নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার প্রিয় কিছু পাপের কাছে আমি বন্দি হয়ে আছি

নাভিদ কায়সার রায়ান

তৃতীয় ধরণের পাগল হল সেয়ানা পাগল। এটা সবচেয়ে কঠিন ধরণের পাগলামি। এই পাগল কি সুস্থ না অসুস্থ সেটা বোঝা খুব কঠিন। যখন সে পাগলামি করছে তখন তার কাজকারবার হবে সুস্থ মানুষের মতো। জটিল সব যুক্তি দিয়ে সে তার পাগলামি প্রতিষ্ঠিত করবে। আবার যখন সে সুস্থ থাকবে তখন তার চিন্তা ভাবনা হবে পাগলের মতো। অফিসে এবং বাসায় নিয়মিত ভাবে আমি এই পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে ভালোই লাগে। শুধু মাঝে মধ্যে আমার মাথার মধ্যে জ্যোৎস্না ঢুকে পড়ে। তখন খুব অস্থির লাগে। কেন লাগে জানি না। আপনারা কেউ কি জানেন?

নাভিদ কায়সার রায়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

"বস" এর সাথে তিন পাগলের শবে বরাত

২১ শে জুন, ২০১৩ রাত ১১:০৯

গাজীপুর থেকে S.S.C. পরীক্ষা যেবার দিলাম, সেই বছর সবে বরাতে কঠিন মজা করেছিলাম। সদস্য ছিলাম আমি, রনি, রবিন ভাই আর তারিন। প্রায় দেড়টা দুইটা পর্যন্ত বাইরে ছিলাম। মসজিদের তবারুক নিয়ে সারারাত দক্ষিন ছায়াবীথি হাঁটতে হাঁটতে খেলাম। কিছু জিলাপি ছোঁড়াছুড়িও হল। লক্ষ্যবস্তু, লিপি আর সুচীদের বাসা। সারা রাত হাউমাউ আর চিল্লাচিল্লি করে শেষ রাতে বাসায় ফিরেছিলাম।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ। রেজাল্টও হয়ে গেছে। বুয়েটে পরীক্ষা দিয়ে পাখির মত উড়ে বেড়াচ্ছি। কারন পরীক্ষা দেয়ার আগেই বুঝে গিয়েছিলাম বুয়েট আমাকে দিয়ে হবে না। তার জন্য সাধনা লাগে। ধৈর্য লাগে। আর লাগে মেধা। এর কোনটাই আমার মধ্যে নাই। সমস্যা হল, আমার যে বুয়েটে পড়া হচ্ছে না এই নির্মম সত্যতা শুধু আমি জানি। অথচ, বাসায় সবাই খুব আগ্রহ করে অপেক্ষা করছে কবে রেজাল্ট দেবে। বাসায় বাসায় মিষ্টি বিলানো হবে। সন্তানের সাফল্যে আম্মার গর্বিত হাসি মুখ দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। হল না।

প্রথম সন্তান ছেলে হবার পর থেকেই নাকি আম্মার খুব শখ ছেলে বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমার বাকি সব খালাত, মামাত, চাচাত ভাই, এমন কি বোনেরা পর্যন্ত দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিস্থানে পড়ালেখা শেষ করে এখন দেশে বিদেশে চাকরি করছে। ব্যবসা বাণিজ্যেও অনেকের রমরমা অবস্থা। সেখানে আমি যে কি হতে যাচ্ছি তার কোন ঠিক ঠিকানা পাচ্ছি না। সারাক্ষণই মনে হয় পায়ের নিচে মাটি নেই। শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। খুব যে খারাপ লাগছে তা না। শুধু মনের মধ্যে যে একটা দশমনি বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেটাই মাঝে মাঝে খুব পীড়া দিচ্ছিল।

আমি তখন ঢাকায়, খালার বাসায়। আব্বা-আম্মা গাজীপুরে থাকেন। বাসায় ভাল লাগছিল না। আব্বা-আম্মার দিকে তাকালে বারবার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল বলে ঢাকায় পালিয়ে এলাম। নটরডেম কলেজে এখানে থেকেই পড়ালেখা করেছি। ঢাকায় কাজ আছে বলে সপ্তাহ খানেকের জন্য হিজরত করতে এলাম।

দুপুরে বিছানায় শুয়ে আগডুম বাকডুম ভাবছিলাম, এমন সময় রনি ফোন দিল,

-“তোর কি আজকে রাতে কোন কাজ আছে?”

