![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তৃতীয় ধরণের পাগল হল সেয়ানা পাগল। এটা সবচেয়ে কঠিন ধরণের পাগলামি। এই পাগল কি সুস্থ না অসুস্থ সেটা বোঝা খুব কঠিন। যখন সে পাগলামি করছে তখন তার কাজকারবার হবে সুস্থ মানুষের মতো। জটিল সব যুক্তি দিয়ে সে তার পাগলামি প্রতিষ্ঠিত করবে। আবার যখন সে সুস্থ থাকবে তখন তার চিন্তা ভাবনা হবে পাগলের মতো। অফিসে এবং বাসায় নিয়মিত ভাবে আমি এই পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে ভালোই লাগে। শুধু মাঝে মধ্যে আমার মাথার মধ্যে জ্যোৎস্না ঢুকে পড়ে। তখন খুব অস্থির লাগে। কেন লাগে জানি না। আপনারা কেউ কি জানেন?
আগের পর্ব Click This Link
(৬) বিদায় হেড কোয়ার্টার
সিভিল ডিপার্টমেন্টের পেছনে যে জাম গাছটা আছে তার নিচে দাঁড়িয়ে আমি একটা সিগারেট খাচ্ছিলাম। দুপুরে আজকাল নর্থ এক্সটেনশনে খাচ্ছি। এখানে খাওয়ার মান বেশ ভালো। খাওয়া দাওয়া শেষে একটা সিগারেট আয়েস করে খেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দোস্তদের জ্বালায় কখনই সেটা হয়ে ওঠে না। একটা সিগারেট জ্বললেই চার পাশ থেকে, সিগারেটে ফার্স্ট বুক, সেকেন্ড বুক, থার্ড বুক... চলতেই থাকে। এমনও হয়েছে, কেউ ম্যাচ জ্বালিয়েছে, সিগারেট তখনো ধরায়নি। এদিকে টেনথ বুকে হয়ে গেছে। জুয়েল খেপে গিয়ে এঁদের নাম দিয়েছে “মাছি”।
আমরাও তার নাম দিয়েছি সম্রাট। মাঝে মাঝে সম্রাটের মুড খুব ভালো থাকে। সম্রাট তখন একটা আগুন শলাকা হাতে নিয়ে ডাক দেয়, “ অ্যাই মাছিরা কে কে আছিস, বিড়ি খাবি, বিড়ি?”
টুপ করে মাথার উপর একটা জাম খসে পড়ল। উপরে চেয়ে দেখলাম গাছটা জামে জামে ছেয়ে গেছে। রাজর্ষি বা সমীর কেউ সম্ভবত এখনও জামের খবর পায়নি। ওরা জানবে আর গাছ অক্ষত থাকবে এরকম এখনও ঘটে নাই। ওদের জ্বালায় টিচার্স কোয়ার্টারে গাছগুলোও তাদের ইজ্জত বাঁচাতে পারেনি।
টিভি রুমের একরাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল। টিভি রুমে 54 নাম্বার রুমটায় আমরা একসাথে ১৬ জন গাদাগাদি করে থাকতাম। সবাই সিভিল ডিপার্টমেন্টের। এতজন একসাথে থাকার জন্য আমরা এই রুমটাকে “হেড কোয়ার্টার অব সিভিল ডিপার্টমেন্ট” নাম দিয়েছিলাম। সিভিলের কোন ছাত্র পড়ালেখা বিষয়ে কোন ঝামেলায় পড়লে তাকে এখানে আসতেই হতো।
হেডকোয়ার্টারে আমাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে। সম্ভবত আজকেই এলটমেন্ট দিয়ে দেবে। আবার নতুন জায়গা, নতুন কোন অভিযান শুরু হবে।
