![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দগদগে ক্ষত তখন মানুষের সামনে। ইতালির চলচ্চিত্রশিল্প একদিকে যেমন ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের মুখে দাড়িয়ে ছিল, পরে বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে চলচ্চিত্রের পরিকাঠামোও ধ্বংসপ্রায়। বিরুদ্ধসময়ে ইতালিতে নব্যবাস্তববাদী আন্দোলনের সূচনা। নির্মাতারা তখন স্টুডিরও বদলে বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস্তব দৃশ্যকল্পের সামনে গল্প বলার কৌশল আয়ত্ত করছেন। ভিক্তোরিয়া দি সিক্কার ‘দ্যা বাইসাইকেল থিভস’ এই আন্দোলনেরই চলচ্চিত্র। ক্যামরোয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে জনজীবনের অর্থনীতির কষাঘাত ও হতাশা ফুটে উঠছে। ভারতে সত্যজিৎ রায়ের আর্বিভাব সেই বিক্ষুব্ধ সময়ে। বিশ্বরাজনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাত ভারতের ভঙ্গুর সামন্তীয় সমাজজীবনে কেমন- তা প্রত্যক্ষ করতে করতে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় নামের মহীরুহের উত্থান। সত্যজিৎ এই নব্যবাস্তববাদী আন্দোলনে ভীষণ প্রভাবিত হয়ে ‘পথের পাঁচালী’কে স্টুডিও’র প্রথাগত চিত্রায়ণ থেকে বের করে আনেন। ওয়াইড শটে “কাশবনের মধ্য দিয়ে ট্রেন চালিয়ে দেওয়ার” দৃশ্যটি ভারতীয় চলচ্চিত্র ও জনজীবনে বহু কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। দৃশ্যটি নিছক অপু-দুর্গার প্রাণোচ্ছল কৈশোরজীবনের অংশ নয়। বিভূষিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের নিছক গ্রামীণ পটভূমি সত্যজিতের স্পর্শে যান্ত্রিক জনজীবনের হাতছানি হয়ে উঠেছে। ট্রেনের ধোয়া উড়ে যাওয়া সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটা যেন হু হু করে ওঠে, যেন ঔপনিবেশিককালোত্তর হাহাকার। সবকিছু ছাপিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্যে চিত্রায়ণের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি ভারতে সফলভাবে তিনিই প্রথম প্রয়োগ করেছেন। সত্যজিৎ রায় ও তার অনবদ্য সৃষ্টি পথের পাঁচালী ভারতীয় চলচ্চিত্র এভাবেই অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। অস্কারের বদৌলতে এই বিষয় দুটো বেশ আলোচিত হলেও তাকে বোঝার আরো বহু পাঠ আমাদের সামনে পড়ে রয়েছে। ২৩ এপ্রিল তার প্রয়াণদিবস। বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই নির্মাতার অবদান মহাকাল অবধি শেষ হওয়ার নয়।
চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধে ফরাসি নির্মাতা জ্যাঁ রেনোয়া তার ‘দ্যা রিভার’ চলচ্চিত্রের কাজে ভারতে এসেছিলেন। সে সময় সত্যজিৎ তাকে সহায়তা করেছিলেন। সত্যজিতের চলচ্চিত্রপ্রেম এখান থেকেই বিশালতা লাভ করেছে। প্যারিসে তখন নতুন সম্পাদান কৌশল, শট নেওয়ার নিত্যনতুন ধরন, চরিত্রের সজ্জাহীন উপস্থাপনাসহ বেশ কিছু কৌশল নতুন মাত্রা পেয়েছে। চলচ্চিত্রের ধ্রুপদী ব্যাপারস্যাপরগুলো প্যারিসে ‘ফরাসি নব তরঙ্গ আন্দোলন’ রূপে বিকশিত হচ্ছে তখন। জাঁ রোনোয়া, এরিক রোহমার, জ্যাঁ লুক গদার, আদ্রে বাঁজিনরা তখন নবতরঙ্গের নির্মাতা। সত্যজিৎ রেনোয়ার সংস্পর্শে এর দ্বারাও ব্যপক প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর চারুলতা, সমাপ্তি, মহানগর, জলসাঘর প্রভৃতি চলচ্চিত্রে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পথের পাচালি’র পরের ‘অপুর সংসার’ ও ’অপরাজিত’ চলচ্চিত্রেও এসবের প্রভাব দেখা যায়।