-“আমার আবার কি কাজ?”

-“তাহলে বিকেলে উত্তরা চলে আয়।“

-“উত্তরা? কেন?”

-“রবিনের বাসায় আয়। কাজ আছে।“

-“কি কাজ?”

-“এত কথা বলিস কেন? আসতে বলেছি, আসবি। মোবাইলে টাকা নাই। রাখলাম।“ - মোবাইলটা কানে ধরা অবস্থাতেই লাইন কেটে গেল। টুট টুট শব্দ করে ফোনটা একসময় নিরব হয়ে গেল। আমি শুয়ে শুয়ে আরো কিছুক্ষণ ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ফ্যানের পাখা গোনার চেষ্টা করলাম। নাহ! জমছে না। রবিন ভাইকে একবার ফোন করে দেখি।

-“হ্যালো!হ্যাঁ, রবিন ভাই। ঘটনা কি? রনি বলল উত্তরা আসতে। কিছু হবে টবে নাকি?”

রবিন ভাইয়ের গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল, “আজকে তো সবে বরাত। রাতে বস এর সাথে দেখা করার জন্য কাটাসুর যাব। রনির কাছে শুনলাম, তুমি নাকি ঢাকায়। তাই রনিকে বলেছিলাম তোমাকে জানানোর জন্য। আসবা নাকি?”

আমি দ্বিধায় পরে গেলাম। রবিন ভাই অতি বিপদজনক চরিত্র। কখন কি করবে ঠিক নাই, মতি গতি বোঝা বড় কষ্ট। শেষবার আমাকে আর রনিকে নিয়ে উত্তরা থেকে গুলশান পর্যন্ত মোটর রেস খেলেছিলেন। ঢাকার রাস্তায় যে এত স্পিডে গাড়ি চালানো যায়, এর আগে আমি জানতাম না। গাড়িতে ওঠার আগপর্যন্ত ভুলেও বুঝতে পারিনি জীবনে কি একটা অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে। গাড়িতে ওঠার পর আমার হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলছিলেন, রায়ান, একটু গুলশান যাব।ভয় পাবা না তো?

গুলশান যাব, এতে ভয় পাবার কি আছে?

ও, তাই নাকি? বলে তার ভূবন ভুলান হাসি দিলেন। বান্দার চেহারাও বানিয়েছেন আল্লাহ্‌। সাক্ষাৎ টম ক্রুজ।

পরবর্তী ঘটনা আমি মনে করতে চাই না। চার-পাঁচ টা গাড়ি সাঁই সাঁই করে উড়ে চলল। একবার এ আগে যায় তো আরেকবার সে আগে যায়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বনানী মোড়ে রবিন ভাইয়ের গাড়ি তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে সবার সামনে এগিয়ে গেল। রাস্তায় গাড়ির টায়ার স্কীড করে বিকট আওয়াজ করে সবাইকে চমকে দিল। একটা মিনিবাস তো আমাদের প্রায় খেয়েই দিয়েছিল। কারো দোয়ায় সে যাত্রা বেঁচে গেছি।

এই “বস” আবার কবে আবিস্কার হল কে জানে। কিছুই তো জানতে পারলাম না। কয়দিন আগে শুনেছিলাম দেশের বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শুনে একটু দুঃখ পেয়েছিলাম। বন্ধু বান্ধব সব দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু কি আর করা। যেতে তো হবেই। “দাঁড়াবার সময় তো নাই”।

খানিক্ষন ভেবে বললাম, “আসি তাহলে। এমনিতেও কিছু ভাল্লাগছিল না।“

-“হ্যাঁ, চলে আস। রনি আমার বাসাতেই আছে। আজকে কিন্তু সারারাত বাইরে থাকতে হবে। বাসায় বলে এসো।“

আমি থমকালাম, “সারারাত কি কাজ?”