সেদিন বিকেলে রাজর্ষি সারা ক্যাম্পাস সার্ভে করে খবর দিল, ভিসির বাংলোর ভেতরে যে কাঁঠাল গাছটা আছে সেটাতে বেশ বড় সড় কয়টা কাঁঠাল দেখা যাচ্ছে। আজ রাতে অপারেশন। শুরুতে অভিযানের নাম “অপারেশন কাঁঠাল” ঠিক হলেও পরে তীব্র প্রতিবাদের মুখে “অপারেশন ভিসির বাংলো” ঠিক হয়। অভিযানে লিড দেবে রাজর্ষি, সমীর সেকেন্ড কমান্ড। আর ভলান্টিয়ার হিসেবে 02 ব্যাচের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের বেছে নেয়া হল। পূর্ব অভিজ্ঞতার জোরে আমি, ফুয়াদ আর কাবু সহজেই দলে ভিড়ে গেলাম। সেতু থাকল দুধভাত হিসেবে। আর গাজীপুরের ছেলে সম্রাট জুয়েল থাকল চোরাই মালের কোয়ালিটি কন্ট্রোল আর ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্টে। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।
রাত দশটার মধ্য ক্যাম্পাস একদম ঠাণ্ডা মেরে যায়। জেগে থাকলেও বাইরে কাউকে খুব বেশী একটা দেখা যায় না। সব দেখে শুনে রাত সাড়ে এগারোটায় আমরা রওনা দিলাম। গোল চত্তর থেকে যে সোজা রাস্তাটা টিচার্স কোয়ার্টারের গিয়ে পৌঁছেছে ভিসি স্যারের বাংলোটা ঠিক তার মাঝামাঝি। মূল রাস্তাটা থেকে একটু ভেতরে। রাস্তাটা বাদে স্যারের বাড়ির চার পাশটা অনেক নিচু। অনেকটা পরিখার মত করে কাটা। সেখানে সারা বছরই ধান চাষ হয়।
রাস্তা দিয়ে গেলে চোখে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। আমরা তাই পেছন দিয়ে ঢাল দিয়ে নেমে পরিখা পার হলাম। আবার ঢাল বেয়ে প্রায় দশ বারো ফুট উঠলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি স্যারের বাসার চারপাশে কাটাতারের বেড়া দেয়া। রাজর্ষি অতি সন্তর্পণে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তার পড়ে গেল সমীর, ফুয়াদ আর কাবু। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে চার পাশে চোখ রাখলাম।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম ঝুপ করে একটা কাঁঠাল পড়ল। তারপর ঝুপ ঝাপ আরো কয়েকটা। কিন্তু সব গিয়ে পড়ল বেড়ার ভেতরে। আমি সেতুকে বললাম, “তুই বাইরেই থাক। আমি ভেতরে গিয়ে কাঁঠালগুলো টেনে বেড়ার কাছে নিয়ে আসি। তুই বেড়ার ফাঁক দিয়ে বের করে জুয়েলের কাছে দিয়ে দিবি।”
সেতু মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে সে বুঝতে পেরেছে। আমি বেড়াটার ফাঁক দিয়ে সাবধানে শরীর গলিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। সেদিন সম্ভবত পূর্ণিমা ছিল। আবছা আলোতে দেখলাম, ভেতরটা একেবারে জঙ্গল। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে কাঁঠালগুলো খুঁজে বের করলাম। বাকি গেছোরা ততোক্ষণে গাছ থেকে নেমে গেছে। ওরা বলল, গাছে আর পাকা কাঁঠাল নেই। চার পাঁচটা যা ছিল সব ওরা পেড়ে ফেলেছে।
পাঁচ জনে পাঁচটা কাঁঠাল নিয়ে যখন আমরা বেড়ার কাছাকাছি ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন একটা বাঘা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে আমাদের দিকে ধেয়ে এলো। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। কুকুরের ডাক শুনে আমরা দিকবিদিক খেই হারিয়ে ফেললাম। এলোপাতারি ছোটাছুটি করে দুই একজন গাছে উঠল। আর বাকিরা কোন রকমে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে। কেউ অবশ্য কাঁঠাল হাতছাড়া করে নি। আমরা যারা বাইরে আসতে পেরেছি তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেড়ার উপর দিয়ে কাঁঠাল ওপাশে পাঠিয়ে তারপর বর্ডার পার করেছি।
