নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবনের কথা বলি

নাসির আহমেদ কাবুল

নাসির আহমেদ কাবুলের জন্ম ১৯৬০ সালের ৬ জানুয়ারি বৃহত্তর বরিশাল জেলার মঠবাড়িয়া থানার ব্যাংকপাড়ায়। পিতা আনছার উদ্দিন আহমেদ ও মা পিয়ারা বেগমের দ্বিতীয় পুত্রসন্তান তিনি। ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের এগার দফা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে স্কুল জীবনেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৭১ সালে শারীরিকভাবে যুদ্ধ করার ক্ষমতা না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন তিনি। ছাত্র ইউনিয়ন, খেলাঘর আসর ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী লেখকের প্রিয় সংগঠন। লেখালেখি শুরু কিশোর বয়স থেকে। ১৯৯৪ সালে তিনি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকারের স্বীকৃতি লাভ করেন। এ যাবত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭টি। এর মধ্যে ৪টি উপন্যাস, দু’টি শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ও একটি কবিতাগ্রন্থ রয়েছে। এ ছাড়াও কবিতা, গল্প ও শিশুতোষ গল্পের বেশ কয়েকটি সম্পাদনা গ্রন্থ রয়েছে তার। তিনি সাহিত্য ম্যাগাজিন জলছবি বাতায়নের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) বাংলা সার্ভিসে কর্মরত।

নাসির আহমেদ কাবুল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোট গল্প : কষ্ট

০৩ রা জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:৩২



[ গল্পের কাহিনী লেখকের ব্যক্তি জীবনের কোথাও মিল থাকতেই পারে। তবে অন্য কারও জীবনের সঙ্গে মিলে গেলে সেটা কাকতলীয়।]



অনিন্দ্যর গোপন একটা দুঃখবোধ আছে। সব মানুষেরই যেমন থাকে। কারও বড়লোক না হওয়া, গাড়ি-বাড়ি না থাকা, আবার কারও কারও সন্তান না হওয়ার দুঃখ খুব সাধারণ। জীবনের প্রতিটি যোগফল মিলে যাওয়ার লোক খুব কমই আছে এ জগৎ-সংসারে। এই বিরাট পৃথিবীতে কষ্টে নেই, এমন মানুষ হয়তো পাওয়াই যাবে না! তাহলে অনিন্দ্যর কেন দুঃখ থাকবে না! সে তো অন্য পাঁচজনের মতোই। অসাধারণ কেউ নয় অনিন্দ্য! তারপরও অনিন্দ্যর দুঃখটা একটু আলাদা, অন্য পাঁচজনের মতো নয়। পড়ন্ত বিকেলে এবং সন্ধ্যায় এমন করেই ভাবে অনিন্দ্য। ওর এই ভাবনা নিরন্তর।

মফস্বল শহরের পোড় খাওয়া মধ্যবিত্তের সংসার ছেড়ে অনিন্দ্য যখন ঢাকায় আসে তখন বুড়িগঙ্গা বিষাক্ত ছিলো না। ঢাকা তখন ব্যস্ত নগরী ছিলো না একটুও। এতো এতো দালান-কোঠার ঠাসাঠাসি ছিলো না এ নগরীতে। জহুরুল ইসলামের বাইশ তলা নাভানা বিল্ডিং আর ডিইটির ঘড়ি ছাড়া হাইকোর্টের মাজার ছিলো মানুষের কৌতূহলের বিষয়। রমনা পার্কে মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্য খুঁজে বেড়াতো। যদিও ঢাকার রাজপথগুলো ছিলো বৃক্ষশোভিত। মানিক মিয়া এভিন্যুর এখনকার প্রশস্ত রাস্তা এমন ছিলো না তখন। আসাদ গেট পর্যন্ত রাস্তাটি পরিপূর্ণ ছিলো গাছে গাছে। চৈত্রের তাপ থেকে বাঁচতে মানুষ সেসব গাছের নীচে আশ্রয় নিতো। টুংটাং রিকশা চলতো, বাস চলাচল শুরু হয়নি তখনও এ রাস্তায়। সন্ধ্যায় নিয়নের আলো-আঁধারীতে গা ছমছম পরিবেশ ছিলো মানিক মিয়া এভিন্যুর। অনিন্দ্য তখন এ রাস্তায় হেঁটে বেড়াতো একা একা।

