –ভয়েস, স্যার। সৈয়দ কিংবা মামুন, আমাদের ক্লাসে দুই বেস্ট স্টুডেন্টের একজন হয়ত জবাব দিয়েছিল। জবাবটা শুনলেন বলে মনে হল না। খানিক পরে স্যার বললেন,-ভয়েস তোরা শিখে নিতে পারবি। তার চেয়ে লেখ। বলে বোর্ডে গেলেন। মুখে উচ্চারণ করতে করতে বললেন, Foe মানে শক্র Foe to the male= Female. একই ভাবে বললেন, woe মানে দুঃখ, বেদনা, কষ্ট হ্যাঁ woe to the man = woman. একটু থামলেন তারপর আবার লিখতে লিখতে স্যার বললেন, ইভের দেয়া আপেল খাওয়ার পর নিজ ভুল বুঝতে পেরে অ্যাডাম চিৎকার করে উঠেছিলেন, Ah! Man! What I’ve done! এই ah!man শব্দগুচ্ছ থেকেই woman শব্দটির জন্ম! বোর্ডের লেখা শেষ করে চেয়ারে এসে বসে রইলেন স্যার। সে দিনের ‘পুরা’ ইংলিশ পিরিয়ড এ ভাবেই শেষ হল। পড়ালেন না আর কিছুই।
এ ছাড়া, বসিরউল্লা স্যার, যাকে আমরা ‘বসুউল্লা’ স্যার বললাম, ইংরেজি পড়াতেন তিনিও। ক্ষেপে গেলে বেত চালাতে দ্বিধা করতেন না। হাতে না মেরে ' বেতে' মারার ব্যাখ্যা একবার দিয়েছিলেন ‘বসুউল্লা’ স্যার। -দেখ কনুই দিয়ে ‘কিলিয়ে’ পাকা ঝুনা নারকেল এখনও ছিঁড়তে এবং ভাঙ্গতে পারি। এই কনুই চালালে কি তোরা বাঁচবি। সত্যিই নাকি একবার ক্লাসে কনুই দিয়ে ঝুনা নারকেল ছেঁড়া দেখিয়েছিলেনও স্যার। তবে সেটা আমাদের ক্লাসে নয়।
এ ছাড়া বড় মজিদ স্যার পড়াতেন বাংলা। তার হাতেও বেত থাকত। ভোলা স্যার নামে আমাদের আরেক শিক্ষক ছিলেন। 'রাজরোগ' যক্ষ্মায় ভুগে মারা গিয়েছিলেন তিনি ।
শিক্ষকদের মধ্যে এরাই ছিলেন প্রবীণ। এ কয়েকজন শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ শিক্ষক ছাড়া, কাউকেই তেমন ছেড়ে কথা বলতেন না ভুবন দা’। ঘণ্টা পড়ে গেছে কিন্তু ক্লাসে যেতে কোনও শিক্ষক দেরি করছেন! ভুবন দা’র মোটেও সহ্য হতো না। বলতে শুনেছি, পোলা-পাইনরা এইখানে ধান-চাইল দিয়া পড়তে আইছে? ক্লাসে যান না কা স্যার।
হেডমাস্টার আবদুল কাদির স্যার ছিলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আলীগড়ের ডিগ্রিধারী। আমরা অবশ্য কাদির স্যারকে কাদের স্যার বলতাম। তবলিগ জামাতের কট্টর ভক্ত কাদের স্যারের পায়জামা সব সময় 'টাকনুর' ওপরই থাকত। হেডস্যারের হাতেও বেত শোভা পেত। শ্যাওলা কালো রং’এর লিকে লিকে বেতটি নাকি আসাম থেকে এনে দিয়েছিলেন ভুবন দা। এমন গপ্প শুনেছি। নিয়মিত খাঁটি সরিষার তেল মাখাতে হতো এতে। এও শোনা কথা। হেডস্যারের ওই ‘আসামি’ বেতের বাড়ি শেষ খেয়েছিলাম টেস্ট পরীক্ষার আগে ভাগে। আমি এবং হজরত আলীর কপালে এ ‘উপহার’ জুটেছিল। বাঁ হাতের তালুর দিকে তাকালে এখনও সেই বেতের বাড়ির দাগ দেখতে পাই! সেই বেতের গুণেই কি হজরত আলী দেশের নামকরা চক্ষু চিকিৎসক হতে পেরেছে!