বাইরে আসার পর বেড়ার ভেতরে দেখে তো আমরা অবাক হয়ে গেলাম। আরে, এতো ভোলা! আমাদের চেনা কুকুর! হারামজাদা প্রতিদিন আমাদের কাছ থেকে ফাউ খেয়েও এরকম বেইমানি করল? অবশ্য ভোলার আর কি দোষ। ও তো চোর দেখে ছুটে এসেছিল। দিনের আলোতে যারা এতো দান-খয়রাত করে, রাতের আঁধারে যে তারা সিঁধেল চোরে পরিণত হবে ভোলা বোধহয় সেটা কল্পনাও করতে পারেনি।
ত্যু ত্যু করে ডাকতেই ভোলা আমাদের ডাকে সাড়া দেয়। লেজ নাড়তে নাড়তে কাছে আসে। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাকিদের গাছ থেকে নেমে আসতে বলি।
ওরা বাইরে আসার পর কাঁঠাল গুনে দেখি। একটা কাঁঠাল মিসিং। যাক, ব্যাপার না। কোলাটেরাল ড্যামেজ।
কিন্তু সেতু কই? ওরে না বাইরে অপেক্ষা করতে বললাম?
অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না প্রায়। ধরা পড়ার ভয়ে টর্চ ও জ্বালাতে পারছি না। ডাকাডাকির পরে খাদের নিচ থেকে সেতুর কণ্ঠ ভেসে আসে। ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এসে দেখি সেতুর কাদায় পা গেঁথে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরের ভয়ে নাকি ও ঢালের উপর থেকেই চোখ বন্ধ করে লাফ দিয়ে ছিল। পড়েছে একেবারে কাদার মধ্যে। নিচে পড়ার পর ওরপাশেই একটা কাঁঠালটা এসে পড়ে। সেতু হাতে আমাদের সেই মিসিং কাঁঠাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেটা বেড়ার উপর দিয়ে ওপার পাঠিয়েছিলাম সম্ভবত সেটাই। সেতুর সাথে জুয়েলও আছে।
জুয়েল নাক কুঁচকে বলল, “কিরে গুয়ের গন্ধ আসে কই থেকে?”
ছি ছি এর মধ্যে আবার “গু” আসল কিভাবে? কিন্তু গন্ধ তো সত্যি সত্যিই পাওয়া যাচ্ছে। নাহ আর পারা গেল না।
নিরুপায় হয়ে টর্চ জ্বালাতে হলে। টর্চের আলোতে দেখি সেতু যে কাঁঠালটা ধরে আছে, সেটাতেই গু লেগে আছে। আমি ঢিল দেয়ার পর ওটা ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়েছে একেবারে গুয়ের ওপর। কাঁঠাল থেকে কিছুটা গু সেতুর হাতেও লেগেছে।
আমরা ছ্যা ছ্যা করতে করতে সেতুকে কাঁঠাল সহ রেখে এসেছিলাম সেদিন। হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
সিগারেটটা ফেলে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
বড় ভাইদের হাতে লাঞ্ছিত হবার পর আমাদের এই স্পিরিটটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে। সবাই মজা করি কিন্তু সেখানে প্রানের বড় অভাব।
দেখতে দেখতে আমাদেরও একবছর কেটে গেছে । শুনলাম সেকেন্ড ইয়ারের সবাইকে নাকি নর্থ এক্সটেনশনে পাঠিয়ে দেবে। দিক। দরকার নাই মেইন হলে যাওয়ার। বড়রা থাকুক বড়দের মত। আমরা থাকি আমাদের মত। যারা সিনিয়রদের চামচামি করতে চায় তারা মূল হলে থাকুক। আরো চামচামি করুক। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