মফস্বল শহরের ছেলে বলে শহরে তখনও অনিন্দ্যর বন্ধু জোটেনি তেমন। বন্ধুত্ব করার কিছুই ছিলো না অনিন্দ্যর। কলেজ জীবনের বন্ধুরা যখন বেলবটম পড়ে বেড়াতো, টু-ইন ওয়ানের গানের ক্যাসেট হাতে অহংকারের দীঘিতে ডুবসাঁতার খেলতো, অনিন্দ্যর হাতে তখন একটা ঘড়িও ছিলো না। তবে ঘড়ি পরার খুব ইচ্ছে ছিলো অনিন্দ্যর। গ্রামের রংচটা তারুণ্য নিয়ে শহরের উজ্জ্বল আলোতে খেই হারিয়ে ফেলা অনিন্দ্য মানিক মিয়ার এভিন্যুর রাস্তায় একা একা হেঁটে বেড়াতো। পথের পাশে আগাছার মধ্যে খুব তীক্ষè চোখ বোলাতো অনিন্দ্য- যদি একটা ঘড়ি কুড়িয়ে পাওয়া যায়!

এসএসসি পাস করে তিতুমীর কলেজে ভর্তি হয় অনিন্দ্য। বড়লোক ভগ্নিপতির বাসায় আশ্রয়ে থেকে রেশন তোলা, বাজার করা আর ফুটফরমাস খাটার পর কলেজে যাওয়ার সময় পার হয়ে যেতো প্রায়ই। গোরানবাজার থেকে পৌনে এক ঘন্টার রাস্তা পায়ে হেঁটে মালিবাগ মোড়ে পৌঁছে গুলশানগামী ছয় নম্বার বাসে বাদুরঝোলা হয়ে কলেজে পৌঁছানো সহজ কথা নয়। তবু অনিন্দ্য চেষ্টা করতো। বাসের একটু জায়গা করে নেয়ার জন্যে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কতবার ছিটকে পড়েছে সে কথা আজও মনে পড়ে তার। ঘড়ি না থাকায় আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় গোণার চেষ্টা করতো সে। মেঘলা আকাশ হলে অন্যের কাছে সময় জানতে চাইতো অনিন্দ্য। ঠিক সে সময় কষ্টটা কেমন ডালপালা বিস্তার করতো। আচ্ছন্ন করে রাখতে অনিন্দ্যকে।

অনিন্দ্যর কোন পড়ার টেবিল ছিলো না। বইগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতো এখানে-ওখানে। অনিন্দ্যর ছোট দু’টি ভাগ্নে-ভাগ্নি বইয়ের পাতা ছিড়ে নৌকো বানাতো। মামা বলে কিছুই বলতে পারতো এসবের জন্য। কলেজ থেকে ফিরে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত খোলা বারান্দায় স্টিলের একটি চেয়ারে বসে হাঁটুর ওপর হিসাব বিজ্ঞানের মোটা বই খুলে অংক কষতো। রাতে ষাট ওয়াটের ম্লান আলোয় পড়ার সুযোগ খুঁজতো অনিন্দ্য।

আজকাল সন্ধ্যাবেলায় লেখালেখির টেবিলে ল্যাপটপের বোতাম টিপতেই পুরনো কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অনিন্দ্যর। কম্পিউটার স্ক্রিনে ঘড়ির কাঁটা ত্রিশূলের মতো বাজে বুকে। পাশেই দামী হাতঘড়ির দিকে তাকায় ঝাপসা দৃষ্টিতে। কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে যায় তার। একবার একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে, ‘ক’টা বাজে অনিন্দ্য?’ অনিন্দ্য তখন আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো। মেঘে ঢাকা সূর্যকে দেখতে না পেয়ে আন্দাজ করতে পারলো না সময়টা কত। ‘ঘড়ি নেই তোমার?’ - মেয়েটির কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি অনিন্দ্য। এসব এখন খুব পুরনো স্মৃতি। কিন্তু কষ্টটা খুব টাটকা। শীতের সকালে নতুন সবজির মতো। বিন্দু বিন্দু শিশির কণার সতেজতার প্রমাণ দেয়ার মতোই।