-“বললাম না। বসের ওখানে যাচ্ছি। গেলেই দেখতে পাবে। সারারাত অনেক মজা হবে। চলে আস।“

মনের ভেতর যে যেন আমাকে সাবধান করে দিল – খবর্দার! ভুলেও আজকে ওদের সাথে যাবি না। গেলেই বিপদে পড়বি।

কিন্তু আমি না করতে পারলাম না। বিপদ আছে জেনেও নিম রাজী হয়ে বললাম, “ঠিক আছে, আসছি।“

রবিন ভাই ফোন রেখে দিল।

আমি ভাবতে বসলাম, কি করা যায়। যেতেও ইচ্ছা করছে আবার এও বুঝতে পারছি রবিন ভাইয়ের মতলব ভাল না। নির্ঘাত কোন ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি। কিন্তু কথা হল ঝামেলাটা কোন ধরনের। আর এই বস টাই বা কে? কোন স্মাগলার টাগলার না তো? হতেই পারে। দেখা গেল বসের সাথে দেখা করতে গিয়েছি, এদিকে পুলিশের রেইড পড়েছে। বসের সাথে আমাকেও হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে গেল। সবে বরাত কাটল আমার জেলে। পরদিন পেপারে বসের সাথে আমার ছবি ছাপা হল। শিরোনাম, “কাটাসুরে কিশোর মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার” আল্লাহু! মাফ কর খোদা!

শেষ পর্যন্ত উত্তরা রওনা দিলাম। বাসায় বোরিং লাগছে। গিয়ে দেখি কি হয়!

এই ফাঁকে রনি আর রবিন ভাইয়ের পরিচয় দিয়ে নেই।

দুজনেই আমার বাল্যকালের পরম বন্ধু। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া রবিন ভাই এখন থাকেন অস্ট্রেলিয়াতে। অত্যন্ত সুদর্শন এবং স্মার্ট এই মানুষকে দেখে মুহূর্তেই যে কারো ভাল লেগে যাবে। অসংখ্য মেয়ের সাথে প্রেম করে অবশেষে বিয়ে করেছেন। ফুটফুটে দুটা পরীও আছে তার।

একসময় কি না করেছেন। সাধারনত দেখা যায়, ক্লাসের ভাল ছাত্রগুল আমার মতই ম্যান্দা মার্কা হয়। কিন্তু আমার এই বন্ধু পড়ালেখায় যেমন মেধাবী, বদমায়েসীতেও তেমনি নাম্বার ওয়ান। বন্ধু মহলে এখনও তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা, এক নামে সবার কাছে পরিচিত। আমার জানা মতে এমন কোন নিষিদ্ধ কাজ নেই যেটা রবিন ভাই একবার চেখে দেখেননি। কিন্তু কোথাও আটকা পড়ে যাননি। সব মধুর মজা নিয়ে সহি সালামত ঠিকই বের হয়ে আসতে পেরেছেন বলেই জীবনে এখন তিনি সফল।

আমার সাথে যোগাযোগ এখন প্রায় নেই বললেই চলে। ফেসবুকের ছবি টবি দেখে ভালই আছেন সেটা আন্দাজ করতে পারি।

রনি।

রনি সম্পর্কে কি বলব। রনি নিজেই একটা ইতিহাস। আমার কোন ভাই নাই। না থাকার দুঃখও নাই। ভাই বানানোর সুযোগ থাকলে রনিকে আমার আপন ভাই বানিয়ে নিতাম। জমজ না। আপন বড় ভাই। রাজউক কলেজে ভর্তি হয়ে রবিন ভাই উত্তরা চলে যাবার পর একটা সময় ছিল যখন আমি আর রনি একজন আরেকজনের ছায়া হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয় বন্ধুত্বের একটা সীমানা আছে। মাঝে মাঝে সেই সীমানা পার হয়ে যায়। বন্ধু আর বন্ধু থাকে না। একজন আরেক জনের ছায়া হয়ে যায়। ছায়া হয়ে একজন আরেক জনের জীবনটাকে ঘিরে রাখে।