(নর্থ এক্সটেনশনঃ মূল হলে যাদের থাকার জায়গা হয় না, স্যারেরা তাদের জন্য কিছু টিনের ঘর তুলেছেন মূল হলের কাছাকাছি। সাধারনত ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের জায়গা হয় এখানে। ক্যাম্পাসে আমাদের তিনটা হল ছিল। নর্থ হল (শহীদ তারেক হুদা হল), সাউথ হল (শহীদ মোহাম্মদ শাহ হল), আর কিউ.কে. হল। সবকয়টারই এক্সটেনশন আছে। তার মধ্যে নর্থ এক্সটেনশনটা সিভিল ডিপার্টমেন্টের পাশে আর মূল তিনটা হল থেকে বেশ দূরে। কিন্তু মূল হলের মত এখানেও ডায়নিং আছে। কাজেই খাওয়া দাওায়ার জন্যও আমাদের বাইরে যেতে হচ্ছে না। আমাদের সবারই খুব আগ্রহ এখানে আসার।)
(৭)
নতুন জীবন
অমাবশ্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেঘহীন আকাশে ঝিকমিক করছে হাজার হাজার অগুনিত তারা। খোলা ছাদে শুয়ে আকাশের দিকে তাকালে খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় রহস্যময় রাজকুমারী অ্যান্ড্রোমিডাকে। নয় লক্ষ আলোক বর্ষ দুর থেকে হাতছানি দিয়ে মানবজাতিকে ডাকছে সে। প্রতিনিয়ত। কে জানে কোন সর্বনাশ করার জন্য!
নর্থ এক্সটেনশনের বাইরে খালি গায়ে যে কয়জন তরুনকে ছোটাছুটি করতে দেখা যাচ্ছে, অ্যান্ড্রোমিডাকে তারা চেনে না। তাদের হাতে এতো সময় নেই। অনেক কাজ তাদের। অ্যান্ড্রোমিডার অধিবাসীরা যদি তাদের দেখতে পেয়ে থাকে তাহলে তারা হয়ত এতক্ষণে খাতা কলম নিয়ে বসে গেছে গবেষণা করার জন্য। মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু কাজ করে এই ছেলেগুলো। এসব রহস্যময় কাজের মাধ্যমে কি বোঝাতে চায় এরা? অনুসন্ধানীদের পাঠানো প্রতিবেদন দেখে স্বর্গের কাছাকাছি বসা প্রধান পুরোহিতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। কি করছে এরা?
আমাদেরও একই প্রশ্ন। এরা করছেটা কি? প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে “এরা কারা” সেটা জেনে নিতে হবে।
দীর্ঘ একবছর এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার পর 2002 শিক্ষাবর্ষের ৬০ জন ছাত্রের আবাস হয়ে ওঠে নর্থ এক্সটেনশন। মূল হলে জুনিয়র সিনিয়র মিলে থাকতে হয়। সব সময় বন্ধুরা মিলে যা খুশী তাই করা যায় না। অনেক আদব কায়দা আছে। অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। নাহলে বেয়াদবির কেসে ঝামেলায় পড়ে যাবার সম্ভাবনাও আছে।
মূল হলগুলো থেকে অনেক দূরে থাকায় নর্থ এক্সটেনশনবাসীর এসব আদব কায়দা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই। এখানে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। কারো কিচ্ছু বলার নেই। শাসন করার কেউ নেই। এযেন রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের ট্রেজার আইল্যান্ড।
যাই হোক, আগে দেখে আসি এরা কি করছে।