বড় ভাইয়ের হাতে একটি নতুন ঘড়ি দেখে পছন্দ হয়েছিলো অনিন্দ্যর। অনিন্দ্য সে কথা ভাইকে জানিয়েছিলো মায়ের মুখ দিয়ে। কথাও দিয়েছিল ভাই। কিন্তু হঠাৎ তাস খেলতে গিয়ে ঘড়িটা বন্ধক রাখে ভাইয়া। অনিন্দ্য বন্ধুদের কাছ থেকে পাঁচশ’ টাকা ধার করে ঘড়িটা ছাড়িয়ে ভাইয়ের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল। মনে মনে ভাবছিল বড় ভাই ঘড়িটা না নিয়ে হয়তো অনিন্দ্যকেই দেবে। দেয়নি। কিছুদিন পরে ঘড়িটা পেয়েছিল অনিন্দ্যর ভাবীর বড় ভাই। তারপর অনিন্দ্য সে ঘড়ির দিকে ফিরেও তাকায়নি একবারও।

অনিন্দ্যর এখন বেশ কয়েকটা ঘড়ি। দামী-কম দামী সবই আছে। তবে ভাইয়ের হাতের ওই ঘড়িটির মতো দামী মনে হয় না সেগুলোকে কখনও!

সারাটা দিন যেভাবেই কাটুক, রাতে ঘুমানোর একটা জায়গা খুব দরকার প্রতিটি প্রাণীরই। মানুষের জন্য নিরাপত্তা একটু জটিল। তারপরও শহরের নদী ভাঙা মানুষ জীর্ণ বস্তি এবং ফুটপাতে ঘুমায়। পাকা দালানে বাস করেও অনিন্দ্যর ঘুমানোর জায়গা ছিলো না। তবে তিন দিক খোলা বারান্দায় পাতলা একটি তোষক আর একটি বালিশ ছিলো অনিন্দ্যর। রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় থাকতে হতো অনিন্দ্যকে। চারদিকের বাতিগুলো নিবে গেলে অনিন্দ্য বিছানা পাততো খোলা বারান্দায়। গরমের দিনগুলোতে খোলা জায়গায় খারাপ কাটতো না তার। তারপরও মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য পাতলা কাঁথা মুড়ি দিয়ে রাতটা পার করতে হতো তাকে। শীতের দিনগুলোতে হাত-পা ঠান্ডার হয়ে আসতে অনিন্দ্যর। সকালের সূর্যের অপেক্ষায় থাকতো সে।

বর্ষা অনিন্দ্যর খুব পছন্দের। তবে গ্রাম ছাড়ার পর শহরের বর্ষা অনিন্দ্যকে কষ্ট দিয়েছে খুব। রাতে বৃষ্টি শুরু হলে বিছানাপত্তর গুছিয়ে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে বসে থাকতো হতো অনিন্দ্যকে। মাঝে মাঝে বাড়িওয়ালার বৃদ্ধ কুকুরটিকে কাছে পেতো অনিন্দ্য। কুকুরটি কাছে পেলে ভয় কেটে যেতো ওর।

বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার মা এলেন মেয়ের বাসায় বেড়াতে। শীতের মধ্যে খোলা বারান্দায় অনিন্দ্যকে পড়তে দেখে মা কষ্ট পেলেন। বললেন, ‘এবার বাড়িতে চল বাবা। বাসার পাশেই তো কলেজ আছে।’ অনিন্দ্য উত্তর দিলো না। একদিন রাত দশটার দিকে অনিন্দ্য বারান্দায় বসে পড়ছিল। হঠাৎ অনিন্দ্যর ভগ্নিপতির নির্দেশ এলো বারান্দার লাইট না নেভালে জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়! অনিন্দ্য বাধ্য হয় লাইট বন্ধ করতে। অনিন্দ্যর মা বুঝতে পারলেন তার ছেলের কষ্টের কথা। নীরবে চোখ মুছলেন। অনিন্দ্যর দৃষ্টি এড়ালো না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দ্যর কষ্টের বোঝা ভারি হতে লাগলো। পালাতে মন চাইলো। পালিয়ে গেলো সে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর অনিন্দ্যর হল জীবনে বেশ কয়েকজন বন্ধু জুটে গেলো। এনায়েত, কবির, আমজাদ, ফেরদৌসী আর শিরিনদের সঙ্গে আড্ডা জমতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, টিএসসি’র কড়িডোরে। ফেরদৌসী প্রায়ই রবি ঠাকুরের ‘কেটেছে এলেকা বিরহেরই বেলা’ গানটি গাইতো উদ্যানে বসে। সেই ফেরদৌসীকে কবির নীরবে ভালোসতো। একদিন কবির জানতে পারে আনন্দমোহন কলেজের এ্যাথলেটিকসে চ্যাম্পিয়ন ফেরদৌসীর বিয়ে হয়ে গেছে আগেই। কষ্টে দেশ ছেড়ে পালালো কবির।

অনিন্দ্যর মন ছটফট করতো বাড়িতে আসার জন্য। গ্রামের বাড়িতে শাম্মীর সঙ্গে অনিন্দ্যর অপ্রকাশিত একটি সম্পর্কে ছিলো। অনিন্দ্য কখনো সে কথা বলেনি শাম্মীকে। চিঠি দিয়েছিলো গোটা দুই। উত্তর পায়নি কিছু। তারপর থেকে শাম্মীর সঙ্গে দেখা হলেই কেমন চোখে যেন তাকাতো অনিন্দ্যর দিকে। অনিন্দ্যর বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠতো। চিঠির কথাগুলো গুছিয়ে বলতে মন ব্যাকুল হতো। পারতো না। মনের কথা বলতে না পারার কষ্টে নীল হতো অনিন্দ্য।

সেই শাম্মীরও হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেলো একদিন! বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটির অবসরে বাড়িতে গেলে অনিন্দ্যকে খবরটি দিলো ছোটবোন নীলা। ওর ধমনীতে তখন রক্তের শীতল স্রোত বয়ে গেলো। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মুখে অনিন্দ্য তাকালো সূর্যের দিকে। মেঘলা আকাশে সূর্যকে খুঁজে পেলো না অনিন্দ্য। তারপর ত্রিশ বছর ধরে আরও একবার শাম্মীর সঙ্গেও দেখা হওয়ার প্রতীক্ষায় আছে অনিন্দ্য। কষ্টের দিনগুলো এখন আর কিছুতেই পিছু ছাড়ে না ওর। অনিন্দ্য কষ্টের বাগানে প্রজাপতিগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে এখন।



২৯ অক্টোবর, ২০১১

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:২০

অশান্ত শান্ত ছেলে বলেছেন: তারপর ত্রিশ বছর ধরে আরও একবার শাম্মীর সঙ্গেও দেখা হওয়ার প্রতীক্ষায় আছে। ভালো লাগলো

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৮:০১

নাসির আহমেদ কাবুল বলেছেন: আজও প্রতীক্ষায় থাকে অনিন্দ্য। ধন্যবাদ। শুভ সকাল।

২| ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:৪১

মাহবুবুর শাহরিয়ার বলেছেন: অত্যন্ত ভালো লাগলো৷

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৮:০৩

নাসির আহমেদ কাবুল বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের মন্তব্য একজন লেখকের জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা। শুভ সকাল।

৩| ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৫৪

শহিদুল ইসলাম বলেছেন: অন্যরকম লেখা ।। দারুন লাগল...

৪| ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৮:০৪

নাসির আহমেদ কাবুল বলেছেন: ধন্যবাদ। কবি, শুভ সকাল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.