আব্বার ছিল বদলির চাকরি। সেসুবাদে দু-তিন বছর পরপর আমার স্কুল পাল্টে যেত। নতুন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করতে হত। ছোট বেলায় যে স্কুলেই গিয়েছি, সবখানেই পোংটা ছেলেদের একটা গ্রুপ পেয়েছি। স্কুলের প্রথম দিনেই কিভাবে যেন এরা টের পেয়ে যেত যে একে নিয়ে খেলা করা যায়। প্রতিবাদ করে লাভ হত না। অত্যাচারের মাত্রা তাতে আরও বাড়ত। গাজীপুরে গিয়েও একই অবস্থা হল। এরা আমাকে বিরক্ত করে মারল। অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল যে আমার আর স্কুলে যেতে ইচ্ছা করত না। রনিকে তখন ভাল করে চিনতাম না। কিন্তু ও যে এই গ্রুপেরই র্যা ঙ্কধারী সদস্য সেটা সেটা জানতাম।

একদিন যথারীতি বিচ্ছু বাহিনী আমাকে কলম-পেন্সিল দিয়ে খুচিয়ে, নানা ভাবে বিনোদিত হচ্ছে। হঠাৎ রনি গম্ভীর স্বরে বলল, ওরে আর বিরক্ত করিস না।

“বিরক্ত করিস না? মানে কি?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সবাই রনির দিকে তাকিয়ে দেখল রনি চোয়াল শক্ত করে বসে আছে।

ব্যাস! আমার জীবনে শান্তি নেমে এল। ওরা এরপর আর কখনো আমাকে বিরক্ত করেনি। দেখতে দেখতে সবার সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে গেল। রনি হয়ে গেল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

সে অনেক আগের কথা!

উত্তরা পৌছাতে বিকাল হয়ে গেল। রবিন ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেখি রনি কম্পিউটারে কি একটা গেম খেলার চেষ্টা করছে। এসির বাতাসে ঘর হিম শীতল। ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার। স্টেরিয়োতে হাই ভলিয়ুমে গান বাজছে। গানের কথা কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শুধু দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। চমৎকার পরিবেশ। আমাকে বসতে বলে রবিন ভাই বাইরে গেল কি যেন আনতে।

রনির পাশে বসার পর খেয়াল করলাম ওর এককানে দুল। দুদিন আগেও তো ছিল না!

-“কিরে, মেয়েদের মত দুল কেন তোর কানে? কান ফুটা করলি কবে?”

-“এইসব তুই বুঝবি না। আপাতত ইমিটেসনের দুল পরেছি বলে দেখতে হয়ত ভাল লাগছে না। একটা হোয়াইট গোল্ডের দুল অর্ডার দিয়েছি। সেটা পড়লে বুঝবি, ভাব কারে বলে।“

রনির দৃষ্টি কম্পিউটার স্ক্রিনে। মুখে ভাবের হাসি।

-“দুলের মধ্যে আবার ভাব কিসের? দুলতো পড়ে মেয়েরা।“

-“বললাম তো এইসব তুই বুঝবি না।“

-“বললেই বুঝব।“

-“না বুঝবি না।“

বুঝলাম, এই বিষয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ নাই। যথাসময়ে রনিই সব কিছু জানাবে।

একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মাথাটা একদম হালকা লাগছে। রুমের ভেতর ধোঁয়ার একটা মেঘ তৈরি হয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ দৃশ্যটা উপভোগ করলাম। ভালইতো! গানটা একদম মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। অনেক আওয়াজ তার পরও মনে হচ্ছে, ভলিয়ুমটা আর একটু বাড়িয়ে দিলে ভাল লাগত।

আহ, কি জীবন! এত আরাম-আয়েসে থাকলে ছাওয়াল-পাওয়াল তো একটু বিগড়াবেই! সে তুলনায় রবিন ভাই অনেক ভাল। স্বার্থপর না, বন্ধু বান্ধবের খেয়াল রাখে। বড়োলোক বলে দেমাগও নাই।

সিগারেটটা এমন লাগছে কেন? কটু গন্ধ! খাওয়ার পর চোখের পাতা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠছে! ঘুম ঘুম ও পাচ্ছে।

-কিরে রনি, এটা কি সিগারেট? এমন লাগে কেন?