আজকাল খুব লোড শেডিং হচ্ছে। রাতে প্রায়ই বিদ্যুৎ থাকে না ঘন্টার পর ঘন্টা। তখন শীতের শুরু। কারেন্ট চলে গেলে গত কয়দিন ধরে এরা রুম ছেড়ে পঙ্গপালের মত বেড়িয়ে আসছে। নর্থ এক্সটেনশনের সামনে একফালি ফাঁকা মাঠ আছে। মাঠের ওপারে অডিটোরিয়াম। ডান পাশে সিভিল বিল্ডিং। রুম থেকে বেড়িয়ে কেউ কেউ এক্সটেনশনের কমন টয়লেটের সামনে বারান্দায় ধোঁয়া খায়। কেউ কেউ অডিটোরিয়ামের সিঁড়িতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গ্যাঁজায়। কেউ কেউ মাঠে বসে বাতাস খায়। স্বাধীন জীবন।
গত কয়দিন ধরে এরা নতুন খেলা পেয়েছে। ছুটোছুটি করে গাছের ডালপালা একজায়গায় জড়ো করে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। এক্সটেনশনের দোতালায় যে বারান্দা আছে সেখানে সবাই তাদের জামা কাপড় ধোয়ার পর রোদে শুকাতে দেয়। মাঝে মাঝে শুকনো কাপড় বাতাসে উড়িয়ে নিচে নিয়ে ফেলে। খেয়াল করতে না পারলে বদমাইশের দল সেগুলোও জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কাবুর একটা শার্ট, আমার একটা পাঞ্জাবী সহ অনেকের পুরনো জামা কাপড় অলরেডি পুড়ে গেছে।
আগুন জ্বালানো হয়ে গেলে বিশাল আগুনের কুণ্ডলী ঘিরে তার পর শুরু হয় উদ্দাম নৃত্য আর অর্থহীন সঙ্গীত। খালি গায়ে নাচতে নাচতে একসময় ক্লান্ত হয়ে গেলে একজন আরেক জনের কাঁধে হাত দিয়ে গভীর রাতে মৌচাকে ফিরে আসে।
আনন্দ। এঁদের এসব অর্থহীন কাজের একটাই উদ্দেশ্য - নিজেকে আনন্দ দেয়া, দুঃখগুলোকে ভুলে থাকা। মা-বাবা, ঘরবাড়ি ছেড়ে এঁদের অনেকেই প্রথম বারের মত উঠোনের বাইরে পা দিয়েছে। প্রথম বারের মত তাদের পরিচয় হয়েছে বাস্তবতার সাথে। বাস্তবতার কঠিন মূর্তি দেখে অনেকেই ঘাবড়ে গেছে। কিন্তু পেছনে ফেরার আর কোন রাস্তা নেই। অনেকটা ডু অর ডাই সিচুয়েশনের মত “Have fun or die”।
নর্থ এক্সটেনশনের আমরা আমাদের হল লাইফের সেরা সময়টা কাটিয়েছিলাম। আনন্দ দেবার লোকের এখানে কোন অভাব ছিল না। কিভাবে যেন সারা বাংলাদেশ থেকে ফিল্টার করে পাগলগুলোকে এখানে জড়ো করা হয়েছে। আলাদাভাবে অন্যান্য এক্সটেনশনেও মজা হতো কিন্তু ডিফারেন্ট কিছু পেতে চাইলে এখানে আসতেই হবে।
যেমন শ্যাম। এক্সটেনশনে শ্যামের রুম ছিল একতলায়, অজুখানার পাশে। রুমমেট ছিল সম্ভবত মিনহাজ। মিনহাজ রুমমেট হিসেবে বেশ ভালো। সবসময়ই ওর কাছে খাওয়ার জন্য কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই। তাছাড়া দুই রুমমেটই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে শুধু মিনহাজের মাথায় ক্যেমিকেল ইম্ব্যালান্স হয়ে যায়। তখন আর ওকে চেনা যায় না, এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে আজব সব কাজ কারবার করতে থাকে। এছাড়া আর কোন সমস্যা নেই।
একদিন সকালে, এক্সটেনশনের বাইরের দেয়ালে মিনহাজ হাতে লেখা একটা পোস্টার ঝুলিয়ে দিল। পোস্টারে একদম উপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা --
“সর্পরাজ ঘন শ্যাম এর আশ্চর্য কেরামতি”
সুখবর! সুখবর!! সুখবর!!!