কাদের স্যারের রসবোধও ছিল। আমাদের দুই তিন ব্যাচ সিনিয়র এক আদর্শ ছাত্র ছিলেন। জ্ঞানের প্রদীপ ছিলেন তিনি! বাসা থেকে বের হয়ে সোজা স্কুলে আসতেন। ছুটি শেষে সোজা বাসায় ফিরে যেতেন। ক্লাস ওয়ান থেকেই গণি স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। বাম-ডানে তাকাতেন না। দুষ্টামি-শয়তানি, সাত-পাঁচ কিছুতেই থাকতেন না সিনিয়র ভাইটি।
স্কুলের সামনে ২০/২২টা নারকেল গাছ ছিল। এ সব গাছের ডাব এবং নারকেল চুরির দায়ে কয়েকজন ছাত্রের নামের তালিকা কাদের স্যারকে দিলেন হোস্টেল সুপার হেড মাওলানা স্যার। সেখানে ওই আদর্শ বড় ভাইটির নামও ছিল। তিনি তখন ক্লাসে টেনের ছাত্র। কাদের স্যার ওর নাম দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, আপনি কি শিওর ও ডাব চুরি করছে? ডাব বা নারকেল শব্দ করে নিচে যেন না পড়ে যে জন্য দড়ি আড়াআড়ি ভাবে ধরা হয়। এতে চড়িয়ে দেয়া হলে মধ্যাকর্ষণের টানে নিঃশব্দে সাঁ সাঁ করে নিচে চলে আসে ডাব বা নারকেলের ‘কাদি।’ হেড মাওলানা স্যার বললেন- স্যার ও দড়ি ধরে ছিল। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
কাদের স্যার সবার নামের পাশে জরিমানা লিখে দিলেন। কেবল মাত্র ওই নাম কেটে দিলেন। বললেন-ওরে দুইটা টাকা দিয়া দিয়েন। এতদিন পরে পোলাটা দুষ্টামি শিখতাছে!
অন্যদিকে আমাদের ড্রিল টিচার ছিলেন রফিক স্যার। সবুজ চোখ। ঘন দাড়ি। চশমা পড়তেন। তার হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছিলাম। সম্ভবত ক্লাস এইটের বছরেই। সেই মারের দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। কথাটা বলেছিল আমাদের শ্রেণি-বান্ধব বা ক্লাসফেন্ড সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী জয়নাল। জয়নাল ‘বিড়ি’ ফোঁকা শিখেছিল স্কুলে থাকার সময়ই।
ছোট মজিদ স্যার ছিলেন ‘বেতাগাজি’র ব্যবহারে সিদ্ধ এবং উদার হস্ত। ‘বেতাগাজি’ শব্দটিও তারই আবিষ্কার বলেই শুনেছি!