-কি???কোন প্যাকেট থেকে নিয়েছিস?

-তোর হাতের পাশে, টেবিলের ওপর থেকে।

রনি প্যাকেট খুলে দেখে একটু হাসল।

-খাওয়া শেষ?

-হ্যাঁ

-ভাল লাগছে?

-হ্যাঁ। ঘুম পাচ্ছে।

-তাহলে শুয়ে থাক। ভাল লাগবে। যাবার সময় ডেকে দিব। শুয়ে থাক।

-ঠিক আছে। বলে পাশ ফিরে খেয়াল হল কোথায় যাব জিজ্ঞস করিনি।

-এই শালা, কোথায় যাবো রে আজকে? “বস”টা কে?

রনির দৃষ্টি এখনও কম্পিউটার স্ক্রিনে। এবারও হেসে জবাব দিল,

-“বস” হল নূর, নূর!

-নূর?

-হ্যাঁ!

-কিসের নূর? স্মাগলার টাগলার নাতো? ঠিক করে বল। আমি কিন্তু নাহলে যাব না।

রনি হি হি করে শয়তানি হাসি হাসে।

-এসে যখন পড়েছিস, যেতে তো হবেই! ভয়ের কিছু নাই। আমি আছি।

আমরা কাটাসুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম সন্ধ্যা নামার আগে। যেতে যেতে “বস” এর কাহিনী শুনলাম।

রবিন ভাইয়ের আবিস্কার এই বস নাকি খুবই উচ্চ শ্রেণীর পীর। সাধারণ মানুষ এখনও উনার খবর জানেন না। এই পীরের কিছু যুক্তি নির্ভর মতবাদ আছে। কি সেটা?

Step 01 : নবী করিম (সাঃ) নূরের তৈরি। (আমি জানতাম না। এখনও জানি না।)

Step 02 : আল্লাহ্‌ তা’লা নূরের তৈরি।

Step 03 : আমরা যদি আল্লাহকে সেজদা করতে পারি, তাহলে নবী করিম (সাঃ) কেও সেজদা করা যায়।

কথা বার্তা শুনে তখন আমার মাথা ঘুরছে। আরও কাকে কাকে যেন সেজদা করার কথা বলছিলেন, সব কথা আমার মাথায় ঢুকেনি। আমি জানতাম রবিন ভাইয়ের মতলব ভাল না। তাই বলে সবে বরাতের রাতে আমার ধর্ম নিয়ে টান দিবে? ভুলটা আমারই হয়েছে।

আমার হতভম্ব চেহারা দেখে রবিন ভাই বললেন, “ব্যাপার না, রায়ান। প্রথমে আমার ও মানতে একটু কষ্ট হয়েছিল। But ঠিক হয়ে যাবে।”



Boss



কাটাসুরে এক গলির ভেতর সেই পীরের দোতলা বাসা। সেখানে পোঁছে দেখি আমাদের মত আরও অনেক ছাগল পাগল সেখানে উপস্থিত। কাউকেই ঠিক স্বাভাবিক মনে হল না। আমাকে আর রনিকে বাইরে রেখে রবিন ভাই বসের বাসায় ঢুকে গেলেন। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়ি খেতে লাগলাম। সবাই দূর থেকে আড় চোখে আমাদের কিছুক্ষণ দেখল। তারপর ওরাও একজন একজন করে আমাদের দেখা দেখি সিগারেট ধরাতে লাগল। তবে আমাদের মত দেখিয়ে দেখিয়ে না। আড়াল করে।