জয় বাবা শ্যাম নাথ গতকাল দিবাগত রাত্রিতে এই পাহাড়ি জঙ্গলের রহস্যময় এবং পরম আরাধ্য নাগরানীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন। নাগরানী শ্যামের রুপে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাহার সাথে রাত্রি যাপনের ইচ্ছা পোষণ করিয়াছিলেন। কিন্তু নাগরানীর প্রতাপে ভীত এবং কম্পিত শ্যামনাথ ছিলেন অত্যান্ত নিরুপায়, কিছুক্ষণ আগেই তিনি ভারমুক্ত হয়েছেন। কিছু করিতে না পারিয়া শ্যামনাথ যখন ক্রন্দন করিতে উদ্যোগ নিতেছিলেন তখনই নাগরানি দয়াপরবশ হইয়া তাহাকে এক আশ্চর্য বরদান করিলেন। তাহার দিব্যচক্ষু খুলিয়া গেল। তিনি সর্প বিদ্যা প্রাপ্ত হইলেন।
বর্তমানে সর্পরাজ ঘন শ্যাম মানবকুলের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এখানে আপনাদের যেকোনো জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক, পারিবারিক এবং সামাজিক, প্রেমে ব্যর্থতা সহ যাবতীয় গোপন রোগের গ্যারান্টি সহকারে এখানে সমাধান দেয়া হয়।
পোস্টার দেখে হাসির হুল্লোড় বয়ে গেল। সবাই একবার করে শ্যাম কে দেখে যেতে লাগল। শ্যামও কম যায় না। রুমে আগরবাতি জ্বালিয়ে রীতিমত সর্পরাজের আস্তানা খুসে বসল। ঘটনা হল, আগের দিন রাতে শ্যামের রুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে বিশাল এক গোখরা সাপ চলে এসেছিল। ভয়ে কেউ সে সাপ মারতে পারেনি। ঝামেলা দেখে সাপই লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।
শ্যামের রঙ্গতামাশা বেশিদিন টিকলো না। সমীরের পিসি তে সারা রাত সিরিয়াল দিয়ে ভোরে NFS underground কিংবা Far cry খেলা একসময় আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল। বিকেল বেলা ক্রিকেট খেলা শেষে ঝাঁক বেঁধে নাস্তা করতে যাওয়া, দুপুরে ক্লাস না করে ঘুমানো কিংবা তাস পিটানো আর পড়ালেখার পাশাপাশি আড্ডা বাজি তো চলছেই। —এসব করে করে যখন আমরা চরম বোরড তখনই ক্যাম্পাসে ক্ষমতা দখলের এক লড়াই শুরু হয়। আমরাও উত্তেজনায় নড়ে চড়ে বসলাম।
আমাদের কাউকে কখনো একা একা ঘুরতে দেখা যেত না।। সবাই ৭-৮ থেকে ১২-১৫ জনের গ্রুপে ভাগ হয়ে দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াত। বিকেলে নাস্তা শেষে আমরা গোলচত্তরে কিংবা ক্যান্টিনের সামনে বিশাল আড্ডা জমাতাম। সন্ধ্যার পর সবাই এক্সটেনশনে ফিরে আসতাম। মূল ক্যাম্পাস থেকে আমরা ছিলাম টোটালি ডিটাচড। ওখানে কি চলছে সেটা নিয়া আমাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না।