সেকালে গণি স্কুলে যে সব শিক্ষক ছিলেন তারা কেউই মামুলি শিক্ষক ছিলেন না। প্রত্যেকেই জানতেন কি করে ছাত্র পড়াতে হয়। এতকাল পরে মনে হয়, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন মহাশিক্ষক। আমরা তখন ঢাকা ছিলাম অজ্ঞতা, মূর্খতা আর অনভিজ্ঞতার চাদরে। বয়স ছিল নিতান্তই কম। এ কারণে তাদেরকে সঠিক ভাবে চিনতে পারি নি। বুঝতেও পারি নি তাদরে কদর। আজ নিশ্চিত যে এখন আবার তাদের দেখা পেলে, আমরা সবাই দলে দলে কদমবুসি করে দোয়া চাইতাম তাদের।
আরেকটা কথা, টিউশনির এই ঘোর কলির যুগে স্বীকার করতেই হবে। সে যুগেও শিক্ষকদের গোলাভরা ধান বা পুকুর ঝোঝাই মাছ ছিল না। তাদের ঘরে আর যাই থাক না থাক অভাবের কমতি ছিল না। চাল-ডাল ‘বাড়ন্ত’ হতো মাস ফুরাবার আগেই। ‘নুন আর পান্তা’ একই সময়ে পাতে পড়ার ঘটনা কমই ঘটত। তারপরও সে যুগে টিউশনি করার চিন্তা সাধারণ ভাবে করতেন না কোনও শিক্ষক।
সতীর্থদের মধ্যে সে সময়ে যারা বিখ্যাত হয়েছিল তাদের মধ্যে নান্নু একজন। বেঁটে হলে কি হবে দুর্দান্ত বাস্কেট বল খেলত। বল হাতে গেলেই স্কোর! এ ছাড়া, সাঁতারেও তুখোড় ছিল। তোফাজ্জলও সাঁতার এবং দৌড়ে অপরাজেয় ছিল। বডি বিল্ডার ছিল। আন্তঃ স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় গণি স্কুলের অত্যন্ত ভাল করার পেছনে নান্নু- তোফু বা তোফাজ্জলের অবদান ছিল।
অন্যদিকে আয়ুইব আলীকে হাত-পা বেঁধে বস্তায় ঢুকিয়ে পানিতে ফেলে দেয়া হত। ও একনাগাড়ে ভেসে থাকত ২৪ কি ৪৮ ঘণ্টা। মাঝে মাঝে বস্তার মুখ খুলে ওকে খাবার দেয়া হত। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্য! এও সম্ভব! খোদ এসডিও সাহেব এ রকম অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করতেন। ইলেকট্রিক তার টেনে, লাইট লাগিয়ে মাইক বসিয়ে টাউন হলের কাছের ঝিলে এমন আয়োজন করা হত। চাঁদপুর জুড়ে সাড়া পড়ে যেত। চাঁদপুরের বাইরে থেকে লোকজন আসতে দলেদলে। ঝিলের চারপাশে ভিড় লেগে থাকত দিনরাত। এতে গণি স্কুলের নামও ফাটত!
পাঠ্য বইয়ের চেয়ে ‘অ-পাঠ্য’ বইয়ে যাদের ভক্তি বেশি আমি সে দলের এক ‘বান্দর।’ গণি স্কুলে এ কাজের সাথী পেয়েছিলাম। এদের মধ্যে কামাল ছিল প্রাতঃস্মরণীয়। ক্লাসে পড়ালেখায় কখনওই ভাল করে নি সে। কিন্তু ট্রাংক ভরা উপন্যাস আর নোবেল ছিল তার। ছিল অনেক ডিটেকটিভ বই। দস্যু মোহন সিরিজের অনেক বই তার কাছে থেকে নিয়ে পড়েছি। সেবা থেকে প্রকাশিত রহস্য পত্রিকার প্রথম দিকের একটা সংখ্যায় কামালের ছবিসহ চিঠি প্রকাশ পেয়েছিল। মাসুদ রানার প্রথম আমাদের পড়তে দিয়েছিল কামালই। বইয়ের প্রথমেই লেখা থাকতে কেবলমাত্র প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য। ওর নামটা ভুলে গিয়েছিলাম। মনে করিয়ে দেয় খলিল। খলিলও ছিল গপ্পের বই পড়ুয়াদের দলে। আর ছিল হজরত আলী। এদের কথা শেষ হওয়ার নয়।