আমি তখন শতভাগ নিশ্চিত এখানে অস্ত্র কেনা বেচা হয়। কারন বান্ধবী সংক্রান্ত এক ঝামেলায় রবিন ভাই গুন্ডাদের কাছ থেকে থ্রেট খেয়েছিলেন। সেদিন আমি ও সাথে ছিলাম। ছয় নাম্বার সেক্টরে একটা নতুন আইস ক্রিম পারলার খুলেছে। চমৎকার ব্যবস্থা। বাইরে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে আইস ক্রিম খাওয়া যায়। তবে আইস ক্রিম খাওয়াটা আমাদের মূল উদ্দেশ্য না। উত্তরার হুর পরীরাও এখানে আইস ক্রিম খেতে আসে। এই হুর পরীদের যে রানী, যার নাম কিনা সোনিয়া। সেই সোনিয়াকে এক নজর দেখার জন্য আমরা প্রায় প্রতিদিনই এখানে আসছি। মধু থাকলে মাছি তো আসবেই।

কিন্তু সমস্যা হল আমাদের দেখা দেখি একদিন কিং কং সাইজের এক মাছি এসে উপস্থিত। গাড়ি থেকে নেমে সোজা আমাদের দিকে এসে সংক্ষেপে বলল, এদিকে যেন আর না দেখি।

রবিন ভাই এসব দেখে অভ্যস্ত। হুমকি শুনে মুখটা একটু গম্ভীর হল শুধু। আমি হা করে দেখলাম, কিং কং নির্দ্বিধায় পকেটে করে একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বাইরে আধ ঘণ্টার মত দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি আর রনি একসময় মহা বিরক্ত হয়ে গেলাম।

রনি ফোন করে জিজ্ঞেস করল , কিরে আর কতক্ষণ?

রবিন ভাই বলল, ভিতরে চলে আয়।

আমরা অধৈর্য হয়ে গৃহে অন্তরিন হলাম।

বস এর বাসা বাইরে যেমন সাদামাটা ভেতর টাও আড়ম্বরহীন। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখলাম মেঝে জুড়ে ভারী কার্পেট। স্যান্ডেল বাইরে রেখে আসতে হল। ঘরে ঢুকেই আরামদায়ক মিষ্টি একটা সুগন্ধ টের পেলাম। গন্ধটা পরিচিত কিছুর সাথে মিল পেলাম না। অনেক বড় বাসা। সারা বাসাই সম্ভবত এসি করা। তবে এসি চলছে রুম টেম্পারেচারে। ড্রইয়িং রুমে ঢুকে দেখি ৪-৫ জন বিভিন্ন বয়সের লোকজন সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। রবিন ভাই বয়স্ক এক লোকের সাথে কথা বলছে। আমাদের দেখে চোখের ইশারায় বসতে বললেন। আমি আর রনি এক কর্নারে সোফায় বসে পড়লাম। “বস” বলে কাউকে আলাদা করতে পারলাম না।

সেন্টার টেবিলে চানাচুর,বিস্কুট আর কমলা দেয়া ছিল। বিকেলে কিছু খাওয়া হয় নাই। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সবাই দেখলাম ভদ্রতা করে কিছুই খাচ্ছে না। আমার এত ভদ্রতার সময় নাই। প্রথমেই চানাচুরের প্লেট কোলে নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। রনি শুরুতে লজ্জা পাচ্ছিল। পরে দেখি রনির হাতেও তিন-চারটা বিস্কুট ধরা। আমি রনির দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ভালতো, ভালো না?

চানাচুর খেতে খেতেই পীর বাবা এসে হাজির হলেন।

আমি উনাকে দেখে চমৎকৃত হলাম। দাঁড়ি-গোঁফ নেই, একেবারে ক্লীন শেভড। (পীর, কিন্তু গালে দাঁড়ি নাই কেন প্রশ্ন টা মাথায় তখন এসেছিল। পরে ভাবলাম ইনি হয়ত মডার্ন হুজুর। এঁর বোধহয় দাঁড়ি রাখার প্রয়োজন পরে না।) গায়ের রঙ ফর্শা, উচ্চতা মাঝারী। কাল রঙের মখমলের পাঞ্জাবী পরনে, সাথে সাদা পায়জামা। মাথায় কালো টুপি। চেহারা ঠিক নূরানি বলব না, তবে আকর্ষণীয়। চলাফেরা, কথাবার্তা খুব ধীর স্থির।

আমাকে আর রনিকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল। রনি দেখলাম হ্যান্ডসেক করল। আমিও দেখা দেখি হাত বাড়িয়ে ধরলাম হ্যান্ডসেক করার জন্য।

আমার হাত ধরে মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, “ আপ কি তারিফ? ভাল আছেন?”