সেদিন সন্ধ্যা হওয়ার পর মেইন হল থেকে আমাদের ইয়ারের একটা ছেলে (খুব সম্ভবত তানজিম) নর্থ এক্সটেনশনে এসে নেতাজীকে (অন্তু) একটা খবর দিয়ে গেল – “আজকে রাতে “কিছু একটা” হতে পারে। আমরা যেন রেডি থাকি। ডাক দিলে যেন সবাই ঝাপিয়ে পড়ি।“
গত কয়েকদিন ধরে নাকি সারা ক্যাম্পাসে টান টান উত্তেজনা। যদিও সেই রাতের আগে আমরা এর কিছুই জানতাম না। খবর শুনে নেতাজী ডাইনিং রুমে মিটিং ডাকলেন। একে একে আমরা সবাই সেখানে জড়ো হলাম। একশ ওয়াটের টিম টিমে আলো জ্বলছে। সবগুলো টেবিল জোড়া দিয়ে লম্বা সারি বানানো হয়েছে। দুপাশে বসার জন্য চেয়ারও পাতা আছে। কেউ কেউ জায়গা পেয়ে চেয়ারে বসল বাকিরা দাঁড়িয়েই রইল। নেতাজী টেবিলের একপ্রান্তে আসন নিয়েছেন। কৌতুহলি জনতার দৃষ্টি নেতাজীর উপর নিবদ্ধ। জনতা জানতে চায় ঘটনা কি? তাদের মাঝে কৌতূহলের সাথে কিছুটা কৌতুক মিশ্রিত উত্তেজনাও কাজ করছে। ঘটনার বিস্তারিত বিবরন সংক্ষিপ্ত আকারে আমরা সেখানেই জানতে পারলাম-
সেশন জটের কারনে ’৯৯ আর ২০০০ ব্যাচের ছাত্ররা একই সেমিস্টারে ক্লাস করত। আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস শুরু করি ’৯৯ ব্যাচের সাইফুল ভাই তখন ছাত্রদলের প্রেসিডেন্ট। প্রভাবশালী এই নেতাকে সমর্থন দিচ্ছিল স্থানীয় কিছু লোকজন আর ক্যাম্পাসের কিছু সহপাঠীরা। লম্বা চওড়া, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আর ভীম কালো সাইফুল ভাইকে দেখলেই মনে কেমন যেন একটা সমীহ জেগে উঠে। লিডার লিডার মনে হয়। ছাত্রলীগ কে হঠিয়ে তিনি যেদিন ছাত্রদলকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন, সেদিন নাকি তিনি একাই সাউথ হলের ছাদে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমনই তার শান।
অন্যদিকে ছিলেন ২০০০ ব্যাচের ভাইয়ারা। এই ব্যাচের ছাত্রদের নিজেদের মধ্যে দারুণ একটা সংহতি ছিল। এরা পুরো ব্যাচের ছাত্ররা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে হবে। সাথী হিসেবে আমাদের ব্যাচের কিছু ছাত্রকে তারা পাশে পেয়েছে। তারা আবার আমাদের কাছে এসেছে হেল্প চাইতে।
“এখন তোরা ঠিক কর, কি করবি।” সংক্ষেপে ইতিহাস বলে আমাদের মন্তব্য জানতে চাইল অন্তু।
রাজর্ষি এগিয়ে গিয়ে বলল, “ওদের বলে দে, আমরা এইসবের মধ্যে নাই।”
সবাই “হ্যাঁ-বাচক” গুঞ্জন করে সমর্থন জানালো।
নেতাজী হাত তুলে সবাইকে থামালেন, “দ্যাখ, ক্যাম্পাসে থাকতে হলে তোকে কারো না কারো সাইড নিতে হবে। এইসবের মধ্যে নাই বললে তো হবে না।”
অন্তুর কথা শুনে আবারো গুঞ্জন ওঠে।
মিনহাজ এবার বলে ওঠে, “আপনি কি তাহলে বলতে চাচ্ছেন যে আমরা ওখানে গিয়ে মারামারি করি?”