ভুবন দা’র কথায় আবার ফিরছি। ভুবন দা’র সন্তানরা তখন নাকি আসামে থাকতেন। স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তারা। তাদের কাছে যেয়ে পায়ের ওপর পা দিয়ে কাটানো মোটেও কষ্টকর ছিল না ভুবন দা’র জন্য। একবার চলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু থাকতে পারেন নি বেশিদিন। আসামে বসেও গণি স্কুলে ঘণ্টাধ্বনি কানে বাজত তার। তাই বেশি দিন থাকতে পারেন নি। আসামকে বিদায় জানিয়ে ভুবন দা ফিরে আসেন গণি স্কুলের ওই কুটিরে।
পরীক্ষার হলে ভুবন দা’ কখনও কখনও জরুরি প্রয়োজনে গার্ড দিয়েছেন। বেত হাতে ঘুরতেন তখন ভুবন দা’। নকল করাকে আমরা ‘চোতা,’ বা ‘তাবিজ’ বলতাম। ভুবন দা গার্ডে থাকলে ‘চোতা’ বা ‘তাবিজের’ কথা ভুলে যেত এ কর্মের বিশেষজ্ঞরা। আমাদের সময়ে অনেকেরই এ কাজের দক্ষতা বিশ্ব মানের ছিল। এ কথা তারা গর্ব করে বলত।
ভুবন দা গার্ডে থাকলে ‘চোতা মারা’ তো দূরের স্বপ্ন, ঘাড় ঘোরানো বা ফিসফিস করে কথা বলাও ছিল অসম্ভব।
মেট্রিক পরীক্ষার হলে নকল ধরা পড়লে অপরাধী ছাত্রকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেয়ার পক্ষে ছিলেন ভুবন দা’। কখনও ছাত্রকে বহিষ্কার করার কথা বলেন নি। এটা কাদের স্যারেরও নীতি ছিল। সেকালে মফস্বল স্কুলের ছাত্রদের মেট্রিক পরীক্ষার সিট পড়ত গণি স্কুলে। নকল হাতে নাতে ধরা পড়ার পর তাদের অনেককেই কঠিন বেত্রাঘাতের কথা শুনেছি।
আমাদের গণি স্কুলের ক্যান্ডিডেটদের সিট পড়ত শহরের কোনও স্কুলে। ১৯৭০ সালের মেট্রিক পরীক্ষার ছাত্রদের সিট পড়েছিল লেডি প্রতিমা গার্লস হাই স্কুলে। অর্থাৎ যে স্কুল থেকে স্কুল জীবনের শুরু সে স্কুলেই স্কুল জীবনের শেষ মহাপরীক্ষা দিয়েছিলাম। আর গার্ড দিয়েছিলেন পুরান বাজারের একটা স্কুলের শিক্ষকরা। স্কুলের নামটা ভুলে গেছি। জুবলি স্কুলে সিট পড়া নিয়ে একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটেছিল ’৭০ সালের আগে। সে কারণে, আমাদের জানা মতে ওখানে আর গণি স্কুলের ছাত্রদের সিট পড়ে নি।
স্কুল শুরু হওয়ার আগের এবং স্কুল শেষ হওয়ার পরের ভুবন দা’র সঙ্গে স্কুল চলাকালের ভুবন দা’র কোনও মিল ছিল না। বড় কঠোর ছিল সে সময়ে তার ব্যবহার। কিন্তু অন্য সময়ে ভুবন দা’ ছিলেন মাটির মানুষ। যে কোনও প্রয়োজনে ছাত্ররা প্রথম ছুটত ভুবন দা’র কাছে। কি করতে হবে সঠিক ভাবে বাতলে দিতেন তিনি। অবশ্য স্কুল চলাকালে ছাত্রদের ‘লাই’ দিতেন না ভুবন দা’। মানে ক্লাস ছেড়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে দিতেন না তিনি। টিচার যেতে দেরি করলে হই চই করা ছাত্ররা নিজেদের মানবাধিকারের অংশ হিসেবেই মনে করে। কিন্তু এ অধিকারকে পাত্তাই দিতেন না ভুবন দা’। কড়া গলায় ধমক দিতেন ছাত্রদের। প্রয়োজনে বেত হাতে হাজির হতেন। একজন দফতরি কড়া ধমক দিচ্ছে বা বেত মারছে- এ নিয়ে কখনও কেউ কিছুই মনে করে নি। কারণ ভুবন দা’কে সবাই গণি স্কুলের স্কুলের প্রধান একটা অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছিল।