আমি আমতা আমরা করে বললাম, “জী, আমি রায়ান।”

ভদ্রলোক আমার হাত ধরেই রাখলেন। অলৌকিক আর রহস্যময় একটা ব্যাপার ঘটল তখন। অদ্ভুত একটা অনুভুতি আমার সারা শরীর-মন অবশ করে ফেলল। হাত ধরার পর থেকেই সারা শরীর কেমন যেন ঝিন ঝিন করছে। কোথায় আছি, কেন আছি, কোথায় যাব – এই প্রশ্ন গুল হঠাৎ অর্থহীন লাগল। এতক্ষণ খুব অস্থির লাগছিল। আমার অস্থিরতা কমে এল। নিজেকে ভয়ংকর নিঃসঙ্গ আর অসহায় লাগল। যেন পৃথিবীতে আমার আপন বলে কেউ নেই। অনেক কষ্ট আমার। একমাত্র সামনে দাঁড়ানো এই লোকটাই আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

আমি সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালাম। গভীর কালো তীক্ষ্ণ চোখ আমার অন্তর ভেদ করে চলে গেল। আমি আত্মসমর্পণ করলাম।

“মাশাআল্লাহ। সুন্দর নাম। আপনি কি জানেন আপনার নামের অর্থ কি?”

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। একহাতে আমার ডান হাতটা ধরে, অন্য হাতে আমার হাতের তালুতে কি যেন লিখলেন। শরীরে সেই রহস্যময় ঝিন ঝিনে অনুভুতি আমাকে প্রায় অবশ করে ফেলছে।

“না। আমি জানি না।”

“تواق (দাও’আখ) অর্থাৎ তৃষ্ণার্ত।” চোখ বন্ধ করে বললেন “আর আপনি রাইয়ান। তৃষ্ণা নিবারন করে যিনি পরিতৃপ্ত।”

দীর্ঘ অক্ষি পল্লবে ঘেরা অসম্ভব সুন্দর চোখ খুলে বললেন, “সন্তুষ্ট। Satisfied. মাশা-আল্লাহ।”

আমি কি বলব বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকলাম।সবাই কোথায় যাবার জন্য যেন তাড়াহুড়া করছিল। আমাকে সাথে আসতে বলে উনি বেরিয়ে গেলেন।

বাইরে বেরিয়ে দেখি হুলুস্থুল কান্ড। দুইটা মিনি বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাস ভর্তি মানুষ। এরা সবাই “বস” এর মুরিদ।

রবিন ভাইকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, আমরা এঁদের সাথে করে আজকে সারারাত মাজারে মাজারে ঘুরব। রবিন ভাই যদি থাকে, আমি তো আর চলে যেতে পারি না। আমাকেও থাকতে হল। সেইরাতে তাদের সাথে মিরপুর মাজার, হাইকোর্ট মাজার হয়ে আজিমপুরে কার যেন একটা কবর জিয়ারত করে উত্তরা ফিরলাম সকাল সাতটায়। দারুণ মজায় কেটেছে ওই রাতটা। সবে বরাতের রাতে ঢাকায় যে এতো পাগল ঘোরাঘুরি করে সেইদিন জানতে পেরেছিলাম। প্রত্যেকটা মাজার মানুষ আর ফকিরে ভর্তি। মিরপুরে এক নাম্বার গোল চক্কর থেকে মিরপুর মাজার পর্যন্ত হেঁটে যেতে হল। কারন রাস্তা দখল করে বসে আছে না হলেও কয়েক লক্ষ ফকির। এরপর রবিন ভাইদের বাসায় দুপুর দুইটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে, বিকেলে আমি আর রনি গান গাইতে গাইতে গাজীপুরে চলে এলাম।











মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.