প্রশ্ন শুনে সবাই চুপ। উত্তরের অপেক্ষা।
“মারামারি করবি ক্যান? সাথে থাকবি।”
“মারামারির মধ্যে “মারামারি” না করে “সাথে” কিভাবে থাকে আমি ঠিক বুঝলাম না।”
মিনহাজের কথার মধ্যে এমন কিছু ছিল যেটাতে সবাই হে হে করে হেসে ওঠে। নেতাজী অশ্রাব্য ভাষায় একটা গালি দিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলল।
“দ্যাখ। ফাইজলামীর সময় এইটা না। তোদের কাছে কি মনে হয়, তানজীম যে এখানে এসেছিল সেটা সাইফুল ভাইরা জানে না? তানজীম এখানে আসা মানে আমরা তাদের বিপক্ষে। আজকে যদি সাইফুল ভাইরা ’০০ (জিরো জিরো) দের মেরে বের করে দ্যায় তাহলে তোরা কি ভাবছিস ওরা তোদের কে ছেড়ে দেবে?”
আরে সর্বনাশ! এটা তো কেউ ভেবে দেখিনি। আবার শুরু হল বিড়বিড়ানি। হারামজাদা তানজিম তো আমাদের মারাত্মক ঝামেলায় ফেলে দিয়ে গেছে! সবাই মিলে তানজিমের মুন্ডুপাত করলাম। কিন্তু তাতে তো সমস্যার সমাধান হল না। জনতার মাঝে আবার প্রশ্ন, “তাহলে উপায়?”
কেউ কেউ বলল আমরা আমাদের মত হলে থেকে যাই। কারো সাথে না থাকলেই হল। আমরা তো কারো আগেও নাই, পিছেও নাই। শুধু শুধু ঝামেলায় জড়িয়ে কি লাভ?
অন্তু পাল্টা যুক্তি দেখাল, “ সিনিয়ররা তোদের হেল্প চেয়েছে। ’০০ যদি জিতে যায় তাহলে তো ওরাও তো আমাদের ছাড়বে না। কারন বিপদের সময় তোরা তাদের সাথে ছিলি না। আর এ রকম অবস্থায় সাথে না থাকা মানেই বিপক্ষে থাকা।”
জনতার ধৈর্যের বাঁধ এবারে ভেঙ্গে যায়। সবাই উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি করতে থাকে। সজীব হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বলল।
অনেক তর্ক বিতর্কের পর ঠিক হল, আমরা হলে থাকব না। ক্যাম্পাসের বাইরে থাকাই এ সময়ে নিরাপদ। ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে একদল মেইন গেট দিয়ে বের হবে। আরেক দল ক্যাম্পাসের পেছন দিকে একটা গেট আছে, সেদিক দিয়ে বেরিয়ে, গৌরীশঙ্কর হয়ে পাহাড়তলি থেকে বাসে চেপে শহরে পালাবে।
সিদ্ধান্ত হয়ে যাবার পর দ্রুত সবাই গোছগাছ করে নিলাম। একে একে সবাইকে বিদায় করে দিয়ে আমি, অন্তু আর সজীব রাতের অন্ধকারে বাকি ১০-১২ জনকে নিয়ে গৌরীশঙ্করের পথ ধরলাম। যারা মেইন গেট দিয়ে বের হয়েছে তারা জানাল মারামারি অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। দূর থেকে নাকি ফাঁকা গুলির আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যেন আর দেরী না করে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে যাই।
সিভিল বিল্ডিঙের কাছাকাছি পৌঁছে আমরা চমকে উঠলাম।
ঘন অন্ধকারে চারপাশ ঠিক মত দেখা যাচ্ছে না। গহীন জঙ্গলে কোথা থেকে যেন একটা রাতজাগা পেঁচা ডেকে উঠে হুহু করে। পায়ের নিচ দিয়ে সরসর করে কি যেন একেবেকে চলে যায়। রীতিমতো ভৌতিক পরিবেশ। এর মধ্যে জুয়েল হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। হাতের ইশারা করে আমাদের যা দেখালো তাতে আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা স্রোত নেমে যায়। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় দেখলাম সিভিল বিল্ডিঙের সামনে চার-পাঁচ জন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজনকে “সাইফুল ভাই” বলে আইডেন্টিফাই করা গেল।
পিন পতন নিস্তব্ধতা। এখন?
পরবর্তী পর্বঃ
©somewhere in net ltd.