ভুবন দা বয়সে নাকি কাদের স্যারেরও বড়। কাদের স্যার নাকি গণি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ভুবন দা নাকি বলেছেন, ওই 'কাদেইরাকে' কতবার কানে ধইরা ক্লাসে ঢুকাইছি। এ কথাটা সত্যি কিনা কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ভুবন দা’ প্রশ্নের জবাব দেন নি। হেসেছিলেন। যারা দেখেন নি তার বুঝতে পারবেন না হৃদয়ের কতো গভীরে স্পর্শ করতে পারতে ভুবন দা’র ওই ফোকলা দাঁতের হাসি।
ভুবন দা’কে নাকি খুবই সম্মান করতেন কাদের স্যার। এও শোনা। চাকরির বয়স শেষ হওয়ার পরও হিসাবের কারসাজি করে ভুবন দা’কে চাকরিতে রেখে দিয়েছিলেন কাদের স্যার। এটা সবাই জানতেন।
কাদের স্যার ছিলেন কড়া টাইপের মানুষ। ছাত্রদের কঠিন শাস্তি দিলে আড়ালে তাকে নাকি ভুবন দা বলতেন, কাদেইরা তোরে কতবার কানে ধরে ক্লাসে ঢুকাইছি মনে আছে? এরপর কাদের স্যার চুপ হয়ে যেতেন। ভুবন’দার ‘আপত্তি’ মেনে নিতেন। কিন্তু কারো সামনে কখনও কাদের স্যারের সঙ্গে কোনও ধরণের ‘হালকা’ আচরণ করেন নি ভুবন দা।
ক্লাস এইটের বছরে মুন্সেফের বাড়ির সামনের পুকুর আমাকে বিপদে ফেলল । পানি পচে মাছ ‘গাবানো’ শুরু হলো। অর্থাৎ মাছ লাফিয়ে উঠতে শুরু করল। ঘটনাটা ঘটল স্কুল শুরু হওয়ার কাছাকাছি সময়ে। সাথেসাথেই মাছ ধরার এক মচ্ছব লেগে গেল।
স্কুলে বেশির ভাগ ছাত্র পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। কেউ কেই মাছ ধরতেও নেমে গেল। দর্শকের দলেই ছিলাম আমি। স্কুল শুরু হওয়ার ঘণ্টা শুনে তাড়াহুড়া করে ফেরার পথে ঘটল ‘গ্যাঞ্জাম।’ ‘প্যাঁকে’ পা পিছলে ‘বিশাল’ আছাড় খেয়ে প্যান্ট বরবাদ হয়ে গেল। সার্টটা বাঁচল নেহাৎ ভাগ্যগুণে।
প্যান্ট বদলাতে বাসায় ছুটলাম। স্কুলে ফিরলাম দ্বিতীয় পিরিয়ড চলার সময়ে। ততক্ষণে গর-হাজির ছাত্রদের নামের তালিকা সুন্দর করে পাঠিয়ে দিয়েছে ক্লাস ক্যাপ্টেন করিম পাটোয়ারী।(আমার ধারণা বেহেস্তে বসেও সমান তালে ক্যাপ্টেনগিরি ফলাচ্ছে করিম, আর ওকে তাল দিচ্ছে জি.এম.ভুঁইয়া(স্বপন), রোরহান, মুস্তাফিজ, ফারুকসহ আমাদের বাকি বন্ধুরা, যারা এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছে অকালেই। ওরা ওপারে আমাদের জন্য ভাল জায়গা ‘রিজার্ভ’ করে রাখছে! আমরা যেভাবে আগে এসে সামনের সিটে খাতা রেখে জায়গা রিজার্ভ করতাম। শুধু নিজের নয় অন্যদের জন্যও! তাই, বিশ্বাস করি, আকাশের ওপারের পৃথিবীতে এখন গেলে কোনও অসুবিধাই আর হবে না!)