সত্যজিৎ যখন এই অঞ্চলে সিনেমা বানাচ্ছেন তখন লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকায় চলচ্চিত্রের আরেকটি আন্দোলন ষাটের দশকে ‘তৃতীয় চলচ্চিত্র’ হিসেবে বেশ সাড়া ফেলছে। বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রিকা ও এশিয়ায় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চলছে। এ সময় ‘তৃতীয় চলচ্চিত্র’ নামের ধারাটি স্বজত্যবোধের আকাঙ্ক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। লাতিন আমেরিকার ফার্নান্দো গিলেটিনো, অক্টাভিও সোলানাস, আফ্রিকার ওসমান সেম্বেনের পাশাপাশি আমাদের মৃণাল ও ঋত্বিকরাও এখানে সমুজ্জল। তৃতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অভিযোগ, ইউরোপীয় ধ্রুপদী শিল্প অ-ইউরোপীয় বিশ্বের মানুষের জনজীবনের সংকট ধারণ করতে ব্যর্থ। সমালোচকরাও তখন বলতেন, সত্যজিতও এখানে অপেক্ষাকৃত কম মনোযোগী। সমালোচকদের কাছে এ সম্পর্কিত তার জবাব ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ চলচ্চিত্রটি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যস্ত, এদিকে সদ্যস্বাধীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সঙ্কট, ভারতের বামপন্থী নকশাল আন্দোলন- সবকিছুই যেন এই চলচ্চিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। তার ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র এখনো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ। পথের পাচালির সিকুয়্যালও তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গির সেলুলয়েড। মধ্যবিত্তের জীবনের নগরজীবনের নিদারুণ রূপ ফুটে তুলেছেন ‘মহানগর’ সিনেমায়। জমিদারিপ্রথার উচ্ছেদের পরবর্তী সময়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের সামাজিক জীবনের রূপ চিত্রায়িত হয়েছে ‘জলসাঘর’ চলচ্চিত্রে, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জীবনের কতটা বাস্তব হয়ে ওঠে তা ‘অশনি সংকেত’ না দেখলে বোঝা যাবে না।এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের সংকট কতভাবে ব্যাখা করা যায়, তাই ছিল ‘রাজনৈতিক নির্মাতা’ সত্যজিতের চেষ্টার পুরোভাগে। বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি ধ্রুপদী নির্মাণের পাশাপাশি এভাবেই একজন শক্ত রাজনৈতিক নির্মাতা হয়ে উঠেছেন। সত্যজিৎ মোটামুটি ৩২ টি সিনেমার নির্মাতা. এর প্রতিটি গল্প ও নির্মাণই স্বতন্ত্র।
কয়েক মাস আগে সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় মারা গেলেন। সত্যজিতের সঙ্গে তার জুটি বাংলা চলচ্চিত্রে বেশ আলোচিত বিষয়। সত্যজিতের সকল অনবদ্য নির্মাণে সৌমিত্র নামটি সবার আগে সামনে আসে। যাকে দিয়ে তিনি ফেলুদা নামক গোয়েন্দা সিরিজের বেশিরভাগ করিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের পাঠক থেকে সিনেপ্রেমীদের কাছে ফেলুদা ছাড়া কোনো শক্তিশালী গোয়েন্দা সাহিত্য আছে? নিশ্চয়ই নেই।
সত্যজিৎ রায় বিশ্ব চলচ্চিত্রের একজন অবশ্য পাঠ্য বিষয়বস্তু। তিনি এমনই নির্মাতার যার নির্মাণশৈলী মানুষের রাজনৈতিক সংকটকে যেমন স্পর্শ করতে পেরেছে তেমনি ধ্রপদী ও নান্দনিক শিল্পের বিচারেও তা অনন্য। উভয়ের সম্মিলন ঘটাতে পেরেছে বিশ্ব চলচ্চিত্রে এমন নির্মাতা কমই পাওয়া যাবে।
©somewhere in net ltd.