বেতন দিতে যেয়ে টের পেলাম সর্বনাশের সাড়ে বারোটা বেজেছে। বেতনের ডাবল জরিমানা হয়েছে সেদিনের ক্লাস ‘ফাঁকি’ দেয়ার বিশাল অপরাধে। দরখাস্ত হাতে গেলাম। কেরানি স্যারকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। লাভ হলও না। তিনি সাফ বলে দিলেন, এ জরিমানা কারোই মাফ করা হয় নাই। হবেও না। কাদের স্যারের কড়া অর্ডার।
কিন্তু আমি তো... কেরানি স্যার থামিয়ে দিলেন। জরিমানা মাফের দরখাস্তও রাখলেন না। বরং বললেন- লাভ নেই বকবকানিতে। জরিমানার টাকা দিতেই হবে। সে সময়ে ভুবন দার কথা আশ্চর্যজনক ভাবে মনে হল। অফিস ঘরের সামনেই ছিল হেডস্যারের রুম। সেখানেই পেলাম ভুবন দা’কে। সাধারণত ওখানেই থাকতেন স্কুল চলার সময়। পুরা ঘটনা খুলে বললাম। ভুবন দা বললেন, দে দরখাস্তটা। টিফিনের পর আসিস। আমার মা-বাবা দু’জনেই শিক্ষক ছিলেন সে কারণে হয়ত খানিকটা খাতির করতেন ভুবন দা।
গেলাম। অবাক হয়ে দেখলাম- লাল কালি দিয়ে জরিমানা মাফের কথা লিখে দিয়েছেন হেডস্যার। কেরানি স্যারকে দেখালাম। দরখাস্তটা নিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। এবং হেডস্যারের রুমের দিকে দ্রুত চলে গেলেন। কতক্ষণ পরে ফিরে আসলেন। -হ সত্যিই তোর জরিমানা মাফ করছেন স্যার। সিগনেচার জাল না। তা আইজ কি বেতন দিবি? দিলাম। টাকাটা সাথেই ছিল।
ভুবন দা’ পরকালে অনেক দিন আগেই চলে গেছেন। আমার মনে প্রশ্ন একটাই, ওখানে বসে আজও কি গণি স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পান তিনি!#
২৩ শে জুন, ২০১৮ রাত ৮:২৪
সৈয়দ মূসা রেজা বলেছেন: ধন্যবাদ।
২| ২৪ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:৪১
রাজীব নুর বলেছেন: অতীত দিনের সৃতি চারন ভাল লাগলো।
৩| ২৪ শে জুন, ২০১৮ রাত ৯:৩৯
সৈয়দ মূসা রেজা বলেছেন: স্মৃতিচারণ ভালো লাগার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
৪| ২৭ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৪:৪১
রাজীব নুর বলেছেন: মন্তব্যের উত্তর দিতে হবে ভাই।
২৭ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১২
সৈয়দ মূসা রেজা বলেছেন: কষ্ট করে মন্তব্য করবেন এবং তাতে প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই উত্তর দিবো। এটা মন্তব্যকারীর অধিকার। ধন্যবাদ ভাই।
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে জুন, ২০১৮ রাত ৮:১৭
কাইকর বলেছেন: ব্লগে স্বাগতম